আফিম_বড্ড_নেশালো পর্বঃ১০,১১

0
838

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১০,১১
লেখিকাঃমাহযাবীন
১০

“একসাথে থাকার চেয়ে,একসাথে ভালো থাকাটাই খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।একই সাথে রয়েও যদি সেথায় মানসিক প্রশান্তি না থাকে তবে একসাথে থাকাটা বৃথা নয় কি?” ২৪ বছর আগে এই প্রশ্ন জেগেছিলো সানিয়া বেগমের মনে।এর উত্তর খুঁজে পাওয়ার পরেই তিনি আফিমের বাবা আরহাম ইবনানের সাথে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
তাদের বিয়ে টা হয়ে ছিলো পারিবারিক ভাবে।বিয়ের আগে তারা শুধু একে-অপরের রুপ এবং কিছু গুণাবলী সম্বন্ধে জানারই সুযোগ পেয়েছিলেন।অতঃপর বিয়ের পর পরিলক্ষিত হয়,প্রতিটি জিনিসেই তাদের ভিন্ন মত,তাদের মুগ্ধতা ভিন্ন জিনিসে।সব জিনিসেই দুজনের ভিন্ন মত হওয়ায় একজনকে তো সমঝোতা করতেই হতো।আর সেই একজন টা ছিলেন সানিয়া বেগম।নিজের ইচ্ছে,চাওয়া-পাওয়া সব কিছু নিজের মাঝে চেপে তিনি আরহাম সাহেবের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।হয়তো এটিই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।একটি সম্পর্কে যখন সবসময়ই একতরফা সমঝোতা হয় তখন সমঝোতা করা মানুষটির অনুভূতির মৃত্যু ঘটে।সে মানুষটি কখনোই সে সম্পর্কে থেকে খুশি থাকতে পারে না।আর যে মানুষটি নিজেই খুশি নয় সে অন্যকে কিভাবে খুশি রাখবে!আরহাম সাহেব স্ত্রী হিসেবে যেরূপ নারী চেয়েছিলেন তেমনটি তো মোটেও ছিলেন না সানিয়া বেগম।তাই মনের দিক দিয়ে সেও এই সম্পর্কে সুখে ছিলেন না।এর মানে এমনটি মোটেও নয় যে তিনি সানিয়া বেগমের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করতেন বা সানিয়া বেগমকে স্ত্রী হিসেবে যোগ্য মূল্য বা সম্মান করেননি।
আফিমের বয়স যখন ১০ তখন সানিয়া বেগম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।একটিই তো জীবন!একে সমঝোতা বা বিনা সুখ,প্রশান্তিতে কাটিয়ে দেওয়াটা বোকামী মাত্র।তাই তিনি আরহাম সাহেবকে তালাকের প্রস্তাব দেন।এ প্রস্তাবে আরহাম সাহেব প্রথমে অবাক হলেও পরে সম্মতি দেন।অতঃপর নিজের বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছেতে বিদেশ গমন করেন।তার ২ বছর পর আরহাম সাহেব তার মাকে জানান তিনি ওখানের এক বাংলাদেশী মেয়েকে পছন্দ করেছেন এবং বিয়ে করতে চান।
সানিয়া বেগম এবং আরহাম সাহেবরের মাঝে পার্থক্য এতোটুকুই যে আরহাম সাহেব তার নতুন জীবন সঙ্গীর মাঝে সুখ খুঁজে নিয়েছেন এবং সানিয়া বেগম সুখ খুঁজে নিয়েছেন নিজের পুত্রের মাঝে।

