#আমার_অবেলায়_তুমি,১০,১১
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১০
মাহতাব বেরিয়েছে আসরের আগে আগে। মধু আসরের নামাজ পড়ে কুলসুম বেগমের রুমে গেলেন। ময়না বেগম তার সাথে বসে। দুজনে কিছু একটা আলোচনা করছে।
— আসবো মা?
— আরে এসো বড় বউমা। আমার কাছে এসে বসো।
মধু ধীর পায়ে কুলসুম বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। ময়না বেগম মধুর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
— মাহতাবের সাথে সব ঠিকঠাক আছে ? বজ্জাতটা তোমাকে আবার সিনামার ডায়ালগ শোনায় নি তো?
মধু অবুজের মতো ময়না বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ কিছু না বুঝে মলিন গলায় বলল,
— বুঝি নি আপা।
— আহ! ও মা, মাইয়া তো কিছুই বোঝে না! শোন, মাহতাব কি তোমাকে খাটে জায়গা দিয়েছে? নাকি সিনেমার মতো বলেছে,আমার খাটে তোমার জায়গা হবে না। যাও ব্যালকনিতে গিয়ে শুয়ে পরো।
ময়না বেগমের নাটকিয় ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো মধু। কুলসুম বেগম ধমকে উঠে বলল,
— এসব কি ধরনের কথাবার্তা ময়না। বুড়ো হয়ে যাচ্ছো এখনো বুদ্ধি হলো না? তাদের ব্যক্তিগত ব্যপারে নাক গলাচ্ছো কেন?
ময়না বেগমের কোন হেলদোল হলো না। সে মধুকে উত্তরের জন্য তাড়া দিলো।মধু ময়না বেগমকে আস্বস্ত করে বলল,
— এমন কিছুই হয়নি আপা। সে আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে।
ময়না বেগম হা হুতাশ করে উঠলো। কুলসুম বেগমের কাছে নালিশ করার ভঙ্গিতে বলল,
— দেখেছো মা দেখেছো? বিয়েই করতে চাইছিল না।আর এখন বউ নিয়ে খাটে ঘুমায়!
কুলসুম বেগম বিরক্ত হলেন। মেয়ের ভিত্তিহীন কথা শুনে মুখ কুচকে বললেন,
— তাহলে তুমি কি চাইছিলে? সে বউকে মেনে না নেক? মধুকে ফ্লোরে শোয়ালে খুব খুশি হতে বুঝি?
ময়না বেগম মুখ বাকালেন।
— একদম ছেলের পক্ষ নিবে না। তাহলে এতো ঢং করার কি দরকার ছিল। ওর জন্য আমাদের অনশনে নামতে হয়েছিল ভুলে গেছো! তোমার ছেলের পেটে পেটে শয়তানি।
কুলসুম বেগম চুপ রইলেন। মেয়ের সাথে তর্কে গিয়ে নিজের ছেলেদের নামে বদনাম শুনতে সে মোটেও ইচ্ছুক নয়।
মধু কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমতা আমতা করে বলল,
— চা খাবেন মা? আপা আপনার জন্য চা নিয়ে আসি?
— ওমা,তুমি যাবে কেন? রহিমা দিয়ে যাবে। খালা এলেই একসাথে খাবো।
— আমি করে আনি প্লিজ।এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না আপা।
ময়না বেগম হেসে ফেললো।
— আচ্ছা যাও৷ মায়ের ডায়েবিটিস আছে। চিনি দিও না।
— আচ্ছা।(হালকা হেসে)
— লামিয়া কেও ডেকে নিও। মেয়েটার যে কি হয়েছে কে জানে? খুব চুপচাপ থাকে ইদানীং।
মধু মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে চলে গেলো। লামিয়ার রুমের সামনে গিয়ে দরজায় হালকা নক করলো।
— আপু,,আছো?
