আমার_একলা_আকাশ #পর্ব_১০

0
612

#আমার_একলা_আকাশ
#পর্ব_১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
আদনানের অচেনা ঐ দৃষ্টিতে আজ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। চোখ নামিয়ে নিল প্রাপ্তি। আদনান যেভাবে হাত ধরেছিল সেভাবেই ছেড়ে দিয়ে মিহিকণ্ঠে বলল,

‘তোকে কথাগুলো অনেকদিন ধরেই বলতে চাচ্ছি।’

‘বলো।’ না তাকিয়েই উত্তর করল প্রাপ্তি।

আদনান ব্যস্তভাবে হাতের ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’এখন নয়। অফিস থেকে এসে বলব।’

প্রাপ্তির মনে উচাটনের ঝড় শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। সে উদ্বিগ্ন এবং সংকোচের সহিত আড়ষ্ট হয়ে ছিল; যার দরুণ তৎক্ষণাৎ জানতে চাওয়ার আগ্রহ আদনানের নিকট প্রকাশ করা হয়ে উঠল না। এর বদলে সে তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলল,

‘ঠিক আছে। সাবধানে যেও।’

আদনান চলে যাওয়ার পর প্রাপ্তি বাড়ির ভেতর ঢোকে। সকাল সকাল প্রাপ্তিকে দেখে তৃধা একটু অবাকই হয়। উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চায়,

‘সব ঠিকঠাক?’

প্রাপ্তি বিছানার এক কোণে বসতে বসতে মাথা নাড়িয়ে বলল,’হুম।’

‘তুই বোস। আমি চা নিয়ে আসি।’

‘অঙ্কিতা আসুক আগে।’

‘কখন আসবে?’

‘এসে পড়বে।’

‘আচ্ছা।’ বলে তৃধা প্রাপ্তির পাশে বসল।

প্রাপ্তির মাথায় তখনও চলছিল, আদনান তাকে কী বলতে চায়, কী বলার আছে এসব চিন্তা-ভাবনা। তাই সে তৎক্ষণাৎ তৃধার সাথে কোনো প্রকার গল্প জুড়ে দিতে পারল না। বরঞ্চ প্রতিদিনের তুলনায় আজ তাকে একটু বেশিই চুপচাপ মনে হচ্ছিল। তৃধা সেটা বুঝতে পেরে বলল,

‘ব্যাপার কী বল তো? এত কী ভাবছিস?’

প্রাপ্তি বুকশেলফ থেকে একটা বই নিয়ে বলল,’কিছু না তো।’

এরপর সে আনমনে বইয়ের পাতা উলটাতে লাগল। লাইনগুলো সে পড়ে গেলেও মস্তিষ্ক বুঝতে পারছিল না যে, সে আসলে কী পড়ছে। কেননা মস্তিষ্ক তো আর একসাথে দুটি কাজ পরিচালনা করতে পারবে না।

‘তুই নিশ্চয়ই এখানে বই পড়তে আসিসনি?’ বলে প্রাপ্তির হাত থেকে বইটি টেনে নিয়ে গেল তৃধা।

প্রাপ্তি ভারী তপ্ত দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আর ভালো লাগে না রে! বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকালে খুব কষ্ট হয়। সবকিছু কি এভাবে এলোমেলো হওয়ার প্রয়োজন ছিল?’

তৃধা এগিয়ে গিয়ে প্রাপ্তির পাশে বসল। কাঁধে হাত রেখে বলল,’এসব নিয়ে ভাবিস না। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আমরা কেউই তো চাইলেও সেসব ঠিক করতে পারব না। বর্তমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে। আবারও তোদের সুন্দর একটা বাড়ি হবে দেখিস।’

প্রাপ্তি কিছু বলল না। শুধু তৃধার হাতটি শক্ত করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বসে রইল।
.
.
কোনোভাবেই অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না আদনান। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। কিন্তু কাজ এখনো কিছুই হয়নি। তার মনের অন্তঃকোণে বারবার যেন প্রাপ্তির মুখ, তার সঙ্গ-ই উঁকিঝুঁকি মারছিল। সে কিছুতেই পারছিল না প্রাপ্তিকে সরিয়ে কাজে মনোনিবেশ করতে। ক্ষুধাও যেন ম’রে গেছে। খাওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। এভাবে আর চলে না। চলতেও দেওয়া যাবে না। তাহলে হয়তো সময়ের সাথে সাথে সেও নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সে তো চায় তার অনুভূতি হোক অনিঃশেষ।

