আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১৯,২০

0
1211

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,১৯,২০
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৯

এক কাপ আদা চা ও এক কাপ ব্লাক কফি হাতে নিয়ে আফিমের কক্ষের দিকে এগিয়ে চলছে নাফিয়া।অনেকটা সময় বৃষ্টিতে বাচ্চাদের মতো দুষ্টুমি করে মন ভরতেই কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে তারা।বাড়ি ফিরেই দু’জন দু’জনার কক্ষে গিয়ে গোসল সেরে নিয়েছে।নাফিয়ার গোসল শেষ হতেই সে চলে যায় রান্না ঘরে।নিজের জন্য আদা চা এবং আফিমের জন্য আফিমের পছন্দের ব্লাক কফি বানিয়ে এখন সে অগ্রসর হয়েছে ছেলেটার কক্ষের দিকে।
কক্ষে প্রবেশ করতেই নাফিয়া দেখতে পায় ভিজে চুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিশার্ট পরিধানে ব্যস্ত আফিম।চুল ভালোভাবে মোছেও নাই ছেলেটা।তার মাথা ভর্তি মসৃণ,সোজা ছোট চুলগুলো হতে টুপ টুপ করে পানি বেয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার ঘাড়,গলা।হাতে থাকা কাপ দু’টো আফিমের বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলটার উপর রেখে বিছনায় পড়ে থাকা আফিমের টাওয়াল টা হাতে তুলে নেয় নাফিয়া।আফিম তখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে পারফিউম লাগাতে ব্যস্ত।আফিমের এমন কান্ড দেখে ব্রু দ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে নাফিয়া।মনে মনেই প্রশ্ন করে ওঠে,
“রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পারফিউম আবার কে লাগায়?”
মনের প্রশ্ন মনেই রাখে সে।নিজে নিজে উত্তর বানিয়ে নেয়,
“পাগলে কিনা বলে,ছাগলে কিনা খায়”
আফিমের কাছে গিয়ে তার হাত আঁকড়ে ধরে নাফিয়া।হটাৎ মেয়েটার এমন স্পর্শে থেমে যায় আফিম।হাতের পারফিউম টা টেবিলের উপর রেখে নাফিয়ার দিকে ফিরে দাঁড়ায় সে।আফিম তার দিকে ফিরে দাঁড়াতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-এদিকে আসুন।
নাফিয়াকে অনুসরণ করে আফিম নিজের বিছানা অব্দি এসে থামে।নাফিয়া ইশারায় তাকে বসতে বলতেই সে ভদ্র ছেলের মতো নিজের বিছানায় বসে পড়ে।কিন্তু চোখে স্পষ্ট প্রশ্ন ফুটে আছে তার।নাফিয়া কি করতে চাইছে তা-ই নিরবে বুঝার চেষ্টা করছে আফিম।
আফিম বিছানায় বসতেই নাফিয়া ব্লাক কফির মগটা হাতে ধরিয়ে দেয় তার।তারপর যত্নের সহিত তার মাথা মুছে দিতে আরম্ভ করে।অবাক হয় আফিম।মুহূর্তেই মুগ্ধতায় ভরে ওঠে তার মন।এতোটা তো নাফিয়ার থেকে আশা করেছিলো না সে।বরং ভেবেছিলো বাচ্চা একটা মেয়ের দায়িত্ব নিচ্ছে সে।এই বাচ্চাটাকে দেখে রাখা,হেফাজতে রাখা আর একজন সফল মানুষ হিসেবে গড়তে সাহায্য করা তার দায়িত্ব।তাই মেয়েটার খেয়াল রাখাও তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।কিন্তু যেখানে তার দায়িত্ব মেয়েটার খেয়াল রাখার সেখানে মেয়েটাই তার খেয়াল রাখছে।আসলে লোকমুখে প্রচলিত কথাটা যথার্থ যে,
“দায়িত্ববোধটা বয়সের সাথে আসে না বরং পরিস্থিতি,বাস্তবতা ও অভিভাবকের দেওয়া উত্তম শিক্ষাই মানুষকে দায়িত্ববান বানিয়ে দেয়”

আফিমের মাথা মুছতে মুছতেই বিরক্ত কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন অথচ নিজের খেয়াল রাখা শিখলেন না।একে তো এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছেন তারপর ভিজা কাপর গায়ে জড়ানো ছিলো পুরোটা রাস্তা।তার উপর গোসল সেরে এসে মাথাটাও মুছেন নাই ঠিক মতো।ঠান্ডা লেগে যাবে না?