— কে, ভাবি?দরজায় দাড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো।
লামিয়া বারান্দা থেকে তড়িঘড়ি করে রুমে এলো। মধু রুমে ঢুকে লামিয়ার মলিন চেহারা দেখে নিজের মুখটাও মলিন করে ফেললো।
— বসো না ভাবি।
— বসবো না আপু। সবার জন্য চা বানাবো। তুমিও এসো না বাইরে।
— তাই! চলো তাহলে।
লামিয়ার সাথে কিচেনে চলে গেলো মধু।
মেহরাব আসলো সন্ধ্যায়। লামিয়া নিজেই গিয়ে দরজা খুললো। মেহরাব মলিন হাসলো। লামিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেহরাবের ক্লান্ত মুখের দিকে।
— ভিতরে আসতে দিবে না?
— ওহ,,এসো।
মেহরাব হেসে লামিয়ার নাক টেনে দিলো। ভিতরে ঢুকে ময়িনা বেগম কে ড্রয়িং রুমে দেখে অসহায় চোখে লামিয়ার দিকে তাকালো। ময়িনা বেগম নিশ্চিত এখন তার ক্লাস নিবে!
— এদিকে আয়।
— ফেশ হয়ে আসি আপা?বাইরে থেকে এসেছি। শরীরে খুব জীবানু। পাচ মিনিটে আসছি।
— একদম নাটক করবি না।আম্মার জন্য আখ আনতে বলেছিলাম, কাঠ নয়। তুই কি আমাদের দাত ভেঙ্গে মা*রতে চাইছিলি? (কটমট করে)
— কি বলো আপা!আমি নিজে খেয়ে চেক করে এনেছি।আখ তো ভালোই ছিল।
— আমি মিথ্যা বলছি?তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বললি!মায়ের পেটের ভাই হয়ে তুই আমাকে এভাবে অপমান করলি! ওমা,,দেখে যাও তোমার ছেলে আমাকে কি বলছে।আমি আজই বাপের বাড়ি চলে যাবো।
মেহরাবের মুখটা থতথমে হয়ে গেলো। কোথাকার কথা কোথায় চলে গেলো তা ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে যাওয়ার জোগাড়। সে হতভম্ব গলায় বলল,
— তুমি বাবার বাড়িতেই আছো আপা।
— তুই আমাকে বাবার বাড়ির খোটা দিলি! তোদের বাড়ি থাকি এটা চিৎকার করে বলে আমাকে অপমান করলি! আমি আজই চলে যাবো। ছোট ভাইদের এতো অপমান সহ্য করে থাকতে পারবো না।ও বাবা গো,,তুমি আমাকে কোথায় ফেলে গেলে!
মেহরাব মুখটা কাচুমাচু করে ফেলল।তার মনে হতে লাগলো সে নিশ্চয়ই আপা কে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। সব দোষ ওই বেটা আখ ওয়ালার। তাকে এই ভাবে ফাসিয়ে দিলো!
লামিয়া ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। যে কোন সময় তার মুখ ফসকে হাসি বেরিয়ে যাবে।
ময়না বেগমের আহাজারি শুনে মধু কিচেন থেকে বেড়িয়ে এসেছে। মেহরাবের কাচুমাচু মুখটা দেখে তার বড্ড মায়া হলো। ময়না বেগম আচলে মুখ গুজে গুনগুন করে কাদছে।
কুলসুম বেগম রুম থেকে রহিমার সাহায্যে বেড়িয়ে এসেছে। মেয়ের অত্যাচারে তার ছেলে দুটো অতিষ্ঠ। তবুও মুখ ফুটে একটা শব্দ ও করে না।
— দাড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে ফ্রেশ হও।
মায়ের অনুমতি পেতেই মেহরাব দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো। মেহরাব যেতেই ময়না বেগম কান্না বন্ধ করে চা খাওয়ায় মন দিলো। কুলসুম বেগম দু পাশে মাথা নাড়িয়ে মেয়ের পাশে বসে পরলো।
— আর কতো জ্বালাবে ওদের? সারাক্ষণ পিছনে পরে থাকো কেন? সমস্যা কি?
ময়না বেগম চা রেখে আবার গুনগুন করে কাদতে লাগলো। আচল দিয়ে নাকের পানি মুছে হা হুতাশ করে বলল,
— তুমি এই কথা বলতে পারলে মা!এই তুমি আমার মা তো? নাকি আমাকে ড্রেনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলে? সত্যি করে বলো আমি বাবার আগের ঘরের মেয়ে না তো?(সন্দিহান গলায়)
— পাগল হয়ে গেছো? কিসব বাজে কথা বলছো?
