আমার_অবেলায়_তুমি,০৬,০৭

1
631

#আমার_অবেলায়_তুমি,০৬,০৭
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৬

দুপুরের ভ্যাপসা গরমে জনজীবন ওষ্ঠাগত। কড়া রোদে উত্তপ্ত রাস্তায় বাতাসের সাথে যেন আগুন ঝড়ে পড়ছে। মেহরাব বিরক্তির শিষ তুললো। গাড়ির এসি বাড়িয়ে লামিয়ার ফোনে কল লাগালো। আজ সারাদিন ব্যস্ততার জন্য একবার ও মেয়েটার খবর নেয়া হয়নি। দুটো সার্জারি ক্যান্সেল হওয়ায় সময়ের আগেই বাসায় ফিরে যাচ্ছে সে।
কয়েকবার লাগাতার রিং হওয়ার পরেও ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো না। মেহরাব ভ্রু কুচকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাসায় মেহমান আছে, কেউ কিছু বলে নি তো! ভাবতে চাইলো না মেহরাব। কিছু বললেও তার পরিবার সামলে নিবে। তবুও বক্ষপিঞ্জরে আনচান করছে। জ্যাম ছাড়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কচ্ছপের গতিতে এগুচ্ছে গাড়ি। কাপালে ভাজ ফেলে দোয়া দুরুদ পড়ে ময়না বেগম কে কল করলো মেহরাব। আপার কথা অনেকটা বা*রুদের মতো মনে হয় তার কাছে। কি থেকে কি শুনিয়ে দেয় ভাবা মুশকিল।

— আসসালামু আলাইকুম আপা। লামিয়া কল ধরছে না।বাসায় কি কিছু হয়েছে?

ময়না বেগম আ*র্তনাদ করে উঠল। নাটকীয় ভঙ্গিতে বুক চাপড়ে বলল,

— বিয়ে করে আপা কে একদম ই ভুলে গেছিস! একদিন ফোন দিয়া খবরও নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিস না। বউ কল না ধরায় এখন আপার কথা মনে পড়ল?এই আমার নাম্বার ছিল তোর ফোনে? এখন কার থেকে নিয়ে কল দিয়েছিস সত্যি করে বল।দাড়া,আগে সালামের জবাব দিয়ে নেই, ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।

মেহরাব বিমূঢ় হয়ে ফোন কানে নিয়ে বসে রইলো। ময়না বেগমের কথা সব মাথায় জট পাকিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে আবার ও একই প্রশ্ন করল। ময়না বেগম এবার কষ্ট পাওয়ার ভান করে বলল,

— আজ থেকে তোর কোন বোন নেই।আমি ভাই হিসেবে তোকে তেজ্য করলাম। মিনিমাম সম্মানটুকুও নেই! কল দিয়ে বলতে তো পারতি,আপা কেমন আছো? কি করছো? সকালে খেয়েছো? তা না করে সরাসরি বউ! তোর বউ আমার পাশেই আছে। ভালো আছে। আমি তাকে পাটিসাপটা করে খাওয়াচ্ছি। কল কা*ট। তোর সাথে কথা বলে একটা পিঠা পেনে লেগে গেছে। বাসায় আয়,এটা তোকে খাওয়াবো। আসার সময় আম্মার জন্য আখ নিয়ে আসিস। আম্মা খেতে চেয়েছে।

মেহরাব তপ্ত শ্বাস ফেললো। ভুল করেও এটা বললো না, আম্মা আখ খায় না আপা।তার দাত নেই। পাছে আবার যদি তাকে বংশ থেকেই বাদ দিয়ে দেয়!

