#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১০,পর্বঃ১০ {বর্ধিতাংশ}
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১০
মনোযোগসহকারে ল্যাপটপে নিজের কাজ করাতে ব্যস্ত আফিম।আগামী ক’দিনের মাঝেই নতুন কিছু ড্রেস কালেকশন নিজের শোরুমে লঞ্চ করার জন্যে কাজের চাপটা বেশিই।
নাফিয়া আফিমের ক্যাবিনে পাতানো সোফার এক কোণে বসে আফিমের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো আলাদা করে রাখছে যাতে এখন আফিমের যেসব ফাইলস প্রয়োজন হবে তা যেনো সহজেই সে পেয়ে যায়।নয়তো খুঁজতে গেলে সময় অপচয় হবে।এ কাজের মাঝেই ঘড়ির দিকে চোখ যায় নাফিয়ার।দু’টো বেজে আরো কিছু সময় পাড় হয়ে গিয়েছে। সকালে সেই ৮ টার পর থেকে গ্রীন টি ছাড়া আর কিছুই খায়নি আফিম।কাজ করছে তো করছেই।
নাফিয়া ফাইলগুলো রেখে আফিমের কাছে এগিয়ে যেয়ে বলে ওঠে,
-আপনার খিদে পায়নি?
আফিম ল্যাপটপে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই বলে ওঠে,
-সময় নেই।
আফিমের এমন উত্তরে মেজাজ খারাপ হয় নাফিয়ার।একটু খেয়ে নিতে কতটুকুই বা সময় লাগে?নাফিয়া আবারও বলে ওঠে,
-একটু খেয়ে নিন।খেলে কাজে স্পীড আসবে নাহলে তো শরীরে দূর্বল লাগায় কাজ ভালো করে করতে পারবেন না।
নাফিয়ার কথায় তার দিকে এক পলক তাকায় আফিম।আবারও দৃষ্টি সরিয়ে কাজে মনোনিবেশ করে গম্ভীর কণ্ঠে নাফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
-খাইয়ে দেও।
আফিমের কথা কানে আসতেই অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় নাফিয়া।এখন আফিমকে তার খাইয়ে দিতে হবে!এতো বড় এক বুইড়া ছেলেরে একদিন তার গোসল করায়ে দিতে হইছে আজ আবার খাইয়েও দিতে হবে।নাফিয়া নিজেই মনে মনে প্রশ্ন করে ওঠে,
“আমি কি কোনো বিজনেসম্যানের আন্ডারে কাজ করতেছি নাকি কোনো বাচ্চা পালার জব নিছি?”
নাফিয়াকে নিজের জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আফিম বলে ওঠে,
-শুনতে পাওনি?
নিজের আজাইরা সব চিন্তার মাঝেই আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসে নাফিয়ার।কথাটি শুনতেই দ্রুত পদে খাবার প্রস্তুত করতে অগ্রসর হয় সে।
২ মিনিটে প্লেটে খাবার বেড়ে আফিমের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় নাফিয়া।কেমন জানি একটা অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে তার।একটু কেমন লজ্জাও লাগছে আবার কেউকে খাইয়ে দেওয়ার অভ্যাস টাও তার নেই।নাফিয়াকে আবারও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয় আফিম।বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে নাফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাল হা করে সে।এতে নাফিয়ার জন্য আফিমকে খাওয়ানোটা সহজ হয়ে যায়।নাফিয়াও দেরি না করে এক লোকমা খাবার আফিমের মুখে পুরে দেয়।আফিমও খাবার মুখে নিয়ে আবারও কাজে মন দেয়।
আফিমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নাফিয়া তাকে খাইয়ে দিচ্ছে।প্রথমে বিরক্ত হলেও এখন ভালো লাগছে নাফিয়ার।হাতে একটু একটু আফিমের ঠোঁটের স্পর্শ লাগছে আর এতে নাফিয়ার হৃদয়ের ধুকপুকানিও বাড়ছে সমান তালে।আবার আফিমের ঠোঁটের আশেপাশে খাবার লাগার সাথে সাথেই তা আলতো হাতে যত্ন করে মুছে দিচ্ছে নাফিয়া।
কাজ করার মাঝেই আফিম অনুভব করছে নাফিয়ার হাতের যত্নমাখা স্পর্শ।মেয়েটা কতোটা যত্নে খাইয়ে দিচ্ছে তাকে!এক মুহূর্তের জন্য আফিমের নিজের ছোট বেলা মনে পড়ে গেলো।মনে পড়লো তার মাও তাকে এভাবেই স্বযত্নে খাইয়ে দিতো।মুহূর্তেই বুকের মাঝে দহন উঁকি দিলো,হাত থেমে গেলো আফিমের।গলা দিয়ে খাবার টাও আর নামতে চাইছে না।নিজেকে সামলানোর উদ্দেশ্যে নিজের চেয়ার ছেড়ে সোজা উঠে গিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো সে।
খাওয়ার মাঝেই আফিমের এভাবে উঠে যাওয়ায় অবাক হলো নাফিয়া।হবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে আফিমের যাওয়ার পথে।মনে একটিই প্রশ্ন, “হটাৎ করে হলো টা কি ছেলেটার?”
