#আমার_অবেলায়_তুমি,১৮,১৯
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৮
মধু আর মাহতাবের সম্পর্ক একটা গন্ডির মধ্যে আটকে আছে। মাহতাব এগিয়ে যেতে চাইলেও মধুর অবুঝ ব্যবহারে সে আবার পিছিয়ে যায়। বার কয়েক এ ও ভেবেছে যে মধুর জীবনে হয়তো অন্য কেউ ছিল। তাই তার থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকে। জিজ্ঞেস করতে চেয়েও আর করা হয়ে উঠেনি। তার নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগবে। এমন নয় সে মধুকে জৈবিক চাহিদার জন্য কাছে চাইছে। সে মন থেকেই মধুকে নিজের করে চাইছে। তার চাওয়ার পরিধি বেশি নয়,ব্যাস মধু তার সাথে সহজ হয়ে কথা বলবে, তার কাধে মাথা রেখে কিছুটা সময় নিজেকে নিয়ে গল্প করবে। তার একান্ত ব্যক্তিগত গল্প।যা সে আজ পর্যন্ত কারোর সাথেই করেনি৷ তাকে ভরসা করতে শিখে যাবে এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাই না মাহতাবের। শারিরীক চাহিদা ভালোবাসারএকটা অংশ। ভালোবাসা একটি মানুষের আত্মার সাথে হয়। কেউ যদি একটা মানুষের শুধু একটি বিষয়বস্তুকে ভালোবাসা তাহলে সেটা কখনো ভালোবাসা হতে পারেনা। ভালোবাসলে ভালো খারাপ দুটো মিলিয়েই ভালোবাসতে হবে। তার সুস্থতা কে ভালোবাসতে হবে, তার অসুস্থতাকে ও ভালোবাসতে হবে। তার হাসি ভালোবাসলে তার রাগ,কান্না কেও ভালোবাসতে শিখতে হবে। তার প্রতিটি সেকেন্ড কে ভালোবাসতে পারলেই তা হবে সত্যিকারের ভালোবাসা। তার চকচকে নিখুঁত সৌন্দর্য ভালোবাসলে তার মেদ জমা খসখসে চামড়ার শরীর কেও ভালোবাসতে হবে।শুধু শারীরিক চাহিদা ভালোবাসা নয়,শারীরিক চাহিদা ভালোবাসারই একটি অংশ।
সারাদিন সূর্য তার অশেষ তেজে পৃথিবী ঝলসে দিলেও রাতের চন্দ্রিমা তার কোমল জোছনায় পৃথিবীর গায়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে যায়। সারাদিনের দৌড় ঝাপে আজ মাহতাব অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পরেছে। তার উপর আসার পর থেকে মধুর দর্শন পাওয়া যায়নি একবারের জন্যও। মাহতাব নিজ থেকে ডাকেনি তাকে। দেখা যাক কতক্ষণ দূরে থাকতে পারে।
পুরোনো বন্ধুর সাথে মান অভিমান পালা মেটাতে অনেকদিন সময় পার হয়ে গিয়েছে। শামির এতো সহজে মানাতে পারেনি মধুকে।এর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। মিনিট দুয়েক কান্নার অভিনয় করে, কানে ধরে ওঠবস করে তবেই মানিয়েছে মধুকে। বোকা মধু আবেগে গাল ভিজেয়েছে অনেকক্ষণ। খুশিতে দুই বার কফি করেও খাইয়েছে।
— মামা এসেছে অনেকক্ষণ।
— হুম।
— যাচ্ছিস না কেন?
— আমি গিয়ে কি করবো?
— গলা ধরে বসে থাকবি গাধী।
— ছিঃ। এগুলো কি ধরনের কথা?
— শোন মধুর চাক, মামা একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষ। তুই নিজেও কচি খুকি নস। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে অবশ্যই ধারণা আছে তোর। তাহলে এমন করছিস কেন?
মধু চুপ করে রইলো। শামির তীক্ষ্ণ চোখে মধুকে পরখ করে সন্দিহান গলায় বলল,
— আসল সমস্যা টা কোথায়? কি লুকাচ্ছিস?
