#আনটোল্ড_ডিজায়ার
#পর্ব_২_৩_ও_৪
লেখক_হাসিবুল_ইসলাম_ফাহাদ
০২
পিসি অন করতেই দেখতে পাই পিসিতে ভিপিএন ইন্সটল করা। অথচ আগে কখনোই এটায় ভিপিএন ইন্সটল করা হয়নি।
মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ নিয়ে ব্রাউজিং স্টোরিতে ঢুকি।
যা দেখি তাতে আমার চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়৷
মনে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরছিলো.. কাজটা কার, আমার স্ত্রী সাবিহার নাকি তার বোন মণিকার!!
মনে একরাশ সন্দেহ নিয়ে
ডেক্সটপ অফ করে উঠে গেলাম।
গেস্ট রুমের সোফায় দু হাত মাথার নিচে দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছি।শীতকালে বেশ অনেক দিন ফ্যান না চালানোয় মাকড়সারা ফ্যানের পাখার সাথে জাল বুনেছে। এই জালে আদৌ কোন পোকামাকড় ধরা পড়বে কিনা জানা নেই তার। মাকড়সার জালে পোকামাকড় ধরা পড়ুক বা না পড়ুক, সাবিহার ভালোবাসার জালে আমি ধরা পরে গিয়েছিলাম।
তখন শীতের শেষ, বসন্ত আসবে আসবে করছে। শীতে ঝড়ে যাওয়া পত্রফলকের জায়গায় নতুন নতুন সবুজেরা কচি মাথা বের করে আগমনী বার্তার জানান দিচ্ছে৷ পাখ পাখালিরা গাছের ডালের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের মিষ্টি কন্ঠের অমীয় সুর তুলে ডেকে যাচ্ছিলো। আমি গাছের ডালের ফাঁক ফোকড়ে উঁকি দিয়ে তাদের দু একজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এমন সময় হঠাৎ করেই সজোরে একটা ধাক্কা খেলাম। কেউ একজন মনে হয় ছুটে এসে আমার গায়ে পড়লো। উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সুকন্ঠী পাখি খুঁজতে খুঁজতে একদম ই বেখেয়ালি হয়ে পড়েছিলাম তাই এরকম একটা ঘটনায় আসলে দোষ টা কার সেটা বুঝতে পারিনি৷ ধাক্কা খাওয়ার পরে দুজন দুদিকে ছিটে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেছি। কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে আসলো৷ দূর থেকে আক্রমনাত্মকভাবে তেড়ে এলেও আমাকে দেখে ওরা লেজ দুলাতে দুলাতে শান্ত হয়ে যায়। এই পার্কের গাছপালা, কাক,কুকুর আমার সবথেকে কাছের বন্ধু। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে অপর প্রান্তে কালো বোরকা পরিহিত মেয়েটাকে সরি বললাম।
সেও ততক্ষনে নিজে উঠে পড়েছে।হাত দিয়ে নিজের গায়ের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে
আমাকে কম্পিত গলায় বললো, আপনি সরি বলছেন কেন! আসলে দোষটা আমার ই। কুকুরগুলো অজানা কারণে আমাকে তাড়া করছিলো। পেছন ফিরে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আপনার গায়ে ধাক্কা খেলাম।
আমাকে মাফ করবেন।
পার্কে সাধারণত কালো বোরকা পরে নিকাব বেঁধে কেউ আসেনা। এখানে আসে উঠতি বয়সের রক্ত গরম তরুণ তরুণীরা। ওদের গায়ে থাকে বাহারি রঙ ও ডিজাইনের পোষাক।
সবুজ রঙ এর হাতা গোটানো মলিন পাঞ্জাবি, একটা আকাশি রঙ এর জিন্স আর তার উপর একটা কালো চাদর জড়িয়ে এখানে আসা হয় আমার। মাঝে মাঝে চোখে পরা চশমার আবছা কাছ চাদরের কোনা দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবি এখানে একদম সেকেলে জামাকাপড় পড়ে বোধহয় আমি ই আসি। কিন্তু আজকে এই মেয়েটাকে দেখে আমার ধারণা চেঞ্জ হয়ে গেল। আমার মত আরো দু-এক জীব তাহলে আছে এ দুনিয়ায়।
মেয়েটার সাথে একটা বড়সড় ব্যাগ। বেশ ভালো ই ওজন হবে পুরোপুরি উঠানোর শক্তি নেই। দু হাত দিয়ে একপ্রকার মাটির সাথে টানতে টানতে আমার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। ততক্ষনে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে।
পাখিগুলো নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে।ওদের আর দেখা পাওয়া যাবে না৷ সন্ধ্যে বেলা পাখিরা সবাই নিজ নিজ বাসায় ফিরে।হুট করে মনে প্রশ্ন আসলো আসলেই কি সবাই ফিরতে পারে?
মনে মনে দু-লাইন কবিতা খেলা করছে।
” কে বলেছে সব পাখিরাই সন্ধ্যে বেলা নীড়ে গেছে?
