#আত্নকথন
#লিখা- Nusrat Khan Ani
– মা জানো, আমার শ্বশুরবাড়িতে কেউ দুধ চা খায় না। সবাই গ্রীন-টি খায়। ওদের দেখাদেখি আমারও এখন গ্রিন-টি’র অভ্যেস হয়ে গেছে।
আমার ছোট মেয়ে নিপার কথা শুনে আমি রান্না থেকে মনোযোগ সরিয়ে তার দিকে তাকালাম;
– গ্রীন-টি’র দাম কত?
নিপা ঘুরে দাঁড়িয়ে ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিতে নিতে উত্তর দিল;
– কম দামেরও আছে, বেশি দামেরও আছে। যার যেটা পছন্দ আর কি।
আমি শুকনো মুখ করে আবার রান্নায় মন দিলাম। নিপা তখন জিজ্ঞেস করলো,
– শাড়িগুলো তোমার পছন্দ হয়েছে মা?
তরকারিতে পরিমাণমতো লবণ ছিটিয়ে দিয়ে আমি নিপার দিকে আড়চোখে তাকালাম;
– তুই কিন্তু এখনো বলিস নি, শাড়িগুলো তোকে কে কিনে দিয়েছে।
নিপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললো,
– দেখো মা, বছরে দু’তিনবার হলেও আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের মুখোমুখি হতে হবে তোমাদের৷ তোমার কম দামী শাড়িগুলোতে তখন আমার মুখ ছোট হয়ে যাবে।
আমি বিস্মিত স্বরে নিপাকে বললাম,
– তাই বলে তুই জামাইয়ের টাকা দিয়ে আমাকে দামী দামী শাড়ি কিনে দিবি!
নিপা ভ্রু কুঁচকে ফেললো;
– ও জানে না।
– না জানিয়ে নেয়া মানে তো চুরি করা। আমি কি তোদের এই শিক্ষা দিয়েছি নিপা?
নিপা কোনো প্রতিউত্তর না করে বিরক্তি নিয়ে আমার সামনে থেকে চলে গেল। আর আমি হতভম্ব হয়ে স্থির দৃষ্টি নিয়ে নিপার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বিয়ের পর এই প্রথম অনেকটা সময় নিয়ে আমার ছোট মেয়ে নিপা আমাদের কাছে থাকতে এসেছে। অনেকটা সময় বলতে পনেরো দিন। মেয়ের বিয়ের বয়স ছ’মাস। ছ’মাসের মধ্যে যতবারই নিপা আমাদের কাছে এসেছে, প্রত্যেকবারই যাওয়ার তাড়া নিয়ে এসেছে। কোনোবার হয় তার শ্বাশুড়ি অসুস্থ থাকেন, নয়তো জামাইয়ের হাতে সময় থাকে না। ব্যবসার কাজে জামাইকে বিভিন্ন জায়গায় ছুটোছুটি করতে হয়। ব্যস্ততা তার নখের ডগায় থাকে। সে যাই হোক, দেরিতে হলেও মেয়েকে আমরা খানিকটা বেশি সময়ের জন্য কাছে পাচ্ছি বলে আনন্দ আর স্বস্তিতে মনপ্রাণ ভরে উঠছে। কিন্তু গত তিনদিনে নিপার কিছু আচার-আচরণ আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে। বিয়ের পরবর্তী সময়টাতে নিপার মন-মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে, যে পরিবর্তনগুলো কখনোই কাম্য ছিল না আমার। এই যেমন- গতকাল বিকেলে আমার জা রেশমা ভাবী এসেছিলো নিপার সাথে দেখা করতে। একই পাড়ায় থাকি বলে আসা-যাওয়া লেগেই থাকে। তো খোশগল্প করার সময় খেয়াল করলাম নিপা ইচ্ছে করে তার বড় চাচীকে এড়িয়ে যাচ্ছে৷ ভাবী এটা সেটা জিজ্ঞেস করলেও কেমন যেন দায়সারা উত্তর দিচ্ছে। বিষয়টা চোখে পড়ার মত বলে ভাবীও তেমন করে আর নিপার সাথে কথা বাড়ায়নি। ভাবী চলে যাওয়ার পর নিপাকে তার এমন আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে;
“- চাচীর সাথে আমি কি কথা বলবো মা! সে কি আমার বয়সী নাকি যে খোশগল্পে মেতে উঠবো তার সাথে? তাছাড়া চাচী সারাক্ষণ ঘর-সংসারের আলাপ নিয়ে পড়ে থাকে, সেকেলে কথাবার্তা বলে; আমার ভালো লাগে না।”
অথচ বিয়ের আগে নিপা এই রেশমা ভাবীর সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতো, তার হাতের রান্না খেতে চাইতো। আর ভাবীও নিপাকে যথেষ্ট আদর করে। নিজের মেয়ে মনে করে আগলে রাখে সবসময়। নিপার এ ছোটখাটো পরিবর্তনগুলো আমার চোখেই হয়তো বেশি পড়ছে। ওর কথা বলার ধরণ আর বাচনভঙ্গি দেখে মূহুর্তেই ওর মনের ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারছি আমি। পারব না! কতগুলো মাস মেয়েটাকে নিজের গর্ভে ধারণ করেছি। তার পা থেকে মাথা অব্দি সবটাই আমার নখদর্পনে।
– আপনি কি ঘুমোচ্ছেন?