— ক কিছু না। তুই থাক,আমি রুমে যাচ্ছি।
শামিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মধু দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। শামির জহুরি চোখে পরখ করলো সবটা। এই মেয়েটার সাথে সে আট বছর পড়াশোনা করেছে। ক্লাস থ্রি থেকে এস এস সি পর্যন্ত তারা একই স্কুলে ছিল। খুব চুপচাপ থাকা মেয়েটি হুট করেই কিভাবে যেন তার বন্ধু হয়ে গেলো। মাঝে মাঝে হাতে মুখে মা*রের দাগ দেখে চোখ ভরে উঠতো তার। এরকম কোমল একটি মেয়ের গায়ে কেউ কিভাবে হাত তুলতে পারে মাথায় আসতো না। শামির অনেক চেষ্টা করেও মধুর মুখ থেকে কিছু বের করতে পারে নি। একসময় সে চেষ্টা করাই ছেড়ে দিয়েছে। বারবার একই প্রশ্ন করে কাউকে অস্বস্তিতে ফেলার কোন মানে নেই। তবে আজকের ব্যপারটা শামিরের কাছে ভালো ঠেকলো না। কিছুতো একটা ব্যাপার অবশ্যই আছে। দেশে আছে কিছুদিন। দেখা যাক কি হয়।
মধু নিজের রুমে এসে হাফ ছেড়ে বাচলো।নাহলে শামিরের প্রশ্নের বান চলেতেই থাকতো। শামিরের প্রশ্নের উত্তর তার কাছে থাকলে সে বলতে পারবে না। সেসব মনে করা মানে পুরোনো ঘা খুচিয়ে তাজা করা। কপালে জমে থাকা ঘামটুকু মুছে মধু চারিদিকে চোখ বুলালো। শূন্য ঘর দেখে কপাল কুচকে গেল তার। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। মাহতাব বারান্দার রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে। মধু হালকা হাসার চেষ্টা করলো। মাহতাব সেদিকে পাত্তা না দিয়ে একমনে মধুর দিকে তাকিয়ে। তার দু চোখ মধুতে বিচরণ করছে। মধুর জোরপূর্বক আনা হাসিটাও মিলিয়ে গেলো। অস্বস্তিতে গাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহতাব মধুর অস্বস্তিকেও পাত্তা দিলো না। সে চোখ বুলিয়ে মন্থর গলায় বলল,
— এদিকে এসো।
মধু নড়লো না। এককদম ও এগিয়ে গেলো না। উল্টো পিছিয়ে গেলো দু কদম। মাহতাব দেখলো। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে এগিয়ে গেলো মধুর দিকে। এই প্রথম বারের মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে দাড়ালো।এক হাতে কোমড় চেপে নিজেদের দুরত্ব কমিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরলো। ঠকঠক করে কাপতে থাকা মধুর সম্পুর্ণ শরীর নিজের বাহুতে মিশিয়ে নিলো।তার শক্ত বুকে মধুর মাথাটা আঁকড়ে ধরে শান্ত গলায় বলল,
— এদিকে আসার মানে হচ্ছে আমার কাছে এসো। ঠিক এতটা কাছে। বুঝেছো?
মধুর শরীরের কাপন থেমে গিয়েছে। সমস্ত ভর মাহতাবের উপর ছেড়ে দিতেই মাহতাবের কপালে ভাজ পরলো। বুক থেকে আলগা করে সামনে আনতেই মধুর নিস্তেজ মুখটা দেখে বুক কেপে উঠলো তার। অস্থির হয়ে মধুকে কোলে তুলে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। চুল টানতে টানতে পায়চারি করতে করতে ভাবলো সবাইকে ডাকবে কিনা। কি না কি ভাববে কে জানে! গ্লাস থেকে পানি নিয়ে কয়েকবার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়েও কাজ হলো না। দ্রুত ফোন নিয়ে মেহরাব কে কল করলো সে। মেহরাব তখন মাত্র হসপিটাল থেকে ফিরেছে। ভাইয়ের কল পেয়ে দ্রুত পায়ে তার রুমে গেলো।
— ভাবির কি হয়েছে ভাই?
