আনটোল্ড_ডিজায়ার #১৫,১৬

0
448

#আনটোল্ড_ডিজায়ার
#১৫,১৬

পর্ব_১৫

মেয়েটা আমাদের বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। একটু পর কিছু কর্মচারী এসে আমাদের মুখরোচক সব খাবার দাবার খেতে দিল।
গেস্ট রুমে বিশ্রামের ব্যবস্থাও ছিল। কর্মচারী আমাদের জানালো, যাতে আমরা খেয়েদেয়ে রেস্ট নেই। সকালে আমাদের সাথে ওনার ম্যাডাম কথা বলবে।
খেয়েদেয়ে বিশ্রামের জন্য বসলাম। ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকলেও এখন ঘুম আসবেনা। আগে নিজের সাথে কথা বলতাম। এখন তাও কথা বলার জন্য সিদ্দীক আছে।
ওকে ডেকে বললাম, বুঝলে সিদ্দীক, ম্যাচের মালিকের বিষয়টা আমার কাছে অত্যন্ত রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে।
সিদ্দীক মনোযোগ সহকারে আমার মুখের দিকে তাকালো।
বললো কিভাবে?
– কেউ এমন একটা জায়গায় কেন শো রুম দিবে, যেটা লোকচক্ষু থেকে অন্তরালে?
মনে হয়না ওনার ওখানে তেমন বেশি একটা বেচাকেনা হয়।
তবুও এত টাকার শো রুম নিয়ে বসার উদ্দেশ্য কি!
– তাইতো! বুঝতে পারছিনা। উদ্দেশ্য কি!
-এটা আমি ঢাকা শহরের বেশ কিছু জায়গায় খেয়াল করেছি। খুব দামি দামি আসবাবপত্র সহকারে এমন এমন জায়গায় বড় বড় শো রুমের স্টল দেয়া হয়, যেখানে মানুষ সপ্তাহের পর সপ্তাহ উঁকি দিয়েও হয়ত দেখে না। বেঁচাকেনা একদম ই নেই। তবুও স্টলগুলো বছরের পর বছর টিকে থাকে।
– এর পেছনে কারণ কি হতে পারে?
– একটা ব্যখ্যা আমার কাছে আছে।
– কি ব্যখ্যা?
– এই যে ধরো যারা এমনটা করে, তাদের কোন না কোন ভাবে অবৈধ লেনদেনের সাথে জড়িত।
এদের প্রচুর ব্লাক মানি থাকে। কখনো আইনী ভাবে নোটিশ দিয়ে এ টাকার উৎস কোথায় তা জানতে চাওয়া হয়, তখন এসব শো রুম থেকে কেনা বেচার একটা হিসেব দেখিয়ে দেয়া যায়।
ব্লাক মানিকে হোয়াইট মানি করার একটা প্রসেস মাত্র।
সিদ্দীক মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, তার মানে আমাদের ঐ ম্যাচের মালিকের ব্লাক মানির সোর্স আছে?
– তার নেই। তবে তার স্ত্রীর আছে।
– আপনি কিভাবে জানলেন?
সেটা বলবো, তার আগে আমাকে বন্ডেজ ক্লাবটায় ঢোকার ব্যবস্থা কর সিদ্দীক।
সব রহস্য ওখানেই লুকিয়ে আছে, সব।
– আমি কিভাবে ব্যবস্থা করমু স্যার!
– তোমার ম্যাডাম বন্ডেজ ক্লাবে যেত, রাইট?
– হুম।
– তাহলে ওখানে প্রবেশের নিয়ম কানুন তোমার জানা আছে।
– ম্যাডাম একটা কার্ড ইউজ করত। ওটা সাথে রাখলে ঢোকার সময় কেউ বাঁধা দেয় না।
– কার্ড টা তোমার ম্যাডাম কোথায় রাখতো? তুমি জানো?
– ওনার রুমে খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।
– আচ্ছা তুমি যেহেতু ঐ বাড়িতে দাড়োয়ানের কাজ করতে, বাড়িটা তোমার হাতের নকশার মত চেনা।
তুমি আমাকে বাড়িটার কোথায় কি আছে তা খুলে বলো ভালো করে।
– আপনে কি ঐ বাড়িতে ঢোকার প্লান করতেছেন।
– হুম, তুমি শুধু আমাকে বলো বাড়িটার কোন পাশে কি কি আছে! কিভাবে ঢোকা যায় সেটা আমি বের করবো।
– কিন্তু, আপনাকে বন্ডেজ ক্লাবে কেন ঢোকা লাগবে? এছাড়া কোন উপায় নেই?