নাফিয়ার কথা শেষ হতেই তাকে এক হেঁচকা টানে নিজের কোলে বসিয়ে নেয় আফিম।দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নাফিয়ার কোমর।মেয়েটাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে আফিম বলে ওঠে,
-বুড়ো হচ্ছি মানে?আমাকে কোন দিক থেকে বুড়ো মনে হয় তোমার?
আফিমের কাজে চমকে গেলেও তার করা প্রশ্ন কানে আসতেই ঠোঁট চেপে হাসে নাফিয়া।আফিমের গলা জড়িয়ে ধরে দুষ্টু কন্ঠে বলে ওঠে,
-পা হতে মাথা অব্দি সব দিক থেকেই তো বুড়ো হচ্ছেন।
নাফিয়া দুষ্টুমি করছে তা ঠিকই বোধগম্য হলো আফিমের।কিন্তু তাও মিথ্যে রাগ দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে ওঠে,
-২৮ বছর বয়সের এক তাগড়া যুবককে তুমি বুড়ো বলছো কোন সাহসে?
আফিমের প্রশ্নে হাসি বৃদ্ধি পায় নাফিয়ার।ভেংচি কেটে বলে ওঠে,
-এহ আসছে ‘তাগড়া যুবক’!!
চোখ পূর্বের ন্যায় ছোট ছোট করে আফিম।বিনাবাক্য ব্যয়ে নাফিয়াকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ায় সে।বারান্দার দিকে এগোতে এগোতে বলে ওঠে,
-আজই ভাঙ্গা হাড়-গোড় নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হবা।
আফিমের কথা কানে আসতেই চোখ গুলো রসগোল্লার ন্যায় বড় হয়ে যায় নাফিয়ার।ভয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আফিমের গলা।চোখ-মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে সে বলে ওঠে,
-না না প্লিজ স্যরি।আপনি তো অনেককক হ্যান্ডসাম, একদম কিউটের ডিব্বা, বাচ্চা একটা ছেলে।একটু আগে তো আমি মজা করেই বুড়ো বলেছি।
নাফিয়ার পল্টি খাওয়া দেখে মৃদু হাসে আফিম।মূহুর্তেই গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে সে বলে ওঠে,
-আচ্ছা তাই!ধন্যবাদ সত্যি টা স্বীকার করার জন্য। কিন্তু তাও আজ তোমার হাড়-গোড় আমি ভেঙেই ছাড়বো।
কথাগুলো বলতে বলতে বারান্দার একদম কিনারায় চলে আসে আফিম।রেলিং এ গা ঠেকেছে তার।আর নাফিয়া শূন্যে ভাসছে।আফিম ছেড়ে দিলেই ২ তলা থেকে সোজা মাটিতে গিয়ে পড়বে সে।আর যদি ভুলে কোনো ইট,পাথরে মাথা বারি খায় তাহলে সোজা আসমানে পৌঁছে যাবে।এসব ভাবতেই গলা শুকিয়ে যায় নাফিয়ার। আফিমের গলা আরো শক্তপোক্তভাবে জড়িয়ে ধরে চোখ-মুখ কুঁচকে সে বলে ওঠে,
-প্লিজ আফিম স্যরি তো।আর বলবো না কখনো।
নাফিয়ার ভয় পাওয়া দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আফিমের।বহু কষ্টে নিজের হাসি লুকিয়ে সে গম্ভীর কণ্ঠেই বলে ওঠে,
-তোমার কথা রেখে আমার লাভ কি?
-যা যা বলবেন সব করবো।
-যেকোনো কিছু করতে রাজি?
-রাজি।
-Are you ready to kiss me?
