#আমার_অবেলায়_তুমি,১৪,১৫
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৪
“তোমরা কি বিয়ে করেছো?”
কুলসুম বেগমের সন্দিহান প্রশ্নে সবাই বিরক্ত হলো। মাহতাব ময়না বেগম কে শান্ত করে বসিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলল,
— আম্মা,,বুঝদার মানুষ হয়েও অবুঝের মতো কথা আপনার কাছে আমাদের কারোরই কাম্য নয়। দয়া করে পরিস্থিতি বুঝে কথা বলুন।
কুলসুম বেগম কপালে ভাজ ফেলে ছেলের দিকে তাকালো। ছেলেমেয়েদের এমন ব্যবহারে সে বিরক্ত। বিয়ের ছয় বছরেও যখন তাদের কোন সন্তান নেই তাহলে মেহরাব আরেকটা বিয়ে করতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। সে তো আর লামিয়া কে ফেলে দিচ্ছে না। লামিয়া ও আগের মতোই এ বাড়িতে থাকবে। যে সংসারে বাচ্চাকাচ্চা নেই সে সংসার কে কি সংসার বলে!
— তোমরা বাড়াবাড়ি করছো মাহতাব। মেহরাব যদি এই মেয়েকে বিয়ে করে থাকে আমি তো এখানে দোষের কিছু দেখছি না। আমি চাই মেহরাব সন্তানের মুখ দেখুক। এখানে ভুল টা কোথায় বলবে?
মেহরাব ছাড়া বাকি সবাই আহত চোখে কুলসুম বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। ময়না বেগম কিছু বলতে গিয়েও মাহতাবের ইশারায় থেমে গেলো। মেহরাব আগের মতোই মাথা নিচু করে বসে। খালা সহ রহিমা আর জরি কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখেই অশ্রু জমেছে।
কুলসুম বেগমের প্রশ্রয়ের কথায় এলিজা যেন একটু সাহস পেল। আগের মতো ভয়ের আভা তার মুখে আর দেখা যাচ্ছে না৷ মাহতাব সবার দিকে চোখ বুলিয়ে মেহরাব কে উদ্দেশ্য করে বলল,
— তুই কি নিজের ব্যপারে কিছু বলতে চাস?
মেহরাব কারো দিকে তাকালো না। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো সে। পুরো জীবন টাকেই অর্থহীন লাগছে তাঁর কাছে। পরিবারের মানুষ গুলো ও তাকে বিশ্বাস করছে না! লামিয়া তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে কি হবে।
সবার এমন খাপছাড়া ব্যবহার দেখে ময়না বেগম তেতে উঠল। এলিজার দিকে তেড়ে গিয়ে রাগে গড়গড় করতে করতে বলল,
— এই মেয়ে, মুখ খোল। এরকম নোংরা কাজ কেন করেছিস? আমার ভাই কোনদিন ও এমন কাজ করবে না আমরা সবাই তা ভালো করে জানি। এখন যদি সত্যি কথা না বলিস তাহলে এই মুখ নিয়ে আর বের হতে পারবি না। তোর ওই মুখ ভেঙ্গে আমি স্টোর রুমে রেখে দেবো।
— আহ ময়না! অভদ্রের মতো ব্যবহার করছো কেন? বাচ্চা যদি মেহরাবের হয় এটা তো খুশির কথা। তোমরা অযথাই ঝামেলা করছো।
— তুমি চুপ করো আম্মা। তোমার বিবেচনা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি এই বাড়ির মুরব্বি। তোমার এমন অবিবেচকের মতো কথা মানায় না আম্মা। এই মেয়ে, তুই মুখ খুলবি নাকি আমি তোর মুখ ভাঙ্গবো?
