আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ৭

0
828

আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ৭
খাদিজা আরুশি আরু

২৭

এয়ারপোর্টে বসে আছে প্রলয়, কিছুক্ষন পর ইমিগ্রেশন পার করার জন্য ঘোষনা করা হবে আর সে তার ইন্দুবতীকে ছেড়ে অনেক দূরে পাড়ি জমাবে! তার অসম্পূর্ণ গল্পটাকে আর পূর্ণতা প্রধান করতে চায় না সে…

–ইউ আর আন্ডার এরেস্ট মি. প্রলয়।

ইন্সপেক্টরের কথায় ঘোর কাটে প্রলয়ের, কিছুটা ইতস্তত করে বলে,

–স্যার, আমার মনে হয় আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে!
–না মি.প্রলয়, আমরা ঠিক মানুষকেই ধরেছি।
–আমার নামে কে কেইস করেছে?
–ফেমাস সিংগার ইন্দুবতী চৌধুরি আপনার নামে কেইস করেছে মি.প্রলয়।
–ইন্দু!
–তো এখনো দাঁড়িয়ে থাকবেন, নাকি যাবেন?
–চলুন।

থানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে ইন্দু, চেহারায় রাগ স্পষ্ট। তবুও কতো শান্ত সে,ইন্দুবতী রাগলে একদম নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। অথচ আজ কতোটা নিশ্চুপ সে, এ যেনো এক নতুন ইন্দুবতীকে দেখছে প্রলয়! অধৈর্য্য হয়ে প্রলয়ই প্রশ্ন করলো,

–ইন্দু তুমি আমার নামে কেইস করেছো!কেনো?
–চুক্তি অনুযায়ী তুমি এক মাসের নোটিশ দেয়া ছাড়া কাজ ছাড়তে পারবে না। কিন্তু তুমি আমাকে না বলেই চলে যাচ্ছো… আমার যে ক্ষতি হলো তার খেসারত কে দেবে?
–চুক্তিপত্র তো…
–তুমি পড়ো নি,তাই জানো না। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই, তুমি মানলেও সেটা ঠিক না মানলেও।
–ইন্দু!

তখন থেকে ইন্দুর ফোন বাজছে, কিন্তু সেতো প্রলয়ের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত। হঠাৎ ফোনের দিকে নজর যাওয়ায় অবাক হয়ে বললো,

–ভাইয়ের এতোগুলো মিসডকল! বাবারও! এক মিনিট প্রলয়, তোমার সঙ্গে পরে কথা বলছি। ফোন টা তুলতে হবে।
হ্যালো বাবা, ফোন দিয়েছিলে… কিহ!তানি…! হ্যাঁ ও আমার সঙ্গেই আছে, আমরা এক্ষুণি আসছি।

ফোনটা কেটেই ব্যস্ত হয়ে ইন্দু বললো,

–প্রলয়, হাসপাতালে চলো।
–হাসপাতালে, কার কি হয়েছে?

কাঁপাকাঁপা গলায় ইন্দু বললো,

–তানি হাসপাতালে…
–কেঁদোনা ইন্দু, কিছু হবে না তানিয়ার। হাসপাতালে চলো।

হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান, সঙ্গে রায়হান সাহেব ও মনিরা বেগমও আছে।ইন্দু দৌঁড়ে ইরফানের কাছে গেলো।

–ভাইয়া, তানি! কি করে হলো এসব?
–তুই কোথায় ছিলি ইন্দু?
–ভাইয়া তানি…
–উত্তর দে ইন্দু।

ধমকে উঠলো ইরফান, ইন্দুর বাহু ঝাঁকিয়ে তদন্তের মতো প্রশ্ন করছে তাকে। ইরফান আগে কখনো ইন্দুর উপর রাগ করেনি।কিন্তু আজ ইন্দু ইরফানের এ চেহারা দেখে কেঁপে উঠলো।