– সিদ্দীক তোমাকে বলেছিলাম না ঐ ম্যাচের মালিককে আমার সন্দেহজনক মনে হয়েছে?
– হুম।
– সে নিয়মিত বন্ডেজ ক্লাবে যায়। তবে তার ক্ষেত্রে আরো একটা জঘন্য বিষয় আমি উদঘাটন করেছি। সে একজন সমকামী।
– কিভাবে উদঘাটন করলেন?
– তার শো রুমের কর্মচারী ছেলেটিকে অবজারভার করে।
সিদ্দীকের সাথে কথা বলতে বলতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম আমি।
.
.

.
.
অবশেষে এ বাসাতেই একটা যথোপযুক্ত জায়গা পেলাম থাকার জন্য। একেবারে ছাদের চিলেকোঠায় দু রুমের একটা ফ্লাট পেলাম।
আমাদের এখানে থাকার জন্য অবশ্য কিছু শর্ত পালন করে চলতে হবে।
ছাদের উপরে থাকা অগণিত চেনা অচেনা বাহারী ফুলগাছ গুলোতে প্রত্যহ সকালে পানি দিতে হবে,প্রতি মাসের দশ তারিখের ভেতরে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করতে হবে।
খুবই সাধারণ শর্ত। মেনে নিয়ে চিলেকোঠাতেই উঠে গেলাম।
তবে অদ্ভুত বিষয় হলো,যে মেয়েটি আমাকে এখানে নিয়ে এলো তার সাথে আমাদের আর দেখা হয়নি। যত কথা হয়েছে, সব কিছুই হয়েছে কেয়ার টেকার এর সাথে।এ বাসার কেয়ারটেকার লোকটাও অনেক আন্তরিক।
সিদ্দীক কে বললাম, সিদ্দীক?
বাসায় তো উঠেছি। কিন্তু আমাদের তো বাসায় কিছুই নেই। না আছে ঘুমানোর জন্য একটা তোষক, না আছে পানি খাওয়ার মত একটা গ্লাস। কি করা যায় বলতো!
সিদ্দীক ওর নিজের মাথা চুলকালো কিছুক্ষন।
বুঝলাম, এ প্রশ্নের কোন উত্তর ওর কাছে নেই।
নিজের ই যা করার করতে হবে।
ম্যাচের মালিকের সাথে আজকেই দেখা করতে হবে। লোকটার প্রচুর টাকাপয়সা থাকলেও, স্বভাবে ভীষন কিপটে।
না- না, আমার দৃষ্টিভঙ্গি উলটো,
আসলে ব্যপারটা এমন, লোকটা ভীষণ কিপটে বলেই এত টাকা পয়সার মালিক হয়েছে।
ওনার কাছ থেকেই সাহায্য নিতে হবে। তবে সাহায্য কেউ কাউকে এমনি এমনি করে না। ভবিষ্যতে যদি আমাকে দিয়ে তার কোন উপকার হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তবে আমি তার কাছ থেকে সাহায্য পাব না।
সুতরাং তার কাছে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তোলাটা ভীষণ জরুরি।
এদিকে সিদ্দীক কে ছোট খাট একটা কাজ দিলাম।
ফারহান যে হাসপাতালে ক্যান্সারের রোগী হওয়ার নাটক করে অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা লুট করছে, সেখানে পাঠালাম সিদ্দীক কে। ওর কাজ হলো ফারহান কে ফলো করা। ফারহান কখন কোথায় কেন যায় সবকিছু আমাকে ডিটেইলস এ জানানো।
সিদ্দীক এ গুরু-দায়িত্ব মাথায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
আমি পাঁয়ে হেটেই রওনা দিলাম আমার গন্তব্যে।
যখন পৌঁছালাম, তখন খুব তেষ্টা পেয়েছে। ধনকুব ম্যাচ মালিকের, কাঠের ফার্ণিচারের শো রুমে ঢুকেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, এক-গ্লাস পানি!!
