#আমার_অবেলায়_তুমি,১৬,১৭
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৬
আজ দুই দিন হলো লামিয়া মেহরাবের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। মেহরাব তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। লামিয়ার কষ্ট হলেও সয়ে নিচ্ছে। দোষ তার হয়েছে।মেহরাবের সাথে সরাসরি কথা বললে আজ এই সমস্যা হতো না। আজও সকালে মেহরাব হসপিটালে যাওয়ার সময় তাকে বলে যায়নি। গত দুইদিনে মেহরাব তার সাথে একটা কথাও বলেনি। রাতে বারান্দায় শুয়েছে। লামিয়া হাজার অনুরোধ করেও তাকে রুমে আনতে পারেনি। তাই আজ ঠিক করেছে আজ থেকে সে নিজেই বারান্দায় থাকবে। লোকটা সারাদিন পরিশ্রম করে এসে বারান্দায় শোয় তা তার একদম ভালো লাগে না। তাই আগে ভাগেই বারান্দা দখল করে রেখেছে সে। অবহেলা যা করার বিছানায় শুয়ে বসে করুক। সে নাহয় বারান্দায় মশার কামড় খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবে।
মেহরাব বাসায় আসতে আসতে নয়টা বেজে গেছে। ড্রয়িং রুমে সবাই আড্ডা দিলেও লামিয়া কে না দেখে তার কপাল কুচকে গেল। আবার কোথায় গিয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে কে জানে! এই মেয়ে বাড়ি ছাড়া মানে তার চরিত্রের রফাদফা।
— ভাবি, লামিয়া কোথায়?
মেহরাবের বলতে দেড়ি হলেও ময়না বেগমের খপ করে ধরতে দেড়ি হয়নি। সে চায়ের কাপ নাড়তে নাড়তে হতাশ হওয়ার ভান করে বলল,
— আমরাও আছি ভাই। আমাদের খবরাখবর ও একটু জানতে চা। বউ তো তোর একার নেই,সব বিবাহিত ছেলেদের ই বউ থাকে।তারা এসেই এভাবে বউয়ের খোঁজ করে না।
— আমি করি আপা। একটা মাত্র বউ আমার। খোঁজ খবর না রাখলে আমাদের কাছে থাকবে কেন?আর তোমাদের আদরের বউ বাড়ি ছাড়লে তো তোমরা সেই আমার ঘাড় ই মটকাতে আসবে। তাই একটু খোজ খবর রাখতে হয়।
মেহরাব আর কিছু বলতে না দিয়ে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। কুলসুম বেগম বিরক্ত হয়ে বলল,
— মাত্র বাইরে থেকে এসেছে ময়না। সবসময় পিছনে লাগো কেন? বউয়ের খবর রাখবে না তো কি পাশের বাসার মানুষের খবর রাখবে?অদ্ভূত!
ময়না বেগম পাত্তা দিলেন না। সে নিজের মতো চা খাওয়ায় মন দিলো। আজ সারাদিন তার গুণধর ছেলে কল করেনি।কোন বিদেশি নিয়ে ঘুরছে কে জানে? বংশের মতো হয়েছে নিশ্চিত। অসভ্য ছেলেপেলে যত্তসব।
মাহট্যাব নিজের রুমেই অফিসের কাজ করছিল। কুলসুম বেগমের রাগী গলা শুনে দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে। দাঁড়ানোর কারণ যদিও ভিন্ন। তার পরিবারের সবার ব্যবহার সম্পর্কে সে অবগত। এসব তার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজকাল একটা বিষয় খুব নতুন আর উপভোগ্য। তা হলো,মধুর ভ্যাবাচেকা খাওয়া অসহায় মুখ। তাদের পরিবারের এই হালকা পাতলা সংঘর্ষ দেখে মধুর শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মাহতাবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। মেয়েটা যে বড্ড সরল।
মধু মুখ কালো করে কিচেনে চলে গেলো। রহিমা সেফ কে সাহায্য করছে রান্নার জোগাড় করতে। সেদিকে তাকিয়ে কি মনে করে মধু নিজের রুমে চলে গেলো। মাহতাব বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেলি ফুলের বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা সাদা ফুলে বাগান ভরে গেছে। ফুলের সুভাসে চারিদিক মো মো করছে। মাহতাব চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিলো। এই বেলিফুলের বাগান তার অসম্ভব প্রিয়। সে নিজের হাতে পরিচর্যা করে। কিন্তু গত একমাস যাবত সে বাগানে সময় দিতে পারছে না। ব্যবসার কাজে ইদানীং একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে সে।
মধু ধীর পায়ে এসে মাহতাবের পাশে দাড়ালো। মাহতাব তখন চোখ বন্ধ করে বেলীফুলের সুভাস নিতে ব্যস্ত। মধুর আসার আভাস পেয়ে সে চোখ খুললো। মধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— কি ব্যাপার? শ্বাশুড়ি আর আপাকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হলো? তুমি তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছো না মধু! এটা কি মেনে নেয়া যায় বলো? নাকি বুড়ো বলে আমার সামনে আসতে ইচ্ছে হয় না?