–আমি…
–আমি কি ইন্দু?
–প্রলয় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো, আমি ওকে আটকাতে গেছিলাম।
–প্রলয় চলে যাচ্ছিলো মানে!
–মানে প্রলয়, কাওকে কিছু না বলে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো।

ইন্দুকে ছেড়ে প্রলয়ে কাছে গেলো ইরফান, ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলো প্রলয়ের গালে। তারপর প্রলয়ের শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বললো,

–তোর জন্য সব হয়েছে, একমাত্র তোর জন্য…
–আমার জন্য!
–হ্যাঁ তোর জন্য, না তোর মনে ইন্দুর জন্য অনুভুতি হতো আর না তুই ইন্দুকে তির্থের সঙ্গে দেখে হিংসায় জ্বলে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করতি। তুই না গেলে তোর পেছন পেছন ইন্দু যেতো না, আর ইন্দু না গেলে তানিয়াকেও ছুটতে হতো না।
–ইফু!
–মরে গেছে তোর ইফু, এই নামে আর কক্ষণো আমাকে ডাকবি না। ইরফান নাম আমার। আমি সারা জীবন চেয়েছি ইন্দুর বিয়ে তোর সঙ্গে হোক। কিন্তু তুই তো অশুভ, স্বার্থপর। তোর কাছে তোর ভালোবাসাই সব, আমরা কেউ কিচ্ছু না।তুই তানিয়ার ভাই হওয়ার যোগ্যই নস, আজ আমি বলছি আমি চাই না তোর অশুভ ছায়া আমার বোনের উপর পড়ুক।ইন্দুর বিয়ে তির্থের সঙ্গেই হবে।

অপারেশন থিয়েটারের বাতি নিভে গেলো, ভেতর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। সবাই দৌঁড়ে ডাক্তারের কাছে গেলো। রায়হান সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–ডাক্তার, কেমন আছে বউমা?
–ক্লাম ডাউন, সি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার নাউ। বাট…
–বাট! থেমে গেলেন কেনো ডাক্তার? বলুন না তানি আর বাচ্চাটা ঠিক আছে কিনা!
–সরি, আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি।সিঁড়ি থেকে পড়ার কারনে অনেকটা ব্লিডিং হয়ে গেছিলো। তাই চেয়েও বাঁচাতে পারিনি বাচ্চাটাকে। আর খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে উনি হয়তো আর কখনো মা হতে পারবেন না। তবে বিধাতার ওপর ভরসা রাখুন, মিরাক্কেলতো হয়ই। এগেইন, উই আর রিয়েলি ভেরি সরি।

ডাক্তার চলে গেলেন, ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লো ইরফান। ইন্দু গিয়ে পাশে বসলো, ইরফানের কাঁধে হাত রাখলো। তার ভাইকে যে তার থেকে ভালো কেউ বুঝে না। শান্তস্বরে বললো,

–ভাই, এই ভাই কথা বলনা… ও ভাই… ভাই!

ইন্দুর কাঁধে মাথা রেখে ইরফান বললো,

–ইন্দু আমি তানিয়াকে কি বলবো, কি করে ওর সামনে যাবো? বল না… কি করে ওকে বলবো যে ওর বাচ্চাটা…

ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ইরফান। যত রাগই করুক বোনটাই যে তার বিপদের সঙ্গী, নার্স এসে যে কোনো একজনকে তানিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিলো। সবাই তানিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, তবে চোখ মুছে ইরফান ভেতরে গেলো। ভেতরে গিয়ে তানিয়ার দিকে চোখ পড়তেই চোখে জল চলে এলো ইরফানের, তার বউটা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। যেনো প্রান নেই… সত্যটা জানার পর তানিয়াকে কি করে সামলাবে সেটা ভেবে এখনই ভয় পাচ্ছে ইরফান।

