#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,৩৬,৩৭
#লেখিকা_মাহযাবীন
#প্রেম
#পর্বঃ৩৬
সন্ধ্যের আকাশ ধূসর বর্ণে আবৃত হয়ে আছে।চারিপাশে বয়ে চলছে সন্ধ্যে হাওয়া।সবে গাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের চারপাশটায় চোখ বুলোতে আরম্ভ করেছে নাফিয়া।এ এক জমকালো একালা।রাস্তার দু ধারে রয়েছে বেশ কয়েকটি টং এর দোকান।সেথায় আড্ডায় মজেছে কিশোর বয়সী থেকে শুরু করে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া ব্যক্তিবর্গও।রয়েছে হরেকরকমের খাবারের ছোট ছোট ভ্যান।মানুষ সেসব ভ্যানের চারিপাশে জড়ো হয়ে খাবারের সাথে সাথে উপভোগ করছে নিজেদের আড্ডাও।রিকশা,
গাড়ি ইত্যাদির কোলাহলে চাপা পরে যাচ্ছে কলেজ,ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের আড্ডার আসরের অকৃত্রিম হাসির শব্দগুলো।
নিজের চারপাশটা দেখতেই মন উৎফুল্লতা লাভ করে নাফিয়ার।ঠোঁটে অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে তার।এরই মাঝে হটাৎ নিজের হাতে এক ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পায় সে।নিজের পাশে চোখ ফেরাতেই সে দেখতে পায় তার নিজের ব্যক্তিগত পুরুষটাকে।ছেলেটার ঠোঁটে ফুটে আছে এক চিলতে হাসি।হাসি প্রশস্ত হয় নাফিয়ার।একে-অপরের চোখ পানে তাকিয়ে পাড় করে কয়েক সেকেন্ড।অতঃপর দৃষ্টি সরায় আফিম।প্রেয়সীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
গরম গরম মম বিক্রি করছেন এক দাদু।বয়স ৬০ এর মতো হবে হয়তো।আফিম এই দাদুর কাছেই এলো প্রথমে।বলে উঠলো,
-দাদু,৬ পিস মম দেও তো।
বৃদ্ধ হাসলেন একগাল।বলে উঠলেন,
-অহনই দিতাছি।
ঠোঁটে হাসি নিয়ে আফিম তাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-দাদি আছেন?
-হ আছে।ও ই তো বানায়া দিছে এডি।পুতের বউ গোর তে বানানো হিকছিলো কয়বছর আগে।হের পর তে এই ব্যবসা করতাছি যত বছর ধইরা সব মম ও-ই বানায়া দেয়।এডি কইরা ভালাই দিন কাটে আমগো বুড়া-বুড়ির।
ঠোঁটে মুগ্ধতার হাসি ফুটে আফিম-নাফিয়া উভয়েরই।
স্বামী-স্ত্রী যে একে-অপরের পরিপূরক হয় তা এই বৃদ্ধ দম্পতির দিকে চাইলেই সহজে উপলব্ধি করা যায়।আধা দায়িত্ব স্বামীর তো আর আধা স্ত্রীর।এভাবেই তো সব কিছু ভাগাভাগি করে নেয় একজোড়া নর-নারী।কাটিয়ে দেয় বছরের পর বছর একসাথে।
ধোঁয়া উড়া মমর প্লেট নিজের হাতে নেয় আফিম।প্লেট হতে একটি মম হাতে তুলে ফুঁ দিয়ে তা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনার চেষ্টা করছে সে।
অপর দিকে,মম গুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাফিয়া।খুদায় পেটে ইদুরের জায়গায় হাতি দৌড়াচ্ছে তার।তবুও গরম মম হাতে তোলার সাহসও হচ্ছে না মেয়েটার।ফলে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় না পেয়ে অসহায় দৃষ্টিতে আফিমের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনে মনে ভাবছে আফিমের হাতের মম টা আফিম নিজে খাবে নাকি এক আদর্শ প্রেমিকের ন্যায় তাকে খাইয়ে দিবে?
