আমার তুমি❤️,পর্বঃ০১

0
9944

আমার তুমি❤️,পর্বঃ০১
লেখিকাঃ ফারজানা তাবাসসুম

চোখের সামনে কাচের এই সঁপিসটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। সেইদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি আমি।বুকের ভেতর টিপ টিপ আওয়াজ করছে।খারাপ কিছু যে হতে চলেছে তার পূর্বাভাস এইটা।

″walk on it!!!!!″

হঠাৎ এমন হুংকারে কিছুটা কেপে উঠলাম আমি।কলিজার পানি শুকিয়ে হাহাকার করে উঠলো ভেতরটা। পাথর মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়েই রইলাম নিজের জায়গায়। ভয়ের কারনে মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে না,হাত-পা নাড়ানোর জন্য। আবারো এক ঝাঝালো কন্ঠে ছিটকে গেলাম আমি।

–কথা কানে যাচ্ছে না মিসেস: আয়াশ?? এই আয়াশ আরহাম এক বাক্য আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে পছন্দ করে না,তা ভালো করেই জানো তুমি।

মাথাটা উঁচিয়ে সামনের দিকে তাকালাম।এক সুদর্শন যুবক আমার দিকে তাকিয়ে। সেই দৃষ্টিতে কি আছে তা আমি জানিনা। তবে এই চোখজোড়া আমাকে পাগল করার জন্য যথেষ্টই। শত কষ্ট পাওয়ার সত্তেও ঐ চোখজোড়ার দিকে তাকানো মাত্র সব কষ্ট,ব্যাথা, মান-অভিমান সব, সব এক নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। এ যেনো এক ম্যাজিক।

আয়শ আমার দিক থেকে নজর সড়িয়ে নিলেন। বেডে গিয়ে বসলেন। আমি এখনো এক জায়গায় একি ভাবে দাঁড়িয়ে। আয়াশ শান্ত স্বরে আবার আদ্রিতাকে বললো:

″এর উপর দিয়ে হেটে যাও″

আয়াশের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। এইসব কেমন শাস্তি দিচ্ছেন উনি আমাকে?? উনার চোখে না আছে কোনো মায়া-দয়া, আর নাই আছে কোনো অনুসুচনা। একটা মানুষ কিভাবে এতো নির্দয় আর নিষ্ঠুর হতে পারে, এই মানুষটাকে দেখলেই বোঝা যাবে।

আর কিছু না ভেবে শাড়িটা একটু উচু করে ধরলাম। একপা একপা করে ভাঙা কাচের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। এই কাজটা আমাকে করতেই হবে। তাই আর বিলম্ব করে লাভ নেই।

এইদিকে আয়াশ আদ্রিতার কাজগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পরখ করছে।আয়াশ মনে মনে ধরেই নিয়েছে এ কাজ আদ্রিতার কাম্য নয়।তাই আয়াশ কোনো প্রকার ভঙিমা না করে টেবিল থেকে লেপটপটা হাতে নিলো।হঠাৎ এক ক্ষিণ চিৎকার কানে বাজলো আয়াশের। পাশে তাকিয়ে আয়াশ যেনো হকচকিয়ে গেলো। বিশ্বাস হচ্ছে না তার আদ্রিতা সত্যিই কাচের উপর পা রেখেছে। আয়াশ কিছু না ভেবেই দ্রুত সেখানে গেলো।

এক পা কাচের উপর ফেলতেই পা অবশ হয়ে আসছে। আরেক পা ফেলতে নিবো তখনি নিজেকে শুন্যে ভাসতে দেখি। চোখ দুটি ঝাপ্সা হয়ে এসেছে।একটু উপর দিকে চোখ তুলে দেখি আয়াশ আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে। এই চরম ব্যাথার মাঝেও মুচকি হাসলাম। আয়াশের মন তাহলে এতটাও কঠিন নয়। এমন ও হতে পারে আমি তার মনে জায়গা করে নিতে পারছি।আর কিছু ভাবতে পারলাম না। চোখজোড়া নুইয়ে গেলো আমার। জ্ঞান হারালাম বোধহয়।

আয়াশ আদ্রিতাকে কোলে করে বেডে শুইয়ে দিলো। পায়ের দিকে তাকিয়ে আয়াশের নিজেরই আত্মা কেপে উঠলো। কাচগুলো কিভাবে বিধে আছে পায়ের মাঝে। আয়াশ ফোনটা হাতে নিয়ে ডক্টরকে তাড়াতাড়ি আসতে বললো।

……………

বেলকনিতে গিটারের টুংটাং আওয়াজে মুখরিত চারপাশ।গিটারটা পাশে রাখলো ছেলেটি। এই শ্রাবনের মেঘের মতো নিজের মনের মাঝেও কত শত মেঘ জমে গেছে। সেই জমে থাকা মেঘগুলো খুব করে চাইছে ঝরে পড়তে।যদি থাকতো সেই মানুষটি তাহলে আজকের এই শ্রাবণটা হতো অন্যরকম।

হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেলো ছেলেটি। পেছনে ঘুরে তাকাতেই তার পুরনো সব ঘা তে যেনো নুনের ছিটা লাগলো। সাথে সাথে চোখ রক্তিম বর্ন ধারন করলো। সামনে থাকা ব্যাক্তিটিকে এক ঝটকায় দূরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।হাতের মুঠি শক্ত করে বললো ছেলেটিঃ

কেনো এসেছো তুমি? কেনো?? তামাশা দেখার জন্য? আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে শান্তি পাওনি তুমি?? আর কি চাই তোমার হ্যা?? বলো!! আর কি চাইইই!!!!!

