#গল্প – #আড়ালে_কে,০৬,০৭
[ পর্ব- ০৬ ]
লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক ( জুনিয়র মুগলি )
রাতে ঘরে ফিরতেই নাকে বোটকা একটা গন্ধ পান শফিক সাহেব। র*ক্ত পঁচা এই গন্ধ সাধারণত কোরবানি ঈদের দিন বিকালে পাওয়া যায়। কিন্তু এখন এই সময়ে এমন পঁচা গন্ধ কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারেন না তিনি। পাশের, বিল্ডিংয়ের কাছে যেতেই গন্ধটা আরো বেড়ে যায়। কৌতূহল নিয়ে সেই বাড়ির উঠোনে হাজির হোন। দেখেন বাড়ির সদর দরজা খোলা অবস্থায় আছে। উনি আগে থেকেই জানেন এই বাড়ির মালিক এখানে থাকেন না। ছোট্ট ২ রুমের এই বাড়িটা কেবল বিশাল জায়গাটা পাহারা দেওয়ার জন্য যেন একটা পরিবার থাকতে পারে সেজন্য তৈরি করা হয়েছে। কয় মাস আগেই এটিতে আসে এক নবদম্পতি। অল্প বয়সের নতুন দম্পতিটি পালিয়ে বিয়ে করছে বলেই ধারণা করেন শফিক সাহেব ওনার মাথায় দুঃশ্চিন্তা ঢুকে যায়। মোবাইলের লাইট জালিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখেন মেঝেতে র*ক্ত জমাট বেঁধে আছে। বাতাসের ধাক্কায় তীব্র গন্ধ এসে ঠেকে ওনার নাকে। পকেটে কিছু না পেয়ে পাঞ্জাবির হাতে দিয়েই নাক চেপে ধরেন তিনি।
আর ভিতরে যাওয়ার সাহস করেননি তিনি, সেখান থেকেই ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। পুলিশে কল করে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান এবং রাস্তার পাশের দোকান থেকে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ডেকে এনে পরিস্থিতি দেখান তাদের। সবাই অপেক্ষা করে পুলিশ আসার জন্য। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে ৪ জন পুরুষ ও একজন মহিলা পুলিশ এসে উপস্থিত হলেন। তাদের নেতৃত্বে আছেন এস আই আজিজুর রহমান।
চল্লিশ উর্ধ্ব বয়সের এস আই আজিজুর রহমান দেখতে এতোটাও বৃদ্ধ নন। কিন্তু মেদ অনেকটা বেড়ে গেছে। দাঁড়ি সেভ করে রাখাতে এখনো বয়স ৩৫ এর বেশি মনে হয় না ওনাকে। ভাড়া করা সিএনজি নিয়েই এসেছেন ওনারা। থানার নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসার কোনো প্রয়োজনই অনুভব করেননি। একটা বাঁশি বাজাতে বাজাতে একজন সহকারী কর্মকর্তা উপস্থিত লোকজনের ভিড় সরিয়ে ভিতরে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে দেন।
এসআই আজিজ সাহেব ভিতরে ঢুকেন। মেঝেতে অল্প জায়গাও বাকি নেই যেখানে পা ফেললে র*ক্ত লাগবে না জুতায়। বাধ্য হয়ে র*ক্তের উপর দিয়ে হেঁটেই ঘরে ঢুকেন তিনি। বেশিক্ষণ আর খোলা নাকে থাকতে পারলেন না। পকেট থেকে কারুকাজ করা রুমালটা বের করে নাকে চেপে ধরেন। ফ্লোরে একটা যুবতী মেয়ের লাশ পরে আছে। তার মাথা থেকে বের হওয়া র*ক্তের ফোয়ারা গড়িয়ে গড়িয়ে বারান্দায় গিয়েছে। বিষয়টা বুঝতে পারার পরে
মহিলা সহকর্মীকে ডাকালেন উচ্চ স্বরে ‘ এই সালমা ভিতরে আসো তাড়াতাড়ি।’
মিস সালমা র*ক্ত দেখেই ভয়ে আছেন। কিন্তু ভিতরে না গিয়েও কোনো উপায় নেই। মূূল দরজা পাড় হওয়ার আগেই নাকে মুখে রুমাল চেপে নিলেন। অতঃপর র*ক্তের উপর দিয়ে পা টিপে টিপে কোনো রকমে লাশের সামনে গেলেন তিনি। আজিজ সাহেব অন্য সব পুলিশ অফিসারদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে নিজেও বের হয়ে গেলেন। বারান্দায় এসে বললেন, ‘সালমা এবার বডি উল্টে পাল্টে দেখ অস্বাভাবিক কি দেখা যায়।’
মিস সালমা ডেট বডিটা উল্টে পাল্টে দেখে আজিজ সাহেবকে জানান, “স্যার তেমন কিছুই তো নাই। মাথার পিছনে খালি র*ক্ত।’
আজিজ স্যার আবারও জিজ্ঞেস করে, ” কেমন ক্ষত? ‘
‘ স্যার বুঝা যায় না তো রক্তের জন্য। ছোটই মনে হচ্ছে।’
‘ শরীরের আর কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে?’
