আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ ১

0
1478

আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ ১
খাদিজা আরুশি আরু


গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে। তার সঙ্গে দ্রুত গতিতে চলছে গাড়িতে বসে থাকা মেয়েটির হৃদস্পন্দন! জানলার বাইরে তার দৃষ্টি স্থির, এই রাস্তা দিয়ে শত শত বার সে ঘুরেছে। অথচ আজ এতো বছর পর এ রাস্তাটাই যেন তার বড্ড অচেনা লাগছে! মনের মধ্যে জমে থাকা হাজার যন্ত্রনার স্থায়ি সমাধান খুঁজতেই আজ তার বাড়ি ফেরা। মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, অথচ বাইরে থেকে বুঝবার উপক্রম নেই!স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হাতড়াতে স্মৃতির সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পাতাটা সম্মুখে উম্মোচিত হয়ে গেলো, স্মৃতির পাতায় টুপ করে ডুব দিলো মেয়েটি!

মায়াময়ি সরকারি বিদ্যালয়ে সেদিন বিদায় অনুষ্ঠান ছিলো, শিক্ষার্থীদের চোখে আগামীর স্বপ্ন! যেনো এক আনন্দ নিকেতন। স্টেজে সবার উদ্দেশ্য কিছু কথা বলছিলেন হেডমাস্টার রহমান সাহেব!

–আজ তোমাদের স্কুলের শেষ দিন। তোমরা ভবিষ্যতে একেকজন একেক জায়গায় যাবে। হয়তো আজকের পর তোমাদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা হবে না। তবুও আশা করি তোমরা জীবনে অন্ততো একজন ভালো বন্ধু পাবে। সবার জন্য স্কুলের পক্ষ থেকে শুভ কামনা রইলো। আজ শেষ দিন,এ বিদায় বেলায় আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষার্থী ইন্দুবতীকে একটা গান গাইতে অনুরোধ করবো। ইন্দু মা, এসো।

স্টেজে উঠে এলো ইন্দু, এসেই রহমান সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।

–স্যার আপনি আমার বাবার মতো, তাই আপনার অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি।তবে আমি একা গাইবো না, আমার সঙ্গে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তির্থ হানমনিয়াম বাজাবে। কারন ওকে ছাড়া আমার গানের জগত অসম্পূর্ণ। তাই ও হামনিয়াম বাজাবে আর আমি গাইবো। ওর সুরে আমি আমার সুর মেলাবো! তির্থ প্লিজ স্টেজে আয়।

স্টেজে উঠেই ইন্দুকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলো তির্থ! ক্ষীণস্বরে বললো,

–এসব আদিক্ষেতার মানে কি?
–তুই এতো কথা না বলে বাজা না হারমনিয়ামটা। আর শোন, চলে যাস না অনুষ্ঠান শেষ হলে। পুকুর পাড়ে আমি তোর অপেক্ষা করবো, চলে আসিস। তোকে এমন একটা কথা বলবো না তুই খুশিতে নেচে উঠবি!
–প্লিজ ইন্দু! আচ্ছা, আমি হারমনিয়াম বাজাচ্ছি। তুই গান গা, বাকি সব কথা পরে হবে।
–হ্যাঁ, চল। সবাই অপেক্ষায় আছে।

তির্থ হারমনিয়াম বাজাচ্ছে। তার সুরে গান গাইছে ইন্দুবতী। এ যেনো এক অনন্য মেল বন্ধন!

–আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই,কিছু নাইগো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো…

সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষন ইন্দুর দিকে। মেয়েটা যেমন রূপবতী, তেমনই গুনবতী! গানের গলা অসাধারন তার! তাইতো মুহুর্তেই করতালিতে মুখরিত হলো স্কুল প্রাঙ্গন। অনুষ্ঠান শেষে সবাই যে যার বাড়ি ফিরছে। দু’চোখে নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে…

–তির্থ জানিস, আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে! আমি অনেক বড় গায়িকা হবো দেখিস! দেখ, কতো বড় জায়গা থেকে আমাকে ডেকেছে! এটা আমার জন্য কতো বড় ব্যপার বল, তুই বুঝতে পারছিসতো তির্থ! আমি বড় গায়িকা হতে পারবো, পড়াশুনার পাশাপাশি আমি নিজের জীবন গড়ার সুযোগ পেয়েছি!