বিয়ের পর মেয়েটা কক্ষণো তার কাছে কিছু চায় নি। একদিন শুধু বলেছিলো, “আমার না বাড়িতে একা ভালো লাগে না, একটা বাবু হলে কেমন হয়”! এই বাবুটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনছিলো মেয়েটা। তার স্বপ্নগুলো যে এভাবে ভেঙ্গে যাবে ভেবেই আরও কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ইরফানের চোখ দিয়ে। তানিয়ার কপালে একটা গভীর চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো ইরফান। সে যে আর সহ্য করতে পারছে না…

প্রলয় একটা কোনার চেয়ারে গুঁটিশুঁটি মেরে বসে আছে। তার চোখের জল যেনো থামছেই না, আজ সে তার কাছের বন্ধুকে হারালো। সে তো এটা চায় নি, তানিয়াতো রক্তের সম্পর্কের না হয়েও তার বোন। বোনের এতো বড় ক্ষতি তার জন্য হয়েছে ভাবলেই অপরাদবোধটা আরো চেপে ধরছে, ধম বন্ধ করা অনুভুতি হচ্ছে প্রলয়ের। ইন্দুর চোখে সবটাই পড়লো, প্রলয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ইন্দু। অমনি ইন্দের কোমর জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো প্রলয়। কেঁপে উঠলো ইন্দু, এ প্রথম সে পরিবারের বাহিরে কোনো ছেলে মানুষের চোখে জল দেখেছে। তাও প্রলয়ের মতো কঠিন ব্যক্তিত্বের ছেলের। প্রলয়কে সরালো না ইন্দু, বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এই মানুষটাকে বোঝা দায়, কখনো কতো শক্ত আবার কখনো তুলার মতো নরম। জীবনে এমন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়ে ইন্দু ধন্য হলো। প্রলয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ইন্দু বললো,

–প্রলয়,তুমিতো ভাইকে চিনো, তাহলে কেনো কষ্ট পাচ্ছো বলো!
–তানিয়ার ক্ষতি হবে জানলে আমি কক্ষণো যেতাম না ইন্দুবতী…
–আমিতো জানি প্রলয়, তুমি জেনে বুঝে কারো ক্ষতি করতে পারো না। তানিয়ারতো না’ই।

ইরফারকে হঠাৎ হাসপাতালের এক্সিটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে ইন্দু চেঁচিয়ে ডাকলো,

–ভাই…, কোথায় যাচ্ছিস!

ইন্দুর গলার স্বরে শুনে এক্সিটের দিকে তাকায় প্রলয়, যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে বলে,
–আমি যাচ্ছি, তুমি এখানে থাকো ইন্দু।
–না, আমিও সঙ্গে যাবো।
–আচ্ছা চলো…

২৮

পুরো ঘর অগোছালো, সব এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে। একটা কোনায় বাচ্চাদোর খেলনা আর জামাকাপড় নিয়ে বসে আছে তানিয়া! সবটা জানার পর কাওকে সহ্য হচ্ছেনা তার, মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে ইরফানের জন্য কারন তার জন্য ইরফান কখনো বাবা হতে পারবে না।

ইরফান সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ি গিয়েছিলো, তানিয়ার কষ্ট মেনে নিতে পারে না সে। কোনো ভাবেই না… বাচ্চার জন্য সখ করে তানিয়া অনেক কিছুই কিনেছিলো, সবটা হাতে নিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলো সে। তখন প্রলয় কাছে গিয়ে কাঁধে হাত দেয়, জোর করে জড়িয়ে ধরে ইরফানকে।ইরফান বরাবরই চাপা স্বভাবের, কিন্তু সেদিন প্রলয়ের জন্যই ইরফান নিজেকে সামলাতে পেরেছিলো।

–কেনো হলো আমার তানিয়ার সঙ্গে এমন, কেনো? আমিতো কোনো দোষ করি নি। আর তানিয়া! ও তো কখনো কারো খারাপ চায় নি, তবে কেনো!
–ইফু, কাঁদিস না। তুই কাঁদলে তানিয়াকে কে সামলাবে? কিরে বল… ওঠ, নিজের চোখ মুখ মুছে নে। তোকে শক্ত হতে হবে, তোকে নিজেকে সামলাতে হবে। নিজের জন্য নয়, তোর ভালোবাসার জন্য। তানিয়ার জন্য…

