#আপনিময়_বিরহ (১৪)
#বোরহানা_আতার_রেশমী
________________
আজকে ভার্সিটিতে নবীন বরণ উৎসব। সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সবটা। যার যার মতো সবাই ভীষণ ব্যস্ত। প্রিয়ম, উদয় সকাল সকাল চলে এসেছে। সাথে আছে রিমা, নিতু, নোমান আর সামি। সাদাফ থাকলেও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না কোনো কাজেই। সামিরা মারা যাওয়ার পর থেকেই সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রিয়ম মাঝখানে জ্বরে কাবু থাকলেও দুদিনেই সুস্থ হয়ে গেছে। উদয় আর তনিমার প্রেম, ঝগড়া একসাথে চলতেছে। ভার্সিটির প্রায় সব ছেলেরাই নীল পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা। আর মেয়েরা নীল শাড়ি। প্রিয়তা আর তনিমা এখনো ভার্সিটি আসেনি। তনিমা রেডি হয়ে বসে আছে কিন্তু প্রিয়তার পাত্তা নাই। তাই নিজেই উঠে প্রিয়তার রুমের দিকে যায়৷ গিয়ে দেখে প্রিয়তা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে। তনিমা এই অবস্থা দেখে দেয় এক ধমক। প্রিয়তা লাফিয়ে উঠে। তারপর বলে,
‘এক থা’প্পড় দিবো ইডিয়েট মেয়ে। এরকম কেউ করে!’
‘তুই আগে বল তুই শাড়ি না পড়ে শাড়ি হাতে নিয়ে কি করছিস?’
‘শাড়ির মুখ দেখতেছি।’
‘শাড়ির মুখ নাই যে দেখবি। রেডি হোস নাই কেন? বল!’
প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলে, ‘ইয়ে মানে আমি না গেলে হয় না রে!’
তনিমা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘প্রিয়ম ভাইয়ের মা’ইর খাওয়ার শখ হয়ছে তোর?’
‘আরে ধুর। আমার যেতে ইচ্ছা করতেছে না।’
তনিমা প্রিয়তার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে প্রিয়তাকে তুলতে তুলতে বলে, ‘উঠ তাড়াতাড়ি। দেড়ি হলে খবর আছে আমাদের।’
প্রিয়তা নাক মুখ কুঁচকে বলে, ‘তোর তো জামাই আছে না গেলে তোর পিন্ডি চটকাবে।’
‘আছেই তো। তোরই ভাই।’
বলেই দাঁত বের করে হাসতে থাকে। প্রিয়তা রাগে তনিমাকে রুম থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয়। বিড়বিড় করে বকা দিতে থাকে উদয় আর তনিমাকে। তারপর সুন্দর করে শাড়ি পড়ে ডাক দেয় তনিমাকে। তনিমার হেল্প নিয়ে পুরোটা কমপ্লিট করে। দুজনেই নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, মুখে হালকা সাজ, ম্যাচিং কানের দুল, টিকলি, খোঁপায় কাঠগোলাপের গাজরা, পায়ে নুপুর। ব্যাস দুজনেই রেডি। দুজনে তাঁরা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে একসাথে বেড়িয়ে পড়ে। রিক্সায় উঠতেই কল আসে সাইমার। সেও সেইম ভাবেই সেজেছে। তিন বান্ধবী সেইম টু সেইম।
প্রিয়তা, তনিমা আর সাইমা একসাথে ঢোকে ভার্সিটিতে। প্রিয়ম কাজের জন্য খেয়াল না করলেও রিমা আর নিতু ঠিকই খেয়াল করে। তারা প্রিয়মকে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলে, ‘দোস্ত গেইটের দিকে তাঁকা!’