মধু অবাক চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে। তার মনে মাহতাব কে নিয়ে কখনো কোন হীনমন্যতা আসেনি।মাহতাবের সামনে কম আসে এটা ঠিক। কারণ মাহতাবের হুটহাট রোমান্টিকতায় সে খুব লজ্জা পায়। ভয় ও পায় খানিকটা। এতো বড় একজন মানুষের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা সে। সারাক্ষণ চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে। কখন কোন ভুল করে ফেলবে সেই চিন্তায় সে রাতে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারে না। আর তার দূরে থাকাকে মাহতাব এমন কিছু ভাববে তা মধু কল্পনা ও করেনি।
মাহতাব মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। মধুর আদুরে গাল দুটো টেনে দিয়ে আস্বস্ত গলায় বলল,
— মজা করছিলাম। ভয় পাচ্ছো কেন মধু? আমি ই তো। আমাকে ভয় নয়,ভরসা করবে। ঠিক আছে?
মধু আটকে রাখা শ্বাস টা ছাড়লো। লোকটার হুটহাট মজায় তার জান বেড়িয়ে যাওয়া জোগাড় হয়ে যায়। এভাবে কেউ মজা করে! মধু মুখ কালো করে দাড়িয়ে রইলো।
মাহতাব মধুকে এক হাতে টেনে তার কাছাকাছি দাড় করালো। হালকা অগোছালো চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে শান্ত গলায় বলল,
— কিছু বলতে এসেছিলে?
— হুম।
— আচ্ছা বলো?
— এখন থেকে সবার জন্য আমি রান্না করতে চাই। আমরা মাত্র এই কয়জন মানুষ। এর জন্য একজন সেফ রাখার কি দরকার? আমার এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। সময় কাটতে চায় না। প্লিজ না করবেন না।
মধুর আবদারে মলিন হাসলো মাহতাব। একহাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলল,
— ঠিক আছে। তবে সেফ ও থাকুক। ও আমার পরিচিত কাছের একজন। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে নাস্তা করতাম। আমাদের ভার্সিটির ক্যাম্পাসে রান্না করতো ময়িন। বয়সে আমার থেকে বছর পাচেক ছোট হবে। তখন ই ময়িনের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। পড়াশোনা শেষ করে আমি যখন বিজনেস শুরু করি তখন আর ময়িনের। খোঁজ খবর রাখা হয়নি।
কিছু বছর আগে নিউমার্কেটের ফুটপাতে হকারি করতে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করতেই বলল,চাকরি টা চলে গেছে। তাই উপায় না পেয়ে হকারি করছে। সংসারে খুব টানাটানি অবস্থা। বউ বাচ্চা নিয়ে কোন রকম জীবন কাটাচ্ছে। আমার অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হয়নি। সারা জীবন রান্নার কাজ করেছে। ফ্যাক্টরির কাজ নাকি ওর মাথায় ঢুকবে না।তাই বাসায় নিয়ে আসি। তখন থেকে আমাদের বাসায় ই আছে। এখান থেকে চলে গেলে ও মাঝ দরিয়ায় পরবে মধু। ও কোন সার্টিফাইড সেফ নয়। তাই ভালো কোথাও চাকরি পাবে না। তুমি রান্না করতে চাইলে করবে। তবে ময়িন ও থাকুক। ঠিক আছে।
মধু টলমলে চোখে মাথা নাড়ালো। মাহতাব মধুর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বলল,
— অল্পতেই চোখে পানি আসে কেন তোমার? ইব্রাহিম বাড়ির বড় বউ তুমি। পাহাড়ের মতো শক্ত না হলে সবাইকে সামলাবে কি করে? এখন থেকে শক্ত করবে নিজেকে।
মধু নাট টানতে টানতে বলল,
— আচ্ছা।
মাহতাব মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা শব্দ করে হেসে ফেললো। বউটা তার বড্ড বোকা।
মেহরাব রুমে এসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে লামিয়া কে কোথাও পেলো না। কপাল কুচকে এপ্রোন টা টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুম চেক করলো। খালি ওয়াশরুম দেখে কপালের ভাজ গাড় হলো মেহরাবের। বারান্দার দরজায় কাছে গিয়েই মুখ থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। লামিয়া বারান্দায় উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। মোটা একটা বইয়ের উপর মাথা দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহরাব লামিয়াকে না ডেকে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। দশ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। লামিয়া কে কোলে তুলে রুমে শুয়িয়ে দিয়ে আবার বারান্দায় গেলো। সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস “সাতকাহন” ফ্লোর থেকে হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই উপন্যাস পড়েই তার বউয়ের মাথায় তাকে ছেড়ে একা থাকার কু মতলব এসেছে। সে কি সাতকাহনের দীপাবলির বরদের মতো নাকি?আশ্চর্য!!
