আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ২০

0
461

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ২০

ছেলে চোখের আড়াল হওয়ার পর মাহতাব খান অবনত দৃষ্টিতে মেয়েকে বললেন – তোর সেজ জ্যেঠুকে একটু খবরটা দিয়ে আয়।
উপরের দিকে কিছু পাওয়ার ভঙ্গি করে দু’হাত তুলে মাহতাব খান বললেন – আমার ছেলেটাকে আর কষ্ট পেতে দিওনা আল্লাহ, ওর সহায় হও। একজীবনে শুধু সম্পদ ছাড়া আদর ভালবাসা পায়নি ছেলেটা। ওর সহায় হও, ওকে রক্ষা করো ইয়া আল্লাহ।

নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়াতেই মনে পড়ল মায়ার কথা। মেয়েটার মনের অবস্থা আশংকা করে আবারো ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠেন তিনি।

এতরাতে দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনে দরজা খুলে দিল রায়হান। তার হাতে রং করার তুলি দেখা যাচ্ছে। আয়েশাকে দেখে চমকে উঠে সে। ঘুম জড়ানো কন্ঠের আদলে বলে – এতরাতে আমার কাছে কি? একজন মাতাল, বর্বর লোকের কাছে এতরাতে আসতে ভয় করেনি?

আয়েশা লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল – জ্যেঠু, জ্যেঠু কোথায়?
রায়হান খেয়াল করল আয়েশার চোখের কোণে বর্ণহীন তরল চিকচিক করছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। বুকের ভিতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো তার। কি হয়েছে আয়েশার!
রায়হান আয়েশার দুবাহু ধরে বলল – কি হয়েছে? বাবা ঘরে নেই, আমাকে বল।
ডুকরে কেঁদে উঠে আয়েশা, হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে – ভাইয়াকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
আয়েশার অমন অঝোর কান্নায় রায়হানের ইচ্ছে হচ্ছে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে – টেনশন নিসনা, সে খুব দ্রুত ফিরবে। নির্দোষ, নিরপরাধকে আল্লাহ কষ্ট দেয় না।
কিন্তু নিজের উথাল-পাতাল করা বুকটাকে শান্ত করার জন্য মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরার অধিকারটা এখনো যে তার হয়নি।
রায়হান অপলক তাকিয়ে আয়েশার কান্না দেখছে। কান্নার তোড়ে ফুঁপিয়ে ওঠা মেয়েটার জন্য বুকটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে যেন।
আয়েশার দু’বাহু আরো শক্ত করে ধরে তাকে খানিক কাছে টেনে নিয়ে রায়হান ভরসার স্বরে বলল – এভাবে কাঁদলে কি তানভীর ফিরবে? কাঁদছিস কেন? তানভীরের কিছু হবে না।