প্রিয়ম বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে একবার ওদের দিকে আরেকবার গেইটের দিকে তাকাতেই ‘থ’। হাতে ফুল ছিলো তা পড়ে গেছে নিচে। ভালোবাসার মানুষকে বরাবরই বেশি সুন্দর লাগে। উদয় প্রিয়মকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও সেদিকে তাকায়। তাকিয়ে তারও একই অবস্থা। অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়ে আসে, ‘মাশাল্লাহ।’
রিমা আর নিতু দুজনের কান্ড দেখে খিলখিল করে হেঁসে উঠে। ধ্যান ভাঙে প্রিয়ম আর উদয়ের। দুজনেই হালকা কেশে নিজেদের সামলায়। ততক্ষণে প্রিয়তারা কাছাকাছি চলে এসেছে। সেদিন জ্বরের ঘোরে প্রিয়ম প্রিয়তার পেটে মুখ গুজে দিয়ে কি সব বিড়বিড় করছিলো ভাবতেই লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। তনিমা উদয়কে দেখে লাজুক হাসে। উদয় ঠোঁট কামড়ে হাসে। সাইমা একবার প্রিয়ম আর উদয়ের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার প্রিয়তা আর তনিমার দিকে তাকাচ্ছে। এক পর্যায়ে বলে,
‘ওয়েট ওয়েট! কাহিনিটা কি? তোরা প্রিয়ম ভাই আর উদয় ভাইকে দেখে এমন লাজে রাঙা হচ্ছিস কেন?’
প্রিয়ম ফট করে তাকায় প্রিয়তার দিকে। রিমা আর নিতু শব্দ করে হেঁসে বলে, ‘বুঝো না? লাভ কেইস বইনা।’
বলেই আবার হাসতে শুরু করলো। প্রিয়তা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। আর তনিমা? তার তো বরাবরই লজ্জা কম। তবুও কিছুটা লজ্জা পায়। তারপর হেঁসে বলে, ‘ওদিকে যায়?’
সবাই সায় দেয়। সব মেয়েরা সেদিকে চলে যায়। বাকি রয় উদয় আর প্রিয়ম। উদয় প্রিয়মকে খোঁচা মেরে বলে, ‘তুই প্রিয়তাকে প্রপোজ কবে করবি?’
প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘তুই পৃথিবীর প্রথম ভাই যে কি না বোনের প্রেম দেখার জন্য উতলা হয়ে গেছিস।’
বলেই চলে যায়। বেচারা উদয় আহম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
প্রিয়তারা আসতে নিলেই সামনে এসে দাঁড়ায় সাদাফ। সাইমা একদফা ক্রাশ খায়। প্রিয়তা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘কিছু বলবেন?’
সাদাফ মিষ্টি করে হেঁসে বলে, ‘তোমাদেরকে অনেক কিউট লাগতেছে।’
‘থ্যাঙ্কস।’
সাদাফ যে শুধুমাত্র প্রিয়তার প্রশংসা করেছে তা কেবল রিমা আর নিতুই বুঝলো। সাইমা তো খুশিতে গদগদ। তার প্রিয় মানুষটা সবার মাধ্যমে তারও প্রশংসা করেছে এটা ভেবেই। প্রিয়তা আর কিছু না বলে এড়িয়ে চলে আসে। প্রিয়ম দুর থেকে সবটা দেখে।
নবীন বরন শেষ হয়ে যাওয়ায় সবাই যে যার মতো জায়গা ছেড়ে চলে আসছিলো। তখন হুট করেই প্রিয়ম এসে প্রিয়তার হাত ধরে ক্যাম্পাসের মাঝখানে নিয়ে যায়। প্রিয়তা আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা চমকায়। উদয়, তনিমা, সাইমা, রিমা, নিতু, নোমান, সামি, সাদাফ সবাই ওদের পিছু পিছু যায়। প্রিয়ম প্রিয়তাকে দাঁড় করিয়ে দিতেই প্রিয়তা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়৷ প্রিয়ম সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। এক থোকা কাঠগোলাপ এগিয়ে দেয় প্রিয়তার সামনে। প্রিয়তা শকড। ধীরে ধীরে সবাই জড়ো হয় তাদের ঘিরে। প্রিয়ম বলতে শুরু করে,