এলিজা থরথর করে কাপছে। এক থাপ্পড় খেয়ে তার গাল টনটন করে ব্যথা করছে। আরেকটা খেলে দাত আর মুখে থাকবে না। সব পেটে চলে যাবে।
মাহতাব এখন আর ময়না বেগম কে আটকাচ্ছে না। সে চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। স্থির দৃষ্টিতে মা আর ভাইকে দেখে যাচ্ছে। এই মেয়ের কথায় তার কোন আগ্রহ নেই।
মধু গোল গোল করে ময়না বেগম আর এলিজা কে দেখছে। কখন ময়না বেগম আরেকটা দিয়ে গাল লাল করবে সেই অপেক্ষা। অসভ্য মেয়ে একটা।
— রহিমা আমার জন্য হাতুড়ি নিয়ে আয়। এই মেয়ে এভাবে মুখ খুলবে না।
এলিজা কেপে উঠলো। সোফার একপাশে সেটে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল,
— বলছি, বলছি। মাসখানেক আগে আমার মেহরাবের সাথে দেখা হয় নিউমার্কেট এরিয়ায়। তখন কথায় কথায় জানতে পারি মেহরাবের কোন সন্তান নেই। মেহরাবের এ নিয়ে কোন মন খারাপ ও ছিল না। তবে সে লামিয়া কে নিয়ে চিন্তিত ছিল। লামিয়া নাকি ইদানীং মেহরাবকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। অদ্ভুত সব ব্যবহার করে। তাই ও একটা বাচ্চা দত্তক নিতে চাইছিল। আমার তখন সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। এই বাচ্চাটা আমি নিজেও রাখতে চাইছিলাম না। এবোর্শন করতে গিয়েও কিছু কমপ্লিকেশনস এর কারনে করতে পারিনি। তাই আমি মেহরাব কে অফার করি আমার বাচ্চাটা দত্তক নেয়ার জন্য। মেহরাব খুশিমনে রাজি হয়ে যায়। তারপর থেকে মেহরাব আমার খুব যত্ন নিতো। আমার কখন কি লাগবে তা কখনো বলতে হয়নি। বলার আগেই মেহরাব সব হাজির করেছে। ওর কেয়ার দেখে আমার মনে লোভের জন্ম হয়। কারণ আমার স্বামী কখনো আমার এভাবে খেয়াল রাখেনি। ভিনদেশী হওয়ার দরুন ওদের মধ্যে এমন কেয়ারিং ভাব টা কাজ করেনা। তাই আমি ভাবলাম মেহরাব যেহেতু আমার সন্তান কে নিজের পরিচয় দিচ্ছে সেখানে আমাকে দিলে দোষ কোথায়? লামিয়ার জায়গায় আমি ও তো থাকতে পারি৷ তাই আমি কাল এ বাসায় আসি। লামিয়ার এমনিতেই মেহরাবের উপর সন্দেহ ছিল। আমার সব কিছু গুছিয়ে বলায় ও কিছুটা কনভিন্স হয়। পুরোপুরি বিশ্বাস করাতে আমি লামিয়ার সামনে মেহরাব কে কল করি। মেহরাব রিসিভ করতেই আমি বলি,”তোর মেয়ে আমাকে বিরক্ত করছে। একেবারে তোর মতো হবে দেখবি।যেমন বাবা তার তেমন মেয়ে।”
“দেখতে হবে না মেয়েটা কার।”
আমাদের কথাবার্তা শুনে লামিয়া বিশ্বাস করে নেয় এটা মেহরাবের সন্তান। আমি লামিয়াকে অনুরোধ করি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। তার জন্যই মেহরাব আমাকে এ বাড়িতে আনতে পারছে না। লামিয়া শুধু চুপ করে আমার কথা শুনেছে। আমি ও খুশিমনে ফিরে গিয়েছি কাল। লামিয়া যেহেতু চলে গেছে তখন তার জায়গায় আমি থকলে সমস্যা কোথায়? আমার সন্তান তার সত্যিকারের মায়ের ভালোবাসা পাবে। পরবর্তীতে আমরা আবার বাচ্চা নিবো। আপনি বলুন আন্টি,আমাকে মেনে নিতে তো আর কোন আপত্তি থাকার কথা নয়।
এলিজার গালে আরেকটা চ*ড় পরেছে।আর এবার মেরেছে স্বয়ং কুলসুম বেগম। অতটা জোড়ালো না হলেও ভালোই লেগেছে এলিজার। সে এখনো গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কুলসুম বেগম নিজের জায়গায় বসে শ্বাস টানতে টানতে বলল,
— পুলিশ কে কল করো মাহতাব। এই মেয়েকে এক্ষুনি পুলিশে দিবে। ক্রিমিনাল একটা।
মাহতাব আগেই পুলিশ খবর দিয়েছে। তাই মা কে আস্বস্ত করে শান্ত হতে বলল।পুলিশ সব জায়গায় লামিয়ার খোজ করছে। মেয়েটা কোথায় আছে কে জানে!
