#আনটোল্ড_ডিজায়ার
#পর্ব_৭,০৮
০৭
পূর্ণ পূর্নিমার আকাশ।একটা প্লাস্টিকের চেয়ার হাতে নিয়ে ইলিয়ানাদের বাড়ির পেছনের বড় বাগানটায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি।
এখানে আসার একটা কারণ আছে। বাগান ভর্তি সারি সারি আমগাছ।আম গাছের পাতা বেশি ঘন কিংবা বেশি পাতলা হয়না। পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখার দৃশ্য বড়ই মধুর লাগে। জোছনার আলোর ছিটেফোঁটা এসে গায়ে পড়ে। পাশেই একটা বড় ঝাকড়া গাছের পাতার ফাঁকে একঝাঁক জোনাকিপোকা জ্বলছে নিভছে। এ যেন প্রাকৃতিক মরিচ-বাতি। একটা সময় ছিল যখন তালগাছের পাতায় পাতায় ঝুলন্ত বাবুই পাখর বাসার দেখা মিলতো।
কিছু বাবুই পাখিরা অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হয়।
কথিত আছে রাতের অন্ধকার দূর করতে দিনের বেলা জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে নিজের বাসার দেয়ালে উলটো করে গেঁথে রাখে এই পাখিগুলো।সন্ধ্যে নামলেই তাদের বাসা নীলচে সবুজে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতো। আজকাল তো এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে শহরের আনাচে কানাচে কিছু বিষণ্ণ চড়ুইদের দেখা মিললেও প্রতিভাবান বাবুই পাখিরা অভিমান করে লুকিয়ে গেছে কোথাও।
মাথার পেছনে দু-হাত বেঁধে আকাশের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রবিলাস করছিলাম। হঠাৎ একটা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগলো।
খুব পরিচিত ঘ্রাণ।
বুঝলাম ইলিয়ানা এসেছে। ইলিয়ানা তার লম্বা চুলে বেলি ফুলের সেন্ট দেয়া একটা তেল ব্যবহার করে। তাই নিঃশ্বব্দে হেঁটে আসলেও ওর উপস্থিতি টের পাই।
আমি যে বুঝতে পেরেছি ইলিয়ানা আমার পেছনে দাঁড়ানো, সেটা আমি ওকে বুঝতে দেইনা।
বেশ কিছুক্ষন ও দাঁড়িয়ে থাকে, প্রায় ঘন্টাখানেক।
হুট করেই টুং টাং আওয়াজে না চাইতেও পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে দিয়েছে ইলি।
তার মানে আমার জন্য চা এনেছিল। “শালার মশা মারতে গিয়ে জন্য চা টা পরে গেলো”
ইলির বিরক্তিমাখা কন্ঠ…
ভাগ্য ভাল একঘন্টা আগে পরেনি। একদম গায়ের উপর যেভাবে পড়েছে গরম হলে তো পুরো গা ই ঝলসে যেত।
ইলিয়ানা এবার চুপ হয়ে যায়।
কি যেন একটু ভেবে বলে,
” জানেন? আমি আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে অনেক নিরাপদ বোধ করি। মনে হয় আপনি আমার জন্য দুনিয়ার সবথেকে নিরাপদ জায়গা। আপনার পাশে থাকলে আমার মাথায় থেকে সব দুশ্চিন্তারা ভেগে চলে যায়। আমি ভালো থাকি। ”
– বাহ। তোমার ভালো লাগা বা ভালো থাকার একটা কারণ আমি, এটা জেনে খুব ভালো লাগলো।
– আমি কি করব বলুন তো। আমার তো সারাক্ষন ই আপনার পাশে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।
– আমার কাছে ঠিকানা রেখে, তুমি পাখি হয়ে উড়ে যাও।
আপনার কথা বুঝতে পারছিনা।
সময় হলে বুঝবে। রাত অনেক হয়েছে, বাসার দিকে চলো।