নিপার বাবা আমার ডাক শুনে বাঁকা হয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকালেন;
– কিছু বলবে?
– জ্বী, কথা ছিল।
তিনি উঠে বসলেন। আমিও পাশে গিয়ে পা ভাঁজ করে বসলাম;
– নিপাকে খেয়াল করেছেন? আসার পর থেকে কেমন অদ্ভুত আচরণ করে যাচ্ছে। সারাক্ষণ শুধু শ্বশুরবাড়ির বড়োলোকি আলাপ। আত্নীয়-স্বজনদের ছোট করে কথা বলছে। আমি ওর মধ্যে দেমাগের আভাস দেখতে পাচ্ছি।
– সিরাপটা দাও তো৷ কাশিটা আবার বেড়েছে।
খুকখুক করে কেশে নিয়ে নিপার বাবা আমার কথাগুলোর প্রতিউত্তর করতে লাগলেন;
– মেয়েটার সদ্য বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি নিয়ে একটু আহ্লাদীপনা করছে, এ’ও তোমার সহ্য হচ্ছে না দেখছি।
এক চামচ সিরাপ তার মুখের সামনে ধরে আমি বললাম;
– কোনটা আহ্লাদীপনা আর কোনটা বড়োলোকিপনা তা বুঝার মতো বয়স আর চোখ দুটোই আমার আছে।
– সারাদিন ঘরে বসে থাকো তো তাই এসব ফালতু চিন্তাভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। টিভি-সিরিয়াল ছেড়ে সংসারে একটু মন দাও, দেখবে এসব ভাবার সময়ই পাচ্ছো না আর। বড় ভাইজান ঠিকই বলেন, পড়াশোনা জানা মেয়ে মানুষ কখনো ঘরের বউ হিসেবে ভালো হয় না।
মুচকি হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। অযথাই নিপার বাবার সাথে কথা বাড়ালাম, যেখানে আমি জানি আমার কথার মর্মার্থ বুঝার ধৈর্য্য এবং মন-মানসিকতা কোনোটাই তার নেই।
হাতে গ্রীন-টি’র মগ নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে সোফার উপর পা তুলে বসে নিপা তার কোনো এক বান্ধবীর সাথে ফোনে কথা বলছে। খানিকটা দূরে বসে আমি আমার বড় নাতির জন্য বানানো ফতুয়াটায় সুঁই-সুতো দিয়ে ফুল তুলছি। মেয়ে তার বান্ধবীর সাথে বলছে;
“- আমার দেবরের জন্যও তো মেয়ে খুঁজছে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। বড় ঘরের কোনো সুন্দরী নিখুঁত মেয়ের খোঁজ থাকলে জানাস আমাকে। তারা আবার যেমন তেমন ঘরের কাউকে বউ করে আনবে না বুঝলি? বংশেরও তো একটা ব্যাপার আছে তাই না!”
তাদের কথা বলা শেষ হয়ে গেলে আমি নিপাকে কাছে ডাকলাম;
– নিপা, আয় তোর চুলে তেল দিয়ে দিই। চুলের কি হাল করে রেখেছিস! কাকের বাসা হয়ে আছে।
নিপা অসম্মতি জানালো না। তেলের বাটি নিয়ে এসে চুপচাপ মেঝেতে বসে পড়লো।
যত্নশীল হাতে আঙুলের ডগায় লাগানো তেল নিপার চুলের গোড়ায় ম্যাসাজ করে দিচ্ছি। নিপা গুনগুন করে গান গাইছে। এরমধ্যে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– হ্যাঁ রে নিপা, তোর শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব ভালো মানুষ না রে?