— সত্যি করে বলো কোন ড্রেনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলে? আমি সেখানেই চলে যাব। তখন অন্তত কেউ থাকার খোটা দিবে না।
কুলসুম বেগম চুপ রইলেন। কথা বাড়িয়ে নিজের মাথা খারাপ করার মানে হয়না।
মধু অসহায় চোখে তাকিয়ে সব দেখছে।তার কি বলা উচিত, কি করা উচিত মাথায় আসছে না। তাই চুপ করে এক কোনে দাড়িয়ে রইলো। লামিয়া মেহরাবের সাথে সাথেই রুমে ঢুকেছে।
মাহতাব আসতে আসতে রাত দশটা বেজে গেছে। মেহরাব ময়না বেগমের ভয়ে আর রুম থেকেই বের হয়নি।কখন আপার কোন কথার প্যাচে পড়তে হয় কে জানে!
রাতে খাবার টেবিলে ময়না বেগম কে দেখা গেল না। মাহতাব জিজ্ঞেস করতেই লামিয়া সবকিছু খুলে বললো। মাহতাব দারোয়ান কে কল করে আখ নিয়ে আসতে বলে ময়না বেগমের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
— আপার মেডিসিন গুলো বদলানো দরকার ভাই।ইদানীং বেশি বাচ্চামি করছে।
মাহিতাব ‘দেখছি’ বলে ময়না বেগমের রুমে চলে গেলো।
— আপা।
— আমি কারো আপা না। আমাকে ড্রেনের পাশে রেখে আয়। আমি ওখানেই থাকবো।
— তুমি আমাদের একমাত্র আপা। তোমাকে ড্রেনের পাশে রেখে আমরা বাসায় থাকবো কি করে? তার চেয়ে বরং আমরা সবাই ড্রেনের পাশে চলে যাবো। ড্রেনের আশে পাশে একটা বাসা বানিয়ে নেই আগে।এখন চলো খাবে।
— তোরা কেন যাবি? তোরা তো ইব্রাহীম বাড়ির ছেলে।আমাকে কুড়িয়ে এনেছে আমি যাব।
— খুদা পেয়েছে আপা। আসো না।
মাহতাবের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জেদ ছেড়ে দিলো ময়না বেগম। ভাইয়ের ক্লান্ত মুখে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
— না খেয়ে আছিস কেন ভাই? খেয়ে নে।
— তোমাদের ছাড়া আমি খাই?
— চল চল।আগে খেয়ে নেই। খাওয়ার পরে তোর ছোট ভাই আর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সাথে একটা হেস্তনেস্ত করবো।
— আচ্ছা।
ময়না বেগম কে ডাইনিং এ দেখে মেহরাব দাত বের করে হাসলো। নিজের চেয়ার ছেড়ে ময়না বেগমের পাশে বসে আহ্লাদী গলায় বলল,
— রাগ করো কেন আপা। আমি তো তোমার সাথে মজা করছিলাম।
— দূর হ বেয়াদব।তোকে আমার ভালো করে চেনা আছে।আস্তো বদ একটা। গিয়ে তোর মায়ের কোলে উঠে বসে থাক।আমার পাশে আসবি না।
মেহরাব ময়না বেগমের কথা পাত্তা না দিয়ে তাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরল। ময়না বেগমের গালে চুমু খেয়ে শব্দ করে হাসলো।মাহতাব আর কুলসুম বেগম মুচকি হাসলো।
— তুমিও বসে পরো মধু। আমরা নিজেদের টা নিয়ে খেতে পারি।দাড়িয়ে থাকতে হবে না।
মধুও বসে পরলো তাদের সাথে। এই পরিবার টা দেখলে ওর মন ভরে যায়। এতো ভালোবাসায় ঘেরা পরিবার টা এখন তার নিজের। এই ভালোবাসাময় মানুষ গুলো ও তার।
কয়েকদফা বৈঠক শেষ করে রুমে যেতে যেতে বারোটা বাজলো।মাহতাব আজ খুব ক্লান্ত। কয়েক জায়গায় দৌড়াতে হয়েছে আজ।
— আপাকে কিন্তু আমার দারুণ লাগে।
মধু হাসিমুখে কথাটা বলে বিছানা ঠিক করতে লাগলো।মাহতাব কপালে হাত রেখে সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিল। মধুর কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো। ধীর পায়ে হেটে মধুর পিছনে দাড়িয়ে মন্থর গলায় বলল,
— আর আপার ভাইকে?