সানিয়া বেগম,আফিমকে শিখিয়েছেন সৎ মাকেও সম্মান করতে এবং নিজের সৎ বোনকেও আদর করতে।সানিয়া বেগম কখনোই আফিমের কাছে এসব বিষয়ের জটিলতা উপস্থাপন করেননি বরং এসকল বিষয় তিনি যথেষ্ট চতুরতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে আফিমের কাছে সহজ এবং স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন।সেই সাথে তিনি কখনোই আফিমকে নিজের কষ্টের প্রত্যক্ষদর্শী করেন নাই।বরং আফিমের মনে তার পিতার প্রতি সম্মানটা যেনো বজায় থাকে সে বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন।এসবের একটিই কারণ।তা হলো সানিয়া বেগম কখনোই চান নি তার ছেলে কোনোভাবে কষ্ট পাক বা তার ছেলের মনে এসব বিষয় কোনোভাবে দাগ কাটুক।মায়ের কষ্ট কোনো সন্তানই সহ্য করতে পারে না।তাই হয়তো আফিমের তার পিতার প্রতি ক্ষোভ বা বিরূপ ধারণা তৈরি হতো যা একটি শিশু মনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে।আফিমের মায়ের বুদ্ধিমত্তা এবং সচেতনতার জন্যেই আফিমের শৈশবে তার পিতা-মাতার আলাদা হওয়ায় তেমন গাঢ় এবং বাজে প্রভাব পরেনি এবং সেই সাথে আফিমের এসব বিষয় মেনে নিতে তেমন কষ্টও হয়নি।
আফিম যেমন তার সৎ মা ও বোনকে ভালো জানে ঠিক তেমনই তার সৎ মা,বোনও তাকে যথেষ্ট ভালো জানে।তাদের সবার মাঝেই একটা ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান।সেই সাথে সম্পত্তি নিয়েও কোনো ভেজাল নেই।কারণ আরহাম সাহেব তার বাংলাদেশের কোম্পানি আফিমের নামে করে দিয়েছেন এবং ইউএসএ তে তার চলমান ব্যবসার উত্তরাধিকারী তার কন্যা সন্তান।

!!
আফিমের অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় সে বলতে গেলে সারাদিনই ব্যস্ততায় কাটায়।যেখামে সন্ধ্যেতেই বাড়ি ফেরে সে সেখানে আজ রাত ৮ বাজার পর বাড়ি ফিরেছে।গোসল সেরে নিচে আসতেই আফিমের মনে পরে আজ নাফিয়ার নিজের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো।মনে হতেই আফিম দ্রুত দাদীর রুমের দিকে অগ্রসর হয়।কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছে তার।নাফিয়াকে শেষ একটি বারের জন্যে হলেও সে দেখতে চায় নাহলে আগামী ৪/৫ দিনের এ দূরত্ব যেনো তার জন্যে অসহনীয় হয়ে উঠবে।তড়িৎগতিতে দাদীর কক্ষে প্রবেশ করতেই এক শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে আফিমের হৃদয়টাকে মুহূর্তেই শান্ত করে দেয়।
বিছানায় দাদীর পেছনে বসে দাদীর মাথায় তেল দিতে দিতে গল্প করছে নাফিয়া।অর্থাৎ নাফিয়া এখনো যায়নি।আফিম শীতল চাহনিতে তাকিয়ে রয় তার দিকে।
হটাৎ আফিমকে দেখে চমকে যায় নাফিয়া।সেই সাথে আফিমের চাহনিতে কেমন যেনো একটু লজ্জাও লাগে তার।সে নিরবে দাদীর পেছন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আফিমের দিকে অগ্রসর হয়।নাফিয়া উঠতেই চোখ খুলে তাকান দাদী।দেখেন তার পোতা এসেছে কিন্তু নাফিয়াকে আফিমের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সে আর কিছু বলেন না।
নাফিয়া আফিমের একটু কাছে গিয়ে বলে ওঠে,
-আফিম,আপনি কি আমায় একটু আমার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবেন?আসলে আমি নিজেই যেতে পারতাম কিন্তু এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে!
এতোটুকু বলে একটু থেমে সে আবারও বলে ওঠে,
-বিকেলেও যেতে পারতাম কিন্তু ভাবলাম আজের দিনটা শেষ করেই যাই!
নাফিয়ার কথায় একটি চোরামো ভাব বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে আফিম।নাফিয়া যে তার সাথে দেখা না করে যেতে চায়নি বলেই রাত অব্দি অপেক্ষা করেছে তা বুঝতে আফিমের বেশি বেগ পেতে হলো না।সে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-ইয়াহ শিউর,মিস.শেখ।