উড়তে উড়তে কিছু পাখির ডানা হয়ত চিড়ে গেছে।
কিছু কথা সন্ধ্যে জানে, হয়না বলা দিনের কাছে।
এই শহরে বিষন্নতার গল্প শত লুকিয়ে আছে।”
কবিতা আওড়াতে আওড়াতে পার্ক থেকে বাইরে আসলাম।
পার্কের গেট থেকে বের হলে হাতের ডানপাশে মনা মামার চায়ের দোকান৷ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে শত ভীড়ের মাঝেও মনা মামা চাওয়ার আগেই আমার জন্য স্পেশাল দুধ চা বানিয়ে দেয়।
ধুমায়িত গরম চায়ের কাপে কয়েক চুমুক দিতেই, চোখে পড়লো কালো বোরকা পরিহিত সেই মেয়েটিকে। দু হাতে ব্যাগ মাটির সাথে প্রায় মিশিয়ে টানতে টানতে পার্কের গেট থেকে বের হলো। কয়েকটা রিকশাওয়ালা ” আপা কই যাইবেন” বলে মেয়েটাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। ওদেরকে
” কোথাও যাবনা ” এ উত্তর বারবার দিতে দিতে মেয়েটা নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেলছে।
বেশ কিছুক্ষন ধরে ওকে দেখলাম।
ততক্ষনে আমার চার কাপ চা খাওয়া শেষ। এ পুরো সময়টুকু ওকে পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝতে পেরেছিলাম,
মেয়েটার এখন আসলেই কোথাও যাওয়ার নেই।
“টুং করে একটা মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ আসলো।”
এক বছর আগের ভাবনার জগত থেকে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম।
ফেসবুকে সচারাচর আমি অপরিচিত দের এড করিনা। কিন্তু এইমাত্র যে মেসেজ টা এসেছে সেটা অপরিচিত একটা আইডি থেকেই।
” কেমন আছেন আপনি? ”
দেখে মনে হলো ও প্রান্ত থেকে যে মেসেজটি পাঠিয়েছে আমাকে সে আমাকে অনেক আগে থেকে চিনে। মাঝে বেশ কিছুদিন কথা হয়নি, অনেক খোঁজার পরে আমাকে খুঁজে পেয়ে এমন একটা প্রশ্ন করলো।
আমি রিপ্লাই না দিয়েই ঐ আইডির প্রোফাইলে যাই।
একটা কিউট মেয়ে পুতুলের ছবি দেয়া। ধারণা করে নেই ওপাশে যে আছে সে হয়ত একজন মেয়ে হবে। এর মাঝেই রুমে ঢোকে সাবিহা৷ এসে দেখতে পায় আমি ফোন হাতে সোফায় শুয়ে আছি।
সাবিহা ফোনটা আমার হাত থেকে নিয়ে টি টেবিলের উপর রেখে দেয়। এরপর আমার বুকের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকে। আগে ও এভাবে শুলে আমি শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরতাম। কেন যেন আজ ও সেভাবেই জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু আগের মত ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নেই ওর প্রতি।
দায়িত্ববোধ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, মন খারাপ? কি হয়েছে?
ও উত্তর দিলো, অনেক্ষন ধরে তুমি নেই, আমি খুঁজছিলাম তোমাকে। এখানে এসে একা একা শুয়ে আছো কেন?
আমি ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলাম না৷ ওর ও উত্তর পাওয়ার কোন তাড়া নেই৷ তাই দুজনেই চুপচাপ হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে রাখলাম। সাবিহার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও ভীষন কষ্ট পেয়েছে। ওর মন খারাপের চেহারা আমার বেশ চেনা। কি হতে পারে? কেন কষ্ট পেল?
ফারহান নিশ্চয়ই সাবিহাকে বকা দিয়েছে বা এমন কোন বিষয় নিয়ে বলেছে যার কারণে সাবিহা মনে কষ্ট পেয়েছে। কেন জানিনা,এখন ওর কষ্টে আমারও কষ্ট লাগছে।
.
.
.
পাঁচদিন ছুটি কাটিয়ে অফিসে গেলাম।
আমার সামনের ডেস্ক এর মেয়েটা আজ অন্যরকম ভাবে সেজে এসেছে।তাকে বলিউডের কোন নায়িকাদের মত লাগছে।তাদের চেহারার সৌন্দর্য যেমন ই হোক পোশাক পরিচ্ছদে বেশ আকর্ষণীয় লাগে।
বস রামীম বলেছেন অফিসের সবাইকে ধমকা ধমকি করে টাইট দিয়ে রাখতে আমিও সেটাই করছি। প্রয়োজনের বাইরে অফিসের সবার সাথে একটু কাঠখোট্টা ব্যবহার করছি। আস্তে আস্তে আমার একটা ডমিনেন্স সৃষ্টি হচ্ছে।
সামনের ডেস্কে বসা নীড়া ছাড়া বাকি সবাই এতে অখুশি।
তবে আজকেও একটা বিষয় আমার নজর এড়ায় নি। সেটা হলো নীড়ার গালে লাল হয়ে থাকা থাপ্পড়ের দাগ। ওকে কিছুক্ষন খেয়াল করার পর বুঝলাম ও আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না।
কেউ কিছু বলার আগে আমি আঁচ করার চেষ্টা করি সে, কি বিষয়ে বলতে পারে!!” অফিসের কোন কাজের ব্যপারে এ মেয়েটি আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না।
কারণ তাহলে কোন প্রকার হ্যাজিটেশন ছাড়াই বলে ফেলত। এত ইতস্তত করতো না।
এছাড়া কোন সাধারণ বিষয়েও সে আলাপ করতে চাইছে না। তাহলে ইনিয়ে বিনিয়ে অফিসের কোন কাজের কথা থেকে আলোচনা করতে করতে সাধারণ বিষয়েও আলাপ করে ফেলতে পারতো। যা বলতে চাচ্ছে সেটা হয়ত একটু স্পেশাল কিছু। আমি যতদূর জানি মেয়েটি বিবাহিত।
তাহলে ও কি আমাকে এসে বলবে যে ওর স্বামী ওর উপর অত্যাচার করে, এজন্য ই মাঝে মাঝে ওর গায়ে মারের দাগ দেখা যায়৷ মনে হচ্ছে ও এমন কিছুই হয়ত আমার সাথে শেয়ার করতে চাচ্ছে।
ভাবছি নিজ থেকেই ডেকে কথা শুরু করবো কিনা!
