#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১১,১২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১১
অপরিচিতা মেয়েটি আসার পর থেকে আফিমের ঠোঁট থেকে যেনো এক সেকেন্ডের জন্যেই আলতো হাসিটি সরছে না।আসবার পর থেকেই সোফায় বসে একের পর এক গল্পে মেতে আছে মেয়েটি।আফিমও সায় দিচ্ছে তাকে।যদিও আফিম খুব একটা কথা বলছে না শুধু ঠোঁটে হাসিটিই টেনে রেখেছে।
রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাফিয়া।মেয়েটিকে ভালো ঠেকছে না তার।মোটেও না।ইচ্ছে করছে এখনই এ অপরিচিতাকে অফিস থেকে বের করে দিতে।কিন্তু এ তো তার সাধ্যে নেই।আবার আফিমের ব্যবহারেও বিরক্ত সে।অপরিচিতা মেয়েটি আসার আগে তো আফিম কাজ নিয়ে বহু ব্যস্ত হয়ে ছিলো।তাহলে মেয়েটি আসতেই কাজ ভুলে গল্পে মেতেছে কেনো ছেলেটা?এখন কি সময় অপচয় হচ্ছে না?নাকি তার কাজের থেকেও এই মেয়েটা তার জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
গল্প চলার মাঝেই হটাৎ নাফিয়ার দিকে চোখ যায় অপরিচিতা মেয়েটির।সে আফিমকে উদ্দেশ্য করে নাফিয়ার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আফিম,ও মেয়েটা কে?
এবার নাফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আফিম।ঠোঁটে সেই আলতো হাসি নিয়েই নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-মিস.শেখ এদিকে এসো।
আফিমের আদেশ পেয়ে তাদের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় নাফিয়া।অনিচ্ছা স্বত্তেও ঠোঁটে একটু হাসি টেনে রেখেছে সে।
নাফিয়া কাছে এসে দাঁড়াতেই আফিম তার বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-ও হচ্ছে নাফিয়া।সারাদিন আমার সাথে থেকে আমার কাজে সাহায্য করে।
-মানে তোর পি.এ?
এ প্রশ্নের উত্তরে আফিমের মন বলে ওঠে,
“উহু,ব্যক্তিগত সহকারী নয় বরং আমার একান্তই ব্যক্তিগত একজন।”
এবারও মনের কথাটি নিজের হৃদমাঝারেই আবদ্ধ রাখলো আফিম।উত্তরে কিছু না বলে প্রশ্নটি উপেক্ষা করে সে।নাফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলে ওঠে,
-আর মিস.শেখ,ও হচ্ছে আমার ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ের বান্ধবী,অন্তরা।
অন্তরা নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু সৌজন্যমূলক একটি হাসি দেয়।নাফিয়াও একই কাজ করে।
!!
প্রয়োজনীয় কিছু ফাইল গুছানোর ফাঁকে ফাঁকে আফিম-অন্তরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে নাফিয়া।মেয়েটির প্রতিটি কাজের দিকে নাফিয়ার নজর রয়েছে।আসার পর থেকেই যে মেয়েটা গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে তা শেষ হবার নামই নিচ্ছে না।অবশ্য গুনে গুনে ২ বছর পর বিদেশ হতে বাংলাদেশে ফিরেছে মেয়েটা।বিদেশে গিয়েছিলো হায়ার স্টাডিজের জন্যে।এখন দেশে ফিরে পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করছে।গল্প তো আর কম জমেনি তার।
আফিম ল্যাপটপে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সাথে ঠোঁট হাসি ঝুলিয়ে ও মাঝে মাঝে মাথা নাড়িয়ে এমন ভাব নিচ্ছে যেনো মেয়েটার গল্পেই তার সমস্ত মনোযোগ,ল্যাপটপটা তো হুদাই নিয়ে বসে আছে।কথা বলার মাঝেই ক্ষণে ক্ষণে হাসতে হাসতে আফিমের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে অন্তরা।এ বিষয়টিতে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে নাফিয়া।কিন্তু খুব একটা রাগ লাগছে না তার।কারণ আফিম মেয়েটিকে খুব একটা নিজের কাছে আসার অনুমতি দিচ্ছে না।নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।না মেয়েটির দিকে অপ্রয়োজনে তাকাচ্ছে আর না একবারের জন্যেও আফিমের হাতের স্পর্শ লেগেছে মেয়েটির গায়ে।
কথার এক পর্যায়ে এসে অন্তরা আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-দোস্ত,আমার না একটা জিনিস খুব বেমানান লাগছেরে!
