#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি,৫,৬
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫
দু’বার রিং হবার পরও হামিদ চাচা ফোন তুলছে না দেখে রাগ হতে লাগলো আতিয়ার।
“-এই হামিদ চাচা করছেটা কি? পাপার মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে নাকি? ফোন তুলছে না কেন? ওহ গড! প্লিজ হেল্প মি।’
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার চেষ্টা করলো।
“-হ্যা, হ্যালো চাচা? আমি আতিয়া বলছি। ফোন তুলতে এতো লেট করলে কেন তুমি?’
অচেনা নম্বর দেখে হামিদ ফোন তুলতে চাইছিলেন না। তিনি ভাবতে পারেনি আতিয়া কল দিবে৷ ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন,
“- মা সারাদিন কোথায় ছিলা তুমি? তোমার চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যাইতাছিলাম।’
“-হ্যা, তুমি তো পাগল হচ্ছ। আর আমি টেনশনে মরে যাচ্ছিলাম।’
“-অমন কথা কয় না মা। আল্লাহ আমার হায়াত তোমারে দিয়া দেক। কই তুমি মা?’
“-সিলেট আছি চাচা।’
“-সিলেট! ‘
“-হুম।’
“-ওইখানে কিছু চিনো তুমি? ‘
“-তুমি তো জানোই চাচা। আমি ঢাকা শহরই ভালো করে চিনি না। সিলেট জীবনে আসিনি। তাহলে কী করে চিনবো? ‘
“-এহন কই আছো তুমি? ‘
“-এখানের একটা হোটেলে উঠেছি।’
হঠাৎ হামিদের কন্ঠ অন্যরকম হয়ে গেল। অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন,
“-মা, তুমি ঠিক আছো তো?’
মন খারাপ হয়ে গেল আতিয়ার। এই মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসে কেন? বাবা কেন হামিদ চাচার মত করে ওকে বুঝে না? হামিদ চাচা আতিয়ার খুশির কথা ভাবে। বাবাও ভাবে, কিন্তু হামিদ চাচার মত না।
“-আমি একদম ঠিক আছি চাচা। বাড়িতে সবাই কেমন আছে? ওখানের অবস্থা কী?’
সবাই বলতে আতিয়া বাবার কথা জানতে চেয়েছে। বাবা আর হামিদ চাচা ছাড়া তো বাড়িতে তার কেউ নেই। পাঁচ ছ’টা কাজের লোক আছে।
“-আর বাড়ি! ভাইজান বাড়িরে বাড়ি রাখছে নাকি? তুমি আবার পালাইছো জানার পর থেকেই চিৎকার চেচাঁমেচি করে বাড়িটারে পাগলা গারদ বানাইয়া ফেলছে। সব চাকরবাকররে কাজ থেকে বাদ দিয়া দিতাছে। আমারে সহ সবাইরে গুলি কইরা মারার ধমক দিতাছে।’
হেসে ফেলল আতিয়া।
“-পাপা তো এমনই। মুখেই শুধু বড় বড় কথা। করার বেলা হাওয়া ফুরিয়ে যায়। আর তোমরা ভয় পেয়ো না। পাপার বন্দুকে গুলি থাকে না। ফাঁকা বন্দুক নিয়ে ভয় দেখায় শুধু।’
“-তা আমি জানি।’
“-শোনো, তুমি কিন্তু পাপাকে বেশি টেনশন করতে দিও না। জানোই তো পাপার ব্লাড প্রেশার আছে। একটু টেনশন করলেই পাপাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে টানাটানি লাগে। তুমি পাপার একটু খেয়াল রেখো।’
“-তা আমি রাখমু। তোমার বাপ আমার ভাইজান লাগে। ভুইলা যাইতাছো কেন?
তুমি এইবার কবে ফিরবা?’