‘তোকে গুছিয়ে বলার মতো কোনো শব্দ আমার কাছে নাই। বুঝতে শেখার পর থেকেই আমি তোর প্রতি দুর্বল। সেই দুর্বলতা কবে ভালোবাসায় গিয়ে ঠেকেছে আমার জানা নেই। তোদের বাড়ি না গেলেও তোর খোঁজ সবসময় আমি রাখতাম যখন জানতে পারলাম তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। তবুও নিজেকে সামলিয়েছে। আমি অনেক নিজের অনুভূতির সাথে লড়াই করেছি। ভেবেছি তোকে ভুলে যাবো। কিন্তু তোর প্রতি আমার ভালোবাসা ততদিনে আকাশ ছুঁয়েছে। আমি আর পারছি না তোর বিরহ নিয়ে থাকতে। আমি তোর নামের বিরহ না আমি পুরোটাই তোকে চাই। তোর সব আপনিময় বিরহ দুর করে ভীষণ ভাবে ভালোবাসতে চাই। তোর সাথে জীবনের শেষ বসন্তটাও কাটাতে চাই। তোকে আমি আমার করে চাই। আমার হবি টুনটুনি? প্রিয়তা থেকে শুধুই আমার প্রিয় হবি? ভালোবাসবি আমাকে?’
প্রিয়তা বাকরুদ্ধ। প্রিয়ম তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। তনিমা, সাইমাসহ বাদ বাকি অনেক মেয়ে বলতেছে এক্সেপ্ট করে নিতে। কিছু ছেলেরাও বলছে আবার শিষ বাজাচ্ছে। প্রিয়তার চোখের কোণ জলে টইটম্বুর। প্রিয়ম তাকে এতো আগে থেকে ভালোবাসে আর সে কিছুই জানে না। প্রিয়ম যেন ভীষণভাবে আকুল আবেদন জানাচ্ছে তাকে একটু ভালোবাসার। সেই আকুলতা উপেক্ষা করা প্রিয়তার সাধ্য নয়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফুল নিয়ে মাথা নাড়িয়ে ধরে আসা গলায় বললো,
‘হুম। ভালোবাসবো আপনাকে।’
এটুকুই যেনো যথেষ্ট ছিলো। সবাই হৈচৈ শুরু করে দিলো। প্রিয়ম প্রিয়তার আনন্দ সবাই যেন ভাগাভাগি করছে। আরো কয়েকজন নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করলো। প্রিয়তা লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। সাদাফ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়ম আর প্রিয়তার দিকে। তনিমা উদয়কে গুতো দিয়ে বলে,
‘ছোট বোনের প্রপোজ করা দেখলে! লজ্জা নাই তোমার?’
উদয় ভাব নিয়ে বলে, ‘লজ্জা কেন থাকবে? আর তাছাড়া প্রেম করার অধিকার কি শুধু আমার একার? আমার বোনেরও আছে। হুহ!’
তনিমা শব্দ করে হেঁসে দেয়। নিজেদের মধ্যে খুনশুটি করতে করতে আলাদা ভাবে বের হয়ে যায়। আজ তারাও একা সময় কাটাবে আর প্রিয়ম প্রিয়তাকেও কাটাতে দিবে। তনিমা আর উদয় রিক্সায় করে নদীর পাড়ে চলে আসে। অনেক কাপল আছে সেখানে। তনিমা আর উদয় একটা বেঞ্চে বসে। উদয়ের কাঁধে মাথা রেখে তনিমা বলে,
‘প্রিয়তার বিরহের দিন এবার শেষ। তাই না বলো!’
উদয় মুচকি হেঁসে বলে, ‘হুম। প্রিয়ম ওকে ভীষণ ভালোবাসে। প্রিয়তাকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে।’
তনিমা মুচকি হাসে। সে যেমন অনেকদিনের বিরহ কাটিয়ে ভালোবাসা পেয়েছে তেমনই প্রিয়তাও পাবে। প্রিয়তা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী। সে-ই বা কম কি!