ল্যাপটপে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই আফিম বলে ওঠে,
-কোনটা?
-এইযে তোর পি.এ একটা মেয়ে!না মানে ভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে তো তুই পুরোপুরি শুদ্ধ পুরুষ ছিলি।মেয়ে মানেই যেনো যম।
এ কথায় মৃদু হাসে আফিম।বলে ওঠে,
-মেয়ে মানুষ মানেই মায়া।ব্যাস,মায়ায় জড়াতে চাইনি।
আফিমের কথার উত্তরে দুষ্টু হেসে অন্তরা বলে ওঠে,
-তা তোর পি.এ. কি মেয়ে না? নাকি তার মাঝে মায়া বলতে কিছু নেই?
এমন প্রশ্ন শুনে একটু খারাপ লাগে নাফিয়ার।আসলেই কি তার মাঝে মায়া নেই?মনে এ প্রশ্ন নিয়ে আফিমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় আফিমের উত্তরের আশায়।হয়তো ছেলে টা খুব বেশি কিছু না হলেও শুধু এতোটুকুই বলবে যে,”আছে”।
বান্ধবীর প্রশ্নের উত্তরে মনে মনেই আফিম বলে ওঠে,
“এ মায়া তো সেই সর্বনাশী,ভয়ংকর তীব্র মায়া যে এমন এক পুরুষকে নিজের মায়াজালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে যে পুরুষটিকে শত সুন্দরী রমনী নিজের রুপের জালে আবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো।”
মনের উত্তরখানা ঠোঁট অব্দি আনলো না আফিম।সে নিরবতাটাকেই বেছে নিলো।কিন্তু তার উত্তরের আশায় অপেক্ষেয়মান ছিলো দু দুটো নারী, তাদের উৎসাহী দৃষ্টি পানে একবারো তো তাকালো না আফিম।তাকালে হয়তো দেখতে পেতো কোনো একজনের মনে মেঘ জমছে ক্রমশ।
আফিমের কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত কন্ঠে অন্তরা বলে ওঠে,
-এইজন্য তোর উপর মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয় বুঝলি! চাপা স্বভাইব্বা কোথাকার।
উত্তরে এবারও মৃদু হাসে আফিম।দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নাফিয়া।অভিমান হচ্ছে তার।আফিম কেনো কিছু বললো না।একটা ছোট্ট উত্তর দিলে কি হতো।মানুষ তো বলে নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ। তবে কি অন্তরার কথায় সম্মতি দিয়েছে আফিম?অর্থাৎ তার মাঝে মায়া নেই?তবে আফিম কেনো তাকে কাছে টানে? তাহলে কি সেসব শুধুই মোহ?
এসকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না নাফিয়া।ভালো লাগছে না তার আর এক মুহূর্তও অফিসে থাকতে।এসব ভাবার মাঝেই নাফিয়ার কানে আসে অন্তরার করা একটি প্রশ্ন।
“আফিম,চল না বাইরে কোথাও খাইতে যাই?”
অন্তরার করা প্রশ্নে নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকায় আফিম।দু’টো বাজতে চলছে।বাইরে যাওয়াই যায় ভেবে অন্তরার দিকে সম্মতির ইশারা করে নাফিয়ার দিকে তাকায় আফিম।বলে ওঠে,
-মিস.শেখ চলুন।
প্রায় সাথে সাথেই অন্তরা বলে ওঠে,
-ও আমাদের সাথে যাবে?
ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে আফিম বলে ওঠে,
-হ্যাঁ,কেন?
-সিরিয়াসলি?আমাদের ব্যক্তিগত কোনো কথা থাকতে পারে না নাকি?সবজায়গায় ও কেন যাবে?
এবার আফিম একটু বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-ওর কাজই আমার ছায়া হয়ে থাকা।যে শুধু মাত্র রাতের আঁধারে আমার সঙ্গ ছাড়ে।
আফিমের কথার উত্তরে একটু দুষ্টু কন্ঠে অন্তরা বলে ওঠে,
-তা ওয়াশরুমেও সাথে যায় না ছায়া?
অন্তরার প্রশ্নে চোখগুলো বড়বড় করে আফিমের দিকে তাকায় নাফিয়া।তার মনে পড়ে যায় গোসলে সাহায্য করার জন্যে আফিমের সাথে ওয়াশরুমে যাওয়া ও বাদ পড়েনি তার।নাফিয়ার বড়বড় চাহনির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে আফিম। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে ওঠে,
-কথাটা মন্দ বলিসনি।এখন থেকে নাহয় ওয়াশরুমেও আমার সাথেই যাবে।
কথাখানা বলে আবারও তাকায় আফিম নাফিয়ার দিকে।অন্তরার অগোচরে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে আফিম।নাফিয়ার চোখ যেনো আর একটুর জন্যে চোখের কোটর থেকে বেড়িয়ে আসেনি।দৃষ্টি অস্বাভাবিক রকমের বড় করে আফিমের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
আফিমের উত্তরে হেসে ওঠে অন্তরা।হাসতে হাসতেই বলে ওঠে,
-তোর এই ফাজিল রুপ তো আগে কখনো দেখিনি।আমাদের আফিম যে শুধু শান্তশিষ্টই নয় বরং লেজবিশিষ্টও তা আজ জানলাম।
অন্তরার এ কথার উত্তরে আফিম আর কিছু বলে না। শুধু একটু হেসে বলে ওঠে,
-চল বেরোই।
কথাটি বলেই নিজের ক্যাবিনের দরজার দিকে অগ্রসর হতে যায় আফিম।তখনই তাকে থামিয়ে দিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আফিম,আমি কি এখন বাসায় যেতে পারি প্লিজ? আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
আফিমের কিছু বলার আগেই অন্তরা বলে ওঠে,
-আফিম? নাম ধরে ডাকছো তুমি?
নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে উক্ত প্রশ্ন টি করে আফিমের দিকে তাকায় অন্তরা।অবাক দৃষ্টি ও স্বরে আফিমকে বলে ওঠে,
-কি হচ্ছে আফিম বল তো?তোর পি.এ একে তো মেয়ে,তার উপর বয়স দেখে মনে হয় এইচএসসি পাস ও করে নাই।আবার তোকে নাম ধরে ডাকছে! কি হচ্ছে এসব?
অন্তরার কথাগুলো ভীষণ অপমানজনক লাগছে নাফিয়ার।নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ কিছু মনে হচ্ছে তার।চোখজোড়াও জ্বলজ্বল করছে।
রাগে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে আফিম।কঠিন কিছু জবাব দিতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু সে জানে অন্তরার জায়গা থেকে অন্তরা পুরোপুরি ভুল নয় কারণ মেয়েটা সবকিছু সমন্ধে অবগত নয়।তাই নিজেকে সামলিয়ে অন্তরার কথার কোনো জবাব না দিয়ে নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে আফিম বলে ওঠে,
-মিস.শেখ,তোমাকে রিয়াদ বাসা অব্দি ড্রপ করে দিবে।আমি বলে যাচ্ছি।
কথাটি বলেই নিজের ক্যাবিন হতে বেরিয়ে যায় আফিম।পেছন পেছন অন্তরাও বেরিয়ে যায়।আর নাফিয়া মেঝের দিকে নিজের পানিতে টলমল করা দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখে।
!!
রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে আফিম ও অন্তরা।মন টিকছে না আফিমের।ইচ্ছে করছে এক্ষুনি নিজের মিস.শেখের কাছে ছুটে যেতে।আসার সময় মেয়েটার জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখদুটো না দেখলেও অনুভব করতে পারছিলো সে।রিয়াদকেও সে বলে এসেছে সাবধানে যেনো মেয়েটিকে বাসা অব্দি পৌঁছে দেয়।কিন্তু তাও মেয়েটার জন্য চিন্তে হচ্ছে তার।সাথে সাথে নিজের মুঠোফোনে রিয়াদের নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে তুলে নেয় আফিম।ফোনের ওপাশ হতে রিয়াদের কন্ঠস্বর কানে আসতেই আফিম বলে ওঠে,
-মিস.শেখ কোথায়?
-বাসায় স্যার।ম্যামকে পৌঁছে দিয়ে এসেছি সবে।
-গুড।
কথাটি বলে কল কাটে আফিম।একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় অন্তরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আফিম মৃদু ব্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
-কি হইছে?
-আসল কাহিনি টা ক এবার!
-কি কাহিনি?
-নাফিয়া কি হয় তোর?
প্রশ্নটি শুনে নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে আফিম।ঠোঁটে একটু বাঁকা হাসি টেনে বলে ওঠে,
-ইট’স অ্যা সিক্রেট।
-মানে?
-পড়ে বুঝবি।
-না না না প্লিজ দোস্ত এহনই ক।দেখ এতোটুক তো বুঝতেছি যে এই মেয়ে তোর কাছে অন্য সবার মতো না।বরং বিশেষ কেউ।
-গুড।
আফিমের উত্তরে রাগ উঠে অন্তরার।ছেলেটা কেন ঠিক মতো কিছু বলছে তাকে!রেগে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রয় সে।এতে আফিম পাত্তা না দিয়ে ওয়েটার বয়কে ডেকে কিছু খাবার অর্ডার দেয়।সব খাবারই অন্তরার ফেভারিট।ব্যাস,রাগ ভ্যানিশ তার।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে ওঠে,
-থ্যাংকস দোস্ত।
অন্তরার এমন বাচ্চামোতে একটু হাসে আফিম।কিন্তু তা পুরোপুরি মন থেকে না।মনে বারংবার নাফিয়ার চিন্তা আসছে।
আফিমকে চুপ থাকতে দেখে অন্তরা বলে ওঠে,
-মেয়েটা হয়তো ভালোবাসতে আরম্ভ করেছে তোকে।
অন্তরার কথায় তার দিকে তাকায় আফিম।অন্তরা আবার বলে ওঠে,
-ও জ্বলছিলো আমাকে তোর কাছাকাছি দেখে।কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে তা ঠিকই নোটিস করেছি আমি।সন্দেহ হচ্ছিলো আমার তোদের দু’টোকে দেখে।কোনো বস্-স্টাফের সম্পর্কের মতো না তোদের টা।প্লিজ সব কাহিনি টা খুলে বল না?