“-ওই নাগিন তার ছেলেকে নিয়ে ফিরে গেলেই আমিও বাড়িতে চলে আসব।’
“-নিজের আপন ফুপুরে নাগিন কয় না মা।’
“-নাগিন! নাগিন! নাগিন! নাগিন! ওই মহিলা একশোবার নাগিন। তুমিই বলো, ওকে নাগিন না বলে আর কি বলবো? কাল নাগিন বলবো? অবশ্য কাল নাগিনই বেশি মানায়।’
আতিয়া তার একমাত্র ফুপুকে নাগিন নাম দিয়েছে। এর পেছনেও একটা কারণ আছে। আতিয়া যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন তার মা মারা যায়। আতিয়ার বাবা তখন আতিয়াকে লন্ডনে তার ফুপুর কাছে পাঠিয়ে দেয়। দুই বছর আতিয়া ফুপুর কাছেই থাকে। তারপর দেশে ফিরে এসএসসি, এইচএসসি কমপ্লিট করে। দুই মাস আগে ফুপু উনার ছেলেকে নিয়ে দেশে আসেন। আতিয়া ভেবেছিল ভাই, ভাইঝির কথা মনে করে ফুপু হয়তো ওদেরকে দেখতে এসেছেন। কিন্তু না। এই কাল নাগিনী তো অন্য মতলব নিয়ে এসেছে। উনার ওই ঢেঁড়স মার্কা ছেলেকে নাকি তাকে বিয়ে করাতে চায়৷ প্রথম দিন কথাটা শুনেই আতিয়ার গা জ্বলে গেছিল। পাপাকে সাফ সাফ বারণ করে দিয়েছিল। পাপাও রাজি ছিল না। কিন্তু ওই কাল নাগিনীটা পাপাকে কি ভুজুংভাজুং বুঝালো যে,পাপাও রাজি হয়ে গেল। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার আগের রাতে হামিদ চাচার কাছে জানতে পারে কাল তার এনগেজমেন্ট হবে। তখন আতিয়া হামিদ চাচাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতে সাহায্য নেয়।
“-ওই নাগিন কবে যাবে জানো কিছু? ‘
“-না। আপাজান চলে গেলে আমি তোমারে জানামু। তখন তুমি ফিরে আইসো। ততদিন যেখানেই থাকো ভালো থাইকো। সাবধানে থাইকো। অচেনা কাউরে বিশ্বাস কইরো না। সব মানুষ তোমার মত ভালা না মা।’
“-ওকে, ওকে। তুমি পাপাকে বুঝিয়ে ওই নাগিনকে তাড়াতাড়ি তাড়াও। আমার মনে হয় না এবার ফুপু এতো সহজে ফিরে যাবে।’
“-ভাইজান ক্যান বুঝে না? তোমার ফুপু তোমগোর সম্পদ চায়। তাই তোমারে ছেলের বউ করার জন্য উঠেপড়ে লাগছে। ওই ছেলে ভালা না। ওর সাথে তুমি সুখী হইবা না।’
“-আমি জানি চাচা। দুই বছর ওদের কাছে ছিলাম। বিশাল কেমন ছেলে তা আমার থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না। ক্যারেক্টারলেস ছেলে ও। আমি মরে গেলেও এই জীবনে বিশালকে বিয়ে করব না। দরকার পড়লে সারাজীবন পালিয়ে পালিয়ে থাকব। তবুও বাড়ি ফিরে ওই কাল নাগিন আর তার ছেলের হাতে পড়ব না।’
“-তোমার কাছে টাকা কেমন আছে? টাকা লাগলে আমি পাঠিয়ে দেই?’
“-টাকা অনেক আছে। এক মাস পালিয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট। তুমি শুধু পাপার খেয়াল রেখো। আমি এখন রাখছি। এটা আমার নাম্বার না। অন্য একজনের ফোন দিয়ে কথা বলছি।”
“-আচ্ছা। সাবধানে থাইকো।’
“-তুমি আমার জন্য টেনশন নিয়ো না। আমি নিজেই তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট করব।’
“-হুম।’
আতিয়া রুমে এসে দেখে সা’দ এখনও একই ভাবে বসে আছে। গম্ভীর হয়ে কিছু ভাবছে সে। ভাবনার জগতে এতটাই মগ্ন আছে যে,আতিয়া রুমে এসেছে এটাও খেয়াল করেনি। আতিয়া ওর সামনে গিয়ে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“-নিন আপনার ফোন। ‘
সা’দ চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল। বলল,
“-কথা হয়েছে? ‘
“-হুম।’
আতিয়া সা’দকে দেখতে দেখতে বেডে গিয়ে বসলো। মনে মনে ভাবতে লাগল।
-ব্যাটার হাবভাব কিছু বুঝি না বাবা। এখনও আমাকে সন্দেহ করছে নাকি?’