স্কুলের মাঠের পাশে পুকুর পাড়ে বসে ছিলো ইন্দুবতী, চেহারায় কিছু পাবার আনন্দ স্পষ্ট। তখনই তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তির্থ এলো। তির্থকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইন্দু গড়গড় করে কথাগুলো বলে দিলো। কথাগুলো বলতে বলতে তির্থের কাঁধে হাত রাখলো ইন্দু। তার ছোটোবেলার স্বপ্ন যে পূরণ হতে যাচ্ছে, তাই সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সঙ্গে সে সুখটা ভাগ করে নিতে চায় সে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির তো অন্য কিছুই মঞ্জুর ছিলো!

কাঁধ থেকে এক জটকায় ইন্দুর হাতটা সরিয়ে দিলো তির্থ! তার এমন আচরনে কিঞ্চিত বিস্মিত হলো ইন্দু তবে মুখে কিছু বললো না! তির্থের কাছ থেকে এই মুহুর্তে এরূপ ব্যবহার আশা করেনি সে, ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিব্রত হলো ইন্দু। যা তার চেহারায় স্পষ্ট।

–খুবতো বলেছিলি আমাকে তোর গানের পথের সঙ্গী করবি! আমার সুরে সুর মিলাবি! আমি ছাড়া তুই গান গাইবি না! কিন্তু এখন যেই সুযোগ পেল সেই ধেই ধেই করে নাচছিস! তোর এতো সব কথা,তার কি হলো? কেনো মিথ্যে স্বপ্ন দেখালি? কেনো? উত্তর দে ইন্দু! না, থাক! তুই আর কি উত্তর দিবি! তুই তো বিশ্বাসঘাতক। তোকে না ঘৃণা করি আমি, ঘৃণা! শুনতে পাচ্ছিস? ঘৃণা করি তোকে! এই মনের গহীন থেকে ঘৃণা করি তোকে। তোর চেহারা দেখলে আমার এখন রাগ হয়, মরে যেতে মন চায়! তাই নিজেই চলে যাচ্ছি, এই দেখ। তোর থেকে দূরে…বহুদূরে…!
–তুই সবটা আগে থেকে জানতি! কে বললো তোকে? তুই দূরে যাবার ব্যবস্থা করে এসেছিস! আর আমি বোকার মতো ভাবছিলাম আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আমার সাফল্যতে খুশি হবে! তুই আমার সঙ্গে এটা করতে পারলি তির্থ! আমাকে এভাবে বলতে পারলি, তুই আমাকে ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিবি!
–কেনো! কি ভেবেছিলি? আমি সারা জীবন তোর পেছনে ঘুরবো? তুই সফলতার সিঁড়ি চড়বি আর আমি বসে বসে তামশা দেখবো! কি ভাবিস তুই?আমি তোকে ছাড়া অসম্পূর্ণ? না,এই তির্থ একাই একশো!
–আমি কখনো তোকে আমার থেকে কম ভাবি নি তির্থ! তুই সব সময়ই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে ছিলি। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, বিশ্বাস কর!
–হাহ…বিশ্বাস! তোকে! তোর মতো মেয়েকে! যার কিনা রক্তেই বিশ্বাসঘাতকতা! হাসালি ইন্দু…
–না তির্থ, তুই ভুল ভাবছিস। আমি এমন মেয়ে নই তির্থ, সত্যি! আমি নিজে সফল হলে তবে না তোর সফলতার সঙ্গী হতে পারবো! আমি তো তোর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তাহলে তুই আমার সঙ্গে এমন কেনো করছিস! কেনো আমাকে বুঝতে চাইছিস না?
–তুই আমার বন্ধু ছিলি ইন্দু, এখন আমার জন্য তুই শুধুই ইন্দুবতী চৌধুরি!
–তির্থ! যাস না তির্থ… তুই আমার পাশে না থাকলে আমি কার সুরের তালে গান গাইবো বল! তুই কেনো তোর ইন্দুর সঙ্গে এমন করছিস,কিরে তির্থ বলনা…তির্থ… যাস না…প্লিজ…
–আমার যেতে হবে ইন্দুবতী। তাছাড়া কোনো জায়গাই স্থায়ীভাবে খালি থাকে না, আর তোর মতো মেয়েদের জীবনেতো কারো জন্য জায়গা খালি থাকার প্রশ্নই আসে না। খুব শিঘ্রই আমার ফেলে যাওয়া শূণ্য জায়গাটা পূর্ণতা পাবে। সে ব্যপারে অবশ্য আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। চললাম! তবে যাবার আগে বলে যাই, সবটা আমাকে তোর মা বলেছে! উনিই আমার চোখ খলে দিয়েছে। আমি নই, তোর আর আমার বন্ধুত্বের ভীত গোড়া থেকে উপড়ে ফেলেছে তোর মা!
–তির্থ… বিশ্বাস কর আমার কোনো দোষ ছিলো না রে! আমি নিজে থেকো কিছু করিনি। আমি তোকে ঠকাই নি, আমি বিশ্বাসঘাতক নই! তির্থ…।