!!
পুতুলে নিজের ডিজাইন করা জামা ঝুলিয়ে তা ভালোভাবে পরখ করে নিচ্ছে আফিম।কোথায় আর কি কি সংযোজন বা বিয়োজন করা প্রয়োজন তাই ই দেখছে সে।এতোদিনের করা ল্যাপটপের ডিজাইনগুলোর বাস্তব রুপ দেওয়ার সময় চলে এসেছে।হাতে খুব বেশি সময় নেই।আফিম চাইছে নতুন কালেকশন দ্রুতই লঞ্চ করতে।এজন্য দিন রাত খাটছে ছেলেটা।কর্মীদের উপর সব ফেলে রেখে নিজে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা লোক আফিম নয়।সে নিজে শ্রম দিতে পছন্দ করে।এতে করে মার্কেটে যখন তার করা ডিজাইনের জামাগুলোই দ্রুত স্টোক আউট হয়ে যায় তখনের প্রাপ্ত প্রশান্তিটা আফিমের জন্যে অতুলনীয়।
আফিমের পেছন পেছনই ঘুরছে নাফিয়া।যতটুকু পারছে আফিমের সাহায্য করার চেষ্টা করছে।আশেপাশে আরও কর্মীরাও আছে।তারাও নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।
নাফিয়ার বারংবার আফিমের ক্লান্ত মুখের দিকে চোখ যাচ্ছে।খারাপ লাগছে তার।ছেলেটা দুপুর ৩ টা অব্দি ল্যাপটপে কাজ করে ৩ঃ৩০ এর দিকে স্টাফদের সাথে মিটিং এ বসেছিলো।মিটিং শেষ করেই পুতুলে কাপড় ঝুলিয়ে তাতে ডিজাইনের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে।সেই থেকে এখন রাত ১০ঃ৪৫ মিনিট হয়ে গিয়েছে।এক দন্ড কোথাও বসেওনি ছেলেটা।সেই সাথে কফি ছাড়া আর কিছু খায়ওনি।
এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার মৃদু কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আফিম, ১১ টা প্রায় বেজে গিয়েছে আর আপনি রোবটের মতো কাজ করছেন।
নাফিয়ার কথায় তার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায় আফিম।শরীরের সাথে সাথে মনটাও ক্লান্ত তার।
এখন একটু শান্তি প্রয়োজন।আফিম নাফিয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলে ওঠে,
-You are right miss.sheikh, i need some break.[তুমি ঠিক বলেছো মিস.শেখ,আমার একটু বিরতি দরকার।]
ক্লান্ত স্বরে কথাটি বলে ড্রাইভারকে কল দেয় আফিম।উদ্দেশ্য,নিজে গৃহে ফিরতে চায় সে।
!!
নিজ গৃহে পৌঁছে নাফিয়াকে তার নিজের কক্ষে যাবার আদেশ দিয়ে নিজেও নিজের কক্ষে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে আফিম।ক্লান্তিতে এতোক্ষণে ঘুমিয়ে যাবার কথা ছিলো তার।কিন্তু ঘুম আসছে না।নিজের মাঝে স্বস্তি পাচ্ছে না আফিম।মনটা কেনোই যেনো অশান্ত হয়ে আছে তার।একটু শান্তি প্রয়োজন। কোথায় মিলবে এ শান্তি?
