আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ১৪

0
437

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ১৪

মূল ফটক পেরিয়ে একের পর এক চমক দেখছে মায়া। সবচেয়ে বেশি চমকিত হয়েছে গৃহে প্রবেশের পর। ঘরের চারদিকে আভিজাত্য যেন ঠিকরে পড়ছে। মৃদু আলো বসার ঘরটায়। ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সে।
তার বুকের ভিতরটা এবার ধুকপুকুনির গতি বাড়িয়েছে। তার পা জোড়া যেন থেমে গেছে, আঁটকে গেছে, চলছে না তারা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে তার। কোথায় এলো সে। ফাহিমের কথা শুনে কখনোই মনে হয়নি এতটা আভিজাত্য আর স্বচ্ছন্দে সে বেড়ে উঠেছে। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ফাহিম আর তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটাতে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে ঝলসে যাওয়ার মত ঘামছে মায়া।
তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সে টলতে শুরু করেছে। ধ্যান ফিরল পুরুষালি মৃদু কন্ঠস্বরের নিরুত্তাপ ধ্বনিতে।

– বসো মা, আমার ছেলে আমাকে বলেছে সব। আমার একটা মেয়ে, আজ থেকে দুইটা মেয়ে হলো।

ফাহিমের বাবার বলা কথাগুলো শুনে মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার হলো মায়ার। দৌড়ে এসে ফাহিমের পায়ের কাছে বসে হাতজোড় করে বলল – আমায় যেতে দিন, আমি বাবার কাছে ফিরে যেতে চাই। এখান থেকে যেতে দিন।

মায়ার প্রতিটা কথার বান ফাহিমের বুকে থাকা ঐ ছোট্ট দ্রুত গতিতে চলা পিন্ডটার গতি শ্লথ করে দিয়েছে। তার মায়া তাকে অবিশ্বাস করছে! আচানক পরিস্থিতিটা সামাল দিতে ফাহিম নিজেকে ধাতস্থ করে মায়াকে দুবাহু ধরে উঠিয়ে দাঁড় করালো। ফাহিমের বোন আর বাবা পুরো ব্যাপারটা বুঝতে খানিক সময় নিয়ে দু’জনে হো হো করে হেসে উঠলো।
মায়ার ভয় এবার আরো বেড়ে গেছে। অসহায় চাহনি নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।

ফাহিম এবার কন্ঠটাকে নিচু করে বলল – আয়েশা, ওকে ঘরে নিয়ে যা। আর ওকে বলে দিস আমি বাঘ ভাল্লুক নই, অমানুষও নই। আমি ওর বর।
কথাটা বলেই গটগট করে এগিয়ে গেল।
ফাহিমের বাবা এবার মোলায়েম কন্ঠে বলল – তুমি কি কোন কারণে ভয় পাচ্ছ মা? ঐ ত্যাড়া ছেলেটা তোমাকে আমাদের কথা বলেনি?

মুখে কোন শব্দ আসছে না মায়ার। নির্বাক তাকিয়ে আছে সে। বেশকিছু সময় পর ও বলল – এখানে আর কেউ থাকে না?
আয়েশা হাসতে হাসতে বলল – অনেক মানুষ থাকে ভাবী, আমার চাচা, কাজিন। অনেকে থাকে পাশের ঐ বাড়ি তিনটেতে আমাদের সবাই থাকে। বিশাল ফ্যামিলি আমাদের। এই বাড়িটা শুধু আলাদা কারণ ভাইয়ের পছন্দে বানানো হয়েছে। আমাদের মূল বাড়িটা পাশে, সময় ধরে ঘুরিয়ে আনব তোমায়।

মায়া এগিয়ে এসে শ্বশুরকে বলল – সরি আংকেল, একটু ভয় পেয়ে গেছি। মাফ করে দিন না।
মাহতাব খান হাসতে হাসতে বললেন – তাহলে বাবা ডাকতে হবে।
মায়া মাথা নিচু করে বলল – আচ্ছা বলব।
মাহতাব খান মেয়েকে ইশারা দিলেন মায়াকে ঘরে দিয়ে আসতে।

আয়েশা বাবার কথামত মায়াকে নিয়ে এগিয়ে গেল। সিঁড়ির কাছে এসে মায়া ফের চমকাল।
আয়েশা বলল – উপরের ঘরে ভাইয়া থাকে, চলো।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে মায়া একমনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপছে। সিঁড়ি শেষ করে লম্বা করিডোরটায় পা রাখতেই দেখল একটা সোফা, সামনে চার পা ওয়ালা গোল টেবিল। সারি সারি আর্টিফিশিয়াল ফুল। আয়েশার সাথে হাঁটতে হাঁটতে দেখলো সুন্দর বেতের দোলনা ঝুলানো, পাশে বুক শেলফ। মায়া খেয়াল করলো পুরো ফ্লোরটায় মাত্র একটা কক্ষ।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই আয়েশা বলল – তোর বউকে এনেছি, ও ভাবীইইই। আসো।
মায়া পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকতে চূড়ান্তরূপে অবাক হলো। কি ছিমছাম সাজানো ঘরটা। বেডশিট, পর্দা, আসবাব, দেয়ালের রং সবকিছুতে আকাশী নীল রঙা ছোঁয়া।

আয়েশা আবার বলল – আমি যাই ভাইয়া। আলমারিতে ভাবীর জন্য জামা এনে রেখেছি। তোর সবকিছুও আছে। খাবার রেডি করছি।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে চলে গেল আয়েশা। মায়া তখনো মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।

মাথার ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ফাহিম বলল – দাঁড়িয়ে আছো কেন? অতটা ভয় পাচ্ছো কেন? আমার প্রতি কি বিন্দুসম বিশ্বাস তৈরী হয়নি?
বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকা মায়া তরতরিয়ে বলে দিলো – এটা সত্যি আপনাদের বাড়ি! কিন্তু ঢাকায় আপনি এভাবে থাকেন! আমি মিলাতে পারছিনা। এখানে কি সবাই জানে ঢাকা আপনি কি করেন?

