আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-৭,৮

0
1806

আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-৭,৮
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-৭

বিভোর অনেকক্ষণ ধরে রুহিকে খুঁজছে। হাতে তুলোর প্যাকেট। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কোথাও দেখতে না পেয়ে নিচতলায় নেমে এলো। কিন্তু কোথাও নেই। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ স্টোররুম থেকে একটা স্টিলের কিছু পড়ার শব্দ কানে এলো। বিভোর কি হয়েছে দেখার জন্য ওখানে গেলো। দরজাটা অল্প খোলা, মনে হচ্ছে যে ভেতরে আছে সে তাড়াহুড়োয় লক করতে ভুলে গিয়েছে। রুহিও হতে পারে ভেবে বিভোর দরজাটা ঠাস করে খুলে দিলো। আর অবাক হয়ে দেখলো একটা লোক রুহির সাথে ধস্তাধস্তি করছে। বিভোরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এগিয়ে গিয়ে ইশতিয়াকের পিঠ বরাবর ঘুসি মারতেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো ও। এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি বিভোর এসেছে। ইশতিয়াককে চিৎকার করতে শুনে রুহির হুঁশ এলো। ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিলো ও। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো।

বিভোর রেগে বোম হয়ে আছে। ইশতিয়াককে ফ্লোর থেকে তুলে কলারে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,

‘ তুই কোন সাহসে একটা মেয়ের সাথে এরকম করিস?’

ইশতিয়াক ভয়ে চুপসে গেলো। ওইসময় বড়মুখ করে রুহিকে বললেও এখন বুঝতে পারছে ও কতোটা বিপদে পড়ে গেছে। সবাই জানতে পারলে ওর অবস্থা খারাপ করে দেবে। ও জানে, রুহিকে সবাই কতোটা আগলে রাখে। প্ল্যানটা ফ্লপ হয়েছে বুঝতে পেরে ও বিভোরকে ধাক্কা মেরে পালাতে চাইলো। কিন্তু পেছন থেকে বিভোর ওকে ধরে গলা চেপে ধরলো। হিংস্র গলায় বলল,

‘ তুই যে চোখ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিস, সেই চোখ আমি তুলে নেব!’

উপায় না পেয়ে ইশতিয়াক হিংস্র স্বরে বলল,

‘ ছাড় আমাকে।’

‘ কখনোই না।’

বিভোরের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হলো ইশতিয়াকের। বিভোর ওর পেট বরাবর একটা ঘুসি দিয়ে দু’হাতে ঝাপটে ধরলো পেছন থেকে। ইশতিয়াক নিজেকে ছাড়াতে পারছিলো না, বিভোরের গায়ের শক্তির সাথে কখনোই পেরে উঠবেনা ও। বুঝতে পেরে একটু থেমে আবারও নিজেকে ছাড়াতে বলে উঠলো,

‘ আমাকে ছাড় বলছি, ভালো হবেনা কিন্তু।’

‘ এসব করার আগে মনে ছিলোনা? এখন কেন ছাড়তে বলছিস বাস্টার্ড!’

বিভোরের মুখে গালিগালাজ শুনে কেঁপে উঠলো রুহি। জোরে শব্দ করে কেঁদে দিলো। বিভোর পেছনে ফিরে ওকে দেখার চেষ্টা করতেই ইশতিয়াকের গলা থেকে ওর হাতটা আলগা হয়ে গেলো আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভোরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা খুলে পালিয়ে গেলো ইশতিয়াক।

ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে বিভোর হুমড়ি খেয়ে পড়লো রুহির উপর। আচমকা রুহি গ্রিলের সাথে বারি খেয়ে কঁকিয়ে উঠলো। বিভোর দ্রুত উঠে পড়লো। নিজেকে সামলিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,

‘ লাগেনি তো তোমার? বেশি লেগেছে? দাঁড়াও, আমাকে দেখতে দাও।’

রুহি ঝটকা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ দেখার দরকার নেই।’

বিভোর অবাক হয়ে বলল,

‘ মানে কী?’

‘ মানে কিছুনা।’

‘ লোকটা এরকম করার চেষ্টা করছিলো কেন তোমার সাথে?’

রাগে, দুঃখে রুহি বলল,

‘ আমি খারাপ মেয়ে তাই।’

‘ এরকম বলছো কেন?’

