আতর তৃতীয় ও শেষ পর্ব

0
467

রহস্যগল্প #আতর তৃতীয় ও শেষ পর্ব

পরদিন সকালে অফিসে বসে ছিলাম প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে। শামিনের আসার কথা। কাল রাতে ওর কি হয়েছে সব পরিষ্কার করে জানা দরকার। কানে এখনও বাজছে শামিনের ভয় মেশানো কন্ঠ, সোহেল তোর ভাবী আমাকে গলা টিপে ধরছিল, আমার গাঁ থেকে নাকি উৎকট আতরের গন্ধ আসছে।

কি ভয়ংকর! ও আসলে জানা যাবে পুরো ঘটনা।

শামিন আমার রুমে ঢুকতেই তীব্র আতরের ঘ্রাণ পেলাম। মনে হলো এই ঘ্রাণে পাগল হয়ে যাব। আমার টেবিলের পেপার ওয়েট তুলে নিলাম, ঘ্রাণের উৎসে আঘাত করতেই হবে, তাতে যদি এই ভয়ংকর ঘ্রাণ আসা বন্ধ হয়ে।
শামিন আমার অবস্থা বুঝে চট করে এসে আমার হাত চেপে ধরল, তারপর তার বাঁ হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে আমার কপালের ডান পাশে চাপ দিয়ে বলল, সোহেল শান্ত হ। সবকিছু ঠিক আছে। আতরের গন্ধ আর নেই। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।

আমার শরীর ঝাঁকি খেয়ে আতরের গন্ধ চলে গেল। আমি আর কোন আতরের গন্ধ পাচ্ছি না শামিনের শরীর থেকে। শামিনের দিকে তাকালাম। সে ক্লান্ত হয়ে আমার সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। বলল, চা আনা। চা খেয়ে আগে চাঙ্গা হই।

সত্যি বলতে আমি জানতাম শামিন বেশ ভালো মানের সাইকোথেরাপিস্ট কিন্তু সে একটু আগে যেভাবে আমাকে কন্ট্রোল করল আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

বললাম, দোস্ত তুই তো দারুন দেখালি। আমি তো আর একটু হলে তোকে মেরেই বসেছিলাম। বাপরে বাপ! ওই ব্যাটা কি যাদু করছে রে! ভাবীর কি অবস্থা?

শামিন বিরক্ত হয়ে বলল, তোর ভাবী ঠিক আছে এখন, তোর মতোই তাকেও ঠিক করে ফেলেছি। এগুলা যাদু না, এক ধরনের অটো সাজেশন। খুব শক্তিশালী। খেয়াল করে দেখবি আতরের ঘ্রাণে যারা অগ্রাসী হয়ে যাচ্ছে তারা সবাই এই আতর সম্পর্কে আগে থেকে জানে। আমি আমার স্ত্রীকে এই আতরের ঘটনা খুলে বলেছিলাম, ওইটাই আমার ভুল। অচেনা কেউ কিন্তু আতরের ঘ্রাণে অগ্রাসী হচ্ছে না। আসলে অচেনা কারো উপর এই ঘ্রাণের কোন প্রভাব নেই।

–কি বলিস! প্রথম দশদিন আমার যে এতো এতো ভালো সংবাদ সেগুলো তো এই আতরের প্রভাবে।

–ধুর! ভালো সংবাদগুলো বিশ্লেষণ কর। দেখবি ওইগুলো এমনিতেই হতো। তোর জিএম এমনিতেই গাড়ি স্যাংশন করত, বহুত দিন পেন্ডিং ছিল আর তুই ভালো এমপ্লয়ি। রহমত ভাইয়ের ব্যাপারও একই। আতরের কারন তোর মনে হচ্ছে এই গুলো আলাদা ঘটনা। মোটেই তা না।

শামিনের কথা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু ওর কথা না মেনেও উপায় নেই। এই বিষয়ে যে সে বস সেটা একটু আগেই প্রমাণ করেছে।

শামিন বলল, ওই লোককে ডাক আবার। আমার উপর যে বাটপারিটা সে করল সেটা নিয়ে তার সাথে কথা বলা দরকার।

বললাম, বাদ দে দোস্ত। এই ঝামেলা আবার ডাকার দরকার কি? কোন বিপদ বাঁধায় কে জানে!

