আফিম_বড্ড_নেশালো পর্বঃ০৬,০৭

0
894

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ০৬,০৭
লেখিকাঃমাহযাবীন
০৬

কিছুটা মাথা ব্যথা নিয়েই শুয়া থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে নাফিয়া।কপালটা ৩ আঙুলে আলতো করে চেপে ধরে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নেয় সে।জানালা খোলা থাকায় সূর্যের কিরণে কক্ষ আলোকিত হয়ে আছে।সকাল হয়ে গেছে দেখে বেশ অবাক হয় নাফিয়া কারণ গত রাতে আফিম তার কক্ষ ত্যাগ করার পর সে নিজের পায়ে বিঁধে থাকা কাঁচের টুকরো গুলোকে নিজ হাতে তোলার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ব্যথায় তা ঠিক করে পেরে উঠছিলো না সে।ধীরে ধীরে মাথা ব্যথা আরম্ভ হতে থাকে তার এবং কিছুটা সময়ের মাঝেই নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়।এরপর আর কিছুই মনে নেই তার।নাফিয়া সকাল হয়েছে দেখে যতটা অবাক হয় তার থেকেও বেশি অবাক হয় এ দেখে যে তার পায়ে খুব সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করা।সেই সাথে পুরো রুমটা পরিপাটি আগের ন্যায় গোছানো।নাফিয়ার এসব পর্যবেক্ষণের মাঝেই একজন গৃহ পরিচারিকা এসে উপস্থিত হয়।নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে সে বলে ওঠে,
-এখন কেমন আছেন ম্যাম?
-আলহামদুলিল্লাহ কিন্তু আমার পায়ে ব্যান্ডেজ এবং রুমের গোছগাছ কে করলো?
-আমি এবং অন্য একজন সার্ভেন্ট।
-আপনারা জানলেন কি করে যে আমার সাহায্য প্রয়োজন?
-আফিম স্যার কাল রাতে আমাদের দু’জনকে আপনার পায়ের ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার জন্যে পাঠান।স্যারকে দেখে তখন খুবই রাগান্বিত মনে হচ্ছিলো।তিনি আমাদের বেশ তাড়া দিয়েই বলেছিলেন,আপনার রুমে এসে পায়ে ব্যান্ডেজটি দ্রুত করে দিতে।আমরাও দেরি করিনি,এসে আপনাকে অচেতন অবস্থায় পাই।
-ওহ আচ্ছা।আন্টি,দাদী তারা জেনেছে?
-তাদের কাঁচের কথাটি বলা হয়নি শুধু বলেছি পায়ে ব্যথা পেয়েছেন।
-বেশ করেছেন।
-আপনার এখনই কিছু খেয়ে নেওয়া উচিৎ,ম্যাম।আগামী যে ক’দিন আপনি পুরোপুরি সুস্থ না হন সে পর্যন্ত স্যার আপনার দায়িত্ব আমায় দিয়েছেন।
-কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারবো।
-এমনটি করবেন না ম্যাম।স্যারের রাগ সম্বন্ধে আপনি হয়তো অবহিত নন।তিনি ১ সেকেন্ডও সময় নেবেন না আমায় চাকরি হতে বের করে দিতে।
নাফিয়া উত্তরে আর কিছু বলে না।আফিমের রাগ এ ক’দিনেই বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে সে।নিরাবতাকেই সম্মতি ভেবে নিয়ে মেয়েটি নাফিয়ার নাস্তা আনতে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হয়।
এদিকে নাফিয়ার ঘুম ভেঙেছে খবর পেয়ে দাদী এবং সানিয়া বেগম উভয়ই নাফিয়ার কক্ষে এসে জিজ্ঞেস করেন সে কেমন আছে এবং পায়ে ব্যথা পেলো কি করে!উত্তরে নাফিয়া বলে,
-আসলে রাতে একটু গলা খুসখুস করায় গরম পানি করতে রান্না ঘরে গিয়েছিলাম।গরম পানিটা গ্লাসে ঢালার সময় অসাবধানতা বসত তা হাত থেকে পিছলে পায়ের উপর পরে সবটা!
