#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি,১৫,১৬
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৫
দাদাজান আর নাহিল হলরুমে সোফায় বসে ছিল। আতিয়াও এসে ওদের পাশে বসে। টিভির রিমোট হাতে নিতে নিতে বলে,
“-দাদাজান, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
“-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে তোমার অনুমতি নেয়া লাগবে নাতবৌ?’
আতিয়া হেসে বলল,
“-না। আচ্ছা দাদাজান এ বাড়িতে কি আপনারা তিন জনই থাকেন? আর কেউ থাকে না?’
“-না বোন। আমরা তিনজন ছাড়া আর তো কেউ থাকে না।’
“-ওহ। কিন্তু দাদাজান, আর কেউ থাকে না কেন? বাকি সবাই কোথায়? ‘
দাদাজান এবার বুঝতে পারলেন আতিয়া ঠিক কী বলতে চাইছে। দাদাজান কিছু বলার আগে নাহিল বলে উঠল,
“-তুমি তোমার শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ ওদের কথা জানতে চাইছো নিশ্চয়ই? ‘
“-হুম। ওরা কোথায়? ‘
দাদাজানের দিকে তাকাল নাহিল। বুড়োর মন খারাপ হয়ে গেছে। পরিবারের কথা আসলেই বুড়োর মুখ কালো হয়ে যায়।
“-ওরা কেউ নেই। তোমার শ্বশুরবাড়িতে আমি, দাদাজান আর ভাইয়া এই তিনজন লোকই আছে। আর কেউ নেই বুঝলে? সুতরাং এখানে তোমাকে জ্বালানোর জন্য হিন্দি সিরিয়াল টাইপ খাড়ুস শাশুড়ি নেই। না আছে চুগলখোরি করার জন্য ননদ। তোমার লাইফ এখানে ঝাকানাকা। আরামসে থাকবে খাবে ঘুমাবে। প্যারা দেওয়ার মত কেউ নেই এখানে।’
আতিয়া কিছু বুঝতে না পারলেও আর কোনো প্রশ্ন করল না। কারণ দাদাজানের চেহারা যেন কেমন হয়ে গেছে। মায়ের কথা উঠলে পাপার চেহারা যেমন হয়। দাদাজানেরও ঠিক তেমন হয়েছে। আতিয়া বুঝে নিয়েছে ওর মত সা’দ আর নাহিলেরও মা, বাবা নেই। কিন্তু তাই বলে আর কেউ থাকবে না। তার তো ফুপু আছে।
নাহিল আলোচনা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“-ভাই কোথায়? ‘
“-রুমেই আছে।’
“-ওহ,ভাই মনে হয় তোমাকে ডাকছে। দেখে আসো তো কী লাগবে।’
“-হুম।’ আতিয়া উঠে গেল। দাদাজানকে অন্যমনস্ক দেখে নাহিল দাদাজানের কাছে এগিয়ে এলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“-দাদাজান! ‘
“-হ্যাঁ। ‘
“-একটা কথা বলব?’
“-তুমিও এই ঢং কবে থেকে শুরু করেছ? আগে তো যা বলার থাকতো সোজা বলে ফেলতে। অনুমতি নিতে না। এখন তাহলে…’
নাহিল দাঁত বের করে হেসে বলল,
“-কাল রাতে তো আপনি বলছিলেন, বড় নাতির বিয়ে নিয়ে আপনার অনেক স্বপ্ন ছিল। বলছিলাম কী দাদাজান, ভাইয়ের বিয়ে তো আমাদের কারোর চোখের সামনে হয়নি। তাই আবার যদি ওদের বিয়ে করাতেন। বা রিসেপশন পার্টি দিতেন…’
নাহিলকে মাঝ কথায় থামিয়ে দিয়ে দাদাজান বললেন,
“-ভালো কথা মনে করেছ তো তুমি। যতই ওরা একা একা বিয়ে করুক। আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। আমাদের আত্মীয় কেউ না থাকুক। আমরা নিজেরা তো আবার কাজী ডেকে বিয়ে পড়াতে পারি।’
