আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ২৪

0
406

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ২৪

টেলিভিশনের সামনে বসে আছে মাহতাব খান। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার পরিণতি দেখতে চলেছেন তিনি। আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে সোফার পাশে। বাবার পাশেই খানিকটা দূরত্ব রেখে বসেছে তানভীর। রায়হান যখন তানভীরকে জানায় যে টেলিভিশনে আজ মুখরোচক সংবাদ প্রচার হবে তখন থেকেই টেলিভিশনের সামনে বসে আছে তারা। নিরুপমা, রায়হান, তুষার তারা জামশেদের অবস্থা দেখতে হাসপাতালে গিয়েছে। তার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে রায়হান। নিরুপমাকে কঠিনভাবে বলে – এভাবে আঘাত করেছো কেন? পুরো থেঁতলে গেছে দেখতে পাচ্ছো?
নিরুপমা হেসে বলল – ওর বড়জোর ফাঁ-সি হবে কিন্তু যেই জোরে সে এত মেয়ের জীবন নিয়েছে সেই জোরটা ধ্বংস না করলে সে গর্ব নিয়ে ম-র-ত।

রায়হান নিরুপমার ইমোশনটা বুঝতে পেরে বলল – দিনশেষে আমাদেরও আবেগ আছে, আমরাও মানুষ তাইনা!
নিরুপমা মাথা নাড়িয়ে বলল – উনি কি আমায় নিতে আসবে? না কি আমিই যাবো?
রায়হান কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে কিছু একটা ভেবে তানভীরকে আবার কল দিয়ে বলল – তানভীর শুনছিস?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো।
রায়হান তখন ভূমিকা ছাড়া বলল – একটা কাজে ঢাকা যাচ্ছি, তুই মায়ার ঠিকানা দে। তাহলে তাকে নিয়ে আসতে পারব।
তানভীর খুশিতে গদগদ হয়ে মেসেজ দিয়ে রায়হানের ফোনে ঠিকানা পাঠিয়ে অপেক্ষা করছে কখন তার মায়াবতী ফিরবে।

তখনই টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার শুরু হলো। প্রধান প্রধান সংবাদ পাঠ করার পর নিউজ রিডার বলতে শুরু করলেন – ঊনিশ বছর আগের চাঞ্চল্যকর মামলার পুনরায় উপস্থাপন আদালতে। পরকীয়ার জেরে নিজ সন্তানকে শ্বা-স-রো-ধ করে হ’ত্যা করা এবং নিজ স্ত্রীকে ভা’ড়া’টে লোক দিয়ে ধর্ষণ করিয়ে হত্যা করার গোপন তথ্য ফাঁ-স হয়েছে ঊনিশ বছর পর। সেই সাথে নাম উঠে আসে রাঘব বোয়ালদের। দুর্ধর্ষ নারী পাচার চক্রের নামও উঠে আসে তদন্তে। পুলিশের বরাত দিয়ে জানা যায় আড়ালে থাকা সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স এর দুর্ধর্ষ অভিযানে এবং সাহসী পদক্ষেপে ধূলোয় চাপা পড়ে যাওয়া এই লোমহর্ষক কাহিনীর মূলহোতাদের সকল পরিশ্রম পন্ড করে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়।
বিস্তারিত জানতে যোগ দিচ্ছেন আমাদের রিপোর্টার।

