আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১৫,১৬

0
1130

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১৫,১৬
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৫

মন খারাপের সময়গুলো দীর্ঘ হয় খুব।তাই তো দীর্ঘ এক দিন পাড় করছে নাফিয়া।সময় যেনো যাচ্ছেই না আজ।কোনো কাজে মন নেই তার।অন্য মনস্ক হয়েই গ্রিন টি বানাচ্ছে সে।এরই মাঝে হটাৎ করে কোনো একজনের হাতের মুঠোয় বন্দী হয় তার ডান হাতটি।ফলে ধ্যান ভাঙে তার।অবাক নয়নে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় ব্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফিম।দু’জনের চোখাচোখি হতেই আফিম বলে ওঠে,
-কাপে গমর পানি না ঢেলে নিজের হাতের উপরই ঢালতে যাচ্ছিলে।মন কোথায়?
আফিমের কথায় হুঁশ হয় নাফিয়ার।কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে সামলে নেয় সে।অতঃপর নিচু স্বরে বলে ওঠে,
-আমার একটু সাহায্য লাগবে আফিম।করবেন?
হটাৎ নাফিয়ার এমন প্রশ্নের পেছনের কারণটা বোধগম্য হয় না আফিমের।’মেয়েটার সাহায্যের প্রয়োজন মনে হলো কেনো?’মনে এ প্রশ্ন উদয় হতেই আফিম জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কি সাহায্য?
আফিমের প্রশ্ন শুনে ক’সেকেন্ড সময় নেয় নাফিয়া।অতঃপর নিচু স্বরেই বলে ওঠে,
-শীগ্রই আমার এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্ট বের হবে।আর তারপরই শুরু হবে কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি।ভর্তি হতে তো টাকা লাগবে।
কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।একটু সময় নিয়ে বলে ওঠে,
-আমি কিছু একটা করতে চাই,আফিম।টাকা কামাতে চাই।
নাফিয়ার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে আফিম।স্বাভাবিকভাবেই বলে ওঠে,
-তুমি যেহেতু আমার আন্ডারে কাজ করছো সেহেতু তোমার সব দ্বায়িত্ব তো আমি নিচ্ছি।কলেজেও আমিই ভর্তি করিয়ে দিবো সময় হলে।
নাফিয়া বিনয়ী হেসে আফিমের কথার বিরোধিতা করে বলে ওঠে,
-আমি চাইছি না আমার পড়াশোনার দ্বায়িত্বটাও আপনি নেন।
কথাটা বলে থামে নাফিয়া।তাকায় আফিমের দিকে।ছেলেটার চোখে ভেসে ওঠা প্রশ্ন বুঝতে বিলম্ব হয় না তার।একটি ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাফিয়া বলতে আরম্ভ করে,
-আমার পুরো একটা পৃথিবী হলো আমার মাম্মি।জানেন আফিম,এই মানুষটা আমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।আর এই মানুষটারই স্বপ্ন আমি খুব শিক্ষিত হবো।মানে উচ্চ শিক্ষিত।তার এ স্বপ্নের পেছনের কারণ টা কি জানেন?কারণ সে চায় আমি যেনো একটা স্বাধীন জীবন পাই।যে জীবনে আমার সম্মান থাকবে,আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে,মানুষের কাছে আমার মতামতের মূল্য থাকবে,সবার কাছে আমার গ্রহণ যোগ্যতা থাকবে,আমাকে কারো উপর নির্ভরশীল হতে হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।তার এই স্বপ্ন খুব যত্নে নিজের হৃদয়ে পুষে নিয়ে বেরাচ্ছি আমি।আর আমি চাই না এ স্বপ্ন পূরণের পথে কারো দয়ার ছাপ পরুক বা এও বলতে পারেন যে আমি চাইনা আমার স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রেও অন্য কারো সাহায্য নিতে।আমার মাম্মির স্বপ্ন আমি নিজের যোগ্যতায় পূরণ করতে চাই আফিম।