নাহিল মনে মনে ইয়াহু বলে লাফিয়ে উঠতে চাইল। এটাই তো চেয়েছিল সে। কোনো ভাবে দাদাজানের মাথায় এই কথাটা ঢোকাতে চেয়েছিল। দাদাজান যেহেতু একবার বলেছে আবার বিয়ে করাবে তাহলে উনি এটা করবেনই। মনে মনে নাহিল বলল,
“-যাক ভাইয়ের জন্য পারমানেন্ট একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। এখন আতিয়াকে ম্যানেজ করতে পারলেই হলো।’
দাদাজান আপনমনে মনে যাচ্ছেন।
“-ধুমধাম করে ওদের আবার বিয়ে দিব। সবাইকে আমার বড় নাতির বৌ দেখাব। এতদিন যারা বলত আমার নাতিরা সন্ন্যাসী হবে তাদের গালে ঠাস করে চড় পড়বে।’
“-হ্যাঁ দাদাজান। তাই করুন। আমিও তো ভাইয়ের বিয়ে নিজের চোখে দেখিনি। আপনিও না। এখন ভাই সত্যি বলছে কি-না কীভাবে জানব? হতে পারে ওরা মিথ্যা বলছে। এমনও হতে পারে ভাই ওই মেয়েটাকে দিয়ে নাটক করাচ্ছে। নইলে ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে তা তো আমরা কেউই জানতাম না। আমাকেও মাত্র এক সপ্তাহ আগে জানাল। দাদাজান, আমার মনে হয় ওদের মধ্যে কোন ঘাপলা আছে। আমার কিন্তু ওদের বিয়েটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।’
নাহিলের কথা শুনে মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে দাদাজান বললেন,
“-ঠিক বলেছ। আমারও এমনটাই মনে হচ্ছিল। নইলে সা’দের মত ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকবে না। আর থাকলেও আমরা আগে জানতে পারতাম।’
“-হুম। যদি ওরা আগে থেকেই বিয়ে করে থাকে তাহলে তো ভালোই। আর যদি নাটক করে তাহলে আমরা আবার ওদের ধরে বিয়ে করিয়ে দিব। ওরা নিজেদের জালে নিজেরাই ফেঁসে যাবে। কি বলেন? ‘
“-আইডিয়া তুমি মন্দ দাও না।’ দাদাজান আর নাহিল হাত মেলাল। বাঁকা হেসে নাহিল বলল,
“-ভাই, এই কাজের জন্য আমার কাছে সারাজীবন তুমি ঋণী হয়ে থাকবে হুহ। তোমার সাতপুরুষের কাজ করে দিলাম। এবার তোমাদের মিথ্যার বিয়ে সত্যি হয়ে যাবে।’
আতিয়া আনমনে নখ কামড়াতে কামড়াতে ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সা’দ ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল। আড়চোখে আতিয়াকে ঘরে ঢুকতে দেখল। আতিয়া বলল,
“-ডাকছিলেন? ‘
আতিয়ার দিকে ফিরে সা’দ বলল,
“-হ্যাঁ? ‘
“-না মানে ডাকছিলেন নাকি? নাহিল বলল…
“-নাহিল এমনি বলেছে। আমি আপনাকে ডাকি নি।’
“-ওহ।’
আতিয়াকে চিন্তিত দেখে সা’দ জিজ্ঞেস করল,
“-কিছু হয়েছে? ‘
“-না।’
“-আপনাকে চিন্তিত লাগছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
সা’দ ওয়ালেট আর রুমাল পকেটে ভরে নিল। আতিয়া হঠাৎ বলে উঠল,
“-শুনুন, আপনার মা বাবা কেউ নেই? ‘
স্বাভাবিক ভাবে সা’দ জবাব দিল।
“-না।’
“-কিছু মনে করবেন না। কিন্তু উনাকে কবে মারা গেছেন? ‘
“-ঠিক বলতে পারব না।’
আতিয়া এই কথায় অবাক হলো। অর্থ বুঝতে পারলো না কোনো। সা’দ আবার বলল,
“-আমি আমার মা’কে কখনও দেখিনি। নাহিলও তার মা’কে দেখেনি।’
আকাশ থেকে পড়লো যেন আতিয়া।
“-তার মানে আপনাদের দু’জনের এক মা না? আপনারা আপন ভাই না? সৎ ভাই! আপনাদের মা আলাদা, বাবা এক?’