— রহিমা,,আম্মাকে পানি দে।
— আইচ্ছা ভাইজান।
রাহিমার যেতে যেতে আফসোসের গলায় বলল,
— আম্মার মা*রার কি দরকার আছিল। আফায় মা*রলে তো ভালো কইরা দিতে পারতো। নাগিন বেডি।
— মেহরাব,,,
মেহরাব আগের মতোই চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ভাইয়ের ডাকে চোখ তুলে তাকালো। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মলিন হাসল।
— এতগুলো বছরেও আমি তোমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি ভাই! (আফসোসের স্বরে)
— আমরা তোকে বিশ্বাস করি। তাই এই মেয়েকে তোর মুখোমুখি করেছি। যাতে সব কিছু তোর সামনে আসে। কাল রাতে যখন লামিয়াকে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন মধু আমাকে বিকেলের ঘটনা বলে। আমি ছাদের সিসিটিভি চেক করে দেখে এই মেয়েকে সন্দেহ হয়। তাই আজ সকাল হতেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুই ব্যপারটা লামিয়ার সাথে শেয়ার করতে পারতি। তাহলে আজ এই পরিস্থিতিতে পরতে হতো না। স্বামী স্ত্রীর মাঝে কখনো তৃতীয় কাউকে আনতে নেই মেহরাব। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হওয়া চাই কাচের মতো সচ্ছ। গোপনীয়তা আসলেই সেখানে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। অন্তত পক্ষে আমার সাথে আলোচনা করতে পারতি।
— আমি চেয়েছিলাম ভাই। সব কিছু সামলে আমি তোমাদের সবার সাথে আলোচনা ও করতাম। লামিয়া কে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম আমি। এমন কিছু হবে আমি স্বপ্নে ও ভাবিনি। এই মেয়েকে আমার সামনে থেকে সরাও ভাই৷ আমি কি করে ফেলবো আমি নিজেও জানি না।
রহিমা কুলসুম বেগম কে পানি দিয়ে মাহতাব কে বলল,
— পুলিশ আইছে ভাইজান।
— ভিতরে নিয়ে আয়।
রহিমা দরজার দিকে ছুটলো। এলিজা বার বার সবার কাছে ক্ষমা চাইছে। কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ময়না বেগম কিছুক্ষণ পর পর কটমট করে তাকাচ্ছে৷ মাহতাব তার একহাত ধরে রেখেছে। তাই সে কিছু করতে পারছে না।
পুলিশ ভিতরে আসতেই মাহতাব তাদের সাথে হাত মিলিয়ে বসতে বলল।
— লামিয়ার কোন খবর পেয়েছেন অফিসার?
— জি স্যার। সে বনানীতে তার এক ফ্রেন্ডের বাসায় আছে। ফোন কিছুক্ষণের জন্য অন করেছিল। আমরা লোকেশন ট্রেক করে সেখানে গিয়েছলাম। ম্যাম বলেছে সে নিজের ইচ্ছায় সেখানে গিয়েছে। আর সে এ বাড়িতে আসবে না।
— ঠিক আছে। বাকিটা আমি সামলে নিবো। আপনি আপাতত এই মেয়েকে নিয়ে যান। আমি পরে থানার গিয়ে সব ফর্মালিটিস পূরণ করে আসবো।
— ঠিক আছে স্যার।
পুলিশ এলিজা কে নিয়ে যেতেই মেহরাব উঠে কুলসুম বেগমের মুখোমুখি দাড়ালো। মায়ের গালে হাত রেখে করুন গলায় বলল,
— আমার সন্তান চাই না আম্মা। সন্তান ছাড়া ও আমি বেচে থাকবো। কিন্তু লামিয়া কে ছাড়া আমি ম*রে যাবো আম্মা। লামিয়ার জায়গা অন্য কাউকে দেয়া আমার এই জীবন থাকতে সম্ভব না। ওকে আর এসব নিয়ে কিছু বলো না আম্মা। ও মানুসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছে।আমি অনুরোধ করছি আম্মা।
ভাই,আমি লামিয়াকে আনতে যাচ্ছি। আমি ওকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে যাবো। তুমি কি যাবে আমার সাথে?