এর মাঝে হঠাৎ করে একটা ফোন কল আসলো মনিকার নম্বর থেকে।
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো!
ভাইয়া….
আমারে মাফ করে দেন, আমি মোবাইল টিপছিলাম বাবুকে বিছানায় রেখে, ও বিছানার উপরে রাখা একটা চুলের ক্লিপ মুখে দিয়ে গিলে ফেলেছে আমি খেয়াল করিনাই।
বাবু যেন কেমন করতেছে আপনে জলদি বাসায় আসেন।
ভয়ানক রাগ আর ভীষণ কষ্ট এ দুটো ফিলিংস আগে আমার ভেতর কাজ করেনি। আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, বাবুর আম্মু কোথায়!
মনিকা জানালো আমি অফিসে আসার ঘন্টাখানেক পরই সে বাবুকে রেখে বের হয়ে গেছে। আমি কল কেটে সাবিহাকে ফোন দিলাম। ফোন সুইচড অফ।
মাথার উপরে আকাশ ভেংগে পড়লো আমার। চেয়ার থেকে স্যুট টা টান মেরে নিয়ে দৌড়ে অফিস থেকে বের হলাম।
রাস্তায় রিকশার জন্য দাঁড়ানোর সময় নেই। উদ্ভ্রান্তের মত আমি ছুটে চলেছি। কখন যেন আমার পেছনে পেছনে স্কুটি নিয়ে ফলো করে চলে এসেছে নীড়া। আমাকে দৌড়াতে দেখে বললো, স্কুটিতে উঠুন। কোথায় যাবেন বলেন আমি নিয়ে যাচ্ছি। এক লাফে স্কুটিতে উঠে ওকে বাসার ঠিকানা বললাম। ও যত দ্রুত পারে স্কুটি চালাতে লাগল। আমি পেছনে বসে ততক্ষনে এম্বুলেন্সে ফোন দিয়েছি।
আমাদের বাসায় পৌঁছানোর আগেই এম্বুলেন্স পৌঁছে গেছে। সাথে ছিল একজন অভিজ্ঞ শিশু বিশেষজ্ঞ।আমি নীড়া এবং ডাক্তার তিনজন ই দৌড়ে বাসায় যাই।মনিকা সাফাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মনিকার এন্ড্রয়েড ফোন ফ্লোরে পরে রয়েছে।ও আমাকে ওর বাটন ফোন থেকে কল করেছিল৷ ওটা হাতে নিয়ে সাবিহার মোবাইলে বার বার ডায়েল করে যাচ্ছিলো মনিকা। সাফার চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে আছে ওর গলা থেকে কেমন যেন একটা শব্দ আসছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, শরীর বেঁকে যাচ্ছে।
এমন দৃশ্য আমার জন্য সহ্য করা অসম্ভব। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
তবে একটা বিষয় আমার এবং নীড়ার নজর এড়ায় নি। ফ্লোরে পরে থাকা মনিকার এন্ড্রোয়েড মোবাইলে তখন পর্ণ ভিডিও ক্লিপ চলছিল। ডাক্তার সেটাকে খেয়াল করার আগেই নীড়া ফোন উঠিয়ে পাওয়ার বাটন টিপে দেয়৷
ওদিকে মাথা ঘামানোর মত সময় আমার ছিলনা৷
মনিকা এবং আমি সাফাকে নিয়ে গিয়ে এম্বুলেন্সে বসি। এম্বুলেন্স হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে।
স্কুটি নিয়ে আমাদেরকে পেছন পেছন ফলো করছিলো নীড়া।
সাফার অবস্থা অনেকটা খারাপ। ওকে অক্সিজেন মাস্ক দেয়া হয়েছে।
এম্বুলেন্স এসে দাঁড়ায় একটা সিগন্যালের সামনে৷ এখানে কতক্ষন আটকে থাকতে হয় কে জানে!!এখনকার ১ সেকেন্ড ও আমার কাছে ১ বছরের মত লাগছে।
আচমকা আমার চোখ আটকে যায় সিগন্যালে আমাদের এম্বুলেন্সের পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাইকে।
সাবিহা!! হেলমেট পরিহিত একটা লোকের বাইকের পেছনে বসে সে দু হাত দিয়ে কান চেপে রেখেছে। এম্বুলেন্সের টানা পেঁপোঁ করে বাজতে থাকা শব্দ হয়ত তার কানে বিষ ঢালছে! কিন্তু সে কি আদৌ জানে! এই এম্বুলেন্সে রোগী হিসেবে কে আছে!
তার নিজ দেহ থেকে জন্ম দেয়া একমাত্র ফুটফুটে কন্যা সন্তান…..
.
.