‘ এমনিতে তো বুঝা যাচ্ছে না কিছুই। আরো ভালো করে দেখতে হলে সব খুলতে হবে।’
‘ আচ্ছা তাইলে আর কিছু করতে হবে না এখন। আপাতত এতোটুকুতেই হবে। তুমি বডি বাইরে নেওয়ার উপযোগী কর।”
মিস সালমা ছোট্ট করে উত্তর দেয়, ” আচ্ছা স্যার”।
অতঃপর কাজে লেগে পরেন তিনি। মাথার পিছন থেকে র*ক্ত গুলো পরিষ্কার করে নেন বাতির আলোতে। তারপর চুলে খোঁপার মতো বেঁধে দেন। ওরনাটা গলাতে পেঁচিয়ে অল্প একটু ছড়িয়ে দেন বুকের উপরে। তারপর বাইরে থেকে আরেকজন সহকর্মী এসে ডেট বডিটা ধরা-ধরি করে বাইরে নিয়ে আসে। বাড়ি ওয়ালাকে আগেই কল করে জানানো হয়েছিল। উনি নিজের প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে আরো ২০ মিনিট সময় লাগবে বলে জানান। পুলিশকে অনুরোধ করেন ততক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য। পুলিশের পক্ষ থেকে ওনার অনুরোধ রাখা হয়।
লেখকের আইডি – #সালাহউদ্দিন_তারিক
উনি আসার আগে বাকি ২০ মিনিটে ডেট বডি থাকা ঘর পুরোটা তল্লাশি করা হয়। জরুরি কাগজ পত্রের সাথে সাথে ফ্রিজ ও অন্যসব জিনিসও খুঁটিয়ে দেখেন ওনারা। সাধারণত বাংলাদেশ পুলিশরা ঘটনাস্থল তেমন পরীক্ষাই করে না। আসে, লোকজনের সাথে কথা বলে, এলাকার মেম্বার ও অন্যসব সম্মানিত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে। তারপর লাশ নিয়ে চলে যায় পোস্টমর্টেম করার জন্য। তবে এদিকে একটু আলাদা আজিজুর রহমান স্যার। এই ঘটনা ওনার হৃদয়েও একটুখানি আঘাত করেছে। তাই সবাইকে তাগাদা দিল ভালো করে সব পরীক্ষা করার জন্য।
সহকর্মীরা সব দেখা শেষ করলেন ১০ মিনিটের মধ্যে। তারপর বাইরে উঠোনে চলে আসলেন সবাই। বাইরে কেউ মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। তবে পুরো উঠোন আলোকিত করার জন্য বাইরের সল্প আলোর বাতিটিও জ্বালানো হয়েছে।
এলাকার বেশকিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়েছেন, উপস্থিত হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সাহেবও। সবার একটাই মতামত, এই নবদম্পতি সম্পর্কে তারা কেউই তেমন অবগত নন। তারা এই এলাকার না, কেবল ভাড়া থাকে হিসেবেই জানেন। তাদের বাড়ির পরিবার পরিজনের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় পেলেন না এস আই আজিজ সাহেব।
ততক্ষণে বাড়িওয়ালা এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। ঘেমে একাকারা হয়ে আছে বয়ঃজ্যোষ্ঠ এই ব্যক্তিটির চেহারা। ওনার ভিতরে কি অবস্থা হচ্ছে তা ওনার চেহারা দেখেই আন্দাজ করা সম্ভব। ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে হলো না ওনাকে। এলাকার প্রায় সবাই ই ওনাকে চিনেন। তাই দেখা মাত্রই সবাই জায়গা করে দিলেন ভিতরে যাওয়ার জন্য। উনি ভিতরে গিয়ে দাঁড়াতেই মেম্বার সাহেব ওনাকে এস আই আজিজ স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ইনি হচ্ছেন লোকমান হোসেন সাহেব, এই বাড়ির মালিক উনিই। এখানে যে বিশাল জমি দেখছেন সামনে এটাতে বড় ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করবেন উনি। এজন্য এসব দেখাশোনা করার জন্যই ছোট এই ঘরটি বানিয়ে ছিলেন।”