শোবার জন্য বালিশ ঠিক করে বেডের মাঝে একটা বালিশ রেখে বলল,
“-শুনুন।’
“-হুম।’ সা’দ আতিয়ার দিকে না ফিরেই উত্তর দিল। আতিয়া বলল,
“-এটা ডাবল বেড। আমাদের দু’জনের ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি ওপাশে শুয়ে পড়ুন। আমি এপাশে। ‘
এবার সা’দ ঘুরে তাকাল। আতিয়া যেন চাইনিজ ভাষা বলছে তাই সে কিছুই বুঝতে পারেনি। এমন ভাবে কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“-কি বললেন? ‘
“-আরে আপনি কানে কম শুনেন নাকি? বলেছি, আপনি ওপাশে ঘুমান।’
“-মানে আপনি এক বেডে…আমার সাথে…
“-এখানে মানে টানের কি আছে? ঘুমাবেন না আপনি? নাকি একটা মেয়ের সাথে এক বেডে ঘুমাতে আপনার আপত্তি আছে? অবশ্য আপত্তি থাকলে আমার কিছু করার নেই। আমি বেড ছাড়া ঘুমাতে পারি না। এখন আপনার যদি প্রবলেম থাকে, তাহলে আপনি সোফায় বা ফ্লোরে শুয়ে পড়ুন। আমি বেডেই শোবো।’
কথা ক’টা বলেই আতিয়া কোমর পর্যন্ত চাঁদর টেনে দিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। সা’দ হা করে মেয়েটার কাণ্ড দেখছে। এটা বাংলাদেশী মেয়ে! তাও মধ্যবিত্ত ঘরের, স্কুল টিচার বাবার মেয়ে! এতটা আধুনিক! এতটা মর্ডান এর লাইফস্টাইল! একটা ছেলের সাথে বিনা আপত্তিতে এক বেডে শোবার কথা বলছে। আমি তো খারাপ ছেলেও হতে পারি। রাতে ঘুমের মধ্যে ওর সুযোগও নিতে পারি। মেয়েটা কি বোকা? সবাইকে এ এতো তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করে ফেলে! হ্যাঁ, তাইতো বয়ফ্রেন্ডকে বিশ্বাস করে ঠকেছে।
সা’দ বসে আছে বুঝতে পেরে আতিয়া ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“-কি হলো? আপনার জন্য আমি সারারাত সজাগ থাকব নাকি? লাইট জ্বালিয়ে বসে আছেন যে! আপনার ঘুম না পেলে দয়া করে লাইট অফ করে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যান। আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমাতে না পারলে আমার মেজাজ খারাপ হবে। আর কাল সারাদিন মাথা ব্যথা করবে।’
সা’দ বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে গিয়ে লাইট অফ করলো। লাইট অফ করে দিলেও রুমটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে রুমটা আলোকিত করে রেখেছে। সা’দ এসে আতিয়ার পাশে শুয়েছে। এবার যেন আতিয়ার কেনই একটু ভয় লাগল। ঠিক ভয় না। মনের মাঝে অন্য একটা চিন্তা কাজ করল।
“-শুনুন। আমাদের মাঝে বালিশ দিয়ে যে বেড়া দিয়েছি, ভুলেও আপনি এই বেড়ার এদিকে আসবেন না। ইচ্ছে করে তো দূর, ঘুমের মধ্যেও যদি এদিকে আসেন। তাহলে আমি লাথি দিয়ে আপনাকে বেড থেকে ফেলে দিব। আমাকে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ে ভেবে ভুল করবেন না। আপনার মাথায় যদি উল্টাপাল্টা কোনো মতলব থেকে থাকে। তাহলে এক্ষুনি সব বাদ দিয়ে দিন।
আমি আপনাকে খুন করে জেলেও যেতে পারব। সেই সাহস আমার আছে। ঝামেলায় পড়ে বাধ্য হয়েছি একটা ছেলের সাথে রুম শেয়ার করে থাকতে। নইলে আমাকে কেউ জোর করেও… ‘