#পর্ব_৩
___________________________
এম্বুলেন্স হাসপাতালের গেটে পৌঁছানো মাত্রই সাফাকে এমার্জেন্সির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এমার্জেন্সি কেবিনেটের গেট পর্যন্ত আমি নীড়া এবং মণিকা তিনজন ই ছুটে গিয়েছিলাম। মণিকার চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট। আমার নিজের অবস্থাটা,
খাঁচায় আটকে পড়া ঘুঘু পাখি নিজেকে মুক্ত করার জন্য যেমন ছটফট করে, ঠিক সেরকম-ই। নীড়া সবকিছু দেখে হতভম্ব।
আমার কাছে মনে হচ্ছিলো সময় খুব ধীরে ধীরে অতিবাহিত হচ্ছে। তাই অনুমান করে বলতে পারবো না ঠিক কতক্ষন পরে সাবিহা আমাকে কল করেছিল।
ফোন রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে সাবিহার কন্ঠে চিৎকার করা আহাজারি শুনতে পাই। সম্ভবত কোন প্রতিবেশীর মাধ্যমে ও সাফার ব্যপারে খবর পেয়েছে।
সাবিহাকে সেদিন সত্যি ই আমার অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো। কিন্তু কেন যেন ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেনি। মানুষ প্রশ্ন-উত্তর তর্কাতর্কি তখন-ই করে যখন তারা একটা সমাধানে আসতে চায়। একটা গোলকধাঁধা থেকে বের হতে চায়। কিন্তু সাবিহা নিজেই নিজেকে গোলক-ধাঁধার ভেতরে আটকে রেখেছে। ওর সাথে আমার প্রশ্ন-উত্তর পর্ব জমবে না।
হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দেই ওকে। বেশ দ্রুতই ও পৌঁছে যায়। এমার্জেন্সি-কেবিনেটের সামনে রাখাক ওয়েটিং চেয়ারে বসে থাকতে দেখে সাবিহা দৌড়ে আমার বুকের উপর এসে ঝাপিয়ে পড়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়।
ঠিক এই মুহুর্তে আমার কি করা উচিৎ!
সাবিহা কি আসলেই ওর সন্তানের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি থেকে কান্না করছে, নাকি নিজের দোষ চাপা দেয়ার জন্য ইমোশনাল একটা নাটকের সৃষ্টি করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করে হিমশিম খেলাম।
সাবিহার মুখের দিকে তাকালেই আমার পুরো শরীর অবিশ্বাসের বিষে বিষিয়ে উঠে। ওকে অনেক রহস্যময়ী মনে হয়। মনে হয় ও প্রতিনিয়ত মানুষ ঠকায়, ঠকবাজ, প্রতারক।
ওকে নিয়ে করা এসব ধারণাগুলো আমি নিজের ভেতরেই দমিয়ে রাখি। বাইরে এমন একটা ভাব দেখাই, সবকিছু ঠিক আছে।
সাবিহার কান্না দেখে আমারও নিজের উপর আর কন্ট্রোল থাকলো না৷ সাবিহাকে আমি ভালো না বাসলেও সাফাকে অনেক বেশি ভালোবাসি৷ আমার দু-চোখের কোনা থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরে। দু হাতে সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে।
যত বড় অপরাধী ই হোক, সাবিহা একজন মা। একজন মায়ের কাছে সন্তানের এমন দুরবস্থার সময়ে চারদিক ভীষন অন্ধকার লাগে। আমি এ অবস্থায় ওকে আমার কোন কথা কিংবা কাজের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফেলতে চাচ্ছি না৷
.
.
মনিকার চোখ মুখ থেকে উৎকন্ঠার ছাপ চলে গেছে একটু দূরে বসে মনিকা ও নীড়া নিজেদের মাঝে কথা বলছে। মনিকা মাঝে মাঝে দাঁত বের করে হাসছে।ওকে দেখিলেই আমার অসহ্য লাগছে। নীড়ার চেহারা গাম্ভীর্যতায় পরিপূর্ণ। ওরা কি বিষয় নিয়ে এত খোশ গল্প- আলাপ করছে তা আমার বোধগম্য নয়, জানতেও চাইনা।
খানিক বাদেই এমার্জেন্সি কেবিনেট থেকে একজন ডাক্তার বের হয়ে এসে আমাকে ইশারা দিয়ে ডাকে। আমার বুকটা ধক করে উঠে। আমি উঠে ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে সাবিহা আমাকে আটকায়, “কোথায় যাচ্ছে? আমিও যাব।”
জবাবে বলি, একটু বসো। আমি শুনে আসছি ডাক্তার কি বলে।
সাবিহা এক চোখ অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।
আমি উঠে ডাক্তারের কাছে গেলাম।
তিনি বললেন,
” শহর আহমেদ, আপনার কন্যার অবস্থা আশংকাজনক। চুলের ক্লিপে থাকা সুচালো অংশ ওর গলার নরম মাংসের ভেতরে বিঁধে গিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি একটা অপারেশন পারফর্ম করতে হবে। এবি পজেটিভ ব্লাডের ব্যাকাপ এবং লাখ দশেক টাকা ম্যানেজ করুন খুব জরুরি।
ডাক্তারের কথা শুনে মনে হচ্ছিলো আমি টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পরে যাব।
দশ লাখ টাকা ম্যানেজ করা কোন ব্যপার না। আমার নিজের একটা ফ্লাট আছে। ওটার কাগজপত্র জমা দিয়ে দশ লাখ টাকা ম্যানেজ করা যাবে যে কোন মুহুর্তে।কিন্তু সাফার অবস্থার কথা চিন্তা করে আমি নিজেকে আর সামলাতে পারছিনা।
দ্রুত পায়ে হেঁটে সাবিহার কাছে এসে বললাম তুমি মনিকাকে নিয়ে সাফার কাছে এখানেই থাক। আমি আসছি। ডাক্তার কখনো কিছু বললে আমাকে সরাসরি ফোন দিয়ে জানাবে।
সাবিহা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। ওর কান্নার রেশ কমে এসেছে অনেকটা। উদাস দৃষ্টিতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে সে। চুলগুলো অগোছালো হয়ে পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে, সেদিকে খেয়াল নেই সাবিহার।
খুব দ্রুত বের হয়ে আসি হাসপাতাল থেকে।
পেছন পেছন আসে নীড়াও।
নীড়া আমাকে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে?
