আমার বর,পর্ব:০৫
লেখা : মিশু মনি
আমি বাবার বাসায় এসেছি পাচদিন হয়ে গেল।এই পাচ দিনে তন্ময়ের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি।
আমি ওর ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু অপেক্ষা তো সীমাহীন হয়ে যাচ্ছে।ভালোবাসা না থাকুক,নিজের স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেও তো একবার ফোন দিতে পারত।
শুয়ে শুয়ে ভাবছি এসব কথা।আজ ওর কথা খুব মনে পড়ছে। ও হয়ত ভুলেই গেছে মিফতা নামে ওর জীবনে কেউ একজন আছে।
কে যেন দরজায় নক করল।দরজা খুলে দেখি তন্ময় দারিয়ে!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! স্বপ্ন দেখছি না তো?
তন্ময় জিজ্ঞেস করল,কেমন আছো?
আমি অবাক চোখে তাকিয়েই আছি।বিশ্বাস করতে পারছিনা আমার বর এসেছে!
– কি হলো? ভিতরে ঢুকতে দাও।
আমি দরজা ছেড়ে দিলাম।
তন্ময় সোফায় বসে একটা মোবাইল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,নাও এটা তোমার জন্য।নতুন কিনেছি।
আমি ফোনটা হাতে নিয়ে চুপ করে দারিয়ে আছি।
– মিফতা,কি হয়েছে? এমন চুপ কেন?
– বিশ্বাস হচ্ছেনা আপনি এসেছেন!
ও উঠে এসে আমার হাতে একটা চিমটি দিয়ে বলল,লেগেছে?
– উফফ..
-বুঝলা তো এটা স্বপ্ন নয়।
– হুম।আপনি এতদিন ফোন দেননি কেন?
– নাম্বার ছিলনা।
– কিহ!
– হুম সত্যি।তুমিও তো দাওনি।
– আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।
– অপেক্ষা স্বার্থক হয়েছে।গিফট নিয়ে এসেছি।
আমি কিছু না বলে মোবাইল টা দেখতে লাগলাম।
তন্ময় বলল,এই কয়েকদিন ভালভাবে খেতে পারিনি।এখন kindly ভালো করে কিছু রেঁধে দাও।
– ওহ।তারমানে আপনি আমার জন্য আসেননি।দায়িত্ব থেকেও আসেননি। এসেছেন ভালো করে খেতে?
– হুম।আফা,পাঁচদিন কিছু খাইতে পারি নাই।চারডা খাওন দিবেন?
আমি হেসে বললাম,দুষ্টু কোথাকার।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি খাবার রেডি করছি।
.
তন্ময় হাত মুখ ধুয়ে এসে বলল,কি করা হচ্ছে?
– তরকারি টা গরম করে দিচ্ছি।ওয়েট।
– উফফ বাবা পেট জ্বলছে ক্ষুধায়।পাকস্থলীতে প্রচুর এসিড উতপন্ন হয়েছে।
– ক্ষার ঢেলে দিবো?
– তখন তো লবণ উতপন্ন হবে।
– ভালই হবে।সেই লবণ উত্তোলন করে আমি রান্না করবো আর বাকিটা বেচে দিবো।
– কি বললা? বরকে মেরে ফেলার প্লান তাইনা?
– আপনি আমার বর!? কি দায়িত্ব পালন করেছেন এ পর্যন্ত?
– পড়ে ঝগড়া করছি।আগে খেতে দাও প্লিজ।
.
খাওয়া শেষ করে তন্ময় কিছুক্ষণ আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলল।তারপর রুমে আসল।
আমি বললাম,আমাদের বাসায় আলাদা ঘুমালে অসুবিধা নাই।আপনি চাইলে আমি অন্য রুমে যাচ্ছি।
তন্ময় কি যেন ভাবল।তারপর বলল,ওকে যাও তাহলে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।কথার কথা বলে ফেলেছি বলে এখন আমাকে আলাদা থাকতে হবে! এ কেমন মানুষ!
.
রেগে অন্য রুমে চলে আসলাম। এই কয়েকদিন ওর প্রতি ভীষণ রাগ জমে গিয়েছিল।ওকে দেখে সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবারো রাগ গর্জে উঠছে।
.