সেদিন অনেক ভেঙ্গে পড়েছিলো ইন্দু কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজে নিজেই বলেছিলো, “না, আমি কাঁদবো না!মা আমার সঙ্গে এটা করলো তো, আমি চলে যাবো। আর ফিরবো না, চলে যাবো সবার থেকে দুরে! নিজের পরিচয় বানাবো, যেনো আমার জন্য কাউকে কিছু করতে না হয় তার ব্যবস্থাই করবো আমি। বাবাকে আজই বলবো, আমি চলে যাবো এ শহর ছেড়ে। এ শহর আমার সব কেড়ে নিয়েছে। এ শহরে আমি থাকবো না,কিছুতেই না”!

পুরো দশটা বছর পর ঢাকার মাটিতে পা রেখেছে ইন্দুবতী। আজ সে সফলতার সর্বোচ্চ স্তরে দাঁড়িয়ে আছে। গানের জগতে তার নাম সবার মুখে মুখে। দেশে বিদেশে তার গানের এ্যালবাম, তার ভক্ত বিশ্বজুড়ে। এক পলক তাকে দেখার জন্য হাজার জোড়া চোখ অপেক্ষা করে থাকে। কতো মানুষের মনের রাজ্যে তার বসবাস!কতোনা বাসনার মানুষ সে! তবুও জীবনের অসম্পূর্ণ কিছু ঘটনা আজও অবসরে তাকে ভাবায়। তির্থের মতো মানুষকে মনে করে আজও ঘুমের মধ্যে আঁতকে ওঠে ইন্দু। সেদিন তির্থের চলে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে পারেনি সে!কি করে ভুলবে ও তির্থকে, তির্থ যে ওর অসম্পূর্ণ গল্পের বিস্তর জায়গা জুড়ে রাজত্ব করছে! তাছাড়া অনেক প্রশ্ন আছে মনে, যেগুলোর উত্তর এ ব্যস্ত শহরেই মিলবে! সেই অসম্পূর্ণ গল্পটাকে সম্পূর্ণ করতেই এতো বছর পর তার ঢাকায় ফেরা!

–ইন্দুবতী… তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?
–প্রলয়! কতোবার বলবো আমায় ইন্দুবতী ডেকো না, অসহ্য লাগে। বাবার ওপর মাঝে মাঝে খু্ব রাগ হয়, কেনো যে এমন সেকেলে নাম রাখলো আমার! মনে হয় কোনো পৌরাণিক উপন্যাসের চরিত্র আমি!
–নামটা সত্যিই সুন্দর “ইন্দুবতী”। সাহিত্য সাহিত্য ভাব আছে, শুনলেই মন-প্রান জুড়িয়ে যায়। তুমি বেকার রাগ করছো।
–তুমি আবার তোমার ভাঙা ক্যাসেট চালু করলে! আর আবার আমায় ইন্দুবতী ডাকলে, কতোবার না করেছি তোমাকে?
কল মি ইন্দু, প্রলয়!
–ওকে ম্যাডাম, ক্লাম ডাউন। রাগ করছো কেনো? তা ইন্দু, তুমি কি কিছু ভাবছো?