— হুম।
দুই ভাই বেড়িয়ে গেল। ময়না বেগম আঁচলে মুখ গুজে কাদছেন। লামিয়া কে মেহরাব আর এখানে আনবে না। মধুর মনও খুব খারাপ হয়ে গেছে। লামিয়া কে ছাড়া বাসা ফাকা ফাকা লাগে। বাসার সবার মন খারাপ হয়ে গেলো।
চলবে,,
#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৫
লামিয়ার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে মেহরাব। লামিয়ার বান্ধবী মনি কিচেনে মেহরাবদের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করছে। মেহরাবের শুকনো মুখ ই বলে দিচ্ছে সকাল থেকে তার পেটে কিছু পরে নি৷ মেহরাব আসার পর থেকেই চুপ করে আছে। লামিয়ার প্রতি অভিমান তার মুখ থেকে কথা বের করতে দিচ্ছে না। মাহতাব এসেই লামিয়া কে কড়া ধমক দিয়েছে৷
–এরকম বোকামি কেউ করে? আমরা কি সবাই ম*রে গিয়েছিলাম? আমাদের বলা যেতো না? তুমি কাজটা ঠিক করনি লামিয়া। অন্তত মেহরাবের সাথে বসে সব ডাউট ক্লিয়ার করতে পারতে। সম্পর্কে বিশ্বাস আর ভরসা থাকতে হয়। ভালোবাসাহীন সম্পর্ক তুমি বয়ে বেড়াতে পারবে। কারণ একসাথে থাকতে গেলে ভালোবাসা না হলেও একটা মানুষের প্রতি মায়া জন্মে যায়। আর ভালোবাসার চেয়ে মায়া প্রখর। কিন্তু বিশ্বাস আর ভরসা না থাকলে ভালোবাসার সম্পর্ক ও ভাঙ্গতে সময় লাগে না। আশা করি এমন বোকামি আর কখনো করবে না।
লামিয়া নিরবে অশ্রু ঝাড়াচ্ছে। তার ভুল টা কোথায়? সে তো মেহরাবের ভালোর জন্যই তাকে ছেড়ে এসেছে। মাহতাব সংক্ষেপে সব কিছু খুলে বললো লামিয়া কে। লামিয়া অপরাধবোধে মেহরাবের দিকে তাকাতে পারছে না। মেহরাব আসার পর থেকে একবার ও তার দিকে তাকায়নি। এতেই লামিয়ার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। সে কি অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেহরাব কে!
মনি টেবিলে নাস্তা দিয়ে লামিয়া কে ডেকে বলল,
— ভাইয়াদের নিয়ে টেবিলে আয়। আগে খাওয়া দাওয়া। তারপর বাকি কথা বলা যাবে। সকাল থেকে যে পেটে কিছু পরে নি সেই খেয়াল আছে? বড় ভাইয়া আসুন। দুলাভাই আপনিও আসুন।
— আমরা কিছু খাবো না মনি। এতো কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ। বাসার সবাই চিন্তায় আছে। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমার বোনটাকে দেখে রাখার জন্য ধন্যবাদ। তুমি বরং আমাকে এক কাপ চা দাও। তাহলেই হবে।
মাহতাবের কথায় মনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাহতাব যে এখানে খাবে না তা সে ভালো করেই জানতো। তবুও সে নিজের মতো আয়োজন করেছে। টেনশনে বাড়ির কেরোর পেটে যে দানা পানি পরেনি তা সে জানে। তাদের অভুক্ত রেখে মাহতাব ম*রে গেলেও খাবে না।
মনি দুজনকেই চা দিল।মেহরাব দুই চুমুক দিয়ে আর খেলো না। মাহতাব নিজের চা শেষ করে লামিয়া কে বলল,
— এবার যাওয়া যাক লামিয়া? তোমরা এসো। আমি নিচে যাচ্ছি।
— আমিও আসছি ভাই।
মাহতাব ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না। মেহরাব ও মাহতাবের সাথে বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার আগে মনি কে ধন্যবাদ দিতে ভুললো না। লামিয়া নিজের প্রতি এই অবহেলা মেনে নিতে পারছে না। শব্দ করে কেদে যাচ্ছে। মনি বিরক্ত হয়ে মুখ কুচকে বলল,
— এহন কান্দস ক্যা? জামাই রে ফালায় আহনের সময় মনে আছিল না? বেদ্দপ বেডি। তুমি কি মনে করসিলা তোমারে আইয়া কোলে নিয়া বইয়া থাকবো?এইবার যাও,জামাইর রাগ ভাঙ্গাও। ভাই আরেকটা বিয়া করলে একদম ঠিক হইতো। বেশি ভালোবাসে তো তাই হুস নাই। যেমনে মন চায় অবহেলা করো। এহন বুঝো মজা। সর সামনে থেইক্কা। আর দরজা ওই দিকে। তারাতাড়ি বাইর হ। তাড়ছিড়া বেডি।