কথাগুলো বলে থামে নাফিয়া।মনে মনে ভীষণ গর্ববোধ করছে আফিম নিজের মায়াবীনির প্রতি।বয়সে ছোট হলেও মেয়েটার মাঝে কতোটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে!নিজে কিছু করে দেখানোর স্পৃহা রয়েছে।রয়েছে এক বুক সাহস আর নিজের মাম্মির স্বপ্ন পূরণের দৃঢ় ইচ্ছা।আরও একবার মুগ্ধ হয় আফিম।
নিজের কথাগুলো শেষ করবার পর চোখ তুলে আফিমের চোখের দিকে তাকায় নাফিয়া।ঠোঁটে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে সে বলে ওঠে,
-আপনি অনেক অনেক সাহায্য না চাইতেই করছেন আমায়,আফিম।আপনার কাছে আজ অব্দি একটি বারও নিজের প্রয়োজনের কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার।না চাইতেই নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন, ৩ বেলার খাবার দিচ্ছেন,নতুন আলমারি ভরা কাপড় কিনে দিয়েছেন,আমার সব প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখার জন্য একজন ফিমেল হেল্পার নিযুক্ত করে রেখেছেন।আর কতো?আর কতো করবেন এক অপরিচিতার জন্যে?
এ কথাগুলো বলে থামে নাফিয়া।মনে মনেই বলে ওঠে,
“নামহীন,অপ্রকাশিত ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছেন আমায়।মাত্র ক’টা দিনেই আমার জীবনে সব রঙ ভরে দিয়েছেন।অজানা সব সুখের সন্ধান দিয়েছেন।এতো এতো কিছুর ঋণ শোধ করার সামর্থ্য আমার নেই,আফিম।আর ঋণী হতে চাই না।”
নাফিয়ার কথাগুলোর উত্তরে আফিম মনে মনেই বলে ওঠে,
“অপরিচিতা নও তুমি।তুমি তো একান্তই আমার মায়াবীনি।যেগুলোকে তুমি দয়া ভাবছো তা হক তোমার।কারণ আমার সবকিছুরই অর্ধেক অংশের অধিকারীনি তুমি,আমার অর্ধাঙ্গীনি।”
দু’জনেই তাদের হৃদয়ের কথা হৃদয়েই গোপন করে রাখে।যেনো প্রকাশ করা বারণ।নাফিয়ার কথাগুলোর উত্তরে আফিম ভাবুক কন্ঠে বলে ওঠে,
-You are right Miss. Sheikh. আমি আর কতো করবো!তোমারও উচিৎ কিছু করা।
কথাটি বলে নাফিয়ার দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে আফিম।নাফিয়া আফিমের কথায় চিন্তিত হয়ে পড়ে।সে আবার কি করবে!আর কথাখানা শেষ করে আফিমের তার দিকে এভাবে এগিয়ে আসা টা ঠিক সুবিধের ঠেকছে না নাফিয়ার।সে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয় আফিমের দিকে।আফিম নাফিয়ার কাছে এসে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নাফিয়ার কোমর।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-না মানে আমি এত্তো কিছু করি তোমার জন্য সো তোমার উচিৎ আমাকে ভালো কিছু গিফট করা।
আফিমের কথার উত্তরে নাফিয়ার বোকার মতো বলে ওঠে,
-টাকা তো নেই এখন আমার কাছে।
উত্তরে আফিম তার দুষ্টু হাসিটি বজায়ে রেখেই বলে ওঠে,
-টাকা ছাড়াও আরো অনেকভাবে গিফট দেওয়া যায়,মিস.শেখ।
-যেমন?
-যেমন তুমি চাইলে আমার ঠোঁটে চুমু দিতে পারো, বডি ম্যাসাজ করে দিতে পারো আরো অনেক কিছু চাইলেই করতে পারো।
কথাগুলো বলা শেষে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে আফিম।অবাক হওয়ার শীর্ষে অবস্থান করছে নাফিয়া।কিসব ছিঃ মার্কা কথা বলছে ছেলেটা!চোখমুখ কুঁচকে আফিমকে ঠেলে দূরে সরিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-ছিঃ!দিন দিন নির্লজ্জ হচ্ছেন আফিম।
নাফিয়ার কান্ডে ঠোঁট চেপে আলতো হাসে আফিম।মনে মনে বলে ওঠে,
“নির্লজ্জতার তো এখনো কিছু দেখোই নাই মিসেস. লজ্জাবতী”

