আমার_একলা_আকাশ #পর্ব_৫

0
541

#আমার_একলা_আকাশ
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
সুমনা বেগম চা-নাস্তা এনে সামনে রেখে নিজেও অপজিট সোফায় বসলেন। তার ঠিক পেছনে ক্রুব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদনান।

‘নিন, নাস্তা করুন।’ সবার উদ্দেশ্যেই বললেন সুমনা বেগম।

রায়হানের বাবা বললেন,’নাস্তা তো করবই। এরপর থেকে তো সম্পর্ক আরো গভীর হবে আমাদের দুই পরিবারের।’

‘ঠিক বুঝলাম না ভাই।’ বললেন সুমনা বেগম।

রায়হানের মা এবার হেসে বললেন,’বুঝেননি বোন? আপনার মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নিতে এসেছি।’

সুমনা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। স্বল্প সময়ের জন্য কথা বলার ভাষাও যেন তার লোপ পেয়েছিল। তিনি কিছু বলার পূর্বেই রায়হানের মা বললেন,

‘তাছাড়া ছেলে-মেয়ে দুজনই যখন দুজনকে পছন্দ করে আর ভালোবাসে তখন শুভ কাজে দেরি করে লাভ কী বলেন?’

এই পর্যায়ে আদনান আর কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারল না। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। কাঠকাঠ গলায় সে উত্তর দেয়,

‘আপনার একটু ভুল হচ্ছে আন্টি।সম্পর্ক ছিল। এখন আর নেই।’

রায়হানের বাবা-মায়ের দুজনেরই হাসি হাসি মুখটা অন্ধকার হয়ে আসে।

‘এই ছেলে কে?’ গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন রায়হানের বাবা।

সুমনা বেগম পড়েছেন মাঝ সমুদ্রে। মনে হচ্ছে সবটাই কী রকম মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। রায়হানের সাথে প্রাপ্তির সম্পর্ক আছে, অথচ তিনি জানেন না! এমনকি টেরও পায়নি। এদিকে আদনানের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ও সবটা জানত। জানুক, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। ঘরে মেয়ে থাকলে বিয়ের প্রস্তাব আসবেই; মেয়ের কোনো সম্পর্ক থাকলেও আসবে, না থাকলেও আসবে। তবে মাঝখানে আদনানের হুট করে বলা কথাটি সুমনা বেগমের মনঃপুত হলো না ঠিক। না জানি, সামনের মানুষগুলো কী না কী ভেবে বসে আছে।

সুমনা বেগম একটু হাসার চেষ্টা করলেন। সহজ-স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,’আমার ভাগিনা।’

রায়হান তখন আদনানের কথার উত্তর দিতে গিয়ে একটু হেসেই বলল,’জি, একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে আমাদের মধ্যে। সব সম্পর্কেই তো ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়া হয়। তাই বলে কি সম্পর্ক শেষ? প্রাপ্তি আমার ওপর অনেক রেগে আছে জানি। তাই আমি চাচ্ছি রিলেশনের ইতি ঘটুক বিয়ের মাধ্যমে।’

হুট করে এমন সিচুয়েশনে পড়ায় সুমনা বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। রায়হানের সাথে প্রাপ্তির সম্পর্ক ছিল এটা যদি একবার ওর বাবার কানে যায় তাহলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে যাবে। মানুষটা এমনিতে ভীষণ ভালো। একমাত্র সন্তান এবং একমাত্র মেয়ে হওয়ায় প্রাপ্তিকে তিনি মাথায় তুলে রাখেন। প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই ভালোবাসেন। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি মেয়েকে দিয়েছেন। তার মানে তো এই নয় যে, প্রাপ্তির রিলেশন তিনি মেনে নেবেন। তিনি সর্বদাই প্রেম-ভালোবাসার বিরুদ্ধে। কস্মিনকালেও সে প্রেমকে পছন্দ করেন না। সমর্থন করেন না। সেখানে প্রাপ্তি এমন একটা কাজ কী করে করল!

‘আপনি কিছু বলছেন না কেন আন্টি? প্রাপ্তিকে আমায় দেবেন না?’ সুমনা বেগমের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়হান।

আদনান ক্ষিপ্রকণ্ঠে বলে উঠল,’কখনোই না। প্রাপ্তি তোমার মতো চরিত্রহীন কোনো ছেলেকে বিয়ে করবে না।’

এরপর সে রায়হানের বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,’আঙ্কেল, আন্টি মাফ করবেন। চা, নাস্তা খেয়ে অন্যান্য কথা থাকলে বলতে পারেন। নতুবা আসতে পারেন আপনারা। অপরাধ নেবেন না দয়া করে।’

রায়হানের মা রাগান্বিত স্বরে বলেন,’তুমি কে আমার ছেলের চরিত্র নিয়ে কথা বলার?’