প্রলয়কে জড়িয়ে ধরে ইরফান, মানুষ বরাবরই আপন মানুষের সঙ্গে রাগ করে।ইরফানও তাই, দুর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো ইন্দু। নিজোর ভাইকে সামলে উঠতে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ইন্দু। তবে সমস্যা হলো তানিয়াকে নিয়ে, সবটা জানার পর মুর্তির মতো স্থির হয়ে গেলো সে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেনি, চোখ দিয়ে নিঃশব্দে কেবল জল ফেলেছে। হাসপাতাল থেকে তানিয়াকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর মনিরা তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন,

–ওকে এতো আদিক্ষেতা করে বাড়ি ফিরিয়ে আনার কি আছে শুনি…

মনিরার কথায় বিস্মিত সুরে রায়হান সাহেব বলেন,

–কি বলছো কি গিন্নী!
–ঠিকই বলেছিো কে বলেছিলো নাচতে নাচতে এ অবস্থায় অনুষ্ঠানে যেতে?
–মনিরা!
–মা তুমি…
–থামতো ইরফান, আমার একমাত্র ছেলে তুই। এই বাঁজা মেয়ের জন্য কি সারাজীবন বাবা ডাক না শুনে থাকবি নাকি!
–মা!
–আমি ঠিক করেছি আমি তোর আবার বিয়ে দিবো!

মনিরা বেগমের ব্যবহারে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি তানিয়া, ছুটে ঘরে চলে গেলো। তারপর আর বের হয় নি। নিজের জন্য ইরফানকে কখনো বাবা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হতে দেবে না সে। চলে যাবে এ বাড়ি থেকে, সবার থেকে দুরে। তার ইরফানের থেকে দুরে!

ইন্দু অনেকবার ডাকার পর তানিয়া দরজা খুললো, তবে কিছু বললো না। তানিয়ার দু’চোখ যেনো কতো কথা বলে যাচ্ছে। সবার চেষ্টায় এক সপ্তাহের মাথায় তানিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হলো, তবে এ এক সপ্তাহে অনেক কিছু বদলেছে। মনিরা বেগম এখন আর তানিয়াকে ভালোবাসেন না বরং প্রতি পদে পদে কথা শোনান! তার ছেলের জীবন নাকি তানিয়ার জন্য নষ্ট হচ্ছে, তানিয়ার এতোদিনের ভালোবাসার সংসার যেন নিমিষেই পর হয়ে গেলো।

২৯

–তানিয়া, এই তানিয়া…

মনিরার ডাকে এগিয়ে এসে তানিয়া বলে,

–বলুন মা!
–কি করো কি সারাদিন ঘরের ভেতর শুনি! কাজকর্ম করলে কি হাতে ফোসকা পড়বে?
–কি কাজ করতে হবে বলুন না, আমি করে দেবো।
–আজকে তির্থের চাচাতো ভাই-ভাবী আসবে, আজই বিয়ে পাকা করে যাবে। তো সে জন্য সব ঠিকঠাক করতে হবে নাকি? আমার ছেলের জীবনতো নষ্ট করেছো, এবার মেয়েটার বিয়ের তোড়জোড়তো অন্তত করো।
–হয়ে যাবে মা।
–যত্তসব ঢঙ, নেকা নেকা মুখ করে থেকো না তো।

মুচকি হাসে তানিয়া, দু’ফোটা জল নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো তার চোখ দিয়ে। এই মনিরা বেগম একদিন তাকে মাথায় করে রাখতো, বউমা, বউমা করতো সারাদিন। আর এখন! সে যেনো তার চোখের বিষ, চোখের জল মুছে কাজে মন দিলো তানিয়া। আর যা’ই হোক ইন্দুর বিয়েতে তার জন্য কোনো সমস্যা হতে দিবে না সে।

সেদিনের পর অনেক কিছুই বদলেছে।প্রলয় জানিয়ে দিয়েছে সে আর ইন্দুর কাজটা করবে না, তাই আজকাল এ বাড়িতে খুব কম আসা যাওয়া হয় তার। তবে আজ আসবে, মনিরা বেগম ডেকেছেন বলে আসবে। তবে আরো একটা কারনে প্রলয় আসবে, নিজের ভালোবাসার মানুষের দুরে চলে যাবার দৃশ্যটা দেখতে!

