আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১৭,১৮

0
888

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১৭,১৮
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৭

আফিমের বুকে মাথা গুঁজে শক্ত করে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নাফিয়া।নিরবে তার কয়েক ফোঁটা অশ্রু কণা সমাধিত হলো আফিমের বুকে।একটুখানি ভিজলো ছেলেটার শার্টের কিছু অংশ।
নাফিয়ার অশ্রু কণাগুলো আফিমের ভেরতের পীড়া, ক্রোধানুভূতি ক্রমশ বাড়িয়ে চলছে।নিজের মায়াবীনিকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে আফিম।চোখ বুঁজে জোরে জোরে ক’বার নিশ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।নির্ঘাত সেদিন লোকটার হাতের সাথে সাথে জান টাও নিয়ে নিতো আফিম।কিন্তু ভাবলো তার মায়াবীনি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ঐ লোকটার দেওয়া বাজে স্মৃতির বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।তাহলে লোকটা কেনো একেবারে মৃত্যু অর্থাৎ মুক্তি পাবে এতো সহজে।সেজন্যে লোকটার জান না নিয়ে তার হাতজোড়াকে কেটে দিয়েছে আফিম।তাও নিজের হাতে।যাতে করে লোকটা যতদিন বাঁচবে ততদিন যেনো নিশ্বাস নেওয়াটাও বিষাক্ত লাগতে থাকে তার।
হাত কাটবার সময়ে লোকটার করা আর্তনাদ, আকুতি-মিনতি,ব্যথায় গগনবিদারী চিৎকার সবটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো আফিমের।মুহূর্তেই রাগের মাত্রা কিছুটা কমলো তার।এই স্মৃতি হৃদয়ে মৃদু প্রশান্তিও এনে দিলো আফিমের।রাগের মাত্রা কিছুটা কমে আসায় নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে আফিম।নাফিয়ার কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে সে বলে ওঠে,
-কাঁদে না মিস.শেখ।You are a strong girl,right?
আফিমের কথায় একটু নড়েচড়ে ওঠে নাফিয়া।আফিমের বুকে নাক ঘষে চোখের পানি,নাকের পানি এক করে ছেলেটার শার্টের বুকের অংশটুকু পুরোটা ভিজিয়ে দিয়েছে সে।সফলভাবে শার্টখানা ভিজাবার পর আফিমের বুক হতে মাথা তুলে ছেলেটার চোখে চোখ রাখে নাফিয়া।ভিজে চোখে তাকিয়ে রয় নিজের মনের চিলেকোঠায় যত্নে পুষে রাখা সকল অনুভূতির অধিকারী পুরুষটির দিকে।যে পুরুষের চোখে ভরসা খুঁজে পায় সে,খুঁজে পায় নিজের নিরাপত্তা।
মায়াবীনির মায়াভরা চোখে অশ্রু বড্ড বেমানান।তাই তো সহ্য করতে পারে না আফিম।নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মুছে দেয় তার প্রেয়সীর চোখের পানি যেনো মুছে দিচ্ছে সকল কষ্টেভরা স্মৃতি।মুগ্ধতায় ভরে ওঠে নাফিয়ার মন।এতো যত্নে এই প্রথম তার মাম্মি ব্যাতীত অন্য কেউ তার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। ঠোঁটে প্রশান্তির মৃদু হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।সে কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠে বলে ওঠে,
-আমার পুরোটা অতীত আজ আপনাকে জানাতে চাই আফিম।একটু শুনুন?