লামিয়ার কান্না থেমে গেলো। মনির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— তুই বেদ্দপ।তোর চোদ্দগুষ্টি তারছিড়া।তোর বাসায় না থাকলে কি হইবো। আমর কি বাড়িঘর নাই? গেলাম আমি। অসভ্য মাইয়া।
লামিয়া হনহন করে বেড়িয়ে গেল। মনি সেদিকে তাকিয়ে হালকা হেসে চা খাওয়ায় মন দিলো। সকাল থেকে তার পেটেও কিছু পরে নি।
মেহরাব ভাইয়ের দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল,
— তুমি ওকে বকা দিলে না কেন? জোরে ধমক ও দাও নি।
— দিয়েছি।
— এটা কে ধমক বলে! আরো কিছু বলা দরকার ছিল। আসলে ভালো করে বকে দিবে। নাহলে আবারও এমন করবে।
— পারবো না। তুই দিস।
মাহতাবের সোজা জবাবে মেহরাব বলার মতো আর কিছু খুজে পেল না। সে কিভাবে বকবে! আজ পর্যন্ত তো কখনো একটা ধমক ও দেয়নি। সে তো শুধু ভালোবেসেছে। এখন মনে হচ্ছে ধমক দেয়া দরকার ছিল। মাঝে মাঝে বকাঝকা করলে প্র্যাকটিস থাকতো। তাহলে এখন তা কাজে লাগাতে পারতো। কি এক ঝামেলা। মেহরাব আবার মুখ কুচকে রইলো। এবার লামিয়ার সাথে সে টানা তিন দিন চার ঘন্টা কথা বলবে না। এটা লামিয়ার শাস্তি।
লামিয়া এসে কাচুমাচু করে দাড়ালো। মেহরাব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। মাহতাব ভাইয়ের বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে রাখা দেখে মনে মনে হাসলো। লামিয়া কে গাড়িতে উঠতে বলে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো। মেহরাব হন্তদন্ত হয়ে বলল,
— তুমি ওখানে বসলে কেন? আমি চালাচ্ছি।
— পিছনে বস।
ভাইয়ের গম্ভীর গলা শুনে মেহরাব আর কিছু বলল না। চুপচাপ লামিয়ার পাশে গিয়ে বসে পরলো। তবে লামিয়ার দিকে ফিরেও তাকালো না।
— আমি ও বাড়ি যাবো ভাইয়া।
— কিন্তু মেহরাব ফ্ল্যাটে যেতে চাইছে।
লামিয়া মেহরাবের দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
— আমার ওখানে একা একা থাকতে ভালো লাগে না। বাড়িতে নিয়ে চলুন না।
মাহতাব মেহরাবের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— ঠিক আছে।
মেহরাব ও আর কিছু বললো না। সবার প্রতিই তার ভালোবাসা আছে। শুধু তার বেলায়ই অবিচার।
বাসায় পৌঁছাতেই সবাই লামিয়া কে ঘিরে ধরলো। ময়না বেগম কতক্ষণ বকাঝকা করে আবার নিজেই জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মধু ও একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আছে লামিয়া কে। সবার এতো ভালোবাসা দেখে লামিয়ার চোখ আবার ভরে উঠলো। কুলসুম বেগম ও এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে। এমন যেন আর কখনো না করে তাও বুঝিয়ে বলেছে।
মাহতাব ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো মধু টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। মাহতাব কুলসুম বেগম কে একহাতে ধরে টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে সবাইকে খেতে যেতে বলল,
— রহিমা,,মেহরাব কে ডেকে নিয়ে আয়।
— আইচ্ছা ভাইজান।
মেহরাব নিজের রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছে না। মাহতাবের ডাক সে শুনেছে। তাই রহিমা আসার আগেই সে বেরিয়ে গেলো। টেবিলে গিয়েও সে লামিয়ার দিকে তাকালো না। সবাই মেহরাবের রাগ আর অভিমান বুঝলেও কিছু বললো না। তবে মধুর কাছে ব্যপারটি খুব ভালো লাগলো। ভালোবাসার মানুষদের অভিমান ও খুব সুন্দর। এই যে মেহরাব আড় চোখে দেখছে লামিয়া ঠিকঠাক ভাবে খাচ্ছে কিনা। তার দিকে তাকিয়েছে কি না। এসব দেখেও তো ভালো লাগে।
খাওয়া শেষে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো। মাহতাব এখন অফিসে যাবে। আজ ঝামেলায় অনেকটা দেড়ি হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় এখন প্রায় বারোটা বাজতে চললো।
মাহতাব কে রেডি হতে দেখে মধু ধীর গলায় বলল,
— আপনি কি অফিসে যাচ্ছেন?