‘ আমার ইচ্ছা।’

বিভোর রাগী গলায় ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

‘ পালিয়ে গেলো আজকে। ওর কলিজা কেটে নিতাম যদি এখানে থাকতো।’

রুহি ওর কথার জবাব দিলোনা। কাঠ হয়ে বসে রইলো, কাঁদছে। কতবড় সর্বনাশ করতে আসছিলো ইশতিয়াক। বিভোর সময়মতো না এলে কাউকে মুখ দেখানোর উপায় থাকতো না। কিন্তু এসবের জন্য তো বিভোরও একপ্রকার দায়ী। বিয়ে করা বউয়ের প্রতি যার নূন্যতম রেস্পন্সিবিলিটি নেই। রুহি ওর হাত ঘসতে লাগলো, ওই নোংরা লোকটার ছোঁয়া মুছে ফেলতে চাইছে। এই দৃশ্য দেখে বিভোর একপ্রকার জোর করে স্টোররুম থেকে ওকে অন্য একটা রুমে নিয়ে এলো। কিন্তু রুহি উল্টো হেঁটে নিজের ঘরে চলে এলো। দরজা আটকে দিতে চাইলে বিভোর জোর করে ঢুকে পড়লো। রুহির এরকম ব্যবহারে ও প্রচন্ড রেগে গেলেও চুপচাপ রইলো। একটা মেয়ে তার উপর ওর বউ বলে কথা, ওকে ইগনোর করছে সেটা ভয়ংকর ব্যাপার।

রুহি চট করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। শাওয়ার ছেড়ে দিতে ভিজতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ রক্তবর্ণ আকার ধারণ করেছে। বিভোরের কথা মনে হতেই বুক থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। দীর্ঘক্ষণ ওয়াশরুমে থাকার পর বাইরে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো বিভোর।

‘ এক্সকিউজ মি রক্তজবা! কি করছো এতোক্ষণ ওয়াশরুমে? আন্সার মি!’

রুহি উত্তর না দেওয়ায় বিভোর চিন্তিতমুখে আবার ডাকলো। রুহি এবারও জবাব দিলোনা। বিভোর ভাবছে মেয়েটা না আবার এই অপমান না নিতে পেরে খারাপ কিছু একটা করে বসে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই ও ডেস্পারেট হয়ে গেলো। জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো দরজা। একেবারে ঘেমে-নেয়ে একাকার। কি বিদঘুটে পরিস্থিতি!

‘ এই, তুমি এতোক্ষণ কি করছো? বেরুও বলছি!’

সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার বলল,

‘ আমি কিন্তু এবার দরজা ভাঙতে বাধ্য হবো। শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো, হ্যালো মিস?’

ওয়াশরুমের ভেতর থেকে রুহি বিরক্ত হয়ে গেলো। লোকটা এতো আদিক্ষেতা দেখাচ্ছে কেন আজব! বউ হিসেবে তো মানেই না, এখন দেখ! যেন দরদ, ভালোবাসা উথলে পড়ছে। চুলে টাওয়ালটা ভালো করে প্যাঁচিয়ে দরজা খুললো রুহি। বিভোর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এতোক্ষণ ধরে ডাকছে জবাব নেই, এদিকে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। রুহি ওর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলো।

বিভোর ছুঁতো খুঁজতে লাগলো কীভাবে ওর সাথে কথা বলবে। রুহি ফিরেও তাকালো না। কিন্তু ঘরের ভেতর একটা পুরুষ মানুষ ওর সাথে কথা বলতে চাইছে এটা ওর জন্য অস্বস্তিকর। বিছানায় ও যেতে পারছেনা, কোনো কাজও নেই।

উপায়ন্তর না পেয়ে রুহি চুপচাপ নিজের ঘর গোছাতে লাগলো৷ সবকিছু পরিপাটি থাকা স্বত্ত্বেও আবার এসব করছে মূলত বিভোরের জন্য । লোকটা জানেনা, রুহি ওর উপর কতোটা রেগে আছে। কতখানি অভিমান করে আছে। যদি জানতো তাহলে বিভোর নামক ব্যক্তিটি কখনো ওর সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখার সাহস পেতোনা।

রাত প্রায় দুটোর কাছাকাছি। সব গোছানো কাজ আবার শেষ করে রুহি কাউচে বসে রইলো। এই এতোক্ষণ যাবৎ বিভোর ওর ঘরে বসে ওকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে যেটা ওর জন্য অস্বস্তিকর বিষয়।

‘ শুনো তোমার নাম যেন কী?’

