#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,পর্বঃ৩৩
#লেখিকা_মাহযাবীন
“যদি বলি হ্যাঁ অন্য কেউকেই চাই তাহলে কি করবেন?আমাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন?”
নাফিয়া উক্ত বাক্যদ্বয় বলে শেষ করতে না করতেই তাকে নিজের কাছে টেনে নিলো আফিম।মেয়েটির ওষ্ঠদ্বয়ের উপর আলতো করে নিজের শাহাদাত আঙ্গুল রেখে ধীর শব্দ করে উঠলো ‘হুসসস’।অতঃপর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মেয়েটির চোখের কোণে জমা অশ্রু কণা মুছে দিয়ে মৃদু স্বরেই বলে উঠলো,
-যা আমার তা শুধু এবং শুধুমাত্র আমার।আমি মহান ত্যাগী পুরুষ নাহ।আমি জেদি।যা আমার তা আমি আমার করে রাখতে জানি।
আফিমের চোখে অপলক তাকিয়েই নাফিয়া প্রশ্ন করে উঠলো,
-জেদ করে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায়?
-উহু,ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়।যা অর্জন করে নেওয়ার যোগ্যতা আমার আছে।
আফিমের উত্তরে নাফিয়ার পূর্ণ দৃষ্টি ছোট ছোট হয়ে এলো।রাগী মুখ করে তাকালো সে আফিমের চোখ পানে।বিরোধিতা করে বলে উঠলো,
-কচু আছে।শুনেন,ভালোবাসা পাওয়া,না-পাওয়া পুরোটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।চোখ ঘুরিয়ে দেখেন আশেপাশে, কত যোগ্য মানুষের নসিবে ভালোবাসা জোটেনি।হুহ্,শুকরিয়া নাই মানুষের!হুদাই নিজের দাম বাড়ায়।
কথাগুলো বলে আফিমের বাহুবন্ধন হতে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে নাফিয়া।কিন্তু বহু মোচড়ামুচড়ির পরও সফল হয় না সে।নিজের কাজে অসফল হয়ে চোখ গরম করে তাকায় সে আফিমের দিকে।মুচকি হাসে আফিম।কিশোরীর ক্রোধও যেনো উপভোগ করছে সে।
এবার নাফিয়াকে পূর্বের তুলনায় আরও শক্তপোক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো সে।গালে নাক ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-এতো রাগছো কেনো বউ?
আফিমের মুখে প্রথম বার ‘বউ’ শব্দটি শুনে মুহূর্তেই হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ বৃদ্ধি পেলো নাফিয়ার।তার হৃদয় অস্বাভাবিক হারে স্পন্দিত হতে আরম্ভ করলো।মুখশ্রী লাল আভা ধারণ করলো।মুগ্ধতা, প্রশান্তি ঘিরে ধরলো তাকে।রাগ গলে পানি হতে চাইলো।কিন্তু তার অভিমান, অভিযোগেরা বিরোধিতা করলো এতে।তারা এতো সহজে বিদায় নেবে না।আগে আফিম তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে তারপরই এ অভিমানেরা বিদায় নিবে।
!!
রাগে মেজাজ বিগড়ে আছে আরহান সাহেবের।তার মতো প্রভাবশালী ব্যাক্তি যার কাছে ছোট-বড় সকল খবর সময় মতো গিয়ে পৌঁছায় সে কি করে নিজের ছেলের বিয়ের সংবাদ পেলো না?এতো এতো টাকা দিয়ে কাদের পালছেন তিনি? এতো বড় খবর কি করে তার কান অব্দি এলো না?
রাগে মাথা প্রায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আরহান সাহেবের।তিনি কার উপর নিজের রাগ ঝারবেন তা ভেবে না পেয়ে প্রথমেই ডায়াল করলেন রিয়াদের নম্বর।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার।
-আফিমের বিয়ের খবর আমায় জানানো হয়নি কেনো রিয়াদ?