ফোঁস করে দম ফেলল আতিয়া।
“-থাক সেসব কথা। আপনি কিন্তু এদিকে আসবেন না। মনে থাকে যেন। ‘
মেয়েটার কথা শুনে হাসি পেল সা’দের। এতক্ষণে তাহলে নিজের চিন্তা হলো মেয়েটার। কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। ভয় পেয়েছে একটু। একে আরেকটু ভয় দেখাবে কি? দুষ্টুমি করে ওর হাতটা ধরবে এখন? বা পা দিয়ে ওর পায়ে একটু ছুঁয়ে দিলে কেমন হবে? পরক্ষণেই মাথা ঝাকালো সা’দ। না বাবা থাক। এই মেয়েকে সুবিধার মনে হয় না। দেখা যাবে দুষ্টুমি না বুঝে চিৎকার করে পুরো হোটেল এক করে ফেলবে। তখন সা’দেরই মানসম্মান যাবে। এই মেয়েকে না ঘাটানোই সবচে ভাল হবে। আতিয়া এতক্ষণ কী কী বলেছে কিছুই সা’দের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছোয়নি। শেষের কথাটা শুনেছে শুধু।
“-বুঝতে পেরেছেন? ‘
“-হুম। ‘
তারপর কিছুক্ষণ দু’জনই চুপ করে থাকল। আতিয়া আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সা’দ একটা কথা বলবে বলবে ভেবেও আর বলতে পারছে না। শেষমেশ সাহস করে বলেই ফেলল।
“-একটা কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন না তো? ‘
“-না। মনে করব না। ‘
“-আপনি কি সবাইকে এভাবেই বিশ্বাস করে ফেলেন? ‘
“-হ্যাঁ? ‘
“-না মানে, আপনার বয়ফ্রেন্ড এর নাম কি?’
আতিয়া চট করে ভেবে নিয়ে বলল,
“-শুভ্র। ‘
এই মুহূর্তে এই নামটাই মাথায় এসেছে তার। শুভ্র ছেলেটা আতিয়াকে পছন্দ করত। সেই ক্লাস টেন থেকে।
“-কী করেন উনি?’
“-আপনি কিন্তু বলেছিলেন একটা কথা জিজ্ঞেস করবেন। ‘
হাসলো সা’দ। আতিয়াও নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বলল,
“-ও মেডিক্যালে পড়াশোনা করে।’
শুভ্র ছেলেটা সত্যিই মেডিক্যালে পড়াশোনা করছে। আতিয়া এই লোকটাকে এসব কেন বলছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। আসলে লোকটার সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগছে।
“-আপনাদের পরিচয় কিভাবে হয়? নামে প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল? ‘
“-আমার বান্ধবীর কাজিন হয় ও। বান্ধবীর বাড়িতেই একটা অনুষ্ঠানে দেখা। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে…
“-ওর বাড়ি কোথায়? ‘
“-ঢাকা। ‘
“-ওহ।’
সা’দ আর কিছু জানতে চাইল না। সা’দের সাথে আরও কথা বলতে মন চাচ্ছিল আতিয়ার। কিন্তু নিজে থেকে কী বলবে সে! জিজ্ঞেস করবে ” আপনার গার্লফ্রেন্ড নেই?” উঁহু। না,না। এই কথা জিজ্ঞেস করা শোভা পায় না। ওদের মধ্যে এখনও অতটা পরিচিত হয়নি। আতিয়া আর যাই করুক যেচে পড়ে কারো সাথে কথা বলতে পারে না। এটা তার ইগোতে লাগে।
সকালে আতিয়াকে ঘুমে রেখেই সা’দ চলে গেল। নাহিলের কল এসেছিল। দাদাজান নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই পড়িমরি করে ছুটে যেতে হলো তার। যাবার আগে মেয়েটার সাথে একটা বার কথাও বলতে পারলো না। শুধু একবার ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ।
চলবে….
