#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,০৬,০৭
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ০৬
একই সময়ে দুজনের হাঁচি হওয়ায় একে-অপরের দিকে তাকায় আফিম-নাফিয়া।আবার অনতিবিলম্বে চোখ সরিয়ে নেয়।দুপুরে নিজেদের করা যুদ্ধের কথা মনে পড়তেই উভয়েই একে-অপরের দৃষ্টি এরিয়ে মৃদু হেসেও নেয়।
দুপুরের সেই আকামের পর উভয়েরই একটু আধটু ঠান্ডা লেগেছে।হাঁচি হচ্ছে সেই সাথে মাথাটাও ভার হয়ে আছে।
আফিমের দিকে আদা চা এগিয়ে দিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-এতে হয়তো একটু ভাল লাগবে আপনার।
ল্যাপটপ হতে দৃষ্টি উঠিয়ে এক নজর তাকায় আফিম নাফিয়ার দিকে।অতঃপর আবারও দৃষ্টি ল্যাপটপে আবদ্ধ করে চায়ের মগটি হাতে নিয়ে তা হতে এক চুমুক পান করে সে বলে ওঠে,
-Thanks!
চা পান করার সাথে সাথে নিজের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে আফিম আর নাফিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখার চেষ্টা করছে।
হটাৎ আফিম ল্যাপটপ হতে চোখ না সরিয়েই প্রশ্ন করে ওঠে,
-কি হতে চাও জীবনে?
হুট করে এমন প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় নাফিয়া।ছেলেটা তার সম্বন্ধে কিছুই জানে না।তার পরিচয় বা তাকে সেদিন রাতে ওভাবে রাস্তায় পাওয়ার পেছনের কারণ কোনোটাই জিজ্ঞেস করেনি।যার এসব জানার ইচ্ছে হয়নি তার আবার হুট করে নাফিয়ার জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে হলো কেনো সেটিতে একটু অবাক ও হয়েছে নাফিয়া।অবশেষে এসব ভাবনা বাদ দিয়ে সে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-আপনার মতো।
নাফিয়ার উত্তরে তার দিকে তাকায় আফিম।নাফিয়ার চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে,
-কেনো?
-ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার শখ আমার।
উত্তরে আর কিছু বলে না আফিম।আবারো নিজের ল্যাপটপে দৃষ্টি আবদ্ধ করে সে।ঠোঁটে অল্প একটু, সামান্য হাসি দৃশ্যমান।
কিছু একটা ভেবে নাফিয়া জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আপনার আব্বু-আম্মু কি গ্রামের বাড়িতে থাকে?
এমন প্রশ্নে আফিম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বরং সে নিজের কাজ করতে করতেই বলে উঠলো,
-না।
-তাহলে?কোথায় তারা?বিদেশে?
-মা নেই দুনিয়াতে আর বাবাকে টাকা কিনে নিয়েছে।
-মানে?
-শিল্পপতি আরহান ইবনান! নিজের নামের আগে “শিল্পপতি” ট্যাগ লাগানোর জন্য নিজের জীবন,স্ত্রী, সন্তান কোনো কিছুর পরোয়া করেনি তিনি।এখনো ইউএসএ তে টাকা কামাবার উদ্দেশ্যেই পরে আছেন।
কথাগুলো শেষ করেই ঠাস করে নিজের ল্যাপটপ অফ দেয় আফিম।মুহূর্তেই চোখমুখে কিসের জানি একটা ছাপ ফুটে উঠেছে তার।এটা রাগ নাকি বিরক্তি নাকি কষ্ট! বুঝতে সক্ষম হলো না নাফিয়া।
আফিম সময় ব্যায় না করে নিজের বিছানা থেকে উঠে তৎক্ষনাৎ নিজ কক্ষ ত্যাগ করে।
নাফিয়া অতক্ষণ অবাক চাহনি নিয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলো আফিমের দিকে।আফিম কক্ষ ত্যাগ করতেই একটু নড়েচড়ে উঠে সে।বুঝতে চেষ্টা করে কিছুক্ষণের মাঝেই কি থেকে কি হয়ে গেলো!