শামিনের চোখে রাগ দেখলাম। বলল, কি ঝামেলা করবে? ওর আর কি ক্ষমতা ? আমি আছি না?

কিন্তু তাকে কিভাবে খবর দেই? মনে পড়ল আতরওয়ালা প্রথমদিন একটা কাগজে তার নম্বর লিখে দিয়ে গিয়েছিল, যদি তাকে লকার দিতে রাজি হই তাহলে যাতে ফোন দেই আমি।

আমার ড্রয়ার খুঁজে নম্বর লেখা কাগজ বের করলাম।

লোকটা ফোন ধরেই বলল, স্যার কেমন আছেন?

আমি বিস্মিত হলাম না। ওই লোক নিশ্চয়ই আমার ফোন নম্বর নিয়ে তার মোবাইলে সেভ করে রেখেছে। মারাত্মক চালু লোক।
বললাম, ভালো আছি ভাই। আপনি কি এখন একটু আসতে পারবেন আমার অফিসে? দেখি আপনার জন্য একটা লকারের ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

লোকটা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, না স্যার, আপনার সামনে আপনার বন্ধু আছে, উনি আমার উপর খুবই রাগ। আমি আসলে উনি আমার ক্ষতি করতে পারে।

ব্যাটা ঠিকিই আন্দাজ করছে যে আমার সামনে শামিন বসা। বললাম, ভাই আপনার কোন ক্ষতি করবে না ও। আসলে আপনি আতর নিয়ে যে যাদু দেখিয়েছেন সেটাতে আমরা মুগ্ধ। ওই আতর নিয়েই শামিন কথা বলতে চায় আপনার সাথে। আপনি কিভাবে আমাদের এই রকম পাজলড করলেন সেটা জানার কৌতুহল ছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নাই। আপনি যদি আসেন আমি কথা দিলাম আপনাকে একটা লকারের ব্যবস্থা করে দিব আমি।

লোকটা একটু চুপ থেকে বলল, ঠিক আছে স্যার আসতেছি।

আমি তাকে সত্যি কথাই বলেছি, মনে মনে ভেবে রেখেছি লোকটাকে একটা লকার আমি দেব । এই আতর এর গুনাবলী যদি কিছু কাজে লাগানো যায় লোকটার মাধ্যমে খারাপ কি! তাছাড়া সবকিছু জানার একটা প্রচন্ড কৌতুহলও হচ্ছে।
.

লোকটা আমার রুমে ঢুকে শামিনের দিকে একবার শান্ত চোখে তাকিয়ে সোফায় বসল। আমি শামিনের দিকে তাকিয়ে দেখি সে রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করছে। কাল রাতের ঘটনা তার ইজ্জতে গিয়ে লেগেছে মনে হচ্ছে। একজন প্রখ্যাত সাইকোথেরাপিস্টের উপর এক সাধারন লোক হিপনোটিজম চালিয়েছে সেটা অবশ্য খুব ভালো খবরও না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই আপনি কাল শামিনের শরীরে কেন আতর লাগালেন? আর ওর উপর তো প্রথম দশদিন ভালো প্রভাব পরার কথা, সেটা না হয়ে কেন প্রথম থেকেই খারাপ প্রভাব শুরু হলো?