এক প্রকার চেঁচিয়ে প্রশ্নটি করলেন আরহান সাহেব। পরিস্থিতি খারাপের দিকে এগোচ্ছে তা বুঝলো রিয়াদ।সঠিক সময়ের মধ্যে সব সামলে না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে এগোবে তাতে সন্দেহ নেই।নিজেকে ঠান্ডা রেখে রিয়াদ উত্তর দিলো,
-স্যার,পরিস্থিতির জন্য বাধ্য হয়ে বিয়ের বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে হয়েছে।
রিয়াদ নিজের কথা শেষ করতে না করতেই আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন আরহান সাহেব।বলে উঠলেন,
-আমার থেকে এতো বড় খবর লুকিয়ে এখন পরিস্থিতির দোহাই দিচ্ছো?আমার টাকায় খাও-পড় আবার আমার সাথেই নেমকহারামী করো?
আরহান সাহেবের শেষোক্ত বাক্যটি সোজা গিয়ে আঘাত করলো রিয়াদের আত্মসম্মানে।চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ছেলেটার।কিন্তু মুহুর্তেই সামলে নিলো সে নিজেকে।নিন্ম স্বরে বলে উঠলো,
-আমাকে রাখা হয়েছে আফিম স্যারের অনুগত হয়ে থাকার জন্য।আর ছোট বেলা থেকে সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে নিজের এ দায়িত্ব পালন করে এসেছি আমি।নেমকহারামী আমার রক্তে নেই স্যার।আর আফিম স্যারের বিয়ের বিষয়টি খুব গোপনীয় করে রাখা হয়েছে কারণ কোনোভাবে তা শত্রুপক্ষ অব্দি পৌঁছালে তারা এ বিয়েকে ‘বাল্যবিবাহ’ নাম দিয়ে স্যারের রেপুটেশন নষ্ট করার চেষ্টা করবে, স্যারের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।
রিয়াদের কথায় এবার দমে গেলেন আরহান সাহেব।নিরবে ভাবলেন, আসলেই এ বিয়ে লুকায়িত থাকাই তার ছেলের জন্য শ্রেয়।আর যেহেতু এতোদিন সে বিদেশে ছিলো সেহেতু তার কান অব্দি এ খবর পৌঁছাতে গেলে আরও মানুষের মধ্যে জানাজানি হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।এজন্যে এ খবর তার কাছে পৌঁছানোও সুরক্ষিত ছিলো না।
এবার ব্যাপার খানা বুঝতে পেরে রাগ কমলো আরহান সাহেবের।তিনি ঠান্ডা কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলেন,
-কে এই মেয়ে? কি জাদু করেছে আমার ছেলের উপর যে সে কোনো কিছুর পরোয়া না করে এই মেয়েকে নিজের বউ করে ঘরে তুলেছে?
!!
“তোমার মাম্মি অর্থাৎ নুরি মা আমার মায়ের খুব কাছের বান্ধবী ও আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন।আমার মায়ের যেদিন এক্সিডেন্ট হয় সেদিন নুরি মা নিজের বাসায় ছিলেন না।তিনি ছিলেন তার বড় বোন অর্থাৎ তোমার আম্মুর সাথে তোমাদের বাড়িতে।কারণ তখন তোমার পৃথিবীতে আসার সময় ঘনিয়ে এসেছিলো।নুরি মা নিজের বাড়িতে না থাকায় তিনি জানতে পারেননি আমার আম্মুর মৃত্যুর খবর, জানতে পারেননি আমি নিজের বাড়ি ছেড়ে চাচার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম।তখন না আমার সাধ্যে ছিলো নুরি মায়ের কাছে যাওয়ার আর না নুরি মা পেরেছিলেন আমার খোঁজ জানতে।
এভাবেই কেটে যায় কয়েক বছর।বড় হওয়ার সাথে সাথে ব্যস্ততা বাড়ে।নিজেকে নিয়ে, নিজের জীবনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।ভুলে যাই ছোটবেলার স্মৃতি মনে করা, ভুলে যাই মায়ের মতো আরেকটা মায়ের খোঁজ নেওয়ার কথা,ভুলে যাই নিজের শহরে অন্তত একটি বারের জন্য হলেও যাওয়ার কথা।তখন মনে ছিলো শুধু নিজেকে গড়ার নেশা।