— জানি না।হুট করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
মাহতাবের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে মেহরাব আর কোন প্রশ্ন করলো না। মধুর পালস রেট চেক করে আবার নিজের রুমে গেলো। প্রয়োজনীয় জিনিস এনে নিজের কাজে লেগে গেলো।
— কি এমন হয়েছিল ভাইয়া? ভাবি শকড হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এখন ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। ডেকো না। সকাল পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে।
মাহতাব ভাইয়ের প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না। সে কিভাবে বলবে, তার বউকে একটু জড়িয়ে ধরেছে বলে তার বউ জ্ঞান হারিয়েছে। মেহরাব নিজেও আর কোন প্রশ্ন করলো না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো। মাহতাব এসে মধুর পাশে বসলো। কপালে ভাজ ফেলে কোমড়ের শাড়ি সরিয়ে দিতেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। মধুর ক্লান্ত বিধ্বস্ত মুখের দিকে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলো। দরজা বন্ধ করে এসে নিজের কাজ শেষ করে গাড়ির চাবি নিতে তৎক্ষনাৎ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে নিজের রুম লক করতে ভুললো না সে।
রাতে খাবার টেবিলে মাহতাব কে না দেখে ময়না বেগমের চোখ কপালে উঠলো। শামির নিজে গেলো মাহতাব কে ডাকতে। দরজা লক দেখে ময়না বেগম কে এসে বলতেই ময়না বেগম হা হুতাশ করে বলল,
— দেখেছো আম্মা! এসেই বউ কে নিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। বুড়ো বয়সের ভিমরতি। লজ্জা সরমের মাথা খেয়েছে বেয়াদব টা।
কুলসুম বেগম বিরক্ত হয়ে মাহতাবের রুমের দরজার দিকে তাকালো। ছেলে তার কোনদিন ও এমন করেনি। আজ কি এমন হলো?
লামিয়া শামিরের সাথে কথা বলছিল। ময়না বেগমের কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও কুলসুম বেগমের দৃষ্টি তার কাছে ভালো লাগলো না। আগের দিনের মানুষ সে। চিন্তাভাবনা অনেকটা সেকেলে রয়ে গেছে।
মেহরাব এসে বসতে বসতে সবার দিকে চোখ বুলালো।
— কি হয়েছে? সবাই এভাবে বসে আছো কেন?
— তোর বড় ভাই বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে বউ নিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে। লজ্জায়বামার গলা দিয়ে খাবার নামছে না।
মেহরাব আশ্চর্য হয়ে বলল,
— তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেন?
— তো লজ্জা পাবো না! সবাই ভাববে আমার ভাইয়ের মতো আমিও বোধহয় নির্লজ্জ ছিলাম। তোদের দোষ এসে আমার ঘাড়ে পরবে কেন? আর আমিই বা মানবো কেন?
মেহরাব বুঝলো তার আপার ঝগড়া করার মুড হয়েছে। তাই যুক্তিহীন যুক্তি দাড় করাচ্ছে। সে আর তর্কে গেলো না। কুলসুম বেগমের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— কিছুক্ষণ আগে ভাবি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমি নিজে চেক করে ইঞ্জেকশন দিয়ে এসেছি। আজ রাতে আর ঘুম ভাঙ্গবে না। ভাইয়া হয়তো তার পাশেই আছে। তাই এতো আকাশ কুসুম না ভাবলেও চলবে।
কুলসুম বেগম উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
— কি হয়েছে? সারাদিন তো ভালোই দেখলাম। হঠাৎ করে কি এমন হলো?
— প্রেশার লো হয়েছে আম্মা। চিন্তা করবেন না।
মেহরাব কৌশলে কথা ঘুড়িয়ে দিলো। শামির ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো মেহরাবের মুখের দিকে। কিছু একটা হয়েছে সে নিশ্চিত। মধুর আচরণ ও স্বাভাবিক ছিল না। তার উপর রুমে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়া!
ময়না বেগম মলিন গলায় বলল,
— মেয়েটা অসুস্থ আর তোর ভাই আমাদের একবার বলার প্রয়োজনও মনে করলো না! দেখেছো আম্মা? কি বেয়াদব ছেলে তোমার!