— স্যার উনি আমাকে কেন ঘুম পড়ালেন বলেন তো? আমি কি করছি? ওই জন্য আমি আতর লাগায় দিছিলাম তার কাঁধে। এই আতরের নিয়ম হলো একসাথে পর পর দুইবার লাগানো যাবে না, তাহলে প্রথম থেকেই উল্টো ফল হওয়া শুরু করে। উনাকে আমি দুইবার আতর লাগিয়ে দিয়েছি।

শামিন বলল, দেখ এইসব বুজরুকি আমার ভালো করে জানা আছে। আতরে কাজ হয় না ছাই হয়। তুমি আসলে আমার উপর কোন অটো সাজেশন এপ্লাই করছ। কিভাবে করছ সেটা বলো।

আতরওয়ালা একটু চুপ থেকে বলল, স্যার আপনি কি সব বলছেন আমি জানি না সেটা। এই আতর বহু বছর ধরে আমাদের বাসায় ছিল। আমাদের এক পুর্ব পুরুষ আতরটা মিশর থেকে আনিয়েছিল। উনি এই আতর ব্যবহারের নিয়মগুলো বলে গেছে। বংশের খুব অল্প মানুষই ব্যবহার করেছে এই আতর, অনেকেই বিশ্বাস করেনি অনেকে সাহস করেনি। আমার এক চাচা ব্যবহার করতেন কিছুদিন উনি আমাকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে ব্যবহার করতে হয়।

আমি দেখলাম শামিন রেগে যাচ্ছে। আসলে তারমত একটা ডাক সাইটে হিপনোটাইজারকে একটা অল্প শিক্ষিত লোক নাকানি চুবানি খাইয়েছে এটা সে মানতে পারছে না। সে রাগের গলায় বলল, ফালতু কথা বলবা না একদম। আতরের আবার কি কেরামতি! তুমি আসলে খুব ভালো হিপনোটাইজার। আমি স্বীকার করছি সেটা। কিন্তু আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশী মাইন্ড কন্ট্রোলের ক্ষমতা রাখি , তোমাকে হিপনোটাইজ করা আমার জন্য ডাল ভাত, কালই দেখিয়েছি সেটা। সমস্যা হচ্ছে আমার মধ্যে ভন্ডামি নেই, শুধু শুধু আতরের নামে এইসব চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা ভন্ডামি ছাড়া আর কি।

না স্যার আমি হিপনটাইজ না কি বলছেন ওইসব কিছু পারি না, আমি শুধু মানুষরে না জানায়ে তার শরীরে আতর লাগায় দিতে পারি। আমার চাচা আমারে শিখাইছে এটা। বাকি কাজ আতর করে।

শামিন বলল, দেখি তোমার আতরের বোতলটা।

লোকটা একটু ইতস্তত করে নীল রঙয়ের আতরের শিশিটা বের করে টেবিলের উপর রাখল।

প্রথম দেখায় মনে হলো একটা সাধারন আতরের শিশি এটা। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় এর নীল রঙয়ের কাঁচ একটু অন্য ধরনের। ক্রিস্টাল টাইপ। বোতলের ছিপিটা অদ্ভুত। কোন একটা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি। বহু পুরান দেখলেই বোঝা যায়।
কি কারনে জানি না শামিন শিশিটার দিকে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে বলল, এই ফালতু আতর দিয়ে তুমি গল্প ফেঁদে ভালই মানুষ ঠকাচ্ছ।

এইবার আতরওয়ালার মুখ কুঁচকে গেল। বলল, স্যার কিছু মনে করবেন না, আপনি মানুষটা ভালো না, আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আর এই আতরকে ফালতু কেন বলছেন? আপনি কাল আমাকে ঘুম পড়ায়ে ক্ষমতা দেখাইছেন আমিও সেজন্য আতর লাগায় দিছিলাম আপনার গাঁয়ে। ব্যস! কাটাকাটি। খামাখা আতর আর আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলবেন না। যা বোঝেন না ওই নিয়ে কথা বলা উচিৎ না।

শামিন প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে হুংকার দিয়ে উঠে দাঁড়াল, এতো বড় সাহস, দুই পয়সার ফুটপাতের লোক আমাকে অপমান করে!

