#আমার_অবেলায়_তুমি,০৮,০৯
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_৮
সকালে নাম না জানা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে মধুর। শাহ পাখির ডাক শুনতে পাওয়া দুষ্কর। একটা বড় আমগাছ আছে বাড়ির পেছনের দিকটায়। সেখানেই হয়তো কোন পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। শব্দগুলো খুব কানে লাগছে। কোকিলের মতো মধুর গলায় ডাকলে হয়তো এত কানে লাগতো না। চোখ কচলে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে বলল মধু। পাশের জায়গা টা খালি। এই পাশটায়ই রাতে মাহতাব শুয়েছিল। রাতের কথা মনে হতেই মুখকটা পাংশুটে হয়ে গেলো তার। লোকটা কিভাবে তাকে ভয় দেখাচ্ছিলো!তার ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটা দেখেও তার দয়া হয়নি। ভয় পেলেও মধুর মনের কোন এক জায়গায় মাহতাবের জন্য ভরসা আর বিশ্বাস ছিল।
মাহতাব বিছানার একপাশে শুয়ে গম্ভীর গলায় যখন বলল,
– শুয়ে পরো মধু। আমাকে ভয় পাওয়ার কারণ তুমি নিজেই ভুঝে যাবে একদিন। তার জন্য বাকি জীবন টা তো পরেই আছে।তুমি না বুঝলেও আমি তোমাকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দিবো।এখন ঘুমাও।
মধু মুখটা কাচুমাচু করে শুতে গেলেই মাহতাব ঠান্ডা গলায় বলল,
— রাতের মেডিসিন গুলো খেয়েছো মধু?
— হুম।(হালকা স্বরে)
— আচ্ছা ঘুমাও।
মধু শ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নামল।শরীরে এখনো হালকা ব্যাথা করছে। হাতের পোড়া জায়গায় টান ধরেছে। মাহতাব রুমের কোথাও নেই।
মধু ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো। ময়না বেগম টেবিলে বসে খালার সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। মধুকে দেখেই হাসিমুখে বলল,
— ঘুমা ভাঙলো? মাহতাব সকালেই বেরিয়ে গেছে।ও খুব সকা সকাল বেরিয়ে যায়।আমাকে বললো তুমি ঘুমাচ্ছ। কেউ যেন বিরক্ত না করে। তাই ডাকি নি। এসো নাস্তা করে নাও।
মধু হালকা হাসলো। টেবিলে বসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ধীর গলায় বলল,
— আসলে কিভাবে যে এতো ঘুম এলো বুঝতে পারছি না। আপনারা খেয়েছেন? লুবানা আপু কোথায় আপা?
— আরে এসব নিয়ে ভেবো না। আমাকে কি তোমার কূটনী ননাস মনে হয়? আমরা খেয়ে নিয়েছি। লুবানা তার রুমেই আছে। তুমি খেয়ে নাও। ওষুধ খেতে হবে তো নাকি!
মধু মাথা নাড়লো। ময়না বেগম খালা কে তাড়া দিয়ে বলল,
— খালা, রহিমারে বলো নতুন বউকে নাস্তা দিতে। মধু,,তুমি চা খাবে না কফি?
— চা খাবো আপা।
— ঠিক আছে।
খালা ছুটলো নাস্তা পাঠানোর জন্য৷ মধুর মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো। মানুষ টা তাকে একটু বলেও গেলো না!
নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হলো সে।মাত্র তিনদিনের সম্পর্কে সে মাহতাবের উপর অভিমান করছে!আদোও কি তাদের মধ্যে কোন অভিমান করার মতো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে?
নাস্তা শেষ করে মধু ময়না বেগমের সামনে গিয়ে কাচুমাচু করে দাড়ালো। গলায় অস্বস্তি ঢেলে মিনমিনে গলায় বলল,
— আজকে দুপুরের রান্নাটা আমি করি আপা?