সে কোনোভাবে পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি শেষ করে বাড়িতে ফেরে। একটুখানি রেস্ট নিয়ে গোসল করে ছয়টার দিকে বের হয়। প্রাপ্তির বাড়ির সামনে থেকে প্রাপ্তিকে নিয়ে হাঁটতে থাকে। আজ আদনান সন্ধ্যায় তাকে কী বলবে এই চিন্তাতে প্রাপ্তিও সারাক্ষণ বিভোর ছিল। ঠিকমতো বাচ্চাদের পড়াতেও পারেনি। এই সময়ে তার আরেকটা টিউশনি ছিল। ওদিকে মন পড়ে ছিল আদনানের কাছে। কী করে এখান থেকে ছুটি নেবে ভেবেই পাচ্ছিল না। অবশ্য তার কিছু বলা লাগেনি। বাচ্চার মা নাস্তা দিতে এসে প্রাপ্তির ক্লান্ত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করেছিল,

‘কী হয়েছে প্রাপ্তি? অসুস্থ তুমি?’

প্রাপ্তি আমতা আমতা করে সংকোচের সহিত বলেছে,’শরীরটা ভালো লাগছে না।’

তিনি প্রাপ্তির কপালে, গলায় হাত রেখে বললেন,’শরীর তো বেশ গরম! আজ আসতে গেলে কেন? যাই হোক, নাস্তা খেয়ে বাসায় চলে যাও। রেস্ট করো গিয়ে। আজ আর পড়াতে হবে না।’

তিনি ফিরে যাওয়ার পর প্রাপ্তি নিজের কপালে হাত রাখে। আসলেই তার শরীরের তাপমাত্রা অনেক। নিজে থেকে একটু টেরও পায়নি! নাস্তা বলতে সে শুধু একটু চা-ই পান করেছে। তারপর বাসায় এসে ঝটপট গোসল করে নিয়েছে। তখন ইচ্ছে করছিল একটু ঘুমিয়ে নিতে। ইচ্ছেটাকে দমন করেছে প্রাপ্তি। আজও সে আদনানের প্রতি তার অনুভূতিকে সবকিছুর ঊর্ধে রেখেছে। আদনানের প্রতি জমে থাকা রাগ, অভিমান, ক্লেশসমূহ সকলকিছু আজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে অনুভূতিটুকু।

আদনানের শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তি বলে,’তোমার মুখটা এমন শুকিয়ে গেছে কেন? খাওনি কিছু?’

আদনান লুকাল না কিছু। মাথা নত করে হাঁটতে হাঁটতেই বলল,’না।’

‘সেকি! কেন?’ ঘোলাটে দৃষ্টিতে আদনানের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রাপ্তি।

রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলো ব্যতীত তেমন কোনো আলো নেই। এটুকু আলোতেও আদনানের মনে হলো প্রাপ্তির চোখে-মুখে ভীষণ বেদনার ছাপ। সে ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল,

‘চল কোথাও বসি।’

প্রাপ্তি নিরবে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। দুজনে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। খাবার অর্ডার দিয়েও কেউ কোনো কথা বলল না। প্রাপ্তির ঘোলাটে ক্লান্ত চোখ জোড়ার দিকে দৃকপাত করে আদনান বলল,

‘তুই অসুস্থ?’

‘না, আমি ঠিক আছি।’

আদনান আগ বাড়িয়ে আর কিছু বলতে পারল না। তবে তার মন বারবার বলছিল, প্রাপ্তি ঠিক নেই। ওয়েটার খাবার দিয়ে যাওয়ার পরও দুজনের কেউই তেমন কিছুই খেতে পারেনি। প্রাপ্তির কাছে সব খাবারের স্বাদ তিতকুটে লাগছিল। জ্বরটা রাতে বেশ বাড়বে বোঝা যাচ্ছে। খাবারের বিল মিটিয়ে ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। প্রাপ্তির হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিল অল্পতেই। মুখটুক ঘেমে গেছে। এবার আর মনের কোনো বাধা মানল না আদনান। প্রাপ্তির কপালে হাত রেখে আ’ত’ঙ্কিত হয়ে বলল,

‘তোর যে জ্বর শরীরে!’