শান্তির খোঁজে ছটফট করতে থাকা আফিম নিজের অজান্তেই নিজের বিছানা ত্যাগ করে পা বাড়ায় নাফিয়ার কক্ষে যাবার উদ্দেশ্যে।তার মস্তিষ্ক শান্তির সন্ধানে ব্যর্থ হলেও তার মন জানে শান্তির সন্ধান।তাই তো নিজের মনের বাধ্য হয়ে নাফিয়ার কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় সে।কিন্তু নিজের কক্ষের দরজা অব্দি আসতেই দরজায় নক করার শব্দ শুনতে পায় আফিম।এই রাতে তার কক্ষে কে আসতে পাড়ে ভেবে ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে সে।গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“Come”
একটি প্লেটে করে কিছু খাবার হাতে কক্ষে প্রবেশ করে নাফিয়া।আফিমকে দরজার কাছেই দেখবে তা আশা করেছিলো না সে।তাই একটু অবাক হয়।
নাফিয়াকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হয় আফিম।কিন্তু এ অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রেখে নিজের বিছানায় গিয়ে বসতে বসতে সে বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-আমার কক্ষে আসতে তোমার পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।নেক্সট টাইম এভাবে সময় অপচয় করবে না।
আফিমের কথায় নাফিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলে ওঠে,
-আপনি সেই দুপুরের পর থেকে কিছুই খান নাই।একটু খাবেন?
নাফিয়ার কথায় এতোক্ষণে তার হাতে থাকা খাবারের প্লেটটির দিকে চোখ যায় আফিমের।এতো বছরে মাঝেমধ্যে একমাত্র রিয়াদই আফিমের খাওয়া-দাওয়ার দিকে খেয়াল রাখতো।অন্য কারো সময় কোথায় আফিমের খবর নেওয়ার?সবাই ই তো নিজের আখের নিয়ে ব্যস্ত।
এতোগুলো বছরে এই প্রথম আফিম কারো সন্ধান পেলো যে বিনা স্বার্থে আফিমের যত্ন নিচ্ছে।যে যত্ন টা মন থেকে আসছে,কোনো দ্বায়িত্বের চাপে নয়।
মনে নাফিয়ার প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টি হলেও তা প্রকাশ করলো না আফিম।স্বাভাবিক কন্ঠেই সে বলে উঠলো,
-খাওয়াও।
-হু?
-খাইয়ে দেও।
আফিমের এবারের আদেশে আর দেরি করে না নাফিয়া।বিছানায় আফিমের সামনে বরাবর গিয়ে বসে সে।এক লোকমা খাবার আফিমের মুখে দিতেই আফিম খেতে খেতে প্রশ্ন করে ওঠে,
-তুমি খেয়েছো?