রহিমা টেবিলে মাছের বাটি রাখতে রাখতে বললো,
— ভাইজান তো বাসায় নাই আফা। হেয় তো হেই কহন বাইর হইয়া গেছে।
সবাই অবাক চোখে তাকালো রহিমার দিকে। সবার এমন দৃষ্টি দেখে রহিমা থতমত খেয়ে গেলো। ময়না বেগম আহাজারি করে বলল,
— অসুস্থ মেয়েটাকে রুমে তালা মেরে রেখে গেছে তোমার ছেলে। দেখেছো আম্মা! এই ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিলাম! তোমার ছেলে এতিম মেয়েটার উপর অত্যাচার করছে। ওর নামে আমি নারী নি*র্যাতন মামলা দিবো। মেহরাব,গাড়ি বের কর। আমি এক্ষুনি থানায় যাবো।
ময়না বেগম দুই লাফে উঠে হাত ধুতে চলে গেছে। শামির অসহায় চোখে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
— আমি বিয়ে করবো না মামা। খবরদার আমাকে কোনদিন বিয়ের কথা বলবে না।
— আচ্ছা।
— কাল মা কে নিয়ে হসপিটাল যাবো। তোমার ফ্রেন্ড কে বলে রেখো।
— হুম।
— আমাকে রুমে দিয়ে এসো মেহরাব। রহিমা কে বলো আমার খাবার রুমে দিয়ে আসতে।
— আসুন আম্মা।
মেহরাব কুলসুম বেগম কে তার রুমে নিয়ে গেলো। লামিয়া গালে হাত দিয়ে হতাশ গলায় বলল,
— আপা কখন কার দলে যায় কিছুই বুঝি না।
— সবার দলে গেলেও আম্মু কখনো মামাদের দলে যায় না মামী।
লামিয়া হেসে ফেললো। আজ মেহরাবের খবর করে ছাড়বে ময়না বেগম। থানায় না নিয়ে গেলে কয়েক ঘা লাগিয়েও দিতে পারে।
চলবে,,
#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৯
মাহতাব জয়নাল বেপারীর সামনে সোজা হয়ে বসে আছে৷ শান্ত চোখে তার হাজার ক্রোধ। জয়নাল বেপারীর পাশেই তার দুই ছেলে দাঁড়িয়ে। তারা কপাল কুচকে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ এতো রাতে মাহতাবের আগমন আর এমন শান্ত ভয়ংকর দৃষ্টির মানে কিছুই তাদের মাথায় ঢুকছে না। জয়নাল বেপারীর বড় ছেলে জাবির আজ বাড়িতেই আছে। তারা তিন ভাই জয়নাল বেপারীর প্রথম স্ত্রী মরিয়মের সন্তান। মরিয়ম বিবি বেচে থাকতেই জয়নাল বেপারী আলেয়া বেগমকে বিয়ে করেন। স্বামীর এই বেঈমানী মেনে নিতে পারেননি তিনি। তাই এক কাপড়ে সংসার ছেড়েছেন। জাবির বেশিরভাগ সময় তার সাথেই থাকে। বাবার প্রতি তেমন একটা টান নেই তার। কিন্তু ছোট দুই ভাই একেবারে তার বাবার মতো হয়েছে। দয়া মায়াহীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির। মধুরিমা কে সে ছোট বোনের মতো স্নেহ করে। যতদিন জাবির এই বাড়ি থাকতো মধু অনেকটা স্বস্তিতে থাকতো। জয় আর সামির তার উপর হাত উঠাতে পারতো না। অন্তত প্রতিদিনের মারধর থেকে বেচে যেতো সে। জাবির চেয়েছিলো মধুকে তার সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার মায়ের ঘরে সতীনের মেয়ের জায়গা হবে না। তাছাড়া মধুকে দেখলেই তার মায়ের পুরনো ঘা তাজা হয়ে উঠবে। তাই সেও নিয়ে যায়নি। মাহতাব জয়নাল বেপারী আর বাকি সবাইকে জেলে ঢুকালেও জাবির চুপ ছিল।
— মধু এ বাড়িতে বড় হয়েছে। আপনারা ওকে ছোট থেকে নিজেদের সাথে রেখেছেন। তাই প্রশ্নটা আপনাদের কাছেই করছি। মধুর সাথে কে অস*ভ্যতা করেছে? এক কথায় উত্তর চাই। বেশি কথা শোনার ধৈর্য আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তাই তাড়াতাড়ি উত্তর দিন।