বাহ! বিভোর ওর নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে? ভালোই তো। রুহি না চাইতেও বলল,

‘ রুহানি।’

‘ মনে পড়েছে, রুহি!’

‘ তোমার সাথে ওই লোকটার কি কোনো সম্পর্ক আছে?
আই মিন বয়ফ্রেন্ড হয় তোমার?’

রুহি কিছু বলল না৷ রাগ হচ্ছে প্রচন্ড।

‘ যদি ওটা তোমার বয়ফ্রেন্ড হয়ে থাকে তাহলে ইমিডিয়েট ওকে রিজেক্ট করো। চরিত্র ভালোনা।’

‘ ওটা আমার কেউ হয়না।’

‘ সেটাই ভালো।’

এরপর দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। রুহির নিঃশ্বাস ক্রমশই ভারী হয়ে উঠছিলো। কিভাবে জানাবে যে এই লোকটাকে সে মনেপ্রাণে স্বামী হিসেবে মানে। এতোবছর এই লোকটার জন্য শুধু অপেক্ষা করে এসেছে। ভালোবেসে ফেলেছে লোকটাকে। কিভাবে বললে বুঝবে বিভোর? এতদিন কোনো খোঁজখবর না নিয়ে হঠাৎ আজ এসে বলছে ওকে নাকি ডিভোর্স দেবে। রুহি তো এমনটা কখনো চায়নি। তাহলে কেন দেবে? ওর উল্টাপাল্টা জীবনটাকে সহজ না করে কেন এতো কঠিন করে তুলছে বিভোর। ভীষণ রাগে কেঁপে উঠলো রুহি৷ চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। মাথা নিচু করে বসে আছে। ইচ্ছে করছে বিভোরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে,

” আমার শুধু আপনাকে চাই৷ আমাকে ছাড়া কোথাও যাবেন না আপনি!”

কিন্তু চাইলেই তো সবকিছু বলা যায়না। কেমন আন ইজি ফিল করে রুহি৷ তার চেয়ে বড় কথা বিভোর ওকে ফিরিয়ে দিলে রুহি এবার মরেই যাবে। সামনে বসে থাকা লোকটাকে ও হারাতে চায়না। এতদিন দূরে ছিলো, কাছে পেয়ে হারানোটা কতোটা যন্ত্রণার সেটা রুহির চেয়ে ভালো আর কে জানবে!

বিভোর শুধু ওর কাগজের বউটিকে পরখ করে যাচ্ছিলো। মেয়েটির সাথে কতোটা বিশ্রি ঘটনা ঘটতে নিচ্ছিলো, ছিঃ! এমন হলে বিভোর নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতোনা। নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলো মেয়েটিকে। কিন্তু একজনের কাছে দায়িত্ব শিফট করে আর কোনো খোঁজ রাখেনি মেয়েটার। এই অপরাধবোধ কাজ করছে ওর মনে।

রুহির কপালের কাছে রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে গেলো। কিন্তু ও চুপচাপ ব্যথা সহ্য করে গুম হয়ে বসে আছে। টু শব্দটিও করছেনা। বিভোর এরকম দেখে তাড়াহুড়ো করে ফ্রিজ খুলে বরফ নিয়ে এলো। একটা আইস ব্যাগে সেগুলো রেখে রুহির কপালে ছোঁয়াতেই রুহি প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো৷ এসব আদিক্ষেতা দেখানোর মানেটা কী? কেন এরকম কেয়ার দেখাচ্ছে! ওর পিছু লেগে আছে কেন! সহ্য হচ্ছেনা ওর, রুহি একদম সহ্য করতে পারছেনা বিভোরকে।

যদি ওকে মেনে নিতো, স্ত্রী’র অধিকার দিতো তাহলে রুহি ওর এসব কেয়ারনেস মেনে নিতো। কিন্তু এখন, কোনোভাবেই না। নো নেভার!