এ প্রশ্নের উত্তর ভেবে বের করার পূর্বেই আফিম নিজের হাতের মম এগিয়ে দেয় নাফিয়ার দিকে।ইশারায় বুঝায় মুখ ‘হা’ করতে।অবাক হয় নাফিয়া, খুশি হয় মন,মুগ্ধ হয় অন্তরাত্মা।
মম খাওয়া শেষে আবারও নাফিয়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো আফিম।একটু সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো পাস্তা,চাউমিন,বার্গার বিক্রি হচ্ছে এক ভ্যানে।তার বিপরীতে দই ফুচকা,পাপড়ি চাট এসব বিক্রি হচ্ছে।সেই সাথে আরেকটু সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন স্যুপ বিক্রেতা।কোনটা রেখে কোনটার কাছে যাবে তা নিয়ে বিপাকে পরে গেলো আফিম।থেমে গেলো তার কদম।ছেলেটির বিড়ম্বনা বুঝলো নাফিয়া।আফিমের ধরে রাখা হাতে আলতো চাপ দিয়ে সে বলে উঠলো,
-দই ফুচকা ট্রাই করি?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো আফিম।এগিয়ে গেলো সে ভ্যানের দিকে।চাইলো এক প্লেট দই ফুচকা।ব্রু দ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ পড়লো নাফিয়ার।সব খাবারই আফিম এক প্লেট অর্ডার করছে কেনো?এতো বড় বিজনেসম্যান নির্ঘাত টাকার চিন্তে করছে না।তবে কারণ টা কি ‘প্রেম’?একই প্লেটে ভাগাভাগি করে খাওয়াটাকে প্রেম বলে?নিজের হাতে ভালোবাসার মানুষটাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া টাকে প্রেম বলে?প্রথমে নিজে না খেয়ে ভালোবাসার মানুষটার মুখে খাবার তুলে দেওয়াটাকে প্রেম বলে?
এগুলোই কি আফিমের প্রেম?
এসব ভেবে আনমনে মৃদু হেসে ওঠে নাফিয়া।মুখশ্রী জুড়ে ফুটে ওঠে লাজুকতা।এ মুখশ্রীতে চোখ পরে আফিমের।ব্রু দ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে সে ইশারায় জিজ্ঞেস করে ওঠে, “হাসির কারণ কি?”
মাথা ডানে-বামে ঘুড়িয়ে নাফিয়া বুঝায়,”কোনো কারণ নেই”।
এক দমকা হাওয়া চুল কিছুটা এলোমেলো করে দিলো নাফিয়ার।কয়েকটি চুল এসে আঁচড়ে পড়লো তার মুখশ্রীতে।বিলম্ব করলো না আফিম।সযত্নে গুছিয়ে দিলো প্রেয়সীর অবাধ্য চুলগুলো।মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইলো নাফিয়া।একটা পুরুষ ঠিক কতটা যত্নশীল হতে পাড়ে?
ফুচকার প্লেট হাতে পেয়ে পূর্বের ন্যায় এবারও প্রথম ফুচকা টা আফিম নাফিয়ার দিকেই এগিয়ে দিলো।কিন্তু বাঁধ সাধলো মেয়েটি।আফিমের হাত থেকে ফুচকার প্লেট টা নিজের হাতে নিয়ে নিলো সে।চামচে ফুচকা তুলে আফিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
-আধা-আধা তো!আগের বার আপনি খাইয়ে দিয়েছেন তাই এবার খাইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।
নাফিয়ার কথা শুনে মৃদু হাসে আফিম।তৃপ্তির সহিত মুখ হা করে নেয় সে।প্রিয় মানুষের হাতে বিষ ও তো অমৃতের ন্যায়।তাই এই অমৃত পানে বিলম্ব করলো না এ প্রেমিক।
!!