হাসান খুব দ্রুত আমার জন্য ফ্রীজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি বের করে দিলো।
ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি সাবার করে দিলাম।
বাবুমিয়া চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বাবু-মিয়া হলো ধনী ম্যাচ- মালিকের নিকনেম। যদিও এটা তার জন্মনিবন্ধনকৃত নাম নয়।তার বাবুমিয়া নামের পেছনে একটা মারাত্মক ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, সেটা তিনি আমাকে শোনাবেন শোনাবেন করে এখনো শোনান নি। যাই হোক,
তিনি আমার দিকে বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললেন! ব্যাপার কি! হয়েছে তোমার!
কিডনাপার রা আবার ধাওয়া দিলো নাকি!
আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
না, জনাব। তেমন কিছু নয়।
কিন্তু আরো ভয়াবহ কিছু।
তিনি আরেকটু সামনে ঝুঁকে বসে দু হাত গালে দিয়ে মনোযোগী ভঙ্গীমায় বসে জিজ্ঞেস করলেন!
-খুলে বলো তো! ঘটনা কি!
– খবরের কাগজ কি পড়েন না আজকাল?
– না পড়া হয়না।
– শহরে নতুন এক গ্যাং নেমেছে।
যারা মানুষকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তার জীবনের গোপন ইচ্ছে কি! এবং সেটা তারা যে কোন উপায়ে পূরণ করে দেয়ার চেষ্টা করে।
– এটা তো অদ্ভুত এবং ভালো খবর। খারাপ বা ভয়াবহ খবর কি!
– গোপন ইচ্ছেটা পূরণ করার পর, ভিক্টিম কে” হত্যা” করা হয়।
হুট করেই হত্যা করা হয় এমন ভাবে বললাম, বাবুমিয়ার শরীর একটু ঝাঁকি দিয়ে উঠলো।
জিজ্ঞেস করলো, কারা এ কাজ করছে এবং কাদের কাছে এমন কল যাচ্ছে?
– সিদ্দীক কে চিনেন?
– তোমার সাথে যে লোকটা ছিলো সে?
-হুম। খুব সম্ভবত ও যে বাসার দাঁড়োয়ান ছিলো, সে বাসার মালিককে দিয়ে এমন কার্যকলাপের শুরু৷ এরপর বেশ কয়েকজনের সাথেই সেম ঘটনা ঘটেছে। এমনকি আমার সাথেও। আমাকেও ফোন করা হয়েছিলো।
শেষ ইচ্ছে জানতে চেয়েছে। আমি বলিনি। এজন্যই হয়ত কিডন্যাপ করার পর আমাকে খুন না করে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো শুধু।
পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী,
প্রায় বারো জন মানুষ ঐ গ্যাং এর হাতে শিকার হয়েছে। সবার ফোনের কল রেকর্ড ঘেটে একই তথ্য পাওয়া গেছে৷পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকেই আটক করতে পারেনি।
– এটা তো মহা সর্বনাশের কথা।
আমার কাছে এমন কল আসলে আমার কি করা উচিৎ হবে?
– সেটা ভাবার সময় আমার কাছে নেই জনাব। আমার মাথায় এখন অন্য চিন্তা!
– কি চিন্তা!
– ঐ গ্যাং এর সাথে যুক্ত একজন আমার স্ত্রী ও ওয়াইফ কে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে।
গত কাল রাতে আমি এ খবরটি পাই।
ওদের উদ্ধার করার পরিকল্পনা করছি।
– পুলিশে জানিয়েছ?