ময়না বেগম চোখ তুলে তাকালেন। মধুর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা ভরে গেলো তার।
— নাহ মধু।তুমি অসুস্থ। আগে সুস্থ হও তারপর দেখা যাবে। রান্নার জন্য সেফ আছে। তুমি গিয়ে ওষুধ গুলু খেয়ে নাও। তারপর রুমেই রেষ্ট করো। মাহতাব দুপুরে খেতে আসবে। এই শরীরে রান্না করেছো শুনলে রাগ করবে।
— আমি একদম ঠিক আছি আপা। এভাবে শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। গা ব্যথা হয়ে গেছে। না করবেন না প্লিজ। আমার একটু ও কষ্ট হবে না। খুব ইচ্ছে করছে। প্লিজ আপা।
ময়না বেগম দ্বিধায় পরে গেলেন। এই শরীরে মধুকে রান্না করতে দিতে চাইছে না।আবার মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিষেধ ও করতে পারছে না। ময়না বেগমের ভাবনার মাঝেই মধু আরো কয়েকবার অনুরোধ করে ফেললো। শেষ পর্যন্ত ময়না বেগম কে রাজি হতে হলো।ময়না বেগম রাজি হতেই মধু উৎফুল্ল গলায় বলল,
— আপনাদের কার কি পছন্দ আমাকে বলে ফেলুন আপা।আজ আমি সবার পছন্দ মতো রান্না করব।
— মাহতাবের বিভিন্ন রকমের ভর্তা আর টক ডাল পছন্দ। আমাদের সবার জন্য যেকোনো একটা আইটেম করলেই হবে। মায়ের ও ভর্তা আইটেম খুব পছন্দ। রহিমা আর খালা তোমাকে সাহায্য করবে।কিছু দরকার হলে সেফ কে বলবে। ঠিক আছে?
মধু প্রফুল্ল মনে কিচেনে চলে গেলো। চারিদিকে সাজানো গোছানো জিনিসপত্র দেখে মনটা আরো ভালো হয়ে গেলো। এমন রান্নাঘর পেলে সে সারাদিন রান্না করতে পারবে।
— রহিমা আপা,আপনি একটু লামিয়া আপুকে জিজ্ঞেস করে আসুন সে কি পছন্দ করে। আর আপনারা আজ কি খেতে চান বলুন। আপনাদের জন্যও আজ আমি রান্না করবো।
রহিমা চোখ গোল গোল করে তাকিয় রইলো। খালা মুচকি হেসে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে মধুকে।কোথায় কি আছে সব নিজে বের করে দেখিয়ে দিচ্ছে।
রহিমা লামিয়ার রুমে গিয়ে দেখে লামিয়া ঘুমাচ্ছে। লামিয়া কে ঘুম থেকে ডেকে তুললে সে সারাদিন মাতবা ব্যথায় ভোগে এটা বাড়ির প্রায় সবাই জানে।তাই রহিমা তাকে না ডেকেই বেড়িয়ে গেল।
— ছোড ভাবি তো ঘুমায় ভাবি। হেতিরে ঘুমের থেইকা ডাইকা তুললে হেতির মাথা বেদনা করে।হেল্লাইগা ডাহি নাই। ছোড ভাবি গরুর মাংস ভুনা মেলা পছন্দ করে৷ আফনে হেইডা করতে পারেন বড় ভাবি।
— আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা কি খাবে বললে না তো।
— আমাগো লেইগা কিছু করা লাগবো না ভাবি। আমগো রান্দা আমি নিজেই কইরা ফেলমু।
আচ্ছা আমাকে এগুলু একটু ধুয়ে দাও। আর শুটকি গুলো ভালো করে ধুবে। ভর্তা করবো আজ।
— আইচ্ছা।আমি জরিরে ডাইকা লইয়া আহি।
— জরি কে?