“-উঁহু। নাহিল আর আমি আপন মায়ের পেটের ভাই না। আমাদের বাবাও এক না। আসলে ওর সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। দাদাজানের সাথেও না। যেমন আমি জানি না আমার বাবা মা কে। তেমন নাহিলও জানে না ওর বাবা মা কে। দাদাজান আমাদের দুই ভাইজে অনাথাশ্রম থেকে নিয়ে এসেছেন।’
আতিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না। এই লোকটা আলতু ফালতু কী বলছে এসব।
“-আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ক্লিয়ার করে বলবেন একটু? ‘
“-বলছি। দাদাজান ছিলেন উনার বাবার একমাত্র ছেলে। উনার কোন ভাই বোন ছিল না। আমাদের দাদীজান যাকে আমি, নাহিল কেউই দেখিনি।উনাকে দাদাজান ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের অনেক বছর পরেও দাদীজানের কোনো সন্তান হয়নি। তারপর দাদীজান যখন মারা যান তখন আর দাদাজান বিয়ে করেননি। তাই উনার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। দাদাজান ছিলেন একা মানুষ। নিজের ছেলেমেয়ে ছিলেন না। দ্বিতীয়বার বিয়েও করেননি। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল উনার দিন। কিন্তু এক সময় এসে দাদাজান বুঝতে পারেন এভাবে একা একা জীবন পার করা সম্ভব না। একা একা কখনও বেঁচে থাকা যায় না। কাউকে না কাউকে পাশে লাগেই। তখন আমাকে আর নাহিলকে আলাদা দুই জায়গা থেকে তুলে এনে একসাথে বড় করে। আমাদেরকে উনি নিজের নাতির থেকে কম দেখেননি। উনার কাছে আমরাও উনার সব। আমরা দু’জনই যখন বড় হই। জীবন সম্পর্কে বুঝতে শিখি, দাদাজান তখনই আমাদের সবকিছু জানিয়ে দেন। আমরা দুই ভাই সবকিছুই জানি৷ আমাদের বাবা মা কে? আমরা কোথায় থেকে এলাম? কেন বাবা মা আমাদের নিজেদের থেকে দূর করে দিয়েছেন? এখন আর আমাদের কাছে ওসব ম্যাটার করে না। আমরা মন থেকে মানি দাদাজান আমাদের সব। আমরা বিশ্বাস করি আমরা দু’জন উনারই নাতি। রক্তের সম্পর্ক নেই তো কি হয়েছে? আত্মার সম্পর্ক আছে। আছে ভালোবাসার সম্পর্ক।’
সবটা শুনে আতিয়া থম মেরে বসে রয়েছে। আজ সত্যিটা না শুনলে সে কখনও জানতেই পারত না ওরা দু’জন আপন ভাই না। কত মিল দুই ভাইয়ের মধ্যে! কত ভালোবাসা। দাদাজানের জন্য সব করতে পারে এরা। এক তার ফুপু,নিজের আপন ভাইয়ের সম্পত্তির উপর লোভ করে।
“-দাদাজানকে ভালোবাসি বলেই উনাকে মিথ্যা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। আপনাকে আমার বৌ সাজিয়ে নিতে আসতে মন সায় দিচ্ছিল না। তবুও দাদাজানের চাপাচাপিতে আর নাহিলের জোরে কাণ্ডটা করতে হলো। দাদাজান যেদিন জানবেন আমরা তিনজন উনাকে ধোঁকা দিয়েছি যেদিন ভীষণ কষ্ট পাবেন।’
আতিয়া নিজে নিজেই বিরবির করে বলে উঠল,
“-আমার মিথ্যের সামনে তো আপনাদের মিথ্যে কিছুই না। আমি তো সেই প্রথম থেকে আপনার সাথে মিথ্যা বলে আসছি। আপনি মিথ্যে বলেছেন দাদাজানের খুশির জন্য। আর আমি মিথ্যা বলে যাচ্ছি নিজের স্বার্থের জন্য। আমার সত্য যেদিন আপনাদের সবার সামনে আসবে সেদিন আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন না। আমিও মুখ দেখাতে পারব না।’
“-কিছু বললেন? ‘
“-হ্যাঁ? কই না তো৷ কিছু বলিনি।’
“-সবই তো শুনলেন, তাই আপনার কাছে একটা অনুরোধ রইল দাদাজান যেন আপনার কোনো কাজে বা আচরণে কষ্ট না পায়। প্লিজ এ বিষয়টা খেয়াল রাখবেন।’
মাথা নাড়ল আতিয়া।
“-হুম।’ সা’দ চট করে একবার আতিয়ার মুখের দিকে দেখে নিল। মনে মনে বলল,
“-শুধু দাদাজানের সাথে না, আপনার সাথেও মিথ্যে বলেছি আমি। দাদাজানের কোন অসুখ নেই। উনার হার্টের প্রবলেম নেই। হ্যাঁ প্রেসার আর ডায়াবেটিস আছে। কিন্তু…
আতিয়ার কাছে মিথ্যে বলে সা’দ স্বস্তি পাচ্ছে না। নাহিল কেন যে শুধু শুধু দাদাজানকে নিয়ে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলল। মনে মনে সা’দ বলল,
“-খুব শীঘ্রই সব সত্যি বলে দিব আপনাকে। তখন আপনি আমাকে ক্ষমা করে আমার ভালোবাসা গ্রহণ করে নিয়েন। ভুল বুঝে ফিরিয়ে দিবেন না প্লিজ। আপনাকে পাওয়ার জন্যই এই মিথ্যা বলা। তবুও আমি মানছি ভুল আমার। একটা সম্পর্কের শুরু কখনও মিথ্যে দিয়ে করতে নেই। ‘
দু’জনের মনে একই সময়ে ঠিক দুই রকমের চিন্তা কাজ করছে। দু’জনই নিজের জায়গা থেকে নিজেকেই দোষ দিচ্ছে।
সা’দ আগে আগে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আতিয়া তার পেছন পেছন আসছে। নিচে দাদাজান আর নাহিল এখনও বসে আছে। নাহিল দাদাজানের কাঁধে মাথা হেলান দিয়ে আস্তে করে বলল,
“-দাদাজান! ও দাদাজান! ‘
“-বলো।’
“-ওদের দেখে আপনার কিছু মনে হচ্ছে না? মানে ভাই কিন্তু আতিয়াকে তেমন ডাকে না। কোনো কথা বলে না। দরকার পড়লেও না। আমার কিন্তু কেমন খটকা লাগছে।’
“-আমারও এখন একটু একটু খটকা লাগছে। ভালোবেসে বিয়ে করলে ওদের মধ্যে ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
“-হুম। দাদাজান আরেকটা কথা তো আপনি জানেন না,আতিয়া ভাইকে আপনি করে বলে।’
নাহিলের দিকে ফিরে দাদাজান অবাক হয়ে বললেন,
“-হ্যাঁ? সত্যি? তুমি শুনেছ?’