উত্তরে আফিম শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-উহু আর না।অতীত আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয় না মিস.শেখ।যে স্মৃতি আমাদের কষ্ট দেয় তা মনে করাটা বোকামি মাত্র।কারণ ছোট একটা জীবনে সুখ না কুড়িয়ে দুঃখবিলাস করাটা চরম রকমের সময়ের অপচয়।
-Totally agree with you my boss.[আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত]
ঠোঁটে হাসি টেনে কথাটা বলে নাফিয়া।আফিমও নিজের ঠোঁটে হাসি টেনে ডান হাত দ্বারা আলতো করে নাফিয়ার নাক টেনে দেয়।আফিম হাত সরাতেই নাফিয়া মন খারাপের স্বরে ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-কিন্তু আফিম,আমার তো বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।না বললে আমার পেট ব্যথা করবে।
মেয়েটার এমন কথায় হাসি পায় আফিমের।প্রতিবার মনে মনে ভীষণ রকমের মুগ্ধ হয় আফিম নাফিয়ার এসব বাচ্চামিগুলোতে।এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।কিন্তু সেই বাজে স্মৃতি সমন্ধে আবারও শুনতে হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে যায় তার।কিন্তু তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেয়সীর মন রাখতে সম্মতি দিতে বাধ্য হয় সে।বলে ওঠে,
-ঠিক আছে,বলো।
আফিমের সম্মতি পেয়ে ঠোঁটে একটু হাসি টানে নাফিয়া।নিজের সম্পূর্ণ জীবনটা তুলে ধরতে চায় সে এ মানুষটার সামনে।চায়,আফিম যেনো সবটা জেনে তাকে নিজের হৃদয়ে একটুখানি ঠাঁই দেয়।তাই তো মন খুলে সব বলতে চায় আজ সে।আফিমের জায়গায় অন্য কেউ হলে এভাবে নিজের জঘন্য অতীত এতো সহজে বলতে পারতো না নাফিয়া।কিন্তু ছেলেটাকে সে যতটা চিনেছে,জেনেছে,বুঝেছে তাতে সে এতোটুকু জানে যে আফিম বিশ্বাস ও ভরসার যোগ্য একজন ব্যাক্তি।সে আর যাই হোক, নাফিয়ার অতীত দিয়ে নাফিয়াকে বিচার করবে না বা অতীত সমন্ধে জেনে নাফিয়াকে ছোট চোখে দেখবে না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ঠোঁটে টেনে রেখে আফিমের বাম হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে নাফিয়া বলে ওঠে,
-হাঁটতে হাঁটতে বলি?
নাফিয়ার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ইশারায় সম্মতি দেয় আফিম।আফিমের বাম হাতের মুঠোয় থাকা নিজের ডান হাতটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাফিয়া।মুহূর্তেই ঠোঁটে আলতো হাসি এসে জায়গা করে নেয় তার।মনে ভরসা বৃদ্ধি পায়।ভরসা পায়,এই মানুষটা আগলে রাখবে তাকে অতি যত্নে।ছাড়বে না হাত,ছুটবে না এই হাতের বাঁধন।
অতঃপর চোখ বুঁজে জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় নাফিয়া।ক’সেকেন্ড সময় নিয়েই বলতে আরম্ভ করে,
-তখন সবে আমার ১২ বছর বয়স।শৈশব থেকে ধীরে ধীরে কৈশোরে পদার্পণ করছিলাম।আসছিলো শারীরিক পরিবর্তন।কখন যে লোকটার বাজে দৃষ্টি পড়লো আমার উপর বুঝতেই পারিনি।যেদিন বুঝতে পারি সেদিনটি ছিলো আমার জীবনের অন্যতম জঘন্য দিন।
মাঝে মাঝে আমাকে ঘুম পড়াতে গিয়ে মাম্মি নিজেই ঘুমিয়ে পড়তেন।তো সেদিন রাতেও মাম্মি আমাকে ঘুম পড়াতে গিয়ে আমার সাথে আমার রুমেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।কিন্তু ঘুম না আসায় আমি সজাগই ছিলাম।সজাগ থাকায় হুট করে খিদেও পেয়েছিলো।মাম্মিকে ডেকে যে খাবারের কথা বলবো তাতেও মন সায় দিলো না।মানুষটা এমনিও সারাটা দিন সংসারের কাজে খাটা-খাটুনি করেন।তাই তার প্রশান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে হলো না। নিজে নিজেই গেলাম রান্নাঘরে খাবারের সন্ধানে।রান্নাঘরে দুধ জ্বাল করা ছিলো আর কৌটোতে ছিলো বিস্কুট।ব্যাস কাপ,প্রিজে সেসব নিচ্ছিলাম। এমন সময় হটাৎ খালু এসে আমার বাহু চেপে ধরেন।চমকে তার দিকে তাকাতেই আমাকে বলে ওঠেন,
“কিরে নুফি,কি করছিস?”