এস আই আজিজ সাহেব ওনাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলেন। লম্বা পাঞ্জাবি পরিহিত ধবধবে ফর্সা পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক। সহকর্মীকে নির্দেশ দিলেন হিস্ট্রি লেখার জন্য। নাম, বয়স, ঠিকানা এসব কিছু নেওয়ার পরে ডেট বডি সম্পর্কে ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন আজিজ স্যার।
বাড়িওয়ালা লোকমান সাহেব এমনিতেই ঘেমে আছেন। পকেট থেকে একটা টিস্যু নিয়ে আগে নিজের চেহারা মুছে নিলেন। তারপর শুরু করলেন সব বর্ণনা দেওয়া, “প্রায় ৩ মাস আগে একটা ছেলে আমার কাছে আসে বাড়ি ভাড়ার জন্য। সে না-কি তার এক বন্ধুর কাছে আমার এই বাড়ির কথা শুনেছিল। এখানে ভাড়া কম দিতে হবে আর তার-ও ইনকাম কম। এজন্য অনুরোধ করল যেন তাকে ভাড়া দেই। ছেলেটাকে দেখে ভালোই মনে হল। সিগারেট ছাড়া অন্য কোনো নেশার প্রতি তার ঝোঁক আছে মনে হয়নি। আমিও এমন লোকই খুজছিলাম। তাই ওকে জিজ্ঞেস করি কাকে নিয়ে থাকবে। সে বলেছিল যে নতুন বিয়ে করেছে আর এখন যে কোম্পানিতে কাজ করে সেটা এখান থেকে কাছে হবে বিধায় বউ নিয়ে চলে আসবে। আমি বিয়ের কাবিননামা দেখি। ওই ছেলের ও তার বাড়ির লোকের আইডি কার্ডের ফটোকপি এমনকি তার বউয়ের আইডি কার্ডের ফটোকপি ও নিই। এই যে এগুলোই।”
এক নিঃশ্বাসে এই সবগুলো কথা শেষ করে মানিব্যাগ থেকে ৩ টা কাগজ বের করে দেন তিনি। আজিজ সাহেব কাগজগুলো ভালো করে দেখে সেগুলোর ঠিকানাও নোট করে নেন।
তারপর কাগজ গুলো সহকর্মীর হাতে দিয়ে দেন বিবরনের কাগজের সাথে রেখে দেওয়ার জন্য। কাগজ গুলো যত্নের সাথে রেখে বাড়ি ওয়ালার আছে ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু বলতে বলেন।
লোকমান সাহেব আবারও একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে থাকেন, ‘ভাড়া দেওয়ার পরে মাত্র ৩-৪ বার আসছিলাম এখানে। সর্বশেষ এসেছিলাম মনে হয় ২২ দিন আগে। তখন ছেলেটার চেহারাটা আগের মতো ছিল না। দাঁত, ঠোঁট দু’টোরই রং কালচে হয়ে গেছে। গাল ভেঙে ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে। আমার মনে হলো সে সিগারেটের বাইরে অন্য নেশাও শুরু করেছে। কিন্তু তার বউটা খুব ভালো মেয়ে ছিল। আমাকে অনেক সুন্দর করে রান্না করে খাইয়েছিল। সাংসারিক ভাবে ওদের মধ্যে তেমন কোনো ঝগড়াঝাটি আমার নজরে আসেনি, আর আসার কথাও না যেহেতু মাসে ১বার দেখি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।”
আজিজ সাহেব প্রয়োজনীয় কথা গুলো সহকর্মীকে দিয়ে নোট করিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। বাড়িওয়ালার সাথে হ্যান্ডসেক করে বললেন, ‘আপনার সোজা সাপটা কথাগুলো ভালো লেগেছে। কিন্তু প্রথমে আপনার ঘাম দেখে তো ভাবলাম আপনিও হয়তো কোনো অঘটন ঘটিয়েছেন।”