টেলিভিশনের পর্দায় একে একে ভেসে ওঠে তামান্না রহমান, মতিন খান, সাদমান আশরাফ ও জামশেদ রহমানের ছবি। সাথে বলা হয় তাদের সেই লোমহর্ষক কাহিনী। পুরো দেশের মানুষ হতবাক হয়ে যায় সংবাদটুকু শুনে। আয়েশা চিৎকার করে কেঁদে উঠে। মাহতাব খান নির্বাক চেয়ে আছেন। ঊনিশ বছরের পুরোনো ক্ষত আজ আবার তাজা হয়েছে। ভাই নামক বিষাক্ত শত্রুটাকে চিনতে পেরে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে।
তানভীর সবটা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়েছে। ইচ্ছে করছে একেকটাকে ধরে নিজ হাতে খু-ন করতে। ঠিক তখনই মনে পড়ল রায়হানের বলা কথাটা। রায়হান তাকে বলেছিল – ঘৃণ্য শত্রুর, বেঈমানের রক্ত নিজ হাতে লাগিয়ে নিজেকে কলুষিত করার মানে হয়না। বেঈমানদের রক্তগুলোও জীবাণু বহন করে, পাছে তাদের রক্ত ছুঁয়ে দিলে যদি তাদের পাপটা আমাদের শিরায় আসে?
নিজেকে শান্ত করে তানভীর ভাবল অপেক্ষার অবসান হয়েছে। অপরাধীরা শাস্তি পাবে।
এদিকে মাহতাব খান ভাবছে রায়হানের কথা, ফারহানের কথা।
নিরুপমা গিয়েছিল তামান্না রহমানের সাথে দেখা করতে। কয়েদীদের সাথে থাকা তামান্না রহমানকে দেখে নিরুপমা বলল – পরকীয়ার শাস্তিটা দেখেছেন? হালাল সম্পর্ককে অস্বীকার করে যে মরীচিকার পিছু ছুটলেন সে আসলে গুড়ে বালি। বাকিদের আমি চরম ফর্মূলা দিলেও আপনাকে ছুঁইনি কারণ আপনি মিস্টার তানভীরের জন্মদাত্রী, সে হিসেবে আপনাকে কিঞ্চিৎ অনুগ্রহ দেখালাম।

অপরাধের চরম অনুশোচনায় মাথা তুলতে পারেনি তামান্না। সে জানে এরপর তাকে ভুগতে হবে নরক যন্ত্রণা।

____

অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে রায়হান ও মায়া। বিকেল চারটার ফ্লাইটে তারা ঢাকা ছাড়ে। তানভীরকে আগেই জানিয়ে দিয়েছে রায়হান।
নিজের মায়াবতীকে এতদিন পরে দেখবে, সেই খুশিতে গদগদ তানভীর। আয়েশাও খুশিতে আটখানা হয়ে আছে। মাহতাব খান ভাবছেন রায়হানের কথা। ছেলেটা একা হয়ে গেল।

বার কয়েক কথা হয়েছে রায়হানের সাথে। ত্রিশ মিনিটে চট্টগ্রাম পৌঁছে গেছে তারা। তানভীরের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না।

অপেক্ষার প্রহর অবশেষে সাঙ্গ হলো বলে। মায়াকে দেখে খুব ইচ্ছে হলো জড়িয়ে ধরার। মাহতাব খান এগিয়ে এসে বললেন – কেমন আছিস মা?
আয়েশাতো আলোর গতিতে এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল – ভাবীইই, অনেক মিস করেছি।
মায়ার দৃষ্টি তখন তার ফাহিমের দিকে। তানভীর খেয়াল করলো মায়ার চোখভরা অভিমান। যেন এখনি ঘোর আঁধার করে বৃষ্টি হয়ে নামবে।
মাহতাব খান আয়েশাকে বললেন মায়াকে ঘরে নিয়ে বসাতে। আয়েশাও বাবার বাধ্য মেয়ের মতন মায়াকে ঘরে এনে বললো – তোমায় ছাড়া খুব কষ্ট হয়েছে ভাবী।
মায়া ঠোঁটজোড়া হালকা প্রশস্ত করে বলল – তাইতো দূরে পাঠিয়ে দিলে।
মাহতাব খান মায়ার কথা শুনে বলল – এজন্য বুঝি আমাদের পুতুল অভিমান করেছে?
মায়া মাথা নিচু করে আছে। লজ্জা পেয়ে পালাতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
তানভীর মায়ার পিছু আসছিল কিন্তু রায়হান তাকে থামিয়ে বলল – কই যাস? তোর বউ এনে দিলাম এত দূর থেকে, আমাকে ট্রিট না দিলে বউয়ের কাছে যেতে দিব না বৎস।