-উহু।
-খাও।
-এইতো একটু পর।
কথাটি বলে দ্বিতীয় লোকমা আফিমের মুখের সামনে ধরতেই আফিম বাঁধা দেয়।বলে ওঠে,
-৫০-৫০ ডিল।তুমি হাফ খাবা আমি হাফ খাবো।মিন্স আমি এক লোকমা তুমি এক লোকমা।
-আমি পরে খেয়ে নিবোনে।
-আদেশ মানতে বাধ্য তুমি মিস.শেখ।
অতঃপর অপারগ হয়ে ভাগাভাগি করেই খেয়ে নেয় তারা।খাবার শেষে ওয়াশরুমে চলে যায় নাফিয়া হাত ধুতে।নাফিয়া যেতেই ঠোঁটে মুগ্ধতার হাসি ফুটে ওঠে আফিমের।মেয়েটার শুধু চেহারাটাই মায়াময় না।বরং মেয়েটা পুরোটাই মায়াবিনী।যার মায়ার জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে আফিম।
আফিমের এসব ভাবনার মাঝেই নাফিয়া ওয়াশরুম হতে হাত ধুয়ে ভিজে হাত নিয়ে কক্ষে এসে আফিমের ঠোঁট ও আশপাশের এঁটো পরিস্কার করে আবারও ওয়াশরুম চলে যায়।আফিম অপলক মেয়েটির যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।সেই ছোট থাকতে মা খাইয়ে দিয়ে এভাবে মুখ মুছে দিতো, মা মারা যাবার পর কখনো কেউ খাইয়ে দেয়নি আফিমকে।কেউ ছিলোই তো না খাওয়ানোর জন্যে।বড় হবার পর থেকে চামচ দিয়ে খাওয়া শুরু হতেই সবসময় টিস্যু দিয়েই মুখ মুছে আসছে সে।এতো বছর পর বারংবার মায়ের স্মৃতি মনে পড়ায় মন আবারও অশান্ত হয়ে পড়েছে আফিমের।হৃদয়ে এক অদ্ভুত কষ্টরা উঁকিঝুঁকি দিতে আরম্ভ করেছে।
এরই মধ্যে নাফিয়া ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এসেছে।আফিমের কাছে গিয়ে ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটিয়ে সে বলে ওঠে,
-ঘুমিয়ে পড়ুন আফিম,শুভ রাত্রি।
কথাটি বলে নিজ কক্ষে যাবার উদ্দেশ্যে এক কদম অগ্রসর হতেই আফিমের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হয় নাফিয়ার ডান হাতের কব্জি।থেমে যায় সে।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আফিমের দিকে তাকাতেই আফিম বলে ওঠে,
– I need you, Miss. Sheikh.[আমার তোমাকে প্রয়োজন, মিস.শেখ]
চলবে।
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১০ {বর্ধিতাংশ}
“I need you,Miss. Sheikh”
নাফিয়ার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাটি বলে ওঠে আফিম।ছেলেটির চাহনি ও কন্ঠস্বর কোনোটিই স্বাভাবিক ঠেকছে না নাফিয়ার।চোখ-মুখে চিন্তার ছাপ ফেলে সে বসে পড়ে আফিমের সামনে বরাবর।আফিমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠে,
-ঠিক আছেন আফিম?কি হয়েছে?
নাফিয়ার চিন্তিত চাহনির দিকে দৃষ্টি স্থির রাখে আফিম।মেয়েটির করা প্রশ্নের উত্তরে আফিমের হৃদয় বলে উঠলো,
“এক আকাশ সমান বিশাল শূন্যতার মাঝেও একা চাঁদের মতো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মতো সাহস, সামর্থ্য, মনোবল সবটাই আছে আমার।কিন্তু মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে ভারী।এ ক্লান্তি দূর করবার জন্যে একটি ভালোবাসামাখা স্পর্শের বড্ড প্রয়োজন আমার,একটা ভরসার স্থান প্রয়োজন,প্রয়োজন একটু প্রশান্তির।”
হৃদয়ের এ কথাগুলো হৃদয়েই আবদ্ধ রাখে আফিম।তা ঠোঁট অব্দি আসার অনুমতি না দিয়ে সে জিহ্বা দ্বারা নিজের ওষ্ঠ একটু ভিজিয়ে নেয়।অতঃপর শান্ত ভঙ্গিতে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-একটু ঘুমোতে চাই মিস.শেখ।একটু প্রশান্তির ঘুম।দিতে পারবা আমাকে?