!!
ছাঁদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ায় আফিম।আকাশে একটি পূর্ণ চাঁদ জ্বলজ্বল করছে।ঐ চাঁদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।নিজের দৃষ্টি চাঁদে আবদ্ধ রেখেই আফিম বলে ওঠে,
-একা থাকতে চাইছি মিস.শেখ।তুমি যেতে পারো।
আফিমের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কথায় একটু চমকে ওঠে নাফিয়া।ছেলেটা তাকে না দেখেই কিভাবে তার উপস্থিতি টের পেলো তা বোধগম্য হলো না তার।তবুও আফিমের আদেশ পেয়ে চলে যাবার জন্য এক পা বাড়িয়েও থেমে যায় সে।যাওয়ার জন্য মন সায় দিচ্ছে না।বড়সড় ছাঁদ টার একদিকে রয়েছে সুইমিং পুল।আবার এক কোণায় পাতানো রয়েছে চেয়ার-টেবিল।অন্যদিকে অনেকগুলো ফুল গাছ এবং তার মাঝেই রয়েছে একটি দোলনা।অনেক সুন্দর করে সাজানো এবং পরিপাটি করে রাখা এই ছাঁদ টা।রাতের ঠান্ডা বাতাস,আকাশের চাঁদ সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর সব কিছুই এখানে আছে।এ স্থান ত্যাগ করার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নাফিয়ার নেই।আর আফিমেরও হয়তো মনটা ভালো নেই।এভাবে ছেলেটাকেও একা থাকতে দিতে মন চাইছে না তার।
সবটা ভেবে নিয়ে আফিমের উদ্দেশ্যে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আমার ডিউটি তো এখনো শেষ হয়নি।আপনার ঘুমের আগ অব্দি আমার কাজ আপনার সাথে থাকা সো আমি থাকবো।
উত্তরে কিছু বলে না আফিম।সে তার মতো করে রাতের এই সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করায় মনোনিবেশ করে।নাফিয়াও কিচ্ছুটি না বলে ধীর পায়ে আফিমের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।সেও নিরবে এই নিস্তব্ধ সুন্দর পরিবেশ টা উপভোগ করতে আরম্ভ করে।সেই সাথে একটু একটু তাকাচ্ছেও সে আফিমের দিকে।বুঝার চেষ্টা করছে কি চলছে ছেলেটার মনে!যদিও তার চেষ্টার ফলাফল শূন্যই।কিছুই বুঝতে পারলো না আফিমের মনের হাল।
কিছুটা সময় এভাবেই পাড় হয়ে যায়।নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দের উৎপত্তি হয় আফিমের কন্ঠনালী হতে।ছেলেটি শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-ঐ চাঁদ টা দেখছো, মিস.শেখ?
চাঁদ টা কিন্তু বড্ড একা।দেখো পুরো কালো অন্ধকারে ঢাকা বিশাল আকাশটার বুকে একটি চাঁদই জ্বলজ্বল করছে।ও একা কিন্তু অসহায় নয়।এই বিশালতার মাঝে ও একাই শক্তপোক্ত ভাবে নিজের অবস্থানে নিজেকে উজ্জ্বলিত করে রেখেছে।দেখো তো,চাঁদ টাকে দেখে কি তোমার মনে হয় সে দুঃখি?