জয়নাল বেপারী কুলকুল করে ঘেমে যাচ্ছেন। আলেয়া বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মাহতাবের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মাহতাবের শান্ত চোখে ক্রোধের মাত্রা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আলেয়া বেগম জয়নাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বলল,
— জামাই এসব কি বলছে জয়নাল? আর তুমি কেন চুপ করে আছো? মধুর সাথে এই বাড়িতে কেউ অসভ্যতা করেনি বলছো না কেন? ওই মুখপু*ড়ি এখানে থাকতেও শান্তি দেয়নি এখন শ্বশুর বাড়ি গিয়েও শান্তি দিচ্ছে না।
শেষের কথা গুলো বলে আলেয়া বেগম রাগে গজগজ করতে । জাবির এক দৃষ্টিতে তার বাবা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহতাব হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে। তার ইচ্ছে করছে এখনি এই সব ক’টা কে মাটিতে পু*তে দিতে। আর আলেয়া বেগমের দিকে তাকাতে গা গোলাচ্ছে। এ কেমন মা! মা রা কি এরকম হয়? উহু,মা কখনো এমন হতে পারে না। মায়েরা হয় মমতাময়ী। তারা শুধু হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। এ মহিলা কারো মা হওয়ার যোগ্য না। মাহতাব নিজের ফোন থেকে মেহরাব কে এস এম এস করে এখানে আসতে বললো। তার আবার একটাই সমস্যা,অতিরিক্ত রাগ উঠলে মুখ থেকে কথা বের হতে চায় না। যেমন এখন সে মূর্তিমান মানবের মতো জমে বসে আছ।
সবার স্তব্ধতা দেখে মুখ খুললো জাবির। জয়নাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— ভাইয়ার প্রশ্নের জবাব দাও বাবা। সে এতো রাতে এখানে নিশ্চয়ই আমাদের সাথে মজা করতে আসেনি। নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে যে কারণে তার এতো রাতে এখানে আসতে হয়েছে। তাই সময় নষ্ট না করে জবাব দাও। আমাদের সকালে অফিস আছে।তুমি আর তোমার ছেলেদের মতো বসে বসে খাই না।
ছেলের কর্কশ গলায় দমে গেলো জয়নাল বেপারী। ভীতু চোখে তাকালো ছোট দুই ছেলের দিকে। জয় আর সামির ভয়ে কাপছে। জাবির কে তারা ভালো করেই চেনে। সত্যি টা জানতে পারলে মে*রে হাত পা ভে*ঙে দিতে দু’বার ভাববে না।
আলেয়া বেগম বুঝলেন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আগের বার জেল থেকে আসার পর পাড়াপ্রতিবেশি তাদের উপর ছিঃ ছিঃ করেছে। এখনো কেউ খুব একটা মিশতে চায় না। গলির চায়ের দোকানে তাদের নিয়ে নিত্যদিনের বৈঠক বসে। এর মধ্যে আবার কিছু হলে এ পাড়ায় আর থাকা হবে না। সবাই এক*ঘরে করে দিবে তাদের।
জয়নাল বেপারী এবার গলা পরিস্কার করে একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন। মাহতাবের দিকে তাকিয়ে না জানার ভান করে বললেন,
— আপনি কি বলছেন বুঝতে পারছি না। এখানে আমরা মধুর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি ঠিক তবে তার সাথে অসভ্যতা করার কেউ নেই এ বাড়িতে। আমরা সবাই তার আপনজন। বাবা ভাই হই। এসব মুখে আনাও পাপ জামাই।
জয়নাল বেপারীর ভোলা ভালা চেহারা দেখে মাহতাবের মেজাজ খারাপ হলো। চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলো জয়নাল বেপারীর মুখের দিকে। কয়েকটা শক্ত ঘু*সি বসিয়ে চোয়াল ভে*ঙে দিতে পারলে মনটা একটু শান্ত হতো। জয়নাল বেপারীর থেকে চোখ সরিয়ে মাহতাব ঘড়ির দিকে তাকালো। এতক্ষণে মেহরাবের চলে আসার কথা। ছোট ভাই ডাক্তার হলেও হাড় ভা*ঙ্গার অভিজ্ঞতা তার কম নেই। স্কুল কলেজে এজন্য অনেকবার ই মাহতাব কে জরিমানা গুনতে হয়েছে। আজ ভাইয়ের এই গুপ্ত প্রতিভা কাজে লাগানোর সুযোগ হাতছাড়া করবেনা মাহতাব। মাহতাব কে দিয়ে ভাঙ্গবে আবার তাকে দিয়েই পট্টি করাবে। সে নিজে কিছু করবে না। শ্বশুরের গায়ে হা*ত তো*লা টা ভালো দেখায় না।