কল কে*টেই ফিক করে হেসে দিলো ময়না বেগম। লামিয়া পেট চেপে হাসছে। ভাইদের নাস্তানাবুদ করতে পারলে বুকের ভিতর শান্তি শান্তি লাগে। কেন যে সে ভাইদের ছোট হলো না? তাহলে আরো আহ্লাদ করা যেত।

মাহতাব রুমে এসে দেখে মধু ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত মুখেও অস্বস্তি স্পষ্ট। মাহতাবের কপাল কুচকে গেলো। মেয়েটা কি নিয়ে ইতস্ততা করছে? হয়তো নতুন পরিবেশ তাই!নিজ মনকে বুঝ দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো মাহতাব।লম্বা একটা শাওয়ার নিতে হবে। অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে আসছে।

মধুর ঘুম ভাঙ্গল দুপুরের পড়ে। দগদগে সূর্যটা তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। মাহতাবের ছোট মামী কয়েকবার ডাকতে চাইলে মাহতাবের থমথমে মুখ দেখে আর কথা বাড়ায় নি। সাহিদা রাগে ফুলে ফেপে উঠছে। বউয়ের জন্য দরদ যেন উপচে পরছে! আদিখ্যেতা বলে মনে মনে তিরস্কার করলো বার কয়েক।

কুলসুম বেগম কে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে মাহতাব। টেবিলের সবার কাছে বিষয় টা স্বাভাবিক। তারা আগে থেকেই দেখে আসছে মাহতাব তার মাকে দুপুরে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। কিন্তু এখন ঘরে বউ এসেছে। এই দৃশ্য পাল্টে যেতে কতক্ষণ?
মাহতাবের বড় মামাতো ভাইয়ের বউ টিপ্পনী কেটে বলেই ফেলল,

— মায়ের প্রতি এই ভালোবাসা থাকবে তো মাহতাব ভাই? এখন ঘরে বউ এসেছে। হিংসে করতে পারে। তখন আবার মা কে ভুলে যাবেনা তো?

মাহতাব চোখ তুলে তাকালো। ময়না বেগম আর লামিয়া শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে। তার শান্তশিষ্ট ভাই রেগে গেলে হুস থাকে না। সবার সামনে চিল্লিয়ে উঠলে একটা বিশ্রী অবস্থা হবে।

কুলসুম বেগম এসবে পাত্তা দিলেন না। তার ছেলে খাটি হিরে। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও কতটা সময় ড্রাইভ করে বাসায় আসে শুধু তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে। ছোট বেলায় মাহতাব সব সময় জেদ করতো তার হাতে খাওয়ার জন্য। মাহতাবের বয়স যখন চৌদ্দ কি পনেরো, তখন একদিন কুলসুম বেগম মাহতাব কে বলেছিলেন,

— আর কতো আমার হাতে খাবে বাবা? এবার তো বড় হয়েছো। নিজের হাতে খাওয়ার অভ্যাস করো। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। এখন তো আমার ছেলের হাতে খাওয়ার কথা।তা না,আমিই বুড়ো ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছি।

মাহতাব সেদিন খেতে খেতে মায়ের গাল ধরে আদুরে গলায় বলেছিল,

— আমি বড় হলে আমিই তোমাকে প্রতিদিন খাইয়ে দিবো আম্মা। ততদিন তোমার হাতে খাবো। তোমার হাতে না খেলে আমার পেট ভরে না আম্মা।

মাহতাব তার কথা রেখেছে। তার বাবা মারা যাওয়ার দিন থেকে মাহতাব কুলসুম বেগম কে সব সময় নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। আগে তিন বেলা খাইয়ে দিলেও এখন সময়ের অভাবে পারে না।তাই দুপুরে বাড়িতে চলে আসে সে।

ময়না বেগম চোখ রাঙ্গিয়ে তাকালো ভাইয়ের বউয়ের দিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খোচা মারতে পেরে সে ভিষণ খুশি। মাহতাব ধীরেসুস্থে কুলসুম বেগম কে খাওয়ানো শেষ করলেন। মায়ের মুখ যত্নসহকারে মুছিয়ে দিয়ে লামিয়া কে বলল,

— মাকে তার রুমে নিয়ে যাও লামু। দুই ঘন্টা রেষ্ট করতে হবে। আমি এসে মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি। লামিয়া কুলসুম বেগম কে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