প্রাপ্তি হাসার চেষ্টা করে বলল,’তাই নাকি? বুঝতে পারিনি আমি।’

আদনান কয়েক সেকেণ্ড, শুধুমাত্র কয়েক সেকেণ্ড কেমন একটা মনকাড়া দৃষ্টিতে প্রাপ্তির চোখের দিকে তাকাল। এরপর রাস্তা পার হয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জ্বরের ওষুধ নিলো। প্রাপ্তি স্বগতোক্তি করে বলল,

‘শুধু শুধু বাড়াবাড়ি এসব!’

আদনান কোনো প্রত্যুত্তর করল না। পাশের দোকানে গিয়ে প্রাপ্তিকে বেঞ্চে বসিয়ে পানির বোতল কিনল। ওষুধ হাতে দিয়ে বলল,

‘চুপচাপ পানি দিয়ে গিলে ফেল।’

প্রাপ্তি ভ্রুঁ কুঞ্চন করে বলল,’জ্বরের ওষুধ? মাথা ব্যথা জ্বরের চেয়েও বেশি।’

‘এটা মাথা ব্যথার ওষুধ হিসেবেও কাজ করবে। খেয়ে ফেল।’

মুখে পানি নিয়ে ওষুধ গিলে ফেলে প্রাপ্তি। আদনানের হাতে পানির বোতল দিয়ে দেয়।

‘তুই একটু বোস। আমি একটা সিএনজি নিয়ে আসি।’ বলল আদনান।

সে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই প্রাপ্তি হাত ধরে বলে,’সিএনজি কেন? আমরা কোথায় যাব?’

‘বাসায়।’

ঘোর প্রতিবাদের কণ্ঠে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে প্রাপ্তি। ‘নাহ্! বাসায় যাব কেন? তুমি না আমায় কী বলবে বলেছিলে?’

‘বলার জন্য অনেক সময় আছে। আগে তোর সুস্থতা।’

প্রাপ্তি আরেকটু শক্ত করে হাত চেপে ধরে বলল,’এত কনফিডেন্স নিয়ে কী করে বলছ, এখনো অনেক সময় আছে? মানুষের তো নিঃশ্বাসেরই বিশ্বাস নেই। এমন হতে পারে আমি, তুমি এখনই ম’রে গেলাম। তখন?’

আদনান কড়া একটা ধমক দিতে গিয়েও থমকে যায়। মলিন, বিমর্ষ মুখটার দিকে তাকিয়ে তার বুক হুহু করে ওঠে। মন নরম হয়ে যায়। সে পারে না তখন আর কঠিন হতে। প্রাপ্তি বায়না করে বলে,

‘এখন বাসায় যাব না প্লিজ! জ্বরের মেডিসিন তো নিয়েছি। কমে যাবে। তাহলে বাড়িতে ফিরে কী লাভ হবে বলো? এছাড়া এমনভাবে এই দিনটি তো আর ফিরে না-ও আসতে পারে আদনান।’

‘তুই এভাবে কেন কথা বলছিস?’ ভীত শোনাল আদনানের কণ্ঠস্বর।

প্রাপ্তি হেসে ওঠে। ঠোঁট চেপে হেসে বলে,’ভয় পাচ্ছ কেন তুমি? আমি কি ম’রার কথা বললাম নাকি? আমি বলতে চেয়েছি, কাল থেকে তো প্রাইভেট পড়িয়ে আর সময় পাব না এভাবে বের হওয়ার। এছাড়া সবসময় তো তোমারও আর সময় হবে না।’

‘তোর জন্য আমি সময় বের করে নেবো।’

‘আচ্ছা তুমি না হয় নিও। কিন্তু আমার তো এমন সময় সর্বদা হবে না। টিউশনি করিয়ে বাড়িতে ফিরেই আমি ঘুমে কাদা হয়ে যাই।’

‘কী চাইছিস তুই বল তো?’

‘আমি এখন বাড়িতে যেতে চাচ্ছি না।’

আদনান প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,’তাহলে কোথায় যাবি?’