তানভীর ভ্রু কুঁচকে কপট অবাক হওয়ার ভান করে বলল – এখন কি বউয়ের কাছে যেতেও ট্যাক্স লাগবে?
রায়হান হেসে দিয়ে বলল – আচ্ছা তুই যা বউয়ের কাছে আর আমি ঘরে যাই।
তানভীর রায়হানের হাত টেনে ধরে বলল – আমাদের ঘরে চল, ওদিকে কেন যাচ্ছিস?

রায়হান হাত ছাড়িয়ে দিল। দীর্ঘনিঃশ্বাসটা বুক চিরে বেরিয়ে এলো তার। মুখে হাসি ভাবটা এনে বলল – পরে আসব।

তানভীর মাথা চুলকে বলল – আমি মায়াকে নিয়ে বের হব। একটু ঘুরবো।
রায়হান হাসলো তার দিকে তাকিয়ে। তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বাঁ হাতটা দিয়ে চুল এলোমেলো করে বলল – আচ্ছা পরে আসব।

দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো তানভীর কিন্তু মায়াকে দেখতে পেল না। আয়েশাকে দেখে বাঁ ভ্রুটা উঁচু করে বলল – ম্যাডাম কোথায়?
আয়েশা ঠোঁট টিপে হেসে বলল – বার নম্বর মহা বিপদ সংকেত, তোর গিন্নী অভিমান করেছে। রুমে গিয়ে মনে হয় ঘূর্ণি সৃষ্টি করছে।
তানভীর কথা না বাড়িয়ে উপরে চলে গেল। নিজের কক্ষটার সামনে যত এগোচ্ছে তত তার হার্টবিট বাড়ছে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে প্রতিটি স্পন্দনের। দরজা ঠেলে ভেতরে আসতেই দেখল রুমটা ফাঁকা।
এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখল ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ। বিছানায় বসে অপেক্ষা করতে থাকল কখন তার মায়াবতী আসবে।
দরজায় খট জাতীয় শব্দটা শুনে উঠে দাঁড়াল সে। ওয়াশরুমের দরজা খুলে মায়া যখন বেরোল তখন সে তানভীরকে দেখেও এড়িয়ে যাচ্ছিল।
তানভীর তার পথ আঁটকে বলল – কোথায় যাও? বলে যাও শুনি।
মায়া মুখ ঘুরিয়ে বলল – বলব না। আমি আপনার কে? দূরে পাঠিয়ে দিয়ে এখন একদম আদর দেখাবেন না।
মায়ার আদুরে কথাগুলো তানভীরের বুকে বিঁধেছে। মায়ার গাল ফুলানো দেখে মনে হল কোন বাচ্চা মেয়ে যেন পুতুল কেনার বায়না ধরেছে।
অমন আদুরে মেয়েটার অভিমান না ভাঙালেই নয়। তাইতো নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে তাকে কাছে টেনে বলল – দূরে পাঠিয়ে না দিলে এখানে একা গুমরে কাঁদতে আর আমার সেটা সহ্য হতো? একা এই রুমটায় তখন হাসফাস লাগতো না?
বাম হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে মায়া বলল – একদম বাহানা করবেন না। একদম বাহানা করা লাগবে না। আমার মা নেই তো, আমাকে বোঝারও কেউ নেই।
মায়ার কথাটা যেন একটা শেলের চাইতেও বিষাক্ত ছিল। তাকে বুকে জড়িয়ে দু হাতে আবদ্ধ করে তানভীর বলল – অমন কথা বলেনা মায়া। ও কথা আমি সহ্য করতে পারব না। কথা দিচ্ছি আর কখনো কোন অভিযোগের সুযোগ দিব না। তবুও এই কথাটা বলে আমাকে অপরাধী করে দিওনা।
তানভীর টের পেল মায়া ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গুমোট পরিস্থিতিটাকে চনমনে করতে তানভীর মাথা নিচু করে বলল – তুমি আমার জন্য কাঁদছ, বউ? তাহলে কি সামথিং সামথিং!
অমন পরিস্থিতিতে তানভীর কিভাবে রসিকতা করতে পারে তা ভেবে কান্নার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অবাক তাকিয়ে আছে মায়া।
তানভীর চোখ বড় বড় করে বলল – তাহলে তো এখনই তোমায় নিয়ে আনন্দে একটা ভ্রমণ দেয়াই যায়। চলো আজ তোমায় নিয়ে অজানায় হারিয়ে যাব।
মায়া মুখ বাঁকা করে বলল – আমি যাব না, আপনি যান।
তানভীর চেষ্টা করল মায়ার মত মুখ বাঁকা করতে। এদিক সেদিক মুখ বাঁকিয়ে চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলো তখন সে বলল – মুখ ব্যাকা করে বলছি বউ, তুমি যাবে, সাথে তোমার বরও যাবে। আর কোন কথা না। তোমার কথায় ফুলস্টপ বসাও। আর তৈরী হয়ে নাও, আমি বাবাকে বলেই গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি। দশ মিনিটে তোমায় নিচে দেখতে চাই।