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, ইন্দু একটা বাসন্তী রঙের জামদানী পরেছে। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য ফুটন্ত গাঁদাফুল, অল্প সাজেও কি অপরূপ লাগে মেয়েটাকে। অনেক ভিড়ের মধ্যে থাকলেও প্রথম দৃষ্টি যার উপর পড়ে ঠিক তেমন সুন্দর! ইন্দুকে এগিয়ে আসতে দেখে মনিরা দাম্ভিক স্বরে বললো,

–ইন্দু মা, এসো পাশে বসো। তোমার মা হয়ে আমার আজ নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে, কি সুন্দর মেয়ে আমার।

ইন্দু বসার পর তির্থর দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসি হাসে মনিরা। তারপর বলে,

— তির্থ বাবা, ওনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও।
–জ্বী, অবশ্যই। এই হচ্ছে আমার চাচাতো ভাই তন্ময় আর তার স্ত্রী দিয়া। ভাইয়া-ভাবী এনারা ইন্দুর বাবা-মা, এই যে ইরফান ভাইয়া আর তানি…

তানিয়াকে কোথাও না দেখে তির্থ জিজ্ঞেস করে,

–তানি কোথায় ভাইয়া?
–তানিয়ার শরীরটা ভালো নেই, তাই বিশ্রাম করছে। এখনতো আসা যাওয়া লেগেই থাকবে, তাই আজ আর ডাকছি না।
–আচ্ছা।

ইরফান মিথ্যে বললো, তানিয়া আসতে চায় নি তা নয়। বরং তাকে আসতে মানা করা হয়েছে, মনিরা বেগম মানা করেছেন।নিজের মায়ের দোষ ডাকতেই মিথ্যা কথা বললো ইরফান।

–আরে প্রলয়, তুমি দুরে দাঁড়িয়ে কেনো? কাছে এসো… ভাইয়া,এ হলো প্রলয়। ইন্দুর সেক্রেটারি।

তির্থের কথায় কিছুটা রাগীস্বরেই ইন্দু বললো,

–না, প্রলয় আমার সেক্রেটারি নয়। ও আমার বন্ধু, খুব কাছের বন্ধু।
–আচ্ছা সে যাই হোক। আন্টি, এ হচ্ছে নিশিতা… আমার বন্ধু।
–নিশিতা মা, আমার কাছে এসে বসো তো। কি মিষ্টি মেয়ে, মা তুমি কিন্তু মাঝে মাঝে আমার কাছে আসবে কেমন?
–জ্বী আন্টি।

ইন্দুর খুব রাগ হচ্ছে, এই মেয়েটাকে নিয়ে এতো ঢঙ করার কি আছে কে জানে! সবটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলো, পরের মাসের প্রথম শুক্রবার বিয়ে।

আজকাল নিশিতাকে খুব বেশি ইন্দুদের বাড়িতে দেখা যায়, তির্থ-ইন্দুর আংটি বদলের অনুষ্ঠানে ঘটলো এক অবিশ্বাস্য কান্ড!নমনিরা বেগম তির্থ আর ইন্দুর বিয়ের দিন ইরফান আর নিশিতার বিয়ে দিবেন বলে ঘোষণা করলেন! ইরফান মনিরা বেগমকে থামাতে যখন বলে,

–মা তুমি! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি আমার মা! তানিয়ার কি হবে? কি বলছো তুমি এসব, কেনো করছো এমন?
–তুই নিশি মাকে বিয়ে করবি কিনা বল!
–না!
–তুই যদি নিশি মাকে বিয়ে না করিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি!
–মা…!