— এইহানেই কাম করে। সব কছু ধোয়ামোছা করে ও। পুরা নাম জরিনা বানু।
মধু হালকা হেসে বলল,
— আচ্ছা যাও। (হালকা হেসে)
রহিমা খুশিমনে চলে গেলো। মধু হালকা হেসে রান্নায় লেগে পরলো। খালা ময়না বেগমের কাছে গিয়ে বসেছে।তার বেশিরভাগ সময় ময়না বেগম আর কুলসুম বেগমের সাথেই কাটে৷
দুপুরে মাহতাব আর মেহরাব একসাথে বাসায় ফিরেছে। মাহতাব আসার পথে মেহরাব কে হসপিটাল থেকে নিয়ে এসেছে। বাসায় ঢুকতেই শুটকি ভর্তা আর কালোজিরা ভাজার ঘ্রান নাকে এসে বারি খেলো। মাহতাব মুচকি হেসে কপাল কুচকালো। আজ বাসায় কে তার উপর সদয় হলো!
খাবার টেবিলে সবাই আজ আগেভাগেই বসে আছে। লামিয়া একটু পরপর ঢাকনা তুলে দেখছে। পারলে সে এখনই হামলে পরে।
— কি ব্যপার! আজকে এতো আয়োজন কার জন্য?
— ভাইয়া আজকে ভাবি সব রান্না করেছে। আমার তো জিভে পানি চলে এসেছে। শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা,কালোজিরা ভর্তা, মাছ ভর্তা, লাউশাক ভর্তা, ডাল,গরুর মাংস ভুনা সব করেছে।
— হ ভাইজান।আর আমাগো লেইগা বিরিয়ানির করছে। চুলায় আছে এহনো।এগুলা করতে একটু দেড়ি হইয়া গেছিলো। প্রায় হইয়া গেছে।
রহিমা আর জরির চোখ খুশিতে চকচক করছে। তাদের খুশি দেখে মাহতাব মুচকি হাসলো। মেহরাব দ্রুত পায়ে রুমে গেছে ফ্রেশ হতে।লামিয়া ও তার পিছু পিছু ছুটেছে।
— বসো তোমরা।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
কুলসুম বেগম মাথা নেড়ে সায় জানালেন। ময়না বেগম চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে মাহতাব কে দেখছে।
মাহতাব রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। মধু রান্না শেষ করে ওয়াশরুমে ঢুকেছে শাওয়ার নিতে। তারাহুড়ো করছে সে। মাহতাব যে কোন সময় চলে আসবে।
মাহতাব রুমে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলালো।মধুকে না দেখে শ্বাস ছেড়ে গায়ের শার্ট খুলতে লাগলো। মেয়েটা অসুস্থ অবস্থায় রান্না কেন করতে গেলো! ওয়াশরুমে পানির শব্দ পেয়ে মাহতাব বারান্দায় চলে গেলো। মধু রুমে এসে তাকে দেখলে অপ্রস্তুত হতে পারে।
মধু শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। শাড়ি রুমে রেখেই গিয়েছিল। ওয়াশরুমে শাড়ি পড়তে পারে না সে। শাড়ি ভিজে একাকার হয়ে যায়।
শাড়ি দুইপেচ দেয়ার পরেই মাহতাব প্রকট হলো।মধুকে কিছু না বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলো। মধুর হাতের শাড়ি আলগা হয়ে ফ্লোরে পরে গেছে। ঠোঁট দুটো হালকা ফাক করে চোখ বড় বড় করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। মাহতাব তার দিকে তাকিয়েছিল! দেখেছে সে। তীক্ষ্ণ চোখে তার উপর চোখ বুলিয়েছে! কিছু না বলে, স্পর্শ না করেও এভাবে ছোয়া যায় তা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। ওই ধারালো চোখ দিয়েই তাকে স্পর্শ করে গেছে লোকটা! কি সাংঘাতিক!
মাহতাব পাচ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। মধু নিজেকে সামলে কোন রকম শাড়ি পরে নিয়েছে। মাহতাব মধুর পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললো,
— বুঝেছো কেন ভয় পাওয়া উচিত?