#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি(৬)
#জেরিন_আক্তার_নিপা
আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য কেউ ডাকলো না। কানের কাছে অ্যালার্মও বেজে উঠলো না। না হামিদ চাচার ঘ্যানঘ্যান। না বাবার চিল্লাচিল্লি। আর না অ্যালার্মের বিরক্তিকর ক্রিংক্রিং শব্দ। আহ! শান্তির একটা ঘুম হয়েছে। ঘুম ভাঙার পর চোখ খুলে শুয়ে থেকে কিছুক্ষণ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কোথায় আছে সে মনে করার চেষ্টা করল। পাশে তাকিয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসলো। চোখ ডলতে ডলতে বলল,
“-ওই ইন্দুর ব্যাটা কই?” হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলো আতিয়া।
“-ওঠে গেছে হয়তো। কয়টা বাজে? কখন সকাল হয়েছে?” দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে চোখ কপালে উঠে গেল।
“-হায় আল্লাহ! সাড়ে দশটা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি! লোকটা একবার ডাকলো না।’ চাঁদর ছুড়ে ফেলে লাফিয়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসেও সা’দকে দেখতে না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। রিসেপশনিস্ট লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো।
“-এক্সকিউজ মি! আমার সাথে যে লোকটা ছিল…মানে ২০৭ নাম্বার রুমের ওই লোকটা কোথায় গেছে বলতে পারেন? ‘
“-সা’দ স্যার? ম্যাম উনি তো চলে গেছেন।’
“-হ্যাঁ? চলে গেছেন? ‘
“-হ্যাঁ ম্যাম।’
“-কখন গেছেন? ‘
“-এইতো ত্রিশ মিনিটের উপরে হবে।’
আতিয়ার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। লোকটা চলে গেছে! তাকে কিছু না বলেই চলে গেল। কাল রাতে তো ভালোই কথা হচ্ছিল। যাবার আগে অন্তত ভদ্রতা করে বাই তো বলে যেতে পারতো। এভাবে ওকে ঘুমে রেখে কেন চলে গেল।
“-যাবার আগে আপনাকে কিছু বলে গেছে? আমার জন্য কোন ম্যাসেজ…’
“-না ম্যাম।’
“-আচ্ছা। ‘
আতিয়া রুমে চলে এলো। লোকটা শুধু বজ্জাত না, অভদ্রও। খাটাশ ব্যাটা। যাবার আগে বাই বলে গেলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো?
“-ধুর! ওই ব্যাটার কথা আমি ভাবছি কেন? ব্যাটা জাহান্নামে যাক। তাতে আমার কি?’
ব্রেকফাস্ট করে আতিয়া হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লো।
আতিয়া সিলেট এসেছে ওর আম্মুর বান্ধবীকে খুঁজতে। নানির বাড়ির থেকে আত্মীয় বলতে তার কেউ নেই। দাদীর বাড়ির আত্মীয়দের কাছে যাওয়া যাবে না। তাহলে ওরা পাপার কাছে ওর খোঁজ বলে দিবে। কোনো ফ্রেন্ডের বাসায়ও ওঠা যাবে না। তাহলে আব্বু ওখানেও চলে যাবে। এখন একমাত্র আশা অনি আন্টি। অনি আন্টি আম্মুর ফ্রেন্ড ছিল। আতিয়া উনাকে ছোটবেলা কয়েকবার দেখেছিল। ওদের বাসায় আসা যাওয়া ছিল খুব। কিন্তু আম্মু মারা যাবার পর, ও লন্ডনে চলে যাবার পর আর দেখা হয়নি। দেশে ফিরেও আর যোগাযোগ রাখেনি। তবে অনি আন্টি আম্মুর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। সেই ভরসাতেই এতদূর এসেছে।
“-অনি আন্টি, তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না প্লিজ।’
কড়া রোদে হাঁটতে হাঁটতে আতিয়া ভাবছে,
“-আগে তো আন্টিকে খুঁজে বের করি। জায়গা দেয়া, না দেয়ার কথা তো পরে ভাবা যাবে। দেখি তো চাচা যে ঠিকানা দিয়েছিল…