আমি বাঁধা দেয়ার আগেই সে টেবিল থেকে আতরের শিশিটা নিয়ে ফ্লোরের উপর আছড়ে ভেঙ্গে ফেলল। আতরওয়ালা হাউমাউ করে উঠল। তারপর ছুটে আমার রুম থেকে বের হয়ে গেল।

আতরের শিশি থেকে রক্তের মতো লাল রঙের আতর মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল, তারপর একটা ঝাঁঝাল ঘ্রানে আমার রুম ভরে যেতে লাগল। শামিনের দিকে তাকিয়ে দেখি সে একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে আবার আমার সামনের চেয়ারে বসে পড়েছে। আমি হতাশ হয়ে শামিনকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তখন আতরওয়ালা ছুটে আবার আমার রুমে ঢুকল, আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সে আমাকে রুম থেকে বের করে ফেলল। তারপর আমার রুমের কাঁচের দরজা আটকে দিল।

আতরওয়ালা আমাকে আমার রুমের সামনের সোফায় বসিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তখন খেয়াল করলাম আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে। হঠাৎ মনে হলো আমার চারপাশে কুয়াশার মতো কিছু ঘিরে ধরেছে। চেষ্টা করছি কিন্তু কথা বলতে পারছি না। ভয়াবহ আতংক নিয়ে লক্ষ্য করলাম প্রাণপণ চেষ্টাতেও শরীরের কোন অংশ নড়াতে পারছি না।

আতংকে যখন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ করেই আবার আতরওয়ালার কন্ঠ শুনলাম। শান্ত গলায় সে বলছে, একটু রেস্ট নেন স্যার। অল্পের উপর বিরাট বাঁচা বেঁচে গেছেন। আমাদের পূর্ব পুরুষ বলে গেছেন এই বোতলের পুরা আতরের ঘ্রাণ কখনও নাক দিয়ে না টানতে, আতর যদি কখনও পড়ে যায় সেখান থেকে সরে যেতে কারন এই বোতলের আতর দ্রুত বাতাসে মিশে যায়, ওই বাতাস বেশী পরিমানে কারও নাকে ঢুকলে সে বেঁচে থেকেও মরে যাবে। সবকিছু দেখবে শুনবে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না, চলাফেরা করতে পারবে না।

আমি আতঙ্কিত হয়ে কাঁচের পার্টিশনের ভিতর দিয়ে আমার রুমের ভিতর তাকালাম। শামিন এখনো আমার চেয়ারে বসা আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে সে হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

.

এর মাস দুই পরের কথা। অফিসে বসে সেদিনের পত্রিকা দেখছি। পত্রিকার মাঝের পাতায় একটা খবর এসেছে ,দেশের প্রখ্যাত সাইকোলজিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট শামিন চৌধুরি অজানা অসুখে জীবন্মৃত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছেন অনেকদিন। পত্রিকায় লিখেছে, শামিন চৌধুরির অসুখের কোন ধরন ডাক্তাররা ধরতে পারছেন না। তার শরীরের সব অর্গানগুলোই কাজ করছে ঠিকঠাক মতো , বোঝা যাচ্ছে তিনি চারপাশের সব কিছু বুঝতে পারছেন, সবার কথা শুনতে পারছেন কিন্তু রেসপন্স করতে পারছেন না। তার পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশ নেয়ার চেষ্টা করছেন।

আমি আনমনা হয়ে গেলাম শামিনের কথা ভেবে। বেচারা হিংসাত্মক হয়ে কি চরম মূল্যই না দিচ্ছে এখন। আতরওয়ালা বলেছে শামিন এই অবস্থা থেকে ফিরবে কিনা সে জানে না। হয়ত দেখা যাবে হঠাৎ একদিন সে স্বাভাবিক হয়ে যাবে, আবার নাও হতে পারে কোনদিন। কি হবে কেউ বলতে পারে না।

( এই গল্পটা আমি দ্বিতীয় পর্বেই শেষ করেছিলাম। কিন্তু অসংখ্য পাঠক আর এক পর্ব লেখার অনুরোধ জানিয়েছেন। সেজন্য এই পর্ব লেখা। কেমন লাগল জানাবেন।)

লেখক খোন্দকার মেহেদী হাসান
Khondokar Mahedi Hasan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here