“স্যার,গরম খবর! আফিম ইবনান ও নাফিয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে চুটিয়ে প্রেম করছে।মিঃইবনান প্রেমে এতোটাই মগ্ন যে সে নিজের অবস্থানই ভুলে গেছে।রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তার খাবার খাচ্ছে সে।সাথে নেই কোনো বডিগার্ড আর না আছে কোনো সেফটির ব্যবস্থা।স্যার,আজই সুবর্ন সুযোগ।আসমানের টিকিট কেটে দেই দ্যা গ্রেট ফ্যাশন ডিজাইনার মিঃআফিম ইবনানের জন্য?”
চোখমুখে খুশির ঝলক শাহীন সাহেবের।হৃদয়ে টান টান উত্তেজনা।ওপাশ হতে অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা মাত্র।একটি ইতিবাচক সাড়া পাওয়া মাত্রই আফিমের উপর তাক করা হবে বন্দুক।ক্ষত-বিক্ষত করে দেওয়া হবে ঐ প্রশস্ত, চওড়া বুকখানা।
-সবর করেন শাহীন মিঞা।ওরা প্রেম করছে করতে দিন না!ভিলেন হতে চাচ্ছেন কেনো?ওরা যত প্রেম করবে ততই সফল হবো আমি আমার পরিকল্পনায়।
বসের কথা কানে আসতেই শাহীন সাহেবের ঠোঁটের হাসি নিজের অস্তিত্ব হারালো।বসের কথাগুলো ঠিক বোধগম্য হলো না তার।সে প্রশ্ন করে উঠলো,
-বুঝলাম না স্যার।এতো সুন্দর সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইছেন?মিঃইবনানকে ছেড়ে দিবো আজ?
উত্তরে রহস্যময়ী হাসেন লোকটা।বলে ওঠেন,
-আফিম ইবনান এতো সহজ মৃত্যু ডিজার্ভ করে না।আমি ওকে এমন জীবন দিবো যে ও মৃত্যু কামনা করবে আর যখন ওকে মৃত্যু দেবো তখন ও আফসোস করবে,বাঁচতে চাইবে।
ভয়ে মৃদু ঢোক গেলেন শাহীন সাহেব।এতোদিন সে ভাবতো তার বস শুধু আফিমকে মেরে তার শত্রুতা শেষ করতে চায়।কিন্তু এবার তার মনে হচ্ছে সে কিছুই জানে না তার বসের সমন্ধে।এই লোকের পরিকল্পনার গভীরতা অনেক।সেই গভীরতা সমন্ধে অবগত নন শাহীন সাহেব।মুহূর্তেই সবকিছু ধোঁয়াশা লাগতে আরম্ভ করেছে তার কাছে।সে শূন্য মস্তিষ্কে প্রশ্ন করে উঠলো,
-স্যার,এসবের সাথে আফিম আর নাফিয়ার প্রেমের কি সম্পর্ক?
-সম্পর্ক আছে শাহীন মিঞা।বলতে গেলে আমার সম্পূর্ণ প্লানটার বেজ(base) ই হচ্ছে আফিম-নাফিয়ার বিয়ে।ওদের বিয়ে হওয়াটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য।
-কিন্তু কেনো স্যার?
এ প্রশ্নের উত্তর পেলেন না শাহীন সাহেব।ফোনের ওপাশ হতে কল কেটে দেওয়া হয়েছে।
!!
সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ,আছে বড়সড় কয়েকটি গাছ।মাথার উপর বিশাল আকাশ আর তার বুকেতে চাঁদ। হাতে-হাত দুজন মানব-মানবীর।ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের।হাঁটার এক পর্যায়ে থেমে যায় আফিম।তাকায় নাফিয়ার দিকে।উভয়ের দৃষ্টি একে-অপরের নয়নে।নাফিয়ার চোখে প্রশ্ন, “থেমে গেলেন কেনো?”
আফিমের চোখে গভীর কিছু উত্তর।নাফিয়ার হৃদয় সে উত্তর পড়তে পারলো না,ব্যর্থ হলো।
আফিম বলে উঠলো,
-এই ওয়েদার কিছু একটা চাচ্ছে,মিস.শেখ।
-কি চাচ্ছে?
