আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,৩৮,৩৯

0
1219

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,৩৮,৩৯
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৩৮

কলেজ জীবনের সূচনা আজ।আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে।বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব।সবেই কলেজের মেইন গেট অব্দি নাফিয়াকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে আফিম।ছেলেটা প্রস্থান করতেই নাফিয়া এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে কলেজ বিল্ডিং এর ধারে।কিন্তু মাঝ পথে দাঁড়িয়ে পরে সে।কলেজের সামনের খোলা মাঠে কপালের মাঝখান টা দু’হাতে চেপে ধরে রেখে আকাশের দিকে তাকায় মেয়েটা।যেকোনো মুহুর্তে শুরু হবে বর্ষণ।তা লক্ষ্য করে নাফিয়া মনে মনে বলে উঠলো,
-প্রিয় মেঘমালা, প্লিজ এখনই ধরণীর বুকে নেমো না।দেখছো না আমার কপালে উনার চুমু লেগে আছে।বিল্ডিং অব্দি যাওয়ার আগেই যদি তুমি বর্ষিত হও তাহলে এই স্পর্শ মুছে যাবে।আর তা আমি চাই না,একটুও চাই না।
মেঘেরা যেনো শুনলো নাফিয়ার আকুতি।তারা অপেক্ষা করলো মেয়েটার বিল্ডিং অব্দি পৌঁছানোর।অদ্ভুতভাবে নাফিয়া বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করতেই শুরু হয়ে গেলো বর্ষণ।সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটালো নাফিয়া।মনে মনে বলে উঠলো,
“ধন্যবাদ”

!!
কলেজ জীবনে পদার্পণে শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎফুল্লতা,উত্তেজনার অন্ত নেই।অনেকেই ব্যস্ত নতুন বন্ধু বানাতে আবার অনেকেই ভাগ্যক্রমে স্কুল জীবনের বান্ধবীদের পেয়েছে কলেজ জীবনেও।চলছে জমিয়ে আড্ডা।ক্লাসরুমের দরজার ধারে দাঁড়িয়ে এসবই লক্ষ্য করলো নাফিয়া।পুরো কক্ষটায় চোখ বুলিয়ে নিলো সে।এতো এতো হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে শুধু একটি মেয়েই চুপচাপ বসে আছে সামনের দিকের এক বেঞ্চের কোণে।নাফিয়া সোজা গিয়ে বসলো সেই মেয়েটির পাশে।মেয়েটি এক ধ্যানে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।বুঝা যাচ্ছে পড়ায় তার মন নেই,বইয়ের দিকে তাকিয়ে অন্য কোনো চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে সে।
মেয়েটাকে কেমন স্বাভাবিক ঠেকলো না নাফিয়ার।কেনো যেনো তার মনে আগ্রহ জন্মালো মেয়েটি সমন্ধে জানতে।অতঃপর সে নিজে থেকেই বলে উঠলো,
-হাই!
নাফিয়ার কথায় ধ্যান ভাঙ্গলো মেয়েটির।অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসলো সে।তাকালো নাফিয়ার দিকে।ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে আবারও নিজের দৃষ্টি আবদ্ধ করে নিলো বইয়ে।
মেয়েটির এমন আচরণ নাফিয়ার আগ্রহ আরো বাড়ালো।সে নিজে থেকেই আবারও বলে উঠলো,
-আমি নাফিয়া, তুমি?
-জাফরান।
-সুন্দর নাম।তুমি কি খুব কম কথা বলো?
এবার জাফরান তাকালো নাফিয়ার দিকে।এক দীর্ঘ শ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে বলে উঠলো,
-এক সময় সবাই আমাকে বাঁচাল বলতো।
-এখন আর বলে না?
উত্তরে না বোধক মাথা নাড়লো জাফরান।নাফিয়া আবারও প্রশ্ন করলো,
-কেনো?
মেয়েটি উত্তর দিলো না।কথা ঘুরাতে বলে উঠলো,
-তোমার বাসায় কে কে আছে?
নাফিয়া বুঝলো জাফরান তার ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে স্বস্তিবোধ করছে না।না করাটাই স্বাভাবিক।এক অপরিচিতাকে তো আর মনের কথা সব বলা যায় না।ব্যাপার খানা স্বাভাবিকভাবে নিয়ে নাফিয়া মেয়েটার করা প্রশ্নের উত্তর দিলো,
-আমার হাসবেন্ড আর বাবা।
মুহূর্তেই চোখমুখে অবাক হওয়ার ছাপ ফুটে উঠলো জাফরানের।সে আশ্চার্যান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-তোমারও বিয়ে হয়ে গেছে?
জাফরানের প্রশ্নে নাফিয়া হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-তুমিও বিবাহিত?
মেয়েটি উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো।
বিয়ের ব্যাপারটা নাফিয়ার কাছে স্বাভাবিক ঠেকলেও তার পাশে বসে থাকা মেয়েটির ক্ষেত্রে হয়তো তা স্বাভাবিক ঠেকলো না বরং তা হয়তো এক বিভৎস, ভয়ংকর বাস্তবতা তার জন্য।