-বয়সে বড় হলেও এখনো বাচ্চাটি রয়ে গিয়েছো।এ বয়সে এমন বেখেয়ালি হলে চলে?(সানিয়া বেগম)
-তোমার থেকে এমনটা আশা করেছিলাম না।ক’দিন বিশ্রামেই থাকো।(দাদী)
-দুঃখিত।যেহেতু আমি এ পা নিয়ে কাজ করতে পারবো না সেহেতু সুস্থ হওয়া অব্দি কি নিজের বাড়িতে যেয়ে থাকবো?
-নাহ তার প্রয়োজন নেই।এ অবস্থায় যাওয়াটাও যেমন তোমার জন্যে কষ্টসাধ্য তেমন তোমার পরিবার বিষয়টি জেনে শুধু শুধুই চিন্তিত হবেন।(দাদী)
-অনেক ধন্যবাদ দাদী এতোটা ভাবার জন্যে।(ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে নাফিয়া)
দাদী উত্তরে আর কিছু না বলে তিনিও ঠোঁটে হাসি টেনে আনেন।

!!
দু’টো দিন পাড় হয়ে গেলো।এ দু’দিন নাফিয়া সম্পূর্ণ বিশ্রামে ছিলো।নিজ কক্ষ হতেও বের হতে পারেনি পায়ে ব্যথার জন্যে।স্কুলেও নিজের অসুস্থতার ব্যাপারটি জানিয়ে দিয়েছিলো সে এবং প্রায় ১ সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছে।আর এ দু’দিনে আফিম ও নাফিয়া একবারের জন্যেও একে-অপরের মুখোমুখি হয়নি।কিন্তু আফিম যাকে নাফিয়ার সেবায় নিয়োজিত করেছিলো তার থেকে ঠিকই নাফিয়ার খবর জেনে নিচ্ছিল।
৩য় দিনে,একটু ব্যথা থাকলেও হাঁটতে পারছে নাফিয়া।ব্যাস,এখন কি আর তাকে বসিয়ে রাখা সম্ভব!সে সকালে উঠে পায়ের ব্যথাটা কম অনুভব করাতে আবারও নিজের কাজে লেগে যাবে বলে মনস্থির করে নেয়।নিজের সকালের কাজ সেরে সে ধীরে ধীরে কদম ফেলে দাদীর কক্ষে উপস্থিত হয়।
-আসসালামু আলাইকুম দাদী।শুভ সকাল!
-কি ব্যাপার,তুমি বিশ্রাম না নিয়ে এখানে কি করছো?(কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠেন দাদী)
-আমার পা এখন অনেকটাই ঠিক হয়ে গিয়েছে দাদী।এখন আমি মোটামুটি হাঁটাহাটি করতে পারবো!
-ভেবে বলছো?
-জ্বি।
-ঠিক আছে বসো এখানে।পত্রিকার এই খবরটি পড়ে শোনাও তো চোখে ঠিকভাবে দেখছি না আমি।
-জ্বি দাদী অবশ্যই কিন্তু ৬ টায় আপনার হাঁটতে বেরোতে হবে তাই চা বা দুধ যেটি চান একটু খেয়ে নিতে পারেন।
-আচ্ছা।(ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলেন দাদী)
পায়ে ব্যথা থাকায় দাদীর সাথে হাঁটতে যেতে পারবে না নাফিয়া।আবার দাদীকে একাও যেতে দেওয়াটা ঠিক হবে না।এসব যখন ভাবছিলো নাফিয়া ঠিক তখনই দাদীর কক্ষে প্রবেশ করেন সানিয়া বেগম।নাফিয়াকে দেখে তিনি বলে ওঠেন,
-পায়ের ব্যথা কিছুটা কমেছে?
-জ্বি আন্টি।(ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে নাফিয়া)
উত্তরে সানিয়া বেগম ও ঠোঁটে হাসি টেনে আনেন।সানিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে নাফিয়া বলে ওঠে, -আজ বৌমা শাশুড়িকে সঙ্গ দিলে কেমন হয়?