!!
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আফিম,পাশের সিটেই নাফিয়া।আফিমের গাড়ি চালানোর গতি কিছুটা এমন যে,
“এ পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হবে,তুমি বলো তো!”
বিষয়টি নাফিয়ার বেশ ভালোই লাগছে।জানালা খোলা থাকায় ফুরফুরে বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই সাথে রাতের শহরে একা একই গাড়িতে প্রিয় মানুষটির সাথে।সময়টি উপভোগ করার মতো।আফিম গাড়ি চালানোর মাঝেই আড়চোখে বেশ ক’বার দেখে নিয়েছে নাফিয়াকে।নাফিয়াও এর বিপরীত নয়।সে ও লুকিয়ে লুকিয়ে ক’বার দেখে নিয়েছে আফিমকে।
হটাৎ নাফিয়ার কানে সঙ্গীতের শব্দ ভেসে আসে।

“এখন তো সময় ভালোবাসার,
এ দুটি হৃদয় কাছে আসার,
তুমি যে একা আমিও যে একা,
লাগে যে ভালো,
ও প্রিয় ও প্রিয়”

এ মুহূর্তের জন্যেই যেনো এ গানটি তৈরি করা হয়েছিলো।এই মুহূর্তে এমন গানে নাফিয়ার বেশ ভালো লাগছে যার বহিঃপ্রকাশ তার ঠোঁটে বিরাজ করছে।সে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়েই আফিমের দিকে তাকায়।আফিমও একই সময় তাকায় নাফিয়ার দিকে।উভয়ের চোখাচোখি হতেই নাফিয়া খানিকটা লজ্জা নিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।আর আফিম ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ড্রাইভিং এ মনোনিবেশ করে।

অবশেষে পৌঁছে যায় তারা নাফিয়ার বাড়ির সামনে।নাফিয়া গাড়ি হতে নামতেই আফিমও গাড়ি হতে বেরিয়ে আসে।নাফিয়া,আফিমের কাছে এসে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ আফিম।
-হাও বরিং!
ব্রু কুঁচকে তাকায় নাফিয়া।আফিম বলে ওঠে,
-আই ডোন্ট ওয়ান্ট থ্যাংকস লাইক দিস।
-তো কিভাবে চাইছেন?
নাফিয়ার প্রশ্ন শুনে আফিম বাঁকা হেসে নাফিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে নাফিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।চকমে আফিমের দিকে বেশ বড় বড় চোখ করে তাকায় নাফিয়া।আফিম বাঁকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে ওঠে,
-ঠিক এতোটা কাছে এসে (ঠোঁটের দিকে ইশারা করে)এখানে স্পর্শ এঁকে ধন্যবাদ বলতে হয়।
চোখ আরো বড় করে নাফিয়া বলে ওঠে,
-ছিঃ আফিম! কতোটা লুচু আপনি।
-আমি লুচু?(এক ব্রু উঁচু করে বলে আফিম)
-একদম।(মজা করেই বলে ওঠে নাফিয়া)
-তাহলে তো একটু লুচুগীরি করতেই হয়।
বলেই নাফিয়ার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে আফিম।আবারও নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে।নাফিয়া মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-কোন অধিকারে?
-হু?(নাফিয়ার ঠোঁটের অনেকটা কাছে থেকেই বলে ওঠে আফিম)
-কোন অধিকারে এতোটা কাছে আসা?
ঠোঁটে হাসি রেখেই আফিম বলে ওঠে,
-আমার আগে অন্য কোনো ছেলের সাথে মিশেছো?অন্য কোনো ছেলের সাথে রাতে একা ছাঁদে থেকেছো?ঘোড়ায় চড়েছো?ড্যান্স করেছো?
-উহু।
-অন্য কোনো ছেলের এতোটা কাছে এসেছো?
-উহু।
-তবে কোন অধিকারে আমাকে নিজের এতোটা কাছে আসার অনুমতি দেও?
আফিমের করা প্রশ্নে নিশ্চুপ হয়ে যায় নাফিয়া।এর উত্তর কি?এর উত্তর কি এই যে,আফিমের কাছে আসা টা তার ভালো লাগে!আফিম তার কাছে আসলেই তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় এবং সে এক অন্য রকম আনন্দানুভূতি অনুভব করে!সে এ সময় গুলো খুব করে উপভোগ করে!আফিম কাছে আসায় তার যে অনুভূতি হয় সে অনুভব সে বারংবার চায়।কিন্তু এসব অনুভূতির কারণ কি?
নাফিয়াকে নিশ্চুপ দেখে আফিম আর কিছু বলে না।টুপ করে নাফিয়ার নাকে একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-টেক কেয়ার।
কথাটি বলে নাফিয়াকে ছেড়ে দিয়ে আফিম নিজ গাড়িতে যেয়ে বসে পরে।নাফিয়ার ঘোরের মাঝেই যেনো সব হলো।ঘোর কাটতেই দেখে আফিম গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে ঠোঁটে আলতো একটা হাসি নিয়ে নাফিয়াকে ইশারা করে বাড়ির ভেতরে যেতে বলে।নাফিয়া কিছুটা সময় আফিমের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই উল্টো দিকে ঘুরে নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়।ঠোঁটে ফুটে ওঠে আলতো লজ্জারাঙ্গা হাসি।