রুহি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল,

‘ আপনার জন্য সব হচ্ছে। আপনি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন। আপনার এসব সো কল্ড কেয়ার আমাকে দেখাবেন না। আমার বিরক্ত লাগছে আপনাকে। আমি কখনো আপনাকে ক্ষমা করবো না।’

ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

বিভোর রুহির কথা শুনে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলো। মুখ দিয়ে কথা আসছে না। রুহি ওকে ঠেলে বের করে দিলো ঘর থেকে। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে সোফায় বসে পড়লো। মাথা ধরে আছে রুহির। কান্নাকাটি বন্ধ করে একটা মাথাব্যথার ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। বিভোরের মুখের উপর উচিৎ কথাটা বলতে পেরে ভেতরে ভেতরে একটা শান্তির ভাব আসছে। এতো দরদ দেখানোর কোনোই রাইট নেই ডাক্তারবাবুর! তোকে যে লোকটা ছেড়ে চলে যেতে চায় তাকে তুই পাত্তা দিবিনা। বুঝুক কেমন লাগে। জাস্ট ইগনোর রুহি, ইগনোর। এদিকে রুহির কান্ডকারখানা দেখে হতভম্ব হয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বিভোর। মেয়েটা ওকে বের করে দিলো? হাও? ওই পুচকি মেয়েটাকে ও নিজে শহরে নিয়ে এসেছে আর ওর ওপরই চিৎকার করছে? আজব তো। দরজায় টোকা দিতে গিয়েও থেমে গেলো। হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইচ্ছে করছেনা। মেয়েটার আচরণ ওকে ভাবাচ্ছে, বেশ ভাবাচ্ছে। নাসিমা চৌধুরীকে ফোন করলো বিভোর।

‘ হ্যালো আম্মু!’

‘ কে?’

‘ আমি বিভোর।’

‘ হ্যাঁ বল। তুই কোথায়? কোত্থেকে ফোন করছিস?’

‘ নিচ থেকে।’

‘ নিচে থেকে মানে? বাসায় চলে গিয়েছিস নাকি?’

‘ আরে না আম্মু। আমি নিচতলায় আছি।’

‘ ওহহ। কী করিস সেখানে?’

‘ আমার ঘুম পাচ্ছে, উপরে আর যাচ্ছিনা। তোমাকে জানাতে ফোন দিলাম!’

‘ কোনো প্রবলেম হচ্ছে নাকি?’

‘ নাহ। এমনিই। এনজয় করো তোমরা।’

‘ আচ্ছা।’

বিভোর ফোন রেখে দিলো। চোখগুলো জ্বালা করছে। রুহির নখেত আঁচড় ওর হাতে ঢুকে গিয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দাগগুলো। মেয়েটা কি সাইকো? আজব! হুট করে কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করলো ওর সাথে। বিভোর ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে কাপড় পাল্টে মোবাইল স্ক্রল করলো। ওখানে করার মতো কিছু না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলো। সারা ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো। হঠাৎ করে রুহির কথা মনে হতেই ভাবলো বিভোর কীভাবে ওর জীবন শেষ করে দিলো? ও তো রুহিকে সাহায্য করতে চাইছিলো। তাহলে ওকে কেন দোষী ভাবছে মেয়েটা? ভাবাভাবি বাদ দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। আজ একটার পর একটা কাহিনী ঘটছে। সবগুলোই ওর সাথে রিলেটেড। রুহির সাথে দেখা, ওকে সাহায্য করা আবার ওর কাছ থেকে ইগনোরও হজম করতে হয়েছে। যা বিভোর মানতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে মেয়েটার কানের নিচে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে।

সকালবেলা রুহির ঘুম ভাঙলো বেশ দেরিতে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই মনে পড়লো আজ ইভার বিয়ে। বাড়িতে অনেক কাজ আছে। বড়মাকে সাহায্য করতে হবে, একা মানুষ পারবে না। বিভোরের খালা হন নাদিরা ইসলাম। এক মেয়ে ইভা-ই তার সব। স্বামী গত হয়েছেন বছর দুই হতে চললো। এখন এই সংসারে যোগ হয়েছে রুহি। তিনজনের জীবন খুব ভালো করেই চলে যাচ্ছে। যাইহোক, রুহি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বাইরে গেলো। হাতের কাজগুলো শেষ করে ছাদের গাছগুলোতে পানি দেওয়ার উদ্দেশ্য চলে গেলো। গিয়েই ওর চোখ ছানাবড়া। ডাক্তারবাবু খালি গায়ে জিম করছে। লজ্জ্বা শরম খুইয়ে এসেছেন নাকি পথের ধারে! রুহির দিকে নজর পড়তেই বিভোর এগিয়ে এলো ওর দিকে কথা বলার উদ্দেশ্যে। হাসিমুখে বলল,

‘ গুড মর্ণিং রক্তজবা!’