‘আমি কেউ না। তবে যেটা সত্যি সেটাই বলেছি।’

সুমনা বেগম আদনানকে ধমক দিয়ে বললেন,’আহ্! আদনান, তুই কী শুরু করেছিস এসব?’

‘আন্টি তুমি জানো না এই ছেলের উদ্দেশ্য কত্ত খারাপ! আমি বলতে পারছি না তোমায়।’

‘বলতে পারছ না বললে তো হবে না। বলতেই হবে। আমার ছেলেকে ব্লেইম দেওয়ার সাহস হয় কী করে।’ বললেন রায়হানের বাবা।

রায়হান বিষয়টাকে ধামাচাপা বা আটকানোর চেষ্টা করেও পারল না। ওর বাবা-মা দুজনেই ক্ষেপে গেছেন। বাবা চেঁচিয়ে চেঁচিয়েই বললেন,

‘এখানে যেচে অপমানিত হতে আসিনি আমরা। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের বংশ, টাকা-পয়সা কীসের কমতি আছে? কিচ্ছুর নেই। আমার ছেলে দেখতে, শুনতে মাশ-আল্লাহ্। শিক্ষিত। এমন ছেলের জন্য, এমন পরিবারের ছেলের জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে বলে ধারণা? বরঞ্চ আপনাদের মেয়ের চেয়েও বেটার বেটার মেয়ে রয়েছে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে শুধুমাত্র ছেলের পছন্দ বলে এই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। সেখানে আপনার ভাগিনা, না কে সে আমাদের এভাবে অপমান করছে!’

আদনান বেশ শান্ত হয়েই বলল,’সত্যি কথা সবসময় একটু তেতোই হয় আঙ্কেল। তাছাড়া আমি যথেষ্ট ভদ্রভাবে, সুন্দর করে কথা বলেছি। তবুও আপনি যখন এতগুলো কথা বললেন। বংশের, টাকার, ছেলের এত গুনগান গাইলেন তখন সত্যিটা না হয় আমি বলেই দেই। আপনার সব কথাই ঠিক মেনে নিলাম। আপনার ছেলে সুন্দর, শিক্ষিত এগুলোও ঠিক আছে। সমস্যাটা হচ্ছে গিয়ে আপনার ছেলের চরিত্রে। টাকা না থাকলেও ডাল-ভাত খেয়ে সুখে থাকা যায়। কিন্তু চরিত্র খারাপ হলে ইহকাল, পরকাল দুটোই জাহান্নাম হয়ে যায়। আপনার ছেলের চরিত্র এতই ভালো যে, যাকে সে ভালোবাসি বলে দাবি করছে, যাকে সে বিয়ে করবে বলে এই বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে…সেই তাকেই আপনার ছেলে তার জন্মদিন উপলক্ষে একদিনের জন্য চেয়েছে। যেমন-তেমনভাবে চায়নি। ফিজিক্যালি ইন্টিমেট হতে চেয়েছে। এটাকে আপনি ভালোবাসা বলবেন? একটা মেয়ে একটা ছেলেকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসলে কী চায় জানেন? সম্মান আর শ্রদ্ধা। কিন্তু আফসোস! প্রাপ্তি এমন এক ছেলেকে ভালোবাসলো যে সম্মান তো দেবে দূরের কথা; উলটো বিয়ের আগেই ইন্টিমেট হতে চেয়েছে।
আপনাদের সামনে আমার মুখে এসব কথা হয়তো শুনতে বড্ড তিতকুটে লাগছে। কিন্তু আ’ম স্যরি টু সে, আপনাদের এবং প্রাপ্তির পরিবারের জানা উচিত কেমন ছেলে এসেছে প্রাপ্তিকে বিয়ে করতে।’

কথাগুলো শুনে রায়হানের বাবা-মা দুজনেই বিস্মিত হয়ে রায়হানের দিকে তাকায়। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রেখেছে রায়হান। সুমনা বেগম স্তব্ধ। বাসার কলিংবেলের শব্দ সকলেই একটু নড়েচড়ে বসে। আদনান গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সেতু এসেছে। আদনানের রাগান্বিত চোখ-মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে? রেগে আছো কেন?’