-সময় আসলে জানবি।না ও আমার পি.এ. আর না প্রেমিকা। There is a secret.[একটা রহস্য আছে]
কথাটি বলে বাঁকা হাসে আফিম।মনে মনে একটু খুশিও হচ্ছে সে।এটি ভেবে যে নাফিয়ার অনুভূতি জ্বলন অব্দি এসে ঠেকেছে।
চলবে।
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১২
এক মেঘবালিকা ছাঁদের কোণে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মেঘলা আকাশ পানে।পড়ন্ত বিকেল,সন্ধ্যে নামবে নামবে ভাব।যেখানে সূর্যের বিদায়ে আকাশে আলো শূন্যতা দেখা দিতে আরম্ভ করেছে সেখানে মেঘেরা আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কালো আবরণে আকাশকে আবৃত করে নিতে।সেই আঁধারে ছেয়ে যাওয়া আকাশ পানেই দৃষ্টি আবদ্ধ নাফিয়ার।মনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমানেরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বারংবার।বিনা কারণেই এক পুরুষের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে নাফিয়ার মন।সেই পুরুষের বিলম্বে মনে অভিমান জমছে ক্রমশ।
বক্ষ মাঝারে এক সূক্ষ্ম কষ্ট অনুভব করছে নাফিয়া।মানুষটা কেনো বাড়ি ফিরছে না? এখনো কি ব্যস্ত সে সেই মানবীর সাথে?নাফিয়ার কথা কি একবারও মনে পড়ছে না মানুষটার?টানা ১ মাস ঘুমের সময়টা বাদে প্রতিটি মুহূর্ত তো দু’জনে একসাথে কাটিয়েছে তাও কি ঐ মানুষটার অভ্যেসে পরিণত হয়নি নাফিয়া?তাকে ছাড়া নাফিয়া যেমন শূন্য শূন্য অনুভব করছে তেমনই কি অনুভূতি হচ্ছে না ঐ মানুষটারও?হলে অবশ্যই এতোক্ষণে সে মানুষটা বাড়ি ফিরতো।কিন্তু কই,ফেরেনি তো সে।হয়তো পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গ তাকে নাফিয়ার অনুপস্থিতির শূন্যতা ভুলিয়ে দিয়েছে।
এসব ভাবতেই চোখের কোণ জ্বলজ্বল করে ওঠে নাফিয়ার।টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পরে বাম আঁখির কোণ বেয়ে।মাত্র এক মাসের পরিচয়ে একটা মানুষের প্রতি তৈরি হওয়া অভিমান এতোটা তীব্র হতে পারে জানা ছিলো না নাফিয়ার।নিজের এমন আবেগে নিজেই বিরক্ত সে।কেনো আফিমের কার্যকলাপ এতোটা প্রভাবিত করছে তাকে?কিই বা হয় সে আফিমের?কেনো এসব অভিমান?
নাফিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই প্রচন্ড বেগে বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে।বাতাসের বেগে উড়ছে নাফিয়ার ঘন লম্বা চুল।এলোমেলো হয়ে উড়ছে তার পড়নের কাপড় টাও।ছাঁদে লাগানো ছোট্ট ছোট্ট হলদে আলোতে নাফিয়ার এ রূপ যেনো যেকোনো যুবকের মনে ঝড় তুলতে সক্ষম।মেয়েটা আনমনে চেয়ে আছে আকাশ পানে।বৃষ্টির অপেক্ষায় অপেক্ষেয়মান তার হৃদয়।খুব করে এ আসন্ন বৃষ্টিতে তার বৃষ্টি বিলাসের সঙ্গী হিসেবে আফিমের সঙ্গ চাইছে তার হৃদয়।চাইছে ছেলেটা তার সাথেই বৃষ্টি বিলাস করুক,কোনো পরনারীর সঙ্গে নয়।এমন কোনো এক ঝড়ের রাতেই তো আফিমের জীবনে এসেছিলো সে।আজ আবারও এক ঝড়-বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যেতে আফিম আসবে কি তার শূন্যতা দূর করতে?