-Yes
ভয়ে কিছু না ভেবেই উত্তরখানা দেয় নাফিয়া।নাফিয়ার উত্তরে ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে নেয় আফিম।ধীরে তাকে কোল থেকে নামাতেই যেনো প্রাণ ফিরে পায় মেয়েটা।জোরে জোরে ২-৩ টে শ্বাস নিয়ে আফিমের দিকে তাকায় সে।আফিম বুকে দু’হাত গুঁজে বারান্দার দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
নাফিয়ার চোখে চোখ পড়তেই আফিম বলে ওঠে,
-Now do your work fast Miss. Sheikh. [এখন দ্রুত নিজের কাজ করো মিস.শেখ]
আফিমের কথা কানে আসতেই নাফিয়ার মনে পড়ে তার এখন আফিমকে চুমু দিতে হবে।মুহুর্তেই চোখমুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে তার।মনের গহীনে লজ্জাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে।কোনোভাবে এই কাজ থেকে বাঁচা যায় কিনা ভেবে কিছু একটা মাথায় আসতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-এমন সন্ত্রাসী মার্কা কাজ করে একটা মেয়ের কাছ থেকে চুমু নিবেন আফিম?আপনার মতো এমন উত্তম পুরুষকে কি এ কাজে মানায়?
নাফিয়ার চালাকি বুঝতে কষ্ট হয় না আফিমের।সে বেপরোয়া কন্ঠেই বলে ওঠে,
-সোজা আঙুলে কি ঘি উঠবে নাকি হাড়গোড় ভাঙতেই হবে?
আফিমের উক্ত প্রশ্নে যা বোঝার বুঝে নেয় নাফিয়া।তার চালাকি যে এই ছেলের উপর প্রভাব ফেলবে না তা বুঝে নিয়ে ধীর কদমে আফিমের দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে সে।এ পরিস্থিতিতে সোজা আঙুলে ঘি উঠাই শ্রেয়।
সে এগোতে এগোতে আফিমের একদম কাছে চলে যায়।হৃৎস্পন্দনের গতি ক্রমশ বাড়ছে তার।মনে লজ্জাদের উঁকিঝুঁকি।দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সে আফিমের কাঁধ।ধীর গতিতে ছেলেটার মুখের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে তার ওষ্ঠদ্বয়।লজ্জার ছাপ চেহারাতেও ফুটে উঠেছে তার।আর এই লালাভ মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ আফিমের।
কক্ষের কিছু আলো এসে অন্ধকার বারান্দাটাকে কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে।সেই মৃদু আলোয় নাফিয়ার লালাভ মুখশ্রী দারুণ লাগছে দেখতে।ধীরে ধীরে আফিমেরও হৃৎস্পন্দন বাড়তে আরম্ভ করেছে।তার হৃদয় অপেক্ষার প্রহর গুনে চলছে কখন মেয়েটার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করবে তাকে!
দু’জনের মাঝের দূরত্ব শূন্যের কোঠায় যাবায় ঠিক আগ মুহুর্তেই,
“হাঁচিইইইইইই”
ঘটে গেলো অঘটন।হুট করে হাঁচি আসায় তা আঁটকে রাখতে অক্ষম হলো নাফিয়া।আফিম চোখ-মুখ কুঁচকে মৃদু উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
“ইয়ুক,মিস.শেখ”
কথাখানা বলে আর দাঁড়ায় না আফিম।এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে।উদ্দেশ্য নিজের মুখখানা পরিস্কার করে নেওয়া।
এদিকে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম নাফিয়ার।কোনোভাবেই হাসি থামাতে পারছে না সে।হাসতে হাসতেই সে বলে ওঠে,
“খুব শখ না চুমু খাওয়ার!খাও খাও”

অতঃপর হাসতে হাসতেই আফিমের কক্ষে প্রবেশ করে তার বিছানার এক কোণে বসে পড়ে নাফিয়া।হাতে নিজের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আদা চা টা নিয়ে তাতে চুমুক বসায়।ঠান্ডা চা খাওয়ার এক বাজে অভ্যেস আছে তার।এ নিয়ে কতো কথাই তো শুনতে হতো তাকে তার মাম্মির কাছ থেকে।প্রচলিত বাক্যটা ছিলো,
“চা না খাইয়া সরবত খাইলেই পারিস।ঠান্ডা দুধে চিনি,চা পাতা মিক্স কইরা খাবি।ঢং করতে গ্যাস নষ্ট করিস কেন?”
নিজের মাম্মিকে ভীষণ মনে করে সে।কিন্তু বাড়ি থেকে পালাবার আগে তো মাম্মি তাকে নিষেধ করেছিলো তার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করতে।তাই জন্যেই তো কোনো ফোন কল এখনো অব্দি করেনি সে।আচ্ছা তার মাম্মির কি তার জন্য চিন্তা হয় না?তার মাম্মির কি জানতে ইচ্ছে হয় না যে ও কি অবস্থায়,কোথায় আছে?