আমার তো মনে হয় না।চাঁদের দিকে তাকালেই আমার মনে হয় চাঁদ হাসছে।সে একাই নিজের মতো করে আনন্দে আছে।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে আফিম।এবার নিজের দৃষ্টি চাঁদ হতে সরিয়ে নাফিয়ার দিকে আবদ্ধ করে সে।
আফিম নাফিয়ার দিকে তাকাতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-ঠিক বলেছেন।আমারও চাঁদের দিকে তাকালে এমনই মনে হয় যে,চাঁদ মামা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।কিন্তু আমাদের মানুষের বেলায় ব্যাপার টা হতো উল্টো।আমরা মানুষরা একাকিত্ব ভয় পাই।একাকিত্ব,নিঃসঙ্গতা আমাদের ডিপ্রেশন,সুইসাইড এসবের কারণ হয়।আমরা মানুষরা একা থাকতে ভীষণ রকমের অপছন্দ করি।আমরা চাই আমাদের আপন মানুষগুলোকে নিয়ে একযোগ হয়ে থাকতে।
নাফিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মেয়েটির সব কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে আফিম।নাফিয়ার কথা শেষ হতেই তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-কিন্তু বাস্তবতা টা হচ্ছে পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে কেউই আমাদের আপন নাহ।এ পৃথিবীতে কেউ আমাদের স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসে না।এমনকি নিজের বাবা-মা ও আমাদের স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসেন না।দিনশেষে আমরা প্রতিটা মানুষ শুধু নিজেই নিজের।কেউ শেষ অব্দি আমাদের সাথে,আমাদের পাশে থাকে না।একটা নির্দিষ্ট সময় পর সবাই ই আমাদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়।রয়ে যাই আমরা নিজেই নিজের জন্য।প্রকৃত সত্যি হচ্ছে আমরা মানুষরা পৃথিবীতে আসি একা, যাবো ও একা আর পৃথিবীতে যতদিনই বাঁচি আমাদের জন্য শুধু আমরা নিজেরাই রই।বাকি সব স্বার্থ।
কথাগুলো বলে একটু থামে আফিম।নাফিয়া গভীর মনোযোগী হয়ে আফিমের কথাগুলো শুনছে।আফিম কিছুটা সময় নিস্তব্ধ থেকে আবারও বলে ওঠে,
-কিন্তু এতো স্বার্থের ভীড়ে আমরা প্রতিটি মানুষই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জন্ম হতে মৃত্যু অব্দি পাই।আর এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা টা হচ্ছে আমাদের স্রস্টার।একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তার সকল বান্দাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন।তিনি ভালোবেসে আমাদের সৃষ্টি করেছেন।তার এতো এতো আদেশের অবাধ্য হওয়ার পরও,এতো এতো গুনাহ করবার পরও তিনি তার নিয়ামত,রহমত দিয়ে আমাদের বঞ্চিত করেন না।বরং বারংবার সুযোগ দিয়ে যান, ক্ষমা করে যান।তার কিছুই পাওয়ার নেই আমাদের থেকে। তিনি তো অভাবমুক্ত বাদশাহ।যার ধনভাণ্ডার কখনো ফুরাবে না তবুও তিনি আমাদের ভালোবাসেন।
কথাগুলো বলে থামে আফিম।একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে তাকায় নাফিয়ার দিকে।নাফিয়া মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে।একবার নাফিয়াকে দেখে নিয়ে নিজের দৃষ্টি আবারও অন্ধকার আকাশে আবদ্ধ করে আফিম।নিরবে চেয়ে থাকে সেথায়।আফিমকে চুপ থাকতে দেখে নাফিয়া বলে ওঠে,