— আমিই দিয়ে দিবো ভাইয়া। আপনি খেয়ে নিন।

মাহতাব কিছু বললো না। হাত ধুয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলো।সবাই খাওয়া শেষ করে সেখানেই বসেছে। সাহিদা একটু পর পর মাহতাব কে দেখছে।
দুই বাচ্চার মা হয়ে সে অনেকটা বুড়িয়ে গেছে। তবে মাহতাব কে দেখে বয়স বোঝার জো নেই। শুধু কানের পাশের কয়েকটি চুলে পাক ধরেছে এই যা। মধুকে দেখার জন্য হাসফাস করছে ভিতরে ভিতরে। মাহতাব ভুল করেও তার দিকে তাকাচ্ছে না। কেন তাকাচ্ছে না? বউ পেয়ে তাকে দেখতেই চাইছে না! এই তার ভালোবাসার শ্রী?

মাহতাব ফোন ঘাটতে ঘাটতে তার মামাতো ভাইকে বলল,

— দিনকাল কেমন যাচ্ছে ভাই? ব্যবসার কি অবস্থা?

— আছে আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি। তোর মতো কোটিপতি বনে যাইনি এখনো।

তাদের কথার মাঝখানেই সেই ভাবি আরো কয়েকবার মাহতাব কে পিঞ্চ করে কথা বললো । সাহিদা সহ কয়েকজন শব্দ করে হাসছে।

— আপনি বুঝি মামীকে হিংসে করেন ভাবি? তা নাহলে এতো সহজেই বুঝে ফেললেন কি করে? আর বউ হিংসে করলে এক প্লেটে দুজনকে খাইয়ে দিবো। খাবারের টান পরবেনা আমার বাসায়। দুহাত ভরে টাকা কামাই। এদের জন্যই তো। দু’জন কে খাইয়ে দিলে হিংসে করবে না নিশ্চয়ই?

বেচারির হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো।জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল,

— আমি তো মজা করছিলাম ভাই। রাগ করলে নাকি?

— আমিও ঠিক আপনার মতোই মজা করেছি। রাগ করবো কেন?

থমথমে পরিবেশেই আগমন হলো মেহরাবের। ঘামে ভিজে যাওয়া শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।হাতে দু আটি আখ। লামিয়া ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। মেহরাব মুচকি হেসে পানি খেয়ে রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। মাহতাব লামিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— মধুকে নিয়ে এসো লামু। ও হয়তো উঠে পরেছে।

লামিয়া মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। লামিয়া কে পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে মধুকে একটু গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে আসা।

— খাবে না আপা?

ময়না বেগম টেবিলের কাছে যেতে যেতে বলল,

— খাবো না কেন? তোদের জন্য বসে আছি ভাবিস না। আমি এমনিতেই দেড়ি করছিলাম। খেতে মন চাইলে টেবিলে আয়। মাহতাব মনে মনে হাসলো। বোন টা আর বদলালো না।

মেহরাব, মাহতাব , ময়না বেগম টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে মধুর জন্য। ময়না বেগম সুফিয়া খালাকে বলল পিঠা গুলো ড্রয়িং রুমে নিয়ে যেতে।যার মন চাইবে খাবে।

মধুকে নিয়ে নিচে আসতেই সবার চোখ কপালে। সাহিদা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মাহতাব এতো কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করেছে কেউ আন্দাজ ও করে নি। কালো জামদানীতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে মধুকে। মাহতাব কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। মনে মনে বলল,

— সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর।

মধু সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। লামিয়া তাকে রেডি করাতে করাতে সবার বিবরণ দিয়ে ফেলেছে। তাই রয়ে সয়ে সবার কথার উত্তর দিচ্ছে সে।

ময়না বেগমের কথা শেষ হতেই সাহিদা শ্লেষাত্মক গলায় বলল,

— আগে খেয়ে নাও মধু। সবাই ঘরের মানুষ। পরেও আলাপ করা যাবে। এই লামু,এসে বসে পর।

— বাবাহ আপা! ভাইয়ের জন্য তো কমবয়সী মেয়ে ধরে এনেছেন। এজন্যই বুঝি দু’দিনেই মাহতাবের মাথা ঘুরে গেছে?