!!
কলেজ শেষে আফিমের সাথে সোজা অফিসে ফিরেছে নাফিয়া।আফিমের ক্যাবিনের সাথে পারসোনাল ওয়াশরুম ও ছোট একটি বিশ্রাম নেওয়ার কক্ষ আছে।ফলে সুবিধেই হলো মেয়েটার। ক্যাবিনের সাথে থাকা সে ওয়াশরুমে নিজের গোসল সেরে নিচ্ছে সে।রাস্তায় অবশ্য আফিম তাকে বলেছিলো অফিসে না এসে বরং বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিতে।কিন্তু সে নিজ থেকেই নাকচ করে দিয়েছে।আসলে প্রিয় মানুষটার কাছে কাছে থাকার বাহানা কুড়োতে তার ভালোই লাগে।

গোসল শেষে ওয়াশরুম হতে ক্যাবিনে প্রবেশ করে নাফিয়া।দেখতে পায় আফিম কোনো একটা ফাইল বেশ মনযোগ দিয়ে দেখছে আর তার সামনের টেবিলটায় বেশ কয়েকটা ফাইল এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
নাফিয়া এগিয়ে গিয়ে ফাইলগুলো গুছতে আরম্ভ করলো।তার দিকে তাকালো আফিম।বলে উঠলো,
-ব্লু কালারের ফাইলগুলো শুধু একসাথে করে আমার কাছে দেও।অন্যগুলোর এখন প্রয়োজন নেই।
নাফিয়া মাথা নাড়িয়ে আফিমের কথামতো কাজ করে অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো উঠিয়ে রাখলো সেল্ফে।
এরই মাঝে লাঞ্চ ব্রেক পড়ে গেল।একজন লোক খাবার নিয়ে এলো আফিমের ক্যাবিনে।নাফিয়া সে খাবার প্লেটে বেড়ে দিতে দিতে ডেকে উঠলো আফিমকে।নাফিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে ফাইল টেবিলের উপর রেখে হাত ধুয়ে এসে সোফায় বসলো আফিম।অতঃপর উভয়ই একসাথে খাওয়া শুরু করলো।

খাওয়ার মাঝেই আচমকা নাফিয়ার মাথায় একটা চিন্তা এলো।সে ভাবলো তার শশুরের বলা একটা কথা নিয়ে।আরহান সাহেব বলেছিলেন,
প্রতিটি সত্যেরই দুটো দিক থাকে।আফিম একটি জানে, আরেকটি জানে না।অর্থাৎ অপরদিকের সত্যটি আফিম জানলে হয়তো বাবা-ছেলের এই অভিমানের অন্ত হবে।
বিষয়টি মাথায় আসতেই বুদ্ধি আঁটতে আরম্ভ করলো নাফিয়া।কিভাবে কি করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করলো সে।