-তাহলে এতো এতো ব্যাখ্যার উপসংহারে এসে বলা যায়,পৃথিবীতে কেউই কারো নয়।আমরা নিজেই শুধু নিজের।প্রতিটা মানুষ নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট আল্লাহর রহমতে।
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসে আফিম।চাঁদের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,
-আমাদের উচিৎ ঐ চাঁদের মতো হওয়া।যে একাই বাঁচতে জানে।একাকিত্ব উপভোগ করে আনন্দ কুড়াতে জানে।যার চারিপাশে কেউ নেই এ শোকে সে ভেঙ্গে পড়েনি বরং এ বিশাল শূন্য আকাশে মজবুত বা শক্ত ভাবে নিজে জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর বুকে জোৎস্না পাঠাচ্ছে।
মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আফিমের কথাগুলো শুনছে নাফিয়া।বেশ ভালো লাগছে তার কথাগুলো শুনে। সত্যিই তো পৃথিবীতে কেউই কারো আপন নয়।খুব কাছের কারোরও যদি স্বার্থতে একটু আঘাত লাগে তাহলে সেও রুপ পরিবর্তন করতে সময় নেয় না।দিনশেষে আমরা নিজেই নিজের।এটি মাথায় রেখে নিজেকে শক্তভাবে গড়ে তুলে চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ গড়া খুব তো অসম্ভব নয়।
এই প্রথমবার আফিমে এতোটা মুগ্ধ হয় নাফিয়া।ছেলেটা যে এতো সুন্দর করে এতো কথা বলতে জানে তা তো নাফিয়া স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।নাফিয়া ভাবতো আফিম গম্ভীর স্বভাবের ছেলে যার মুখ দিয়ে কথা বের হতে ট্যাক্স লাগে,যে শুধু কথায় কথায় ইংলিশ বলে ভাব নেয়।কিন্তু আসলে আফিম তো এমন নয়। এই মানুষটার ভেতরে আরেকটা মুগ্ধতায় ভরা মানুষ আছে তা আজই প্রথমবার উপলব্ধি করলো নাফিয়া।
অনেকটা সময় উভয়েই নিরবে কাটিয়ে দেয়।নিরবতা ভাঙতে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আপনি কি আরো কিছু ভাবছেন?
নাফিয়ার প্রশ্নে তার দিকে তাকায় আফিম।পরিবেশ টা খুব গম্ভীর হয়ে আছে যা চাইছে না সে।নিজের মনের ভেতর চলতে থাকা কথাগুলো নাফিয়াকে বলে এখন অনেকটা হালকা লাগছে আফিমের।কিন্তু সে ভাবছে এসব কথা আদৌও নাফিয়াকে বলা ঠিক হয়েছে কিনা।কারণ মেয়েটার বাচ্চামিই ভাল্লাগে তার।সে চায় না বাস্তবতার এসব কুৎসিত দিকগুলো মেয়েটার বাচ্চামিগুলোকে শেষ করে দিক।
তাই গম্ভীর পরিবেশ টাকে স্বাভাবিক করতেই আফিম বলে ওঠে,
-হু।
-কি ভাবছেন?
-ভাবছি এই ডুপ্লেক্স বাসার ছাঁদ থেকে তোমাকে নিচে ফেলে দিলে কেমন হয়?
হটাৎ আফিমের এমন কথা শুনে বেকুব বনে যায় নাফিয়া।ভয়ে একটু ঢোক গিলে বলে ওঠে,
-মানে?
-এখান থেকে তোমাকে ফেলে দিলে মন হয় তুমি মরবা না।ব্যাস কয়েকটা হাড়গোড় ভাঙবে আরকি!কি বলো একবার ফেলে টেস্ট করবো নাকি যে মরবা কিনা?
-মজা করছেন?
কথাটি বলে ভয়ে এক পা এক পা করে পিছাতে আরম্ভ করে নাফিয়া।নাফিয়াকে ভয় পেতে দেখে মজা পায় আফিম।কিন্তু তা প্রকাশ না করে এক পা এক পা করে নাফিয়ার দিকে এগোতে এগোতে সে বলে ওঠে,
-নাহ।যে পরিমাণ জ্বালাও তুমি।এভাবে তোমাকে একটা শিক্ষা দেওয়াই উচিৎ।
আফিমের কথাটি বলতে দেরি হলেও নাফিয়ার দৌড়ে পালাতে দেরি হলো না।দৌড়ে ছাঁদের দরজা অব্দি গিয়ে বলে ওঠে,
-ছাঁদটা ভালো করে খুঁজে দেখুন তো কোথায় জানি আপনার মাথার একটা স্ক্রু খুলে পরে গিয়েছে।
বলেই আবারও দৌড় দেয় নাফিয়া।নাফিয়া যেতেই হেসে ওঠে আফিম।মৃদু শব্দ করেই হাসে সে।জীবনে কত বছর আগে এভাবে হেসেছিলো তা আফিমের নিজেরই মনে নেই।