প্রিয়তা আর প্রিয়ম ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। প্রিয়তা লজ্জায় লাল হচ্ছে, প্রিয়ম তা বারংবার আড়চোখে দেখছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে। প্রিয়ম নিজের অনামিকা আঙুল নিয়ে প্রিয়তার অনামিকা আঙুল ধরতেই প্রিয়তা চমকে তাকায়। কিছু বলে না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে লেকের পাড়। প্রিয়তা শাড়ি খানিকটা উচু করে পা ডুবিয়ে বসে পানিতে। প্রিয়মও পাশে বসে। দুজনেই অনেকটা সময় চুপ থাকে। নিরবতা ভেঙে প্রিয়তাই প্রথমে বলে,
‘বাড়ি যাবেন না?’
প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে, ‘এতো রোমান্টিক মুডে তোর বাড়ির কথা মনে পড়লো!’
‘আজব! সারাজীবন কি এই লেকের পাড়ে থাকবো নাকি?’
‘তোকে থাকতে কে বলছে? যা তুই।’
প্রিয়তা রাগ করে বলে, ‘ঠিক আছে যাচ্ছি।’
বলেই উঠতে নিলে প্রিয়ম হেঁসে হাত টেনে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নেয়। প্রিয়তা ছাড়ানোর চেষ্টা করলে প্রিয়ম আরো শক্ত করে ধরে। একসময় ক্লান্ত হয়ে নিজেই প্রিয়মের বুকে মুখ লুকায়।
______________
সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরে উদয়, তনিমা, প্রিয়ম আর প্রিয়তা। প্রিয়তার মুখে এখনো লজ্জার আভা স্পষ্ট। তনিমা প্রিয়তাকে জ্বালাতে ব্যস্ত। প্রিয়ম বাড়ি এসে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। মাথাা ব্যাথা বেড়েছে বলে এই অসময়েই আগে শাওয়ার নেয়। তারপর একটা মাথা ব্যাাথার মেডিসিন নিয়ে মায়ের রুমের দিকে এগোয়। তাহেরা বেগম তখন রেস্ট নিচ্ছে। প্রিয়মকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন৷ প্রিয়ম সোজা এসে নিজের মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে। তাহেরা বেগম হেঁসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। প্রিয়ম বলে,
‘আম্মু তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো!’
তাহেরা বেগম মুচকি হেঁসে বলে, ‘আমি জানি তুই কি বলবি!’
প্রিয়ম অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি জানো?’
‘হুম জানি।’
‘বুঝলাম না আমি। কেমনে জানলা? আর কি জানো?’
‘আমি হলাম তোর মা। তোর মন কি চায় তা আমি ভালোভাবেই বুঝি। এই যে যেমন তুই এখন বলতে এসেছিস তুই প্রিয়তাকে ভালোবাসিস আর প্রিয়তা তোকে।’
প্রিয়ম অবাকের সপ্তম পর্যায়ে। প্রিয়মকে আরো অবাক করে দিয়ে তাহেরা বেগম বলেন, ‘আমি কথা বলবো তাঁরার সাথে। তুই একদম নিশ্চিন্তে থাক। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে আমি ওকে আমার ছেলের বউ করে এনে সব কষ্টের অবসান করবো। আর যারা ওকে ছোট করেছে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবো আমার প্রিয়তা বেষ্ট।’
প্রিয়ম খুশিতে জড়িয়ে ধরে তাহেরা বেগমকে। বলে, ‘লাভ ইউ আম্মু।’
বলেই দৌড় লাগায়। পেছন থেকে তাহেরা বেগম ছেলের কান্ড দেখে হেঁসে দেয়। ছেলেমেয়ের সুখেই বাবা-মায়ের সুখ।
প্রিয়ম দৌড়ে নিজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকায়। প্রিয়তাও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। প্রিয়ম খুশির ঠ্যালায় হুররেএএ বলে টাওয়েল ঘুরিয়ে ফেলে দেয় ফ্লোরে। প্রিয়তা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাাকে সেদিকে।
চলবে..