লোকমান সাহেব কষ্ট করে একটু হেসে বললেন, “স্যার কি যে বলেন। এতো বড় কান্ড হয়ে গেছে আমি যে স্ট্রোক করিনি এটাই আল্লাহর হাজার দয়া।”
আজিজ সাহেব ওনার কাঁধে হাত রাখলেন। দুইবার চাপড় মেরে বললেন, “চিন্তা করবেন না। ঠিকানা যেহেতু পেয়ে গেছি এবার এর একটা রফাদফা করে ফেলব খুব তাড়াতাড়িই। আপনার ভয়ের কিছু নেই।”
লোকমান সাহেব কেবল লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন।
আজিজ সাহেব তার সহকর্মীদের হাতে ইশারা করলেন লাশ গাড়িতে তোলার জন্য। সিএনজির পিছন থেকে একটা বড় বস্তা এনে লাশটা উঠিয়ে সেটার উপরে রাখল ২ জন মিলে। তারপর আবারও একসাথে দু’জনে ধরে লাশটা টেনে হিঁচড়ে তুলতে লাগলেন সিএনজির পিছনে।
জমাট বেঁধে যাওয়া র*ক্তের এক ফোঁটাও বের হলো না বস্তার নিচে দিয়ে। বস্তায় উপরেই লেপ্টে গেল সেসব।
লাশ নিয়ে চলে গেলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আইডি কার্ডে থাকা ঠিকানা অনুযায়ী মেয়ে ও ছেলে উভয়ের বাড়িতেই পৌঁছে দেওয়া হলো খু*নের খবর।
নিজের একমাত্র বোনের খু*ন হয়েছে শুনে ভাইয়েরা চিৎকার জুড়ে দিল। মা গানের সুরে সুরে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু তার বাবা তখনও শক্ত হয়ে বসে রইল কাঠের চেয়ারটাতে। ওনার চোখে কোনো পানি নেই, মুখে শব্দ নেই, চেহারায় নেই কোনো শোকাবহ বেদনাদায়ক ছাপ…..।
( চলবে…)
#আড়ালে_কে [ পর্ব – ০৬ ]
#লেখক — সালাহউদ্দিন তারিক (জুনিয়র মুগলি )
. #গল্প — #আড়ালে_কে – [ #পর্ব – ০৭ ]
#লেখক : #সালাহউদ্দিন_তারিক [ জুনিয়র মুগলি ]
ফোনে প্রেমিকের সাথে কথা বলছে সোহানা। এমন সময়ই বারান্দায় উঠে নাদিয়া। ভাবীর প্রতি আগে থেকেই তার সন্দেহের দৃষ্টি আছে, এজন্য ফোনে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনতেই পা টিপে টিপে ঘরের দরজায় কাছে এসে দাঁড়ায়। বেশিক্ষণ লাগে না মামলা বিষয়ক গোপন কথাটা শুনতে। রাগে তার মাথা গরম হয়ে যায়। এতো বড় সাহস কি করে হয় যে তার ভাইয়ের নামে মামলা করে! নাদিয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ভাবীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সবগুলো কথা শোনার জন্য। সোহানা কল কাটতেই আবারও পা টিপে টিপে বারান্দা বারান্দা পেঁড়িয়ে সিঁড়িতে চলে যায় সে। জোরে জোরে শব্দ করে হাঁটে সিঁড়ির উপরে। ইচ্ছে করেই এমন করে যেন তার ভাবীর কান অবধি এই শব্দ যায়, আর সে বুঝে নাদিয়া এই মাত্রই আসতেছে।
বারান্দায় উঠে জুতা দু’টো পরিষ্কার করার ভঙ্গিতে একে অপরের সাথে বাড়ি দেয় যেন এই শব্দটাও তার ভাবীর কানে যায়। নাদিয়া এসে পরেছে বুঝতে পেরে মোবাইল ফোন রেখে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নেয় সোহানা। নাদিয়াকে সে জমের মতো ভয় পায়। তার কারণ একটাই, নাদিয়া হচ্ছে তার ভাইয়ের তথা নাজমুল সাহেবের কলিজার টুকরো থেকেও বেশি কিছু। নাজমুল সাহেবের জন্মের অনেক বছর পরে জন্ম হয় নাদিয়ার। ছোট থেকেই তাকে অনেক আদর করেন নাজমুল সাহেব। আর নাদিয়াও ভাইয়ের জন্য জান প্রাণ। তার এমন কোনো কথা নেই যা সে ভাইয়ের সাথে শেয়ার করে না। এজন্য নাদিয়ার থেকে পুরোপুরি লুকিয়ে কথা বলতে হয় সোহানাকে।