চলবে।
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ০৭
গাড়ির ড্রাইভিং সিট এ বসে ড্রাইভ করছে আফিম।তার পাশের সিটেই বসে আছে নাফিয়া।উদ্দেশ্য অফিসে পৌঁছানো।প্রতিদিন ড্রাইভার ড্রাইভ করলেও আজ আবহাওয়া ভালো থাকায় আফিমের নিজেরই ইচ্ছে হলো ড্রাইভ করার।তাই জন্যে ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজেই বেরিয়ে পরলো গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।
আকাশ মেঘলা।অল্প রোদের উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছে কিন্তু মেঘেরা সূর্যকে আড়াল করে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত।চারিদিকে বয়ে চলছে ঠান্ডা বাতাস।
এমন মনোমুগ্ধকর আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে নিস্তব্ধ কোনো রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে বেশ লাগে।এই মুহূর্তে নাফিয়ারও ইচ্ছে হচ্ছে কোনো এক জনমানবহীন প্রকৃতিতে ঘেরা জায়গায় গিয়ে নিরবে হেঁটে চলতে,মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে,প্রকৃতির নির্মল বাতাস নিজের মাঝে টেনে নিতে।কিন্তু এ মুহূর্তে তো তা সম্ভব নয় এটি ভেবে মন খারাপ করে জানালা হতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
গাড়ি চালানোর মাঝেই নাফিয়ার দিকে এক-দুবার তাকায় আফিম।মেয়েটির মন ভালো না তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তার।কিন্তু কি কারণে মন খারাপ সেটিই ভাবনার বিষয়।
আফিমের এসব ভাবার মাঝেই হুট করে তার কানে আসে নাফিয়ার উত্তেজিত কন্ঠে উচ্চারিত শব্দ ত্রয়।
-আফিম আফিম আফিম!
হটাৎ নাফিয়ার এভাবে তাকে ডেকে ওঠার কারণ বোধগম্য হয় না আফিমের।সাথে সাথে গাড়ির স্পিড কমিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকায় সে।চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে,
-Anything happened?Are you alright?[কিছু হয়েছে?তুমি ঠিক আছো?]
আফিমের প্রশ্নদ্বয় উপেক্ষা করে নাফিয়া তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
-গাড়ি থামান না প্লিজ! দ্রুত।
নাফিয়ার কথা শুনে আর কোনো বাক্য ব্যায় করে না আফিম।ফুটপাতের পাশে পার্কিং এর জায়গা দেখতে পেয়েই গাড়ি পার্ক করে ফেলে।
আফিম গাড়ি থামাতেই নাফিয়া ঠোঁটে হাসি ও চোখ-মুখে উত্তেজনার ছাপ ফেলে বলে ওঠে,
-ঐযে ঐ দিকে দেখুন,ঘোড়ার গাড়ি।আমার ঘোড়ার গাড়ি খুব খুব খুব পছন্দ।উঠতে চাই।জীবনে কখনো উঠার সুযোগ হয়নি।
শেষ বাক্যটি বলার সময় ঠোঁট উল্টে মন খারাপের সুরে বলে ওঠে নাফিয়া।আফিম চরম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।এইটুকু কথা বলতে এতো ঢং!মেজাজ খারাপ হওয়ায় আফিম বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-আজও সুযোগ পাবা না।
কথাটি বলেই আবারও গাড়ি স্টার্ট দিতে যায় আফিম।কিন্তু তাকে থামাবার উদ্দেশ্যে নাফিয়া বলে ওঠে,
-প্লিজ একটু সুযোগ দিন।এর বদৌলতে আমি বাড়তি কিছু কাজ করে দিবো।যা বলবেন তাই ই করবো।
-যা বলবো তা ই করবা?
-হ্যাঁ।
-ভেবে বলছো?
-হ্যাঁ।
নাফিয়াকে নতুন একভাবে জ্বালানোর বুদ্ধি মাথায় আসতেই মেয়েটির কথায় সম্মতি দিয়ে বাঁকা হেসে আফিম বলে ওঠে,
-Done.