“-হুম। এখনও দেখছেন না দু’জন কেমন মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অফিসে যাওয়ার আগে বউ জামাইকে হাসি হাসি মুখে বাই বলে। টাই বেঁধে দেয়। অনেকে তো কপালে চুমা দেয়। আবার অনেকে…
দাদাজান নাহিলকে থামিয়ে দিল।
“-থামো, থামো। এদেরকে তো আমি দেখছি। আজই বেরিয়ে যাবে ওরা সত্যিই বিয়ে করেছে নাকি স্বামী স্ত্রীর নাটক করছে।’
“-হুম।’
অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখছে নাহিল। এখন ভুলেও বুড়োর সামনে হাসা যাবে না। বুড়োর মনে ঘোর সন্দেহ ঢালতে হবে। নইলে ওই দু’টা কখনও কাছাকাছি আসবে না। পাশাপাশি থাকবে তো ঠিকই কিন্তু কোনো কেমিস্ট্রি তৈরি হবে না। দাদাজানের নজর পড়লে তবেই এরা লাইনে আসবে।
সা’দ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। তার চোখ নাহিলের উপর পড়লে ভ্রু কুঁচকে গেল। নাহিল কিছু বলতে চাইছে নাকি? ইশারা করে কী বুঝাতে চাইছে? এই ছেলের মাথা ঠিক নেই। নাহিল দাদাজানের চোখের আড়ালে ভাইকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভাই গাধা কিছুই বুঝতে পারছে না। এই অবুঝ শিশু ভাইকে নিয়ে কী করবে সে? নাহিল ঠোঁট নেড়ে চোখে দাদাজানের দিকে ইশারা করে বলল,
“-বুড়ো তোমাদের সন্দেহ করছে ভাই।’
কপাল কুঁচকে সা’দও তেমন ভাবে বলল,
“-কি?’
“-বলছি দাদাজান সন্দেহ করছে। ‘
এবার কিছুটা বুঝতে পারল সা’দ। এই দাদাজান তো জ্বালিয়ে খাচ্ছে। এখন আবার সন্দেহ করছে কেন? নাহিল পেছনে আতিয়াক দেখিয়ে বলল,
“-বুড়ো তোমাদের আরও কাছাকাছি দেখতে চাইছে।’
“-হ্যাঁ?’
নাহিল ডান হাতে আতিয়াকে দেখিয়ে, বাঁ হাতে সা’দকে দেখিয়ে পরমুহূর্তে দুই হাতের আঙুল একসাথে মুঠি বদ্ধ করে নিল। সা’দ চোখ পাকালো। নাহিল ঠোঁট বাকিয়ে অসহায় ভাবে বলল,
“-আমার কী দোষ? বুড়ো চাইছে।’ দাদাজান এবার নাহিলকে দেখে বলল,
“-ইশারা ইশারায় কী কথা বলছো তোমরা? আমি সামনেই আছি ভুলে গেছ?’
নাহিল অস্বীকার করে বলল,
“-কিছুই তো বলছি না দাদাজান। আমরা কিছুই ইশারা করিনি, তাই না ভাই?’
চলবে…
#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি(১৬)
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মেইন দরজার কাছে গিয়ে সা’দ পেছন ফিরে আতিয়াকে ডাকলো,
“-কই শুনছো?’