লোকটাকে এমনিও পছন্দ ছিলো না আমার।তাই তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলেছিলাম,
“হাত ছাড়ুন খালু,ব্যথা লাগছে।”
উত্তরে লোকটা বলে উঠলেন,
“আহারে!আয় আদর করে দিচ্ছি।”বলেই লোকটা বাজে ভাবে শরীর স্পর্শ করতে আরম্ভ করেছিলো।সাথে সাথে চিৎকার করে উঠেছিলাম।লোকটা দ্রুত মুখ চেপে ধরেছিলো আমার।জোর করে তার রুমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।আর আমি তার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম।হুট করে দরজার দিকে চোখ যায় আমার,দেখি মাম্মি রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন।সে যেনো নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।লোকটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত থাকায় তিনি মাম্মির উপস্থিতি টের পাননি।কিন্তু আমি দেখেছিলাম মাম্মিকে।ক্রোধনরত অবস্থায় তাকিয়ে ছিলাম মাম্মির দিকে।লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো দেখে শব্দ করতে পারিনি।কিন্তু মনে মনে চলছিলো হাজারো আকুতি-মিনতি।আমার চোখ দুটো সাহায্য ভিক্ষে চাচ্ছিলো।বয়স কম হবার পরও খালুর নিয়ত খারাপ তা বুঝেছিলাম আমি।তাই তো নিজেকে খালুর হাত থেকে ছুটানোর জন্য ছটফট করছিলাম আর সাহায্যের আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম মাম্মির দিকে।এর ক’সেকেন্ডের মাঝেই মাম্মির চেহারাই যেনো বদলে গিয়েছিলো।চোখমুখে ক্রোধের অগ্নি ধাউ ধাউ করে যেনো জ্বলে উঠেছিলো।সে এক রণচণ্ডী রূপ!স্ত্রী হিসেবে মাম্মি সবসময় অবলা নারীর রূপ ধারণ করে থাকলেও সেদিনের ক্ষিপ্ত মা ছিলো ভয়ংকর ক্রোধান্বিত এক ধ্বংসাত্মক নারী।দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে ছুরি হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি।কোনো কিছু না ভেবেই সে আঘাত করে খালুর হাতে।এসব এতো দ্রুত হয় যে খালু কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা বুঝে উঠতে পারছিলো না।তাকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর নূন্যতম সময় না দিয়ে আবারও আঘাত করতে আরম্ভ করেছিলো মাম্মি।এক আঘাতে যেনো মাম্মির ক্রোধ এক বিন্দুও কমেনি।তাই তিনি বারংবার এলোপাতাড়ি আঘাত করে চলছিলেন খালুকে।প্রথমবারের জন্য খালুর চোখে মাম্মির প্রতি ভয় জন্মাতে দেখেছিলাম সেদিন।ভীত চোখে তাকাচ্ছিলেন তিনি মাম্মির দিকে এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন,মাম্মিকে থামানোর চেষ্টাও করেন তিনি।কিন্তু মাম্মিকে সেদিন থামানো যাচ্ছিলো না।ছুরি দ্বারা বার বার আঘাত করায় খালুর হাত, বুক,গালসহ আরো অনেক জায়গায় কেটে যায়।রান্নাঘরের ফ্লোর রক্তে ভরে ওঠে।এতো ছোট বয়সে একদিনে এতো কিছু নিতে পারিনি আমি।এমন রক্ত দেখেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
কথাগুলো বলে থামে নাফিয়া।আফিমের দিকে তাকায় সে।ছেলেটার চোখমুখ স্বাভাবিক নয়।কেমন এক ভয়ংকর রাগ ফুটে উঠেছে ছেলেটার মুখশ্রীতে।নিরবে নিজের রাগ দমিয়ে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত ছেলেটা।নাফিয়া তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আমাকে কি আপনার অপবিত্র মনে হচ্ছে আফিম?ঐ লোকটার বাজে স্পর্শে অপবিত্র হয়েছি আমি?
নাফিয়ার করা প্রশ্নদ্বয় কানে আসতেই কান গরম হয়ে গেলো আফিমের।মুহূর্তেই ক্রোধের পরিমাণ সীমা অতিক্রম করে ফেললো তার।নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভয়ংকর ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো তোর।সাহস কি করে হলো নিজেকে অপবিত্র বলার?

চলবে।

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৮

দু’হাতে নাফিয়ার গাল আলতো করে আঁকড়ে ধরে আফিম।চোখবুঁজে কপালে কপাল ঠেকায়।হৃৎপিণ্ডে কেমন এক মিশ্র অনুভূতি অনুভব করছে সে।ক্রোধ ও পীড়ার এ এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি।
আচ্ছা,তার মায়াবীনি কি জানে যে তার কষ্টে আফিম ও সম পরিমাণ কষ্ট অনুভব করে?সে কি অনুভব করে,তার অতীতের ক্ষতগুলো আফিমকে কতোটা ক্ষত-বিক্ষত করে?সে কি বোঝে তার অতীত আফিমকে কতোটা অসহায় বা অপারগ অনুভব করায়?