ইলিয়ানা বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে। পেছনে পেছনে আমি ইলিয়ানাকে অনুসরণ করি। পাশের এক ঝোপ থেকে হাসু বের হয়ে হাসু আমার পেছনে হাটা শুরু করে।
হাসুকে ঝোপ থেকে বের হতে দেখে অবাক হই একটু।
ওর দিকে চোখ বড় করে তাকাতেই ও এক গাল হেসে বলে “আমার দোষ নাই, আমনেরা কি করেন, হেইডা দ্যাখতে আমারে চাচাজান পাডাইছে”
ইলিয়ানা বিষয়টি ভালোভাবে নিল না। আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো, মনে হলো সে তার বাবার এমন কাজের জন্য নিজেই লজ্জিত।
আমি মনে মনে হাসলাম।
অন্তত ছোট হলেও অভিমান করার মত একটা কারণ পাওয়া গেল। বিশ্বাস যেখানে হারিয়ে যায় সেখানে নিজের অবস্থান স্থায়ী করার ইচ্ছে কারো মাঝেই থাকেনা। এ উসিলায় আমি সেদিন ভোর রাতেই ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। কিন্তু কোথাও যেন একটা হাহাকার কাজ করছিলো ইলিয়ানার জন্য। এ ‘কদিনের দেখায় ইলিয়ানার মাঝে আমি একটা ছোট খাট কারণ ও খুঁজে পাইনি, যেটাকে কেন্দ্র করে ওকে কোন দোষে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। অনেকটা নিঁখুত স্বভাবের মানুষ যদি কোন ভেংগেচুরে যাওয়া, ঠকে যাওয়া ব্যক্তির সামনে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে বেড়ায়, তবে যে কেউ ই ইম্প্রেসড হতে বাধ্য।একটা জিনিস
মনে হলো পুরুষ মানু্ষ জীবনে বহুবার প্রেমে পড়ে, কারণে অকারণে প্রেমে পড়ে।
আর প্রতিটা প্রেম ই তাদের কাছে প্রথম প্রেম।
নারীরাও প্রেমে পড়ে হয়ত বহুবার। কিন্তু তাদের প্রেম হয় শুধু প্রাপ্তির জন্য। অকারণে তারা প্রেমে পড়েনা।
মাথার ভেতর এমন সব আজগুবি চিন্তা করতে করতে হেঁটে চলে এসেছি বহুদূরে। মাথায় বিভিন্ন ধরণের ভালমন্দ চিন্তাভাবনা চালাতে থাকলে অকপটে বহুদূর হেঁটে ফেলা যায়।
মহেশপুর গ্রামে খারাপ কাটেনি আমার দিন। বিদায় নেয়ার সময় মনে মনে ভাবছিলাম,ইলিয়ানার জন্য হলেও আমার এ প্রস্থান শেষ প্রস্থান নয়। সকালে উঠে আমাকে না দেখলেই ওর ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা কাজ করবে।
এই শূন্যতার অনুভূতিটা আমিও পেয়েছি।
স্রোতের বিপরীতে বৈঠা মেরে নৌকা চালিয়ে নিচ্ছিলো হারুণ মাঝি। মাঝিদের নামগুল অদ্ভুত, মাঝি শব্দটার সাথে সুন্দর ভাবে মিল খায়। সকালে পাখি ওঠার আগেই এরা উঠে পরে। ঘাটে এসে দু-একজন যাত্রীদের আসায় বসে থাকে।
নৌকা দিয়ে মহেশপুর পার হয়ে ওপারে গেলেই একটা ছোট্ট শহর৷ এ শহরে কিছু যান্ত্রিক ভটভটি চলাচল করে।
ঘণ্টাখানেক ভটভটিতে করে এগিয়ে গেলেই ঢাকার বাস পাওয়া যায়৷ এখানে দিনে একটাই বাস। সকাল সকাল রওনা না দিলে সেটা মীস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
অনেক ঝামেলা পেরিয়ে ভাগ্যক্রমে বাস পাই। আমি অবশ্য বেশ আগেই চলে এসেছি। আরো দু-ঘন্টা পরে বাস ছাড়বে।
বাসের সিটে হেলান বসে চোখ বন্ধ করতেই ঘুম চলে আসে চোখে।
রাতে না ঘুমানোর দরুন এটা।
পুরোপুরি ঘুম ভাঙ্গার আগেই আমার অবচেতন মস্তিষ্ক হুট করে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন হয়ে যায়।
নাকে সেই চির পরিচিত ঘ্রাণ,