আয়েশা কান্নার বেগ থামিয়ে বলল – ভাইয়া বলে গেছে কাল ঢাকা চলে যেতে। আমি, বাবা আর ভাবী ঢাকা চলে যাব কাল। কিন্তু ভাইয়াকে কোথায় রাখা হবে?
রায়হানের বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল যখন শুনলো আয়েশাও চলে যাবে কিছুদিনের জন্য। নিজেকে সামলে বলল – ওকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে, মামলাটা ওখানে হয়েছে। আর তুই ঢাকায় গিয়ে কি করবি?
আয়েশা চোখ মুছে বলল – আমি যাই।
রায়হানের বলা শেষোক্ত কথাটা সে শুনতে পায়নি। রায়হানও নাছোড়বান্দা, নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে সেও পথ আগলে দাঁড়ালো আয়েশার। আয়েশা চকিতে তাকালো রায়হানের পানে। উৎসুক চোখজোড়া আয়েশাকে দেখতে ব্যস্ত। চোখের সামনে তিল তিল করে মেয়েটাকে বড় হতে দেখেছে। ছোট বেলায় মায়ের আদর না পেয়ে যখন গুমরে কেঁদে উঠত মেয়েটা তখন রায়হান তাকে স্বান্তনা দিত। কৌশোরে পদার্পণের পর আয়েশাই দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
আয়েশা ছোট্ট করে বলল – কিছু বলবেন?
রায়হান মাথা নাড়িয়ে বলল – আমাকে এত অপমান করিস কিন্তু এতরাতে আমার বাসায় আসতে ভয় পাসনি? মনে হয়নি আমি মা তা ল। কিছু একটা করে ফেলতে পারি।
আয়েশা মিনমিন করে বলল – জ্যেঠুর কাছে এসেছি, আপনার কাছে নয়।
রায়হান গম্ভীর হয়ে বলল – এখনতো আমি একাই আছি শুধু। বাবাতো নেই।
আয়েশা রুক্ষস্বরে বলল – আপনার চরিত্রে ঐ দোষ এখনো আসেনি।
রায়হান কথা না বাড়িয়ে বলল – চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে আলতো করে আয়েশার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে রায়হান বলল- আমার সাথে তোর কি শত্রুতা? আমার সাথে এমন করিস কেন?
আয়েশা একমনে হাঁটতে লাগল। রায়হান কথার বিষয়বস্তু বদলে বলল – তানভীর তিনদিনের মধ্যে ফিরবে। সব ব্যবস্হা করা হয়েছে।
আয়েশা চমকে বলল – আপনি কিভাবে জানেন?
রায়হান ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে আয়েশাকে দেখছিল, তার প্রশ্ন শুনে বলল – তোর কাছে আমি মা তা ল, বর্বর কিন্তু তানভীরের কাছে আমি বড় ভাই। ও আমাকে জানিয়ে গেছে।

হঠাৎ কেউ লাফিয়ে পড়লে যে ধরনের শব্দ হয় ঠিক তেমনি একটা শব্দ শুনতে পেল আয়েশা। রায়হানের হাতটা খামচে ধরে বলল – কারো লাফিয়ে পড়ার শব্দ পেয়েছি, আমার ভয় লাগছে।
রায়হান ডোন্ট কেয়ার ভাব এনে বলল – তোর আশিক এসেছে তোকে নিতে। বলদ কোথাকার। বিড়াল লাফাচ্ছে হয়ত। ঘরে চল।

আয়েশা ঘরে ঢুকে দেখল বসার ঘরটা ফাঁকা। বাবার ঘরে গিয়ে দেখল ছেলের ছবিটা হাতে নিয়ে মাহতাব খান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি যেন দেখছেন। মৃদুস্বরে আয়েশা বলল – বাবা জ্যেঠু ঘরে নেই, রায়হান ভাই এসেছে।
মাহতাব খান চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন আয়েশার পিছনে রায়হান দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এনে বললেন – আমার ছেলেটাকে তারা কি করছে রায়হান। মারছে না তো?

রায়হান চাচাকে আশ্বস্ত করে বললেন – আদালতের আদেশ ব্যতীত তার গায়ে বিনা প্রমাণে হাত দিতে পারবেনা। তার আগেই সে ফিরবে চাচু।
রায়হান কিছু একটা ভেবে বলল – মায়া কোথায়?
উপরের দিকে ইশারা করে মাহতাব খান বললেন – মেয়েটাকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা নেই। ও বরং কিছুক্ষণ একাই থাকুক।
রায়হান ঠোঁট হালকা প্রশস্ত করে বলল – আমি সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম।