কথাটা বলেই নিচে নেমে এল তানভীর। জোরে জোরে চিৎকার করে বলে – আয়েশার আব্বু আর আমার বাবা, আপনি কোথায়? একটু ডেটিংয়ে যাচ্ছি বউ নিয়ে।
সোফায় বসা মাহতাব খান মুখ খিঁচিয়ে বললেন – এহ, কথার তামাশা দেখো। লাজ লজ্জা সব খেয়ে নিয়েছে।
তানভীর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল – সত্য বললে যে কথা গায়ে লাগে তা আমি জানি। তা খান সাহেব, আপনার জন্য কি আনব? কিছু না আনলে তো হিংসুটে বুড়ো আবার জ্ব লে যাবে হিংসায়।
মাহতাব খানও নিজের চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বললেন – একটা ডান্ডা আনিস, যাতে কাউকে ঠান্ডা করতে পারি।
তানভীরের মুখের ভাব ভঙ্গি বদলে গেল, ভ্রু কুঁচকে চোখ বড় করে বলল – হয়েছে ভদ্র করে কথা বলছি, অমন ভয় দেখানোর কি আছে,হুহ।
মাহতাব খান হো হো শব্দে হেসে উঠে বললেন – কবে বড় হবি তুই? আচ্ছা তোরা যা, আমিও কাজে যাব।

বাবার আহ্লাদ মাখা কথা শুনে তানভীর মৃদু হেসে বলল – বড় হতে চাইনা বাবা।
মায়া এতক্ষণ বাবা ছেলের খুনসুটি দেখে ভাবছে তার বাবা তার সাথে কতদিন এভাবে কথা বলেনা। চোখে বেহায়া জল আসতেই মুছে নিল আড়ালে।
মাহতাব খান তখন ছেলেকে বললেন – ঐ যে পিচ্চি মেয়েটা নেমে এসেছে। আগলে রাখিস।

বাবার দিকে সম্মান আর শ্রদ্ধাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তানভীর, ততক্ষণে তার বাবা এগিয়ে গেলেন।
তানভীরও মায়ার হাতটা ধরে মৃদু হেসে বলল – চলেন মহারাণী, ঘুরে আসি।
যাওয়ার আগে আয়েশাকে ডেকে সাবধানে থাকতে বলে তানভীর। আয়েশা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে – বৃষ্টি আসতে পারে ভাইয়া, তুই সাবধানে যাস। ভাবীকে সাবধানে রাখিস, তোর পুতুলের বাচ্চা আবার কেউ চুরি না করে।
কথাটা বলে ফিক করে হেসে দেয় আয়েশা। তানভীরও হাসে কিন্তু মায়া লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ততক্ষণে।