এসব উপন্যাস আর বাসায় রাখা যাবে না। কি সাংঘাতিক ব্যপার স্যাপার।
রাতের খাওয়ার সময় মেহরাব আর লামিয়া কে ডাকেনি। লামিয়ার মেন্টাল কন্ডিশনের জন্য এখন প্রোপার ঘুম প্রয়োজন। জেগে থাকলেই উল্টো পালটা চিন্তা করে নিজের মাথা খারাপ করবে সাথে তার টাও করবে। রহিমা কে দিয়ে লামিয়ার খাবার রুমে নিয়ে রাখলো মেহরাব। রাতে জেগে গেলে খেয়ে নিবে।
লামিয়ার ঘুম ভাঙ্গলো মাঝরাতে। নিজেকে বিছানায় দেখে বুঝতে বাকি রইলো না মেহরাব তাকে এখানে রেখে গিয়েছে। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে বারান্দায় গেলো সে। মেহরাব এক হাত কপালে দিয়ে শুয়ে আছে। লামিয়া গিয়ে সোজা মেহরাবের পায়ের কাছে বসে পরলো। মেহরাব হুড়মুড় করে উঠে বসে লামিয়ার হাত দুটো চেপে ধরে হতভম্ব গলায় বলল,
— এসব কি করছো তুমি? পায়ে হাত দিচ্ছো কেন!
— আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি আর কখনো এমন ভুল করবো না। প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দাও। তুমি এভাবে রাগ করে থাকলে আমার খুব কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। প্লিজ শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও।
লামিয়া ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মেহরাব লামিয়াকে বুকে টেনে নিলো। এক হাতে চোখের পানি মুছে অস্থির হয়ে বলল,
— আরে কাদছো কেন? আমি রাগ করে নেই আর।কান্না বন্ধ করো প্লিজ। আর কখনো আমার পায়ে হাত দিবে না লামিয়া। আমি পছন্দ করি না।
শেষের কথাটা গম্ভীর গলায় বলল মেহরাব।লামিয়া তার হাতদুটো ধরে তড়িঘড়ি করে বলল,
— করবো না।আর কোন ভুল করবো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।
— শোন লামিয়া, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা বোঝো? যা মনের অন্তস্তল থেকে আসে। যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানে কখনো ধোকা,প্রতারণা থাকবে না। কেউ যদি ধোকা দিয়ে বলে, তার সাথে সম্পর্ক থাকলেও ভালো আমি শুধু তোমাকেই বাসি। তাহলে বুঝে নিতে হবে সে কখনো ভালোবাসেনি। আমি তোমাকে আমার সহধর্মিণী হিসেবে ভালোবেসেছি। আমার বাচ্চার মা হিসেবে নয়। কতো মানুষের হাত থাকে না,পা থাকে না। অপূর্ণতা নিয়ে তারা কি বেচে থাকছে না? আমাদের তো সব আছে। একটা সন্তান নাহয় নাই থাকলো। আল্লাহ হয়তো এতেই আমাদের কল্যাণ রেখেছে। কারণ সন্তান দেয়ার মালিক একমাত্র সে। আমরা কপাল কুটে ম*রে গেলেও সন্তান পাবো না যদি না সে চায়। তাই প্লিজ,আর কখনো এমন বোকামি করবে না।আমি কষ্ট পাই খুব। ভালোবাসি বলে কষ্ট দিয়ো না বউ।
চলবে,,
#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৭