মনে মনে এসবই আওড়াচ্ছে নাফিয়া।বাতাসের বেগে তার শরীরের ওরনা উড়ে যে এক যুবকের নাক-মুখে আছড়ে পরেছে সেদিকে বিন্দু পরিমাণ খেয়াল তার নেই।ছেলেটা ওরনা সরিয়ে নিজের সামনে বরাবর তাকাতেই দেখতে পায় এক হৃদহরণ করা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।যেখানে এক রমনী আনমনে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে আকাশ পানে আর বাতাসের তীব্র বেগে উড়ছে তার এলোমেলো ঘন লম্বা কেশ।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় আফিম।নাফিয়ার কাছে গিয়ে পেছন থেকেই এক হাত এগিয়ে মেয়েটির পেটের উপর রেখে আলতো করে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে।হটাৎ কারো স্পর্শে কেঁপে ওঠে নাফিয়া।কিন্তু পেছনে ঘুরে মানুষটির চেহারা দেখার প্রয়োজন হলো না তার।কারণ এ স্পর্শ,শক্তপোক্ত বক্ষের ছোঁয়া ও ছেলেটির গায়ের সুঘ্রাণই যথেষ্ট নাফিয়ার এ মানুষটিকে চেনার জন্যে।
আফিম নাফিয়ার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলে ওঠে,
-এমন খারাপ আবহাওয়ায় ছাঁদে কি করছো?
আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসে নাফিয়ার।কিন্তু উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে হলো না তার।নিজেকে আফিমের বাহুবন্ধন হতে শান্তভাবে মুক্ত করে স্বাভাবিক কন্ঠে সে বলে ওঠে,
-একা থাকতে চাই।
বাতাসের শব্দে নাফিয়ার কথাগুলো ঠিকঠাক শুনলো না আফিম।কিন্তু মেয়েটার ব্যবহার কেমন যেনো অস্বাভাবিক ঠেকছে তার কাছে।আফিম ব্রু দ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-Are you okay Miss. Sheikh?[তুমি ঠিক আছো মিস.শেখ?]
নাফিয়া উত্তরে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আফিম।বুঝতে চেষ্টা করছে মেয়েটার নিরবতায় লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত অনুভূতি গুলো।
এদিকে বৃষ্টি না হয়েই বাতাস প্রবাহের বেগ কমে গিয়েছে অনেকটা।হয়তো আবারও প্রবল বেগে বাতাস ছেড়ে বৃষ্টি নামার পূর্বের নিরবতা বিরাজ করছে এখন।
আফিম কিছুটা সময় নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই মেয়েটার হাত আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিজের একদম কাছে টেনে নেয়।অন্য হাত দ্বারা গাল স্পর্শ করে বলে ওঠে,
-What happened Miss. Sheikh?[কি হয়েছে মিস.শেখ?]
আফিমের করা প্রশ্নটি কাটা গায়ে নুনের ছিটার ন্যায় ঠেকছে নাফিয়ার।এতোটা সময় কই ছিলো এই চিন্তা গুলো?এতোক্ষণ বান্ধবীর সাথে ঘুরা শেষ করে এসে এখন দরদ দেখানো হচ্ছে তাকে!
রাগে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো এই কিশোরী।এক ঝটকায় আফিমকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো সে।ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আফিমের দিকে তাকিয়ে অনতিবিলম্বে ছেলেটির শার্টের কলার শক্ত করে মুঠোবন্দি করে নিলো।ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠলো,
-খুব চিন্তা হচ্ছে এখন আমার জন্য?সকাল থেকে কই ছিলো এই চিন্তা?সারাদিন তো বান্ধবীকে নিয়ে পড়ে ছিলেন, একবারও কি তাকিয়েছিলেন আমার দিকে?তাকান নাই।এখন যখন বান্ধবী চলে গেছে তখন খুব দরদ উথলায়ে পড়ছে আমার উপর তাই না?