!!
কাজের মাঝেই কুসুম এক পলক তাকায় রিয়াদের দিকে।ছেলেটা পুতুলের গায়ে কাপড় জড়িয়ে তার ডিজাইনের কাজ করছে।
তা দেখে নিয়ে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো কুসুম।মনোযোগী হলো নিজের কাজে।পূর্বের দিনগুলোয় লাঞ্চ ব্রেকের সময়ও যখন রিয়াদ কাজে মগ্ন থাকতো তখন কুসুন নিজ থেকে তার কাছে গিয়ে বলতো,
“মে আই হেল্প ইউ স্যার?”
রিয়াদের উত্তর যাই হোক সে ঠিকই কাজে সাহায্য করে সুযোগ করে দিতো যাতে ছেলেটা কিছুটা সময়ের জন্য বিরতি নিতে পারে।
আবার মাঝে মাঝে রিয়াদের ক্লান্ত মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করে নিজ থেকে কফি বানিয়ে নিয়ে যেতো যাতে রিয়াদের ক্লান্তি কিছুটা কমে।
নিজের ‘কৃষ্ণকলি’ ফেসবুক আইডি দিয়ে মাঝে মাঝে রিয়াদকে জ্বালাতোও তো সে-ই।
কিন্তু এখন সব বন্ধ করে দিয়েছে সে।এসবে আর মনোনিবেশ করতে চায় না কুসুম।
আসলে কুসুম ভুলে গিয়েছিলো, সে তার নিজের চোখে সুন্দর কিন্তু এই সমাজের চোখে নয়।রিয়াদ তো এই সমাজেরই বাসিন্দা।তার চোখেও হয়তো কুসুম কুৎসিত।
কুৎসিত কিছুকে কি মানুষ ভালোবাসে?

!!
অনেক ভাবনা-চিন্তার পর অবশেষে নাফিয়া বলে উঠলো,
“আফিম আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”
ফাইল হতে চোখ তুললো আফিম।নাফিয়ার চেহারা পানে তাকাতেই ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ পরলো তার।বুঝলো নাফিয়া গুরুতর কোনো এক বিষয়ে কথা বলতে চাইছে।ফাইল খানা টেবিলের উপর রেখে সে নাফিয়াকে প্রশ্ন করে উঠলো,
-কি কথা?
নাফিয়া জিহবা দ্বারা নিজের ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
-আপনি কি কখনো বাবার কাছ থেকে কোনো এক্সপ্লেনেশন নিয়েছিলেন?বা বাবাকে নিজের দিক টা আপনার কাছে উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়েছিলেন?
আফিম বুঝলো নাফিয়া কি করতে চাইছে।তাই আগ্রহ হারালো সে নাফিয়ার কথাগুলো শোনার।আবারও হাতে তুলে নিলো ফাইল খানা।বলে উঠলো,
-এসবে নিজেকে জড়িয়ো না,মিস. শেখ।
এবার আফিমের দিকে এগিয়ে গেলো নাফিয়া।হাত থেকে ফাইলটা টেনে নিয়ে রেখে দিলো টেবিলে।আফিমের কোলে বসে দু’হাতে ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
-মিস. শেখ না মিসেস. আফিম ইবনান আমি।বুঝছেন?এখন যা বলতেছি তা চুপচাপ শুনবেন।

নাফিয়ার এমন রূপ দেখে মৃদু চমকালো আফিম।তবে পরমুহূর্তেই বাঁকা হেসে জড়িয়ে ধরলো নাফিয়ার কোমর।বলে উঠলো,
-যদি না শুনি?
-আপনার কাছে না শোনার অপশন নেই আফিম। শুনতেই হবে।
-আচ্ছা শুনবো।
ঠোঁটে হাসি নিয়েই উক্ত শব্দদ্বয় বললো আফিম।হাসি ফুটে উঠলো নাফিয়ার ঠোঁটেও।সে হাসি হাসি মুখেই বলতে আরম্ভ করলো,

-রাগ,অভিমান থাকা ভালো।এসব অনুভূতির প্রয়োজন আছে কিন্তু চাপা অভিমান আর মাত্রাতিরিক্ত রাগ সুন্দর একটা সম্পর্কে ইতি টেনে দেয়।দুরত্ব বাড়ায়,ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে আর সম্পর্কের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়।সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই চাপা অভিমান আর মাত্রাতিরিক্ত রাগ টা দুটো ধ্বংসাত্মক অনুভূতি।তাই বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে অভিমান প্রকাশ করা,অভিযোগ করা,অপর মানুষটাকে নিজের রাগের কারণ বলা এবং অতিরিক্ত রেগে থাকলেও অপর মানুষটার এক্সপ্লেনেশনটা শোনা।এতে অন্তত ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়ে সম্পর্ক টা শেষ হবে না।কথা নিজের মাঝে চেপে রাখা এবং অপর মানুষটাকে নিজের দিকটা ব্যাখ্যা করার সুযোগ না দেওয়াই সব থেকে বড় ভুল।এভাবেই তো সৃষ্টি হয় ভুল বুঝাবুঝি, দূরত্ব আর শেষ হয়ে যায় সম্পর্ক।