মধু কেপে উঠলো। হচকচিয়ে ঘুরতে গিয়ে মাহতাবের বলিষ্ঠ বুকে ধাক্কা খেয়ে বিছানায় বসে পারলো।
— বললে না তো!
মধু অসহায় মুখে হাত কচলাতে লাগলো।মাহতাব এখনো দাঁড়িয়ে। যেন জবাব না নিয়ে সে যাবে না।
চলবে,,
#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১১
“আপার ভাইকে তোমার কেমন লাগে বললে না তো মধু”
মধু দ্বিধান্বীত চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে।মাহতাব পকেটে হাত গুজে দাড়িয়ে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে উত্তর দিতে না পারলে তাকে শূণ্য দিয়ে ফেইল করানো হবে। মোটা বেত দিয়ে দু ঘা লাগিয়েও দিতে পারে। মধু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
— ভালো।
— শুধু ভালো!
মধু অসহায় বোধ করলো। মনে মনে লোকটাকে খুব জেদি ঘোষিত করে আচ্ছা করে ঝেড়ে দিলো।
— ঘুমাতে হবে মধু। একটু তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয়।
মাহতাবের কথা শেষ হতেই মধু টানটান হয়ে শুয়ে পরলো। মাহতাব এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। মধু মাহতাব কে মেকি তাড়া দিয়ে বলল,
— তাড়াতাড়ি শুয়ে পরুন। কাল অফিস আছে না?ঘুমাতে হবে তো। এক টা বাজলো প্রায়!
মাহতাব শান্ত গলায় বলল,
— উত্তর না দিলে ঘুমাতে দিবো না।
মধু অসহায় গলায় বলল,
— আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন? আপনি কি রেগে আছেন।
মাহতাবের সোজা জবাব,
— না।
— কাল উত্তর দিবো। এখন ঘুমান।প্লিজ!
— আচ্ছা। ওহ! আমি তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম মধু৷ তুমি কিন্তু রাতে মারাত্মক নাক ডাকো। সে জন্য মাঝে মাঝে আমার তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে হয়। ভেবো না আমি ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরি। শুধু নাক ডাকা বন্ধ করার জন্য ধরি। আমাকে ভুল বুঝবে না। ঠিক আছে?
মধু তাড়াক করে উঠে বসলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে হতভম্ব গলায় বলল,
— কি বলছেন! আমি সত্যিই নাক ডাকি? আগে তো কেউ কখনো বলে নি!
মাহতাব বিছানার আরেক পাশে নিজের গা এলিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— আগে কি তোমার বর ছিল? এখন তোমার বর আছে। সে রাতে মনোযোগ দিয়ে তোমার নাক ডাকা শোনে। তাই আজ তুমি জানতে পারলে৷ কয়েক বছর আগে বিয়ে করলে আগেই জেনে যেতে। ভেরি ভেরি ব্যাড লাক মধু।
মাহতাবের আফসোস শুনে মধুর চোখ টলমল করে উঠলো। নিজের এমন সাংঘাতিক একটা সমস্যা জানেনা ভেবে নিজেকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হলো খুব! কি আশ্চর্য! এ জীবন তার ষোল আনাই বৃথা। এই অসভ্য নাক টাকে বটি দিয়ে কেটে ফেলার তীব্র বাসনা মনে চাপা দিয়ে
বালিশ নিয়ে নিচে নামতেই মাহতাব হাত ধরে আটকালো।
মধুকে নিজের পাশে বসিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— কোথায় যাচ্ছো?
