#আফিম_বড্ড_নেশালো(০২),পর্বঃ০১
#লেখিকা_মাহযাবীন
ঝড়ের রাত!চারিদিকে প্রচন্ড বেগে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে সেই সাথে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু পানি ধরণীর বুকে জায়গা করে নিচ্ছে।এমন খারাপ আবহাওয়ায় যখন মানুষ ঠাঁই নিয়েছে নিজ গৃহে তখন জনমানবহীন শূন্য ব্রিজের এক কোণে দু হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে একটি মেয়ে।শীতে শরীর কাঁপছে তার।তবুও মেয়েটির কোনো হেলদোল নেই।শীতের সাথে যেনো এই মেয়েটি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।অর্থাৎ শীত যতই বাড়ুক মেয়েটি সবটা সহ্য করে নেবে কিন্তু নিজ অবস্থান হতে এক বিন্দু পরিমাণও নড়বে না।কিন্তু এই যুদ্ধে ব্যাঘাত ঘটলো কিচ্ছুক্ষণের মাঝেই!
-হেই,আর ইউ এলাইভ অর নট?[তুমি বেঁচে আছো নাকি না?]
চোখে বিস্ময় ও কন্ঠে চিন্তিত ভাব নিয়ে উক্ত প্রশ্নটি করে ওঠে এক যুবক।
অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্যে মেয়েটির কান যেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।উহু,শুধু কান নয়,মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে পুরো শরীরই যেনো বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে।শরীরের কোনো অঙ্গই যেনো এখন সচল নেই তার।যুবকটি মেয়েটির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দ্রুত মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাত স্পর্শ করে আবারও ডাকতে যায় কিন্তু তার ডাকার আগেই মেয়েটি ধীরে ধীরে মাথা উঠিয়ে আধো আধো চোখে ছেলেটির দিকে তাকায়।মেয়েটির চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে, সেই সাথে ফোলা ফোলাও লাগছে, হাত-পা বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে আছে।পরিস্থিতি বুঝতে পেরে যুবকটি আর এক মুহূর্তও সময় অপচয় না করে এক হেঁচকা টানে মেয়েটিকে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে নিজ কোলে উঠিয়ে নেয়।সামনেই যুবকটির গাড়ি দাঁড় করানো ছিলো।দ্রুত পদে মেয়েটিকে নিজের গাড়িতে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে এসে বসে পরে।গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগেই মৃদু কন্ঠে উচ্চারিত হওয়া কিছু শব্দ যুবকটির কানে ভেসে আসে,
“আমাকে বাঁচতে দেও,দয়া করো”
মেয়েটির অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারিত শব্দগুলো বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না যুবকটির।মেয়েটি যে সজ্ঞানে নেই তা বুঝতে পারছে সে কিন্তু মেয়েটি কেনো এ কথাগুলো বলছে তা নিয়ে ভেবে সময় অপচয় করার মতো সময় এখন তার নেই।তাই অনতিবিলম্বে গাড়ি স্টার্ট দেওয়াতেই মনোনিবেশ করলো সে।
!!
কক্ষের ভেতরে একজন গৃহপরিচারিকা মেয়েটির ভিজে জামা বদলে তাকে শুকনো কাপড়ে মুড়িয়ে দিতে ব্যস্ত আর কক্ষের বাইরে যুবকটি সহ তার অ্যাসিস্ট্যান্ট রিয়াদ আহমেদ কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রিয়াদ আহমেদের কানে ফোন।দু-তিনবার রিং বাজতেই ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিটি কল রিসিভ করে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে ওঠে,
-কে বলছেন?
-ডাক্তারঃফাহাদ বলছেন?(রিয়াদ)
-জ্বি কিন্তু আপনার পরিচয়?(ডাক্তার)
-আমি আফিম ইবনানের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, রিয়াদ বলছি।স্যার যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে তার বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
রিয়াদের কথাগুলো কানে আসতেই ঘুম পুরোপুরি উড়ে যায় লোকটির।ব্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলে ওঠেন,
-আফিম ইবনান অর্থাৎ শিল্পপতি আরহান সাহেবের একমাত্র ছেলে যে?