বাঁকা হাসলো আফিম। নিজের ফোন বের করে তাতে গান ছেড়ে রাখলো ঘাসের উপর।অতঃপর নাফিয়ার কাছে এগিয়ে এসে নিজের ডান হাত মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
-Will you dance Miss. Sheikh?
আফিমের এহেন প্রস্তাবে হাসি ফুটলো নাফিয়ার ঠোঁটে।বলে উঠলো,
-Why not?
কথা খানা বলে হাত রাখলো আফিমের হাতে।অন্য হাতে মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো আফিম।একে-অপরের চোখে চোখ রেখে গানের তালে তাল মিলিয়ে দুলছে দু’জনে।হটাৎ নাফিয়া বলে ওঠে,
-আপনার এ রূপ এই ক’মাসে একবারও দেখিনি আফিম।আজ কেমন নতুন নতুন লাগছে আপনাকে।
মৃদু হাসে আফিম। বলে ওঠে,
-এতো দিন যাকে দেখেছো সে আফিম ইবনান, শিল্পপতি আরহান ইবনানের একমাত্র উত্তরাধিকার। আর আজ যাকে দেখছো সে আফিম।শুধু আফিম।যার স্টাটাস মেইনটেইন করে চলতে হয় না।
মুগ্ধ নাফিয়া।বারংবার এই মানুষটাতে মুগ্ধ হতে বাধ্য হয় সে।মুগ্ধতার ছাপ ফুটে ওঠেছে তার মুখশ্রীতে।আর এই মুখশ্রীতে দৃষ্টি আবদ্ধ আফিমের।
ল্যামপোস্টের হলদে আলো নাফিয়ার মুখে আঁচড়ে পরায় হদলে আভা ফুটে উঠেছে তার মুখে।মৃদু ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলায় অবাধ্য ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে জায়গা করে নিচ্ছে মুখশ্রীতে।আফিম অপলক তাকিয়ে দেখছে এ দৃশ্য।আনমনে তার হাত কপাল ছুঁলো নাফিয়ার।অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে দিলো সে।চোখ গেলো নাফিয়ার শুকনো ঠোঁট জোড়ায়।নিষিদ্ধ কামনার উদয় ঘটতে আরম্ভ করলো আফিমের হৃদয়ে।তৃষ্ণার্থের ন্যায় নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো নাফিয়ার ঠোঁট পানে।ক’সেকেন্ড তাকিয়ে কাটাবার পর ঢোক গিললো সে।দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলো খানিক।কিন্তু অবাধ্য কামনারা নিষেধাজ্ঞা মানতে নারাজ।আফিম আবারও দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নাফিয়ার ঠোঁটে।এই ওষ্ঠদ্বয় যেনো চুম্বকের ন্যায় কাছে টানছে তাকে।
আফিমের আচরণ কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে নাফিয়ার।সে নাচ থামিয়ে এক হাত রাখে আফিমের গালে।চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-ঠিক আছেন আফিম?পানি লাগবে?পানি খাবেন?
আফিম অসহায় চোখে তাকায় নাফিয়ার দিকে।বলে ওঠে,
-আচ্ছা আমি যদি এখন ভয়ংকর কিছু করে বসি তাহলে খুব কি অন্যায় হবে?
আফিমের এমন প্রশ্নের অর্থ বোধগম্য হলো না নাফিয়ার।সে ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-মানে?
নাফিয়ার প্রশ্নে চোখ বুঁজে নিলো আফিম।জোরে এক নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে চোখ মেলে তাকালো সে।আর সময় অপচয় করলো না।দু’হাতে নাফিয়ার গাল আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে মেয়েটিকে মিশিয়ে নিলো আফিম।ঠোঁট রাখলো নাফিয়ার নরম ওষ্ঠে।বহুকালের তৃষ্ণার্থের ন্যায় শুষে নিতে আরম্ভ করলো প্রেমের অমৃত।
চলবে।
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৩৭
“তোকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে আজ।তাই অফিসে যাইতে হবে না, ছুটি নে।”
কথাগুলো বলে মেয়ের কক্ষ ত্যাগ করবার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন রাহেলা বেগম।কিন্তু মাঝ পথে থেমে যান মেয়ের কন্ঠস্বর শুনে।
“বলা নেই, কওয়া নেই ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে মানে?”
চোখমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে মেয়ের দিকে তাকান রাহেলা বেগম।চরম বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠেন,
-আপনি কি মহারানী যে আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে কাজ করতে হবে?শুকরিয়া আদায় করেন যে ছবিতে আপনার এই কালা চেহারা দেখেও কেউ দেখতে আসতে চেয়েছে।
-মা,এতো বছরেও কালা না ডেকে আমাকে কৃষ্ণকলি ডাকতে শিখলে না? আর আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।
-তোর চাওয়া না চাওয়া কেউ জানতে চায়নি কুসুম। যা বলেছি চুপচাপ কর।তোর এই কাইল্লা রং দেখে কে চাইবে তোরে বিয়ে করতে?তাও একজন যে একটু আগ্রহ দেহাইতেছে তাতে শুকরিয়া নাই কেন তোর?
-আমি অ্যাডাল্ট মা।বড় হয়েছি,অন্তত বিয়ে কখন করবো সে ডিসিশন নেওয়ার অধিকার আমার আছে।আর আমি তো তোমাদের কাঁধে বোঝা নই।নিজে কামাচ্ছি এবং নিজের টাকায় নিজে চলি।তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে তোমাদের মাধ্যমে আমি এই সুন্দর পৃথিবীতে এসেছি আর ছোট থেকে তোমরা আমাকে লালন-পালন করে বড় করেছো।এই কৃতজ্ঞতার জন্য তোমাদের খুশি রাখার বা তোমাদের কষ্ট কমাবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করি মা।কিন্তু বাস্তবতা কি জানো?আমার এই চেষ্টা টা আমার কালো রং এর নিচে ঢেকে যায়।তোমরা শুধু আমার গায়ের কালো রং টাই দেখো কিন্তু আমার মনে তোমাদের জন্য থাকা সম্মান, ভালোবাসা টা দেখো না,দেখতে পারো না।
কথাগুলো বলে আর কক্ষে দাঁড়ায় না কুসুম। জলে টইটম্বুর চোখজোড়া নিয়ে ছোটে বেলকনির দিকে।চোখের পানিগুলোকে সে কারো সামনে ঝরার অনুমতি দেয় না।কারণ সে চায় না কেউ তাকে দুর্বল ভাবুক।তার দূর্বলতা একান্তই তার।
মেয়ের চোখে জমা হওয়া অশ্রু দৃষ্টি এড়ায় না রাহেলা বেগমের।মেয়ের মনের ভাব বোঝেন তিনি।কিন্তু ছোট থেকে সমাজের কটুক্তি তার মাঝে যেনো বিষ ভরে দিয়েছে।ঐ বিষের প্রভাবে নিজের সন্তানের সাথে সেই ছোট থেকেই খারাপ আচরণ করতে বাধ্য হন তিনি।মনে করেন, কুসুম তার গর্ভের কলঙ্ক।এই কৃষ্ণ বর্ণের মেয়ের বিয়ে কি করে দিবেন তা নিয়ে তার থেকে পাড়াপড়শির চিন্তাই যেনো খুব বেশি।মা হওয়ায় মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তে তো তার নিজেরও কম হয় না।তাই তো চাইছিলেন বিয়ে দিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে।
নিজের দৃষ্টি খোলা আকাশে আবদ্ধ করে কুসুম।নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-কি ভাবছেন, অভিযোগ করবো?বলবো যে,কেনো বানালেন আমাকে কৃষ্ণকলি?