_______

রাত তিনটা বেজে পনের মিনিট। জোর আঘাতে আর্তনাদ করা কন্ঠটা শোনা যাচ্ছে যেন। জেলে এনেই তানভীরকে বিশ্রীভাবে একের পর এক আঘাত করছে এসআই বিপ্লব। মোটা টাকা পেয়েছে এই কাজের জন্য। পিছনে হাত বাঁধা তানভীর ততক্ষণে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। পুনরায় তাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে লাঠি তোলার পূর্বেই কারো জোরালো আদেশ পেল এসআই বিপ্লব। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল ইন্সপেক্টর আহসানকে। সাথে মুখোশে আবৃত একজন নারী। মাথায় সাহেবী টুপিটার জন্য তার চোখ দেখা যাচ্ছে না। পুরো মুখটা কালো কাপড়ের আড়ালে আবৃত। হাতে রয়েছে কালো গ্লাভস। পায়ে বুট। সম্পূর্ণ শরীরটাকে আবৃত করে রেখেছে একটা কালো কোটমতো ড্রেস।
নারীকন্ঠটা তখন তেজস্বিনীর মত ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – ওনার মামলাটা ঢাকায় করা হয়েছে। ঢাকায় ওনাকে পাঠানোর আগে এখানে এনে ওনাকে এই অত্যাচারের প্রতিবাদে থানা ঘেরাও করব মিস্টার আহসান। আপনার এস আইকে ক্লোজ না করা পর্যন্ত দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতে পারি কিন্তু আমি করব না। আইনের মাধ্যমে সমস্ত সমস্যার সমাধান হোক।তাইতো আপনার শরণাপন্ন হলাম।
এস আই বিপ্লবকে কঠিন আদেশ দিলেন ইন্সপেক্টর। তানভীরকে ইমিডিয়েট হাসপাতালে নেয়ার আদেশ দিলেন তিনি। রহস্যময়ী মানবীটা তখন বললেন ওনাকে এখান থেকে বের করবেন না। প্রাণ সংশয় হতে পারে। আপনি বরং ডক্টর এখানে আনিয়ে নিন এবং আমার হাতে থাকা ডকুমেন্টসগুলো দেখুন।

ইন্সপেক্টর আহসান ডকুমেন্টসগুলো দেখতে দেখতে বললেন – সাদমান তাহলে বেঁচে আছে? কিন্তু সেলিম এবং শাফায়াত খু নে র প্রমাণতো মিস্টার তানভীরের বিরুদ্ধে।
এস আই বিপ্লব তখন বললেন – এজন্যই কথা বের করতে গেছিলাম স্যার।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মুখোশ মানবী চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন – তার দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়নি।
আহসান হাত উঁচিয়ে বললেন – নিরুপমা, আপনি থামেন। ওনার ব্যাপারটা উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হবে। তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে অত্যন্ত ভয়ানক। নীতি ভঙ্গ করার অপরাধে ওনাকে শূলে চড়ানো হবে। ইন্সপেক্টর আহসান ভয় পাচ্ছেন নিরুপমাকে। কা-ট কা-ট ভঙ্গিতে কথা বলা মেয়েটা অনেকদূর যেতে পারে তা আন্দাজ করে ভয় পাচ্ছেন তিনি। তিনি কোন ঝামেলা চান না। ঝামেলাহীন এবং সাধাসিধে আহসান ফাহমিদ খুবই সততার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তাইতো পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। সামনে বসা মেয়েটা এস আই বিপ্লবের সাদমানের হাত থেকে টাকা নেয়ার মুহূর্তটা ফ্রেমে বন্দী করে আহসানকে দেখিয়েছেন। আহসান খেয়াল করেছেন মেয়েটা সমস্ত প্রমাণ নিয়ে আঁট ঘাট বেঁধে এসেছে। ঢাকায় নেয়ার আগ অবধি সেখানে সমস্ত প্রমাণ পেশ করার আগেই যদি তানভীরকে ছেড়ে দেয়ার এখতিয়ার থাকত তাহলে আহসান তাকে ছেড়ে দিত।