নিজের ভেতর কোন ভারী কথা চাপিয়ে রাখলে তা মানসিক কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই নীড়াকে বললাম “এই মুহুর্তে আমার লাখ দশেক টাকা এবং এবি পজেটিভ ব্লাড ম্যানেজ করতে হবে।”
নীড়া স্কুটি স্টার্ট দিল। আমি উঠে বসলাম।
নীড়া জিজ্ঞেস করলো, দশ লাখ টাকা কিভাবে ম্যানেজ করবে?
– ফ্লাটের কাগজপত্র বন্ধক রেখে।
– কাগজপত্র বের করে জমা দিয়ে টাকা আনতে কত সময় লাগবে?
– ঘন্টাখানেক তো লাগবেই।
– অনেক সময়ের ব্যপার। আমার সাফার জন্য সত্যি খুব টেনশন হচ্ছে।
নীড়া যে টেনশন করছে সেটা ওর স্কুটিতে চড়েই বুঝতে পারছি। ও স্মুথলি ড্রাইভ করতে পারছে না।
এভাবে চালালে নিজেদের ও কোন বাস বা ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে হাসপাতালে এডমিট হতে হবে।
নীড়া নিজ থেকেই বললো পাঁচ মিনিট সময় দরকার ওর।
একটা পার্কের পাশে স্কুটি দাঁড় করায় নীড়া।
পড়ন্ত দুপুরে একদমই ফাঁকা ছোট্ট এ পার্কটি। নীড়া হেঁটে ভেতরে ঢোকে। পেছন পেছন আমিও আগাই।আমার মনে সাফার অস্থিরতা বিরাজ করছে।
নীড়া একটা মোটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়।
আমার দিকে তাকিয়ে বলে, শহর এদিকে আসুন।
আমি গুটি গুটি পায়ে ওর দিকে এগিয়ে যাই।
নীড়া আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আমার অদ্ভুত একটা ইচ্ছে আছে। আপনি পূরণ করতে পারবেন?
আমি নিরস কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কি ইচ্ছা?
নীড়া একটু ইতস্তত করতে করতে বললো,
আমাকে একটা থাপ্পড় দিতে পারবেন?
যত জোরে পারেন?
– কি বলছো এসব?
– জ্বী। ঠিক শুনেছেন।
– এটা কেমন ইচ্ছে?
– সময় নষ্ট করবেন না প্লিজ, আমাকে প্লিজ আপনি একটা থাপ্পড় দিন।
-শিওর?
– হ্যাঁ।
আমি হালকা ভাবে ওকে একটা থাপ্পড় মারলাম। চটাস করে উঠলো। মনে হচ্ছে একটু বেশি জোড়ে মেরে ফেলেছি। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। নীড়া দাঁত কিটমিটিয়ে বললো “আর জোর নেই গায়ে? জোরে মারতে বলেছি।এত আস্তে কেন?”
ওর কথা শুনে একটু বিরক্তিকর মনে হলো আমার কাছে। যেহেতু নিজ থেকেই চাইছে তাই সজোরে ওর গালে একটা চড় লাগালাম।
ওর ঘাড় ঘুরে গেল। হাতের কয়েকটা আংগুলের ছাপ ওর ফর্সা গালে বসে লাল হয়ে গেছে। ও যখন আমার দিকে তাকালো, ওর চাহনী দেখে মনে হলো ও একটা ম্যাচের অবিষ্ফোরিত কাঠির মত হয়ে ছিল এতক্ষন, ম্যাচের কাঠি ঘষা দিলে ছোট একটা বিষ্ফোরণের মাধ্যমে যেমন আগুন জ্বলে উঠে, আমার থাপ্পড় খেয়েও নীড়া সেভাবেই জ্বলে উঠেছে। হুট করে ও ডান হাত দিয়ে আমার জামার কলার চেপে ধরে। অন্য হাত দিয়ে আমার মাথার পেছনের চুল খাঁমচে ধরে আমার ঠোঁটে ওর নরম ঠোঁট গুজে দেয়। নীড়ার ডান হাত আমার জামার কলার ছেড়ে গলায় চলে আসে। ধারালো নখগুলো বেশ কয়েকটা লাল রেখা এঁকে দেয় আমার শরীরে। এভাবে কয়েক সেকেন্ড। এরপর ছোট একটা ধাক্কা মেরে আমাকে সরিয়ে দেয় ও। আমার দিকে এমন নজরে তাকিয়ে ও হাপাচ্ছিলো, যেন আমি ওর সামনে একটা ছোট্ট হরিণ শাবক আর ও ক্ষুধার্ত বাঘিনী। এই ছোট্ট কয়েক মুহুর্তে কি হয়ে গেল তা বুঝে উঠতে আমার বেশ সময় লাগবে৷ আমার মাথায় তখন সবকিছু ছাপিয়ে সাফার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমি শার্ট ঠিক করে ওর সামনে থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম। পেছন থেকে নীড়া অন্যরকম একটা কন্ঠে আমাকে ডাক দিয়ে বললো,
“ওহ – মাই মাষ্টার
আই উইল গিভ ইউ দ্যা মানি।
ফুল টেন লাখস।
ইউ যাস্ট হ্যাভ টু মেক মি ইউর স্লেভ।”
ওর কথা গুল আমার মাথার উপর দিয়ে গেল।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম।
নীরা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলতে লাগলো,
টাকা আর ব্লাড আমি ম্যানেজ করে দিচ্ছি।
আমার ১ ঘন্টাও সময় লাগবে না।
কিন্তু একটা শর্ত আছে,
আমি অস্ফুট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কি শর্ত?