-অর্থাৎ?(সানিয়া বেগম)
-আজ দাদীর হাঁটতে যাওয়ায় আপনি তাকে সঙ্গ দিবেন,আন্টি?জানি যে কোনো সার্ভেন্টকে বললে তারা দাদীর সঙ্গে যাবে কিন্তু তাতে দাদী সঙ্গ পাবে না।চুপচাপ হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু আপনি গেলে দাদী ও আপনি উভয়ই বিভিন্ন গল্প বা স্মৃতিচারণ বা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সময়টা উপভোগ করতে পারবেন।
নাফিয়ার কথায় বেশ খুশি হয়ে দাদী বলে ওঠেন,
-যথার্থ বলেছো।বৌমা আজ যেহেতু নাফিয়া যেতে পারছে না সেহেতু তুমি যাবে তো আমার সাথে?
-জ্বি মা অবশ্যই।(ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলেন সানিয়া বেগম)
নাফিয়ার কথাটি শাশুড়ী-বৌমা উভয়েরই পছন্দ হয় কারণ বেশ অনেক দিনই হলো তারা শাশুড়ি-বৌমা মন খুলে কথা বলেন না।

!!
ছাঁদের রেলিং ধরে সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে কালো বর্ণ ধারণ করা আকাশ পানে তাকিয়ে আছে নাফিয়া।সূর্যের আলো যে সবটাই অনুপস্থিত তা কিন্তু নয়।চাঁদের পেছনে লুকিয়ে নিজের আলো জোৎস্না রুপে পৃথিবীতে প্রেরণ করছেন সূর্য মামা।আর নাফিয়া মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জোৎস্না বিলাস করছে।একা একা নির্জন রাত ও সেই সাথে শীতল হাওয়া ও জোৎস্না।এ অনুভূতিটি ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়।কিছুটা সময় এভাবেই কাটানোর পর হটাৎ নিজের পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করে নাফিয়া।পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে আফিম দাঁড়িয়ে আছে।আফিমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্থান ত্যাগ করার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই আফিম বলে ওঠে,
“স্যরি”
হটাৎ এক অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ কানে এসে পৌঁছাতেই নাফিয়া অবাক চাহনি নিয়ে আফিমের দিকে ফিরে তাকায়।আফিম নাফিয়ার দিকে না তাকিয়ে নিজের সামনে বরাবর দৃষ্টি রেখেই আবারও বলে ওঠে,
“আই এম স্যরি”
উত্তরে কিছু বলে না নাফিয়া।সে কল্পনাও করেনি আফিম তাকে স্যরি বলবে!অবাক হওয়ার সীমা অতিক্রম হওয়ার পরেও চেহারায় স্বাভাবিকতা বজায়ে রাখে নাফিয়া।কিছুটা সময় নিয়ে সে বলে ওঠে,
-আমি জানি আপনি অনুতপ্ত।নাহয় প্রতিদিন আমার খবর নিতেন না।
অবাক হয় আফিম।এ বিষয়টি নাফিয়া কিভাবে জানলো!সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাফিয়ার দিকে তাকায়।
-যাকে জিজ্ঞেস করতেন সেই বলেছে।
উত্তরে আর কিছু বলে না আফিম।নাফিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশ পানে তাকায়।নাফিয়াও একই কাজ করলো।কিছুটা সময় নিরাবতা চলার পর নাফিয়া বলে ওঠে,
-আপনি খুব বদমেজাজী বা বদরাগী হলেও মানুষটা খারাপ নন তা উপলব্ধি করেছি।
নাফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আফিম।মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-হু?
-আপনি সত্যিই খারাপ হলে,প্রথম দিন শুধু মাত্র অচেতন হওয়ায় একজন অপরিচিত মেয়ের জন্যে সেই রাতে ডাক্তার ডেকে আনতেন না।আর সেদিন রাতে আপনার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার পরও, অনেকটা রেগে থাকার পরও আমার পায়ে ব্যান্ডেজ করবার জন্যে সার্ভেন্ট পাঠাতেন না।
উত্তরে কিছুই বলে না আফিম।কিছুটা সময় নাফিয়ার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকার পর দৃষ্টি সরিয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।অবাক হচ্ছে আফিম।মেয়েটি ওর জন্যে এতোটা কষ্ট পাবার পরও ক্রোধান্বিত না হয়ে উল্টো ওর ভালো দিকগুলো নিয়ে ভাবছে!