চলবে।

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১১
লেখিকাঃমাহযাবীন

পরিবারের সবার সাথে প্রায় অনেকটা সময় কাটিয়ে রাত ১২ টায় নিজ কক্ষে ফেরে নাফিয়া।অনেক ভালো লাগছে তার নিজ পরিবারের সবার সাথে এতোটা দিন পর সময় কাটাতে পেরে।ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখজোড়া বুঝতেই নাফিয়ার চোখের সামনে ভেসে ওঠে গত রাতে ছাঁদে আফিমের সাথে একসাথে নাচার কিছু মুহূর্ত।বিনে কারণেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।সোজা হয়ে শোয়া থেকে ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে চোখজোড়া বুঝতেই আবারও নাফিয়ার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আজকের মুহূর্তগুলো।যেখানে হুট করেই আফিম তাকে নিজের কাছে টেনে এনেছিলো আর শেষে তার নাকে আফিমের ঠোঁট ছোঁয়ানোর মুহূর্ত টা!মনে পরতেই মনে একরাশ লজ্জা ও মুগ্ধতা এসে ভর করে।সাথে সাথেই সে পাশ ফিরে বাম দিকে কাত হয়ে শোয়।ঠোঁটে হাসি বজায়ে রেখেই আবারও চোখজোড়া বুজে নেয় সে।চোখ বুঝতেই তার চোখের সামনে সেই মুহূর্ত টা ভেসে আসে যখন আফিম প্রশ্ন করেছিলো,
“কোন অধিকারে আমাকে নিজের এতোটা কাছে আসার অনুমতি দেও?”
চটজলদি চোখজোড়া মেলে তাকায় নাফিয়া।আবারও এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে জায়গা করছে তার মনে।এ অনুভূতিতে আছে লজ্জা,মুগ্ধতা সেই সাথে কিছুটা দ্বিধা।নাফিয়ার মনে হচ্ছে,সে হয়তো আফিমকে ভালোবাসতে শুরু করেছে কিন্তু তা কতটা ঠিক সেটি নিয়ে সে নিশ্চিত হতে পারছে না।হতেও তো পারে এসব শুধুই মুগ্ধতা বা আকর্ষণ।

বারান্দায় হাতে কফির মগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আফিম।আকাশটা আজ অন্ধকার।না আছে চাঁদ আর না দেখা যাচ্ছে তেমন তারার সমাবেশ।তাও অন্ধকার সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে।নাফিয়া তার জীবনে আসার পর হতে এখন অব্দি ঘটা সকল স্মৃতি একের পর এক স্মৃতিচারণ করছে।
প্রথম দিনে নাফিয়ার চেহারার সেই মায়ায় আকর্ষিত হয় আফিম।তারপর আফিমের করা প্রতিটি অন্যায় এর জবাব দেওয়ার যে সাহসটা নাফিয়া দেখিয়েছিলো তাতে আফিম বাধ্য হয় নাফিয়াকে নিয়ে ভাবতে।সেই সাথে নাফিয়ার আচার-আচরণ,স্বভাব,চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যা এই তিন মাসে ফুটে উঠেছে তাতে আফিমের মনে নাফিয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে মুগ্ধতা।সেই সাথে নাফিয়াতে অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছে সে।