নীড়া উত্তর দিলো,
তোমাকে আমার সাথে বন্ডেজ ক্লাবে যেতে হবে।
– বন্ডেজ কি?
– আজ রাতে গিয়ে গুগলে দেখে নিও…
.
.
.
নীড়ার স্কুটির পেছনে চড়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি। ওর কার্ড থেকে পেমেন্ট করা যাবে। ব্লাডের ব্যবস্থাও ও করেছে।
মাথায় সাফার চিন্তার পাশাপাশি অন্য একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হল এতদিন নীড়ার শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন গুল দেখেছিলাম সেগুলো ইচ্ছেকৃতভাবে নিজের শরীরে দিয়িয়েছে কিনা!!….
#পর্ব_৪
__________________________
নীড়ার স্কুটির পেছনে চড়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি। ওর কার্ড থেকে পেমেন্ট করা যাবে। ব্লাডের ব্যবস্থাও ও করেছে।
মাথায় সাফার চিন্তার পাশাপাশি অন্য একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হল এতদিন নীড়ার শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন গুল দেখেছিলাম সেগুলো ইচ্ছেকৃতভাবে নিজের শরীরে দিয়িয়েছে কিনা!
খুব শীঘ্রই আমার চিন্তাভাবনা থেকে নীড়ার ব্যপারটা হারিয়ে গেলো।
আমার মাথায় তখন ঘুরছিলো সাফা কেমন আছে, ওর কি অবস্থা।
হাসপাতালে পৌঁছাতে আমাদের বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়না। ডাক্তারের সাথে কথা বলে টাকা পেমেন্টের ব্যবস্থা করে নীড়া।
জোগাড় হয়ে যায় এ বি পজেটিভ ব্লাডও।
দুঃসময়ে নীড়ার এমন হুট করে এগিয়ে আসাটা সত্যি ই কল্পনার বাইরে ছিল আমার। তবে পৃথিবীতে একদম শুধু শুধু কেউ ই কিছু করে না। ওর সাথে বন্ডেজ ক্লাবে যেতে হবে।বন্ডেজ ক্লাব কি সেটা আমি এখনো জানিনা।হবে হয়ত কোন নাইট ক্লাব টাইপ কিছু একটা। তবে যাই হোক আমার যেতে কোন আপত্তি নেই৷ সাফার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি।
খুব দ্রুততম সময়ের ভিতরে সাফার অপারেশন এর ব্যবস্থা হয়ে যায়। বেশ কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার মিলে একত্রে অপারেশন পরিচালনার কাজে হাত দেন।
নীড়া সব কাজ শেষ করে ওর নিজের বাসায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার আগে সবার অগোচরে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাকা করে একটা ভেংচি কাটে।
সাবিহার শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।ও বার দুয়েক বমি করেছে। প্রেসার লো হয়ে গেছে। ডাক্তার ওকে চলে যেতে বলা সত্তেও চুপচাপ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে অপলক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে। মণিকার কাছে শুনেছি সাবিহা তার মোবাইল ফোনটি আছাড় মেরে ভেংগে ফেলেছে, আমি তখন চলে যাওয়ার পরে। মণিকা বলেছে, আমি শুনেছি। এতটুকুই।সাবিহার কোন কার্যক্রম আমার মনে এখন কোন প্রভাব ফেলছে না। কারণ তখন আমার মন মস্তিষ্ক অনুভূতির পুরোটুকু জুড়ে শুধুমাত্র সাফার কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
চেয়ারে বসে থাকা, পায়চারি করা,সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা, ওটির রুম থেকে কখন ডাক্তাররা বের হবে তার অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মত ওটির লোহার দরজার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।
মনে মনে অনেক বেশি হতাশ হয়ে একটা চেয়ারে বসি। কখন যে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছি, তা টের পাইনি। ঘুম ভাংগে মণিকার ধাক্কা-ধাক্কিতে।
চোখ মেলে তাকাতেই ও জানায় ওটি থেকে ডাক্তাররা বের হয়েছেন। আমাকে ঘুমাতে দেখে তারা ডাকেন নি৷ ধীরেসুস্থে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে বলেছেন।
.