রুহি উত্তর না দিয়ে গাছে পানি দিতে লাগলো। বিভোর মনে মনে বেজায় রেগেছে। দু-দিনের পুচকি ভাব দেখাচ্ছে ওকে।

‘ এই শুনো, আমার সঙ্গে একদম ইগো দেখাবে না।’

শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে নেমে এলো রুহি। বেশ শান্তি লাগছে ওকে ইগনোর করে। নিচে নামতেই নাদিরা এসে বলল,

‘ রুহি মা, দেখতো মিষ্টিগুলো কোথায়? তোর হাতে দিয়েছিলাম তো!’

‘ হ্যাঁ, আমি ডিপ ফ্রিজে রেখেছিলাম। নিয়ে আসছি।’

‘ তাড়াতাড়ি যা।’

নাসিমা চৌধুরী পাশ থেকে বলে ওঠলো,

‘ মেয়েটা খুব ভালো। কি সুন্দর সব কাজ করছে।’

‘ হুম, ওর মতো মেয়ে হয়না।’

বিভোরের কানে এই কথা ঢুকলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কার কথা বলছো?’

‘ রুহি।’

বিভোর চোখমুখে গম্ভীর ভাব ধরে রেখে বলল,

‘ এই মেয়েকে কোথায় পেলে তোমরা? রিলেটিভ হয় নাকি?’

নাদিরা ইসলাম বলল,

‘ নারে বাবা। ওর কাহিনী অন্যদিন শুনিস, আপাতত ওকে গিয়ে হেল্প কর।’

‘ কিসের হেল্প?’

‘ মিষ্টিগুলো ফ্রিজ থেকে আনতে গিয়েছে। একা ওইটুকু মেয়ে এতোগুলা বক্স আনতে পারবেনা। তুই গিয়ে হেল্প কর।’

বিভোর বিড়বিড় করে বলল,

‘ আমি যেন ওকে হেল্প করতেই দুনিয়ায় এসেছি।’

তারপর পা বাড়ালো। রুহি ফ্রিজ থেকে এক এক করে সবগুলো বক্স সাজিয়ে রাখলো। একসাথে সব নিতে পারবেনা, আলাদা নিতে সময় লাগবে। কাউকে ডেকে নিয়ে আসলে হতো। এমন সময় বিভোর আসলো। বলল,

‘ আমাকে দাও, নিয়ে যাচ্ছি।’

রুহি শক্ত গলায় বলল,

‘ লাগবেনা!’

‘ আরে দাও।’

‘ রুহির কারোর সাহায্য নিতে চাচ্ছেনা।’

‘ তাই নাকি? তোমার সব সাহায্য তো আমিই করে দিলাম, খালামণিও পাঠালো তোমাকে সাহায্য করতে। তোমাকে সাহায্য করার জন্যই বুঝি আমার জন্ম হয়েছিলো।’

‘ আপনার বকবক বন্ধ করুন। আর ইচ্ছে হলে নিয়ে যান এসব। দয়া করে যান!’

বিভোরের হাতে মিষ্টির বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে নিজেও নিয়ে এলো রুহি। ডাইনিংয়ে রেখে হাত ধুয়ে প্লেটে সাজিয়ে মেহমানদের দিলো। ইভা ডাকছে রুহিকে। পার্লারে যেতে হবে তাই। কিন্তু ও যেতে নারাজ। নাদিরা ইসলাম একপ্রকার জোর করে রুহিকে ইভার সাথে পাঠালো। বিভোর ওদেরকে পার্লারে ড্রপ করে দিয়ে এলো। দুজনের চোখাচোখি হলো, কিন্তু চোখের ভাষা কেউ পড়তে পারলো না। কি বিদঘুটে পরিস্থিতি।

রুহি তার ডাক্তারবাবুকে বর হিসেবে চায়। কিন্তু লোকটা বউ হিসেবে ওকে চায়না। ভালোবাসাকে না পাওয়ার মতো ভয়ংকর শাস্তি জগতে আর কি আছে? পার্লারের সাজগোজ বরাবরই ভারী এবং বিরক্তিকর। একগাদা মেকআপ লাগিয়ে, রঙচঙ মেখে সঙ সাজতে রুহির ভালো লাগেনা। গ্রামে থাকার সময় তো ভাবতো পার্লার বুঝি মেয়েদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক একটা জায়গা, স্বস্তির জায়গা। কিন্তু এর মতো অস্বস্তিকর আর কিছু আছে কিনা কে জানে? ইভাকে পুরাই অন্যরকম লাগছে। ব্রাইডাল মেকআপ, লাল শাড়ি, গহনা সব মিলিয়ে নিরুপমা টাইপ সুন্দরী। বউয়ের সাজ যেমন হয় তেমনই। কিন্তু রুহি নিজেকে দেখে চিনতেই পারলোনা।
সবুজ রঙের জামদানি শাড়িটাতে ওকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে ইভা অট্টহাসি দিয়ে বলল,