চোখ মেলতে ইচ্ছে করছেনা। জানি চোখ মেললেই দেখব আমার সামনে ইলিয়ানা রাগী একটা মুড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম…
আস্তে আস্তে ঘ্রাণটা হারিয়ে গেল।
চোখ খুলে দেখলাম আমার ভ্রান্ত ধারণা। আমি হয়ত ওকে বেশি অনুভব করছি তাই এমনটা ঘটছে।
চোখ বন্ধ করে ফেললাম আবার৷ কখন যে সময় কেটে গেল টের পাইনি।
যখন ঘুম ভাংগে তখন বাস তার পূর্ণ গতিতে চলছে।
আড়মোড়া ভেংগে পাশে তাকাতেই ছোট খাট একটা চিৎকার দিলাম। বাসভর্তি লোকজন সব আমার দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে তাকালো।
চিৎকার দেয়ার অবশ্য একটা কারণ ও আছে। আমার পাশেই বসে আছে ইলিয়ানা।আমি যে চিৎকার দিয়ে ফেলেছি, পুরো বাসের লোকজন হতচকিত হয়ে উঠেছে কিন্তু তার কোন রিয়াকশন নেই। সে ছাগলের মত কেক চিবাতে ব্যস্ত।একটু পর বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে পানিও খেলো।
ওকে দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি কি বলব তা বুঝছিলাম না। তবে মনের কোথাও যেন একটু আনন্দ হচ্ছে।
একটু ভালো-লাগা দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
আমার সাথে একবিন্দু ও কথা বলেনি ইলিয়ানা।
বরং আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা পিঠা সহ আরো অনেক কিছু একা একাই সাবার করেছে। এমন একটা ভাব নিচ্ছে আমি তার পাশে বসা অপরিচিত একজন মানুষ৷ আমাকে সে চিনেই না।
আমার মনে আবার একটু কালো মেঘ জমল।
মনে মনে ভাবলাম, ঠিক আছে আমার পথে আমি ওর পথে ও।যে যার মত করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাব। কিন্তু ও আমার দিকে একবারেএ জন্য আড়চোখেও যে তাকাচ্ছে না বিষয়টি আমি মেনে নিতে পারছিনা।
এরকম গুমোট পরিবেশে চুপচাপ থেকেই পুরোটা রাস্তা শেষ হয়ে গেল। বাস থেকে সবাই খুব তাড়াতাড়ি করে নামছে। সবার সাথে নেমে গেল ইলিয়ানাও।
আমার নামার তাড়া নেই। কারণ আমার কোন গন্তব্য নেই। আমি নিজেও জানিনা আমাকে এখন কোথায় যেতে হবে। ইলিয়ানার আমূল পরিবর্তন আমাকে অবাক করলো। ও সবার সাথে নেমে যাওয়ার পর আমি মনে মনে অনেকটা কনফিউজড হয়ে গেলাম।
হয়ত আমি ওকে এতটা বেশি অনুভব করেছি যে অন্য কোন মেয়েকে আমি ইলিয়ানা রূপে দেখে এসেছি পুরোটা রাস্তা।
মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে মানুষের অনুভূতিকে বোকা বানায়।
বাস থেকে নেমে আশেপাশে তাকালাম,এখান থেকে শিকড় নামের একটা বাসে উঠতে হবে৷ কেন জানিনা মনে হচ্ছে আমাকে প্রথম গন্তব্য হবে ঐ বন্ডেজ ক্লাব।
হিসেবের অগোছালো খাতাটার গোছালো হিসেবের শুরুটা ওখান থেকেই করতে হবে।
…
#পর্ব_৮