আফিম অপলক তাকিয়ে রয় নাফিয়ার চোখ পানে।মাঝে মাঝে বাচ্চা মেয়েটা কিভাবে যেনো বড় হয়ে যায়,বড়দের মতো কথা বলে ওঠে অথবা বড়দের মতো দায়িত্ব ও যত্ন ফুটে ওঠে তার কাজে, আচরণে।আফিম জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-তুমি চাইছো,আমি যেনো বাবার সাথে কথা বলি?
নাফিয়া হাসি মুখে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।বলে উঠলো,
-আমি চাই অন্তত একবারের জন্য হলেও আপনি বাবার পুরো কথা ধৈর্য্যর সাথে শোনেন।
মৃদু হাসি ঠোঁটে রেখে পলক ফেললো আফিম।বুঝালো সে শুনবে।
খুশিতে নেচে উঠলো নাফিয়ার হৃদয়।পেরেছে সে।জয়ী হয়েছে প্রথম ধাপে।
মন খুশিতে পরিপূর্ণ হওয়ায় কেমন প্রেম প্রেম ঠেকলো নাফিয়ার।এগিয়ে গিয়ে চুমু এঁকে দিলো সে আফিমের কপালের মাঝ বরাবর।
ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো আফিমের।শক্ত হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো সে নাফিয়াকে।মুখ ডুবালো গলায়।ছোট ছোট চুমু আঁকতে আরম্ভ করলো সে সেথায়।চোখ বুঁজে নাফিয়া খামচে ধরলো আফিমের কাঁধ।

চলবে।

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৩৯

আরহান সাহেবের কক্ষে থাকা সোফায় একে অপরের মুখোমুখি হয়ে বসে আছেন আরহান সাহেব ও আফিম।আফিমের পাশেই বসে আছে নাফিয়া।হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক নাফিয়ার।ছেলেকে আলাদা ভাবে বুঝানোর পর বাবাকেও আলাদাভাবে বুঝিয়েছে সে।অতঃপর মুখোমুখি এনেছে দু’জনকে। এখন শুধু স্রষ্টার উপর ভরসা রেখে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে মেয়েটা।
নিরবতার অবসান ঘটিয়ে কথা শুরু করলেন আরহান সাহেব।বলে উঠলেন,
-বাবা আফিম,আমি জানি সময়ের কাজ সময়ে করা ভীষণ জরুরী।কারণ সময় পাড় হয়ে যাবার পর অতি কাঙ্ক্ষিত জিনিস টাও নিজের মূল্য হারিয়ে ফেলে।এই যে দেখো তোমার মাঝে তৈরি হওয়া অভিমানেরা তখন আশা করেছিলো তার বাবার ‘স্যরি’ বা তার বাবার একটু ‘সময়’ বা তার বাবার সামান্য ‘এক্সপ্লেনেশন’। কিন্তু সেই সময় টায় আমি তোমাকে এসব দিতে ব্যর্থ্য হয়েছি দেখে আজ ১৫ বছর পর তোমার কাছে এসবের আর মূল্য নেই,শোনার ইচ্ছে নেই তবুও বাবা আজ আমি বলতে চাই।

কথাগুলো বলে থামেন আরহান সাহেব। তাকান নিজের ছেলের দিকে।আফিম মাথা নুইয়ে চুপচাপ বসে আছে।সে আজ শুনবে, সবটা শুনবে।আর সবটা শুনবার পরই নিজের প্রতিক্রিয়া দেখাবে,এর আগে নয়।
আফিমের নিরবতা দেখে আরহান সাহেব এক পলক তাকান নাফিয়ার দিকে।নাফিয়া চোখের ইশারায় তাকে বুঝায় “সব ঠিক আছে বাবা।আপনি বলুন”।
নাফিয়ার চোখের ভাষায় মৃদু স্বস্তিবোধ করলেন আরহান সাহেব।অতঃপর তিনি বলতে আরম্ভ করেন,