কিশোরীর ক্রোধান্বিত অগ্নির ন্যায় তীব্র তেজি এই রূপ দেখে বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে আফিম।কি ঝাঁজালো এ কণ্ঠস্বর!চোখে তার ফুটে উঠেছে কঠোরতার উপস্থিতি।
আফিমকে নিরব থাকতে দেখে রাগ বাড়লো নাফিয়ার।অভিমানগুলো বেসামাল হলো তার।ক্ষিপ্ত স্বরে আবারও বলে ওঠলো,
-কি করছিলেন এতোক্ষণ ঐ মেয়ের সাথে?এতো কিসের কথা?এতোক্ষণ ঐ মেয়ের সাথে কাটিয়ে এসেছেন আর এসে দরদ দেখাচ্ছেন আমাকে?এতোই যদি আমার চিন্তা হতো তাহলে অন্তত খোঁজ নিতেন আমি খেয়েছি কিনা!একা বাসায় এতোটা সময় কি করছি!যদি এক বিন্দুও আমার শূন্যতা অনুভব করতেন তাহলে এতো দেরি করে বাড়ি ফিরতেন না।
কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।তার স্বরে কাঠিন্যতা কমে গিয়েছে।বড্ড কষ্টেই শেষ কথাখানা বলে সে।অভিমান, রাগগুলো কান্না হয়ে বেরোতে চাইছে,চোখ টলমল করছে।সেইসাথে কন্ঠস্বরও স্বাভাবিক নেই তার।একটু সময় নিয়ে আবারও নিজেকে স্বাভাবিক করে নাফিয়া।পূণরায় চোখে কাঠিন্য ও কন্ঠে ঝাঁজালো ভাব এনে বলে ওঠে,
-আমাকে অবলা নারী ভাব্বেন না আফিম।ভাব্বেন না যে আমি মুখ বুঁজে সয়ে যাওয়া টাইপের মেয়ে।এমনটা ভেবে থাকলে বড্ড ভুল ভাবছেন।আমি কখনো মেনে নেবো না আপনাকে অন্য কোনো নারীর আশেপাশে।এক বিন্দুও মানবো না।
চোখমুখে ক্রোধ বজায়ে রেখেই কথাগুলো বলে নাফিয়া।ক্রোধের বসে কি এক সাংঘাতিক কথা সে বলে বসেছে সেদিকে বিন্দু পরিমাণ খেয়াল নেই তার।তার ও আফিমের নামহীন অনুভূতিপূর্ণ এ সম্পর্কে কি আদৌও এতোটা অধিকার ফলানো সাজে?আফিমকে শুধু মাত্র নিজের ভাব্বার অধিকার কে দিয়েছে তাকে?তবে কি তার হৃদয় আফিমের অনুমতি না নিয়েই ছেলেটিকে নিজের একান্তই ব্যক্তিগত সম্পদ ভেবে নিয়েছে?
নাফিয়ার কথাগুলো শেষ হতেই অবাধ্য এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।পড়ে বললে ভুল হবে অবশ্য।কারণ সেই এক বিন্দু অশ্রু অতিব যত্নে নিজের হাতে নেয় আফিম।
এতোটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো সে মেয়েটির দিকে।তার অবাক হওয়ার পরিমাণ যেনো আসমান ছুঁই ছুঁই।আশা করেনি এ কিশোরী এতোটা অভিমানীনি,এতোটা তেজি,এতোটা আবেগপ্রবণ।আশা এও করেনি যে,এই কিশোরীর হৃদয়ে নিজের জন্য এতোটা জায়গা বানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে সে।হাতে নেওয়া অভিমানীনির অভিমানী অশ্রু কণার দিকে তাকিয়ে আছে আফিম।এ অশ্রু কণাই সাক্ষ্য দিচ্ছে এই কিশোরীর অভিমানের তীব্রতা।বুকে শীতল প্রশান্তিময় বাতাস বইছে আফিমের।তার ইচ্ছে করছে চেঁচিয়ে ঐ বিশাল আকাশ পানে তাকিয়ে বলতে,
“ঐ আকাশের মতো একা নই আমি,শূন্য নই,নিঃস্ব নই।আমারও আছে একজন,একান্তই আমার।”
আফিমের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরা হাতের মুঠো ঢিলে করে আস্তে করে ছেড়ে দেয় তাকে নাফিয়া।ধীর কদমে এগিয়ে গিয়ে ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় সে।নিস্তব্ধ পরিবেশ,চারিপাশে বিরাজ করছে নিরবতা।কিন্তু শো শো বাতাস বয়ে চলায় শব্দ কানে লাগছে।আফিমকে কথাগুলো বলেও মন শান্ত হয়নি নাফিয়ার।না রাগ কমেছে আর না অভিমান।মন ভরা বিষাদ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি কামনা করে চলছে সে।বৃষ্টিতে ভিজলে হয়তো মনের বিষাদ খানিকটা কমবে!