_________________________
বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরে একটা বাস পেলাম। অতিরিক্ত যাত্রীদের চাপে বাস একদম কানায় কানায় পূর্ণ৷ তাও ঠেলে ঠুলে ভীড়ের মাঝে জায়গা খুঁজে চলেছি।জীবন সব জায়গায় যুদ্ধের। পেছন থেকে বেশ কয়েকবার আমার জামা কাপড় টেনে ধরেছে কে বা কারা যেন, ফাঁকা জায়গায় কার আগে কে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে সেটার একটা অহেতুক প্রতিযোগিতা চলছে। যাই হোক বাসের উপরের হাতল ধরে কোন রকম জায়গা করে কলাবাদুড়ের মত ঝুলে রইলাম৷ এত গাদাগাদি অবস্থা যে নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিজেন না অন্য মানুষের বর্জন করা কার্বণ ডাই-অক্সাইড প্রবেশ করছে। এর মধ্যেই পায়ের উপরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। চাপাচাপির ভেতরেও ছোটখাট একটা লাফ দিয়ে উঠলাম। যে ব্যক্তি আমার পায়ের উপর তার পা দিয়ে পিষে দিয়েছে তার কলার ধরে দুইটা থাপ্পড় দিতে পাশে তাকালাম।
দেখি, ভিড়ের মাঝ থেকে বিড়ালের মত উঁকি মেরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ইলিয়ানা। আমার পায়ের উপরে ইলিয়ানাই তার হাই হিল জুতা দিয়ে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত আক্রমণ চালিয়েছে। মানুষের বেশিরভাগ হ্যালুসিনেশন হয় যখন সে একা থাকে, কিংবা তার মস্তিষ্ক যখন ঘুম বা বিশ্রামের অভাবে ভুগে। এই ভিড়ের মাঝে আমার হ্যালুসিনেশন অবশ্যই হচ্ছেনা।আমার পাশে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সে অবশ্যই ইলিয়ানা।
তবে ওর মাথা থেকে এখন আর বেলী ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছিনা। পুরো বাস জুড়েই ঘামের একটা আঁসটে গন্ধ ছড়িয়ে আছে।
হেল্পারকে চিৎকার করে বাস থামাতে বললাম। বাস থামলো। ভীড় ঠেলে বাস থেকে নামার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।
ঢোকার সময় যেমন আমার জামা কেউ পেছন থেকে টেনে ধরেছিলো, এবার ও তাই হলো। পেছনে ফিরে দেখলাম ইলিয়ানা।
এবার বুঝলাম বাসে ঢোকার সময় ইলিয়ানাই আমার জামাকাপড় টেনে ধরে সাপোর্ট নিয়ে ভীড়ের ঠেলে আমার পাশে জায়গা করে নিয়েছিল।
বাস থেকে নামার পরে জিজ্ঞেস করলাম,
কি ব্যাপার ইলি? আমার সাথে লুকোচুরি কেন?
– কিসের লুকোচুরি?
– প্রথমে ঢাকায় আসার বাসে উঠে আমার সামনে দাঁড়িয়েছিলে। আমি চোখ মেলে দেখি নেই তুমি। পরে আবার দেখি আমার পাশের সিটে বসে আছ।
বাস থেকে নেমে আবার উধাও।
পরবর্তীতে শিকড় বাসে আবার আমাকে ফলো করে আমার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছ, আমি নেমেছি আমার সাথে তুমিও নেমেছ। সমস্যাটা কি?
-কোন সমস্যা নেই।জানতাম আপনি হয়ত চলে আসতে পারেন পালিয়ে। তাই আমি পিছু নিয়েছিলাম আপনার। বাসে উঠে আমি প্রথমে আপনাকে খুজে বের করি৷ এরপর আপনার পাশে বসার জন্য পাশের সিটের লোকটার থেকে আমি টিকেট কিনে নেয়ার উদ্দেশ্যে বাস থেকে নেমে তাকে ম্যানেজ করি৷ পরে বাস ছাড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে আপনার পাশে বসি। এবং তখন আপনি ঘুমাচ্ছিলেন। আমার একটু রাগ ছিল তাই আপনার সাথে কথা বলিনি। এর পরের বার বাস থেকে আগে আগে নেমে ইচ্ছে করেই লুকিয়েছিলাম। আপনি যখন অন্য বাসে উঠলেন আমি আবার আপনার পিছু নিয়েছি। এখন আমি আপনার সাথে যাব,আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই।
– কেন? আমার সাথে কেন?