মধু নাক টেনে বলল,
— নিচে যাচ্ছি। আমার জন্য আপনার ঘুমের অসুবিধা হবে। বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না আমি নাক ডাকি।জানলে আপনাকে বিরক্ত করতাম না। আমি বরং বারান্দায় ঘুমাই? আপনি এখানে আরাম করে ঘুমান।
— বারান্দায় ঘুমালে তোমার নাক ডাকার শব্দে পাশের বাসার সবার ঘুম ভেঙে যাবে। চিন্তার কোন কারণ নেই। তুমি নাক ডাকলে আমি তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো। ঠিক এভাবে।
কথা শেষ করেই মাহতাব মধুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরেছে। স্বামীর প্রথম আলিঙ্গন অনুভব করা বাদ দিয়ে মধু প্রতিবেশীর ঘুম ভাঙা নিয়ে ভাবতে বসলো। সে কি এতো জোরেই নাক ডাকে যে পাশের বাসার মানুষের ঘুম ভেঙ্গে যাবে! এই যে এখন নাক থেকে শব্দ বের হওয়ার ভয়ে সে খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে। এভাবে নিলে তো আর কারোর ঘুম ভাঙ্গবে না। আচ্ছা, নাকে একটা ক্লিপ লাগিয়ে নিলে কেমন হয়?
হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে মধু ঘুমিয়ে গেলো। মাহতাব তার সহজ সরল বউয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বুকের সাথে আরেকটু গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে ধীর গলায় বলল,
— ভালোবাসা নাম্বার পাচ।
ভোর সারে চারটায় ঘুম ভাঙ্গলো মধুর। নিজেকে মাহতাবের বাহুবন্ধনীতে দেখে লাফিয়ে উঠলো। ভয়ার্ত চোখে মাহতাবের কোচকানো গেঞ্জির দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা হাতে তা ঠিক করে দিলো। এখন কি সে ঘুমের মাঝে মানুষের গেঞ্জি ধরে টানাটানি করে নাকি! এই অভ্যাস কবে থেকে হলো! কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য!
ওয়াশরুম থেকে ওজু করে এসে দেখে মাহতাব উঠে পরেছে। ঘুমে ফোলা ফোলা চোখে কুচকে বিছানায় বসে আছে। ঘুম ঠিকভাবে না হওয়ার দরুন মাথা ব্যাথা করছে৷ চোখ ও হালকা জ্বালাপোড়া করছে।
মধুর মন খারাপ হয়ে গেলো। বেচারা রাতে তার জন্য ঘুমাতে পারেনি হয়তো। মুখ কালো করে মাহতাবের কাছে গিয়ে ধীর গলায় বলল,
— মসজিদে যাবেন না?
— যাবো।
— আচ্ছা। আমি নামাজের রুমে গেলাম।
— যাও।
মধু বিষন্ন মনে নামাজ আদায় করতে চলে গেলো। মাহতাব সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা এতো আদুরে কেন?
সকালে মাহতাব আজ দেড়ি করে উঠেছে। নামাজ পড়ে এসে আরো কয়েকঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। ঘুম ঠিকভাবে না হলে সারাদিন খারাপ যাবে।কোন কাজ ঠিক হবে না।
নাস্তার টেবিলে মেহরাব বাদে বাকি সবাই মাহতাবের জন্য অপেক্ষা করছে। লামিয়া উদাস মনে বসে আছে। ময়না বেগম কয়েকবার খেয়াল করলেও কিছু বলেনি।ইদানীং মেহরাব খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। আসেও খুব দেড়ি করে। লামিয়ার মন খারাপের কারণ সে কিছুটা আচ করতে পারছে। তবে ভাইয়ের উপর তার বিশ্বাস একচুলও কম নেই। তার ভাইয়েরা লাখে একটা। তাই সে নিশ্চিন্ত।
ময়না বেগম নিজেও ডিপ্রেশনে রুগী। সে চায় না লামিয়া অযথা মন খারাপ করে ডিপ্রেশনে তলিয়ে যাক। আগে মেহরাবের খবর নিতে হবে। ভাইয়ের উপর তার পূর্ণ ভরসা আছে৷ কিন্তু তার ভাই মানুষ। আর মানুষ বদলায়। মেহরাব যদি বদলে গিয়ে কোন কেলেংকারী করে থাকে তাহলে সে লামিয়া কে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবার বিয়ে দিবে। মনে মনে পাশের বাসার হ্যান্ডসাম ছেলেটা কে লামিয়ার জন্য ঠিকও করে ফেললো। যৌতুক হিসেবে মা আর মাহতাব কে পটিয়ে এই বিল্ডিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোর লিখে দিবে লামিয়ার নামে। স্বামী নিয়ে সেও এখানেই থাকবে। মেহরাবের চোখের সামনে বরের হাত ধরে ঘুরে বেরাবে লামিয়া। তখন বেয়াদপ টা বুঝবে কেমন লাগে।
ময়না বেগমের বিস্তর পরিকল্পনার মাঝেই মাহতাব উপস্থিত হলো। চোখ গুলো লাল হয়ে ফুলে আছে। কুলসুম বেগম চিন্তিত হলেন। ব্যাস্ত গলায় বললেন,
— তোমার চোখে কি হয়েছে বাবা? এভাবে ফুলে আছে কেন? রাতে ঘুমাও নি?