মনে প্রশ্নগুলো উদয় হতেই খারাপ লাগতে আরম্ভ করে নাফিয়ার।এরই মধ্যে আফিম বেড়িয়ে এসেছে ওয়াশরুম থেকে।মুখ মুছতে মুছতে মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকায় আফিম।বুঝতে পারে মেয়েটার মনে মেঘ জমেছে কোনো কারণে।কিন্তু কি কারণে তা বুঝতে সক্ষম হলো না সে।এগিয়ে গিয়ে নাফিয়ার পাশেই নিজের বিছনায় বসে পরে আফিম।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কি হয়েছে?
-মনের আকাশে মেঘ জমেছে।
নাফিয়ার এমন কাব্যিক উত্তর আশা করেছিলো না আফিম।মেয়েটার কবিতা টবিতা লেখার শখ আছে কি না কে জানে!নাফিয়ার উত্তর শুনে আফিম আবারও প্রশ্ন করে ওঠে,
-কেনো?
আফিমের প্রশ্নে তার দিকে তাকায় নাফিয়া।ব্রু কুঁচকে উল্টো প্রশ্ন করে ওঠে,
-আগে বলেন,আপনি কেনো জানতে চান নাই যে আমি সেই রাতে ব্রীজে কি করছিলাম বা নিজের বাসা রেখে আপনার কাছে কেনো পরে আছি?

‘প্রশ্ন করা মানে হচ্ছে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করা।একটা মানুষ যা নিজে থেকেই জেনে নিয়েছে সে কেনো তা আবার জিজ্ঞেস করে জানতে চাইবে?’ আফিম নিজের যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন খানা নিজের মনেই গোপন রাখে।প্রকাশ্যে বলে ওঠে,
-কারণ চেয়েছিলাম তুমি নিজে থেকে বলো।
আফিমের এ উত্তর খানা তেমন একটা পছন্দ হয়না নাফিয়ার।কি অদ্ভুত পুরুষ! সে যদি না বলে সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতো তাহলেও কি জানতে চাইতো না আফিম?একটা মানুষের মধ্যে অন্তত একটু হলেও কৌতূহল তো কাজ করে!

আফিমের দিকে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে নাফিয়া জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-তাহলে কি এখনো জানতে চাইবেন না?
নাফিয়ার প্রশ্নে মৃদু হাসে আফিম।বলে ওঠে,
-তুমি বললে শুনবো।

চলবে।

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২০

অতিতের খণ্ডাংশঃ-

“নুরি, কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন নুরানি বেগম।হটাৎ নিজের স্বামীর উচ্চারিত উক্ত বাক্যটি কানে আসতেই থেমে যান তিনি।লোকটার দিকে তাকাতে বা কোনো কথা বলতে রুচিতে বাঁধে নুরানি বেগমের।কেমন ঘেন্না লাগে তার এই লোকটাকে দেখলেই।বিগত দিনে লোকটার কাজ কর্মই এসবের জন্যে দায়ী তাতে দ্বিমত নেই।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকটার দিকে তাকান নুরানি বেগম।লোকটা বলে ওঠে,
-আমার বন্ধু ইরফান নুফির জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ও এতোকাল বিদেশে ছিলো আর একমাস আগে যে দেশে ফিরেছে তাতো তুমি জানোই।এবার আর বিদেশে যাবে না।বাকি জীবন দেশেই কাটাবে।আর ওর অর্থনৈতিক অবস্থা যে ভালো সে বিষয়েও তুমি জানো।
স্বামীর কথায় ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নুরানি বেগমের।তিনি উৎসাহী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
-ইরফান ভাই তার ছেলে ইমরানের জন্য নাফিয়াকে পছন্দ করেছে?এর থেকে সুখবর তো কিছু হতেই পারে না।ইমরান এমনিও ভীষন ভদ্র ছেলে।ওর সাথে বিয়ে হলে নুফি সুখী হবে।
-আরে থামো।কি সব আবোল-তাবোল বকছো?টাকা সব বাপের আর নুফি সুখী থাকবে বেকার ছেলেরে বিয়ে করে?ইমরান এখনো মাস্টার্স কমপ্লিট করে নাই।নাই কোনো আয়-ইনকাম।ওর সাথে বিয়ে হইলে নুফি সুখী হবে?তার চেয়ে ইরফানের সাথে নুফি সুখে থাকবে।টাকা-পয়সার অভাব হবে না।যা চাবে সব পাবে।ইরফান ওরে মাথার মুকুট বানায়ে রাখবে।
স্বামীর কথায় ব্রু দ্বয়ের মাঝে ভাজ পরে নুরানি বেগমের।তিনি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলে ওঠেন,
-কি বলতে চাইছেন আপনি?