হটাৎ কানের কাছে কারো শীতল হাতের স্পর্শে শিহরিত হয়ে চোখ বুজে নেয় মেঘবিলাসী।আফিম আলতো হাতে কানের কাছ থেকে নাফিয়ার চুল সরিয়ে সেথায় ঠোঁট লাগিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-এ বাড়ির সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে মিস.শেখ।তাই বাড়িতে থাকা কারো খবর নিতে কল করতে হয় না আমার।জানি দুপুরে খাওনি।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই ছাঁদে এসেছো।সেই দুপুর থেকে এখনো ছাঁদে।
কথাগুলো বলে সে দু’হাত রাখে নাফিয়ার পেটে।শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মেয়েটিকে নিজের সাথে।এতে মৃদু কেঁপে ওঠে নাফিয়া।চোখজোড়া বুঁজেই রেখেছে সে।আফিমও চোখবুঁজে নাফিয়ার কানের কাছে নাক ঘষতে ঘষতে মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে,
-অন্তরা রেস্টুরেন্টে খাবার শেষ করেই বিদায় নিয়েছিলো।ইচ্ছে ছিলো তখনই বাসায় ফিরবো কিন্তু রিয়াদের কল পেয়ে সোজা অফিসে যেতে হয়েছে।কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় সেসব শেষ করে বাসায় ফিরেছি।
আফিমের কথাগুলো শুনে ঠোঁটে একটু হাসি ফুটে উঠেছে নাফিয়ার।অভিমানী মেঘেদের মাঝে সূর্যের কিরণ উঁকি দিচ্ছে।ছেলেটা দূরে থেকেও সে কি করেছে না করেছে সেসবের দিকে দৃষ্টি রেখেছে।আবার ‘অন্তরা’ নামক মেয়েটার সাথেও ছিলো না এতোটা সময় বরং কাজে ব্যস্ত ছিলো।আর সব থেকে বড় কথা,আফিমের মতো একজন সফল ব্যবসায়ী তার মতো বলতে গেলে একটা নিঃস্ব মেয়েকে জবাবদিহি করছে!এতেই বুঝে যায় নাফিয়া যে,সে কতোটা বিশেষ এই মানুষটার কাছে।ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি টেনে নিজের পেটের উপর অবস্থিত আফিমের হাতজোড়ার উপর হাত রাখে সে।ইচ্ছে করে আরেকটু মিশে যায় আফিমের সাথে।এতোক্ষণের রাগ,অভিমান,অভিযোগে ক্লান্ত তার হৃদয়।আফিমের বক্ষে মাথা ঠেকিয়ে এবার একটু বিশ্রাম চাইছে।এতে আফিমের খোচাখোচা দাঁড়ি তার গলায় বিঁধছে এবং এক অদ্ভুত শিহরণে শিহরিত হচ্ছে সে।
নাফিয়ার ইতিবাচক সাড়া পেয়ে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আফিমের ঠোঁটে।সে ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁট দ্বারা নাফিয়ার গলায় স্পর্শ আঁকতে আরম্ভ করে।মেয়েটি শিহরণে খামচে ধরে তার হাত।এতে আফিমের ঠোঁটের স্পর্শ আরো গাঢ় হয়।নাফিয়ার খামচির জোরও বৃদ্ধি পায়।
এমন মুহূর্তে হটাৎই একটি প্রশ্ন মাথায় আসে নাফিয়ার।সে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আমার সমন্ধে কিছু না জেনেই কি করে নিজের এতোটা কাছে টেনে নিচ্ছেন আফিম?আপনার কি জানতে ইচ্ছে হয় না আমার পরিচয়?
নাফিয়ার প্রশ্ন কানে আসতেই আফিমের ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে।
চলবে।