‘উমম! নিরিবিলি কোথাও? লেকের পাড়ে?’

একটুখানি সময় মৌন থেকে আদনান বলল,’ঠিক আছে। চল।’

প্রাপ্তি হাত ছাড়েনি তখনও। সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে দুজনে লেকের পাড়ে যায়। ওদের মতো আরও কতশত মানুষ রয়েছে এখানে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। প্রাপ্তি কিছুটা উল্লাসিত হয়ে বলে,

‘ওয়েদার সুন্দর না?’

‘হুম।’ ছোটো করে বলল আদনান।

রিকশা থেকে নেমে দুজনে চুপচাপ হাঁটছে। ‘ফুচকা খাবি?’ জিজ্ঞেস করে আদনান। প্রাপ্তি দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বারণ করে।

কিছুদূর হেঁটে প্রাপ্তি ক্লান্তস্বরে বলে,’চলো একটু বসি।’

ফাঁকা স্থানে দুজনে পাশাপাশি বসে। সামনেই লেকের পানিতে অর্ধবৃত্ত চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। পানিতে কী রকম একটা কলকল শব্দ হচ্ছে। মৌনতা কাটিয়ে প্রাপ্তি বলে ওঠে,

‘বলবে না?’

অন্যমনস্ক আদনান জানতে চায়,’কী?’

‘কী আবার? কিছু বলতে চেয়েছিলে আমায় তুমি।’

‘জ্বর কমেছে?’

‘কথা ঘুরাচ্ছ কেন?’

‘বলব। এত অস্থির হচ্ছিস কেন?’

প্রাপ্তি দমে যায়। পাছে আবার অতিরিক্ত আশা করে পূণরায় তার মন ভাঙে! কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে আদনান বলে,

‘হূরপরীর কথা মনে আছে?’

বুকে ধ্বক করে শব্দ হলো প্রাপ্তির। একটা সময়ে সে মনে করতো সে-ই বোধ হয় আদনানের হূরপরী। কিন্তু যখন তার বিয়ে ঠিক হলো এবং ভাবলেশহীন আদনানকে সে নতুন করে পর্যবেক্ষণ করতে শিখল, তখনই সে বুঝে গেছিল সে আসলে কতটা ভুল ছিল! সে নয় বরং অন্য কোনো ভাগ্যবতী মেয়ে আদনানের হূরপরী। এতদিন বাদে অতীত মনে পড়ে এবং পূণরায় যখন সে বুঝতে পারল আদতেও আদনানের হূরপরী সে নয়, তখন তার বক্ষপিঞ্জরে পুরনো দগদগে ঘা পূণরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল। তার মনে হতে লাগল, তখন বাড়িতে ফিরে যাওয়াটাই বোধ হয় ভালো ছিল। বারবার সে নিজেই নিজের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেলেও বাহির থেকে নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,

‘হুম। কেমন আছে সে?’

আদনান বিষাদিতস্বরে বলল,’আমি আসলে জানিনা সে কেমন আছে!’

‘জানো না মানে? কথা হয় না?’

‘কথা হয়। দেখাও হয়। আজকাল আমি তাকে বুঝতে পারি না। কেবলই সে একটু একটু করে যেন দূরে সরে যাচ্ছে। আবার কখনো মনে হয়, সে আসলে কাছেই আছে। কিন্তু শক্ত খোলস দ্বারা নিজেকে সে আবৃত করে রাখে।’

প্রাপ্তি কথাগুলো ভেতর থেকে অনুধাবন করতে পারছে না। তার হৃদয়ের গহীনে তখন পুরনো ক্ষত বুদবুদ শব্দ করছিল। তাই সে চুপ করে রইল। আদনান বলল,

‘আমি কী করব বলতে পারিস?’