নাদিয়া নিজের রাগান্বিত চেহারাটা প্রকাশ করে না সোহানার সামনে। মনে মনে শুধু ভাবে, আরেকটু অপেক্ষা কর কালসা*প, ভাইয়া বাসায় এসে নিক। এতো ধুমধাম করে ৩ লাখ টাকা কাবিন দিয়ে তোকে বিয়ে করে আনছে। আর তুই আরেক পোলার লগে ফস্টি*নস্টি করে এখন ভাইয়ার নামে মামলা করিস। তোর তো দুই পা দু’দিকে টে*নে ছিঁ*ড়ে ফেলা উচিত।
এমন হাজারো কথা চিন্তা করতে করতেই হাত-মুখ ধুয়ে নেয় নাদিয়া। পরনের ইউনিফর্ম পাল্টে বাড়ির সাধারণ পোশাক পরে নেয়।
বিকালের সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তে শুরু করেছে। নাদিয়ার কিছুই ভালো লাগছে না। ভাইয়া কখন বাড়িতে আসবে, আর কখন সোহানাকে শাস্তি সেই অপেক্ষায় সময় গুনছে সে।
সন্ধ্যার পরেও পড়াতে মন বসে না তার, বারবার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরে। বিয়ের আগে তার মা’কে সে-ই সবার আগে বলছিল যে সোহানা কে তার পছন্দ হয়েছে। তার পছন্দের কারণেই সবাই এতো গুরুত্ব দিয়েছে তাকে। নাদিয়ার এখন নিজেকে দোষী মনে হতে থাকে। ভাবে তার জন্য ই তো ভাইয়ার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। রাগে তার মনে চায় যে সবকিছু ভেঙে ফেলতে চায়। মাথার যন্ত্রণায় পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে শুয়ে পরে বিছানায়। নিজের মা কে বলে রাখে তার ভাইয়া আসলেই যেন ডেকে দেওয়া হয় তাকে।
রাত ৯:৩০ এর দিকে ঘুৃম ভাঙে নাদিয়ার। চোখ খুলতেই দেখতে পায় নাজমুল সাহেব তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে উঠে বসে দ্রুত, ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, ‘তুমি কখন আসছ ভাইয়া?’
নাজমুল সাহেব তখনও ছোট বোনের মাথায় আদরের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো বলে, ‘তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ! বইখাতা কিভাবে ফেলে রাখছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আবার শুনলাম সন্ধ্যার সময়েই ঘুমিয়ে গেছিস আমি আসলে ডেকে দেওয়ার কথা বলে।”
নাদিয়া হাত মাথা থেকে ভাইয়ের হাতটা নিজের মুঠের মধ্যে নেয়। তারপর কাচুমাচু করে বলে, “স্যরি ভাইয়া তুমি আমাকে মাফ করে দিও। আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।”
নাজমুল সাহেব অবাক হয়ে যায় নাদিয়ার কথা শুনে। আবারও প্রশ্ন করে, ‘কি হয়েছে তোর আমাকে বলতো?’
‘ ভাইয়া, কিভাবে কি বলব বুঝতে পারছি না। আব্বু আম্মু জানলে কি যে হবে আমি কল্পনা করতে পারছি না। তুমি জানো ঐ কালসা*প কি করেছে?’
‘ কালসা*প আবার কে! ‘
‘ যেই কালনা*গিনী কে আমি ভাবী হিসেবে পছন্দ করছিলাম। ঐ ডাই*নির কথা বলতেছি।’
‘ মানে! কি করছে তোর ভাবী?’