_____

দরজায় খট খট শব্দ পেয়ে দরজাটা খুলতেই অবাক হয় আয়েশা। সন্ধ্যা বেলায় ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল। শরীরটা খারাপ লাগায় বৃষ্টিতে ভেজার লোভ সামলে ঘরেই শুয়ে ছিল। আর এখন দেখছে এই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে জলে ভিজে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান।
চোখজোড়া লাল হয়ে গেছে বৃষ্টির তোড়ে। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বিরক্তি নিয়ে আয়েশা জিজ্ঞেস করলো – কি চাই?
রায়হান মৃদু স্বরে বলল – তানভীর কই? বাসায় একা লাগছে বেশ। ওকে একটু ডেকে দে।
যদিও রায়হান জানত তানভীর ঘরে নেই তবুও আয়েশাকে এক নজর দেখার জন্য অতটুকুন অযুহাত তো দিতেই হতো।

আয়েশা একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল – ভাইয়াও নেই, আব্বুও নেই। আপনার সাথে কথা বলার মত এ ঘরে কেউ নেই।

তখনই ভীষণ জোরে বাঁজ পড়লো। আকাশের বুক চিরে আলোর তীব্র ঝলকানি। রায়হানের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেলো। বাঁজ পড়ার পরেই সে ও মা গো বলে এক লাফে ঘরের দরজায় চলে এলো।
আয়েশাও বেমক্কা ভয় পেয়ে মুখ বাঁকা করে বলে – বাংলা ছবি দেখতে দেখতে মাথা গেছে নাকি? এতদিন জানতাম বাঁজ পড়লে মেয়েরা লাফায় এখন দেখি আপনিও লাফান।

রায়হান ভ্রু কুঁচকে নাক ফুলিয়ে বলল – তোর কি আমায় নিয়ে সন্দেহ হয়? আর বাঁজ পড়লে যে মানুষ মরে সেটা শুনিস নি? ও আমি মরলে তো তোর শান্তি। এখন অবশ্য আমার কেউ নেইতো, আমি মরলে কার কি এসে যায়?