কিছুটা সময় নিরাবতায় কাটিয়ে দেয় উভয় একে-অপরের পাশাপাশি।অতঃপর নাফিয়া তার কক্ষে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়িয়েও থেমে যেয়ে বলে ওঠে,
-কারো কথায় নিজেকে বিচার করা বোকামো।আপনি জানেন আপনি অক্ষম নন তবে আপনি সত্যিই অক্ষম নন,আফিম!
বলে আর দাঁড়ায় না নাফিয়া।সে নিজের কক্ষের পথে অগ্রসর হয়।এদিকে নাফিয়ার কথায় আলতো এক হাসি ফুটে ওঠে আফিমের ঠোঁটে।

চলবে।

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ০৭
লেখিকাঃমাহযাবীন

বাচ্চাদের কাছে খুব প্রিয় একটি দিন হচ্ছে শুক্রবার।ঠিক তেমনই কিছু আরাম প্রিয় মানুষের কাছে শুক্রবারের আরেক নাম “প্রেম”।বাচ্চারা শুক্রবার পছন্দ করে পড়াশোনা দিয়ে একটি দিন রেহাই মিলবে বলে আর আরাম প্রিয় মানুষেরা শুক্রবারে প্রেম খুঁজে পায়।তাদের প্রেম হয় সকালের এক লম্বা ঘুমের সাথে।আহা,সকালের ঘুমটা সে যে কি শান্তিময়!
নাফিয়া আরাম প্রিয় মানুষের কাতারেই পরে।আজ শুক্রবার!সে তো কোনোভাবেই ১০ টার আগে বিছানা ছাড়তে রাজি নয়।কিন্তু ৫ টা ৪০ মিনিটেই তার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।এমন প্রেমময় ঘুমের মায়া কাটিয়ে দরজার ওপাশের ব্যক্তিকে সাড়া দেওয়ার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে তার নেই।ওদিকে দরজার ওপাশের মানুষটি কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে নিয়ে দরজার কড়া নেড়ে চলছে।একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দরজা খোলে নাফিয়া।চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে বলে ওঠে,
-আজ শুক্রবার,আমি ঘুমবো!
নাফিয়ার উক্তি শুনে গৃহ পরিচারিকা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-ম্যাম,আপনি এখন ছাত্রজীবনে নেই যে শুক্রবার ছুটির দিন উদযাপন করবেন।
বিরক্তিভাব বজায়ে রেখে নাফিয়া বলে ওঠে,
-কি বলতে চাইছেন?
-দাদী ডাকছেন আপনায়।
এবার ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আসছি!
অতঃপর তৈরি হয়ে সে দাদীর কক্ষে উপস্থিত হয়।দাদীর কক্ষে সানিয়া বেগম এবং দাদী উভয়ই বড় এক জানালার ধারে পাতানো দু’জোড়া সোফায় দুজনে বসে আছেন।নাফিয়া তাদের সালাম দিয়ে তাদের কাছে গিয়ে বসে।
সানিয়া বেগম নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-নাফিয়া,পায়ের ব্যথা তো মনে হয় এখন আর নেই?
-জ্বি আন্টি।
-শুক্রবার আর শনিবার আফিম অফিসে যায় না।ওর আলাদা কিছু কাজ থাকে তার জন্য এই দু’দিন বরাদ্দকৃত।ভাবছি ওকে বলবো আজ কাজ বাদ দিয়ে আমাদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে!
ঘুরতে যাবার কথা শোনা মাত্রই সকালে হওয়া তার প্রেমের বিচ্ছেদের সব শোক ভুলে গেলো নাফিয়া।তার মুখে ফুটে ওঠা সেই লম্বা হাসিটি সাক্ষ্য দিচ্ছে সে কতোটা উচ্ছ্বসিত।নাফিয়া,সানিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-কখন যাবো আমরা?
নাফিয়ার এমন আগ্রহ দেখে আলতো হাসেন সানিয়া বেগম এবং উত্তরে বলেন,
-দেখি আফিম কি বলে!
সাথে সাথেই মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো নাফিয়ার।সে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-গোমড়ামুখো নিয়ে যাবে বলে মনে হয় না।
-কিছু বললে?(সানিয়া বেগম)
-নাহ আন্টি।দাদী রাজি তো যেতে?
-হ্যা।(দাদী)

!!