তারপর হটাৎ এক বর্ষণে এক মেঘকন্যা আসে আমার জীবনে।অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভিজা,অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া,দুশ্চিন্তা ও দূর্বলতায় জ্বর হয় তার।অসুস্থ থাকে টানা দু’দিন।আর তার এই অসুস্থতার দু’দিনকে কাজে লাগাই আমি।রিয়াদকে বলি তার সম্পূর্ণ খোঁজ-খবর নিয়ে আমাকে জানাতে।রিয়াদও নিজের কাজ এক দিনে সম্পূর্ণ করে।চলে যাই আমি সেই মেঘকন্যার শহরে।সেখানে গিয়ে কেমন যেনো এক অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরেছিলো আমাকে।অদ্ভুত এক টান কাজ করছিলো।মনে হচ্ছিল এ শহর আমার ভীষণ পরিচিত।কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারছিলাম না।কারণ এতো বছরে ওখানের সব পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।কিন্তু পরিবর্তন হয়নি শুধু নুরি মা।তাকে দেখেই চিনে গেলাম।হৃদয়ের কোনো এক কোণে জ্বালাপোড়া অনুভব হচ্ছিল তখন।এতো বছর পর প্রিয় মুখখানা এভাবে দেখতে পাবো ভেবেছিলাম না।কিভাবে যেনো নুরি মাও চিনে গেলেন আমাকে।গালে স্নেহ ভরা হাত রেখে ডেকে উঠেছিলেন,
“আফিম?”
ব্যাস, এরপর একে-অপরকে সব কিছু খুলে বললাম আমরা।নুরি মা যখন জানলেন তুমি আমার বাড়িতে তখন স্বস্তির শ্বাস নিয়েছিলেন তিনি।কিন্তু আমার বাসায় আমি ছাড়া আর কেউ থাকে না।যতই হোক আমি একজন পুরুষ।যদিও মা বিশ্বাস করেন আমাকে তবুও তার ভয় ছিলো লোকে জানাজানি হলে তারা তোমার চরিত্র নিয়ে বাজে মন্তব্য করবে।
নুরি মায়ের চিন্তা দূর করতে সেদিন আমি তাকে বলে ছিলাম,
“আমি নাফিয়াকে বিয়ে করতে চাই।”
আমার এই একটা বাক্য মায়ের মুখের সব চিন্তা দূর করে হাসি এনে দিয়েছিলো।তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন তোমাকে নিয়ে।অতঃপর মায়ের কাছ থেকে এসেই রিয়াদকে বললাম বিয়ের প্রস্তুতি নিতে।ও সব ব্যবস্থা করে বিয়ের পেপারস রেডি করে আনলো।তারপর তোমাকে ডিলের কথা বলে পেপারে তোমার সাইন নিয়ে নিলাম,নিজেও সাইন করলাম।
এই ছিলো সব কাহিনি।”
আফিম নিজের কথা শেষ করে তাকালো নাফিয়ার দিকে।বারান্দার রেলিং ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তারা উভয়ই।নাফিয়াও এতোক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিলো আফিমের দিকে ফলে একে-অপরের চোখাচোখি হতেই নাফিয়া বলে উঠলো,
-শুধু মাত্র মাম্মির চিন্তা দূর করতেই বিয়েটা করেছিলেন?
নাফিয়ার প্রশ্নে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে নিলো আফিম।দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বলে উঠলো,
-তো? আর কি জন্য বিয়ে করবো? নুরি মায়ের কথা ভেবেই তো বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম।
আফিমের এমন উত্তরে দুঃখানুভব হলো নাফিয়ার।চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো অভিমানে।উত্তরে কিছু বলার আর ইচ্ছে হলো না তার।নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করবার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো সে।দু’কদম আগাতেই পেছন হতে এক হেঁচকা টানে আফিমের বুকে আঁচড়ে পড়লো সে।তাকালো আফিমের চোখ পানে।অভিমানী কিশোরীর সিক্ত চোখপানে তাকিয়ে আফিম বলে উঠলো,
-এই বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ে করার পরই অনুভব করলাম ‘জীবন সুন্দর’।
চলবে।