!!
রেজাল্টের চিন্তা,টাকার চিন্তা,নতুন কলেজের চিন্তা সব মিলিয়ে মনে শান্তি পাচ্ছে না নাফিয়া।এতোদিন যেনো কোনো এক রঙিন দুনিয়ায় বসবাস ছিলো তার।নতুন সব অনুভূতিতে ঘেরা নতুন এক প্রশান্তিতে ডুবে ছিলো সে।ভুলে বসেছিলো বাস্তবতা কখনোই এতো সুন্দর হয় না।তাকে পরিশ্রম করতে হবে।অনেক অনেক পরিশ্রম!যাতে সে নিজের যোগ্যতায় নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তব রূপ দিতে পারে।
আজ সকালে যখন ঐ মহিলা ও বাচ্চাটিকে দেখেছিলো সে তখন থেকেই হৃদয়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা অনুভব করছে সে।তখন থেকেই সেই রঙিন দুনিয়া থেকে বেরিয়ে বাস্তবতায় ফিরেছে নাফিয়া।ভাবছে নিজের পরবর্তী সব পদক্ষেপগুলোকে নিয়ে।কিভাবে একটু একটু করে এগিয়ে যাবে নিজের স্বপ্ন ছুঁতে সেই পরিকল্পনা করে যাচ্ছে সে।
নিজের প্রয়োজনের কথা আফিমকে তো বলেছে সে কিন্তু ছেলেটা কি করে সহায়তা করবে তাকে?এখনো এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্টই বের হয়নি তার।এতো কম পড়াশোনায় কোনো চাকরি পাওয়া আদৌতেও কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব নয়।আর চাকরি পেলেও তাতে কি আর সম্মান মিলবে?
আফিমের ক্যাবিনে থাকা সাদা সোফাটিতে বসে ব্যস্ত নগরী পানে চেয়ে থেকে এসব চিন্তেতেই বিভোর হয়ে আছে নাফিয়া।হটাৎ ক্যাবিনে কারো আগমনে ধ্যান ভাঙে তার।
“May i come in,sir?”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্নখানা করে ওঠে রিয়াদ।গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাইল হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলোতে ব্যস্ত ছিলো আফিম।রিয়াদের প্রশ্নে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে তার।ফাইল হতে দৃষ্টি সরিয়ে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে,
“Come”
অনুমতি পেয়ে কক্ষে প্রবেশ করে রিয়াদ।ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে ওঠে,
-স্যার চারজন বাচ্চা পেয়েছি।তারা ক্লাস ২ তে পড়ে।আর তাদের বাবা-মা তাদের জন্য বাসায় পড়ানোর টিচার খুঁজছিলো তাই তাদের প্যারেন্টসদের সাথে কথা বলে আমি সব ঠিক করে এসেছি।আপনি অনুমতি দিলে তারা এ মাস থেকেই পড়া শুরু করবে।
রিয়াদের কথা শুনে ভীষণ রকমের অবাক হয় নাফিয়া।আফিমের মতো এতো ব্যস্ত মানুষ যার কিনা এতো বড় বিজনেস সে কেনো টিউশনি করাতে যাবে!মনে এ প্রশ্ন উদয় হওয়ার ক’সেকেন্ডের মাঝেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।কৃতজ্ঞতায় ভরা দুনয়নে তাকায় আফিমের দিকে।
ছেলেটা রিয়াদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।আর নাফিয়া ব্যস্ত এই মানুষটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকাতে।