আতিয়া প্রথমে বুঝতে পারেনি সা’দ যে তাকে ডাকছে। নাহিলের কথায় বুঝতে পারল।
“-কই গো ভাবি, তোমার উনি তোমাকে ডাকছেন।’
আতিয়া ইতস্তত করে সা’দের দিকে এগিয়ে গেল। সা’দের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আতিয়া। সা’দ মনে মনে সাহস জুগিয়ে চোখ বন্ধ করে বারকয়েক দম নিল। তারপর আতিয়ার মাথার পেছনে হাত রেখে কপালে চুমো খেল। হঠাৎ একঝাঁক শীতল বাতাস এসে আতিয়ার সমস্ত শরীরে শিহরণ ধরিয়ে দিল। কী হয়েছে এটা ঠিক বুঝতে পারলো না সে। নাহিলের চোখ কপাল টপকে মাথায় উঠে গেছে। হা করে ভাইয়ের কাণ্ড দেখল সে। এটা কি সত্যিই তার ভাই? তার সেই ভাই হঠাৎ এতো সাহস পেল কোত্থেকে? সরাসরি কিস করে ফেলল! দাদাজানও নাহিলের মতো অবাক হয়েছে। উনার বড় নাতি সম্পর্কে ধারণা অন্য রকম ছিল। এই নাতি তলে তলে এতদূর ভাবতে পারেননি তিনি।
সা’দ নিজের এই কাজে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। দাদাজান, নাহিলের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে গেল। সবাই কেমন ভূত দেখার মত করে তাকে দেখছে। আতিয়ার মুখের দিকে তাকাতে পারলো না সে। বেরিয়ে গেল। আতিয়া জমে গেছে। লোকটা করলোটা কি হ্যাঁ? দাদাজান আর বসে থাকলেন না। আলগোছে উঠে দাঁড়িয়ে এখান থেকে কেটে পড়লেন। মেয়েটাকে আর লজ্জায় ফেলা ঠিক হবে না। এমনিতেই মুখটা লাল হয়ে গেছে। নাহিল আতিয়ার কাছে উঠে এলো। শিস দিতে দিতে বলল,
“-অহহো… আমি তো জানতাম আপনারা ফেইক হাজবেন্ড ওয়াইফ। এখন তো দেখছি ঘটনা অন্য কিছু। চুম্মাচাটি পর্যন্ত এগিয়ে গেছে আমার ভাই! বাহ বাহ! চালিয়ে যাও ভাবি। তোমার দেবর আছে তোমাদের পেছনে। ‘
হাসতে হাসতে চলে গেল নাহিল। আতিয়া কখনও লজ্জা পাওয়া টাইপ মেয়ে ছিল না। কিন্তু আজ তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। এই ঘটনার পরে তো লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। রুমে চলে গেল সে। দুপুর পর্যন্ত বাকি সময়টা রুমে বসেই কাটাল।
অফিসে বসে থেকে সা’দও অস্থির হচ্ছে। আসার সময় কি করেছে সে এটা? দাদাজান সন্দেহ করছে বলে এই কাজ করবে! মেয়েটা তাকে কী ভাবছে? আজ বাড়ি ফিরে ওর সামনে যাবে কী করে? মুখ দেখাবার পথ রাখল না সে। মাঝে মাঝে এমন সব বোকামি করে বসে তাতে নিজের উপরই রাগ হয়। ফোনটা বারবার বেজে উঠছে। সা’দ ফোনের উপর রাগ দেখিয়ে বলল,
“-দূর ছাতা! কত বাজতে পারে এটা?’
নাহিল বিছানার উপর ফোন রেখে দিয়ে হাসলো।
“-তুমি আজ এতো সহজে বাড়ি ফিরবে না তা আমি জানি ভাই।’
রেডি হয়ে বেরিয়ে এসে আতিয়াকে ডাকল নাহিল।
“-ভাবি সাহেবা, আমি একটু বের হচ্ছি। তোমার কিছু লাগলে বলে দাও নিয়ে আসব।’
“-আমার কিছু লাগবে না। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
ভ্রু নাচিয়ে নাহিল বলল,
“-গেস করো দেখি।’
“-ডেট-এ যাচ্ছ?’
“-ঠিক ধরেছ। তবে ওটাকে ঠিক ডেট বলা চলে না। ব্রেকআপ করতে যাচ্ছি। আজ এগারো নাম্বার গার্লফ্রেন্ডের রফাদফা করে আসব। শালি অনেক জ্বালিয়েছে। ওকে আর নিতে পারছি না।’
হাসলো আতিয়া। বলল,
“-সিরিয়াস ভাবে কখনও কারো প্রেমে পড়ো নি? ‘
“-সে কপাল আর হলো কই? কিন্তু ভাবছি তোমার ছোট বোন তোমার মত সুন্দর, সুইট,কিউট হলে ওকেই বিয়ে করে নিব। আসি এখন। তুমি দাদাজানের খেয়াল রেখো। সন্ধ্যার আগে ভাই ফিরে আসবে। আমি রাতে সবার সাথে খাব।’
“-হুম। ‘
নাহিল চলে গেলে আতিয়া দাদাজানের রুমে গেল। আতিয়াকে দেখে দাদাজান পানির গ্লাস রাখতে রাখতে বললেন,
“-এতক্ষণ কোথায় ছিলে? এসো।’
“-কী করছেন দাদাজান? ‘
“-আমার আর কাজ কি? সারাদিন শুয়ে বসে কাটাই। তোমার বরটা তো আমাকে কিছু করতেই দেয় না।’
অনেকক্ষণ কথা বলল দু’জন। কথায় কথায় আতিয়া দাদাজানকে জিজ্ঞেস করল,
“-দাদাজান, আপনি কী খেতে পছন্দ করেন?’
“-তুমি রাঁধবে?’