-ইরফান নিজের জন্য নুফিকে পছন্দ করেছে।
কথাখানা শুনতেই নুরানি বেগম চোখমুখে ঘেন্নার ছাপ ফেলে বলে ওঠে,
-ছিঃ!নিজের সন্তানের মতো মেয়ের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাতে বিবেকে বাঁধলো না তার?
নুরানি বেগমের কথায় বিরক্ত হোন হিমেল সাহেব।বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠেন,
-তোমার নীতি বাক্য রাখো তো।নাফিয়ার বিয়ে ইরফানের সাথেই হবে আর আগামীকালই ওদের কাবিন হবে।সব ঠিকঠাক করাই আছে।তোমাকে জানানো দরকার ছিলো তাই জানিয়েছি।ব্যাস,যা হচ্ছে চুপচাপ হতে দেও।
-আমার মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে হিমেল?
রাগী গলায় প্রশ্ন করলেন নুরানি বেগম।হিমেল সাহেবও রেগে গেলেন।দাঁতে দাত চেপে বলে উঠলেন,
-এতো বছর আমার টাকায় খেয়ে-পড়ে আবার জিজ্ঞেস করছো আমি অধিকার কোথায় পেলাম?
এ প্রশ্নে দমে গেলেন নুরানি বেগম।আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিজে কখনো টাকা কামানোর চেষ্টা করেননি তিনি।আসলে তিনি নিজেকে ভীতু,অবলা এক গৃহিনী হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।তাই তো সাহস দেখিয়ে এই কাপুরষের হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিতে পারেননি তিনি,পারেননি নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করতে,পারেননি নিজের যোগ্যতায় একটা টাকা ইনকাম করার সাহস অর্জন করতে।সেদিন নাফিয়ার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যে রণচণ্ডী রূপ ধারণ তিনি করেছিলেন সেই সাহস টা যদি নিজের মাঝে ধরে রাখতে পারতেন,যদি নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায় মেনে না নিয়ে নিজের ভেতরে জিদ পুষতে সক্ষম হতেন তাহলে হয়তো আজ নিজের স্বামীর এমন প্রশ্নের সম্মুখীন তার হতে হতো না।
নুরানি বেগমকে দমে গিয়ে চুপ থাকতে দেখে ঠোঁটে বিজয়ের হাসি টেনে নেন হিমেল সাহেব।বলে ওঠেন,
-যাও গিয়ে নাফিয়াকে বোঝাও।বিয়েতে যেনো কোনো ঝামেলা না হয়।
কথাটি বলেই ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হোন হিমেল সাহেব।কিন্তু মাঝ পথেই থেমে যান নুরানি বেগমের প্রশ্নে,
-আমাদের মেয়ে হুমায়রাকে যদি ইরফান বিয়ে করতে চাইতো তাহলে বিয়ে দিতেন আপনি?
প্রশ্নটা যেনো পানির মতোই সহজ ঠেকলো হিমেল সাহেবের।সোজা উত্তর দিলেন,
-আমার মেয়েকে ঐ নজরে দেখার সাহস ওর নেই।
-আর নাফিয়াকে ঐ নজরে দেখার সাহস কি করে পেলো?নাফিয়ার বেলায় কেনো এই অন্যায়?