নীল পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা পরিহিত আফিম সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষ হতে হল রুমের উদ্দেশ্যেই আসছে।হল রুমের সোফাতে বসে ছিলো নাফিয়া ও দাদী।পায়ের শব্দ পেয়ে নাফিয়া সিঁড়ির দিকে তাকায় ।এলোমেলো ভেজা চুল,নীল পাঞ্জাবির হাতাটি কনুই অব্দি উঠানো সেই সাথে সাদা পায়জামা পরিহিত এই সুদর্শন যুবকটিতে চোখ আঁটকে যায় নাফিয়ার।
আফিম খুব বেশি লম্বা না হলেও ৫ ফিট ৮ ইঞ্চি কম নয়।দুধে আলতা গায়ের রং তার।মুখে চাপ দাড়ি।চোখ গুলো খুব বড় না হলেও পাপড়ি গুলো বেশ ঘন।সেই সাথে চোখের মনি একদম গাঢ় খয়েরী রঙের।ঠোঁট টা নাও পাতলা নাও মোটা একদম “সম্পূর্ণ ঠোঁট” যাকে বলে।চেহারাটা কিছুটা লম্বাটে।স্বাস্থ্য নাও মোটা,নাও হ্যাংলা।
আফিমকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে এতোটাই মগ্ন ছিলো নাফিয়া যে যখন তার ধ্যান ভাঙে দেখতে পায় আফিম এক ব্রু উঁচু করে তার দিকেই চেয়ে আছে।অপ্রীতিকর এক পরিস্থিতিতে পরে যায় নাফিয়া।আফিমের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে নিজেকে কঠিন কঠিন কিছু গালি শুনিয়ে দেয়।সেই সাথে তার মনে প্রশ্ন জাগে এতো দিন ধরে দেখছে লোকটাকে কই আগে তো এভাবে চোখ আঁটকে যায়নি তার উপর তবে আজ কি হলো?
নিজের মনে মনেই উত্তরটি বানিয়ে নিলো সে,হয়তো আফিমের সৌন্দর্য এতোদিন তার মনে জমে থাকা সেই ঘৃণানুভূতিই আড়াল করে রেখেছিলো।
সোফায় বসে আফিম একজন সার্ভেন্টকে কফি আনার আদেশ করে।সার্ভেন্টটি আদেশ পেয়ে রান্নাঘরে যেতেই নাফিয়া কিছু একটা ভেবে বলে ওঠে,
-আমি একটু আসছি।
বলেই উঠে যায় সে।নাফিয়ার হুট করে এভাবে উঠে যাওয়ার বিষয়টি আফিমের কাছে সন্দেহের মনে হলো।
রান্নাঘরে এসে নাফিয়া সার্ভেন্টটিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-কফিটি আমি বানিয়ে দিচ্ছি আপনি ততক্ষণে আমার রুমের বিছানাটি পরিষ্কার করে দিয়ে আসুন।একটু বিশ্রাম নিতে চাইছি কিন্তু বিছানাটি অপরিষ্কার।
-ঠিক আছে ম্যাম আমি অন্য কেউকে বলছি আপনার বিছানাটি পরিস্কার করে দিতে।শুধু শুধু কষ্ট করে আপনর কফি বানাতে হবে না।
-যা বলেছি তাই করুন।কফি বানানো শেষ হলে আপনাকে ডেকে নিবো,যেয়ে কফিটা দিয়ে এসেন।
মেয়েটি আর কিছু না বলে রান্নাঘর ত্যাগ করে।এদিকে মেয়েটি যেতেই নাফিয়া ঝটপট কফিটি বানিয়ে নেয়।অতঃপর ঠোঁটে এক শয়তানি হাসি ফুটিয়ে লবণের ডিব্বাটি হাতে নিয়ে বলে ওঠে,
“স্যরি আফিম কিন্তু আপনাকে একটু না জ্বালালে শান্তি পাবো না।বদ অভ্যেস হয়ে গিয়েছে আপনাকে জ্বালানো!”
কথাটি শেষ করে নাফিয়া যেই কফিতে লবণ ঢালতে যাবে ওমনি কেউ একজন তার হাত ধরে নেয়।চমকে হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই আফিমকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় তার।আফিম নাফিয়ার হাত থেকে লবণের ডিব্বাটি নিয়ে জায়গা মতো রেখে নাফিয়ার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হতে বলে ওঠে,
-তো কি বলছিলেন মিস.শেখ?আমায় না জ্বালালে আপনি শান্তি পাবেন না?