– আমার ঢাকায় থাকার মত জায়গা নেই৷
– তুমি যে ফুফুর বাসায় বড় হয়েছ সেখানে যাও।
– ওখানে শুধু ফুফু না। আমার ফুফু,চাচা মামা, সবাই আছেন। গেলে তারা আমাকে সাদরে জায়গা দিবেন। কিন্তু মাদক চোরাকারবারিদের হাত থেকে আমি রেহাই পাব না। আমাকে যে কোন সময় তুলে নিয়ে যাবে।
ইলিয়ানা কথাটা মিথ্যে বলেনি। শুধু ইলিয়ানার নিজ এড়িয়াতে নয়, পুরো ঢাকাটাই ওর জন্য অনিরাপদ৷
কিছুক্ষন ভাবলাম।
ইলিকে বললাম, এর একটা সমাধান আমার কাছে আছে।
তুমি তোমার ফুফু, মামা চাচা যার ইচ্ছে তার কাছেই থাকতে পারবে।নিরাপদ ভাবেই।
– কি সমাধান?
– বলব তবে একটা শর্ত আছে।
– কি শর্ত?
আজ সারাদিন আমার সাথে ঘুরতে হবে৷ যেখানে যেখানে যাব, বাস ভাড়া খাওয়ার বিল, সব তোমাকে পরিশোধ করতে হবে৷ সর্বোপরি আমি যা বলব তা শুনতে হবে৷
– আমি রাজি।
সাথে সাথে “আমি রাজি” কথাটা এমন ভাবে বললো যেন মনে হল ও দৌড় প্রতিযোগিতায় দৌড়ের জন্য রেডি হয়ে ছিল। বাঁশির সংকেত সোনার সাথে সাথে যেমন প্লেয়ার দৌড় শুরু করে ইলিয়ানাও সেভাবে প্রশ্নের সাথে সাথেই রাজি বলে দিল।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, না ভেবে কোন কাজ করলে যে পরিণতি খারাপ হয়, তার উপযুক্ত একটা শিক্ষা ইলিয়ানাকে দিতে হবে।
যেহেতু খরচের ভাড় ইলিয়ানার, বাসে না উঠে একটা সি এন জি নিলাম।
– আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
– এমন একটা জায়গায় যেখানে মেয়েদের মারা হয়।
– কি আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন?
– না মেরে ফেলা হয়না।কিভাবে বুঝাই কালো বেল্ট দিয়ে মেয়েদের পেছনে মারা হয়।
– কি সব অশ্লীল কথাবার্তা। আপনি আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন কেন?
– টুইস্ট আছে।
– কি টুইস্ট?
– মেয়েরা ওখানে ইচ্ছে করেই মার খায়। তাদের মার খেতে ভাল লাগে। পেইন উইথ প্লেজার। বুঝবেনা তুমি।
– পুরো বিষয়টি ঘোলাটে লাগছে আমার কাছে। আমাকে খুলে বলুন।
– বেশি খুলে বলতে পারবোনা। আমার শরম করে।
– ফাজলামো করছেন আমার সাথে?