সাহিদার হাসতে হাসতে মারা খোচাটা গায়ে মাখলো না মাহতাব।ময়না বেগম কিছু বলতে গেলেও তাকে থামিয়ে দিয়ে হাসি মুখে উত্তর দিলো,

— ঠিক ধরেছো সাহিদা। অপেক্ষার ফল সব সময় সুমিষ্ট হয়। আমি আমার দুঃখের বিনিময়ে সুখ কিনে এনেছি। সাময়িক কষ্ট টা এখন আশীর্বাদ মনে হচ্ছে। নাহলে এমন জীবনসঙ্গী পাবো কেন?

সাহিদার মুখটা অপমানে লাল হয়ে গেলো। থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলো মধুর দিকে।

চলবে,,

#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৭

গোধুলির রক্তিম আভা আকাশের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা একরাশ লাল রঙ আকাশের গায়ে মেখে দিয়েছে।

দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতেই আসরের আজান হয়ে গেলো। মাহতাব ঘড়ি দেখে ভ্রু কুচকাল। এতটা দেড়িতে সে কখনো খায়না। আজ একটু ভিন্নতা। ড্রয়িং রুমে এখন শুধু কয়েকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। ময়না বেগম নিজের রুমে রেষ্ট নিচ্ছেন।

মধু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। অস্বস্তি হচ্ছে খুব। সবাই কেমন বাকা চোখে দেখছে তাকে। সারাদিনের ব্যস্ততায় লামিয়া ক্লান্ত। ঘন্টা ঘানেক শুয়ে থাকতে পারলে একটু ভালো লাগতো। কিন্তু মধুকে ছেড়ে উঠতে পারছে না সে। মেহরাবের মামাতো ভাইয়ের বউয়েরা ঘিরে রেখেছে মধুকে।

— মেহরাব কে ডেকে দাও বোন।নামাজের সময় চলে যাচ্ছে। আপনারা ও নামাজ পড়ে নিন। তোমারা যাবে তো?

মামাতো ভাইরা মাথা নেড়ে উঠে দাড়ালো। মাহতাব ব্যস্ত ভঙ্গিতে আরেকবার ঘড়ি দেখলো। পেটা হালকা ভারী ভারী লাগছে। নামাজের পর কিছুক্ষণ হেটে আসলে মন্দ হয়না।

মিনিট পাচেক পর মেহরাব আসলো। ফোলা ফোলা রক্তিম চোখ নিয়ে ভাইয়ের সাথে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো।যাওয়ার আগে মাহতাব মধুর কাছে এসে নরম গলায় বলল,

— মধু,,,সম্ভব হলে নামাজটা পড়ে নিয়ো।আর নিচে আসার দরকার নেই৷ নামাজ শেষে রুমে গিয়ে রেষ্ট করবে। আমার আসতে লেট হবে। লামিয়ার সাথে যাও। আমি আসছি। ঠিক আছে? লামিয়া,, মধুকে নিয়ে নামাজের রুমে যাও। আম্মা আর আপা কেও ডেকে দিও বোন।

লামিয়া মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। মাহতাব আসছি বলেও দাড়িয়ে রইলো।যেন মধু যাওয়ার অপেক্ষায় সে।পাছে কেউ তাকে কোন কটু কথা বলে ফেলে! সাহিদা সহ তার মামাতো ভাইয়ের বউরা মুখ কুচকে তাকিয়ে। সাহিদা চুপ থাকতে পারলো না। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেই ফেললো,

— কচি বউ নিয়ে মানুষের সামনে এত আদিখ্যেতা দেখাচ্ছো কেন মাহতাব? তোমার বউ কে কেউ গিলে খাচ্ছে না। বুড়ো বয়সে আর লোক হাসিয়ো না।

মধু মুখটা কালো করে ফেললো। মাহতাব লামিয়া কে ইশারা করতেই লামিয়া মধুকে নিয়ে নামাজের রুমের দিকে চলে গেলো। মাহতাব সাহিদার মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো। সাহিদার চোখে চোখ রেখে বলল,