‘ মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি। বউয়ের থেকে তার বোনকে বেশি সুন্দর লাগছে।’

‘ যাহ। তুমি এসব কি বলো আপু!’

‘ ঠিকই বলছি। তোর একটা জামাই থাকলে রে আজ হার্ট অ্যাটাক করতো!’

‘ আপু তুমি চুপ করো তো।’

‘ লজ্জ্বা পাস কেন? আমার বিয়ে আমিই লজ্জ্বা পাইনা, আর ওনি দেখো মরে যাচ্ছে৷ আরে বাপু, এতো ঢং করার কোনোই দরকার নাই!’

‘ তোমার বিয়ে, তাই তোমার উচিৎ চুপ থাকা আর লজ্জ্বাবতী হয়ে বসে থাকা। তুমি কেন এতো কথা বলছো? দেখা যাচ্ছে বিয়ে অন্য কারোর আর বউ সাজছো তুমি!’

ইভা রুহির কথা শুনে হাসলো। বাড়ি ফেরার জন্য সবাই ফোন করছে, বর‍যাত্রী আসতে বেশিক্ষণ বাকি নেই। ইভা ডায়াল করলো বিভোরের নাম্বারে, ওরই নিতে আসার কথা। ফোন রিসিভ করে বিভোর জানালো ও বাইরে ওয়েট করছে। রুহি মনে মনে ভাবলো এতো ফার্স্ট, বাহ!

এদিকে গাড়িতে উঠার পরপরই রক্তজবার দিকে নজর গেলো ডাক্তারবাবুর। মাথা পুরোই হ্যাং হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়েটা ওর দিকে তাকাচ্ছেই না, কি ইগনোর! বিভোরের মনে হচ্ছে বউ সাজে ইভা’র চেয়ে এই রুহি বেশি সুন্দর। সাজলে কোনো মেয়েকে এতো সুন্দর দেখায় জানা নেই বিভোরের। হালকা সাজে, খোলা চুলে, সবুজ শাড়িতে অপ্সরা দেখালেও কি যেন নেই, নেই লাগছে। রুহির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা বিভোর। এই প্রথম মনে হচ্ছে রুহি যদি ওর সত্যিকারের বউ হতো তাহলে জড়িয়ে ধরে ফটাফট চুমু খেয়ে নিতো। কিন্তু মেয়েটা তো সত্যিই ওর বউ!

পেছনের সিটে বসে লুকিং গ্লাসে বারবার চোখ যাচ্ছে রুহির। মনে হচ্ছে ওই শয়তান বরটা ওকে দেখছে। কিন্তু একবারও ধরতে পারলোনা রুহি। জানালা খুলে বাইরে দৃষ্টি দিলো। এই ঢাকা শহর বড়ই বিরক্তিকর। ধুলোবালি,মানুষজন গিজগিজ করছে। রুহির এসব ভিড়ভাট্টা একদম পছন্দ নয়। পাশ থেকে ইভা বলল,

‘ রুহি আয় সেলফি নিই।’

রুহি হাসিমুখে পোজ দিলো। বেশ কয়েকটা সেলফি নেওয়ার পরে বিভোর গমগমে স্বরে বলল,

‘ গাড়ি কি সেলফি তোলার জায়গা? চুপ করে বস তোরা।’

‘ বকছিস কেন ভাইয়া? আমার আজ বিয়ে, যেখানে খুশি ছবি তুলতে পারবো।’

‘ বেহায়া বউ তুই। কোথায় লজ্জামুখ নিয়ে বসে থাকবি তা না। বকবক করে মাথা খাচ্ছিস। রাবিশ।’

‘ তুই রাবিশ, তোর বউও রাবিশ।’

বিভোর বিষম খেলো। আড়চোখে রুহির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও ইভার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বিভোর হেসে ফেললো।

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here