ছেলেটা ভেতরে ভেতরেই নিজের অপারগতার দহনে জ্বলছে।অপারগতা এটিই যে সে কেনো তার মায়াবীনির জীবনে আরো আগে এলো না,কেনো সে তার মায়াবীনিকে এসব কষ্টের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে যত্নে আগলে রাখতে পারলো না!সে জানে এসবে তার জোর ছিলো না,পুরোটাই ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল ছিলো।কিন্তু তাও মন তার প্রেয়সীর কষ্টগুলো মানতে নারাজ আর নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রয়াসে মত্ত।

আফিমের মিশ্রানুভূতিতে পূর্ণ হৃদয়ে এক অবাস্তব ইচ্ছের উঁকিঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।তার ইচ্ছে জাগছে, মেয়েটিকে নিজের বক্ষ পিঞ্জরে আবদ্ধ করে নিতে।খুব যত্নে সেথায় আগলে রাখবে সে এই কিশোরীকে।বাহ্যিক যেকোনো আঘাত,শোক,কষ্টকে তার মায়াবীনির ধারেকাছেও আসতে দিবে না সে।পুরো দুনিয়া হতে লুকিয়ে রাখবে সে তার মায়াকে।এমন চিন্তে মনে জায়গা করে নিতেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আফিম।এই ইচ্ছেকে বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব নয় কারণ নাফিয়াকে লড়তে শিখাবে সে,লুকিয়ে থাকতে নয়।শেষ কথাখানা ভেবে চোখ মেলে তাকায় আফিম।
নাফিয়া চোখ বুজে আফিমের কোমরের কাছের দিকের শার্টের খানিকটা অংশ আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটার চোখের কোণে এক বিন্দু পানি জ্বলজ্বল করছে।আফিম অনতিবিলম্বে তার বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা সে জল মুছে দেয়।দু’হাতে মেয়েটার গাল আঁকড়ে ধরে টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে।আফিমের স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় নাফিয়া।এবার দু’জনার দৃষ্টি একে-অপরের চোখে আবদ্ধ।আফিম মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-সমাজে অহরহ বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের বসবাস আছে,মিস.শেখ।এরা মানসিক ভাবে এতোটাই অসুস্থ যে একটা ৬ মাসের শিশুতেও যৌনতা খুঁজে পায়।শুধু নারী নয় এখন তো এমন যুগ চলছে যেখানে পশুরও ধর্ষন হয়।আর যারা এসব করে তারা কি করে স্বাভাবিক মস্তিষ্কের হতে পারে?
প্রশ্নটি করে থামে আফিম।নাফিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আফিমের চোখ পানে।উত্তরের অপেক্ষা না করে আফিম আবারও বলে ওঠে,
-যেসব পুরুষ নিজের স্ত্রী ব্যাতীত অন্য যেকোনো নারীর দিকে কামুকী দৃষ্টি তাকায় তারা আসলে মানুষের কাতারেই পড়ে না।কারণ মনুষ্যত্ব তাদের নেই।আর যারা ছোট শিশু বা কিশোরীর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকায় তারা তো এক কথায় বিকৃত মস্তিষ্কের পশু।এখন নিজে ভাবো একটা পশু তো যেকোনো কিছুই করতে পারে।তাদের তো আল্লাহ বিবেকবুদ্ধি দেয়নি।সহজভাবে ভাবো একটা হিংস্র পশুর সামনে যদি তুমি যাও তাহলে তারা তো তোমার উপর আক্রমণ করবেই।এখন আক্রমণে তাদের নখের ক’টা দাগ তোমার শরীরে লাগার অর্থ কি এই যে তুমি অপবিত্র?