— হুম। (আয়নায় মধুর দিকে তাকিয়ে)
— কাল রাতে তো ঘুমাতে পারেননি। এখন একটু ঘুমিয়ে বিকেলে গেলে হয়না?
মাহতাবের হাত থেমে গেলো। টাই বাধা রেখে সে মধুর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— হয়।
— তাহলে রেস্ট নিন।
— আচ্ছা।
— তাহলে আমি যাই। আপনি ঘুমান।
— না।
— না মানে?
মাহতাব মধুর সামনে এসে দাড়ালো। পকেটে হাত গুজে মধুর দ্বিধান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— নাক ডাকা না শুনলে ঘুম আসে না।
মধুর মুখটা কালো হয়ে গেলো। অসহায় চোখে মাহতাবের দিকে তাকালো সে।
— তুমিও আমার সাথে ঘুমাবে এসো।
— আমার ঘুম আসছে না।(অসহায় গলায়)
— তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। তুমিও কাল থেকে ঠিক করে ঘুমাও নি।
মধু আর কিছু বললো না। এভাবে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকলে মানুষ কি বলবে? সবাই খারাপ ভাববে হয়তো। তার সত্যিই খুব ঘুম আসছে।
— কেউ কিছু বলবে না। চুপচাপ শুয়ে পরো। আমি চেঞ্জ করে আসছি৷
— হুম।
মাহতাব চেঞ্জ করে এসে দেখে মধু আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
— ঘুমাও নি কেন?
— হ হ্যাঁ হ্যাঁ। ঘুমাচ্ছি।
মধু কাচুমাচু করে গিয়ে একপাশে সুয়ে পড়ল৷ মাহতাব জানলার পর্দা গুলো টেনে দিয়ে নিজেও মধুর গা ঘেঁষে শুয়ে পরলো৷ একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।
— দূরে কেন?আমার কাছে এসে ঘুমাও।
মধুর মুখটা শুকিয়ে গেলো। মাহতাবের কাছাকাছি শুতে তার ভয় করে। যদি হাত পা লেগে যায়! এমনিতেই তার নাক ডাকার জন্য বেচারা ঘুমাতে পারে না।
— আমি শক্ত করে ধরে রাখবো তোমায়। হাত পা ছুড়তে পারবে না। এসো।
মধু বোকা বনে গেলো। মনের কথা বুঝলো কি করে? সে কি জোরে জোরে বলে ফেলেছে।
মধুকে ভাবতে দেখে মাহতাব তাকে কাছে টেনে নিলো। নিজের বুকের সাথে মাথাটা চেপে ধরে মন্থর গলায় বলল,
— এবার ঘুমাও। বুড়ো বলে আমাকে বেরসিক ভাবার কারণ নেই। তোমার বর যথেষ্ট রোমান্টিক। দেখবে?
মধু দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাহতাবের বুকে আটকে থাকায় বলতে পারলো না। মাহতাব মধুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মধুর কপালে চুমু খেয়ে ধীর গলায় বলল,
— ভালোবাসা নম্বর বত্রিশ। দেখেছো তোমার বর কতো রোমান্টিক?
চলবে,,