আতিয়া দাঁড়িয়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে ঠিকানা লিখা কাগজটা বের করে।
“-হুম। এখন এখানকার কোনো লোককে জিজ্ঞেস করতে হবে। এই এলাকা ভালো করে চিনে এমন কোনো রিকশা ওয়ালা বা সিএনজি ওয়ালাকে পেলেই হবে।’
এই প্রচণ্ড রোদে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। ছোট থেকে কখনও তো গাড়ি ছাড়া বের হয়নি। অভ্যাস নেই।
আতিয়া কপালের উপর হাত রেখে রোদ আড়াল করার চেষ্টা করছে।
“-দেখো পাপা! তোমার জন্য তোমার মেয়েকে কী কী করতে হচ্ছে! না তুমি ওই কাল নাগিনীর কথায় আসতে, আর না ওর ঢেঁড়স ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইতে। তাহলে তো আমি বাড়ি থেকে পালাতাম না। বিয়ে করতে তো আমার অমত ছিল না। ওই লোকটার মত সুন্দর হ্যান্ডসাম একটা ছেলে এনে বলতে। তখন দেখতে আমি রাজি হই কি-না? তুমি কি করলে ঢেঁড়স কুমড়োটার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইলে! আমার? এই সুইট,কিউট, পুতুলের মত আতিয়ার! ছি পাপা, ছি। তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি। ‘
এতক্ষণ পরে আবার সা’দের কথা মনে পড়লো আতিয়ার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।
“-না। ওই সেলফিশ খাটাশটাকেও আমি বিয়ে করতাম না। অসভ্য, বজ্জাত লোক। আমাকে না বলে চলে গেছে। ‘
সা’দ নিজেকে পুরোপুরি ভাবে একটা ফাইলের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছে। নাহিল পাশেই সোফায় বসে আছে। অফিস রুমে কেউ সোফা রাখে না। কিন্তু সা’দকে রাখতে হয়েছে। শুধুমাত্র নাহিলের জন্য। দাদাজান তাকে ভাইয়ের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। সে এখন সকাল সকাল ভাইয়ের গলায় ঝুলে অফিসে তো চলে আসে। কিন্তু নিজের ক্যাবিনে না গিয়ে ভাইয়ের কাছে চলে আসে। নাহিলের কথা।
“-নিজের ক্যাবিনে বসে একা একা বোর হবার কোনো মানে আছে? কাজের কাজ তো আমি কিছুই করি না। সব করো তুমি। তাহলে আমি কেন কষ্ট করে ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ারে বসে থেকে কোমর ব্যথা করবো? আমাকে এখানে একটা সোফা এনে দাও। আমি নাহয় আরাম করে শুয়ে বসে গেমস খেলে সময় পার করব।’
সা’দ করেছেও তাই। যতই হোক ভাইয়ের আবদার সে ফেলতে পারবে না। নাহিল এখন ফোনে বান্ধবীদের সাথে চ্যাট করতে ব্যস্ত। তবুও মাঝে মাঝে চোখ তুলে সা’দকে দেখছে। কিন্তু কিছু বলছে না। এভাবে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। ফোন পাশে রেখে বলল,
“-ভাই! এবার অন্তত কিছু বলো। প্লিজ! ‘
সা’দ ফাইল থেকে চোখ না সরিয়ে বলল,
“-কী বলতে বলছো?’
“-কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলে? আই মিন,আমি জানি তুমি কোথায় ছিলে। কিন্তু কার সাথে ছিলে সেটা বলো।’
সা’দ এবার নাহিলের দিকে তাকাল একবার। এতে নাহিলের মুখের ভাব পাল্টালো না। সে একই রকম উৎসুক ভাবে সা’দের মুখের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে।
“-তুমি কি সবাইকে তোমার নিজের মত মনে করো?’
“-ও ভাই! অন্য কথায় যাবে না। আমি জানি তুমি আমার মত না। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, তুমি কাল রাতে একটা মেয়ের সাথে ছিলে।’
সা’দ কথাটা শুনে তেমন কোনো রিয়্যাক্ট করলো না। তার কপাল সামান্য কুঁচকে গেল শুধু।
“-বলো তুমি কাল রাতে একটা মেয়ের সাথে ছিলে না? বলো।’
“-ছিলাম। তো?’