এ প্রশ্নে থামে আফিম।নাফিয়া এবারও চুপ।মেয়েটা যেনো আফিমের কথায় গভীর মনোযোগী।সে চাইছে না আফিমের কথার মাঝে কথা বলে ছেলেটার কথায় ব্যাঘাত ঘটাতে।তাই সে নিরব মনোযোগী শ্রোতা।আফিম আবারও বলতে আরম্ভ করে,
-উত্তর হচ্ছে, ‘না’।কারণ পশুর আক্রমণে আমরা ব্যথা পাবো, শরীরের খানিকটা অংশে ক্ষত সৃষ্টি হবে, অপরিষ্কার হবে।তাই হয় অ্যান্টিসেপ্টিক দিয়ে জায়গা পরিষ্কার করে নিতে হবে নাহয় ডাক্তার কাছে ক্ষত সারবার ওষুধের জন্য যেতে হবে।এখানে কোথাও ‘পবিত্র’ বা ‘অপবিত্র’ হওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে?
আসেনি।কারণ ‘পবিত্রতা’ আর ‘অপবিত্রতা’ থাকে মানুষের মনে,নিয়তে।একটা পশুর আক্রমণে তুমি ‘অপবিত্র’ হবে না মিস.শেখ।কিন্তু যে পশু টা তোমার দিকে বাজে নিয়তে তাকিয়েছে সেই পশুটাই অপবিত্র।তুমি অপবিত্র নও,কোনোভাবেই নও।
কথাগুলো বলে থামে আফিম।নাফিয়া নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আফিমের চোখ পানে।যে চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে।যে চোখে নাফিয়া স্পষ্ট রাগ আর কষ্টের উপস্থিতি দেখতে পারছে।এ রাগ টা কিসের জন্য বা কার উপর তা বুঝতে কষ্ট হয়নি নাফিয়ার।সে জানে এই রাগ আফিমের নিজের উপর হচ্ছে।কারণ সে পারেনি ঐ নরপশুর বাজে দৃষ্টির হাত থেকে নাফিয়াকে বাঁচাতে।আর কষ্ট টা অনুভব করছে তার মায়াবীনির কষ্ট দেখে।
আবেগ বেসামাল হওয়ায় নিরবে ক’ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে নাফিয়ার।অনতিবিলম্বে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে আফিমকে।কানে বাজতে থাকে আফিমের জোর গলায় বলা শেষ বাক্যটি, “তুমি অপবিত্র নও,কোনোভাবেই নও”।
ছেলেটার বুকে মাথা রেখে তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে টেনে নেয় সে।এই মানুষটার মতো করে পৃথিবীতে আর কেউ হয়তো কোনোদিনও তাকে এভাবে ভালোবাসতে পারতো না।
নাফিয়া আফিমকে জড়িয়ে ধরতেই দ্বিগুণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে আফিম।চুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে ওঠে,
-তোমাকে অনেক স্ট্রোং হতে হবে মিস.শেখ।অনেক বেশি।এই সমাজে নরপিশাচদের অভাব নেই।তারা নারীদেহ পেলেই সুযোগ খোঁজে হামলে পড়ার।এসব হায়নাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তোমাকে নিজেরই প্রতিবাদী হতে হবে।মনে রাখবে এই পৃথিবী,’শক্তের ভক্ত,নরমের যম’।যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজন তা হলো মনোবল,সাহস।আর বাকিটা প্রয়োজন নিজের আত্মরক্ষার কিছু ট্রিকস জেনে রাখা।এসব ট্রিকস আমি নিজ দায়িত্বে শিখিয়ে দিবো তোমায়।কারণ আমি চাই তুমি আত্মনির্ভরশীল হও।আর তা তুমি হবেই।নিজের লড়াই নিজে লড়বে।এই পৃথিবীতে ভালোভাবে টিকে থাকতে হলে নিজেকে শক্তভাবে গড়তে হবে।মনে থাকবে?