প্রশ্ন এবার প্রাপ্তির দিকে আসা সত্ত্বেও সে কিছুই বলতে পারল না। যখন দেখল আদনান তার প্রত্যুত্তের প্রতিক্ষায় নিজেও কিছু বলছে না তখন সে কিছু বলবার চেষ্টা করে মুখ খুলল,

‘এই ব্যাপারে তুমি সরাসরি তার সাথে কথা বলো। কেন এমন করছে, কেন সে নিজেকে তোমার থেকে দূরে সরাচ্ছে এসব প্রশ্ন তাকে করো। সে-ই ভালো এবং সত্য উত্তর তোমাকে দিতে পারবে।’

ঝড়ের গতিতে আদনান প্রাপ্তির দিকে ঘুরে বসল। প্রাপ্তির দু’হাত ধরে বলল,

‘তাহলে আমায় এবার বল, কেন তুই নিজেকে এভাবে দূরে সরিয়ে নিচ্ছিস? কেন প্রাচীরঘেরা করে রাখছিস নিজেকে?’

বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইল প্রাপ্তি। আদনান তাকে এসব প্রশ্ন করছে? কেন? তাহলে কি অতীতে করা প্রাপ্তির ধারণাই সত্য ছিল? অন্য কোনো নারী নয়, বরং প্রাপ্তিই তার রূপকথার হূরপরী? যদি তা-ই হয়, তাহলে তখন কেন জানায়নি? কেন প্রাপ্তির বিয়ের সময়ও সে নিশ্চুপ ছিল? একটা চাপা অভিমান যেন একটু একটু করে প্রাপ্তিকে আবারও পেঁচিয়ে ধরছিল। সে থমথমে অভিমানি কণ্ঠে সুধাল,

‘এসব আমায় কেন জিজ্ঞেস করছ?’

‘তুই বুঝতে পারছিস না?’

প্রাপ্তি ক্ষীণস্বরে বলল,’না।’

‘কারণ তুই-ই আমার হূর প্রাপ্তি!’

স্পষ্ট ও প্রকাশ্য বাক্য কর্ণকুহর অব্দি প্রবেশ করা মাত্র চমকে আদনানের দিকে তাকায় প্রাপ্তি। কেন যেন চোখ দুটো ছলছল করছে। এখানেও কি চোখদুটো বেঈমানী করবে? আদনান মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

‘হ্যাঁ, প্রাপ্তি! তুই।’

মনের ভেতর অভিমান তরতর করে বাড়তে থাকে। পুরনো ঘা যেন এখন আরো বেশি দগদগে হয়ে উঠেছে। সে শ্লেষেরসুরে বলে,

‘তাই বুঝি? তাহলে সেদিন তুমি কোথায় ছিলে, যেদিন আমার বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক হয়েছিল। সেদিন কেন তুমি চুপ করে ছিলে?’

‘প্রাপ্তি আমাকে না বলা তোর কথাগুলো, আমার প্রতি তোর অনুভূতি সবটাই আমি বুঝতাম। আমার ওপর অভিমানে, রাগে তুই যখন রায়হানের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলি আমি সহ্য করতে পারিনি। আবার মুখ ফুটে তোকে এসব বলতেও পারিনি। নিরবে সরে এসেছিলাম এটা ভেবে যে, তুই হয়তো রায়হানকে সত্যিই ভালোবাসিস। এই ধারণা যখন মিথ্যা প্রমাণিত হলো তখন ঠিক কতটা খুশি হয়েছিলাম তোকে বলে বোঝানোর ভাষা আমার নেই। ওরকম একটা ঝামেলা মেটার সাথে সাথে নিজের অনুভূতি জানানোও সম্ভব ছিল না। তোকে একটু সময় দিচ্ছিলাম। এর মাঝেই শুনি আঙ্কেল, আন্টি তোর বিয়ে ঠিক করেছে। তারা এমনভাবে নিজেদের খুশি প্রকাশ করেছিল যে, আমার নিজের অনুভূতির কথা বলার সাহস আর হয়নি। তাই নানানভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতাম। তোর সামনে নিজের ব্যস্ততাকে আরো বেশি করে তুলে ধরতাম। মূলত তোর বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই তোর প্রতি আমার অনুভূতির পারদ আরো বেশি বেড়েছে। আর এরপর তো! এতসব হয়ে যাওয়ার পর আমার অনুভূতি তোর সামনে কী করে ব্যক্ত করব আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি প্রেম, রিলেশন এসবে বিশ্বাসী নই। আমি তোকে সারাজীবনের জন্য হালালভাবে চাই। আমি পরিবারকে জানিয়ে তোকে বিয়ে করতে চাই।
প্রাপ্তি, আমি তোকে ভালোবাসি।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here