নাদিয়া একটু উঁকি দিয়ে দেখে নেয় আর কেউ তাদের ঘরের দরজার কাছে আছে কি-না। তারপর ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, ‘তুমি অফিসে যাওয়ার পরে এই মেয়ে তোমার নামে মামলা করে আসছে থানায় গিয়ে।’
‘ মামলা! কিসের মামলা! ‘ চমকে উঠেন নাজমুল সাহেব।
‘ হুম মামলা, নারী নির্যাতনের মামলা করে আসছে।’
‘ কি বলিস এসব! তুই কোথায় শুনছিস। ‘
‘ নিজের কানে তাকে বলতে শুনছি তার কোন প্রেমিকের সাথে। ‘
‘ কখন শুনছিস? ‘
‘ স্কুল থেকে ঘরে ঢুকেই। আমি আসার শব্দ পায়নি, ভাবছিল আব্বু আম্মু তো ঘুমাচ্ছেই। মনের সুখে কথা বলতেছিল নিশ্চিন্তে, আমি চুপি চুপি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছি। কি মিষ্টি করে কথা বলতেছিল, আমার মন চাইছিল তখনই মাথাটা ফা*টিয়ে দেই ওই ডাই*নির।”
নাদিয়ার মুখে সব শুনে রাগে দাঁত কিরকির করতে থাকেন নাজমুল সাহেব। তবুও ছোট বোনের সামনে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই কিছু চিন্তা করিস না লক্ষীটি। আর মন খারাপ করিস না, ওর একটা ব্যবস্থা করব আমি। ‘
নাদিয়ার মন শান্ত হতে চায় না। উল্টো ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে সে। সারাদিনের আটকে রাখা কষ্ট সব লোনা জল হয়ে নাজমুল সাহেবের টি-শার্টে মিশে যেতে থাকে। অঝোরে কাঁদতে থাকে নাদিয়া, আর নাক টেনে টেনে বলতে থাকে, ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও ভাইয়া।’
নাদিয়ার কান্না কখনোই সহ্য হয় না নাজমুল সাহেবের। পরম আদরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওনার নিজের চোখেও পানি চলে আসতে চায়। কোনো রকমে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে বোনের কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে আসেন সেখান থেকে। নিজের রুমে না ঢুকে সোজা ছাদে চলে যান তিনি। নিরবে কতক্ষণ কাঁদতে মনে চায় ওনার। কিন্তু এখন কেন জানি আর কান্না আসে না ওনার। কেবল রাগে শরীর জ্বলতে থাকে। মনে মনে স্বীদ্ধান্ত নেয়, ডাই*নি হ্যাঁ! আমার নামে মামলা করা হয়েছে! তোর যে কি দশা করব তুই নিজেও বুঝতে পারবি না।’
.
লেখকের আইডি – #সালাহউদ্দিন_তারিক
অনেকক্ষণ ছাঁদে থাকার পর নিচে আসেন নাজমুল সাহেব। সোহানা তখন টেবিলে খাবার সাজায়। সবাই খেতে বসে কিন্তু নাদিয়া আসে না। নাজমুল সাহেব নিজে উঠে গিয়ে ডেকে আনেন তাকে। নিজের পাশের চেয়ারে বসান খাওয়ার জন্য। অল্প কয়টা খেয়েই উঠে পরে নাদিয়া। এতে করে নাজমুল সাহেব বাঁকা চোখে তাকাতেই বলে, ‘পেট ভরে গেছে ভাইয়া, আর খাব না। ‘
আর কিছু বলেন না তিনি। ঘাড় নেড়ে বুঝান, ‘আচ্ছা যা তবে।’
খাওয়া শেষে সেখানে বসেই নাজমুল সাহেব জানান, ওনার অফিসে নতুন কাজের চাপ পড়েছে। তিনি এখন এতো দূর থেকে এসে গিয়ে অফিস করাটা কষ্ট হয়ে যাবে। বাড়তি আরো দু’ঘন্টা অফিস করতে হবে ওনাকে। এজন্য ঠিক করেছেন যে অফিসের কাছেই কোথাও একটা বাসা ঠিক করে চলে যাবেন।