রাগে গজগজ করতে করতে ইরফান নিজের রুমে গিয়ে দেখে তানিয়া ব্যাগ গুছাচ্ছে। সব মিলিয়ে ইরফানের রাগ সপ্তম আসমানে ছড়ে বসেছে! তানিয়ার কাছে গিয়ে পেছন থেকে হাত মচকে ধরলো ইরফান, তানিয়া ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো। তবে তার আওয়াজ যেনো ইরফানের কান অবধি পৌঁছালো না। বরং আরো জোরে চেপে ধরলো সে তানিয়ার হাত। রাগে গটগট করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,

–কোথায় যাচ্ছো! কেনো করছো তোমরা আমার সাথে এমন? কেনো?

তানিয়াকে ছেড়ে দিয়ে আয়নায় সজোরে ঘুষি দিলো ইরফান, আয়না ভেঙ্গে পুরো ঘরে কাঁচ ছড়িয়ে আছে। ইরফানের হাত কেটে গেছে, তানিয়া ধরতে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ইরফান। তারপর কাঁচের উপর দিয়েই হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়, ধাক্কা খেয়ে বেসামালভাবে পড়ে বিছানার কোনায় লেগে তানিয়ার কপাল কেটে রক্ত পড়ছে। তবে সেদিকে তার খেয়াল নেই, ইরফানকে আটকাতে হবে।এভাবে চলতে থাকলেতো ইরফান মরে যাবে!

চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলো ইরফান, বেডের পাশের চেয়ারে বসে তার বুকের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তানিয়া। মাথা কেটে রক্ত শুকিয়ে আছে, অথচ দিব্যি বসে আছে মেয়েটা। কি করে পারবে ইরফান এই মেয়েটার যত্ন ছাড়া সারাজীবন কাটাতে!
ইরফানের নড়াচড়ায় তানিয়া জেগে গেলো, মুচকি হেসে বললো,

–কেমন লাগছে এখন?
–ভালো।
–তুুমি আমায় বড্ড জ্বালাও বুঝলে, তবে এবারই শেষ। এখন থেকে নিশিতাকে জ্বালাবে, জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে খাঁটি স্বর্ন বানাবে। জানোতো যে স্বর্ন যত বেশি পোঁড়ে সে স্বর্ন ততো খাঁটি হয়।

তানিয়ার নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর বলে,

–আমি বিয়ে করবো না তানিয়া।
–তুমি বিয়ে করবে।
–আ…
–আমার কথা শেষ হয়নি, বলি?
–বলো।
–তুমি নিশিতাকে বিয়ে করবে, যদি এ জীবনে একটা দিনের জন্য আমায় ভালোবেসে থাকো তবে তুমি এ বিয়েটা নিঃশ্চই করবে।

কথাটা বলেই উঠে বেরিয়ে গেলো তানিয়া, এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যে জ্বলে পুঁড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তানিয়া যখন বের হলো তখন ইন্দুর সামনে পড়লো, পাশ কেটে চলে যেতে নিলে তানিয়ার হাতটা টেনে ধরলো ইন্দু! শান্তস্বরে বললো,

–তুই কি সত্যি পারবি ভাইকে ছাড়া থাকতে!

কান্নাটাকে চোখ দিয়ে বেয়ে পড়তে দেয় না তানিয়া, মৃদুস্বরে বলে,

–পারতে হবে, ইরফানের সুখের জন্য আমাকে পারতে হবে।
–তোর কি মনে হয়, ভাই তোকে ছাড়া সুখি হবে?
–জানিনা, কিচ্ছু জানিনা আমি।

কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো তানিয়া, ইন্দু তাকে টেনে তুললো। ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে সে।দুর থেকে পর্দার ফাঁক দিয়ে সবটাই দেখলো ইরফান।