রায়হান ইচ্ছে করেই ইমোশনাল কথাগুলো বলল। তাতে অবশ্য কাজ ভালোই হলো। আয়েশা চমকে উঠে বলল – আমি কখন ও কথা বলেছি? নিজের কথা আমার মুখে বসান কেন?
রায়হান পিছু ফিরে দেখে বিরক্তি নিয়ে বলল – বৃষ্টি থামার নামই নিচ্ছে না, আবার বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর আসবে। বেঘোরে মরে টরে থাকলেও কেউ খবর পাবেনা। কতক্ষণ ভিজে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে!
আয়েশা কথাগুলো শুনে দরজা ছেড়ে ভেতরে চলে গেল ধুমধাম শব্দ তুলে।
খানিক পর হাতে একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ফিরে এলো। রায়হানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – এগুলো বদলে নিন।
রায়হান কপট রাগ দেখিয়ে বলল – লাগবে না কারো অনুগ্রহ।
আয়েশা চোখ গরম করে বলল – অনুগ্রহ কে করছে? সবকিছুতে একটু কম বুঝলে কি ক্ষতি হয়? শেষে জ্বর বাঁধালে বাবা শুনলে আমায় এসে বলবে বৃষ্টির মধ্যে ছেলেটাকে ঘরে ঢুকতে দিসনি কেন?
রায়হান বাচ্চাদের মত জেদ ধরে বলল – সর সামনে থেকে, অত কৈফিয়ত চেয়েছি নাকি? আমি মরলে তোর কি?
আয়েশা বিরক্ত হয়ে বলল – ন্যাকামি কম করে এগুলো বদলে নেন তো, পাশে ওয়াশরুম আছে।
রায়হান মুখ ঘুরিয়ে বলল – সুন্দর করে না বললে যাবো না।
আয়েশা চোখ মুখ কুঁচকে বলল – ঢং কম করে বদলে নেন।
রায়হান মুখ ফিরিয়ে বলল – চলে যাচ্ছি, লাগবে না বদলানো।
মিটমিট করে হাসছে রায়হান। আজ তার মনের কথাটা আয়েশাকে জানাতে আঁটঘাট বেঁধে এসেছে সে। এদিকে আয়েশাটাও তার ফাঁদে পা দিয়ে দিয়েছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আয়েশা বলল – ভেজা কাপড় বদলে নিন, নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে। জ্বর আসবে। তাতে আপনি কষ্ট পাবেন।
রায়হান উঠে দাঁড়ালো। আয়েশার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল – যাচ্ছি। তার আগে তুই বরং এক কাপ চা খাওয়া।
আয়েশার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট কিন্তু কন্ঠে কোমলতা এনে বলল – আপনি ওয়াশরুমে যান, ফ্লোরে পানি পড়ে ভিজে গেছে, আমি মুছে দিচ্ছি।
রায়হান এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। আয়েশা ফ্লোর মুছে ডাইনিং টেবিল এ থাকা ভ্যাকুয়াম ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে নিয়ে আসে। ততক্ষণে রায়হানও চলে আসে। আয়েশা অবাক হয়ে বলল – এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এলেন?
রায়হান হেসে বলল – একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে চাইনা।
উত্তর না দিয়ে আয়েশা নিজের রুমে চলে যাচ্ছিল কিন্তু নিজের হাতে কারো টান অনুভব করতেই পিছনে ফিরে তাকালো। অবাক হয়ে দেখল রায়হান তার হাতটা টেনে ধরেছে।
আয়েশার চোখে মুখে ক্রোধ উপচে পড়ছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। চোখজোড়া বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে আয়েশা বলল – জানতাম স্বভাবে দোষ আছে, এখন দেখি চরিত্রেও….
কথাটা শেষ করার আগেই রায়হান তাকে চুপ করিয়ে দিল। মৃদু স্বরে বলল – আমাকে দেখে কেন তোর মনে হয় আমি নেশা করি? কেন তোর মনে হয় আমি অভদ্র? আমার সাথে একটু সুন্দর করে কেন কথা বলিস না? তোর কথাগুলো আমাকে কষ্ট দেয়। বিশ্বাস কর আমি নেশা করিনা। ওসব আমি ছুঁই না। আমি তোমাতেই আসক্ত আয়েশা, ওসবে নয়।

আয়েশার চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। রায়হানের এ কোন রূপ দেখছে সে। আয়েশা উত্তর দিল – প্রতিনিয়ত আপনি কেন বলেন আমাকে কেউ বিয়ে করবে না, আপনিইতো আঘাত দেন আমায়।
রায়হান চুপ করে আয়েশার অভিযোগ শুনল। তার কপাল বেয়ে নেমে আসা অবাধ্য চুলগুলো নিজের তর্জনী দিয়ে কানের কাছে গুঁজে দিতে দিতে বলল – তুমি যখন কারো সামনে বসো বউ হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে তখন আমার এইখানটায় লাগে।
নিজের বুকের দিকে ইশারা করে কথাটা বলে আয়েশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে রায়হান। আয়েশাকে সোফায় বসিয়ে তার মুখোমুখি বসে বলল – রাত জেগে তোমায় নিয়ে স্বপ্ন বুনি, কত কত স্বপ্ন দেখি। সেই তুমি কেন অন্যের বউ হতে চাও। আমার মনটা কখনো পড়োনি কেন? আমি বিনা অন্য কোন পুরুষ তোমাকে ছুঁয়ে দিবে? আমি বেঁচে থাকতে হবে না।
আয়েশার মনে হচ্ছে সে কোথাও ডুবে যাচ্ছে। এ কেমন অনুভূতি, এ কেমন ভয়াবহ অনুভূতি।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here