– লাভ নেই।এর থেকে নিজে নিজে ওদের উদ্ধার কার্যে নেমে পড়ব। এটা বেশি এডভেঞ্চারের। রোমাঞ্চকর লোমহর্ষক একটা গল্প হবে। আপনি শুনে মজা পাবেন।
– শুনব মানে! আমি নিজেও তোমার সাথে এ অপারেশন এ যুক্ত হব। আমাকে কি করতে হবে, তা বলবে।
– আপনাকে কিছু করতে হবে না শারিরীক ভাবে। আমার কাছে এখন এমন একটা মিশন পরিচালনা করার মত অর্থ নেই। আপনি আমাকে আর্থিক সহযোগিতা করলেই হবে।
– ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা।
কিন্তু তুমি কিভাবে কি করবে তা আমার কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার খুব ইচ্ছে জাগছে। আমাকে বিশ্বাস করে সাথে নিতে পারো।
– বেশ আপনি থাকবেন আমার সাথে। তবে একটা সহজ ধারণা দেই আগে আপনাকে।
যে বা যারা,
লোকজন দের ফোন দিয়ে আনটোল্ড ডিজায়ার বা গোপন অভিব্যক্তির কথা জিজ্ঞেস করে এবং হত্যা করে, সেই দলের লোকজনদের সাথে আমার কোন প্রকার চেনাজানা বা সম্পর্ক লেনদেন কিংবা ঝামেলা নেই।
আমার ঝামেলা ফারহান নামের এক আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়ার সাথে।
ফারহান ঐ খুনী গ্যাং এর সাথে কোনভাবে কানেক্টেড হয়েছে এবং আমার পিছু লেগেছে। তবে এর ভেতরে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বন্ডেজ ক্লাব। আমার ইনভেস্টিগেশন বলছে আপনিও বন্ডেজ ক্লাবে যাতায়াত করেন। দেখুন সেটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। তবে আমাকে আপনি সাহায্য করতে চাইলে অবশ্যই বন্ডেজ ক্লাব সম্পর্কে সকল তথ্য আমাকে দিতে হবে। কারণ সকল রসুনের গোড়ার মত সবকিছুর সাথে ঐ ক্লাবটি ই যুক্ত আছে।
বাবুমিয়া আমার কথা শুনে রুমাল বের করে নিজের কপালের ঘাম মুছলেন। আমার হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এখনকার মত চলে যেতে।তিনি আবার যখন ফোন করবেন, তখন আমাকে দেখা করতে হবে। তার শো-রুম থেকে উঠতে উঠতে বললাম, আমার কাছে আমার স্ত্রী এবং কন্যা অনেক বেশি ভালোবাসা ও আদরের। আপনার সাথে আর দেখা হয় নাকি, আমি জানিনা। যদি বেঁচে থাকি, কোন একদিন দেখা হবে।
তিনি কিছু না বলে চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ রইলেন। আমি দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে আসলাম। পায়ে হেঁটে কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বিরিয়ানির অর্ডার দিলাম।
প্রিয় খাবার খেলে, মন ভালো থাকে। মুক্তভাবে চিন্তাভাবনা করা যায়।
যা করতে হবে তা ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।
বাসায় ফিরে দেখলাম সিদ্দীক বিমূর্ত হয়ে বসে আছে। আমার দেয়া তথ্য অনুযায়ী কোন কিছুই মিল পায়নি সে। তবে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে রিসেন্টলি ওখান থেকে বেশ কিছু এমপ্লয়ি রিজাইন করে চলে গেছে এবং সেখা নতুনদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বুঝে নিলাম, ফারহান তার আখের গুছিয়ে দলবল নিয়ে সেভ জায়গায় গিয়েছে৷ সে গভীর জলের মাছ। তাকে পাঁকড়াও করা কষ্টসাধ্য হলেও দুঃসাধ্য নয়। সে গভীর জলের মাছ হলে আমিও সামুদ্রিক মাছ শিকারী হিসেবে অবতীর্ন হব। সিদ্দীক কে বললাম রেডি হতে।
আজ রাতে ওর পূর্বের মালিকের পরিত্যক্ত বাসায় অভিযান চালাতে হবে।
সিদ্দীকের বাসাটার আনাচে কানাচে হাতের তালুর মত জানাশোনা। সুতরাং শুধুমাত্র ভেতরে ঢোকাটা কষ্টসাধ্য হবে। বাকিটা খুব সহজ।
ছাদের উপরে গল্পগুজব করতে করতেই সন্ধ্যা নেমে এলো।
আমরা মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি, ভেতরে একটা অপরাধবোধ তো কাজ করছেই তবে উত্তেজনাও কম কাজ করছে না।
হুট করেই বাবুমিয়ার ফোন কল আসলো। তিনি আমাকে দেখা করতে বললেন।
সিদ্দীক কে নিয়ে রওনা দিলাম তার শো রুমের ঠিকানায়।
ঠিক করলাম, যদি রাজি থাকেন তিবে আমাদের এডভেঞ্চারে আমার সাথে বাবু মিয়াকেও নিয়ে যাবো।
সব হিসেবের মাঝেও একটা হিসেব আমি কিছুতেই মিলাতে পারলাম না। ইলিয়ানা কিভাবে ওদের সাথে যুক্ত হলো। আমার মনে হচ্ছে সিদ্দীকের মালিকের বাসা থেকে বন্ডেজ ক্লাবে ঢোকার এক্সেস কার্ড উদ্ধার করার পর শীঘ্রই উত্তরা সাত নং সেক্টরের বাড়িটায় আমাকে আবার যেতে হবে। আগের বার শিকার হয়ে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিলো। এবার শিকারী হয়ে হামলা দিতে যেতে হবে। কে জানে! ওদের আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজের ভেতর আমার মত কতজনকে ওরা বন্দী করে রেখেছে!