এই একটা মানুষ, যার সঙ্গে ইন্দুর কোনো নামের সম্পর্ক নেই। অথচ ইন্দুর না বলা সব কথা মুখ দেখে অবলিলায় বলে দিতে পারে মানুষটা, কিন্তু ইন্দু যে তার কাছে ধরা দিতে নারাজ!

–কিছু না প্রলয়। তা আর কতোক্ষন লাগবে? আমার খুব বিরক্ত লাগছে!
–প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছো সে আমি বেশ বুঝতে পারছি! যাই হোক, বেশিক্ষন লাগবে না।এইতো এসে গেছি, তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো তো। এতো অধৈর্য হলে চলে!
–বেশ চলে, গরুর গাড়ীর মতো গড়গড়িয়ে চলে।
–হাহ, তুমি আর তোমার গরুর গাড়ি! দুটোই দেড় ব্যাটারী, হুহ…
–কিছু বললে?
–না, একদম না। তুমি শান্ত হয়ে বসোতো।

–বউমা… ও বউমা… কোথায় গেলে?

ইন্দু দশ বছর পড় বাড়ি ফিরবে তাই ওর বাড়িতে এক প্রকার উৎসব উৎসব আয়োজন চলছে। চাকর বাকর সব কাজে ব্যস্ত। ইন্দুর মা, মনিরা চৌধুরির যেনো সকাল থেকে দম ফেলার সময় নেই! সব কাজের তদারকি একাই করে যাচ্ছেন তিনি। যদিও ইন্দুর বাড়ি ছাড়ার পেছনে তার ভূমিকাও কম নয়!

–মা, কি হলো? চিৎকার করছেন কেনো? শরীর খারাপ করবে তো আপনার!

তানিয়া, ইন্দুর ভাবী! অবশ্য এছাড়াও তার একটা পরিচয় আছে, সে ইন্দুর স্কুলের বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু, ইন্দুর মন খারাপের সময় এই মানুষটা তাকে খুব যত্নে রেখেছিলো।

–শরীর টরীর খারাপ হবে না, আর হলেও সেসব পরে ভাবা যাবে। তোমাদের কোনো কান্ডজ্ঞান আছে! আমার মেয়েটা এ বাড়িতে দশটা বছর পর ফিরছে আর ওকে এভাবে স্বাগতম জানানো হবে! ওর পছন্দের ফুলগুলো আনাও নি কেনো?
–মা, ইন্দু কি শুধু আপনার মেয়ে? আমার কেউ নয়? আমার ওর আসা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই বুঝি!
–সে কখন বললাম?
–তাহলে চিন্তা করছেন কেনো? ফুল এসে গেছে, এক্ষুণি ফুলদানীতে সাজিয়ে দেয়া হবে। আমিতো আছি নাকি? আমি সবটা সময়মতো করে দিবো। আপনি চিন্তা না করে বিশ্রাম করুনতো এবার।
–পারবে তো! তোমারওতো শরীর ভালো না!
–পারবো মা পারবো, ইন্দুর জন্য বলেই পারবো।
–তাহলে আমি যাই তোমার শ্বশুর মশাইয়ে কতোদূর দেখি, তুমি ইরফানকে বলো জলদি নিচে আসতে। ইন্দুটাতো এলো বলে!
–আমি বলে দিবো মা, আপনি গিয়ে দেখুন বাবার কতোদূর হলো।
–আচ্ছা তাই করি গিয়ে।
–উফ… বাঁচা গেলো। এই ইন্দুটা বাড়িতে আসতে না আসতে সবার নাজেহাল অবস্থা করে দিলো! যাই গিয়ে দেখি ইরফানের হলো কি না! ভাই বোন দুটোই এক। তার ওপর পেটের এই পুচকুটা হলো মহা বদমাশ! পেটে থেকেই মাকে জ্বালিয়ে মারছে, আর হবে নাই বা কেনো… যার পিন্নি এমন ডানপিটে সেতো বিচ্ছু হবেই।আমার হয়েছে যত জ্বালা! ধুর বাবা,যাই দেখি ওর কতোদূর। ইরফান, এই ইরফান…