প্রাথমিক চিকিৎসায় জ্ঞান ফিরেছে তানভীরের। উঠে বসে সামনে তাকাতেই দেখল কালো কোটের আড়ালে ঢাকা, কালো মুখোশের আড়ালে থাকা রহস্যমানবীকে। চোখ কুঁচকে তাকালো, আগা গোড়া পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখল। মাথাটা টনটন করছে। সে কস্মিনকালেও ভাবেনি দুইঘন্টার ভিতরে তাকে এতটা বিশ্রী নির্যাতন করা হবে। লাঠির প্রতিটা আঘাতে শরীর টনটন করছে। তার বুকে দেয়া এস আইয়ের লাথিগুলো যেন তার নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছিলো। মুখেও লাথি মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। মাঝখানে গেটের এপাশে তানভীর আর অন্যপাশে রহস্যমানবী। একদম গেটের কাছটায় এসে দাঁড়ালো মেয়েটা। ইশারায় তানভীরকে গেটের কাছে আসতে বলল। তানভীর উঠে দাঁড়াতে পারল না। প্রচন্ড খারাপভাবে জখম করা হয়েছে তাকে। সে দেখল মেয়েটা ইন্সপেক্টরকে কিছু একটা বলল। ইন্সপেক্টর গেটের তালা খুলে দিয়ে বললেন – আপনি ভিতরে যেতে পারেন। আমার দৃষ্টিতে উনি নিরপরাধ। এটুকু মানবতা দেখাতে পারি, আমিও মানুষ।
ধীরপায়ে এসে তানভীরের সামনে একহাঁটু ভাজ করে অন্য পায়ে ভর দিয়ে বসল মেয়েটা।
পেছন থেকে আহসান বললেন – মিস্টার তানভীর, উনি নিরুপমা। আপনি যখন আঘাতে ঝর্ঝরিত হয়ে পড়েছিলেন তখন উনি এসে দাঁড়ালো আপনাকে রক্ষার জন্য। আপনি নিরপরাধ। আশা করছি ঢাকায় সব প্রমাণ পেশ করলে আপনি মুক্তি পাবেন।

তানভীর তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। নিরুপমা হাত বাড়িয়ে দিলো হাত মেলানোর উদ্দেশ্যে। তানভীর তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল – আমি বিবাহিত ম্যাম। তাকে ছাড়া পরনারীকে ছোঁয়ার কথা অচেতন হয়েও ভাবি না।
হাত নামিয়ে নিল নিরুপমা। কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টি নিয়ে দেখল তানভীরকে। ছোট্ট একখানা কাগজের টু্করো এগিয়ে দিল তার দিকে। তানভীর তাতে চোখ বুলিয়ে দেখল। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিয়ে নিরুপমার দিকে তাকাল। আবার পড়ল লেখাগুলো।

– আপনার মুক্তির মাঝে আর কোন বাঁধা নেই। সকল প্রমাণ পাঠানো হয়েছে জায়গামত। মুক্তি এখন সময়ের অপেক্ষা।

তানভীর ছোট্ট করে বলল – আপনি কথা বলতে পারেন না?
ঝটপট ফোনটা বের করে তাতে কিছু একটা টাইপ করে তানভীরের সামনে ধরল নিরুপমা।

– আমি কলে আছি। তাদের কথা শুনছি। আমার কথা বলা বারণ। আমি ফিরে যাচ্ছি। আপনার ছোঁড়া ইটের আঘাতের কথা মনে আছে মিস্টার মুরাদ। আজই শেষ দেখা আর আজই স্বেচ্ছায় প্রথম দেখা। আপনার সামনে আসব না তবে আপনার মুক্তি পর্যন্ত ছায়া হয়ে আছি।

লেখাটা পড়ে তানভীর জোর করে হাসতে চেষ্টা করল। দৃঢ় কন্ঠে বলল -আপনার আসল পরিচয়টা বলে যান।

ফের টাইপিংয়ে ব্যস্ত নিরুপমা। আবার তানভীরের সামনে ফোনটা ধরলো আলতো করে।

– সব ব্যাপার জানতে হয় না। কিছু না হয় অজানা থাক।

তানভীরকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বেরিয়ে এল নিরুপমা। তানভীর এক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে নিরুপমার প্রস্হান। ইন্সপেক্টরের সাথে কিছু কথা শেষে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। হাঁটা ধরলো সামনে। খানিক বাদে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here