ভোর সারে চারটায় বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। সবাই তখন নামাজে দাঁড়িয়েছে। মাহতাব আর মেহরাব মসজিদে গিয়েছে। আজ আজানের প্রায় সাথে সাথেই সবাই নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। দরজার ওপাশে থাকা মানুষটার যে মোটেও ধৈর্য নেই তার বেল বাজানোর ধরনেই তা স্পষ্ট। অনবরত বিরামহীন ভাবে সে কলিং বেল বাজিয়ে চলেছে। ময়না বেগম দুই রাকাত সুন্নত আদায় করে সালাম ফিরিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
— এভাবে কে বেল বাজাচ্ছে। সামান্যতম ভদ্রতা জ্ঞান নেই! আর বাসায় ঢুকেছে কিভাবে? দারোয়ান ব্যাটা কি হালকা হতে গেট খুলে চলে গিয়েছে। আজকে ওর বেতন থেকে পঞ্চাশ টাকা কাটা যাবে। বেয়াদব!
— আহ! চুপ করো ময়না। নামাজে বসে অসভ্যের মতো কথা বলছো কেন?
কুলসুম বেগম সালাম ফিরিয়ে বিরক্ত গলায় মেয়েকে ধমক দিলেন।
মধু সালাম ফিরিয়ে দ্রুত দরজা খুলতে গিয়েছে। রহিমা আর জরি সবার শেষে নামাযে দাঁড়িয়েছে। তাই তাকেই যেতে হলো। ময়না বেগম ও ধীর পায়ে আসলো মধুর পিছু পিছু। এই অসভ্যের চেহারা না দেখলে তার নামাজে মন বসবে না। বয়সে ছোট হলে হাতে মধু মেখে চটাশ করে এক চর বসাবে। বাসায় না শিখালে কি হয়েছে। সে নিজে চড়িয়ে চড়িয়ে ভদ্রতা শিখিয়ে দিবে।
মধু দরজা খুলতেই পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলো। বহুকালের চেনা জানা মানুষটা কে দেখে মুখে হাসি ফুটলেও পরক্ষণেই তা অভিমানের চাদরে মিলিয়ে গেলো।
দরজার ওপাশের মানুষটাও মধুকে দেখে কম অবাক হয়নি। মধুর এখানে থাকা তাকে বিষ্ময়ের চরম শিখরে নিয়ে গিয়েছে। হাতের লাগেজ টা রেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
— মধুরিমা! তুই এখানে?
মধু কিছু না বলেই চুপ করে রইলো। ময়না বেগম সন্দিহান চোখে সামনে আসতেই নিজের ছেলে সামির কে দেখে অবাক হয়ে গেলো৷ গোল গোল চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর তার হুস ফিরলো ছেলের পাশে সাদা চুল ওয়ালা এক মেয়েকে দেখে। মেয়েটাও তার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। ময়না বেগম আতংকে এক হাত বুকে আর এক হাত পায়ে দিলেন। সে নিশ্চিত তার বেঈমান ছেলে এই বিদেশী পাটখড়ি কে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। পায়ের স্লিপার খুলে সোজা ছেলের গায়ে ছুড়ে মারলেন। হঠাৎ অতর্কিত হামলায় শামির বোকা হয়ে গেলো। স্যান্ডেল সোজা তার নাকে এসে লেগেছে। সামনে তাকিয়ে মা কে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগে দ্বিতীয় পায়ের স্যান্ডেলটি ও ছুড়ে মেরেছে ময়না বেগম।
এবার তা সোজা পাটের আশের মতো চুল বিশিষ্ট মেয়েটির গায়ে লেগেছে। মধু এক হাতে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
শামির অবাক চোখে তাকালো ময়না বেগমের দিকে। যার নজর আপাতত মধুর পায়ের স্যান্ডেলের দিকে। ওগুলো ও মারবে নাকি!
— আম্মু! এসব কি করছো? কোথায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরবে।তা না করে জুতো মারছো কেন?