– বেশি কথা না বলে চুপ থাকো। আমি কি করি তা দেখো।
ইলিয়ানা কনফিউজড হয়ে বসে থাকে। বুঝতে পারছিলাম আমার উপর থেকে ওর অগাধ বিশ্বাসের চাকে ঢিল পড়েছে।
আধাঘন্টা পরে সি এন জি গিয়ে থামলো একটা বিশাল শপিং মলের সামনে। ইলিয়ানা এখানে আগেও এসেছে। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পরিচিত জায়গা দেখে ওর ভেতরের নার্ভাসনেস টা একটু কমেছে।
নীড়ার সাথে টপ ফ্লোরের যে রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিলাম সেখানটায় আবারো গিয়ে বসলাম৷ তবে তাদের কাষ্টমার হিসেবে৷ খুব সতর্কতার সাথে ওদের ওখানের কার্যক্রম খেয়াল করতে লাগলাম।
আমি এবং ইলিয়ানা বেশ অনেকগুলো খাবার অর্ডার করলাম যাতে অনেক ক্ষন বসে খাওয়া যায়।
আমরা উক্ত রেস্তোরায় ঢোকার পরে এখন পর্যন্ত দুজন মহিলা কিচেনের দিকে ঢুকেছে।
তাদের দেখে কোন ভাবেই বাবুর্চি মনে হয়নি। মোটামুটি শিওর হলাম এরা দুজন ই আন্ডারগ্রাউন্ড ক্লাবের সদস্য। তবে ওদের হেঁটে যাওয়াটা একদম স্বাভাবিক ছিল।
কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি, বাঁধাও দেয়নি।
হয়ত ওদের আগে থেকেই চেনে এজন্য অথবা ওরা চলাফেরা করার জন্য নির্দিষ্ট কোন কোড ব্যবহার করে।
এতক্ষনের অবজারভেশনে দুটো জিনিস খুব করে চোখে পড়লো।
**খাবার সার্ভ করে এমন একজনের কাছে আর্মর রয়েছে। হবে হয়ত কোন রিভালবার বা পিস্তল। জামার উপর থেকে শিওর হতে পারছিনা।
** দুজন মহিলা, যারা ভেতরে গেলো তাদের ভেতর একজন বেশ মোটা এবং ফর্সা।
সাথে করে একজন হ্যাংলা পুরুষ নিয়ে এসেছে। তাকে একগাদা খাবার কিনে বসিয়ে দিয়ে মহিলাটি ভেতরে ঢুকে গেছে। হ্যাংলা লোকটি নিসন্দেহে একজন ভোজন রসিক। চিকন হলে কি হবে সে গোগ্রাসে খাবার খাচ্ছে।
তার লম্বা মোচে খাবার লেগে কি একটা বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বুঝলাম এ লোকটি হয়ত ঐ মহিলার গাড়ির ড্রাইভার হবে।
ওর সাথে কোন রকম ভাব জমানো গেলে বন্ডেজ ক্লাব সম্পর্কে অনেক তথ্যই জেনে নিতে পারবো।
হুটহাট কোন মানুষকে পটানোর ক্ষেত্রে মেয়ে মানুষ বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ইলিয়ানাকে বললাম, ঐ লোকটির টেবিলে গিয়ে তার সামনা সামনি বসতে।
ইলিয়ানা আমার দিকে তাকালো।
ওকে আশ্বস্ত করলাম, তুমি গিয়ে যাস্ট বসো। বাকি সবকিছু আমি সামলাবো। যা বলবো,
শুধু আমার সাথে কথায় তাল মেলাবে।
ইলিয়ানা যেহেতু আগে কথা দিয়েছিলো আমি যা বলবো তা শুনবে,
সুতরাং ও আমার কথা শুনতে বাধ্য ছিল।যথারীতি গিয়ে ও লোকটার সামনের টেবিলে বসলো।
লোকটি একবার তাকিয়ে ইলিয়ানাকে দেখল। এরপর তার হালুম হুলুম করে খাওয়া বন্ধ রেখে অতি ভদ্রতার সহিত খেতে শুরু করলো।
কিছুক্ষন পরে আমি গিয়ে ইলিয়ানার পাশে বসি।
লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
ভাই যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
লোকটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। বললো,
কি প্রশ্ন করিবেন?
খাওয়া অনেক বাকি,
আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে,
খাওয়ায় মনোযোগ দি।
“বাহ, কি সুন্দর কবিতা!!” বলে হাত তালি দিলাম।
ব্যাটার কবিতা বলার বাতিক আছে।
অথবা ইলিয়ানার সামনে কবি সাজতে চাইছে। তাই আমিও রসিকতা করে বললাম,
ভাইজান তো একদম ভোজন রসিক।
দাঁড়ি মোচেও লেগে আছে খাদকের প্রতীক।
বড় জানতে ইচ্ছে করে মহাশয়,
কি আপনার পরিচয়?