— কে হাসবে? কার এত সাহস সাহিদা আমাকে আর আমার বউকে নিয়ে হাসবে? আমার বউকে নিয়ে আমি আদিখ্যেতা করি বা তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকি তাতে তোমার এতো জ্বলছে কেন? মুখে ব্রেক লাগাও সাহিদা। ব্রেকফেল হলে ভাঙ্গতে সময় লাগে না।হোক সেটা গাড়ি বা কারো মুখ। নামাজ পড়ে বিশ্রাম নাও।সন্ধ্যায় এসে একসাথে চা খাবো। রাতে তোমার বর আসবে তোমাকে নিতে। আমার লেইট হলে দেখা না করে চলে যেও না কিন্তু। অপেক্ষা করো।আসছি।

সাহিদার মুখ অপমানে থমথমে হয়ে গেলো। ভিতরে ভিতরে সে রাগে ফেটে পরছে। চক্তিম চোখে ছলছল করে উঠেছে। সব রাগ গিয়ে জমা হলো মধুর উপর। এই মেয়েটা আসতেই মাহতাব তার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করা শুরু করেছে। কই আগেতো কখনও এমন করেনি!

মাহতাবের মেজ মামাতো ভাইয়ের বউ এসে স্বান্তনার বাণী শোনালেন। সাহিদার কাধে হাত রেখে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,

— রাগ করো না ভাই। এখনকি আর সে তোমার প্রেমিক আছে? বিয়ে করেছে,ঘরে সুন্দরী বউ আছে। তাকে ছেড়ে কি আর প্রাক্তন কে তোষামোদ করবে? তাও যে কিনা তার যোগ্যতার দোহায় দিয়ে তাকে ছেড়ে গেছে। বাদ দাও। এসো নামাজ পড়ে নেই।

বাড়ির সব মেয়েরা একসাথে নামাজ আদায় করে নিলো৷ মেহরাবরা আগেই মসজিদে চলে গিয়েছিল। মাহতাব কথা বলতে গিয়ে পিছিয়ে গেছে। যেতে যেতে জামায়াত শুরু হয়ে গেছে।

লামিয়া সবাইকে যার যার রুমে পাঠিয়ে নিজে মধুর সাথে মাহতাবের রুমে চলে গেলো। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। তার রুম বর্তমানে মামীদের দখলে।

— তোমার পাশে ঘুমালে তোমার অসুবিধা হবে ভাবি?
মামীরা আমার রুমে রেষ্ট নিচ্ছে। গেস্ট রুমে নাকি তাদের ভালো লাগে না। না করি কি করে বলো? আমি গেস্ট রুমে ঘুমাতে পারিনা। এখন তো ওখানে সাহিদা আপা আছে। কিছু মনে করো না প্লিজ।

মধু তড়িঘড়ি করে বলল,

— আরে কি বলছো আপু। এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিয়ো না। আমার পাশে এসে বসো।

মধু হালকা সরে লামিয়া কে বসার জায়গা করে দিলো। তার মধ্যে আড়ষ্টতা দেখে লামিয়া সন্দিহান গলায় বলল,

— এভাবে ইতস্তত করছো কেন ভাবী? কোন অসুবিধা হচ্ছে? কোথাও ব্যথা করছে? আমাকে বলো।(উদ্বিগ্ন হয়ে)

মধু ইতস্তত গলায় বলল,

— আসলে সব কিছু এমন সাজানো-গোছানো। আমার ভয় করছে।যদি কিছু এলোমেলো হয়ে যায়! উনি রাগ করবেন হয়তো।