নাহিল ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের উল্টো পিঠে শব্দ করে বলল,
“-ইয়েস। হইতো আসল কথা বললে।’
নাহিল চোখ ছোট করে সা’দের দিকে ঝুঁকে এগিয়ে এলো। ফিসফিস করে বলল,
“-মেয়েটা কে ছিল? তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। এই কথা আমি কাউকে বলব না। মরে গেলেও কোনো কাক পক্ষি এই খবর পাবে না।’
সা’দ রাগ করতে যেতেও নাহিলের কথা বলার ধরণ দেখে হেসে ফেলল।
“-কে মেয়েটা? নিশ্চয়ই ওই মেয়ের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্য মেয়েদের মধ্যে নেই। তাই তো আমার সন্ন্যাসী ভাইটা ওর প্রেমে পড়ে গেল।’
সা’দ মাছি তাড়ানোর মত হাত উঠিয়ে বলল,
“-দূর! প্রেম ট্রেম কিছু না। মেয়েটা প্রবলেমে পড়েছিল। আমি জাস্ট ওকে হেল্প করেছি। নাথিং এলস।’
নাহিল ভ্রু কুঁচকে নিয়ে বলল,
“-ইম্পসিবল! বললেই হলো।’
“-আরে হ্যাঁরে ভাই। এমনটাই হয়েছে। ‘
“-আই ডোন্ট বিলিভ ইউ। তুমি মিথ্যে বলছো।’
“-আমি মিথ্যে বলছি? ওকে। বিলিভ না করলে নাই। ওটা তোমার ব্যাপার।’
“-আরে ভাই রাগ করছো কেন? কাহিনী পুরোটা খুলে বলো না। প্লিজ ভাই। ‘
সা’দ নাহিলের কাছে কাল রাতের ঘটনা প্রথম থেকে খুলে বলল। নাহিল সবটা শুনে কপাল চুলকে বলল,
“-তুমি এতটা নিরামিষ ক্যান ভাই? আসার আগে মেয়েটাকে বাই বলে আসলে না! বাই না বলতে অন্তত ওর ঘুম ভাঙার জন্য ওয়েট করতে।’
“-তুমিও তো ফোনে বলেছিলে দাদাজানের নাকি শরীর খারাপ করেছে।’
“-আরে আমি কি জানতাম বুড়ো ড্রামা করছে।’
চোখ পাকিয়ে তাকাল সা’দ।
“-বুড়ো না সরি। আমি তো আর সালাম সাহেবের ড্রামা বুঝতে পারিনি। এই বয়সেও দাদাজান…
“-বাদ দাও। মেয়েটার সাথে কথা বলে এলে, ওকে সুন্দর করে বাই বলে এলে কি হতো? আমাদের তো আর কখনও দেখা হবে না।’
“-সেটাও কথা। কিন্তু তুমি ওর নাম্বার নিলে না কেন? ‘
সা’দ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“-বিকজ আমি তোমার মত ছ্যাচড়া না। চলো যাওয়া যাক।’
নাহিল ভাইয়ের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল,
“-ভাই, তুমি চাইলে আমি রফিক সাহেবকে কল করে মেয়েটার অ্যাড্রেস ফোন নাম্বার নিতে পারি।’
“-নো নিডস। তোমার চরকায় তুমি তেল দাও। আমাকে নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না।’
নাহিল বাঁকা হাসলো।
“-তোমাকে নিয়ে মাথা না ঘামালে এই জীবনে আমার ভাবী পাবো না। তাই না চাইতেও তোমাকে নিয়ে আমার মাথা ঘামাতে হবে।’
সা’দ নাহিলের সাথে আর তর্ক করলো না। গাড়িতে উঠে বসলো দু’জন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সা’দ মিউজিক ছেড়ে দিল। নাহিল মিউজিক অফ করে দিলে সা’দ আড়চোখে তাকাল। প্রতিদিন তো নাহিলই গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে মিউজিক ছাড়ার জন্য পাগল করে দেয়। আজ তাহলে কি হলো? নাহিল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“-ভাই!’
“-হুম।’
“-ও ভাই! ‘
সা’দ এবার আর সাড়া দিল না।
“-ও ভাই কথা বলো না। মেয়েটা দেখতে কেমন? ‘
“-খুবই বাজে। বিশ্রী!’
“-তার মানে খুব সুন্দর।’
“-নাম কি ওর?’
কথাটা শুনে হঠাৎ করে সা’দ কষে ব্রেক করলো। দুমিনিট থম মেরে বসে রইলো। সা’দের হঠাৎ এমন কাজে নাহিল ভড়কে গেল।
“-হোয়াট হেপেন্ড ভাই? গাড়ি থামালে কেন? অফিসে কিছু ফেলে এসেছ? দরকারি কোনো মিটিং ছিল?’