উহু না,আমি এমন কিছুই করবো না।কারণ আমার নিজের স্রষ্টার প্রতি অর্থাৎ আপনার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে আপনি যা করেন ভালোর জন্য করেন।
এই সুন্দর-অসুন্দরের সংজ্ঞা কারা বানিয়েছে?কোন গ্রন্থে লেখা আছে ফর্সা মানেই সুন্দর আর কালো মানেই অসুন্দর?
আপনি (স্রষ্টা) কি দিয়েছেন সুন্দরের সংজ্ঞা? দেননি তো।তাহলে আপনার সৃষ্টিকে সুন্দর ও অসুন্দরের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আমরা কে?
আমার কাছে আমি সুন্দর।কারণ পৃথিবীর কোনো মুসলিম কাবাঘরকে অসুন্দর বলতে পারবে না।ইভেন অমুসলিমরাও কাবাঘরের সৌন্দর্য অস্বীকার করতে পারবে না।কালো হয়েও কাবাঘর যদি সুন্দর হয় তাহলে আপনার দেওয়া আমার এই কালো বর্ণা রূপ অসুন্দর হবে কেনো?
আমি সুন্দর, অবশ্যই সুন্দর আলহামদুলিল্লাহ।
কথাগুলো বলে শেষ করে চোখ বুঁজে নেয় কুসুম। ওমনি চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরে নোনতা দুঃখ কণা।তার মন চিৎকার করে বলে ওঠে,
“কুৎসিত সমাজ আমার শুনে রাখো,
আমার গায়ের রং কালো এটা আমার দোষ না।এটা তোমার স্রষ্টার সৃষ্টি।অকৃতজ্ঞ, নেমকহারাম তোমরা তাই জন্যেই নিজের স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি সম্মান দেখাতে জানো না,স্রষ্টার সৃষ্টিতে সন্তুষ্ট হতে জানো না।তোমাদের মতো গুটিকয়েক মানুষের নজরে আমি সুন্দর নাই বা হলাম।কিন্তু আমার নজরে আমি সুন্দর আর এতোটুকুই যথেষ্ট।”
মনে মনে কথাগুলো আওড়িয়ে চোখ মেলে তাকায় কুসুম।ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে ডানহাত দ্বারা মুছে নেয় নিজের দুঃখ কণাগুলোকে।সন্তুষ্ট চোখে তাকায় আকাশ পানে।মনে মনে ভাবে,
আজ সে কিছু টাকা কামাবার যোগ্যতা রাখে দেখেই জোর গলায় নিজের মাকে বলতে পেরেছে, “আমি তোমাদের উপর বোঝা নই”। আজ সে কামায় দেখেই নিজের মতামত প্রকাশ করতে পেরেছে।নাহয় বাধ্য হয়ে নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি তাকে দিতেই হতো।প্রথমে বাবার টাকার উপর নির্ভর করে অর্ধেক জীবন পাড় করবার পর বাকি অর্ধেক জীবন স্বামীর টাকায় পাড় করতে হতো।সেই সাথে খোঁটা শুনতে হতো, উঠতে বসতে টাকার হিসেব দিতে হতো এবং নিজের ইচ্ছায় ১ টাকা খরচ করার আগে ভাবতে হতো ১০০ বার।
প্রতিটি মেয়েরই উচিৎ নিজের পায়ে দাঁড়ানো।টাকার অংক খুব কম হলেও কামানোর চেষ্টা করা উচিৎ। অন্তত ভিক্ষা দেওয়ার জন্য ৫ টাকার প্রয়োজন হলে সেটা যেনো অন্য কারো কাছ থেকে চেয়ে নিতে না হয় সেজন্য হলেও মেয়েদের কামানো উচিৎ।অবশ্যই তা শালীনভাবে।টাকা কামানোর জন্য অশালীন হওয়ার প্রয়োজন নেই অন্তত জামা খোলার প্রয়োজন তো নেই-ই।
!!