ছেলেটির বাঁকা হাসি মোটেও সুবিধার নয় তা জানে নাফিয়া।সামনে তার জন্য যে ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে তাও বুঝে নিয়েছে সে।কিন্তু এখনের জন্য ঘোড়ার গাড়িতে ওঠাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
!!
চালকের সাথে কথা বলে নিয়ে নাফিয়ার আগে নিজেই ঘোড়ার গাড়িতে ওঠে আফিম।উঠে নিজের ডান হাত এগিয়ে দেয় নাফিয়ার দিকে।ঘোড়ার গাড়িগুলো একটু উঁচু হওয়ায় উঠার সময় একটি সাহায্যের হাত প্রয়োজন হয়।আফিমের এভাবে তার দিকে হাত এগিয়ে দেওয়াটা ভালো লাগে নাফিয়ার।সম্পর্কে সে আফিমের কিছুই হয় না।আর না আফিম তার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানে।তবুও একটি অপরিচিত মেয়ের প্রয়োজনের দিকে যে ছেলেটা চাওয়ার আগেই নিজে থেকে খেয়াল রাখে সে ছেলেটা কতটুকু যত্নশীল তা বুঝতে বাকি রয় না নাফিয়ার।সে ঠোঁটে মৃদু মুগ্ধতার হাসি ফুটিয়ে আফিমের হাতে হাত রেখে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বসে।
গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে।ঘোড়া দৌড়ে চলছে সেই সাথে গাড়িটাও মৃদু দুলছে।ঘোড়ার পায়ের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।রাস্তায় যানজট নেই।বলতে গেলে খুব বেশি মানুষ নেই রাস্তায়।এমন সুন্দর আবহাওয়া ও পরিবেশে ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরার অনুভূতি টা ভীষণ সুন্দর।খুশিতে নাফিয়ার ঠোঁট থেকে হাসি সরছেই না।সে তার ডানে-বামের দৃশ্য এবং এ সময় টা উপভোগে ব্যস্ত।আর আফিম তার ঠোঁটের হাসি ও চোখমুখে ফুটে ওঠা খুশির ঝলক দেখতে ব্যস্ত।
হটাৎ একটি শব্দ কানে এসে লাগায় নিজের সামনে বরাবর তাকায় নাফিয়া।দেখতে পায়,গাড়ি চালক চাবুক দ্বারা ঘোড়াদ্বয়ের উপর প্রহার করছে।এ দৃশ্য দেখতেই ঠোঁটের হাসি গায়েব হয়ে যায় তার।এতোদিন এ নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে অবগত ছিলো না সে।সেভাবে কোনো দিন খেয়ালই করা হয়নি তার।
চালক বেশ ক’বার উভয় ঘোড়ার গায়েই চাবুক দ্বারা প্রহার করে চলছে।এমন দৃশ্য দেখে আফিমের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নাফিয়া।নিজের সামনে বরাবর দৃষ্টি স্থির রেখেই আফিমকে বলে ওঠে,
-আফিম প্লিজ গাড়ি থামাতে বলুন।
হটাৎ নাফিয়ার কি হলো তা বুঝতে সক্ষম হলো না আফিম।কিন্তু প্রশ্ন করবার জন্যে এটি সঠিক সময় বলে মনে হলো না তার।তাই সে বিনা প্রশ্নে চালককে গাড়ি থামানোর আদেশ দেয়।
গাড়ি থামতেই উভয়ই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।তারা নেমে দাঁড়াতেই চালক বলে ওঠে,
-কি হইছে স্যার?কইলেন আধা ঘণ্টা ঘুরবেন।এহন তো ১০ মিনিটও হইলো না।নাইমা গেলেন ক্যান?
উত্তরে আফিমের কিছু বলার আগেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-নিজেদের একটু প্রশ্ন করুন তো,আপনারা কি আদৌও মানুষ?