তন্ময় এসে আমার বিছানার উপর পা তুলে বসল।
রেগে বললাম,আবার এ ঘরে কেন? ওই রুম পছন্দ হয়নি?
– হইছে।
– তাহলে?
– তোমাকে তো বলেছি অন্য রুমে যেতে।কিন্তু আমাকে ছেড়ে একা তো ঘুমাতে বলিনি।
– আপনি হচ্ছেন গিরগিটি। ক্ষনে ক্ষনে রুপ বদলান।আপনি আসলে কি চান বুঝা বড় দায়।
তন্ময় হেসে বলল, আপাতত তোমার পাশে ঘুমাতে চাইছি।দিবা না ঘুমাতে?
আমি কিছু বলতে পারলাম না।ছেলেটা এমন কেন?
.
অনেক রাত অব্দি দুজনে জেগে রইলাম। কখনো খুনসুটি, দুষ্টুমি, ঝগড়া, ফাজলামি,গল্প,কিছু অনুভূতি, সব মিলিয়ে খুব সুন্দর কাটল রাত টা!
.
পরদিন
আজ তন্ময়ের এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত আছে।এই প্রথম ওর সাথে বের হচ্ছি।কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে!
তন্ময় বের হয়েই বলল,হাটার সময় আমার মুখের দিকে তাকাবা না।তুমি মাথা উপরে তুলে আমার দিকে তাকাও ব্যাপার টা দেখলে হাসি পায়।
আমি কিছু বললাম না।শুনতে খারাপ লাগলেও চুপচাপ শুনে গেলাম।বিয়ের প্রথম রাত থেকেই ওর মুখে এমন কথা শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।
.
ওর বন্ধুর বাসায় পৌছলাম। সকলেই উতসাহের সাথে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। বেশ ভালই লাগছে।আরও অনেকেই এসেছেন। তাদের প্রায় সকলেই তন্ময়ের কলিগ।তন্ময় সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো।
আমার মনটা ভীষন ভালো লাগছে।আশংকা ছিল তন্ময় আমাকে নিয়ে বিব্রতবোধ করবে।কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব আনন্দ করছে।আমার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল ওর হাসিমুখ দেখে”
.
এমন সময় তন্ময়ের গার্ল ফ্রেন্ড মিমি আসল।মিমি ও থাকবে এখানে এটা আমি জানতাম না।
তন্ময় বলল,আমাকে ও বলা হয়নি মিমি আসবে এখানে।জানতে পারলে এখানে আসতাম না।ওকে আজকাল অসহ্য লাগে।
তন্ময়ের মুখে এ কথা শুনে স্বস্তি পেলাম।
.
অনেক্ষন ধরে তন্ময় ও মিমি দূরে দারিয়ে কথা বলছে।তন্ময়কে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব উত্তেজিত। রেগে গেছে ভীষন।ওকে সামলাতে হবে।কিন্তু আমি ওখানে গেলে হয়ত আরও বেশি রেগে যাবে।দূরে দারিয়ে দেখতে লাগলাম।
.
তন্ময়ের একজন বন্ধু এসে বলল,ভাবি আপনি এখানে কেন? তন্ময়কে মিমি বাজে কথা বলছে।ওখানে চলুন।
– কিন্তু ও হয়ত রেগে যাবে।
– মিমির বিহ্যাভ সুবিধার না।আপনি আসুন তো।
.
ওদের পাশে গিয়ে দারাতেই মিমি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,শর্ট হলে কি হবে।তামিল নায়িকা বটে।
আমি বুঝতে পারলাম আমার ব্যাপারেই কিছু কথা হচ্ছিল।ইচ্ছে করছে এখান থেকে সরে যাই,কিন্তু তন্ময় কেও নিয়ে যেতে হবে।
.
মিমি তন্ময় কে বলল, আচ্ছা তোমার মনে আছে একবার সরকারি কলেজের এক মেয়ে তোমায় প্রপোজ করছিল আর তুমি কি জবাব দিছিলা?