দুদিন হাসপাতালে থাকতে হলো ইরফানের, এ দুদিনে তানিয়া সবসময়ই আশেপাশে ছিলো। তবে ইরফান জেগে থাকলে তার সামনে আসতো না, বাড়ি ফেরার দিন না চাইতেও তানিয়া ইরফানের সামনে পড়ে গেলো। ইরফান ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বললো,

–ইন্দু, তুই যা। তানিয়ার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে…
–আচ্ছা আমি গেলাম, তোরা আয়।

ইন্দু বেরিয়ে যেতেই ইরফান কোনোপ্রকার ভূমিকা ছাড়াই বললো,

–আমি বিয়েতে রাজি তানিয়া!

তানিয়ার এই মুহুর্তে মরে যেতে মন চাইছে, মনে হচ্ছে তার কলিজাটাকে কেউ ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ছিন্ন বিছিন্ন করে দিচ্ছে। মাথাটা ঘুরে গেলো তার, ইরফান পরম যত্নে তাকে বুকে আগলে রাখলো।খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো তানিয়া, তারপর বললো,

–তাহলে আমি আজই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।
–আমি বিয়ে করবো তবে তার আগে আমার কিছু শর্ত আছে, তুমি যদি সেগুলো মানো তবেই বিয়েটা হবে।

ছলছল চোখে ইরফানের দিকে তাকায় তানিয়া, শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করে,

–কি শর্ত?
–তুমি বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না, কক্ষণোই না। আমার বিয়ের পরও না, কারন আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো না। তুমি নিজে আমার বিয়ের সব কাজ করবে, হলুদ থেকে ফুলশয্যা সবটা হবে তোমার তদারকিতে। ফুলশয্যার খাটটা আমাদের ফুলশয্যার খাটের মতোই সাজাবে কিন্তু…
–সব হয়ে যাবে।
–তাহলে বিয়েটাও হবে, চলো।
–তুমি যাও আমি আসছি।
–ঠিক আছে।

ইরফান বেরিয়ে যেতেই তানিয়ার চোখের কোন বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো, আনমনে বললো, “তুমি যদি আমাকে কাঁদিয়ে এতো শান্তি পাও তবে তাই হোক। আমি কাঁদবো, সারা জীবন কাঁদবো। তুমি আমার চোখের জলে সাঁতার কেটে সুখের রাজ্যে যেতে চাইবে আর আমি সে সুযোগটা তোমায় দিবো না”!

এর মধ্যে ঘটলো এক দুর্ঘটনা, প্রলয়ের মা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেলেন। হয়তো বিধাতা চায় নি তিনি প্রলয়কে নিজ চোখে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে দেখুক!

৩০

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এলো।বউ সাজে ইন্দুকে কোনো অপ্সরীর চেয়ে কম লাগছে না। সিঁদুর লাল বেনারসী, গা ভর্তি গয়না, খোঁপায় তাজা রক্ত গোলাপ। এ যেনো এক পরিপূর্ণ নারী মুর্তি! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কনে বোধহয় প্রলয়ের ইন্দুবতী! তাইতো প্রলয়ের চোখ সরছে না সেদিক থেকে, প্রলয় রুমে ডুকার পর ইন্দু সবাইকে চলে যেতে বললো। সবাই যাবার পর ইন্দু প্রলয়ের সামনে দাঁড়ালো। ঘুরে ঘুরে নিজের সবটা সাজ প্রলয়কে দেখিয়ে বললো,

–কেমন লাগছে তোমার ইন্দুবতীকে? কি গো বলো না!