-পর্ব_১৬

মাষ্টার প্লান টা আমি করলাম।
সিদ্দীক আমাকে ওর মালিকের বাসার টেরিটোরি সম্পর্কে সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বলে দিলো।
বাবুমিয়ার সাথে দেখা করার পরে,
উনি সবকিছু শুনে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগনে। এমন একটা পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে এক্সেস কার্ড চুরি করার ব্যপারটা ওনার জন্য খুব উপভোগ্য এবং এডভেঞ্চারের।
আমি ওনার বেশি উৎসাহ দেখে বলে ফেললাম,
ভাইজান এটা কোন বাচ্চাদের গেইম না।
আমরা যেটা করতে যাচ্ছি সেটা আইনের চোখে অপরাধের একটি কাজ। কোন ভাবে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেলে, হয়ত ঐ বাড়ির মালকিনের মার্ডারের কেস এ আমাদের ই ফাঁসিয়ে দেয়া হবে।
বাবুমিয়া বললো!
“আরে তোমার কোন আয়ডিয়া ই নেই আমার সম্পর্কে, আমি বেশ কয়েকবছর ডিফেন্সে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। দেয়াল টপকানো, জোড়ে দৌড়ানো এবং লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথাও যাওয়াতে আমি খুব এক্সপার্ট। ”
সিদ্দীক হঠাৎ করেই কান্না শুরু করলো।
অদ্ভুত ব্যপার হলো, সিদ্দীকের কান্না হুবুহু মেয়েদের মত। ছেলেরা কান্না করলে মেয়েদের মত শুনায়, এই প্রথম অবলোকন করলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, ” কি ব্যাপার সিদ্দীক তুমি মেয়েদের মত কাঁদছ কেনো? ”
– বস, ঐ বাড়িতে আবার, কোনদিন ঢুকতে পারবো, তা ভাবিনি। আমার চতুর্থ ট্রু-লাভ ছলনার একটা ছবি ঐ বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছি।
আমি যখন গ্রাম থেকে শহরে দাঁড়োয়ান এর চাকরী নিয়ে চলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন ছলনা আমার জন্য অনেক কান্নাকাটি শুরু করে। আমি ওকে অনেক বুঝাই। কিন্তু ও বুঝেনা,বিরহের আগুনে ওর কলিজা ছানখান হয়ে যায় বস।
“থামো,
ওর কলিজা যে ছানখান হয়ে গেছে তা তুমি দেখেছো? ”
“না দেখলেও বুঝেছি।ছানখান হওয়ার বেদনা সইতে না পেরে ছলনা আমার জন্য বিষ খেয়ে মারা যায়।
ওর শেষ স্মৃতি হিসেবে একটামাত্র ছবি ছিল আমার কাছে। ওটা আমি ঐ বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছি। আজ নিয়ে আসবো বস, তাই আনন্দে ও বেদনায় কান্না করছি। আপনি কি বুঝবেন একজন বিধব প্রেমিকার কষ্ট!
– বিধব কি?
– মেয়েদের স্বামী মারা গেলে বিধবা বলে। আর ছেলেদের বলে বিধব।
– এটা তুমি কোথায় লেখা পেয়েছ?
– আমি নিজে বানিয়ে নিয়েছি বস।
কান্নার আওয়াজ শুনে আমি ও সিদ্দীক দুজনেই বাবুমিয়ার দিকে তাকালাম।
সে চোখের পানি মুছতে মুছতে, ঠোঁটকে গোল এবং উঁচু করে বলছে,
” ওহ, প্রকৃত ভালোবাসায় শুধু না পাওয়ার যন্ত্রনারে সিদ্দীক, আহ!”