লোকটা বেশ মজা পেলো।। সে খাওয়া রেখে কবিতার লাইন মিলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ছন্দে ছন্দে জবাব দিলো,
নাম আমার সিদ্দীক,
খ্যাতি আছে চারদিক।
হঠাৎ করে আমার পরিচয়
জানতে কেন চাইছেন তা জানতে ইচ্ছে হয়।
” বাহ ভাই বাহ, আমি হার মানলাম ছন্দের যুদ্ধে আপনাকে হারানো যাবেনা।”
কথাটি ম্যাজিকের মত কাজ করলো। সে একদম গলে গেল। এদিকে ইলিয়ানা হা করে সব দেখছে।
বললাম, জনাব সিদ্দীক। এইযে আমার পাশে যে বসে আছে, এ হচ্ছে আমার কাজিন। বুঝলেন? আপনার মত সেও ভোজন রসিক। কবিতা শুনতেও অনেক পছন্দ করে। ও তো নিজের মুখে বলতে লজ্জা পায়, তাই আমিই বলে দিচ্ছি আপনার খাওয়া দেখে আমার বোন ক্রাশ খেয়েছে আপনার উপরে৷
ও আপনার ফ্যান হয়ে গেছে। এজন্যই আসলে অন্য সিট থেকে উঠে আপনার সামনে এসে বসেছে।
সিদ্দীক হতভম্ব হয়ে গেল আমার কথা শুনে। আড়চোখে বেশ কয়েকবার ইলিয়ানাকে দেখলো৷ এদিকে ইলিয়ানা রেগে একদম লাল হয়ে আছে। কিন্তু ওর কিছু বলার বা করার নেই।
আমার কাজের উপরে ওর প্রশ্ন করা নিষেধ।
সিদ্দীক কে আরো নানান কথাবার্তা বলে অফার করলাম আমাদের সাথে বাইরে নেমে কোথাও একটু ঘুরে আসার। ও ঘড়ি দেখলো। আমাকে জানালো ওর হাতে আরো ঘন্টাখানেক সময় আছে। সুতরাং যাওয়াই যায়। মহিলাটি ঢুকেছে আরো এক ঘন্টা আগে।
হিসেব টুকে নিলাম।মহিলাটি দু-ঘন্টা করে ক্লাবে সময় দেয়।
আমি – সিদ্দীক এবং ইলিয়ানা পাশাপাশি হাঁটছি। সিদ্দীক নতুন নতুন ছন্দ বানাচ্ছে এক পর্যায়ে ইলিয়ানাও ব্যপারটি উপভোগ করতে শুরু করে।এর ভেতরেই ঘটে গেল এক অকাজ। কোথা থেকে একটা কাক এসে আমার মাথার উপরে তার সাদা বিষ্ঠা ত্যাগ করে চলে গেল।
ইলিয়ানা তা দেখে হেসেই খুন।
ওর নির্মল হাসি দেখতে আমার বেশ ভালো লাগছে।
সিদ্দীক কবিতা বানালো,
আপনি হাঁটছিলেন আমাদের পাশে,
উড়ন্ত কাক এসে হেগে দিল আপনার কেশে,
আপনি রাগবেন না। করবেন না মুখ ফ্যাকাশে,
আপনার ভাগ্য ভালো হাতি ওড়েনা আকাশে।
কবিতার আগা মাথা আমি না বুঝলেও ইলিয়ানা আগের থেকেও বেশি হাসতে শুরু করলো৷ মনে হলো ও হাসতে হাসতে মাটিতে পরে গড়াগড়ি খাবে।
আমি বললাম কি ব্যাপার এখানে হাসার কি হলো,,
ইলিয়ানা আমাকে বুঝিয়ে দিলো,
আপনার ভাগ্য ভাল হাতি আকাশে ওড়েনা। লাইনটার মানে বুঝছেন?
– না।
যদি হাতি আকাশে উড়তো,আর সে যদি কাকটার মত আপনার মাথায় হাগু করতো, তাহলে আপনার কি অবস্থা হত ভেবে দেখেন।
আমি বিষয়টি কল্পনায় ভেবে দেখলাম এবং যথারীতি ভয় পেলাম। আসলেই ভাগ্যিস হাতি ওড়েনা আকাশে।
সিদ্দীকের সাথে বেশ অনেক সময় কাটালাম।
সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম তথ্য আমি বেশ কৌশলের সাথে জেনে নিলাম।
ওকে বিদায় দিয়ে ইলিয়ানার সাথে ঢাকা শহরের বিশেষ কিছু জায়গায় রিকশা নিয়ে অনেক ঘুরাঘুরি করলাম। রিকশায় ঘুরতে আমার ভাল লাগে। যেহেতু ভাড়া ইলিয়ানা দিবে,আমার ঘুরে বেড়াতে সমস্যা কোথায়!