উত্তরে কিছু না বলে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায় নাফিয়া।আফিম অগ্রসর হতে হতেই আবারও বলে ওঠে,
-আমায় জ্বালানোর বদ অভ্যেসে পরে গিয়েছেন?
কথাটি শেষ করে এক হাতে নাফিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে নাফিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসে আফিম।আফিমের কাছে আসতেই নাফিয়া এক অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করতে আরম্ভ করে যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি।আফিম,নাফিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-যদি বলি,এ বদ অভ্যেসে আমিও অভ্যস্ত?(ঠোঁটে বাঁকা হাসি তার)
আফিমের শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণে নাফিয়া আবেশে নিজের চোখজোড়া বুজে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে তা নিজের নিঃশ্বাসের সাথে নিজের মাঝে টেনে নিচ্ছে সেই সাথে আফিমের মৃদু কন্ঠস্বর ও তার বলা উক্তিটি নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।আর একটু বাড়লেই হয়তো মরে যাবে সে ঠিক এমনটিই অনুভব করছে নাফিয়া।
এরই মাঝে সার্ভেন্টির পায়ের শব্দ কানে আসতেই আফিম নাফিয়াকে ছেড়ে কিছুটা দুরত্ব বজায়ে রেখে দাঁড়ায়।নাফিয়াও ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে কফিটি হাতে নিয়ে আফিমের দিকে এগিয়ে দেয়।সার্ভেন্টটি রান্নাঘরে প্রবেশ করে আফিমকে দেখে ঘাবড়ে যায় এবং বলতে আরম্ভ করে,
-ক্ষমা করুন স্যার।আসলে আমিই কফি বানাতাম কিন্তু ম্যাম…
মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার আগেই আফিম বলে ওঠে,
-ইট’স অলরাইট!
মেয়েটি যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।অতঃপর নাফিয়া এবং আফিম উভয়ই হল রুমে এসে বসে।এতোক্ষণে সানিয়া বেগমও হল রুমে এসে বসেছেন।আফিম আসতেই তিনি আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-আফিম!
-ইয়াহ মম।
-আজ বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইছি।
-যাওয়া যায়।
-ভাবছি আমাদের পুরান বাড়িটায় যাই?দু’বছর হলো যাওয়া হয় না।
-ঠিক আছে।রবি মামাকে বলে দিচ্ছি বাড়িটি পরিষ্কার করিয়ে রাখতে।
-বেশ।(ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে ওঠে সানিয়া বেগম)

!!
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো আফিম।আজ সে ই ড্রাইভ করবে।তার পাশের সিটে বসলো সানিয়া বেগম এবং পেছনের সিটে দাদী এবং নাফিয়া।ঠিক ৩ টা বাজতেই রওয়ানা হলো তারা আফিমদের পুরোনো বাড়ির উদ্দেশ্যে।প্রায় ২/৩ ঘন্টার রাস্তা।শহর ছাড়িয়ে একটি মফস্বল এলাকাতেই আফিমদের পুরোনো বাড়িটি অবস্থিত।
শহর পেরিয়ে সেই এলাকাটির কাছাকাছি আসতেই দেখা যায় রাস্তার দুপাশে জনবসতিহীন বিরাট জায়গা জুড়ে শুধু হরেকরকমের গাছপালা।রাস্তাটি একদম পাকাপোক্ত হলেও আশেপাশের দৃশ্যমান সব কিছুই নাফিয়াকে গ্রামের অনুভূতি দিচ্ছে।এতোগুলা বছর পর সে গ্রামের মতো একটি জায়গায় যাচ্ছে ভাবতেই একরাশ ভালোলাগা এসে নাফিয়ার মনে জায়গা করে নেয়।বাইরের দৃশ্য নাফিয়ার ভেতরে যে মুগ্ধতা সৃষ্টি করছে তার বহিঃপ্রকাশ তার ঠোঁটের হাসির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।লুকিং গ্লাসের সাহায্যে আফিম ও নাফিয়ার সেই মুগ্ধতার হাসির সাক্ষী হয়ে রয়।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here