নাফিয়ার এমন প্রশ্নের পেছনের কারণ না বুঝায় চালকের ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ পরে।সে উল্টো প্রশ্ন করে ওঠে,
-ক্যান আপা?এডি কইতাছেন ক্যান?
-একটা নির্বাক প্রাণীর উপর এভাবে অত্যাচার করতে হাত কাঁপে না আপনাদের?
-এগো না মারলে এরা দৌড়াইবো না।এরা না দৌড়াইলে আমগো ব্যবসা চলবো ক্যামনে?আপনেরা মজা মাইরা ঘুরবেন ক্যামনে?
-এমন ব্যবসা আপনারা করবেনই কেনো যাতে নিরীহ প্রাণীগুলোর এতো কষ্ট পেতে হয়?আর মজা মেরে ঘুরা?এর জন্য এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে আমার যে একটা নিরীহ,নির্বাক প্রাণীর কষ্টের কারন হয়েছি আমি।
-কষ্ট দেওনের আপ্নে দেখছেন ডাই কি আপা?কয়দিন আগে পত্রিকায় আইছিলো এক চালক এমনে গাড়ি চালাইছে যে ঘোড়ার মুখ দিয়া রক্ত বাইর হইতাছিলো কিন্তু তাও ব্যাডায় চালানো থামায় নাই।ঘোড়ারে মাইরাই যাইতাছিলো।আর অন্য ব্যবসাইরা তো ঘোড়া গো খাইতেও দেয় না।এক একটা হুগনা ঘোড়া।গায় বল পায় না দৌড়ানোর তারপরেও ব্যাডারা পিডাইয়া হেগো দিয়ে দৌড়ায়।আমরা এইরাম কাম করি না।আমগো ঘোড়ার স্বাস্থ্য দেহেন।কি মোডাসোডা! ওগো দিয়া ব্যবসা করি আবার ওগো খাওয়াই ও।
লোকটার কথা শুনে চোখে পানি চলে আসে নাফিয়ার।মানুষ হলেও এদের মনুষ্যত্ব টা কোথায়?মানবতা কোথায়?দয়ামায়া কিছুই কি এদের নেই? এই প্রাণী গুলোর বাকশক্তি নেই।তারা নিজেদের কষ্ট মুখে প্রকাশ করতে ব্যর্থ কিন্তু এর মানে এমন তো না যে এরা ব্যথা পায় না।এদের তো আল্লাহ ব্যথার অনুভূতি দিয়েছেন,এদেরও আমাদের মানুষের মতোই ব্যাথার অনুভূতি হয়।
নিজের সামনে দাঁড়ানো লোকটার সাথে আর কোনো কথা বলার রুচি হলো না নাফিয়ার।চোখে ঘৃণা নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-নিজেকে মানুষ মনে করলে দয়া করে নিরীহ প্রাণীদের কষ্ট দেওয়া ব্যবসা থেকে বিরত থাকুন।
কথাখানা বলে আর দাঁড়ায় না নাফিয়া।সোজা উল্টো দিকে ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করে সে।
এতোটা সময় নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলো আফিম।নাফিয়ার মতো করে এভাবে সে কখনো ভেবে দেখেনি।আগেও ১-২ বার ঘোড়ার গাড়িতে চড়েছিলো সে কিন্তু ভাবেনি যে তার এই কয়েক মিনিটের ভালোলাগা টার জন্য একটি পশুর কতটুকু কষ্ট করতে হচ্ছে।যেখানে রিকশা,ভ্যান, প্রাইভেট কার থেকে শুরু করে এতো এতো যানবাহন আছে সেখানে এসব নির্বাক,নিরীহ প্রাণীর কষ্টের কারণ হওয়ার বিলাসিতা টা বাদ দিলেই হয়।
নাফিয়ার চিন্তাভাবনা এবং চালকের সাথে প্রতিবাদী স্বরে কথা বলা সবটাতেই মুগ্ধ আফিম।মেয়েটার বয়স কম হলেও ভয়,জড়তা এবং মুখ বুঝে অন্যায় সয়ে নেওয়া,সব কিছুতে অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার মতো গুন নাফিয়ার মধ্যে নেই।মেয়েটা সাহসী।
মন খারাপ করে হাঁটছে নাফিয়া,তার পাশেই হাঁটছে আফিম।মেয়েটার গোমড়া মুখ ভালো লাগছে না আফিমের।কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই আফিমের চোখ যায় তার সামনেই দাঁড়ানো একজন লোকের দিকে।হাতে সুগার ক্যান্ডি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি।ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আফিমের।যত টুকু সে চিনেছে নাফিয়াকে তাতে ধারণা করা যায় মেয়েটির সুগার ক্যান্ডি পছন্দ।
হাঁটতে হাঁটতে আফিমের গাড়ির কাছে এসে পৌঁছাতেই আফিমের দিকে তাকায় নাফিয়া।তাকাতেই দেখতে পায় ছেলেটার হাতে দু দু’টো সুগার ক্যান্ডি।একটি ক্যান্ডি খুলে তাতে সবে এক কামড় বসিয়েছে আফিম।নাফিয়া প্রথমে চমকে গেলেও এবার ঠোঁটে বড়সড় হাসি টেনে বলে ওঠে,
-সুগার ক্যান্ডি!!!