স্ত্রীর প্রশ্নে আলতো হাসেন হিমেল সাহেব।দ্বিধাহীন কন্ঠে বলে ওঠেন,
-কারণ হুমায়রা আমার সন্তান আর নাফিয়া আমার স্ত্রীর মৃত বোনের সন্তান।দু’জনের মাঝে অনেক তফাৎ নুরি।যা তোমার চোখে পড়েনা কারণ মৃত বোনের ভালোবাসায় অন্ধ তুমি।এতোটাই অন্ধ যে মৃত বোনের মেয়েকে পালতে যেয়ে নিজের মেয়েকে কি পরিমাণ অবহেলা করছো তা নিজেও বুঝতে পারোনি।
স্বামীর কথায় থমকে যান নুরানি বেগম।সত্যিই কি নাফিয়াকে মায়ের ভালোবাসা দিতে গিয়ে নিজের সন্তানকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন তিনি?তাই জন্যেই কি হুমায়রা তাকে ছেড়ে পড়ালেখার অযুহাত দেখিয়ে নিজের ফুফুর বাসায় উঠেছিলো?
নিজের কথা শেষ করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েন হিমেল সাহেব।এদিকে ধুপ করে বিছানায় বসে পড়েন নুরানি বেগম।মন-মস্তিষ্ক জুড়ে বিভিন্ন চিন্তেরা এসে জায়গা করে নিচ্ছে তার।কি হবে কাল?কি করে এতো বড় ক্ষতি হওয়া থেকে নাফিয়াকে বাঁচাবেন তিনি?যেখানে নাফিয়ার বয়স সবে ১৬ পূর্ণ হয়ে ১৭ তে পড়েছে সেখানে ইরফানের বয়স ৪৮ এর কম নয়।দু’টো বড় বড় ছেলে-মেয়ের বাপ সে।যৌবনকালে টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে স্ত্রী মরার পরও বিয়ে করেনি ইরফান কিন্তু এখন শেষ বয়সে এসে বিয়ে কেন করতে চাইছে? তাও নিজের মেয়ের বয়সী এক কিশোরীকে?
সমাজের অবক্ষয় দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন নুরানি বেগম।এখন সমাজের মানুষ না বয়স দেখে না সম্পর্ক দেখে।এদের মানবিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?
সব চিন্তেরা একে-অপরের সাথে দলা পাকিয়ে পাগল করে দিচ্ছে নুরানি বেগমকে।আর যাই হোক নিজের মৃত বোনের আমানতকে যেমন যত্নে বড় করেছেন তিনি তেমন আজও এই বিপদ থেকে নিজের মেয়েকে যেভাবেই হোক বাঁচাবেন নুরানি বেগম।নিজের চোখের পানি মুছে নেয় সে।অগ্রসর হয় নাফিয়ার কক্ষের দিকে।চোখমুখে কাঠিন্যতা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।এক কঠিন সিদ্ধান্তে মনঃস্থির তার।

নিজের কক্ষে পাতানো পড়ার টেবিলে বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে সহজ এক অংক সমাধান করতে গুনে গুনে ২৫ মিনিট অপচয় করে ফেলেছে নাফিয়া।অথচ অংক মিললো না তার।মাথার মগজ গরম হতেই বই-খাতা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো সে।বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-উফ,কয়টা দিন আগে মাত্র এসএসসি পরিক্ষা ডা শেষ করলাম!কই মাম্মি আমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাবে তা না সে আমাকে ইন্টারের বই খাতা ধরায়ে দিসে।ইন্টারে নাকি সময় কম পড়া বেশি তাই এখন দিয়েই পড়তে হবে।ধুর,স্টুডেন্টসরা কি মানুষ না?এদের জীবনে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নাই?এতো কেন পড়তে হবে?
নাফিয়ার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই কক্ষে প্রবেশ করেন নুরানি বেগম।কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ান তিনি।নুরানি বেগমের চোখ-মুখ স্বাভাবিক ঠেকলো না নাফিয়ার।সে ব্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে উঠলো,
-কি হয়েছে মাম্মি?
উত্তরে সোজাসাপটা দৃঢ় কন্ঠে নুরানি বেগম বলে উঠলেন,
-তোকে পালাতে হবে নুফি।
মায়ের কথায় অবাক হলো নাফিয়া।বোধগম্য হলো না এ কথার অর্থ।তাই জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-কি বললে?
মায়ের কঠিন রূপ হেরে গেলো মমতার কাছে।প্রকাশ পেলো তার দূর্বলতা।চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারলেন না নুরানি বেগম।মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন তিনি।বলে উঠলেন,
-তোকে এখান থেকে পালাতে হবে নুফি।এই দানব টা তোকে বাঁচতে দিবে না।
মায়ের কথায় ধুক করে ওঠে নাফিয়ার হৃদয়।মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়।কি হয়েছে বা কি হতে চলছে বুঝতে পারছে না সে।ভীত ও চিন্তিত কন্ঠে নাফিয়া প্রশ্ন করে ওঠে,
-কি হয়েছে মাম্মি?কাঁদছো কেনো?আর হটাৎ এগুলো কেনো বলছো?