নিপা গুনগুন থামিয়ে ছোট্ট করে শুধু “হুম” বললো। আমি আবার জানতে চাইলাম,
– তোকে ঠিকমতো আদরযত্ন করে?
– তেলটা ঠিক করে দাও না মা। কেন এত কিছু জিজ্ঞেস করছো!
আমি নিপাকে আমার দিকে ঘুরে বসতে বললাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিপা ঘুরে বসলো। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম;
– সত্যি করে বল তো, তুই কি ভালো আছিস?
নিপা স্বাভাবিকভাবে প্রতিউত্তর করলো,
– আমি এখানে এতদিনের জন্য কেন থাকতে এসেছি জানো?
– কেন?
– আমার শ্বশুর বলেছেন তাই। শ্বশুর-শাশুড়ি আর দেবর তারা তিনজন কিশোরগঞ্জ গেছে আমার নানী শাশুড়িকে দেখতে। আর তোমাদের জামাই ব্যবসার কাজে সিলেট গেছে। বাড়িতে আমি একা থাকবো, কত গয়নাগাটি আর আলমারি ভর্তি নগদ টাকা-পয়সা পড়ে আছে; ব্যাপারটা রিস্ক হয়ে যাবে দেখে ওরা আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
– ঠিকই তো করেছে। বাড়িতে ডাকাত পড়লে?
নিপা মুচকি হাসলো,
– না মা, ডাকাতির ভয় না। ওরা আমার উপর ভরসা করতে পারেনি। আমি গরীব ঘরের মেয়ে, যদি ওদের টাকা-পয়সার লোভ সামলাতে না পারি সেজন্য।
আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ নিপা আবার বলতে লাগলো;
– আমি জানি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছো,সবসময় শ্বশুরবাড়ির আভিজাত্যের আলাপ করছি বলে। তোমার হয়তো মনে হচ্ছে আমার মধ্যে অহংকার চলে এসেছে। কিন্ত না, আমার মধ্যে কোনো অহংকার আসেনি। লোক দেখানো মিথ্যে সুখের বড়াই করছি আমি। শান্তিও পাচ্ছি অবশ্য। তাছাড়া এই বড়োলোকিপনা ছাড়া আর কিইবা দেখাব আমি? আমার শ্বশুরবাড়িতে না আছে শিক্ষার আলো, না আছে নৈতিকতা আর না আছে বড় ধরনের মন-মানসিকতা৷ তাদের এ ঘাটতিগুলো আমি ওদের ধন-সম্পদ দিয়ে ঢেকে রাখতে চাই মানুষের কাছে। কিছু একটা করে তো নিজেকে সুখী প্রমাণ করতে হবে বলো?
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। ফ্যালফ্যাল করে নিপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু। নিপার কথা তখনো ফুরোলো না;
– বড় চাচার কথা শুনে আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে না দিলেও পারতে তোমরা। এরচেয়ে একটা শিক্ষিত এবং ভালো মন-মানসিকতার গরীব শ্বশুরবাড়ি ঢের ভালো৷ এদিক দিয়ে আপা সুখে আছে। তার আর্থিক স্বচ্ছলতা এত বেশি না থাকলেও মানসিক কোনো অপূর্ণতা নেই।
নিপার গাল দুটো আজলা ভরে ধরে আমি কেঁদে ফেললাম। সারাজীবন ধরে চেয়ে এসেছি; আমার মেয়ে দুটোর যেন আমার মতো জীবনসংগ্রাম করতে না হয়। কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। আমার চেয়েও কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে গেল তারা। পৃথক বোবা দহনে পুড়ছে দুজনই।
কিছু কিছু সময় জীবনের হিসেবটা আমরা নিজেদের অঙ্কের খাতায় মেলাতে পারি না। একটা না একটা গড়মিল থেকেই যায়। আর সেই গড়মিল মেনে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। পুরনো নিয়ম ভাঙতে পারলে হয়তো মানসিক আত্নতৃপ্তি নিয়ে দিন পার করা যায় কিন্তু সে তৃপ্তি অনুভব করার আগেই সমাজ আমাদের জন্য নতুন নিয়ম তৈরি করে ফেলে।
(সমাপ্ত)