আদনান কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে আসে। সেতুও পিছু পিছু আসে। আর এসে উপস্থিত রায়হান ও ওর বাবা-মাকে দেখে বেশ অবাকই হয়। অস্ফুটস্বরে রায়হানের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,

‘তুই এই বাড়িতে!’

‘রায়হান আর প্রাপ্তির যে সম্পর্ক ছিল এটা জানতিস তুই?’ প্রশ্নটি করে থমথমে দৃষ্টিতে সেতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুমনা বেগম।

সেতু থতমত খেয়ে একবার সুমনার দিকে, আরেকবার আদনানের দিকে তাকায়। রায়হানের বাবা-মা উঠে পড়ে তখন। কোনো কিছু না বলেই দুজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রায়হানও বিনাবাক্যে উঠে পড়ে। আদনান ওর সঙ্গে যায়। বাড়ির বাইরে গিয়ে হাত টেনে ধরে মুখোমুখি দাঁড়ায়। শার্টের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলে,

‘মানুষের খারাপ হওয়ারও একটা লিমিট থাকে। কিন্তু তুমি লিমিটলেস! উদ্দেশ্য সফল হয়নি বলে ডিরেক্ট বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছ? কারণ তুমি তো ভালো করেই জানো, ঐ ঘটনার পর প্রাপ্তি আর কখনোই তোমার কাছে ফিরে যাবে না। ওর দেওয়া জবাবগুলোও নিশ্চয়ই তোমার ইগোতে লেগেছে? আর তাই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য হোক কিংবা রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য হোক; গুটি হিসেবে বিয়ে নামক সম্পর্কটাকে বেছে নিয়েছ। আমি কি ঠিক বলছি?’

আদনানের হাত সরিয়ে দিয়ে রায়হান বলল,’সবকিছুতে তুমি কেন বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছ বলো তো? ভালোবাসো তুমি প্রাপ্তিকে?’

আদনান বাঁকা হাসে। বলে,’তুমি এবং তোমার উদ্দেশ্য সৎ হলে কখনোই আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াতাম না। কোনো অসৎ দৃষ্টি আমি প্রাপ্তির ওপর পড়তে দেবো না। আর হ্যাঁ, ভুলেও আর কোনো নতুন বুদ্ধি আঁটতে যেও না প্রাপ্তিকে পাওয়ার জন্য। তাহলে কিন্তু ফল সত্যিই ভালো হবে না। সেদিন প্রাপ্তি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিল আর আজ আমি দিচ্ছি। আমি আবার অতটাও ভালো মানুষ নই। নেহাৎ-ই বাড়ি বয়ে এসেছ, সঙ্গে আবার তোমার বাবা-মা’ও আছে। মূলত প্রাপ্তির কোনো বদনাম না হোক এজন্যই আজ সুস্থভাবে যেতে দিচ্ছি। পরের বার একই ভুল করলে নিজ দায়িত্বে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আসব।’

‘কাজটা ভালো করলে না। তোমার ধারণাও নেই আমি প্রাপ্তির সাথে ঠিক কী কী করতে পারি।’

‘এক্সাক্টলি! তাই তো আমিও বলি, প্রাপ্তির সাথে খারাপ কিছু করার পূর্বে নিজের বোনের কথাটাও মাথায় রেখো কেমন। আগেই বলেছি, আমি মানুষটা খুব একটা ভালো নই। এখন আসতে পারো।’ বলে আদনান ভেতরে গিয়ে দরজাটা শব্দ করে লাগিয়ে দেয়।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে সেতু সুমনা বেগমের পায়ের কাছে বসে কান্নাকাটি করছে। সুমনা বেগমের চোখেও পানি। আদনান কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,

‘কান্নাকাটি কোরো না আন্টি। ভালোবাসা কখন কার প্রতি হয়ে যায় কেউ কি এটা বলতে পারে?’

‘তাই বলে তোরা সব জেনেও এভাবে লুকালি আমার থেকে? ও না হয় ভয়ে বলেনি। কিন্তু তোরা কেন আমাকে জানাসনি? আজ যদি প্রাপ্তি এই সম্পর্কে অনেক বেশি সিরিয়াস থাকত তাহলে কী হতো? তাহলে তো সেদিন ঠিকই রায়হানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেত।’

‘হয়নি তো! আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে না? আল্লাহ্ ওর সাথে ছিল। মানুষ ভুল করে। প্রাপ্তিও ভুল মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল করে ফেলেছে। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আর প্লিজ, ও বাড়িতে আসার পর ওর সাথে কোনো রকম রাগারাগি কোরো না।’
.
.
দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ধরেছে প্রাপ্তির। আজ রোদের এত বেশি উত্তাপ যে, মনে হচ্ছে মাথা ফেটেই যাবে। তৃধা আর অঙ্কিতা প্রাপ্তিকে নিয়ে গাছের ছায়ায় বসে। টং দোকান থেকে তিনজনে তিন কাপ চা পান করে। প্রাপ্তির কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগবে। কিন্তু এখনো বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনেকটা পথ বাকি। অঙ্কিতা প্রাপ্তির কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘খুব বেশি খারাপ লাগছে দোস্ত?’