ময়না বেগম গুনগুন করে কাদতে লাগলো। ড্রয়িং রুমের এই ভয়ংকর অবস্থা নামাজের রুমে এখনো পৌছায়নি।
মধু অসহায় মুখ করে দাড়িয়ে আছে। শামির নিজেও হতভম্ব চোখে মায়ের কান্না দেখছে। মধু গিয়ে ময়না বেগম কে আগলে ধরলো। সোফায় বসিয়ে দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো তার দিকে। ময়না বেগম বুকে হাত রেখে আহাজারি করতে করতে বলল,
— আমার ভাইয়েদের রক্ত পানি করা টাকায় এই ছেলে কে বিদেশ পাঠিয়েছি পড়াশোনা করতে। আর এই কুলাঙ্গার বিদেশী ধরে এনেছে। ভাইদের সামনে মুখ দেখাবো কিভাবে আমি! আমার নাক কে*টে তিন টুকরো করেছে এই বেয়াদব। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই দিন দেখার আগে বিপি লো হয়ে আমি জ্ঞান হারালাম না কেন?
শামির চোয়াল ঝুলিয়ে মায়ের অভিনয় দেখছে। চেচামেচি শুনে কুলসুম বেগম সহ সবাই নামাজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। শামিরের সাথে আসা মেয়েটা অবাক চোখে ময়না বেগমের কান্ডকারখানা দেখছে। তার হাতে ময়না বেগমমের
দুই নাম্বার জুতো বিদ্যমান।
— ও আজমল আংকেলের মেয়ে মারিয়া আম্মু। এভাবে রিয়্যাক্ট করা বন্ধ করো।
কুলসুম বেগম এতক্ষণ মেয়ের কান্নার কারণ খুজছিল। নাতির গলা শুনে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। খুশিতে চোখ টলমল করতে লাগলো। এক হাতে লাঠি ভর দিয়ে আরেক হাতে নাতিকে কাছে ডাকলো। শামির ও গিয়ে কুলসুম বেগম কে জড়িয়ে ধরলো। মধু এতক্ষণে নিজের মাথার জট খুলতে পারলো। শামির তাহলে এ বাড়ির নাতি। ময়না বেগম নাক টেনে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো। কুলসুম বেগম নাতির চোখে মুখে চুমু খেয়ে সারা মুখে হাত বোলাচ্ছেন। কুলসুম বেগম ছেলের সামনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। শামির শব্দ করে হেসে নিজেও আগলে নিলো মাকে৷
— কেমন আছিস বাবা? শুকিয়ে আমস্বত্তা হয়ে গেছিস। আয় আমি তোকে ভাত দেই।
শামির ময়না বেগম কে থামিয়ে দিলো। মায়ের কপালে চুমু খেয়ে মুচকি হেসে বলল,
— পরে খাবো আম্মু। এখন ফ্রেশ হবো। মামারা কোথায়? আর ছোট মামি কি তার মামার বাড়ি গিয়েছে? দেখছিনা যে? আর মধু এখানে কি করছে?
— তোর মামারা মসজিদে। লামিয়া একটু অসুস্থ। নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে। আর মধুকে কি তুই আগে থেকে চিনিস?
— হ্যা আম্মু। আমার একমাত্র বন্ধু ছিল হাইস্কুলে। বলেছিলাম না তোমাকে একটা মেয়ের কথা। এই সেই মেয়ে।
— ওওও। এখন আর সে তোমার শুধু বন্ধু নেই। বড় মামী হয় তোমার। মামী বলেই ডাকবে।
শামির অবাক চোখে তাকালো মধুর দিকে। মধু নিচের দিকে তাকিয়ে পা দিয়ে ফ্লোর খুটছে। শামির মধুর সামনে গিয়ে দাড়ালো। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে হুট করেই মধুর মাথায় চাটি দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— বলেছিলাম না মধুর চাক,তোর জীবনে একদিন ভালোবাসার জোয়ার আসবে। মিললো তো?