ইরফান ইন্দুর একমাত্র বড় ভাই। ইন্দু থাকা অবস্থায় বোনের সঙ্গে গান গাওয়া, ফুটবল খেলা আর তানিয়াকে টাকা জমিয়ে চকলেট দেয়াই ছিলো তার কাজ। তবে এখন সে দায়িত্ববান হয়েছে, বাবা হবে যে কদিন পর। এ ক’বছরে তার জীবনও কম বদলায়নি! বিয়ে করেছে, রোজ সকালে উঠে অফিস যাচ্ছে। আর অবসরে তানিয়াকে জ্বালাচ্ছে। এটাই এখন তার নিত্যদিনের রুটিন।

–কি হলো তানিয়া? এমন চেঁচাচ্ছো কেনো? পুচকু ভয় পাবে তো। তা তোমার হলো, আমি তো তৈরি!
–কি বললে, আবার বলো!
–না বউ, কিছু না। নিচে চলোতো।
–তোমার জন্য নিচে কতেক্ষন যাবত অপেক্ষা করেছি জানো, ইন্দুটাতো এলো বলে!
–জানি, কিন্তু কি বলোতো ইন্দু আমাকে যেভাবে দেখে অভ্যস্ত আমি চাই ও এসে সেভাবেই আমাকে দেখুক। একদম খাপছাড়া…
–কিন্তু এতে তো ওকে ঠকানো হবে, ওর তো জানা উচিত যে তুমি আর গান করো না! বাবার অফিস জয়েন্ট করেছো, কাজে ব্যস্ত থাকো। আর মোটেও খাপছাড়া নেই, দায়িত্ববান হয়েছো।
–জানাবো না কে বললো, নিশ্চয়ই জানাবো। তবে সময় নিয়ে, এখনই ওকে এসব জানানোর প্রয়োজন নেই। আস্তে ধিরে সব জানানো যাবে, আগেতো আসুক।
–তুমি যা ভালো বুঝ, চলো নিচে চলো।
–এইতো হয়ে গেছে, চলো।

–তোমার হলো, মেয়েটা এলো বলে!
–হয়ে গেছে গিন্নী। এতো চেঁচামেচি করো না তো, বউমা অসুস্থ জানো না! বাড়ি না যেনো চিড়িয়াখানা!

রায়হান চৌধুরি, ইন্দুর বাবা। মানুষটা মেয়েকে বড্ড ভালোবাসে, মেয়ে বলতে অন্তপ্রান!

–তা তুমি দেরি না করলেইতো চেঁচাতে হয় না।
–তোমার নাতি বা নাতনি যে আসবে সে তোমার মতো সারাদিন যেনো চিৎকার না করে সে মানত করে আমি হাজার টাকা দান করবো।
–কিহ, কি বললে তুমি!
–কিছু না, ইন্দু মা আসলো বলে! নিচে যাবে না? নাকি এখন দেরী হচ্ছে না?
–হুম, যাবো তো। চলো চলো…
–যাক কাজ হয়েছে, উফ বাড়িটা দিন দিন কি যে হয়ে যাচ্ছে! সারাদিন চ্যাঁ চ্যাঁ….
–কি এতো বিড়বিড় করছো তুমি? শরীর ঠিক আছেতো?
–কই! না, কিছু না।
–জলদি নিচে চলো।
–হ্যাঁ যাচ্ছিতো।

গাড়ি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছে, কিন্তু সেদিকে ইন্দুর কোনো খেয়াল নেই। সেতো তার স্মৃতির পাতায় কষ্ট খুঁজতে মত্ত। প্রলয়ের ডাকে হুঁশ ফিরে তার।