মধু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে। ঠোঁট কাপলেও কোন কথা মুখ থেকে বেরুলো না। ভয়ংকর লোক একটা।
চলবে,,
#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_৯
দুপুরের খাবার সবাই খুব আয়েশ করেই খেয়েছে। কুলসুম বেগম সহ সবাই খাবারের খুব প্রশংসা করেছে। ব্যাতিক্রম ছিল মাহতাব। সে কুলসুম বেগম কে খাইয়ে দিয়ে পরে নিজে খেয়েছে। “রান্না খুবই ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ মধু।” তার প্রশংসার ঝুলি এখানেই শেষ। মধুর তাতে মোটেও মন খারাপ হয়নি। মাহতাব কে প্রতিদিনের তুলনায় বেশি খেতে দেখে তার মন এমনিতেই প্রফুল্ল হয়ে গেছে।
রুমের ঘটনার পর থেকে মধু যতটুকু পেরেছে মাহতাব থেকে দূরে দূরে থেকেছে। একবার ও তার সাথে চোখাচোখি হয়নি।
মানুষটার সামনে গেলেই লজ্জায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যখন নিজের রুমে চলে গেলো তখন বাধ্য হয়ে মধুরও রুমের দিকে পা বাড়াতে হলো। মাহতাব এখনো রুমেই আছে। আজ ফ্যাক্টরি তে যাবে সে।তাই বাসা থেকে।একটু লেট করেই বেরুবে।
মধু দরজার সামনে কিছুক্ষণ কাচুমাচু করে দাড়িয়ে রইলো। লোকটা আবার তাকে কিভাবে লজ্জায় ফেলবে কে জানে!
মাহতাব বুঝতে পারলো মধু বাইরে দাড়িয়ে আছে।
— ভিতরে এসো মধু।
মধু হচকচিয়ে গেলো। থম মেরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো। মাহতাব সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মধুর উপস্তিতি টের পেয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে মাথার পিছনে হাত গুজে গা এলিয়ে বসলো। দৃষ্টি মধুতে স্থির। মধু ভরকে গেল। আচল টেনে আড়ষ্ট হয়ে খাটের পাশে দাড়িয়ে রইলো। মাহতাব চোখের পলক ফেলছে না। চশমার ভিতরে চোখ গুলো একদৃষ্টিতে মধুকে অবলোকন করছে। মধু ঘামতে লাগলো। কাপা কাপা হাতে কপালের ঘাম মুছে আড়চোখে মাহতাব কে দেখলো। আল্লাহ! এখনো তাকিয়ে! লোকটা এমন নষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে কেন! এতো ভদ্র মানুষের এমন একটা রুপ কেউ বিশ্বাস করবে? সে কি কাউকে গিয়ে বলবে এ কথা? সবাই পাগল ভাববে না তো?
নিজের মনে তালগোল পাকিয়ে ফেললো মধু। মাহতাব এখনো মধুকে দেখছে। মধুর দিকে চোখ রেখেই এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দিলো। মধুর বুক কাপছে। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে বাইরে চলে এলে বিপদ।
–এ এভাবে ক কি দেখছেন?
— তোমাকে।
মাহতাবের সোজা সাপ্টা জবাব। মধু আবার ভড়কালো। এর পরিবর্তে কি বলা উচিত খোজায় ব্যস্ত হলো। হাজার ভার খুজেও তার শব্দ ভান্ডার খালি। মাহতাব এবার নড়েচড়ে বসলো। চোখের উপর থেকে চশমা টা খুলে দুই হাটুতে ভর দিয়ে বসে বলল,
— অনেকবছর এভাবে মুগ্ধ হয়ে কাউকে দেখা হয়না। তাই দেখছিলাম৷ আপত্তি আছে?
মধু অস্থির চোখে তাকালো। তার অস্থির লাগছে। অস্বস্তি ও হচ্ছে খুব। কিন্তু কিভাবে বলবে। এইজে এখনো কিভাবে তাকিয়ে আছে! সে কিভাবে বলবে আমার আপত্তি আছে। ঘোর আপত্তি আছে।আপনি এভাবে নষ্ট মন নিয়ে আমার দিকে তাকাবেন না। কিন্তু বলতে পারলো না। এভাবে জিজ্ঞেস করলে কি বলা যায়?