ওদের এমন অবস্থা দেখে আমি হাসব নাকি কাঁদব বুঝে উঠতে পারছিনা। তবে আমি নিশ্চিত আমি এখন এখানে না থাকলে বাবুমিয়া আর সিদ্দীক দুজনে দুজনার গলা জড়িয়ে ধরে কান্নার আসর বসাতো।
আমি বাবুমিয়া এবং সিদ্দীক মিলে একটা ছোট খাটো প্লান বানালাম।
ঐ এলাকায় গিয়ে বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে হলে আমাদের তিনটে সিসি ক্যামেরা এবং একজন নাইট গার্ডের চোখ ফাঁকি দিতে হবে৷ নাইট গার্ড হিসেবে একজন মানুষ যখন কর্মরত থাকে তখন তার চোখ ফাঁকি দেয়াটা অনেকটাই সহজ। কিন্তু মানুষের সাথে সাথে যখন একটা ট্রেইন্ড জার্মান শেপার্ডও টহল দেয়, সেক্ষেত্রে কাজটা অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে সিদ্দীক যেহেতু দাঁড়োয়ান ছিলো এবং ও ওখানে টহল দেয়া জার্মান শেপার্ডকে মাঝে মাঝেই খাবার দিতো,
সেহেতু আমাদের কুকুরটিকে নিয়ে তেমন চিন্তার কোন কারণ৷ নেই। এবার আসা যাক সিসি ক্যামেরার চোখ কিভাবে ফাঁকি দিবো সে বিষয়ে৷
যেহেতু সিসি ক্যামেরা চালু থাকা অবস্থায় আমরা কিছুই করতে পারবো না, সুতরাং সিসি ক্যাম কে নষ্ট করে দেয়াটাই শ্রেয়। আর এ ক্ষেত্রে আমার ছোট বেলায় ছটকা বা গুলতি দিয়ে পাখি মারার বিদ্যাটা কাজে লাগবে।
কয়েকটা মার্বেল পাথর আর গুলতি হলেই সিসি ক্যাম গুলোকে একের পর এক নষ্ট করে দেয়া যাবে৷ কিন্তু একটা ঘোরতর সমস্যা আছে।
যিনি সিসি ক্যামেরা গুলোর মনিটরে চোখ রাখার দায়িত্বে আছেন, তিনি পরপর তিনটে সিসি ক্যামেরার সিগন্যাল ক্যাচ করতে না পারলে হয়ত জরুরি ফোর্স পাঠাতে পারেন। তবে হিসেব করে দেখলাম, রাতের বেলা দ্রুত কোন ফোর্স এসে ইনভেস্টিগেশন শুরু করতে করতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে যাবে। এবং আমাদের কাজ সে সময়টুকুর ভেতরে হয়েও যাবে।
সবকিছু ঠিক করে আমরা রাত ১২ টার সময়ে শো রুম থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলাম।
রুম থেকে বের হওয়ার পর ই দেখকাম বাবুমিয়ার কপালে অসংখ্য ঘামের বিন্দু জমা হচ্ছে।
তিনি নিজেও বিষয়টি খেয়াল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
আসলে এসির ভেতর থেকে থেকে অভ্যাস তো! তাই এমনটা হয়েছে।
বাবু মিয়া কিছুদুর হেঁটে যাওয়ার পর পরই প্রচুর ঘেমে গেলেন। তিনি তার মাথা থেকে নকল চুল টেনে খুলে ফেললেন,আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল তার বিশাল এক টাক।
হাতের পর চুল দিয়ে মুখের সামনে বাতাস করতে করতে এগিয়ে চললেন তিনি। সিদ্দীক বাবুমিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, মিয়াভাই, আপনার হাঁটতে বুঝি অনেক কষ্ট হইতাছে?