আনমনে সা’দ বলল,
“-আমি তো ওর নামটাই জানি না।’
চোখ মুখ খিঁচিয়ে নাহিল কতক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তার জোরে বলে উঠল,
“-হোয়াট! একটা মেয়ের সাথে তুমি রুম শেয়ার করেছ। সারারাত মেয়েটার সাথে ছিলে। ওর বাবা, মা,ভাই, বোন, ভাই-বোনোর ছেলে-মেয়ে,বয়ফ্রেন্ড, দাদার বাবার বাড়ি,দাদার বাড়ি, বাবার বাড়ি কোথায় সব জেনে নিয়েছ। শুধু নামটাই জানলে না! মানে গাধামির একটা লিমিট থাকা দরকার ভাই। তুমি সব, সব লিমিট ক্রস করলে। মেয়েটার নামই জানলে না। ধুর! এটা হলো কিছু! ‘
বিরবির করে সা’দ বলে যাচ্ছে।
“-নামটা জিজ্ঞেস করলাম না!’
সিএনজি থেমে গেলে আতিয়া সামনের দিকে ঝুঁকে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল,
“-থেমে গেলেন কেন ভাই? ‘
“-আপনার ঠিকানায় আইসা পড়ছি আপা।’
“-এটাই সেই ঠিকানা? ‘
“-হুম। কাগজে এই বাড়ির ঠিকানাই লেখা আছে।’
সিএনজি থেকে নেমে পার্স বের করতে করতে আতিয়া বলল,
“-আসলে আমি আগে কখনও আসিনি তো। তাই ভালো করে চিনি না। আপনি চিনিয়ে না আনলে কী যে হত! থ্যাংক্স ভাই।’
“-সমস্যা নাই আপা। আপনে ভেতরে যাইয়া কথা বলে আসেন। আমি এখানে দাঁড়াই। আপনারে বুঝাইয়া দিয়া তবেই যামু।’
আতিয়া মিষ্টি করে হাসলো। এতো ভালো লোকও দুনিয়াতে আছে! জানাই ছিল না আতিয়ার। লোকটা প্রথম পরিচয়েই তাকে কতটা আপন করে নিল! তার জন্য কতটা ভাবছে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আতিয়া গেটের ভেতর ঢুকলো। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল,
“-সাবের কাছে আইছেন?’
“-না। আমি সাহেবের বউয়ের কাছে এসেছি। উনি বাড়িতে আছেন? ‘
“-ম্যাডাম! কিন্তু ম্যাডাম তো এই বাড়িতে থাকে না।’
“-অ্যাঁ! এই বাড়িতে থাকে না! তাহলে কোথায় থাকে? ‘
“-ম্যাডাম তো উনার বাপের বাড়ি থাকে।’
দারোয়ান লোকটা চশমা ঠিক করে, আশেপাশে দেখে নিয়ে গলা নিচু করে বলল,
“-সাব আর ম্যাডামের তো ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে। তিন মাস হইলো ম্যাডাম বাপের বাড়ি গেছে। সাব উনাকে ফিরাইয়া আনার কত চেষ্টাই না করতেছে। কিন্তু ম্যাডাম! শক্ত মহিলা। উনার একটাই কথা। সাবের ঘর করবেন না মানে করবেনই না।’
লোকটার কথা শুনে আতিয়ার মাথা ঘুরিয়ে উঠল। বলে কি এই লোক! হ্যা। ঢাকা থেকে এতদূর আন্টির খুঁজে এসেছে। এখন এখানে এসে শুনছে আন্টি আঙ্কেলের সাথে থাকে না। মানে কি এসবের? আতিয়া এখন কার কাছে থাকবে?
আতিয়া মাথায় হাত দিয়ে নিজে নিজে বলছে,
“-অনি আন্টি,তুমি এটা কী করলে? তোমার ভরসায় আমি সিলেট এসেছি। এখন কোথায় থাকব আমি? কার কাছে যাব? কাকে বিশ্বাস করব? ভালো ফাঁদে ফেললে তো আমাকে। এখন আমার কী হবে? ওহ গড…!’
চলবে…