মায়ার সেই বাচ্চাসুলভ কথাগুলো শুনে ফাহিম হাসল। এক পা দু পা করে এগিয়ে আসল সে। একেবারে মায়ার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিল। আবার তার পাশ কা’টি’য়ে এসে দরজাটা আটকে দিল। মায়ার হাতটা ধরে তাকে নিয়ে বিছানায় বসালো। বিছানায় বসেও হাত ছাড়ল না একটুও। কথাগুলো মনে মনে সাজিয়েছে কিনা জানা নেই তবে আলতোভাবে মায়ার গালে হাত রেখে ফাহিম বলল – ও মায়া! বাবার অঢেল সম্পত্তি আছে আর আমি সেই জোরে চলব? বাবার পরিচয়ে কেন পরিচিত হতে হবে? নিজের একটা পরিচয় লাগেনা?
মায়া উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বলল – লাগে।
ফাহিম এবার মুখটাকে আরো একটু কাছে এনে বলল – বাবার থেকে পয়সা নিতে চাইনি মায়া। অল্প আয় করে অল্পে চলি। তুমি সন্তুষ্ট নয়?
ফাহিমের প্রতিটি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে মায়া। প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন তার মুখে আছড়ে পড়ছে। সম্মোহনের মত মায়া তাকিয়ে আছে ফাহিমের দিকে। ওর গজদাঁতটা আবারও দেখা যাচ্ছে। ভেজা চুলগুলো থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি কপালে জমছে। তার চোখে যেন কত হাসি।
মায়া আচমকা প্রশ্ন করল – ছেলেদের গালেও টোল পড়ে?
মায়ার অদ্ভুত কথা শুনে ফাহিম হাসতে হাসতে বলল – প্রেমে পড়েছ?
মায়ার তিরতির করে কাঁপা ঠোঁটজোড়া ফাহিমকে আবিষ্ট করে তুলছে। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ফাহিম বলল – যাকে তুমি টোল বলছ বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলে শারীরিক ত্রুটি।তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও। কিছু খেতে হবেতো নাকি!
একরকম পালিয়ে যাওয়ার মত ছুটলো ফাহিম। মায়া তাকিয়ে আছে সেদিকে।

____

ফোনটা ছুঁড়ে মারলেন জামশেদ রহমান। দেয়ালে আছড়ে পড়ে তিন টুকরো হয়ে আছে ফোনটা। মুরাদ হাত থেকে টপকে বেরিয়ে গেল। এই একটা ছেলে তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় সে আসছে।
এতদিন পর মনে হলো তামান্নাকে বিয়ে করা কিংবা তার রূপে মোহাচ্ছন্ন হওয়া দুটোই ভুল হয়েছে।
প্রেমের টানে তিন সন্তানকে ভুলে জামশেদ রহমানের হাত ধরে পালিয়ে এসেছে তামান্না। আসার সময় নিজ হাতে শেষ করে এসেছে নিজের নাড়িছেঁড়া মেয়েকে। তখন প্রেমের টানে বেমালুম মোহাবিষ্ট হলেও কিছুদিন পর থেকেই বুঝতে পারেন তিনি ভুল করেছেন। নিজ সন্তান হ//ত্যা করার মত পাপ তিনি করেছেন। প্রতিনিয়ত মদ্যপ জামশেদের হাতে তিনি মা;র খেয়েছেন। স্বামীর নারী দেহের প্রতি অবাধ লোভও টের পেয়েছেন। গুমরে কেঁদেছেন। কিন্তু ততদিনে সব হারিয়েছেন তিনি। লম্পট লোকটার সাথে হাত মিলিয়ে নিজ সন্তানের পিতাকেও তিনি অপবাদ করেছেন।
নিজের সব ভুলের মাশুল তিনি ক্ষণে ক্ষণে দিচ্ছেন। স্বামী সন্তানের হাতে প্রতিনিয়ত আঘাত পাওয়ার ভয় এখন তাকে গ্রাস করেনা। স্বস্তির জায়গাটা রেখে ন/র/কে স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
স্বামীর অনুপস্থিতিতে হরহামেশা জামশেদের সাথে ছিল তার অন্তরঙ্গ সখ্যতা। বুঝতেই পারেননি মরীচিকার পিছু নিয়েছেন তিনি।

এত বছর পর আজ হঠাৎ খুব করে চাইছেন নিজ সন্তানদের একবার দেখতে। প্রাক্তন স্বামীর নিকট ক্ষমা চাইতে। হঠাৎ ডাক পড়ল তার। জামশেদ ডাকছে উচ্চস্বরে। পুরোনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে ছুটলেন স্বামীর আজ্ঞা পালন করতে। প্রতিনিয়ত ন-ষ্টা, দুশ্চরিত্রা উপাধি শুনতে শুনতে তিনি খুব করে চাইছেন নিজেকে বিসর্জন দিতে। যদি মুক্তি মিলে!

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here