— উহু।
মাহতাব হাসলো। মধুর চোখের আড়ালে হালকা করে ঠোঁট বাকালো। মধু মাথা নিচু করে দাড়িয়ে।
— আমার পাশে এসে বসো মধু৷ তোমার সাথে খোলাখুলি কিছু কথা বলি।
মধু ধীর পায়ে গিয়ে মাহতাবের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে বসলো। মাহতাব হাত বাড়িয়ে মধুর একটা হাত নিজের হাতে নিলো। মধুর কাপা কাপা হাতে নিজের অপর হাতটি রেখে মুখোমুখি হয়ে বসে ধীর গলায় বলল,
— আমি কথা গুলো আগেই বলতে চেয়েছিলাম মধু। সময় টা সঠিক ছিল না এই কথা গুলো বলার।
(কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে)বাবা মারা যাওয়ার আগে বাস্তবতা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল শূন্য। বাবারা এরকমই হয় মনে হয়। সমস্ত ঝড় ঝাপ্টা নিজের মধ্যে রেখে আমাদের উপর বটগাছের মতো দাড়িয়ে থাকে। আমার বটগাছের ছায়া যখন আমার উপর থেকে সরে গেল তখন আমি বাইরের উত্তাপ বুঝতে পারলাম। আমার এতো নাম ডাক একদিনে হয়নি। এসব কিছুর পেছনে আমার অক্লান্ত শ্রম আর জীবনের অনেকটা সময় দিতে হয়েছে। আমার তকদিরে ছিল তাই আমি সফল হয়েছি। অনেকে শ্রম দিয়েও সফল হয়না। আমি হয়েছি। আমার সব কিছু আমার পরিবার। তুমি এখন আমার পরিবারের একজন। আমার নিজের একটা অংশ তুমি। তাই তোমার কাছে আমার আবদার, আমার মা আর বোনের উপর কখনো রাগ করো না।তাদের বয়স হয়েছে। বাচ্চাদের মতো আচরণ করে মাঝে মাঝে।এমনিতে তারা কেউ খারাপ নয়।মানুষ হিসেবে তারা খুবই ভালো। তবে কোন মানুষই একেবারে পারর্ফেক্ট হয় না। তারাও নয়। একসাথে থাকতে গেলে নোকঝোক হয়ে গেলে সামলে নিয়। আশা করি কখনো বাড়াবাড়ি কিছু হবে না। যদি হয় তাহলে মনে রাখবে, তাদের জবাব জন্য আমি তোমার মুখ হয়ে যাব। সব কিছু আমি সামলে নিবো।এতটুকু বলতে পারি,তোমার উপর কখনো অবিচার করা হবে না। আম্মা, আপা বায়না করলে মনে করবে আমাদের বাসায় দুটো ছোট বাচ্চা আছে। তারাই তোমার কাছে আবদার করছে। তাদের বাচ্চাদের মতো সামলে নিবে। এইযে এত টাকা, নাম, পতিপত্তি দেখছ। এসব কিছুই আমার সম্পদ নয়। আমার সম্পদ আমার পরিবার,তোমরা। তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো। কখনো মনে কোন অভিযোগ আসলে আমাকে বলবে। আমি তোমার অভিযোগের ডাকবাক্স হয়ে যাবো। তোমার সমস্ত অভিযোগ নিজের ভিতর নিয়ে নিবো। আমার পরিবারটা কে আগলে রেখো। তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার।
মধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাহতাবের কথা শুনছিল। মন থেকে মাহতাবের জন্য অনুভূতি ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মানুষ টার জন্য সম্মান অনেকটা বেড়ে গিয়েছে তার মনে। মাহতাব এখনো তার হাত ধরে বসে।মধুর অস্বস্তি হচ্ছে না। এ স্পর্শ অতি পবিত্র। তার স্বামীর।
— আমি মনে রাখবো। আপনাকে নিরাশ করবো না।ভরসা করেই দেখুন না।
— আমি তোমায় ভরসা করি মধু।
এই কয়েকটা বাক্যে মধুর চোখে আবার পানি এলো। ছলছল চোখে মাহরাবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