আতিয়া জানে সে রান্নার ‘র’ ও জানে না। রান্নাবান্না তার কাছে যমের মত। তার রান্নাঘরে যাওয়ার মানেই কিচেনের চেহারা পাল্টে ফেলা। নয়তো বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া। গতবার পাপার বার্থডেতে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য নিজের হাতে কেক বানাতে গিয়ে যা কাণ্ড হয়েছিল। সেই ইতিহাস আতিয়া কখনও ভুলবে না। মরার আগের দিনও না। মনে মনে আতিয়া বলল,
-আমি রান্না করলে সেই খাবার মুখে তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। আর মুখে তুললেও হাসপাতালে যে যেতে হবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু যে যেতে হবে তা না, সেখানে ভর্তি হয়ে দু’তিন দিন থাকতেও হতে পারে।’
দাদাজান আবার বললেন,
“-তুমি রান্না করতে পারো?’
আতিয়া বুড়ো লোকটার মন রাখার জন্যে মিছেমিছি বলে দিল।
“-একটু আধটু পারি দাদাজান। পুরোপুরি না কিন্তু।’
“-ওহ। শিখে যাবে। তোমার দাদীজানও প্রথমে রান্নাবান্না তেমন পারতেন না। আমার মা-ই তো ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছেন। তোমার তো এখানে কেউ নেই। শিখতে একটু সময় লাগবে। তবুও পারবে।’
দাদীজানের কথা বলতে গিয়ে দাদাজানের চোখ কেমন যেন খুশিতে চকচক করে উঠলো। বুড়ো এখনও স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন। উনার কথা বলতে গিয়ে চেহারাই যেন পাল্টে যায়। আতিয়া বলল,
“-দাদাজান, দাদীজান কোন জিনিসটা সবথেকে বেশি ভালো রাঁধতে পারতেন? উনার বানানো কোন জিনিস আপনার সবথেকে বেশি ভালো লাগতো?’
“-ওর হাতের সবকিছুই ভালো লাগত। তবে তোমার দাদীজান খাসির মাংস খুব ভালো করে বাঁধতে পারতেন। আমার মায়ের থেকেই তো শিখেছিল। এই একটা জিনিসই খাদিজা ঠিক মায়ের মত পারতো।’
আতিয়া মনে মনে ভেবে নিল, পারুক আর না পারুক। আজ রাতে সে নিজের হাতে দাদাজানের জন্য খাসির মাংস রাঁধবে।
বিকেলে ল্যান্ড লাইন থেকে আতিয়া বাড়িতে কল করলো। কয়েকবার রিং হবার পর ওপাশ থেকে হামিদ চাচা কল তুললো। আতিয়ার কন্ঠ শুনে হামিদ চাচা প্রথমে প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিল। উনার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে বাড়ির সব খোঁজ খবর নিয়ে নিল। সে নিজের কেমন আছে সেটাও জানাল। থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। বলতে গেলে কোনো কিছুরই অসুবিধা হচ্ছে না। চাচাকে অনেক বলে বুঝিয়ে এই কথাগুলো বিশ্বাস করাল আতিয়া। কথা বলা শেষে আতিয়া কিছুক্ষণ ব্যালকনিতে বসে রইলো। বিকেলের এই সময়টা ভালো লাগে তার কাছে।
সন্ধ্যার পরপর আতিয়া রাতের রান্না করার জন্য কিচেনে গেল। হজু নামের মধ্যবয়স্ক লোকটা আতিয়াকে দেখে মাথা নামিয়ে নিয়ে বলল,
“-বিবিজান, আপনার কিছু লাগবে? ‘
“-না। আপনি রাতের রান্না সেরে ফেলেছেন? ‘
“-জি না বিবিজান।’
এই লোকের মুখে বিবিজান, বিবিজান ডাক শুনে আতিয়া ভাবলো, বাড়ি কোথায় লোকটার? এরকম টেনে টেনে কথা বলে কেন? আর বিবিজান আবার কোন অঞ্চলের ডাক! আতিয়া বলল,
“-তাহলে চাচা রান্নাঘর থেকে আজ আপনার ছুটি।’
লোকটা আতিয়ার কথা বুঝতে পারলো না। আতিয়া তাকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“-আজ সবার জন্য আমি রান্না করব। আপনার আজ ছুটি।’
“-না, না বিবিজান। আপনি একা পারবেন না। ‘
হেসে আতিয়া বলল,