আফিমের বুকে মাথা রেখেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় নাফিয়া।চোখের পানি মুছে নেয় সে।অবলা, অসহায় মেয়েদের মতো নিজের এই অতীত মনে করে আর কখনো কাঁদবে না সে।চেষ্টা করবে নিজেকে ভেতর থেকে শক্ত করে গড়ে তোলার।নিজের জন্য নাহলেও নিজের ভালোবাসার মানুষটার কথা রাখার জন্য।আর কেনোই বা ঐ অতীত নিয়ে এতোটা ভাববে সে।একটা হিংস্র পশু আক্রমণ করতেই পারে। তা নিয়ে এতো ভাব্বার কিছু নেই, আসলেই নেই।কথা খানা ভেবে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে নেয় নাফিয়া।অনেক বছর ধরে বয়ে বেড়ানো বোঝা হতে আজ মুক্ত হলো সে।মনে অনুভব করছে এক প্রশান্তির ছোঁয়া।
নিজের মনের বোঝা কমলেও হটাৎ তার মনে একটি প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটে।
“একটা নরপশু কি কখনো ভাবে যে তার বিকৃত মস্তিষ্কে উৎপন্ন হওয়া নিকৃষ্ট লোভ একটা শিশু বা কিশোরী বা নারীর মনে কতোটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে?তারা কি কোনোদিন অনুভব করতে পারবে যে তাদের জঘন্য স্পর্শ একটা মেয়ের মনে কতোটা ঘৃণা সৃষ্টি করে?একটা বাজে স্পর্শে একটা মেয়ে নিজের শরীরটাকেই অপবিত্র বলে মনে করতে আরম্ভ করে।এই এক-দুটো বাজে স্পর্শের বিষাক্ত স্মৃতি একটা মেয়ে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বয়ে বেড়ায়।এই নরপিশাচ গুলো কখনো বুঝবে না তারা কয়েক সেকেন্ডের সুখের লোভে একটা মেয়ের কতশত চোখের পানির কারণ হয়,কত অভিশাপ-বদদোয়ার অধিকারী হয়।”
নাফিয়ার মাথায় হাত রেখে আফিম বলে ওঠে,
-চলো এবার বাসায় যাওয়া যাক।
আফিমের বুক হতে মাথা তুলে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে নাফিয়া বলে ওঠে,
-উহু। বৃষ্টি বিলাস করবো তারপর।
-নো বৃষ্টি বিলাস।এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজা যাবে না।
আফিমের নিষেধাজ্ঞা গায় মাখলো না নাফিয়া।সে আফিমের থেকে সরে এসে ব্রীজের কিনারায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।ঠান্ডা বাতাসেরা ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে।ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি টেনে নাফিয়া বলে ওঠে,
-জানেন ঐ ঘটনার দিনেও বৃষ্টি হয়েছিলো।আবার আমার জীবনে যেদিন আপনি এলেন সেদিনও বৃষ্টি ছিলো।কেনোই যেনো আমার জীবনে ঘটা সব বড় বড় ঘটনার দিন বৃষ্টি হয়।
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আফিমের ঠোঁটে।মনে মনে বলে ওঠে, “তোমার বিয়ের দিনেও বৃষ্টি হয়েছিলো যা এখনো তোমার অজানা”।কথা খানা মনে মনে আওড়িয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে সে বলে ওঠে,
-তোমার জীবনে আমার আগমন বড় ঘটনা?
ঠোঁটের হাসিটা বজায়ে রাখে নাফিয়া।নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-বড় এবং বিশেষ ঘটনা।
কথাটি ধীর কন্ঠে বললেও তা ঠিকই আফিমের কর্ণকুহোর অব্দি এসে পৌঁছায়।এক চিলতে ফুটে ওঠে ছেলেটার ঠোঁটে।কিন্তু তা লুকিয়ে কন্ঠে কঠোরতা ফুটিয়ে তুলে সে বলে ওঠে,
-এখনি বাড়ি ফিরবো।গাড়িতে ওঠো।
আফিমের কথাখানা বলতে দেরি হলেও মেঘ গর্জে উঠতে দেরি হলো না।ঠান্ডা বাতাস তো বইছিলোই এখন শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টির বর্ষণ।মুহূর্তেই এ বর্ষন ভিজিয়ে দিতে আরম্ভ করলো দু’জনকে।সবকিছু এতো দ্রুত হলো যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়ই পেলো না আফিম।ভ্যাবলার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সে।আফিমের এমন ভ্যাবলা মার্কা অবস্থা দেখে শব্দ করে হেসে ওঠে নাফিয়া।হাসতে হাসতেই বলে ওঠে,
-দেখেছেন আমি সত্যিই মেঘকন্যা।খুব হুকুম দিচ্ছিলেন না আমাকে?কিন্তু দেখেন মেঘ বিকট শব্দে বকে দিয়েছে আপনাকে।
নাফিয়ার কথায় চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায় আফিম।বলে ওঠে,
-তাই না?
প্রশ্নটি করে আর দেরি করে না সে।তেড়ে অগ্রসর হয় নাফিয়ার দিকে। আফিমের মতিগতি ভালো ঠেকলো না নাফিয়ার।তাই সেও দৌড়ে সরে যেতে অগ্রসর হলো।মধ্য রাতের এক বর্ষনে বাচ্চাদের মতো দৌড়প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেছে দু’জন মানব-মানবী।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here