-জ্বি।
কথাটি কানে আসতেই লোকটি তৎক্ষনাৎ উঠে বসে তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
-জ্বি জ্বি,আমি আসছি।
-ঠিক আছে,আপনাকে নিতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।যত দ্রুত সম্ভব চলে আসুন।
কথাখানা বলেই কল কেটে দেয় রিয়াদ।ফোন নিজের পকেটে ঢুকিয়ে যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-স্যার,ডাক্তার যত দ্রুত সম্ভব আসছেন তাই এখন চিন্তের কিছু নেই।আর স্যার আপনার এভাবে ভিজে কাপড়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না।
নম্র গলায় কথাগুলো বলে প্রশ্নসূচক চোখে আফিমের দিকে তাকিয়ে আছে রিয়াদ।আফিম নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে চুলের পানি ঝারতে ঝারতে বলে ওঠে,
-হু,আই শুড টেক বাথ।[আমার গোসল করে নেওয়া উচিৎ]
কথাটি বলে আর দাঁড়ায় না আফিম,সোজা নিজ কক্ষের দিকে এগিয়ে যায় সে।
!!
বৃষ্টি এখনো থামেনি।তবে বৃষ্টির বেগ তেমন একটা তীব্র নয়।ঠান্ডা পরিবেশ সেই সাথে বৃষ্টির ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে।এই আবহাওয়া টা ঘুমের জন্য একদম যথাযথ।কিন্তু ঘুমের ‘ঘ’ টাও নেই আফিমের চোখে।তার মাথায় একটি প্রশ্নই ঘুরছে,এমন এক ঝড়ের রাতে ১৫-১৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে এভাবে ব্রিজের মাঝে বসে থাকবে কেনো? আর কেনোই বা গাড়িতে উঠানোর পর মেয়েটি “আমাকে বাঁচতে দেও” কথাটি বলেছিলো?এসকল প্রশ্নের উত্তর হাজার ভেবেও মিলবে না তা জানে আফিম।এজন্যেই মেয়েটির খোঁজ নিতে লোক লাগিয়ে দিয়েছে সে।তবুও প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছেই।এসব ভাবতে ভাবতেই হটাৎ আফিমের মনে পরে মেয়েটিকে বাসায় আনবার পর একটি বারের জন্যেও দেখেনি সে।ডাক্তার চেকআপ শেষ করে যাবার সময় তার সাথে কথা বলেছিলো আফিম।ডাক্তারের ভাষ্যমতে মেয়েটি দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে।অতিরিক্ত মানসিক চাপ,খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম ও অনেক ঠান্ডা লাগায় জ্বর ও শরীরে দুর্বলতা এসেছে তাই চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই।একটু রেস্ট,খাওয়া-দাওয়া আর ওষুধগুলো ঠিক মতো খেলে দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে।
ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর আর মেয়েটির কক্ষে প্রবেশ করা হয়ে ওঠেনি তার।এখন কেনো যেনো আফিমের মন চাইছে মেয়েটিকে একটি বার দেখার।গাড়িতে করে নিয়ে আসার সময় একবার চোখ পড়েছিলো মেয়েটির দিকে।মেয়েটির চেহারা কেমন যেনো মায়া ধরানো।বাচ্চা বাচ্চা চেহারায় স্পষ্ট অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিলো।তখন থেকেই মেয়েটির জন্য এক অদ্ভুত মায়া কাজ করছিলো আফিমের।ব্যস্ততা আর অন্য সব চিন্তায় এতোক্ষণ মেয়েটিকে এক নজর দেখে আসার কথা একবারও মাথায় আসেনি তার।তবে এখন আর দেরি করার মানে হয় না।
অনতিবিলম্বে নিজের কক্ষ ত্যাগ করে আফিম।মেয়েটির কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় বিছানার মাঝ বরাবর শোয়া একজন মানবীর ডান হাতে স্যালাইনের ক্যানোল লাগানো।তার বাম দিকে জানালা হওয়ায় বাইরের লাইটের কিছুটা আলো কক্ষে প্রবেশ করে কক্ষটাকে কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে।আফিম ধীরে ধীরে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে মেয়েটির বাম পাশে এসে বসে।বাইরে থেকে আসা সেই আলোর উপস্থিতিতে মেয়েটির চেহারা বেশ ভালোই দৃশ্যমান। আফিম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে।মেয়েটির গায়ের রং হয়তো হলদে ফর্সা এতো কম আলোতে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।তবে তার ঘন চোখের পাপড়ি, খাঁড়া নাক আর সুন্দর আকৃতির ঠোঁটের সৌন্দর্য বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে।আফিম নিরবে স্থির দৃষ্টিতে মেয়েটির চেহারা পানে চেয়ে থেকে বেশ অনেকটা সময়ই পাড় করে ফেলেছে।এর মাঝে হটাৎই মেয়েটি নড়ে উঠে।যে হাতে স্যালাইনের ক্যানোল লাগানো সেই হাতটি নড়াতে যাবে তার পূর্বেই আফিম তড়িঘড়ি করে মেয়েটির দিকে ঝুঁকে মেয়েটির ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।অতঃপর অতিব যত্নে হাতটি বিছানার উপর রেখে সেই ঝুঁকে থাকা অবস্থাতেই আবারও মেয়েটির মুখ পানে তাকায় সে।মেয়েটির ঘন চোখের পাপড়িতে আফিম মুগ্ধ হয়ে সেদিকেই নিজের দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে।কিছুটা সময় এভাবে পাড় হতেই হটাৎ আফিমের অজান্তেই তার হাত মেয়েটির কপাল ছুঁলো।কপালে কয়েকটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো সযত্নে গুছিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে মেয়েটির চোখের পাপড়িতে এসে থামলো তার হাত।পাপড়িতে হাত বুলোতেই মেয়েটি নড়েচড়ে উঠলো।আফিমের গরম নিঃশ্বাস মেয়েটির চোখ-মুখে আছড়ে পরছে।সেই সাথে আফিমের হাতের স্পর্শ মেয়েটির নিদ্রায় বেশ ভালোই ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।মেয়েটি একটু নড়েচড়ে উঠে জ্বরের ঘোরে মুহূর্তেই নিজের চোখ-মুখে এক ভীত ভাব ফুটিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে,
-আমাকে বাঁচতে দেও প্লিজ,আমার স্বপ্ন গুলোকে উড়তে দেও।
এভাবে একই বাক্য বারংবার বলছে সে।মেয়েটির এমন আচরণেও আফিমের যেনো ঘোর কাটলো না বরং মেয়েটির ভয়ার্ত চেহারা তার মুগ্ধতা আরো বাড়িয়ে দিলো।মুগ্ধতার ঘোরে বিলীন আফিম ভয়ে উত্তেজিত মেয়েটির ভয় দূর করে একটুখানি আস্থা জাগানোর উদ্দেশ্যে নিজের ওষ্ঠদ্বয় মেয়েটির কপালে ঠেকায়।মেয়েটির কপালে ভরসামাখা স্পর্শ এঁকে দূরে সরে আসে সে।
হটাৎ নিজের কপালে এক স্নেহের স্পর্শ পেয়ে চমকে যায় মেয়েটি।জ্বরের ঘোরেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সে।দেখতে পায় একজন যুবক শীতল চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
মেয়েটিকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে আফিম ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে ধীর স্বরে বলে ওঠে,
-ডোন্ট ওয়ারি,নোবডি ক্যান হার্ম ইউ।[চিন্তা করো না।কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না]
উত্তরে মেয়েটি কিছু বললো না,শুধু অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো আফিমের দিকে।জ্বরের ঘোরে মাথা শূন্য হয়ে আছে তার।কোনো কিছু ভাবার মতো অবস্থাতে সে নেই।সে কোথায় আছে?কিভাবে এলো?সামনের যুবকটি কে? এমন কোনো প্রশ্নই তার মাথায় এলো না।কোনো কিচ্ছু নিয়ে ভাবতে পারছে না সে।শুধু শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিজের সামনে থাকা পুরুষটির দিকে।এই পুরুষ টার চোখজোড়ায় ভরসা খুঁজে পাচ্ছে মেয়েটি।ছেলেটা বলেছে,কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তাহলে সত্যিই কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।সে নিরাপদ।এই ছেলেটার কাছে কোনো এক অজানা কারণেই নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে তার।
আফিম মেয়েটির টানা টানা চোখজোড়ায় দৃষ্টি স্থির রেখেই জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-নাম কি মায়া?
মেয়েটি একটু সময় নিয়ে দূর্বল কন্ঠে বলে ওঠে,
“উহু,নাফিয়া”
চলবে।