“-আমি না পারলে আপনি তো আছেনই। যখন দেখবেন একা একা পারছি না, তখন আপনি সাহায্য করে দিবেন। কেমন? এবার তাহলে চুপচাপ সাইডে দাঁড়িয়ে থাকুন। আর আমাকে রাঁধতে দিন।’
মাথা নাড়িয়ে হজু ‘হুম ‘ বলে পাশে সরে গেল। আতিয়া মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে রান্নায় লেগে পড়লো। আতিয়া যে রান্নাবান্না কিছুই জানে না হজু তা দেখেই বুঝে গেছে। সে আতিয়াকে এসব রেখে দিতে বললেও আতিয়া জেদ ধরে নিজেই রান্না বসিয়ে দিল। হজুর সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে আতিয়া কাটাকাটির কাজ করছে। পুরোটা সন্ধ্যা আতিয়া রান্নার পেছনেই কাটাল।
রাতে নাহিল ফিরে এসে দেখে সা’দ এখনও ফিরেনি। আতিয়া একা একা হলরুমে সোফায় বসে টিভি দেখছে। নাহিল তার দিকে এগিয়ে এলো। আতিয়া দুই পা সোফায় তুলে হাঁটুর উপর থুতনি রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে,যার কারণে নাহিলের উপস্থিতি সে টের পেল না। নাহিল মৃদু হেসে টিভির দিকে তাকাল। কোনো মুভি চলছে। এই চাপা চেপ্টা ছেলেটা হিরো কিনা বুঝতে পারলো না সে। এই ছেলে হিরো হলে মুভিটা সুপার ফ্লপ হবে। কে দেখবে এই কঙ্কালকে?ব্যাটা সিগারেট টানতে টানতে ইজি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। আর মনে মনে কিছু ভাবছে। কোন পরিচালক এসব মুভি বানায়? একজন মনে মনে কী ভাবছে সেটা পাবলিক শুনতে পাবে কেমন করে? এসব ফালতুগিরির মানে হয় কিছু? আতিয়াও দুনিয়া ভুলে গিয়ে হাঁ করে এই জিনিস গিলছে। নাহিলের মনে দুষ্টুমি বুদ্ধি এলো। সে আতিয়ার কানের কাছে গিয়ে হঠাৎ জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“-বাড়িতে ডাকাত পড়েছে ভাবি সাহেবা। ‘
আতিয়া ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে নাহিলের দিকে ফিরে বলল,
“-নাহিল,তুমি? ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।’
নাহিল হাসতে হাসতে আতিয়ার হাত থেকে রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে বলল,
“-কিসব দেখছ হ্যাঁ? ‘
“-মুভিটা ভালো ছিল। হিরো মনে মনে হিরোইনকে ভালোবাসতো। কিন্তু মুখে বলতে পারছিল না। ওদিকে আবার মেয়েটার বিয়ে অন্য একজনের সাথে হতে যাচ্ছিল।’
“-সব মুভির একই কাহিনী। আর তোমার বেচারা হিরোকে দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। ওর থেকে তো আমিই ভালো।’
“-তোমার এগারো নাম্বার গার্লফ্রেন্ডের খবর কী? ব্রেকআপ নাকি ঝুলে আছে? ‘
“-আর ঝুলাঝুলি! তালাক দিয়ে এসেছি, তালাক। কান্নাকাটি করছিল অবশ্য। তবে আমি ওর ফাঁদে আর পা দিইনি। ওর চোখে পানি লাইক ব্যাঙের সর্দি।’
শেষের কথাটা শুনে আতিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। নাহিল বলল,
“-ভাই এখনও ফিরে নি? ‘
উদাস গলায় আতিয়া জবাব দিল,
“-না।’
“-এতো দেরি করছে কেন? প্রতিদিন তো এর অনেক আগেই চলে আসে। আজ কোথায় গেল তাহলে? ‘
“-জানি না।’
দাদাজান যখন জানতে পারলেন আজ আতিয়া নিজের হাতে সবার জন্য রান্না করেছেন, তখন উনার খুশি আর দেখে কে? সা’দ এখনও ফিরেনি দেখে নাহিলের সাথে রাগারাগি করলো। যেন সা’দের আসতে দেরি হওয়ার পেছনে নাহিলের হাত আছে। নাহিল দাদাজানের বুঝানোর চেষ্টা করে বলছে,
“-দাদাজান, আমাকে বকছেন কেন? আমার কী দোষ? ‘
দাদাজান ধমকে উঠে বললেন,
“-চুপ থাকো তুমি। তোমারই সব দোষ। মেয়েটা এতো কষ্ট করে নিজের হাতে সব রান্না করেছে। আর তোমার ভাইয়ের কোন পাত্তা নেই। কোথায় সে? কী এতো কাজ তার,যার জন্য বাড়ি ফিরতে এতো রাত করছে?’