মনের ভিতর একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি প্রায় ছুটে গেলাম ডাক্তার সীমান্তের কেবিনে। উনি-ই অপারেশনের লিড ডাক্তার ছিলেন। যাওয়ার পর আমাকে ঠান্ডা হয়ে বসতে বললেন।
উনি প্রথমেই আমাকে বললেন, মিস্টার শহর আপনাকে এখন যা বলবো তা খুব শক্ত মন মানসিকতা নিয়ে শুনতে হবে অহেতুক কোন সিন ক্রিয়েট করবেন না। পৃথিবীতে চাইতে – না চাইতে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটে যায়। এবং যা একবার ঘটে যায় তা হাজার চেষ্টা করলেও বদলানো যায়না। তাই চুপচাপ সবকিছু মেনে নেয়াটাই হলো যথোপযুক্ত কাজ।
আমার সাহস হচ্ছিলো না ডাক্তার কে নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করার। চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পরছিল।
ডাক্তার আমাকে এর পরেই বললেন,
” সাফার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে মিস্টার শহর।”
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাফা কখনো কথা বলতে পারবেনা। ওর ভোকাল কর্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কথাগুলো শোনার পরে আমার অনুভূতি ঠিক কি রকম ছিলো সেটা আমি প্রকাশ করতে পারব না কিন্তু মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো,
ঠিক কি ভুলের জন্য নিষ্পাপ সাফা এতবড় একটা শাস্তি পেল?
সাবিহা যদি সাফাকে একটু টেক কেয়ার করত,
মেয়েটার জীবনের এতবড় একটা ক্ষতি হত না।
ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, রিলিজ করবেন কবে?
ডাক্তার জানালো দিন পাঁচেকের মধ্যেই। তবে গলার ঘা শুকানোর আগ পর্যন্ত বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরেও সাফাকে বেশ কিছুদিন পাইপের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাবার খাওয়াতে হবে এবং এ কাজের জন্য বাসায় একজন নার্স রাখা অতি আবশ্যক।
আমি ডাক্তারের কথা শুনে চুপচাপ বের হয়ে আসলাম।
এসেই প্রথমে হাত পা ভালভাবে ধুয়ে প্রটেকশন নিয়ে সাফাকে দেখতে গেলাম। কয়েকটা পাইপ ওর গলার ভেতরে ঢোকানো। গলায় সাদা ব্যান্ডেজ করা। চোখ বুজে নিষ্পাপ একটা চেহারা করে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ঘুমাচ্ছে অথবা ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। এই মেয়েটা যখন বড় হবে যদি সবকিছু জানতে পারে, কতবড় একটা ক্কষ্ট পাবে,
আমার ওকে দেখে মনেই হচ্ছেনা ও কথা বলতে পারবে না।
সাফা জন্ম নেয়ার পর পর ই আমি প্রতিটা দিন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কবে ওর মুখ থেকে ” আব্বু ” বলে মিষ্টি একটা ডাক শুনতে পাব।
( এরপর কেটে যায় বেশ কিছু দিন)
.
.
.
সাফা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছিলাম প্রায়। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি আছে।
এই এক মাসে অনেক কিছু বদলেছে। সাবিহা মোবাইল ফোন ব্যবহার একদম ই বন্ধ করে দিয়েছে। বাসায় সাবিহার কোন ফোন নেই। বাসা থেকে বের হওয়ার কথা চিন্তা করা তো দূরে থাক, সাফাকে ছেড়ে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য ওয়াশরুমে গেলেও মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশ না করে দৌড়ে চলে আসে। চোখের আড়াল হতে দেয়না একদম মেয়েটাকে।
আমার প্রতি ভালোবাসা ভক্তি আগের থেকে বেড়ে গেছে বহুগুণ।
একটা দুর্ঘটনা হুট করেই যেন সবকিছু বদলে দিল।
সকালে উঠে নিজে নাস্তা বানিয়ে তারপর আমাকে ডেকে তোলে সাবিহা।
আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলে রুটির টুকরা ছিড়ে সাথে ভাজি বা ডিম নিয়ে আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। যদি একজন আরেকজনকে চা খাইয়ে দিতে পারতো সাবিহা মনে হয় আমাকে চাও খাইয়ে দিত।
অদ্ভুত এক ব্যপার হলো ভালোবাসা যত তীব্রই হোক না কেন একজন কখনো তার পার্টনারকে চা খাইয়ে দেয়ার দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করেনা।
চা হলো একান্ত ব্যক্তিগত খাবার। কেউ ছোট ছোট চুমুক দিয়ে চা খায়। কেউ বড় বড় চুমুকে খায়। কেউ হালকা গরম খায়, কেউ প্রচন্ড গরম খায়। চা খুব সাধারণ একটা জিনিস হলেও এটা আরামসে খাওয়াটা মোটেই সাধারণ বিষয় নয়৷ অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া৷
আমার তো মনে হয় চায়ের কাপ তুলে পরিমিত পরিমানে খাইয়ে দেয়ার মত পার্টনার যে পাবে সে-ই পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী ভালোবাসা প্রাপ্তির খেতাবটাও পাবে৷
আমাকে খাইয়ে দেয়ার পরে নিজে খায় সাবিহা৷ এরপর বাবুর ছোট ছোট জামাকাপড়, কাঁথা ইত্যাদি কোনটা কখন কি ধুতে হবে বাবু কোন জামা পড়বে, কি খাবে, এগুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,এদিকে আমাকে বাইরে যেতে হয় বাজারের জন্য৷ বাজারে যাওয়ার আগে আমার গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে কপালে পাপ্পি দিয়ে দেয়া৷ বাজার থেকে ফেরার পরে নিজের ওড়না দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দেয়া, ফ্যানের নিচে আমাকে বসিয়ে ঠান্ডা শরবত এনে আমাকে খেতে দেয়া ইত্যাদি ছোট খাট অনেক কাজ ওর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় যা আমি আগে কখনো ওর মাঝে খেয়াল করিনি।
তবে যা-ই করুক না কেন ওর দিকে তাকালে আমি আর আগের মত ভালোবাসা অনুভব করিনা। একবার কোন কারণে কারো উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেলে তার প্রতি আর নতুন করে ভালোবাসা জন্মায় না৷ আমার মনে সাবিহার কাজকর্মে কোন প্রভাব পড়ছে না।
ও যে মনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমাকে অতি ভক্তি দেখাচ্ছেনা সেটাও বা আমি কিভাবে শিওর হব?