ওনার বাবা-মা প্রথমে অনুমতি দিতে না চাইলেও পরে বাধ্য হোন অনুমতি দিতে। চিন্তা করেন দৈনিক ৪ ঘন্টা রোড জার্নি করা, আবার অফিসের এতো কাজের চাপ। ওনার আসলেই অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে যান তারা। সোহানার এটা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়। সে অনেক ভয় পেয়ে যায় যে ওখানে একা বাসাতে ওর সাথে কি কি হতে পারে তা কেউ জানে না। কিন্তু যেখানে তার শশুর শাশুড়ী রাজী হয়ে গেছে সেখানে তার আর কিছুই করার নেই। সে যথেষ্ট বুঝানোর চেষ্টা করে যে, সে চলে গেলে ওনাদের দেখাশোনা কে করবে। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয় না, ওনারা উল্টো বুঝান যে ওনাদের ছেলের কতটা কষ্ট হচ্ছে। সোহানা বাধ্য হয়ে হার মেনে নেয়। চুপচাপ উঠে ঘরে চলে যায়। নাজমুল সাহেব বাবা-মার সাথে কথা বলা শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখেন সোহানা বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পরেছে। গত রাতের ঘটনার পরে ভয়ে আজ আর বিছানার মাঝখানে বালিশ দেওয়ারও সাহস করেনি সে। নাজমুল সাহেব কতক্ষণ একটা উপন্যাসের বই পড়েন বিছানার এক কোণে বসে। টানা আধা ঘন্টা বই পড়া শেষে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় উঠেন। সাদা আলোর বাতিটা নিভিয়ে নীলচে আলোর ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দেন। নীলচে আলোতে সব কিছু কেমন যেন রোমান্টিক আর চোখ ধাধালো মনে হয়। সোহানার চেহারাটা নীল আলোতে অনেক লাবন্যময়ী লাগে ওনার কাছে। একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। কেমন যেন একটা অজানা মায়া অনুভব করেন তার প্রতি। নিজের মাথাটা অনেকটা ঝুকিয়ে আনেন সোহানার চেহারার কাছে।
তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রেমিকের মতো মায়াবী স্বরে বলেন, ” তোমাকে ভালোবাসি সোহানা। অনেক ভালোবাসি।’
সোহানা তখনও ঘুমায়নি। অপেক্ষা করছিল নাজমুল সাহেব আগে ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য। কানের কাছ থেকে মায়াবী স্বরে ভালোবাসার কথাগুলো তার শরীরের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়। এক অজানা শিহরণ জাগে তার মধ্যে। তবুও একদম স্থির হয়ে শুয়ে থাকে সে। নাজমুল সাহেবকে বুঝতে দেয় যে, সে এখন ঘুমাচ্ছে।
নাজমুল সাহেব আরো কতক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে থাকেন সোহানার দিকে। তারপর উল্টো দিকে ফিরে ঘুমিয়ে যান। সোহানা এজন্যই অপেক্ষা করছিল। সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরে খুব আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যায় সে। মোবাইল আর ইয়ারফোনটা টেবিলের উপর থেকে নিয়ে পা বাড়ায় গোসলখানার দিকে।
গোসল খানায় মোবাইল নিয়ে ঢুকার পিছনে একটা উদ্দেশ্যই ছিল তার। সকালে প্রেমিককে কথা দিয়েছিল রাতে তার অনেক কাছে যাবে। সেই কাছে যাওয়া মানে যে গভীর রাতে গোসলখানায় গিয়ে ভিডিও কল দেওয়া সেটা খুব কম মানুষই বুঝতে পারবে। নাজমুল সাহেবের প্রতি ভয় থাকা স্বত্তেও প্রায় ২০ মিনিট গোসলখানায় থেকে ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ অবস্থা কাটায় সোহানা। তারপর খুব সাবধানতার সাথে ইয়ারফোনটা লুকিয়ে নেয় কাপড়ের ভিতরে। মোবাইল ফোনটাও একটা সুরক্ষিত জায়গায় লুুকায় নিজের শরীরেই। এরপর আস্তে করে গোসলখানার প্লাস্টিকের দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখে। দ্বিতীয় পা টা বাইরে রাখতেই সে দেখতে পায় নাজমুল সাহেব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকেই তাকিয়ে আছে কটমট করে।
আত্মা শুকিয়ে যায় সোহানার। তার বুক ধুর ধুর করতে থাকে। বুুকের ভিতরে কেবল একটা কথাই বাজছে। ”কি হবে এবার!’
[ চলবে ইন শা আল্লাহ ]
#আড়ালে_কে [ পর্ব -০৭ ]
#লেখক — সালাহউদ্দিন তারিক