!!
বিকেলে নাফিয়া ও তার বাবা সোফায় বসে টিভি দেখছে।সেই সাথে বাবা ও মেয়ের একটু-আধটু গল্পও হচ্ছে।এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হন নয়না বেগম।নাফিয়ার পাশে বসে তিনি বলে ওঠেন,
-তোমায় কিছু বলতে চাইছি!
-বলো আম্মু।(গুরুত্ব না দিয়ে টিভিতে চোখ রেখেই বলে নাফিয়া)
-কথাটি গুরুত্বপূর্ণ।এই যে শুনছেন?(নাফিয়ার বাবাকে উদ্দেশ্য করে)টিভিটি অফ করুন তো!
এবার ঠিক হয়ে বসে নাফিয়া।হঠাৎ তার মায়ের কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বুঝতে না পারায় কিছুটা গম্ভীরভাব নিয়ে মায়ের দিকে তাকায় নাফিয়া।নাফিয়ার বাবা টিভিটি অফ করতেই নয়না বেগম বলে ওঠেন,
-নাফিয়া একটি বিষয় তুমি ভালো করেই জানো, আমাদের আর্থিক কোনো সমস্যা নেই।ঢাকায় এই এক তলা বাড়ি এবং গ্রামে তোমার দাদার দুতলা বাড়িটি আমাদের।সেই সাথে তোমার বাবার জায়গা-জমি খুব যে কম তা কিন্তু নয়।
ব্রু কুঁচকে নাফিয়া বলে ওঠে,
-হটাৎ এসব কথা?
-আমার কথা শেষ হয়নি।তুমি এও জানো যে,তোমার চাচা বাটপারি করে তোমার বাবাকে তোমার দাদার বাড়ির কোনো অংশ না দিয়ে সে বাড়িটি বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন।আর নিজের পৈতৃক ভিটা বাঁচাতেই তোমার বাবা নিজের আপন ভাইয়ের থেকে নিজের বাবার বাড়ি ক্রয় করেন।আর এই বাড়ি কিনতেই তিনি এক বড় লোন নিজের কাঁধে তুলেছিলেন যার বোঝা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন।লোন না নিয়ে তিনি নিজের জমিও বিক্রি করতে পারতেন কিন্তু তা সে কোনোভাবেই করতে চায় নি।
-হ্যা মা,সব টাই জানি।হটাৎ আজ এগুলো নতুন করে বলার কি হলো?
-দেখো নাফিয়া,আমি জানি তুমি চাইছো দ্রুতই তোমার বাবাকে এ ঋণ দিয়ে মুক্ত করতে।যা সন্তান হিসেবে তোমার কর্তব্যও।কিন্তু তার আর প্রয়োজন নেই।ঋণ আর বেশি নেই।মাত্র ২ লাখের মতো আছে যা সামনের কিছু মাসের মধ্যে শোধ হয়ে যাবে।
-আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু এটিও তো আমি জানিই মা।
-এখন মূল কথাটি বলছি!আমাদের সমাজে এক প্রচলিত বাণী আছে,”মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি”।সেথায় তোমার বয়স ২৮ বছর হয়ে গিয়েছে যা অতিরিক্ত।আমি এবং তোমার বাবা তোমার বিয়েটায় আর দেরি করতে চাইছি না।তাই তোমার আর চাকরি করতে হবে না সামনের মাস থেকে।এ মাসে তাদের জানিয়ে দিও।
মায়ের কথায় একদম চুপ হয়ে যায় নাফিয়া।মুহূর্তেই চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে যায় তার।এক তীব্র ভয় নিজের মাঝে অনুভব করছে সে।এ ভয়টি শুধুই আফিমকে হারানোর ভয়।টুপ করে নাফিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতেই নয়না বেগম বলে ওঠেন,
-এভাবে কাঁদার কিচ্ছুটি নেই।পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই বিয়ে করে।তুমি প্রথম নও।তাই এতো ভয় না পেয়ে বিষয়টি সহজভাবে নেও।তোমার বাবার পরিচিত এক মুখে ডাকা ভাইয়ের ছেলেকে আমরা তোমার জন্যে পছন্দ করেছি।সে আগামী ১০/১৫ দিনের মাঝেই তোমার সাথে দেখা করবে।
-মা,এখনই কেনো বিয়ে করতে হবে?
-২৮ বছর বয়স কম নয় নাফিয়া।
-বাবা,তুমি কিছু বলো?
পত্রিকা হতে চোখ উঠিয়ে নিজের মেয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠেন,
-তোমার মায়ের সাথে সহমত।আর দেরি করা ঠিক হবে না তবে একটি বিষয় বলতে চাইছি।তোমার কোনো পছন্দ থেকে থাকলে বলতে পারো!
-ওর আবার কিসের পছন্দ।আমরা যা সিদ্ধান্ত নিবো তাই ই ওর জন্য সঠিক।(নয়না বেগম)
-ভুল বললে নয়না।জীবন সঙ্গী ওর,সংসার করবে ও তাই ওর জন্য কোন মানুষটি উপযুক্ত হবে তা ও ই ভালো বুঝতে পারবে।
-আমাদের সময় তো বাবা-মাই বিয়ে ঠিক করছিলো আর সেই কালে বিয়ে টিকতো,এখনকার বাচ্চারা নিজের পছন্দে বিয়ে করে তারপরে তো হয় তালাক।
-আবারও ভুল বললে নয়না।আগের যুগে নারীরা ছিলো এমন যে মরে যাবো কিন্তু স্বামীর বাড়ি ছাড়বো না।তারা হাজারো অত্যাচার বা কষ্ট সহ্য করে সংসার করে গিয়েছিলেন দেখে বিবাহ বিচ্ছেদ তেমন হতো না।আর এখনকার নারীরা স্বাধীন।তারা এখন মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর সংসারে পরে থাকে না।সেই সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ তখন মানুষ যেমন ভয় পেতো এখনকার সময়ে এটি তেমন কোনো ব্যাপারই না।আগের কালের থেকে এখনকার সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে কারণ যুগ পাল্টেছে। এর সাথে বড়রা বিয়ে ঠিক করা বা ছোটরা নিজেরা পছন্দ করা টা কোনোভাবে জড়িত নয়।
উত্তরে কিছু বলেন না নয়না বেগম।স্বামীর কথায় যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন তিনি।
নয়না বেগম নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে ওঠেন,
-পছন্দ আছে কেউ?
উত্তরে বলার মতো কিছুই পায় না নাফিয়া।কিই বা বলবে সে?আফিম তাকে পছন্দ করে কিনা, ভালোবাসে কিনা,বিয়ে করবে কিনা কিছুই তো জানে না সে।উত্তরে কিছু না বলে সোফা থেকে উঠে নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় নাফিয়া।নয়না বেগম নাফিয়াকে থামাতে চাইলে নাফিয়ার বাবা ইশারায় নিষেধ করেন নিজ স্ত্রীকে।