মাহতাব চট করে মধুর হাত ছেড়ে দিল। ইদানীং তার কি হয়েছে সে নিজেই জানে না। এই পুচকে মেয়েটাকে দেখলেই অনুভূতিরা ঠেলে বেরিয়ে আসে। মধুকে সে মন থেকেই মেনে নিয়েছে। মধুর জন্য ভাললাগা ও আছে। সেটা এক-দুই দিনের না। অনেক পুরোনো। প্রথম দিনের মধুর সেই অসহায় চোখ মাহতাবের কয়েকরাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। মধুর সমস্ত খোজ খবর নিয়েছিল মাহতাব। মধুর অবস্থার কথা জেনে খারাপ লেগেছে খুব। তবে নিজের বয়সের কথা বিবেচনা করে সামনে আগাতে ইচ্ছে হয়নি। এখন সেই মেয়েটাই তার স্ত্রী। তার পাশেই বসে রয়েছে। মাহতাব কিছু একটা চিন্তা করে বলল,
— আমাকে তোমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে মধু?
— আল্লাহ! এসব কি বলছেন? আমাকে নিয়ে মনের মধ্যে এমন দ্বিধা আনবেন না দয়া করে। আমার সৌভাগ্য আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছি। এসব ভেবে আমাকে অপরাধী করবেন না।
— তার মানে তুমি আমাকে মেনে নিয়েছো?
মধু ভরকে গেল। আবার সেই বেহায়া দৃষ্টি! লোকটা এভাবে তাকায় কেন? চোখ দিয়েই তাকে ভয়।দেখাচ্ছে। মধু হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে মাহতাবের কথার মানে। এভাবে চলতে থাকলে সে হার্ট*ফেল করে মা*রা যাবে।
— এভাবে তাকাবেন না। আমার কেমন যেন লাগে।(মিনমিন করে)
মাহতাব ভিতরের হাসিটুকু বাইরে আনলো না। অসম্ভব কিউট তার বউ৷ বুড়ো না হলে কয়েকদফা দুষ্টুমি করে ফেলতো সে।এই বয়সে এসব করলে নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগবে তাই কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না মাহতাব। একরোখা দৃষ্টিতে মধুকে দেখে শান্ত গলায় বলল,
— কেমন লাগে?যেমনই লাগুক।অভ্যাস করে নাও।
মধু অসহায় মুখ করে বসে রইল। লোকটা কিছু না করেও তাকে জ্বালাচ্ছে।
মেহরাব দুপুরের খাবার খেয়েই বেরিয়ে গেছে। ইদানীং তার ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। লামিয়া বুঝতে পারে।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না।যদি অপ্রিয় কিছু শুনতে হয়! যা সে সহ্য করতে পারবে না। মেহরাব কে একটু বেশিই ভালোবাসে লামিয়া। তার অবহেলা ভিতরে ভিতরে ক্ষত সৃষ্টি করছে।এই ক্ষতর জ্বালা যে বড় ভয়াবহ। মেহরাব কি বুঝতে পারে না! সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও কি যেন একটা স্বাভাবিক নেই। ইদানীং মেহরাব খুব বেশিই ব্যস্ত থাকে৷ বাসায় এলেও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। লামিয়ার তা নিয়ে অভিযোগ নেই। সে শুধু স্বামীর বুকে শান্তিতে কয়েক ঘন্টা ঘুমাতে চায়। ইদানীং মেহরাব বোধহয় তাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে ভুলে যায়। সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলেও মেহরাবের ক্যন হেলদোল হয়না। লামিয়ার মেহরাব কে সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে না।এতে তার নিজের ভালোবাসাই অপমানিত হবে। মেহরাব তাকে ধোকা দিতে পারে না।এ অসম্ভব!, আসলেই কি তাই!
চলবে,,