আ,, মাকে ভুল বু ঝো ন,,না। থেমে থেমে বললো নিচে পড়ে থাকা মেয়েটি।ছেলেটির এই রুপ দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেছে।

ছেলেটি নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বেলকনির রেলিং ধরে অন্যদিকে ফিরে বললোঃ

আমি খারাপ কিছু করার আগে আমার চোখের সামনে থেকে তুমি চলে যাও। I can’t tolerate you anymore (আমি তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না)। মেয়েটি মুখ চেপে কান্নাভেজা কণ্ঠে ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললোঃ

মাফ করো তুমি আমায়।প্লিজ মাফ করে দিও। বলেই দৌড়ে বেরিয়ে আসলো সেখান থেকে। সিড়ি দিয়ে দ্রুতগতিতে নেমে যাচ্ছে সে। তখনি তার হাত ধরে কেও থামিয়ে দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।

কি হয়েছে মা?? এমন কান্না করে বের হলি কেন, আমার ছেলের ঘর থেকে। মেয়েটি হাত দিয়ে তার চোখের পানি মুছে শক্ত গলায় বললোঃ

আন্টি আপনি?? আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন?? আপনি জানেন না! আজ এইসব পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?? জানেন না আপনি? তাহলে আমি বলে দিচ্ছি, এইসব কিছুর জন্য আপনি দায়ী হ্যা!! আপনিই দায়ী।আজ আপনার ভুল সিধান্তের ফল আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। আর এক দন্ডও দাড়ালোনা মেয়েটি কান্না করতে করতে বেড়িয়ে গেলো।

মাঝ বয়স্ক মহিলাটি ধপ করে বসে পড়লো সোফায়। আজ নিজের ভুলের জন্য দুটি জীবন সে নষ্ট করে ফেললো।

″হে আল্লাহ্!! ক্ষমা করে দাও আমায়!!ক্ষমা করো। আবার সব ঠিক করে দাও তুমি″ কান্না ভেজা কন্ঠে দু হাত তুলে কথাগুলো বললো সে।

…………

ধীরে ধীরে চোখখুলে তাকালাম আমি।আশেপাশে কাওকে দেখতে পেলাম না।জানালার বড় সাদা পর্দা ভেদ করে লালচে রশ্মি আসছে।তারমানে এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। উঠতে নিলে পায়ে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলাম। পায়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলাম,কি সুন্দর করে পায়ে ব্যান্ডেজ বাধা। বাম পায়ে কাচ ঢুকেছিলো। তাই শুধু বাম পায়েই ব্যান্ডেজ। আনমনেই হাসলাম আমি।

আয়াশ আপনিও না পারেন ও বটে!! এই আমাকে এতো কষ্ট দেন আবার নিজেই এতো যত্ন নেন আমার। আমার অতীতের মতো আপনি নন। আমার অতীত বাইরে থেকে যতটা প্রানবন্ত ছিলো ভেতরে ঠিক ততটাই বিষাক্ত ছিলো৷ কিন্তু আপনি বাইরে দিয়ে কঠোর হলেও ভেতর থেকে তার থেকে বেশী যত্নশীল। আমি জানি একদিন আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবেন।

বেড থেকে ধীরে নেমে পড়লাম নিচে। কষ্ট করে দরজার সামনে গেলাম আমি। আশেপাশে কেও নেই। আয়াশকেও দেখতে পারছিনা। এই বাড়িতে আয়াশ, বাবা আর আমি ছাড়া কেও নেই৷ আজতো বাবা বাসায় নেই। আয়াশ ও কি এখন বাইরে চলে গেলো??একটু উদাস হয়ে বাম পাটা উচু করে কষ্ট করে পেছনে ঘুরলাম। তখনি পাশের রুম থেকে কারো চেচামেচির আওয়াজ কানে আসলো আমার।কষ্ট করে হলেও সেই ঘরের কাছে গেলাম আমি। অতি সাবধানে দেয়াল ঘেষে দাড়ালাম আমি।ভেতরে বাবা আর আয়াশ কথা বলছে।

আড়িপাতা ভালো না।তবুও কৌতুহলের জ্বালায় তা না করে পারলাম না। ভেতরে বাবার মুখে যা শুনলাম তাতে আমার পায়ের নিচে মাটি সরে গেলো। চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসলো, টপ করে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে।আমি কি তাহলে এতোটাই অসহায়?? আমার অতীত যে ধোকা আমায় দিয়েছে,, আমার বর্তমান ও কি তাই করবে??ভবিষ্যতে কি আছে আমার জন্য??

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here