!!
কেমন যেনো সব উলট-পালট লাগছে নাফিয়ার।আফিমকে ঘিরে তার এতো এতো অনুভূতিগুলোর কি নাম দেবে তা ই এখনো নিশ্চিত করে পারলো না সে।এরই মাঝে এতো গুলো চিন্তে এসে পরেছে তার উপর।একদিকে বাবা-মা বিয়ের কথা বলায় অদ্ভুত রকমের ভয় কাজ করছে নাফিয়ার।এই ভয়টাতে কেমন যেনো কষ্ট আছে,বিচ্ছেদ হবার আতংক আছে।সেই সাথে আফিমের মনে তার জন্য কিরূপ অনুভূতি কাজ করে তা নিয়েও ভীষণ চিন্তিত নাফিয়া।আফিম কি তাকে ভালোবাসে নাকি সাময়িক সময়ের মোহ এর জন্যেই কাছে আসা?
এসব চিন্তের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে নাফিয়া।তেমন করে আর কারো সাথে কথা বলছে না,রুম হতে দরকার ছাড়া বের হচ্ছে না।কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে সে।নয়না বেগম সহ বাড়ির সবাই বিষয়টি খেয়াল করে কিন্তু নাফিয়ার বাবা সবাইকে বলেছেন নাফিয়াকে কোনো প্রশ্ন না করে নিজের মতো করে কয়দিন থাকতে দিতে।কারণ সে উপলব্ধি করতে পারছেন তার মেয়ে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত।আর তাই হয়তো নাফিয়া একান্তে সময় কাটাতে পারলে নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারবে।