আফিম ভাব নিয়ে ব্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
-তো?
-আমার অনেকককক পছন্দ।
-তো?
নাফিয়া ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-আমাকে একটি দিন না প্লিজ।
-নো।
-প্লিজ?
আফিম দ্বিগুণ ভাব দেখিয়ে বলে উঠলো,
-নো।
আফিমের কথাটি বলতে না বলতেই নাফিয়া ছোঁ মেরে একটি একটি কটন ক্যান্ডি নিজের হাতে নিয়ে নেয়।নাফিয়া এমন কিছু করবে তার জন্য আফিম মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।নাফিয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই মেয়েটি ফিক করে হেসে দেয়।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে বলে ওঠে,
-সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বেঁকা করতে হয়।
-ওহ তাই!
কথাটি বলে আফিম নাফিয়ার দিকে তেড়ে আসার জন্যে অগ্রসর হতেই নাফিয়া দৌড়াতে আরম্ভ করে।ফুটপাতে তেমন মানুষ নেই দেখে দৌড়াতে অসুবিধে হলো না।নাফিয়ার পিছু পিছু আফিমও তাকে ধরার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়।উভয়ের ঠোঁটেই হাসি দৃশ্যমান।
ঠিক এমন সময়েই মেঘ গর্জে উঠে।ঝড়ের মতো বাতাস প্রবাহিত হয়ে বৃষ্টি আসার বার্তা দিচ্ছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে।
আফিম-নাফিয়া উভয়ই দৌড় থামিয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।বৃষ্টি নামার বার্তা পেয়ে ঠোঁটের হাসিটি আরো বৃদ্ধি পেলো নাফিয়ার।সে ঠোঁটে হাসি নিয়ে আফিমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-আফিম,বৃষ্টি নামবে!আমি বৃষ্টিতে ভিজবো।
বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে দু-হাত প্রসারিত করে নাফিয়া।আফিম তাকিয়ে আছে নাফিয়ার দিকে।তার ঠোঁটেও হাসি।কিন্তু হুট করে আফিমের মনে পরে সেদিন ওয়াশরুমে হওয়া ঘটনাটি।বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েটির জামা তার গায়ের সাথে লেপ্টে তাকে আবেদনময়ী করে তুলবে।তার শরীরের প্রতিটি ভাজ দৃশ্যমান হবে।নাফিয়ার এমন আবেদনময়ী রুপ একজন ব্যাতীত অন্য কোনো পুরুষের দেখার অধিকার নেই,মোটেও নেই।যদিও এই রাস্তায় মানুষ তেমন নেই তবুও এক-দুজন যারা আছে তারাও বা কেনো দেখবে?
এসব ভাবতেই আর সময় অপচয় করে না আফিম।নাফিয়ার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে গাড়ির দিকে অগ্রসর হয় সে।
চলবে।