চলবে।

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৬

“এই ব্রিজটাতেই আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো!”
ঠোঁটে হাসি টেনে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কথাখানা বলে ওঠে নাফিয়া।তার পাশেই কদমে কদম মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে সম্মতি দেয় আফিম। ব্রীজের পাশ ঘেঁষে নিরব,নিস্তব্ধ পরিবেশে হাঁটছে দু’জন মানব-মানবী।নীচে জলরাশী আর আকাশে মস্ত বড় চাঁদ,আছে মেঘেদেরও উপস্থিতি।বয়ে চলছে মৃদু বাতাসেরা।উড়ছে কিশোরীর কোমর অব্দি এলোমেলো খোলা লম্বা চুল।তা নজর কাড়ছে আফিমের।সৌন্দর্য এমনই একটা জিনিস যা যেকেউকে আকর্ষিত করতে সক্ষম।আর লোকমুখে শোনা যায় পুরুষেরা নাকি সৌন্দর্যের পূজারী।কিন্তু সত্য টা হচ্ছে,প্রতিটি মানুষই সৌন্দর্যের পূজারী।সৌন্দর্য সবাই পছন্দ করে।এখন প্রশ্ন জাগে সৌন্দর্য টা আসলে কি?সৌন্দর্য বিষয়টা আপেক্ষিক।আবার সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম।যেমন কারো চোখে লম্বা কেশী নারী সুন্দর আবার কারো কাছে ছোট চুলই সুন্দর।কারো কাছে লম্বা পুরুষ সুন্দর আবার কারো কাছে উচ্চতা কমওয়ালা পুরুষই সুন্দর।কেউ কেউ ফর্সা বর্ণে মুগ্ধতা খুঁজে পায়।আবার কেউ কেউ শ্যামবর্ণায় মায়া খুঁজে পায়।আবার কেউ কেউ কৃষ্ণ বর্ণে টান খুঁজে পায়।মূলকথা,পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই সুন্দর কিন্তু সবাই সবার চোখে সুন্দর না।যার চোখ যেটায় মুগ্ধতা খুঁজে পায় তার চোখে সেটিই সুন্দর।
আফিমের চোখে তার পাশে ধীর কদমে হাঁটতে থাকা এই কিশোরীই সুন্দর।হয়তো সে এই কিশোরীর গুনে মুগ্ধ দেখেই কিশোরীর অতি সাধারণ রূপও তার কাছে অসাধারণ সুন্দর মনে হয়।পূর্ণিমা চাঁদের আলোতে নাফিয়ার চুলগুলোকে এভাবে উড়তে দেখাটা যেনো পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যের মাঝে একটি।চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে আফিমের।অপলক তাকিয়ে আছে সে এ দৃশ্য পানে।
নাফিয়ার ব্যস্ত আনমনে হেঁটে চলায়।মনে অনেক অনেক কথা জমেছে তার।না বললে যেনো পেট ফেটে মরেই যাবে সে।তাইজন্যে হাঁটার মাঝেই আফিমের দিকে তাকিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
“আফিম,আমাদের প্রথম দেখার পর আজ ১ মাস ২৯ তম দিনে আপনাকে কেনো আবারও এই ব্রীজে আমাকে নিয়ে আসার বায়না ধরেছিলাম জানেন?”
নাফিয়ার প্রশ্ন কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতেই ধ্যান ভাঙে আফিমের।মেয়েটির চুল হতে দৃষ্টি সরিয়ে তার চোখ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আফিম।স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কেনো?
-কারণ আজ ভরা পূর্ণিমা,আকাশে অল্প-স্বল্প মেঘেদের উপস্থিতি আর এই সুন্দর পরিবেশে আপনাকে নিজের সমন্ধে অনেক কিছু জানানোর ইচ্ছা হচ্ছিল।
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসে আফিম।বলে ওঠে,
-ইচ্ছে হচ্ছিল!এখন আর ইচ্ছে টা নেই?
-আছে তো,শুনবেন?
মেয়েটির করা প্রশ্নে ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়েই চোখের ইশারায় সম্মতি দেয় আফিম।
আফিমের অনুমতি পেয়ে ঠোঁটের হাসিটা দীর্ঘ করে নাফিয়া।হাঁটা থামিয়ে ব্রীজের কিনারায় গিয়ে দাড়িয়ে পরে সে।দৃষ্টি আবদ্ধ করে নেয় উন্মুক্ত আকাশ পানে।একটা লম্বা শ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে বলতে আরম্ভ করে,