আফিমের প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চুপ হয়ে তার চেহারা পানে তাকিয়ে রয় নাফিয়া।ছেলেটার চোখমুখ দেখে ভীষণ মায়া হচ্ছে তার।আফিমের ভেতরে জমানো কষ্টগুলো সম্বন্ধে সে অবগত নয় কিন্তু সে এতোটুকু অনুভব করতে পারছে যে,আফিম ঠিক নেই।ভেতরে ভেতরে ছেলেটা কষ্ট পুষে বেড়াচ্ছে।এমনটি অনুভব হওয়ায় নাফিয়ারও ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগা অনুভব হচ্ছে।তার মন চাইছে কোনো এক জাদু দিয়ে আফিমের সব কষ্ট দূর করে দিতে।অজানা কোনো এক কারণে সে নিজে কেনো যেনো আফিমের কষ্টটা সহ্য করতে পারছে না।
আফিম উক্ত প্রশ্নটি করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয় নাফিয়ার দিকে।নাফিয়া আফিমের প্রশ্নের উত্তরে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে হুট করে নিজের অবস্থান হতে উঠে বিছানার এক কোণে গিয়ে বসে পরে।হটাৎ এভাবে নাফিয়ার স্থান পরিবর্তন করার কারণ বোধগম্য না হওয়ায় তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রয় আফিম।বিছানার কোণে পা মেলে দিয়ে বসে নাফিয়া আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-আমার কোলে মাথা রাখবেন আফিম?আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে হয়তো ঘুম চলে আসবে আপনার।
কথাখানা বলতে দেরি হলেও নাফিয়ার কোলে মাথা পেতে শুতে দেরি হলো না আফিমের।সে নাফিয়ার কোলে মাথা রেখেই চোখজোড়া নেয়।নাফিয়া ধীরে ধীরে আফিমের চুলের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
এবার নিজের মাঝে শান্তি অনুভব করছে আফিম।অনুভব করছে তার চুলের মাঝে বিচরণ করা কোমল হাতের যত্নমাখা স্পর্শ।এতে আফিমের আবারও নিজের মায়ের স্মৃতি মনে পড়ে যায়।ছোট বেলায় তার মাও এভাবেই চুলে হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতো।সুন্দর এসব স্মৃতিগুলো ভেতরে ভেতরে আফিমকে পোড়াচ্ছে ভীষণ।মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো তো সে।
হৃৎপিণ্ডে আবারও যন্ত্রণার আবির্ভাব হতেই সোজা হয়ে শোয়া থেকে বাম দিকে ফিরে শক্ত করে নাফিয়ার কোমর আঁকড়ে ধরে আফিম।নাফিয়ার পেটে মুখ গুঁজে দিয়ে চোখ বুজতেই নিরবে চুপিচুপি আফিমের এক ফোঁটা অশ্রু কণা সমাধিত হয় নাফিয়ার কোলে।
হটাৎ আফিম এভাবে জড়িয়ে ধরায় চমকে যায় নাফিয়া।বড় বড় চোখ করে আফিমের দিকে তাকায় সে।ছেলেটার গরম নিঃশ্বাস সব নিজের পেটে উপর অনুভব করছে নাফিয়া।আবারও সমস্ত শরীরে শিহরণ অনুভব করতে আরম্ভ করেছে সে।হৃৎস্পন্দন ও বাড়তে আরম্ভ করেছে তার।তবুও কষ্ট করে হলেও নিজেকে সামলে নিচ্ছে সে।নিজের থেমে যাওয়া হাতদ্বয় আবারও সচল করে নাফিয়া।ধীরে ধীরে আফিমের মাথায় হাত বুলোতে আরম্ভ করে সে।সময়ের সাথে সাথে পুরোনো স্মৃতিগুলো দ্বারা প্রাপ্ত কষ্টগুলো প্রশমিত হয়ে যায় আফিমের।নাফিয়ার হাতের স্পর্শে ভীষণ আরাম অনুভব করছে সে।ভালোলাগায় ঠোঁটে মৃদু হাসিও ফুটে উঠেছে তার।
আফিম নাফিয়াকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় একই ভাবে শুয়ে থাকায় নাফিয়া ভাবে আফিম হয়তো ঘুমিয়ে গেছে।সে ছেলেটার মাথায় হাত বুলোনোর পাশাপাশি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।ধীরে ধীরে মাথা হতে হাত সরিয়ে আফিমের ডান গাল আলতো করে স্পর্শ করে নাফিয়া।আস্তে আস্তে আফিমের গালের খোচাখোচা দাঁড়িতে হাত বুলোতে থাকে সে।আফিমকে এখন যেনো কোনো এক ৫-৬ বছরের বাচ্চার মতো লাগছে নাফিয়ার কাছে।কেমন বাচ্চাদের মতো তার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা!দেখতেও কতোটা নিস্পাপ লাগছে তাকে!