“তোমার ইন্দুবতী” শব্দটা এখনো কানে বাজছে প্রলয়ের। এই শব্দটাকে বয়ে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে সে। মুচকি হেসে বললো,

–তোমার রূপের প্রশংসা করে আমি তোমার রূপের অবমাননা করতে চাই না ইন্দুবতী। তুমি তো অপরূপা! যার রূপের কোনো শেষ নেই…
–বসো তো, তাহলো… সত্যিই চলে যাচ্ছো?
–থেকে কি হবে?
–কোথায় যাবে?
–জানি না।
–আন্টির কথা মনে পড়ছে খুব?
–মা তো, মনে পড়াটাই স্বাভাবিক।

প্রলয়ের চোখে জল চিকচিক করছে।চোখের জল লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো সে! ইন্দু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,

–কবে যাবে?
–আজই।
–আমার বিয়েতে থাকবে না?
–না, নিজেকে আর ভাঙ্গবো না।
–এরপর!
–এরপর কি?
–কি করবে ভাবছো?
–জানি না, তবে যা করবো নিজের জন্য করবো।
–ঠিকানা দেবে না?
–কিছুতো ফেলে যাচ্ছি না, তবে কেনো ঠিকানা দিয়ে পিছুটান বাড়াবো বলতে পারো?
–একটা অনুরোধ করবো রাখবে?
–তোমার কোন অনুরোধটা রাখিনি বলতে পারো?
–আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে?
–চেষ্টা করবো, আসছি।

প্রলয় চলে যাচ্ছে, ইন্দুর দৃষ্টি তার যাবার পথে স্থির। হাত উল্টে চোখের জল মুছলো প্রলয়, অস্পষ্ট স্বরে বললো, “তোমায় নিয়ে একটা গল্প লিখতে বলছো ইন্দুবতী! এই প্রলয়তো তোমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কতো ডায়েরী শেষ করেছে তার হিসাব নেই। তোমায় নিয়ে গল্প নয়, উপন্যাস লেখা যায়। তুমি আমার সে অসমাপ্ত উপন্যাসের নায়িকা যা কক্ষণো শেষ হবার নয়”! যাবার পথে তানিয়ার সঙ্গে দেখা করে গেলো প্রলয়। তানিয়ার মাথায় হাত রেখে অপরাধীর স্বরে বললো,

–আমাকে ক্ষমা কর তানিয়া।
–তোমার কোনো দোষ নেই ভাই, সব দোষ আমার ভাগ্যের। আমিতো আটকে গেছি, তবে তুমি মুক্তি পেয়েছো। তাই বলছি, এবার নিজের জন্য বাঁচো ভাই। আর কষ্ট পেয়ো না…
–নিজের খেয়াল রাখিস, আসছি।
–সাবধানে যেও…

৩১

ইরফানের বিয়ের শেরওয়ানি হাতে তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে, নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজ হাতে বিযের জন্য তৈরি করার মতো গুরুতর শাস্তি তার কপালে আছে জানলে কোনো কালেই সে ভালোবাসতো না। ভালোবাসার সংস্পর্শে যেতো না… কি আর করার সবই নিয়তির খেল! তানিয়াকে অন্যমনষ্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরফান তাড়া দিয়ে বললো,

–কি হলো? পরিয়ে দাও!
–আ… আমি পারবো না!
–কেনো পারবে না? আমাকে বিয়ে করতে বলবে আর বিয়ের জন্য তৈরি করে দিতে পারবে না?

কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো তানিয়া, নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার। হাজার চেষ্টা করেও ইরফানের সামনে নিজেকে আটকাতে পারলো না সে, ভেঙ্গে গুড়িয়ে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

–আমাকে মেরে ফেলো ইরফান, আমি বাঁচতে চাই না। আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া বাঁচতে, পারবো না!
–কি মনে হয়, আমি পারবো আমার বউকে ছেড়ে বাঁচতে? তোমার জন্যই তোমাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে, সবসময় গুরুজনের সব কথাকে মেনে নেয়া ঠিক নয় প্রিয়…
–সে টা বুঝতে আমি যে অনেক দেরী করে ফেলেছি ইরফান…

পরম যত্নে দু’বাহু ধরে কান্নারত তানিয়াকে দাঁড় করায় ইরফান, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। যেনো ছাড়লেই পালিয়ে যাবে তার বউটা…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here