লামিয়া শব্দ করে হেসে উঠলো। মধুর গাল টেনে দিয়ে হাসি মুখে বলল,

— শোন ভাবী,ভাইয়া গম্ভীর দেখে সবাই ভাইয়াকে খুব রাগী মনে করে। আসলে কিন্তু ভাইয়া রাগী নয়। রেগে গেলেও ঠান্ডা মাথায় সব কিছু সামলে নেয়। তার ধৈর্যশক্তি দেখলে তুমি অবাক না হয়ে পারবে না। তবে রেগে গেলে তাকে সামলানো যায়না।আমি কখনো ভাইয়াকে রাগতে দেখিনি। তোমার দেবর থেকে শুনেছি। সব সময় চুপচাপ শান্ত থাকা একজন মানুষ সে। তোমার বিয়ের পর থেকে বাধ্য হয়েই স্বভাবের বাইরে গিয়ে এতো কথা বলছেন। আমি যখন এ বাড়িতে থাকতাম,তখন সারাদিনে ভাইয়ার হাতেগোনা কয়েকটা কথা শুনতাম। ভাইয়া তার পরিবার কে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার একমাত্র দুর্বলতা তার পরিবার। পরিবারের মধ্যে যাতে সম্পর্ক নষ্ট না হয় তাই আমরা দূরে। এতো বড় বড় ফ্ল্যাট থাকা সত্বেও ভাইয়া এই চার রুমের ছোট ফ্ল্যাট টা ছাড়ে না। কারণ মা এখান থেকে যেতে চায় না। এখানে বাবার স্মৃতি আছে।তাই ভাইয়াও যায় না।

একদমে কথা গুলো বলে থামলো লামিয়া। মধু অবাক হয়ে মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে। লামিয়া থামতেই মধু অবাক গলায় বলল,

— তোমরা এখানে থাকো না? কিন্তু কেন?

প্রশ্নটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লামিয়া। মধু নিজেও থতমত খেয়ে গেছে।এভাবে জিজ্ঞেস করা হয়তো ঠিক হয়নি।

— বিয়ের এতো বছরেও আমাদের কোন সন্তান নেই তাই মা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন। মাঝে মাঝে এসব নিয়ে ঝামেলা হতো। তাই ভাইয়া আমাদের গুলশানের ফ্ল্যাটে সিফট করিয়ে দিয়েছে।

— কিন্তু সন্তান তো আল্লাহর দান।এতে মানুষের তো কোন হাত নেই।তাহলে তোমার উপর রাগ করে কি হবে?

— এটা কেউ বুঝতে চায় না ভাবী। সবাই মনে করে আমার সমস্যা আছে। মেয়ে কি না! সব সময় দোষ টা মেয়েদের ই থাকে। জানো,আমরা অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কারোর কোন সমস্যা নেই। তবুও কেন আল্লাহ মুখ তুলে চাইছেন না কে জানে?

লামিয়ার কথায় চাপা আর্তনাদ স্পষ্ট। মধু কি বলবে বুঝতে পারলো না। তাই চুপ করে লামিয়ার হাত ধরে বসে রইলো। সারা বিকেল আর দুজনের কারোর ই ঘুম হলো না। গল্প করতে করতে মাগরিবের আজান হয়ে গেলো। সাহিদার হাসব্যান্ড মুহিত এসেছে। সাহিদাই তাকে কল করেছে আসার জন্য। এতো অপমানের পর এখানে থাকার মানেই হয়না। মাগরিবের নামজ পরেই সাহিদা বর বাচ্চা নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মাহতাবের কথায় সে স্পষ্ট বুঝেছে মাহতাব এসে তাকে আর এ বাসায় দেখতে চায় না। কমদিন তো হলো না মানুষ টাকে চেনার৷

মাহতাব এলো আরো পরে। মেহরাব তার সাথেই ছিল।অনেকদিন পর দুই ভাই আজ একসাথে এতটা সময় কাটালো। কাল থেকে আবার ব্যস্ত জীবনে ছুটতে হবে৷

রাতের খাবার খেয়ে বাকি মেহমানরা ও চলে গেলো। মধু রুমে এসে বসতেই মাহতাব ও চলে এলো। মধু গুটিশুটি মেরে খাটের এক কোনায় বসে আছে। মাহতাব ধীর পায়ে এসে মধুর বিপরীত পাশে বসলো।

— শরীর ঠিক আছে?

— হুম।

— মন খারাপ?

মধু চোখ তুলে তাকালো। মাহতাবের শান্ত মুখটা দেখে আবার চোখ নামিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,

— না।

— ভয় পাচ্ছো আমাকে?

মধু হচকচিয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।

— পাওয়া উচিত।

মধু চমকে গেলো। মাহতাবের গলাটা কি অন্যরকম শোনালো?

চলবে,,,

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here