-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম আমি।সামান্য টাকা বেতনের একটা চাকরি মিলতেই বাবা-মা দেখেশুনে বিয়ে দিয়ে দেন।যা বেতন পেতাম তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলতো আরকি।এভাবে টেনেটুনে বছর পাড় হলো।স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।দায়িত্ব বাড়লো, বাড়লো খরচও।ওভার ডিউটি করা শুরু করলাম।২৪ ঘন্টা এক করে কাজ করতে আরম্ভ করলাম।এভাবেই গাধার খাটুনি খেটে টাকা রোজগার করে সংসার চালালাম সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া অব্দি।সন্তান আসার পর দায়িত্ব আরো বাড়লো। সমানুপাতিক হারে বাড়লো খরচও।বুঝলাম এই বেতন দিয়ে হবে না,ভালো কোনো চাকুরি লাগবে।চাকরির খোঁজে ছুটলাম কত জায়গায়, কত মানুষের কাছে সাহায্য চাইলাম।ছোট হতে হয়েছিলো অনেক।তবুও মাথায় ছিলো স্ত্রী, সন্তানকে ভালো রাখতে হবে।যাকগে, অনেক কষ্টে পেলাম একটা চাকুরী।সেই চাকরি করে আলহামদুলিল্লাহ অভাব কিছুটা দূর হলো।ভালোই চলছিলো দিন।কয়েক বছর টানা কাজ করলাম সেই অফিসে।তারপর একদিন কোনো এক অজানা কারণে অফিসে হিসেবে গড়মিল পাওয়া গেলো,দোষ চাপলো আমার ঘাড়ে। হারালাম চাকরি টা।অফিসের বস্ দয়া করে মামলা ঠুকে দেননি দেখে বড় বাঁচা বেঁচেছিলাম।
তারপর শুরু হলো একের পর এক পরিক্ষা।ঘরে বাজার নেই,সন্তানের স্কুলের বেতন নেই,বাসা ভাড়া নেই,বিদ্যুৎ বিল থেকে শুরু করে অন্যান্য সব জমতে আরম্ভ করলো।বলতে গেলে এক প্রকার দেউলিয়া হলাম।এর কাছ থেকে ধার,ওর কাছ থেকে ধার করে চললাম।চেষ্টা করলাম একটা চাকরি ম্যানেজ করার কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যার হার এতো বেশি আর কর্মসংস্থান এতো কম যে চাকরি তো যেনো সোনার হরিণ।ব্যবসা করবো তারও উপায় নেই কারণ ব্যবসা করতেও তো আগে ইনভেস্ট করতে হয়। সেখানে আমার কাছে তো ৩ বেলা খাওয়ার টাকাই ছিলো না। মানুষের সাহায্য চাইতে গেলে শুনতে হতো নানান কটু কথা,অপমানিত ও হতে হতো।আত্মসম্মান বলতে রইলো না কিছু।
বহু বহু কষ্টের পর এক নিকটাত্মীয়র মাধ্যমে সুযোগ পেলাম বিদেশ যাওয়ার।আগে-পিছে কিচ্ছু ভাবিনি।নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে বিদেশের মাটিতে পা রেখেছি।