হুট করেই আফিমকে আদর করতে মন চাইছে নাফিয়ার।ইচ্ছে করছে তার কোলে শুয়ে থাকা এই বুড়ো-বাচ্চাটার গালে একটা পাপ্পি দিতে।নিজের মনে উদয় হওয়া এই ইচ্ছেটাকে আর দমিয়ে রাখলো না নাফিয়া।একটু ঝুঁকে আফিমের গালে আলতো করে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিলো সে।প্রায় সাথে সাথেই আফিমের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।ছেলেটা নাফিয়ার পেটে মৃদু নাক ঘষে বলে ওঠে,
-রাত-বিরেতে একটা অসহায় ছেলের সুযোগ নিচ্ছো মিস.শেখ?
আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসতেই চমকে যায় নাফিয়া।ছেলেটা এখনো ঘুমায়নি বুঝতে পেরেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে।সেই সাথে পেটে আফিমের নাক ও খোচাখোচা দাঁড়ির স্পর্শ পেয়ে মৃদু শিহরিতও হচ্ছে সে।
নাফিয়ার কোনো উত্তর না পেয়ে আফিম বেশ ভালোই বুঝতে পারছে যে মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে আছে।ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে সে নাফিয়াকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জামার উপর থেকেই পেটে চুমু এঁকে দেয় আফিম।শিহরণে সাথে সাথে হাত মুঠ করে চোখ বুজে নেয় নাফিয়া।আফিম মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-Good night, Miss.Sheikh.
কথাখানা বলেই হাই তুলে একদম চুপ হয়ে যায় আফিম।মনে হচ্ছে নিদ্রা-ঘোরে বিলীন হয়েছে ছেলেটি।কিন্তু এবার আর কিছু করার সাহস করে না নাফিয়া।লজ্জায় এখনো লাল হয়ে আছে সে।হৃদয়ও ধুকপুক করে চলছে।নিজের পেছনে একটি বালিশ ঠিক করে রেখে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে নিজের চোখজোড়া বুজে নেয় সে।
!!
অফিসে নিজ ক্যাবিনে বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে আফিম।নাফিয়া ব্যস্ত আফিমের জন্যে গ্রীন টি তৈরিতে।উভয়েই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।পরিবেশ নিরব।এমন নিরাবতার অবসান ঘটিয়ে হুট করে একজনের আগমন ঘটলো আফিমের ক্যাবিনে।কেমন যেনো তড়িৎ গতিতে এক রূপসী এসে প্রবেশ করলো আফিমের ক্যাবিনে।ক্যাবিনে প্রবেশ করেই উচ্চ স্বরে মেয়েটি ডেকে উঠলো আফিমকে।
“আফিম”
কাজের মাঝেই হটাৎ নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনে নিজের সামনে বরাবর তাকায় আফিম।নিজের ভার্সিটি জীবনের এক বান্ধবীর দেখা পেয়ে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে।মেয়েটি ঠোঁটে হাসি নিয়েই এগিয়ে যায় আফিমের কাছে।আফিম উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলার জন্যে মুখ হা করতেই যাবে তার আগেই মেয়েটি গিয়ে জড়িয়ে ধরে আফিমকে।এর জন্যে আফিম মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।এ বিষয়টি একটু বাড়াবাড়িই মনে হলো আফিমের কিন্তু ভদ্রতার জন্য সে কিছু বললো না।মেয়েটি জড়িয়ে ধরলেও আফিম তার হাত দ্বারা মেয়েটিকে স্পর্শ করলো না বরং চুপচাপ সোজা দাঁড়িয়ে রইলো।
ক্যাবিনের এক কোণে দাঁড়িয়ে আফিম ও অপরিচিতা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে নাফিয়া।বুকের বাম পাশটায় কেমন জানি একটা সূক্ষ্ম জ্বলন অনুভব করছে সে।কেমন জানি একটা অদ্ভুত কষ্ট অনুভব হচ্ছে তার।এ জ্বলন কষ্টের সাথে আগে থেকে পরিচিত নয় নাফিয়া।এ অনুভূতিটি নতুন।একদমই নতুন।
চলবে।