তন্ময় বলল,অনেক মেয়েই আমাকে প্রপোজ করেছিল।এসব ছোট খাটো ব্যাপার আমি মনে রাখিনা।
– তাহলে মনে করিয়ে দেই? তুমি বলছিলা,নিজের হাইট টা ফিতা দিয়ে মাপিও।দেশে অনেক বাইটটা পোলাপান আছে,তাদের কাউকে খুজে নিও।আমি তোমার জন্য না।
আমি মনে মনে ভীষন রেগে গেলাম।ও আমাকে অপমান করছে,সেই সাথে তন্ময় কেও।
তন্ময় বলল,তখন বুঝিনি।এখন বুঝি।উচ্চতা কোনো ব্যাপার না।
– ব্যাপার না? তুমি যদি হাফ টিকেট হতে,তাহলে কি ডিফেন্সে আসতে পারতে? আমাদের can’t এরিয়ায় একটা শর্ট মানুষ খুজে বের করো দেখি।
তন্ময় রেগে বলল আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি না।আমাকে বিরক্ত করোনা।
– তাই নাকি? বউ পেয়েছ বলে? তন্ময়, এই মেয়েটার মাঝে কি আছে?
আমি প্রচণ্ড রেগে গেলাম।চুপচাপ শুনে যাচ্ছি।আমার বর কি বলে সেটা শুনার জন্য।
মিমি উপহাস করেই চলেছে।
তন্ময়ের বন্ধু তাসিন বলল, মিমি,লিমিট ক্রস করিও না।
মিমি বলল,আমার আর তন্ময়ের মাঝে কখনো কোনো লিমিট ছিলনা।
– কিন্তু এখন আছে।মিফতা সব সহ্য করে যাচ্ছে।তুমি ওকে এভাবে অপমান করতে পারোনা।
– কেন পারিনা? তন্ময়ের সাথে আমার এফেয়ার দীর্ঘ সময়ের।তন্ময় আমাকে ঠকিয়ে একটা পুচকে মেয়েকে বিয়ে করবে আর আমি চুপচাপ দেখবো?
তাসিন ভাইয়া বলল,তাহলে কি তোমাকে বিয়ে করা উচিৎ ছিল? তন্ময়ের বউ হওয়ার যোগ্যতা তোমার নাই মিমি।তন্ময় যেমন পরিবারের ছেলে,তুমি কোনোদিক দিয়েই তার কাছে ঘেসতে পারবা না।কারণ তোমার মানসিকতা অত্যন্ত নিম্নমানের।
আমি চুপ করে আছি।তাসিন ভাইয়ার জবাব টা ভালো লেগেছে।তন্ময় রাগে ফুঁসছে।
মিমি রেগে বলল,তাই নাকি? এই মেয়েটার যোগ্যতা আছে?
– হুম আছে।মিফতার বিহ্যাভেই আমরা বুঝে গেছি।আর ও শুধুমাত্র একটু শর্তা। কিন্তু অন্য সব দিক দিয়েই ওর উচ্চতা কোনো অংশে কম না।
– বাহ! ওর হয়ে এত কথা বলছ যে?
তাসিন বলল,ন্যায় অন্যায় বোধ টা আমাকে খুব নাড়া দেয়।কেউ অন্যায় কথা বললে আমি চুপ থাকতে পারিনা।আর তুমি বারবার শর্ট শর্ট করছ কেন? আমি যাকে ভালবাসি তার সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয়। ওর হাইট আমি জানতাম না।আমি ওকে সত্যিই ভালবাসি। যখন দেখা হল তখন দেখি ও আমার চেয়ে অনেক শর্ট। তাই বলে কি আমি ওকে ছেড়ে দিবো? আমার ফ্যামিলি না চাইলেও আমি অকেই বিয়ে করবো। আর এখানে মিফতা তন্ময়ের বিয়ে করা বউ।
মিমি রেগে বলল,নিজে ভালোবাসো বলে ছাড়তে পারবা না।আর আমাদের এত বছরের রিলেশন? আমিও তো তন্ময় কে অনেক ভালবাসি। ও আমাকে ধোকা দিলো।
.
আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।এখানে আর থাকতে পারছিনা।ভাবলাম তন্ময় কে নিয়ে চলে যাবো কিন্তু তন্ময় রেগে বলল,ভালবাসার মানুষ কে এভাবে অপমান করা যায়? অনেকবার অপমান করেছ আমাকে।আসলে তুমি ভালবাসার মানেই বুঝো না।আমার আম্মু ঠিক ই বলেছে,তোমাকে বিয়ে করলে আমি এক মাসের বেশি ভালো থাকতে পারতাম না।কিভাবে এতদিন ধরে রিলেশন চলেছিল কে জানে!
মিমি হুংকার দিয়ে উঠল। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।সকলে আমাদের চারপাশে এসে দারিয়েছে।
অনেক চেষ্টা করলাম তন্ময় কে এখান থেকে সরানোর।কিন্তু পারছিনা।ওরা তর্ক করেই যাচ্ছে।তাসিন ভাইয়াও অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু কেউই থামল না।
এক পর্যায়ে মিমি তন্ময়ের কলার টেনে ধরে হুমকি দিলো। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।মিমির সামনে দারিয়ে বললাম,শুধু লম্বাই হয়েছ।বিবেক বুদ্ধি হাটুর উপরে উঠেনি।কোন পরিবেশে কার সাথে কিভাবে কথা বলা উচিৎ সেটাও জানো না।এত লম্বা হয়ে কি লাভ হলো তোমার? নিজের উচ্চতা কোথায় প্রমাণ করে দিলে আজ।পার্টি টাই নষ্ট করে দিলে।
সকলে নিশ্চুপ হয়ে গেছে আমার কথায়।রাগেমাথায় কি যে বললাম! আর এখানে থাকা যাবেনা।
তন্ময় কে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।
.
আমার খুব মন খারাপ। রাগ ও হচ্ছে প্রচুর। এরকম পরিস্থিতি তে জীবনে প্রথম বারের মত পড়লাম।আমার উচ্চতার জন্য কখনো কোথাও অপমানিত হতে হয়নি।আজ বিয়ে করে এভাবে অপমানিত হলাম।আমার কি অপরাধ ছিল! তন্ময়ের পাশে দারিয়ে থাকতেও আর ইচ্ছে করছে না।
তন্ময় বলল,থ্যাংকস মিফতা।তুমি ব্যাপার টা শেষ করে না দিলে হয়ত আরও খারাপ হত।আমি খুব রাগী জানোই তো।এত বেশি রেগে গিয়েছিলাম, আর একটু হলেই তো ওকে থাপ্পড় লাগাতাম।
আমি চুপ করে আছি।তন্ময়ের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না।
তন্ময় বলল,আমিতো ভেবেছিলাম তুমি পাবলিক প্লেসে কথাই বলতে পারবা না।কিন্তু তুমিতো দেখছি যোগ্য জবাব দিতে পারো।
আমার রাগ বেড়ে যাচ্ছে।নিজের উপর,তন্ময়ের উপর আর আমার পরিবারের প্রতি।
আমার কাউকেই চাইনা।আমি আমার অবস্থাতেই অনেক ভালো ছিলাম। হঠাত বিয়েটা হয়ে সব সময় অপমানিত হচ্ছি।
তন্ময় আমার হাত ধরে বলল,আমার মিষ্টি বউ।
আমি ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,আমি আমার মত থাকতে চাই।আপনার তো আমাকে নিয়ে অনেক অসুবিধা হয়।আজ থেকে আর হবেনা।
– কি বলছ এসব?
– হুম।বলেছিলেন, মা বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আর আমার মুখ দেখতে চাননা।আর দেখতে হবেনা।
বলেই হাটা শুরু করলাম। তন্ময় ছুটে এসে অনেক কথাই বলল।ওকে বললাম নিজের বাসায় চলে যেতে।আমি একাই অনেক ভালো ছিলাম।
তন্ময় কে রেখেই সিএনজি তে করে বাসায় চলে এলাম।চোখ দুটো আর বাধা মানছে না।অবহেলা,অপমান, রাগ সব মিলিয়ে অনেক বড় আঘাত পেয়েছি।অজস্র চোখের জলে ব্যাথা টাকে ভুলতে চাই।
চলবে