বিশ্বাস করবে না,ওখানে পা রাখা মাত্র নিজের অজান্তে কেঁদে দিলাম।নিজের দেশ,নিজের শহর,বাড়ি,বউ-বাচ্চা সব ফেলে আমি এক অচেনা দেশে এসে পৌঁছিয়েছি যেখানে চারিপাশে শুধু ভিনদেশী মানুষদের বসবাস।
অনেক কষ্টে বিদেশের মাটি আঁকড়ে ধরে পরে রইলাম।অগণিত রাত রাস্তায় কাটালাম,না খেয়েও কাটিয়েছি কত বেলা হিসেব নেই।
তারপর যখন বাংলাদেশী কয়েকজন বন্ধু বানিয়ে শুরু করলাম ছোট ব্যবসা তখন শুনি আমার স্ত্রী আর নেই।বিশ্বাস করো বাবা, নিজের সঙ্গিনীর মৃত্যু মেনে নেওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না।মন বাঁধা মানতে চাইছিলো না।নিজের স্ত্রীকে শেষ দেখা দেখার জন্য আমার আত্মা ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আফিম,আমার স্ত্রী আমার ভালোবাসা হলেও তুমি আমার অংশ, আমার দায়িত্ব।বাবা,তোমার ভবিষ্যৎ তখন আমার হাতের মুঠোয় ছিলো।আমি তখন আবেগে দেশে ফিরলে আর বিদেশে ফিরতে পারতাম না কারণ আমি লিগাল ওয়েতে বিদেশে যাইনি।আর বিদেশে ফিরতে না পারলে দেশে থেকে আমি কি করতাম বাবা?কীভাবে তোমাকে এই জীবন টা দিতাম যা তুমি এখন পেয়েছো?
এই ত্যাগটা করার সময় আমার হৃৎপিণ্ডের রক্তক্ষরণ কেউ দেখেনি, বোঝেনি আর আমিও বুঝাইনি।স্ত্রীর শোক ভুলতে কাজে আরো ডুবলাম, নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম, টাকা কামানোই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নিলাম।আফিম,আমার মাঝে টাকা কামানো একটা জিদে পরিণত হয়ে গেছিলো কারণ এই টাকার জন্য আমি আমার আত্মসম্মান হারিয়েছি,নিজের দেশ ছেড়েছি, নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ বারের মতো দেখার সুযোগ টা পর্যন্ত পাইনি আর না তার জানাজার নামাজে শরীক হতে পারছি।আমি তো আমার স্ত্রীর মৃত শরীরটা জড়িয়ে ধরে এতোটুকু বলার সুযোগও পাইনি যে,
“সানিয়া,পুরো বিবাহিত জীবনটায় তোমাকে অভাবের দুঃখ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। কোনো সুখ দিতে পারিনি আর স্ত্রী হিসেবে তুমি আমার কাছে কখনো কিছু চাও ও নি শুধু এতোটুকু চাইতা যে আমি যেনো কখনো অন্য কোনো নারীর দিকে না তাকাই।আমি তোমার কথা রাখবো সানিয়া।এই আরহানের জীবনে তুমি ছাড়া অন্য কোনো নারীর অস্তিত্ব থাকবে না।”

আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন না আরহান সাহেব।কথা বলার শক্তি হারালেন তিনি।তার দু’চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু কণা ঝরতে আরম্ভ করেছে যেনো সব পুরোনো ক্ষতগুলো সতেজ হয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডটা।
উঠে দাঁড়ালো আফিম।সোজা গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিজের পিতাকে।চোখ জ্বলজ্বল করছে তার।অশ্রুগুলো যেনো বহু কষ্টে আঁটকে আছে।
পিতাপুত্রের দিকে তাকিয়ে কেঁদে চলছে নাফিয়াও।নিজের শশুরের প্রতি গর্ব অনুভব করছে সে শুধু এতোটুকু ভেবে যে মানুষটা তার স্ত্রীকে কতখানি ভালোবাসতো!যৌবনে নিজের স্ত্রী হারিয়েও তিনি ২য় আর কোনো বিয়ে করেনি শুধু মাত্র নিজের স্ত্রীর চাওয়া পূরণ করতে,তাকে ভালোবেসে।
আবার, নাফিয়ার মন খুশিতে আত্মহারা।কারণ অবশেষে বাবা-ছেলের অভিমানের অবসান ঘটলো।

!!
কুসুমের পরিবর্তনগুলো রিয়াদকে ভাবাচ্ছে আজকাল।হটাৎ মেয়েটার আচরণ এতোটা বদলে যাওয়ার কারণ বোধগম্য হচ্ছে না তার।এইযে খুব মাথা ধরেছে তার।প্রয়োজন এক কাপ কড়া কফি।আগে যেমন মেয়েটা না চাইতেই হাজির হতো কফি নিয়ে তেমন এখন কেনো আসছে না?আজকাল কেনো আসে না?
অজান্তেই বিরক্ত হলো রিয়াদ।কফি দেওয়ার জন্য স্টাফ থাকা সত্ত্বেও সে কুসুমকে ডাকলো নিজের ক্যাবিনে।
বিলম্ব করলো না কুসুম।উপস্থিত হলো রিয়াদের ক্যাবিনে।কুসুমকে দেখা মাত্রই রিয়াদ বলে উঠলো,
-আমার কফি কোথায় মিস.কুসুম?
রিয়াদের প্রশ্নটা এমন যেনো তাকে কফি দেওয়ার চাকুরি নিয়েছে কুসুম।ছেলেটার প্রশ্নের উত্তরে কুসুম নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-আমি রবিকে গিয়ে বলছি স্যার কফি দিতে।
কুসুমের উত্তরে মেজাজ বিগড়ে গেলো রিয়াদের।দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-হাতে ফোস্কা পরেছে আপনার?
কুসুম বুঝতে পারলো না রিয়াদের এতোটা রুক্ষ ব্যবহারের কারণ। কফি বানানো তো তার কাজ না তাহলে রিয়াদ তাকে এ কাজের জন্য এভাবে বলছে কেনো?
কুসুম বলে ওঠলো,
-এটা আমার কাজ না স্যার।
এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রিয়াদ।কুসুমের একদম কাছে গিয়ে বলে ওঠলো,
-প্রথমে অনধিকার চর্চা তারপর হুট করে কাজের হিসেব।কি চাইছেন আপনি মিস.কুসুম?
কুসুম অপলক তাকিয়ে রইলো রিয়াদের চোখ পানে।কি জানি আছে এ চোখ জোড়ায়। রাগ নাকি অভিমান নাকি কি জানি একটা ফুটে উঠেছে এ চোখে।ঠিক বুঝলো না কুসুম কিন্তু হৃদয় সাড়া দিচ্ছে তার।অদ্ভুত কোনো কারণে হৃদয়ে জ্বালাপোড়া অনুভব করছে সে।মন বলছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুরুষটার বুকেই মিলবে এই জ্বালাপোড়ার প্রতিষেধক।

!!
সবেই বাবার কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসলো আফিম ও নাফিয়া। অভিমান ভাঙনের পর তিন বাবা,ছেলে ও বউয়ে মিলে গল্পে মজেছিলো।বছরের পর বছর জমানো অনেক কথাই বললো তারা।একটা সুন্দর সময় কাটিয়ে অবশেষে সময় হলো যে যার কক্ষে মৃদু বিশ্রাম নেওয়ার।
শশুরের কক্ষ হতে বেরিয়ে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো নাফিয়া।তবে দু কদম আগাতেই হুট করে পেছন থেকেই তাকে কোলে তুলে নিলো আফিম।চমকে তার দিকে তাকালো মেয়েটা।তবে প্রশ্ন করলো না কোনো।আফিমও তাকালো না মেয়েটির দিকে।সোজা এগিয়ে গেলো নিজের কক্ষের দিকে।

নিজের কক্ষের বিছানায় নাফিয়াকে শুইয়ে দিলো আফিম।মেয়েটির উপর আধশোয়া হয়ে তার চোখে চোখ রাখলো সে।নাফিয়া অপলক আফিমের চোখ পানে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে আফিমের মনোবাসনা।আর আফিম অপলক তাকিয়ে থেকে নিজের মায়াবীনির চোখের মায়ায় ডুবতে আরম্ভ করেছে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আফিম কপাল ঠেকালো নাফিয়ার কপালে।মুগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
-আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ মিস.শেখ।
ঠোঁটে হাসি ফুটলো নাফিয়ার।গলা জড়িয়ে ধরলো আফিমের।বলে উঠলো,
-আই অলসো প্রাউড অফ ইউ মিঃ ইবনান।
নাফিয়ার কথায় ঠোঁটের হাসি বৃদ্ধি পেলো আফিমের।মুখ নামিয়ে চুমু এঁকে দিলো নাফিয়ার কানের গোড়ায়।সেথা হতে ঠোঁট বুলোতে বুলোতে মেয়েটার ঠোঁট অব্দি এসে থামলো আফিম।ক’সেকেন্ড বিলম্ব করে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো সে।ছোট এক চুমু এঁকে শুয়ে পড়লো নাফিয়ার গলায় মুখ গুঁজে।নাফিয়াও শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখলো নিজের অর্ধাঙ্গকে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here