প্রাপ্তি দু’হাতে মাথা ধরে বসে আছে। তৃধা গিয়ে এক বোতল ঠান্ডা পানি কিনে আনে। প্রাপ্তির মাথাটা নিচু করে মাথায় পানি ঠেলে দেয়। ওড়না দিয়ে চুলগুলো দুজনে মুছেও দেয়।

‘এখন কি একটু ভালো লাগছে দোস্ত?’ জিজ্ঞেস করল তৃধা।

প্রাপ্তির একটুও ভালো লাগছে না। ক্রমশ শরীর যেন দুর্বল হয়ে আসছে। গায়ের তাপমাত্রাও বাড়ছে। মনে হচ্ছে শরীর থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। জ্বর আসবে কিনা কে জানে! কিন্তু প্রাপ্তি আর তৃধার এত আন্তরিকতা দেখে সত্যিটা বলতে খারাপ লাগল প্রাপ্তির। তাই সে মিথ্যে করেই বলল,

‘হ্যাঁ, একটু ভালো লাগছে এখন।’

অঙ্কিতা জানতে চাইল,’আদনান ভাইয়াকে একটা ফোন করব?’

প্রাপ্তি বলল,’আরে না! একটা রিকশা ঠিক কর। একাই যেতে পারব।’

‘কত যে একা যেতে পারবি তা তো বুঝতেই পারছি। দাঁড়া রিকশা নিয়ে আসি। আমরাই তোকে দিয়ে আসছি।’ বলল তৃধা।

অঙ্কিতা আর তৃধাই প্রাপ্তিকে বাড়িতে দিয়ে যায়। সুমনা বেগম প্রচণ্ড রেগে ছিলেন। কিন্তু প্রাপ্তির বেহাল অবস্থা দেখে রাগ উধাও হয়ে যায়। উলটো আরো বেশি অস্থির হয়ে যান তিনি। প্রাপ্তিকে ধরে রুমে নিয়ে যায়। মাথা ব্যথার ওষুধ খাইয়ে মাথায় পানি দিয়ে দেয়। সঙ্গে বারবার করে বলছেন,

‘রাতে ঠিকমতো ঘুমাবি না। ফেসবুক চালাবি, মুভি দেখবি তোর মাথা-ব্যথা হবে না তো কার মাথা-ব্যথা হবে? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করিস না। আর দুইদিন পরপর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তোকে নিয়ে আমি পড়েছি যন্ত্রণায়।’

অঙ্কিতা করুণস্বরে বলল,’থাক আন্টি আর বকা দিয়েন না।’

‘বকা দিয়েই আর কী হবে মা? আমার কোনো কথা কি ও শোনে? যাই হোক, তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খেতে দিচ্ছি।’

‘না, না আন্টি। আমরা বাড়িতে গিয়েই খাব।’

‘এখান থেকে খেয়ে আবার বাড়িতে গিয়ে খেও। সমস্যা নেই। ফ্রেশ হও দ্রুত।’

এরপর তিনি সেতুকে প্রাপ্তির কাছে বসিয়ে কিচেনে যায় খাবার সাজাতে। অঙ্কিতা আর তৃধাকে না খেয়ে যে যেতে দিবে না এটা একদম পরিষ্কার। তাই ওরা-ও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সেতু একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। সকালের ঘটনাটি এখনই প্রাপ্তিকে বলবে নাকি পরে বলবে! অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল, পরেই বলবে। সে প্রাপ্তির মাথায় সুন্দর করে হাত বু্লিয়ে দিচ্ছে।
________
সাঁঝের বেলায় জানালার ধারে বসে উপন্যাসের একটা বই ঘাটছিল আদনান। তার ধৈর্য বরাবরই কম। সম্পূর্ণ বই পড়ার ধৈর্য নেই বলে এই লাইন, সেই লাইন, একটা বাদ দিয়ে অন্যটা এভাবে পড়ে। কখনো কখনো বইয়ের সম্পূর্ণ সারমর্ম বুঝতে পারে তো, কখনো আবার কিছুই বোঝে না। এসব নিয়ে অবশ্য তার কোনো মাথা ব্যথাও নেই। তার যা স্বভাব, সে তো তা-ই করবে।

রুমানা বেগম রুমে আসেন তখন। চাপাস্বরে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,’প্রাপ্তিদের বাড়িতে কী করেছিস আজ?’