নাফিয়া নিজের বাসায় আসার পর আজ ২য় রাত!বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকাতেই নাফিয়ার আফিমের সাথে কাটানো বেশ কিছু মুহূর্ত মনে যায়।দুজনার বেশির ভাগ স্মৃতিই এই আকাশের সাথে।রাতের আকাশ,চাঁদ,তারা!নাফিয়া আপন মনেই ভাবে আজ যদি তাদের মাঝে প্রেম নামক সম্পর্কটি থাকতো তবে বলা যেতো,
“আমাদের প্রেমের সাক্ষী এই আকাশ,বাতাস,ঐ চাঁদ ও তারা।”
ভাবতেই হেসে ওঠে নাফিয়া।এই বাক্যগুলো খুবই হাস্যকর লাগে তার কাছে।বাংলা সিনেমাগুলোতে নায়ক-নায়িকাদের প্রেমের সাক্ষী তো এই আকাশ,বাতাস,চাঁদ,তারাই হয়।আর আজ কিনা তারও একই অবস্থা,ভাবা যায়!
হটাৎই নাফিয়ার মুঠোফোনটি বেজে ওঠে।এতো রাতে কে কল দেবে ভেবে পায় না সে।ফোনটি হাতে নিতেই দেখে আননোন নাম্বার।ব্রু কুঁচকে ফোনটি রিসিভ করে কানে ধরে নাফিয়া বলে ওঠে,
“আসসালামু আলাইকুম”
কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না।নাফিয়া চুপ করেই আছে ওপাশের মানুষটির কিছু বলার অপেক্ষায়।কেউ কল দিয়ে এভাবে চুপ করে থাকবে কেন তা বুঝে উঠতে পারছে না সে।হটাৎই তার মনে হয় কলটি কি কোনোভাবে আফিম দিয়েছে!মনে হতেই ধীরে ধীরে নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করে।নাফিয়া মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-আ আ আফিম?
আর কিছু বলতে পারে না নাফিয়া।এক তো সে সন্দিহান আফিমই কল দিয়েছে কিনা!দ্বিতীয়ত হয়তো আফিমই কল দিয়েছে ভেবেই নাফিয়ার ভীষণ খুশি খুশি অনুভব হচ্ছে সেই সাথে তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে চলছে।কিছুটা সময় উভয়ের নিরাবতার পর ফোনের ওপাশ হতে আলতো স্বরে একটি আওয়াজ আসে,
“মিস.শেখ”
শব্দটি শোনার সাথে সাথেই যেনো নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন কয়েকশো গুণ বেড়ে গিয়েছে,অতিরিক্ত খুশি তার ঠোঁটের আলতো হাসিকে অনেকটা বৃদ্ধি করে দিয়েছে।খুশিতে নাফিয়া যেনো কিছু বলতেই পারছে না।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নাফিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলে ওঠে,
“আফিম?”
-হু।
-এতো রাতে!দাদী ঠিক আছে?
-আছে।
-ওহ।
আবারও দুজনেই চুপ।কিছুটা সময় নিরাবতাই চলে তাদের মাঝে।আফিম বলে ওঠে,
-I wanna see you tomorrow at home.
কথাটি বলেই ফোন কেটে দেয় আফিম।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here