.
.
.
দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে অবশেষে অফিসে উপস্থিত হলাম আমি৷
সবাই আমাকে দেখে সাফার কথা জানতে চাইলো। আমি জবাবে জানালাম ভালো আছে সাফা।এতদিন বাসায় থাকার দরুন, অফিসের কাজে একদম ই মন বসছে না। সাফার কাছে পড়ে আছে মনটা। সাবিহার ফোন নেই। মনিকাকে বেশ কয়েকবার ভিডিও কল দিয়ে সাফাকে দেখেছি।
সাবিহা কোথায় আছে বা কি করছে একবার ও জিজ্ঞেস করিনি। মাঝে সাবিহা একবার কল দিয়েছে আমাকে। বলেছে মণিকার ছোট বাটন ফোনটা সাবিহা নিজের কাছে এনে রেখেছে। চাইলে ওকে আমি ঐ সিমে কল করতে পারি। আমি আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলাম।
নীড়াকে অনেক দিন পর দেখলাম। ও আজ গোলাপি রঙ এর শাড়ি পরে এসেছে। সাথে ওর পাতলা ঠোঁটেও ম্যাচিং করে গোলাপী লিপ্সটিক।চুল অর্ধেক খোপা করা।
কলেজ পড়ুয়া বাচ্চাদের মত কিউট ও ছোট্ট লাগছিলো ওকে। সেদিনের কথা মনে পড়লো আমার। ওকে একটা থাপ্পড় দিলেই ওর সাদা গালটা একেবারে লাল টুকটুকে হয়ে যাবে৷ মনে মনে হাসলাম আমি।
নীড়া আমার দিকে তাকিয়ে বেশ কয়েকবার চোখ টিপ্পুনি দিয়েছে৷ হুট করে আমার মনে পড়লো বন্ডেজ কি সেটা গুগল করে দেখতে একদম ই ভুলে গিয়েছিলাম আমি।
এখন মনে পড়লেও গুগল করতে ইচ্ছে করছে না৷ নীড়াকে জিজ্ঞেস করেই জেনে নিতে হবে।
নীড়ার গাল দুটো আজ একদম সাদা দেখাচ্ছে। আগের মত আঘাতের চিহ্ন নেই৷ ও ছোটখাট বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।
ওর কার্যক্রমে আমি অদ্ভুত একটা আনন্দ পাচ্ছি।
একটু পর বেশ কয়েকটা ফাইল নিয়ে ও আমার ডেস্কে আসে৷ সবার সামবে এমন একটা ভাব করে যেন অনেক জরুরি কাজের জন্য ও কথা বলতে এসেছে আমার কাছে৷ কিন্তু এসেই ডেস্কের উপর ফাইলগুলো রেখেই আমাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করে,
মিষ্টার শহর, সেদিনের চুমুটা কেমন ছিল বলুন, পুরো আগুন না?
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না।
নীড়া ওর ঠোঁট দুটোর উপর নিজের জিহবা ঘুরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার লিপ্স গুলো কিন্তু খাঁটি মদের মত। তোমার বউ নিশ্চয়ই এতদিন তোমাকে খেয়ে নেশা করেছে তাই না?
ওর এমন সরাসরি কথাবার্তা শুনে আমার কথা ফুরিয়ে যায়।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করি, তুমি না বিবাহিত? তোমার হাজবেন্ড এসব জানলে তোমার ডিভোর্স হয়ে যাবে।
ও উত্তর দেয়,
ডিভোর্সটা আমি ই ওকে দিয়েছি। একেতো নিজে কোন জব করত না, খেত বউয়ের টাকায়, আর বউকে সন্তুষ্ট করার মত শক্তিও ওর ছিলো না৷
নীড়ার কথা শুনে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না৷ তবে ওর সাথে কথা চালিয়ে যেতে ভাল লাগছিলো আমার।
সাবিহা বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে৷ নীড়ার সাথে কথা বলার রেশ টা নষ্ট করতে চাইনি৷ তাই ফোন পিক করিনি। গল্পে গল্পে একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করে ফেলি,
আচ্ছা বন্ডেজ ক্লাব কি, আমাকে বলো তো খুলে।
– তুমি ধারণা নাওনি?
– না।
সমস্যা নেই৷ আজ অফিস ছুটির পরে তোমাকে নিয়ে যাব৷সব নিজ চোখে দেখে জেনে নিও। যাবে আমার সাথে?
– অবশ্যই যাব৷
আচ্ছা বেশি সময় ব্যয় করা যাবেনা তোমার ডেস্কে। সবার চোখ লাগবে। আমি উঠি এখন।
– আচ্ছা।
নীড়া চলে যাওয়ার পর আবার যখন সাবিহার কল আসলো, রিসিভ করলাম।
সাবিহা জানালো তার অনেক একা একা লাগছে। আমি কখন বাসায় ফিরবো জানতে চাইলো।এমনিতে তো পাঁচটার পরেই বাসায় ফিরি। তবে
ওকে জানালাম অফিসের জরুরি কাজ পরে গেছে। ফিরতে অনেক রাত হবে।