প্রতিদিনের ন্যায় আজও সকাল সকাল গোসল সেরে নিয়ে নিজ কক্ষ ত্যাগ করে নাফিয়া।নিজ কক্ষ হতে বেরিয়ে আসতেই দর্শন পায় আফিমের।চোখে চোখ পরে দু’জনার।আফিমের চেহারা পানে তাকাতেই নাফিয়ার মনে পরে যায় গত রাতের স্মৃতি।মুহুর্তেই লাল আভা ফুটে ওঠে তার সমস্ত মুখশ্রী জুড়ে।চোখ নামিয়ে নেয় সে নিজের।আফিমের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ায় নিজের কদম।
নাফিয়ার এমন লজ্জার কারণ বুঝতে অসুবিধে হয় না আফিমের।সে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসে।
নাফিয়া তার পাশ কাটিয়ে যেতে অগ্রসর হতেই মেয়েটির ডান হাত ধরে এক হেঁচকা টানে তাকে নিজের বুকে নিয়ে আসে আফিম।আচমকা আফিমের এমন আক্রমণে চমকে ছেলেটির চোখে চোখ রাখে নাফিয়া।আফিম নিজের এক হাত রাখে নাফিয়ার গালে।বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা গালে হাত বুলোতে বুলোতে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-i wanna bite here Miss. Sheikh.
লজ্জা আরো বৃদ্ধি পেলো নাফিয়ার।আফিমের চোখে চোখ রাখা দুষ্কর ঠেকছে তার কাছে।চোখ নামিয়ে নিলো সে।আফিমের বুকে চাপ প্রয়োগ করে নিজেকে তার বাহুবন্ধন হতে মুক্ত করবার চেষ্টা করতে আরম্ভ করলো সে।
মৃদু প্রশস্ত হয় আফিমের ঠোঁটের বাঁকা হাসি খানা।সে বলে ওঠে,
-অযথাই নিজের এনার্জি নষ্ট করছো।এর চেয়ে এনার্জিগুলো আদরে ইনভেস্ট করতে পারতা।ফিডব্যাকে ভালো প্রফিট পাইতা।অবশ্য চাইলে এখনো পারো কিন্তু!
আফিম কথাগুলো শেষ করতে না করতেই আরহান সাহেবের কক্ষের দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসে।ওমনি একে-অপরের কাছে থেকে দূরে সরে দাঁড়ায় তারা।আফিমের চোখমুখে ফুটে ওঠে চরম বিরক্তি আর নাফিয়ার ঠোঁট জুড়ে হাসি।
আরহান সাহেব কক্ষ হতে বেরিয়ে আসতেই দেখা পান আফিম-নাফিয়ার।ঠোঁটে হাসি টেনে এগিয়ে আসেন তাদের দিকে।
-আসসালামু আলাইকুম বাবা,শুভ সকাল।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা।
হেসে নাফিয়ার সালামের উত্তর দেন আরহান সাহেব। অতঃপর নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
-আফিম,কয়েকজন নিকটাত্মীয় খুব করে বলছেন তাদের বাড়িতে দাওয়াতে যেতে।অনেক বছর হলো কারো সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না।এখন দেখা করা উচিৎ।কি বলো?
-জ্বি।
-তা একা গেলে কেমন দেখায়?তুমিও চলো সঙ্গে?
-আমি ভীষণ ব্যস্ত,সময় বের করতে পারবো না।স্যরি।
-আফিম,আমি ১৫ বছর পর দেশে ফিরেছি!তোমার কি উচিৎ না নিজের বাবার জন্য একটু সময় বের করা?
-আমার জন্য এসেছেন?আমার জন্য আসলে ১৫ বছর আগেই আসতেন।যখন আমার আপনাকে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিলো।
-তোমার কথা চিন্তা করেই তখন আসিনি।
আরহান সাহেবের কথায় ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে আফিমের।উত্তরে কিছু না বলে দ্রুত কদম ফেলে সে স্থান ত্যাগ করে ছেলেটা।আর তার যাওয়ার পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় দুইজোড়া দৃষ্টি।একজোড়া আরহান সাহেবের আর আরেক জোড়া নাফিয়ার।
চলবে।