একটা জায়গায় এসে রিকশা থামলো।
ইলিয়ানাকে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে।
ও অধীর আগ্রহে কান পেতে আছে, মাদক চোরাচালানকারীদের হাত থেকে নিজেকে কিভাবে সেফ রাখবে সেটা জানার জন্য।
ওকে বললাম –
বোরকা ও নিকাব পরিধান করে চলাফেরা করতে।
এটা সকল ধরণের শত্রু থেকে একটা মানুষকে মুক্ত রাখতে সক্ষম।
বুদ্ধিটা ওর পছন্দ হয়েছে। ওকে নির্দিষ্ট কিছু সময় বেঁধে দিলাম বাসায় ঢোকা এবং বের হওয়ার জন্য।
ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
আমার থাকার ব্যবস্থা না হয় হলো। আপনার কি হবে?
– মহাপুরুষদের থাকার জায়গার অভাব নেই।
উত্তর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
ইলিয়ানার সাথে আর দেখা হবেনা আমার। আমি জানি ও আমার প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে আছে৷ যতক্ষন না ওর চোখের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে যাব ও তাকিয়ে থাকবে। মনে অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছে। এ কষ্টের উৎপত্তি ভালোবাসা,ভালোলাগা নাকি মায়া থেকে তা আমি জানিনা৷
.
.
মাতৃছায়া আবাসিক হোস্টেল।
এ হোস্টেলের ম্যানেজারের নাম জাফর। বয়স ৩০ পেরিয়েছে।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম সিট খালি আছে কিনা,
উত্তরে জানালো আছে। এক মাসের এডভান্স দিয়ে বুকিং করতে হবে৷
– কয়টা সিট খালি আছে?
– ৫/৬ টা৷ যেটা পছন্দ ইচ্ছামত নিতে পারবেন।
– আমার কাছে এডভান্সের টাকা নাই৷
চলতি মাসের ও ভাড়া নাই।
– পাগল নাকি, তাহলে সিট খুজতেছ ক্যান?
– সিট খালি ফেলে রাখলে টাকা পাইবেন? যে কয়দিন থাকব, প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা দিব নগদ।
ব্যপারটা আপনেও গোপন রাখলেন, আমিও রাখলাম।
– ১০০ করে দিলে ভাবতে পারি।
– ৫০ এর বেশি দিবনা।
– আচ্ছা। থাকেন, কিন্তু সিট যখন ভাড়া হয়ে যাবে, তখন কিন্তু ছেড়ে দিতে হবে৷
– বলতে হবেনা।
.
.
.
রাত তিনটা ত্রিশ
হঠাৎ করেই ক্রিং ক্রিং শব্দে রিং আসে নাজিফা খানম এর ফোনে।
ঘুমাতুর চোখে ফোন রিসিভ করে সে।
– হ্যালো, কে বলছেন?
ওপাশ থেকে অদ্ভুত এক হাসির শব্দ ভেসে আসে। এরপর কিছুক্ষন সব চুপচাপ।
” What is your untold Desire? Nazifa khanom”
নাজিফা খানমের ঘুম পুরোপুরি কেটে যায়৷ তার শরীরের লোম দাঁড়া হয়ে ওঠে।
– কে বলছেন?
– আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
আপনার অপ্রকাশিত একটা ইচ্ছের কথা বলুন। যা কোনদিন কাউকে প্রকাশ করতে পারেন নি।
– কেন?
-আমি সেটা পূরণ করব।
– আপনি আমার এমন অপ্রকাশিত ইচ্ছে পূরণ করতে কেন যাবেন?
– কারণ আমি যাকে খুন করব বলে ঠিক করি, আগে তার আন্টোল্ড ডিজায়ার ফুলফিল করে নেই আর তারপর… বেলুন ফাটার মত ঠাস করে একটা শব্দ হয়ে ফোন কেটে গেল।
নাজিফা খানমের শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে৷ সিদ্দীক কে ফোন দেয় সে। গেট ভালো করে লক করা আছে কিনা পুনরায় চেক করতে বলে।