– কি যে বলোনা! সিদ্দীক! আমি একটানা দশ বারো ঘন্টাও হাঁটতে পারি।
সিদ্দীক বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো! “হুম তা আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ”
টুকিটাকি কথা বলতে বলতে আমরা আমাদের প্রাথমিক গন্তব্যে চলে এলাম।
রাস্তার দুই লেনের মধ্যবর্তী এড়িয়ায় থাকা কিছু বড় ফুলগাছের ঝোপঝাড় এর আড়ালে আমরা তিনজন মাথা হালকা নিচু করে বসে আছি।প্রথম সিসি ক্যামেরাটি এখান থেকে এমন এংগেলে বসানো যে আমাদের ক্যাপচার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু আমি ঠিক ই এখান থেকে সিসি ক্যামেরাটিতে নিঁখুতভাবে আঘাত হানতে পারবো।
পকেট থেকে মার্বেল পাথর বের করে গুলতির চামড়ার সাথে সেট করলাম,
এরপর প্রচন্ড শক্তি দিয়ে টেনে একচোখ দিয়ে টার্গেট স্থির করে, লখ্যবস্তুর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলাম। ঝপ করে রাবার এর একটা শব্দ হলো। মার্বেল পাথর ছুটে গেল লক্ষ্যবস্তুর দিকে। আম গাছে ঢিল মারলে যেমন টুপ করে আম পরে নিচে, সিসি ক্যামেরার মাথাটাও তেমনি টুপ করে ভেংগে নিচে পরে গেলো। তবে সাথে সাথে একটা সমস্যাও সৃষ্টি হলো। তা হলো শব্দ। মার্বেল পাথর গিয়ে যখন সিসি ক্যামেরার উপর আঘাত করে এবং যখন ক্যামেরা নিচে পরে মাটি স্পর্শ করে দু সময়েই খুব জোড়ালো শব্দ হয়।
আশপাশের লোকজনের চোখে পরে গেলে এটা অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
একদিকের একটা সিসি ক্যামেরার দফা রফা করা গেল এবার বাকি দু’দিকের পালা।
পরের বার ও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সিসি ক্যাম এ নির্ভুল আঘাত করি। তবে এবার একবারের বেশি শব্দ হয়নি৷ ক্যামেরা ভেংগে নিচে পরার আগেই৷ সিদ্দীক দৌড়ে কাছাকাছি গিয়ে তার হাতের চাদর টা নিচে ছুড়ে মারে। যার ফলে নিচে পরার পরে আগের মত জোরে শব্দ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়৷
এর ঠিক আধাঘন্টা পরেই তৃতীয় ক্যামেরটাও সফলভাবে ভেংগে ফেলতে সক্ষম হই।
তবে ভাগ্য সুপ্রশন্ন হওয়ায় আমাদের নাইট গার্ড ও জার্মান শেপার্ড এর মুখোমুখি হতে হয়নি।
বাড়ির কাছাকাছি আসার পর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় কাটাতারে মোড়ানো দেয়াল টপকানোটা।
কিন্তু সিদ্দীকের জানা শোনার বদৌলতে,
আমাদের তেমন বেশি বেগ পেতে হয়নি।
বাড়ির একদম পেছনের দরজার ফাঁকা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে খুলে ফেলার ট্রিকস জানা ছিলো সিদ্দীকের। ও সেভাবেই দরজা খুলে আমাদের নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা পুনরায় বন্ধ করে দেয়।
পুরো বাড়িটি থমথমে অন্ধকার। শুধুমাত্র বাড়ির আঙিনায় ঢুকলাম আমরা। এরপরের চ্যালেঞ্জ বাড়িটার ভেতরে ঢোকা। পুরো বাড়িতে মোট দুটি দরজা। দুটোতেই বড় বড় তালা ঝোলানো। সিদ্দীকের ভাষ্য অনুযায়ী এখন বাড়িতে একমাত্র উপায় হচ্ছে, বাড়িটির পাশে থাকা মোটা পাইপ বেয়ে উপরে উঠে দ্বিতীয় তলায় থাকা জানালার থাই গ্লাস ভেংগে ফেলা। গ্লাস ভাংগা গেলেই ভেতরে ঢোকা যাবে। কারণ দোতলার গ্লাসে ভেতর থেকে গ্রিল লাগানো নেই।
নিঃশব্দে জানালার কাচ ভাংগাটা কঠিন। তবে ট্রিকস জানা থাকলে,