মধু কিছু বললো না। অভিমানী চোখে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। শামির মধুর অভিমান বুঝলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহিমা কে বলল মারিয়া কে গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে। কাল মারিয়া দিনাজপুর তার দাদার বাড়ি চলে যাবে। এরকম কিছু হতে পারে শামির তাকে রাস্তায় ই বলেছিল। তবুও মারিয়া কম অবাক হয়নি। তার কাছে ময়না বেগম কে অসম্ভব ভালো লেগেছে। সুযোগ পেলে একটু বন্ধুত্বও করবে সে।
মাহতাব আর মেহরাব বাসায় এসে শামির কে দেখে অবাক হলো না। তারা জানতো আজ শামির আসবে। শামির সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। পরিনামে জুতো খেতে হলো। ময়না বেগম ছেলেকে কাছে ডাকলেন। শামির কাছে যেতেই সপাটে এক চড় পরলো তার গালে। মাহতাব আর মেহরাব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেহরাব বিরবির করে বলল,
— বেস্ট অফ লাক শামির।
শামির গালে হাত দিয়ে হতভম্ব গলায় বলল,
— মারলে কেন?
— এই সময় বাসার সবাই নামাজ পড়ে জানো না? অসভ্যের মতো বেল বাজাচ্ছিলে কেন? ভদ্রতা শেখোনি বেয়ারা ছেলে।
শামির গালে হাত দিয়ে মিনমিন করে বলল,
— সরি।
— হুম।রুমে যাও।
সবার সাথে কুশল বিনিময় করে শামির ময়না বেগমের রুমে গেলো। আজ সে এখানেই থাকবে। কাল ছাদের রুমে সিফট হয়ে যাবে। রহিমাকে দিয়ে পরিস্কার করিয়ে রাখতে হবে।
— এভাবে ছেলেটা কে মারলে কেন আপা? মাত্র দেশে এসেছে। একটু ভালো ব্যবহার তো করতে পারো।
— বেশি বুঝবি না। এক বিদেশী মেয়ে নিয়ে সকাল সকাল বাসায় এসে হাজির হয়েছে। তার উপর অসভ্যের মতো একটানা বেল বাজিয়েই চলেছে। এই মেয়ে দেখে যদি আমি হা*র্ট অ্যা*টাক করে মা*রা যেতাম! আরো কয়েকটা দেয়া দরকার ছিল।
মাহতাব চোখের ইশারায় মধুকে ডেকে নিজের রুমে চলে গেলো। আপার সাথে তর্কে যাওয়ার দুঃসাহস তার নেই। ওটা মেহরাবের কাজ।
মধু ধীর পায়ে মাহতাবের পিছনে গেলো। এ বাড়ির তর তরিকা বুঝতে তার অনেক তেল মশলা খরচ করতে হবে। কয়েকদিনেই তার মাথা খারাপের অবস্থা।
ভাবনার মাঝে কখন মাহতাব দাড়িয়ে গেছে মধু খেয়ালই করেনি। ফলাফল মাহতাবের পিঠের সাথে ধাক্কা। মাহতাব এক হাতে রুমের দরজা লাগিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— ধাক্কা বুকে এসে খেতে হয় মধু। তাহলেই তো আমি তোমাকে দু হাতে আগলে নিতে পারবো। এসো,সামনে এসে আমার বুকে এসে ধাক্কা খাও।
মধু হতভম্ব হয়ে গেল। সে কি ইচ্ছে করে পরিকল্পনা মাফিক ধাক্কা খেয়েছে? এভাবে বলছে কেন? ব্যাথা পেলো নাতো আবার? তার মাথা কি বেশি শক্ত? লোহার মতো?
— কি হলো? এসো।
— আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা খাইনি। আপনি কি ব্যথা পেয়েছেন?(আমতা আমতা করে)
— হুম পেয়েছি। আনরোমান্টিক বউ পেলে সব বর ই ব্যথা পায়। আমার মতো বুড়ো হলে তো তুমি সংসার আলাদা করে বলবে,”আপনাকে আর দরকার নেই বাবুর আব্বু। আমি একা থাকতে পারি।আমাদের সংসার আজ থেকে ভিন্ন হলো। আপনি আপনার রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়”।
— বাবুর আব্বু কে?
— আমি।
— কিন্তু আপনার তো কোন বাবু নেই।
— আজ থেকে প্রতিদিন সকালে ভেজানো বাদাম খাবে। বুদ্ধির জন্য ভালো। বুঝেছো? এবার এসে আমার পাশে চুপচাপ শুয়ে পরো।
— নামাজ দুই রাকাত বাকি আছে।
— যাও পড়ে এসো।
— আচ্ছা।
মধু চলে যেতেই মাহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো।
চলবে,,