–ইন্দু, এসে গেছিতো। নামবে না?
–ও হ্যাঁ, নামবো তো!
–বাবা, মা, ভাই, তানি! তোমরা বাইরে কেনো? আমি তো ভেতরেই আসতাম, শুধু শুধু কষ্ট কেনো করলে!
–তুই ভিতরে আসবি আর সে অপেক্ষায় আমরা থাকবো! মারে, তোর মাকে একবার দেখতে মন চায় নি? নিজের এতো বড় বাড়ি থাকতে দেশে বিদেশে ঘুরেছিস! কেনো মা?
–গিন্নী, তুমি থামবে? এখন এসব বলার সময় নয়! ভেতরে চল ইন্দু মা!
–কেমন আছো বাবা?
–তোকে ছাড়া যেমন থাকা যায়!
–ও বাবা, তুমি এতো আবেগী কেনো?
–তুই বুঝবি না। কারন তুই কখনো মেয়ের বাবা হতে পারবি না!
–মায়ের সঙ্গে কথা বলবি না ইন্দু?

পাশ কাটিয়ে চলে যায় ইন্দু, মেয়েটা বড্ড অভিমানী। মায়ের প্রতি অভিমানটা আজও যে দশ বছর আগের মতোই আছে! হাত উল্টে চোখের জল মুছলেন রায়হান সাহেব, তবে এ অশ্রু সুখের।নিজের সন্তানকে এতো বছর পর ফিরে পাওয়ার সুখ!

–কিরে ইন্দু, সবাইকে পেয়ে বেচারা ভাইটাকে ভুলে গেলি!
–না রে ভাই, তোকে চাইলেও আমি ভুলতে পারবো না। কারন তুই ভুলতেই দিবি না!
–হাহাহা… তা মন্দ বলিস নি, আয় কাছে আয়। কতোদিন তোকে জড়িয়ে ধরি না!
–তুইও কাঁদবি!
–না, কই আমিতো কাঁদিনি! চোখে ময়লা পড়লো তাই…
–আমাকে শেখাচ্ছিস?
–আচ্ছা ঠিক আছে,হয়ে গেছি আবেগী…। খুশিতো?
–অনেক… তোর কথা খুব মনে পড়তো রে!
–আমার বুঝি পড়তো না? সেইতো দেখা করতে আমিই যেতাম, তুইতো আর আসতি না।
–সেই, শুরু হয়ে গেলো তোদের! আমাকে তো কারো চোখেই পড়ছে না, এইযে ইন্দুর জন্য সবচেয়ে সুন্দর উপহারটা বয়ে বেড়াচ্ছি তা তো আমিই নাকি?
–তানি… সরি… কান ধরছি দেখ।
–লাগবে না কান ধরা, ভেতরে গিয়ে আমায় উদ্বার করুন মহারানী!
–হাহাহা… তুইও না পারিস, আচ্ছা পুচকুর কয় মাস হলো রে? আমার আর তর সইছে না সত্যি!
–তিন মাস হলো সবে, দেরি আছে।
–আচ্ছা চল যাই, কতো গল্প আছে বল!
–হ্যাঁ, তাইতো। চল, চল… জলদি…
–বাহ, সবাই ইন্দুকেই দেখছে! আমাকেতো ভুলেই গেলো, দেখলে ইন্দু,কেমন এসেই আমার আদরে ভাগ বসালে!
–বেশ করেছি।
–না তা বললে হবে না, আমি কিন্তু হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদবো বললাম! মনে আছে ইফু, ইন্দু কেমন হাত-পা ছুঁড়ে ছোট বেলায় কাঁদতো!
–প্রলয় তোমাকে কেনো সবাই ভুলবে!কেউ ভুলে নি। তবুও তুমি দয়া করে এসব মনে করিয়ে দিও না সবাইকে, আমি এখন নাম করা গায়িকা! আর শোনোনা, আমিতো সবে এলাম কিন্তু তুমি সব সময়ই ছিলে! তাই আমাকে একটু বেশি ভালোবাসছে, আমি মোটেও তোমার ভালোবাসায় ভাগ বসাই নি।
–থাক থাক আর বলতে হবে না, চলো ভেতরে।
–হ্যাঁ, তাই বরং ভালো। চলো যাই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here