মেয়ের প্রশ্নে সব খুলে বলেন নুরানি বেগম।সবটা শুনে চুপ করে রয় নাফিয়া।কেমন শূন্য শূন্য লাগছে তার।মনে শুধু ঘৃণার পাহাড় জমেছে খালু নামক লোকটার প্রতি।কিন্তু পরিস্থিতি আজ তার প্রতিকূলে।ঠিক যেনো সমুদ্রের মাঝখান টায় ভেসে আছে সে আর চারিপাশে কোনো কূল-কিনারা নেই।খালুর প্রতি ঘৃণা সযত্নে নিজের হৃদয়ে পুষে রাখলো নাফিয়া।সময় কখনো তার অনুকূল হলে একদিন লোকটাকে উচিৎ শিক্ষা দিবে বলে ভেবে রাখলো।
এদিকে নুরানি বেগম নিজের শাড়িতে গুঁজে রাখা ক’হাজার টাকা গুঁজে দিলেন নাফিয়ার হাতে।বললেন,
-এই টাকা টা রাখ নুফি।আমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে লুকিয়ে ছোট্ট একটা ব্যাগে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ঢুকিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকবি।রাতে ঐ লোক ঘুমোনোর পর আমি তোর রুমে এসে তোরে পালায়ে যেতে সাহায্য করবো।বুঝছিস?
-কিন্তু মাম্মি,এতো বছর যেভাবে লোকটাকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে সোজা রেখেছি এবারও একি কাজ করতে পারবো না?আর বাল্যবিবাহ তো এমনিও ক্রাইম।
-না এবার এতে কাজ হবে না।কারণ তোর খালু পুলিশ ভয় পেলেও ইরফান পায় না।ইরফানের যেমন টাকা তেমন পাওয়ার।এসব পুলিশ কেস ও ভয় পাবে না।
শেষ আশার আলো টাও নিভে গেলো নাফিয়ার।মন খারাপের স্বরেই সে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-পালিয়ে আমি যাবো কোথায়?
-ভুলেও তোর কাছের কোনো বান্ধবীর বাসায় যাবি না।এই লোক খুঁজে ফেলবে তোরে।তোর কোন জানি একটা সিনিয়র আপু আছে না?তোরে খুব ভালো জানে?
-রিয়ানা আপু?
-হ্যাঁ।ওর বাসা চিনিস?
-চিনি।
-তাইলে ঐ মেয়ের বাসায় যাবি।থাকতে দিবে?
-দিবে।আপু খুব আদর করে আমাকে।আমি থাকতে চাইলে খুশি হবে।
-আচ্ছা।রিয়ানার নাম্বার দিয়ে যাবি আমাকে।আমি সুযোগ বুঝে কল করে তোর খবর জেনে নেবো।আর প্রথম কিছু দিনের খরচ তো দিয়েই দিলাম।আবার পড়ে সুযোগ বুঝে ঐ মেয়েটার কাছে টাকা পাঠায়ে দিবো, ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
-আর কসম দে তুই নিজে থেকে আমাকে কল দিবি না।কারণ ওরা জানে তুই আমার সাথে অবশ্যই যোগাযোগের চেষ্টা করবি।এ জন্য আমার উপর কড়া নজর রাখবে।তুই কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করলেই ধরা খাবি।আমার অনেক স্বপ্ন তোরে নিয়ে নুফি।এই দানবটার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হতে দেখতে পারবো না মা আমার।যেভাবে পারিস,যত কষ্টই হোক নিজেকে গড়ার চেষ্টা করিস,ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
কথা খানা বলেই নুরানি বেগমকে জড়িয়ে ধরলো নাফিয়া।চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে তার।আল্লাহ কেন তার জীবনটাকে এতো কঠিন বানিয়েছেন?কিভাবে থাকবে সে তার মাম্মিকে ছাড়া?শক্তপোক্ত ভাবে নিজের মাম্মিকে জড়িয়ে ধরে রাখলো নাফিয়া।বিদায় বেলা গোড়ার বেগে তেড়ে আসছে তাদের দিকে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here