-মাম্মি বলে আমি নাকি মেঘবালিকা।মানে মেঘের কন্যা।কেনো এমনটা বলে জানেন?কারণ আমি যেদিন ধরনীর বুকে আসি অর্থাৎ যেদিন আমার জন্ম হয়েছিলো সেদিন নাকি সারাদিন বৃষ্টি ছিলো।মানে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো আরকি।আর যখন ভূমিষ্ট হই তখন নাকি বৃষ্টির বেগ ছিলো প্রবল,মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠছিলো পৃথিবী।মা আমাকে জন্ম দিতে গিয়েই মৃত্যুবরণ করেন।মাম্মি বলে সেদিন মা মরা এক দুঃখীনির জন্ম হয়েছিলো বলেই প্রকৃতি বৃষ্টির মাধ্যমে নিজের দুঃখ প্রকাশ করেছিলো।কিন্তু আমি মনে করি না যে আমি দুঃখী।কারণ আমি মা হারিয়েছিলাম বটে কিন্তু আল্লাহ আমাকে মাম্মি রূপে একজন মা দান করেছিলেন।মাম্মি আসলে আমার খালামনি হোন কিন্তু আমার জন্য তিনিই আমার মা।কারণ সেই জন্মের প্রথম দিন থেকে মাম্মিই আমার মা হওয়ার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন।আমার বয়স ৬ বছর হওয়া অব্দি আমার বাবা বেঁচে ছিলেন।তিনি মা মারা যাবার পরও আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।মাম্মি বলে বাবা নাকি মাকে খুব ভালোবাসতেন।সেজন্যেই দ্বিতীয় কারো কথা আর ভাবতে পারননি নিজের জীবনে।আমি জন্মের পর থেকেই মাম্মি আর খালুর সাথে থাকতাম।বাবা ও দাদা নিজেদের বাসায় একসাথে থাকতেন।আর প্রতিদিন নাকি বাবা এসে আমাকে দেখে যেতেন।আমার ভালো মতো কোনো স্মৃতিই মনে নেই তখনের।খুব ছোট ছিলাম তো তাই।কিন্তু মাম্মি বলে ৬ বছরে এমন নাকি একটা দিনও যায়নি যেদিন বাবা আমাকে দেখতে মাম্মির বাসায় আসেন্নি।বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আমার সব খচর তিনিই বহন করতেন।আল্লাহর রহমতে টাকার অভাব ছিলো না আমার বাবার।তারপর যখন আমার বয়স ৬ তখন একদিন বাবা ও দাদা একসাথে কোথায়ও যাচ্ছিলেন আর রাস্তাতেই এক দূর্ঘটনার স্বীকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।তাকায় না আফিমের দিকে।কিন্তু না তাকিয়েও সে বুঝতে পারছে আফিম মনোযোগী শ্রোতা।শুনছে তাকে, আগ্রহ নিয়েই শুনছে।একটু ঢোক গিলে নাফিয়া আবারও বলতে আরম্ভ করে,
-বাবা যেদিন মারা যান সেদিনও নাকি বৃষ্টি হয়েছিলো খুব।একদম আমার মায়ের মৃত্যুর দিনে যেমন প্রবল বৃষ্টি ছিলো ঠিক তেমনই বাবার মৃত্যুর দিনেও।যখন বাবা মারা যান তখন থেকেই একটু একটু করে বুঝতে শিখতে আরম্ভ করি আমি।বাস্তবতার কিছু কিছু কুৎসিত রূপের সাথেও পরিচিত হতে আরম্ভ করি। ‘বাবা’ শব্দটার আরেক নাম হয়তো ‘নিরাপত্তা’।বাবা হারানোর পরই নিজের নিরাপত্তা হারিয়েছিলাম,আফিম।বাবার যা সম্পত্তি ছিলো তা সব আমার পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু চাচারা কিভাবে যেনো সব আত্মসাৎ করে নেন।হয়তো আইনী ভাবে সব এখনো আমার আছে মানে কেস-মামলায় জড়ালে আমি পেতে পারি আমার বাবার সম্পদ।কিন্তু আমার ইচ্ছে নেই আর ইচ্ছে থাকলেও তো আমার কিছু করার থাকতো না।আর খালু আবার পুলিশ-কেস এসব জিনিস ভয় পান তাই এসব দিকে তিনিও জড়াননি।আর এসবের জন্য বাবা মারা যাবার পর আমার সব খরচের বোঝা গিয়ে পড়লো খালুর কাঁধে।শুরু হলো মাম্মির সংসারে ঝামেলা।খালু আমার খরচ বহন করতে ইচ্ছুক ছিলেন না।মাম্মিকে চাপ দিতেন যেনো মাম্মি আমাকে মামার বাসায় দিয়ে আসে।কিন্তু মামাও আমার দ্বায়িত্ব নিতে চাইতেন না।সে নাকি তার নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতেন সেখানে আমাকে আর কি করে পালবেন! খালুর হাজারো গালমন্দ শুনেও মাম্মি আমাকে তার বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।নিজের স্বামীর সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে আমার পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি।আমার পড়ার খরচ বা যেকোনো আবদার মেটাতে অনেক সময় খালুর পকেট,মানিব্যাগ দিয়ে টাকাও চুরি করেছিলেন মাম্মি।ক’একবার ধরাও খেয়েছেন।লোকটা মাম্মির গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করেনি।আর আমার মাম্মিটা আমার জন্য ঐ লোকটার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও চুপচাপ সয়ে গিয়েছিলেন।

কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।একফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পরে মেয়েটার গাল বেয়ে।ঠিক এমন মুহূর্তেই আকাশে মেঘেদের সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করে।অর্থাৎ আবহাওয়া ধীরে ধীরে খারাপের দিকে আগাচ্ছে।হয়তো আবারও বৃষ্টির আগমন ঘটবে!মেঘবালিকার কষ্ট যেনো সহ্য হয় না ঐ দূর আকাশের।তাইতো মেঘবালিকার মনে দুঃখদের আনাগোনা দেখা দিলেই ঐ দূর আকাশে জড়সড় হয় শতশত মেঘেরা।গর্জে উঠে বর্ষিত হয় ধরণীর বুকে।

আফিম অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে নিজের বক্ষমাঝারে।এমনটি নয় যে সে এসব সমন্ধে অবগত ছিলো না।জানে সে,সবটাই জানে নিজের প্রেয়সীর সমন্ধে।কিন্তু তার সামনে তার মায়াবীনির দুঃখ বিলাস পীড়া দিচ্ছে তাকে।ইচ্ছে করছে মেয়েটার অতীতের ক্ষতগুলো মুছে দিয়ে সেথায় সুখ লিখে দিতে।কিন্তু আফসোস,সৃষ্টিকর্তা সে ক্ষমতা তার সৃষ্টি কুলের কেউকে দেননি।

নাফিয়া ক’সেকেন্ড বিরতি নিয়ে আবারও বলতে আরম্ভ করে,
-আমার সাথে দূরব্যবহার করা,থাকা-খাওয়ার খোঁটা দেওয়া,খরচ দিতে না চাওয়া,মাম্মির সাথে ঝগড়া করা,মাম্মির গায়ে হাত তোলা সব কিছু তাও মেনে নেওয়ার মতো ছিলো।কিন্তু এসবের পর একদিন লোকটা নিজের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেললো।লোকটা লোকটা লোকটা আ আ আমার শরীর…..

নাফিয়া আর কিছু বলার আগেই তার হাত ধরে এক হেঁচকা টানে তাকে নিজে বুকে নিয়ে এলো আফিম।চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ছেলেটার।রাগে কপালের রগগুলোও দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে তার।শক্ত করে নিজের প্রেয়সীকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন কন্ঠে আফিম বলে ওঠলো,
-চুপ!
এর থেকে বেশি শোনার ক্ষমতা আফিমের নেই।শুনলে হয়তো ঐ দানব টা আর এই পৃথিবীর বুকে একদিনো বেঁচে থাকতে পারবে না।অবশ্য নিজের হাতদুটো তো ১ মাস ২৭ দিন আগেই হারিয়েছে,এখন হয়তো নিজের জানটাও হারাবে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here