— ঘুমিয়েছি আম্মা। মাথা ব্যাথা করছে তাই এমন দেখাচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে।
— খেয়ে মেডিসিন নিয়ে নাও। আজ পারলে অফিস মিস দাও। অসুস্থ শরীর নিয়ে অফিস যেতে হবে না।
— যেতেই হবে আম্মা। অনেক কাজ জমে আছে। আমি তারাতাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করবো। চিন্তা করবেন না।বেশি খারাপ লাগলে বাসায় চলে আসবো।
কুলসুম বেগম মাথা নাড়লেন। ছেলে কাজের বেলায় খুব দায়িত্বশীল। তাই তাকে আটকানো উচিত হবে না।
মধুর মুখ কালো দেখে ময়না বেগমের ভ্রু কুচকে গেল। এখন কি ওর জন্য ও ছেলে খুজতে হবে নাকি! এভাবে মুখ ফুলিয়ে রাখার কি হলো! চোখ ছোট ছোট করে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে পরোটা চিবাতে লাগলো সে। এই বদ আবার কি করেছে? ছোট বউ এনে দিয়েছি।সারাক্ষণ বউয়ের আগে পিছে ঘুড়বি। তা না করে ফ্যাক্টরির আগে পিছে ঘুরছে। আহ!বউ গুলোর কপাল খারাপ।
কুলসুম বেগম খেতে খেতে মাহতাব কে বললেন,
— শেষ বয়সে এসে বিয়ে করেছো। বছর ঘুরতেই নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই। কবে মরে যাই ঠিক নেই। মরার আগে অন্তত বংশের প্রদীপ দেখে যেতে চাই।
মাহতাব বাদে সবার খাওয়া থেমে গেলো। মধু মাথা নিচু করে বসে আছে। লামিয়ার মন আবার বিষন্নতায় ভরে উঠলো। ময়না বেগম মাকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মাহতাব যখন আছে তখন তার মুখ খোলার দরকার নেই। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাহতাবের ছোট্ট জবাব,
— আচ্ছা।
মধু চোখ বড় বড় করে তাকালো মাহতাবের দিকে। আচ্ছা! আচ্ছা মানে কি? বাচ্চা কি অনলাইন অর্ডার করেছে নাকি!এভাবে আচ্ছা বলে তাকে হার্ট অ্যাটাক দেয়ার অপচেষ্টা কেন করা হচ্ছে? লোকটার কোন সিক্রেট বাচ্চাকাচ্চা নেই তো! কি ভয়ংকর!
ময়না বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের স্বরে কিছু বলতে গিয়েও বলল না।মায়ের আহ্লাদে আটখানা মুখ দেখে নিজেকে কনট্রোল করে ফেললো। লামিয়া নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মাহতাব ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবাইকে বলে বেড়িয়ে গেল।
মধুর মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো। শুধুমাত্র তার নাক ডাকার জন্য একটা সুস্থ মানুষ এভাবে অসুস্থ হয়ে গেলো! এখন কেমন ভুলভাল বকছে। কষ্টে তার গলায় খাবার আটকে গেল। মনে মনে সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। আজ থেকে আর রাতে ঘুমানো যাবে না। দরকার হলে ভুরুর সাথে চোখ টেপ দিয়ে আটকে দিবে। তবুও ঘুমাবে না।তাতে যদি মানুষ টা সুস্থ হয়!
চলবে,,,