নাহিল বিরবির করে বলল,
“-লে এখন ভাই কেন দেরি করে ফিরছে সেই দোষও আমার! নাহিল বাবা তুই কেন এখনও বেঁচে আছিস? না, প্রতিদিন এই অপমান সহ্য করার জন্য বেঁচে আছিস তুই? ‘
“-ফিসফিস করে কী বলছো? ফোন লাগাও তাকে। দেখো সে কোন রাজকার্য উদ্ধার করছে।’
“-লাগাচ্ছি।’
দু’বার রিং হবার পর সা’দ ফোন তুললো।
“-হ্যাঁ ভাই, কোথায় তুমি? দাদাজ…
দাদাজান নাহিলের হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
“-বিশ মিনিটের ভেতর বাড়ি না ফিরলে তোমাকে আজ আর বাড়ি ফিরতে হবে না। বাইরেই থাকার ব্যবস্থা করে নিও।’
কট করে ফোন রেখে দিল দাদাজান। তারপর আতিয়ার দিকে ফিরে মিষ্টি করে হাসলেন। আতিয়া এতক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। চুপচাপ দাদাজানের কাণ্ড দেখছিল। নাহিল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“-বুড়োর ভীমরতি হয়েছে। খাটাশ বুড়ো। ‘
সা’দ রাস্তায়ই ছিল৷ দাদাজানের ওই কথাগুলো শোনার পর হন্তদন্ত হয়ে একপ্রকার উড়ে এসেছে বলা যায়। বাসায় ফিরে সবাইকে একসাথে হলরুমেই পেয়ে গেল। দাদাজান গম্ভীর মুখে বললেন,
“-দশ মিনিটের ভেতর ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসো।’
নাহিল চোখ টিপে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“-যাও, যাও।’
সা’দ আতিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ঠিক দশ মিনিট পরেই সা’দ নিচে নেমে এসেছে। সবাই খাবার টেবিলে বসে আছে। দাদাজান হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
“-আজকের সবকিছু আতিয়া নিজে রান্না করেছে। তাও একা একা।’
নাহিল হেসে বলল,
“-বাহ! বেশ তো। তা খেতে পারব তো ভাবি?’
দাদাজান চোখ পাকালেন,
“-নাহিল!’
“-মজা করছিলাম দাদাজান।’
আতিয়া নিজেও মনে মনে ভয় পাচ্ছে। ওর রান্না সবাই খেতে পারবে তো? জীবনের প্রথম রান্না করেছে। নিশ্চয়ই আজ দুই তিনজন হাসপাতালে যাবে। নইলে পেট খারাপ যে করবে এটা শিওর।
ভয়ে ভয়ে সবার প্লেটে খাবার তুলে দিল আতিয়া। নিজে এখনও বসেনি। দাদাজান খাবার মুখে দিয়ে চুপ করে আছেন। উনার মুখ কেমন লাল হয়ে গেছে। সা’দ মাথা নীচু করে খেয়ে যাচ্ছে। তার মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। নাহিল খাবার মুখে নিয়েই খুকখুক করে কেশে উঠলো। মুখ থেকে ভাত ছিটকে পড়ে গেছে। বাম হাতে মাথায় হালকা থাবা দিচ্ছে সে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“-পানি। পানি।’
আতিয়া তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস ওর হাতে দিলে এক ঢোকে সবটুকু পানি খেয়ে নিল। দাদাজানও পানি খেল। আতিয়া ওদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছে রান্নায় কোন গণ্ডগোল হয়েছে। নইলে সবার মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে যেত না। নিজের উপর রাগ লাগছে তার। একটু আধটু রান্না শিখে রাখলে আজ এমনটা হতো না। যদি সে রান্না শিখে রাখতো তাহলে কী এমন হতো? এরকম লজ্জা পাওয়ার হাত থেকে তো বেঁচে যেত। কত কষ্ট করে, ভালোবেসে সবার জন্য কিছু করতে চেয়েছিল। কিন্তু সব উল্টো হয়ে গেল। কেউ খেতেই পারলো না। নাহিল ঝাল সামলে উঠে বলল,
“-ভাবি তুমি মনে হয় কেকা আন্টি ফ্যান? নইলে ভুলে অন্য কিছুর বদলে মরিচ ঢেলে দিয়েছিলে। ঠিক বলছি না আমি?’
দাদাজান নাহিলকে ধমকালেন।
“-নাহিল!’
নাহিল আতিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“-মজা করছি দাদাজান।’
আতিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। চোখ বেয়ে টুপ করে একফোঁটা পানি বেরিয়ে আসা বাকি রয়েছে শুধু। নাহিল বলল,
“-ব্যাপার না ভাবি। বিয়ের আগে কোনো মেয়েই বাবার বাড়িতে রান্না করে না। আর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে এক দিনেই যে সব শিখে যাবে এমনটা আশা করাও ঠিক না। আস্তে আস্তে পারবে। এই নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই।’
“-ঠিক। নাতবৌ তুমি মন ছোট কোরো না বোন। আমরা আছি তো। আমি তোমাকে শিখাব। আর হজুও তো আছে নাকি? সবাই মিলে শিখালে নিশ্চয়ই শিখে ফেলবে।’
সা’দ আতিয়ার মুখের দিকে সরাসরি চেয়ে বলল,
“-এই ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কেঁদে ফেলা কি ঠিক? কেউ তো বকাবকি করছে না। তাহলে চোখে পানি কেন? ‘
না চাইতেও সবার সামনে আতিয়ার চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা পানি পড়ে গেল। সাথে সাথে চোখ মুছে নিল আতিয়া। এই মানুষ গুলোর সামনে সে কাঁদতে পারবে না। এরা তার চোখে পানি দেখতে পারবে না।
চলবে…