জাবির হতভম্ব চোখে বাপ ভাইদের দিকে তাকিয়ে। এই ছোট ভাই দুটো কিছুদিন আগেও তার কাছে চকলেটের বায়না ধরেছে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন সে তার বাবার কাধে চড়ে বাজারে গিয়েছে। তার চেনাজানা মানুষ গুলো কিভাবে এতো বদলে গেলো! এটা কি তার নিজের পরিবার! জাবির আলেয়া বেগমের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। এই মহিলা তাদের পুরো পরিবারটা কে ধ্বং*স করে দিয়েছে। জাবিরের মন চাইলো নিজেই নিজের গলা চে*পে ম*রে যেতে। লজ্জায় চোখ তুলে মাহতাবের দিকে তাকাতে পারছে না সে। কে এমন নিকৃষ্ট কাজ করেছে তা শোনার সাহস হচ্ছে না তার। ঘৃণায় পেট মুচড়ে উঠছে।
বাইরে গাড়ির শব্দ পেতেই মাহতাব নড়েচড়ে বসলো। ছোট ভাইয়ের কাছে এসব এক্সপ্লেইন করাও অস্বস্তিকর। তবে তার ভাই যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিছু খুলে বলতে হবে না নিশ্চিত।
মেহরাব শার্টের হাতা গোটাতে গোটাত ঢুকলো। তার পিছনে শামীর। মামার সাথে একপ্রকার জোর করেই এসেছে সে। ভিতরে ঢুকেই জয় কে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। যেন বহুদিনের পুরনো বন্ধুকে খুজে পেয়েছে সে। কেউ কিছু বোঝার আগেই দৌড়ে গিয়ে ঠিক নাক বরাবর কয়েক ঘা* বসিয়ে দিলো। মাহতাব সহ সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। মেহরাব হাতা গোটাতে ভুলে ভাগিনার দিকে তাকিয়ে আছে। কি থেকে কি হলো কারোর মাথায় ঢুকছে না। জয়ের নাক ফে*টে ফোয়ারার মতো র*ক্ত বেরুচ্ছে। জয়নাল বেপারী আর্তনাদ করে ছেলে কে আগলে নিয়েছে। শামীর বিজয়ী হাসি হাসতে হাসতে বলল,
— কলেজে থাকতে এই ছেলেই আমার নাক ফা*টিয়ে দিয়েছিলো মামা। মা*ইর খেয়ে বাসায় যাওয়ার অপরাধে মাও আমাকে জুতো দিয়ে মেরেছে। আজ শোধবোধ করে দিলাম। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ।
মাহতাব আবার চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে পরলো। মেহরাব শামীরের পিঠ চাপড়ে বলল,
— আমরা মোটেও কিছু মনে করিনি। এরা ও করেনি। তাই না?
জাবির বিষাদ মুখ নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। নিজের পরিবারের সাথে এখন যা হবে তা সে সামনে বসে সহ্য করতে পারবে না। কাল সকালেই সে এ বাসা থেকে চলে যাবে। আর কখনো এখানে আসবে না। ছেলে হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব তা দূর থেকেই পালন করবে।
মাহতাব মেহরাব কে উদ্দেশ্য করে বলল,
— এই তিনজন কে ততক্ষণ মা*রবে যতক্ষণ না এরা সত্যি বলছে। সামান্য পরিমাণ দয়া দেখাবে না। সব গুলোর মুখ বেধে নাও। আসেপাশের মানুষের যাতে অসুবিধা না হয়। যাও শুরু করো।
মেহরাব আর উল্টো জিজ্ঞেস করলো না কোন সত্যির কথা জানতে চাইছে মাহতাব। সে নিজের কাজে লেগে গেলো।
শামীর কিছুটা বুঝতে পারলো ঘটনা। তাই সে চুপ করে মাহতাবের পাশে দাড়িয়ে রইলো। মনে মনে মধুকে নিয়ে শঙ্কিত হলো কিছুটা। অমানুষ গুলো আবার কিছু করেনি তো!
চলবে,,