সেটা অবশ্যই কঠিন নয়।
প্রথম পাইপ বেয়ে আমিই উপরে উঠে যাই। উপরে উঠে সানসেটে দাঁড়িয়ে জানালার কাছাকাছি চলে যাই। এরপর আমার পেছন পেছন উঠে সিদ্দীক।
কিন্তু সমস্যা হয় বাবুমিয়াকে নিয়ে। সে কোনো ভাবেই তার মোটা ভুড়িটি নিয়ে পাইপ বেয়ে উপরে উঠতে পারছিলো না।
কিন্তু সে নিচেও একা থাকবে না। তার নাকি ভয় করে। আমরা যখন উপরে উঠে জানালা ভাংগার বন্দোবস্ত করছি, সে তখন নিচে বসে চিৎকার চেচামেচি শুরু করেছে। তাকে থামাতে বাধ্য হয়ে আমাদের দুজনের নিচে নেমে আসতে হলো। এই লোককে নিয়ে বেশ মুসিবতে পরা গেলো।
তাকে কিভাবে উপরে উঠানো যাবে, তা নিয়ে বেশ কিছুক্ষন ভাবার পরে, সিদ্দীক কোথা থেকে যেন একটা দড়ি জোগাড় করে নিয়ে আসে। এরপর আমরা ওনার কোমড়ে দড়ি বেঁধে উপরে তোলার ব্যবস্থা করি। যখন টেনে তুলছিলাম তখন বাবুমিয়ার মুখ থেক্ব বের হওয়া উহ আহ ওমাগো শব্দগুলো আমাদের হাসির কারণ হচ্ছিলো। সিদ্দীক তো হাসতে হাসতে দঁড়ি ছেড়ে দেয়ার অবস্থা। অনেক কষ্টে দুজনের প্রচেষ্টায় একটা দেড়শ কেজির মূর্তিকে উপরে তুললাম।
উপরে তুলে বাঁধলো আরেক বিপত্তি, দড়ি তার মাংসের ভেতর কেটে পরে নাকি সে প্রচুর ব্যথা পেয়েছে। এখন যেভাবেই হোক তার ব্যাথা কমাতে হবে। অনবরত ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে বাবুমিয়া। সিদ্দীক উপয়ান্ত না দেখে মোবাইলের টর্চ তার কোমড়ে ধরলো।
আমিও দেখতে পেলাম আসলেই দড়ি তার থলথলে মাংসের ভেতরে বিঁধে কালো দাগ হয়ে গেছে। সিদ্দীক হাত দিয়ে তার আঘাতের উপর একটু আদুরে মালিশ দিয়ে বললো, কষ্ট পেতে হবে না। এক্ষুনি চলে যাবে বাবু, মিয়া।
সিদ্দীকের শান্তনা কাজে দিলো। তার কান্না থামলো।
ওরা যখন এসব কাজে ব্যস্ত আমি তখন জানালার থাই গ্লাস পুরোটুকুই সাথে করে নিয়ে আসা স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলেছি। পকেট থেকে ছোট হাতুড়ি বের করে সেটার মাথায় আমার পরিধেয় গেঞ্জি পেঁচিয়ে সজোরে কয়েকবার আঘাত করতেই হালকা একটা শব্দ শুনতে পাই। বুঝলাম কাঁচে ফাঁটল ধরেছে।
হাতুড়ির মাথায় গেঞ্জি লাগানো থাকায়, জোরে আঘাত করায়, কাচের উপরে বেশ প্রেসার লাগলেও শব্দ হয়নি এবং বাইরে স্কচটেপের আস্তরণ থাকায় কাঁচ ভেংগে গেলেও, ঝনঝন শব্দ করে নিচে পরেনি।
আস্তে আস্তে পুরো কাচটুকুই হাতুড়ির আঘাতে ভেংগে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হই। কিন্তু কাঁচ ভেংগে জানালা ফাঁকা করতেই প্রচন্ড পঁচা গন্ধ এসে নাকে লাগে আমাদের। বাবুমিয়া শব্দ করে ওয়াক করে উঠে। সিদ্দীক এক হাতে নিজের নাক আরেক হাতে বাবুমিয়ার মুখ চেপে ধরে। টর্চের আলো জানালা দিয়ে ভেতরে ফেলতেই দেখতে পাই এক বিভৎস দৃশ্য।
খাটের উপরে পরে আছে দুটি পচা গলা লাশ।
পোকা গিজিগিজ করছে লাশের ভেতরে।
একটি লাশ বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর। আরেকটি বিছানার একদম কিনারে।
কিনারের লাশটি থেকে একটি পা পচে গিয়ে ফ্লোরের উপরে খুলে পরে আছে। দৃশ্যটি দেখেই আমার মাথা ঘুরে উঠে। মনে হচ্ছিলো সানসেট থেকে পা ফসকে এখনি নিচে পরে যাব।

– চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here