আদনান ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,’কই? কিছু না তো!’

‘তোর বাবা তাহলে এত রেগে আছে কেন তোর ওপর?’

‘আমি কী জানি?’

‘ডাকছে তোকে। শুনে আয়।’

বই রেখে আদনান রুমানা বেগমের সঙ্গে রুম থেকে বের হয়। আসাদ রহমান চা পান করছিলেন তখন। আদনানকে দেখেই খিটখিটে মেজাজে বললেন,

‘এসেছ। বসো, বসো।’

আদনান একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বাবার মুখোমুখি বসল। চায়ের কাপ রেখে আসাদ রহমান ছেলের উদ্দেশ্যে কর্কশকণ্ঠে বলেন,

‘তোমার সমস্যা কী আদনান? তুমি সেতুর বিয়ে উপলক্ষে এসেছ আমি কিছু বলিনি। কিন্তু এসে উলটা-পালটা ঝামেলায় নিজেকে কেন জড়াচ্ছ?’

আদনান কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল,’আমি কী করেছি আব্বু?’

‘কী করেছ জানো না? প্রাপ্তির জন্য নাকি বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল আজ। তুমি সেখানে অযথা কেন তর্ক করতে গিয়েছ?’

‘আব্বু সেখানে আমার কথা বলাটা জরুরী ছিল।’

‘কোনো জরুরী কিছু ছিল না। ওদের মেয়ে ওরা বুঝবে। তোমার এত মাথা-ব্যথা কীসের? মা-ছেলের জান বের হয়ে যায় ঐ পরিবারের জন্য।’

আদনান কিংবা রুমানা বেগম কেউই কিছু বললেন না। আসাদ রহমানও ক্ষণকাল নিশ্চুপ থেকে বললেন,’তুমি চট্টগ্রাম যাচ্ছ কবে?’

‘আগামীকাল।’

‘খুব ভালো। দয়া করে নিজের ভালো বুঝতে শেখো। অন্যের ঝামেলা নিজের কাঁধে এনো না।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

‘তুমি এসব জানলে কী করে?’

আসাদ রহমান বাইয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। আদনানের প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন। পিছু ফিরে তাকিয়ে বলেন,

‘মনে করো বাতাসেই সব কথা আমার কানে আসে। তোমাকে যা বলেছি, সেসব মাথায় রেখো।’

তিনি চলে যাওয়ার পর রুমানা বেগম আদনানকে চেপে ধরে সবকিছু জানতে চায়। মায়ের কাছে সবটা ক্লিয়ার করে আদনান। প্রাপ্তি যে রিলেশন করত এটা বিশ্বাস করতে রুমানা বেগমেরও একটু কষ্ট হয়েছে বটে! যদিও বড়ো কোনো অন্যায় সে করেনি! আসলে প্রাপ্তির থেকে কেউই এটা আশা করেনি।

আদনানও বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ঐ বাড়ির খবর নেওয়া হয়নি। দুপুরের দিক দিয়ে বাড়িতে এসে ঘুমিয়েছিল। একটু আগে উঠেছে। যাওয়ার পথে জবা ফুলের গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই গাছটা প্রাপ্তি লাগিয়েছিল। দুইটা জবা ফু্ল গাছের চারা সে কিনে এনেছিল।একটা নিজেদের বাড়ির সামনে লাগিয়েছে, আর একটা আদনানদের বাড়ির সামনে লাগিয়ে দিয়েছিল। তবে সমস্যা বেঁধেছিল অন্য জায়গায়। প্রাপ্তির গাছে থোকায়, থোকায় সাদা জবা ফুল ফুটলেও, এতদিনেও আদনানদের গাছে কোনো ফুল ফোটেনি। এটা নিয়েও আদনান প্রাপ্তিকে কত কথা শুনিয়েছে! প্রায়ই সে বলত,

‘তুই একটা হিংসুটে প্রাপ্তি। হিংসা করে একটা ব্যাটা জবা ফুল গাছ আমাদের বাড়ির সামনে লাগিয়ে দিয়েছিস। আর নিজেদের বাড়ির সামনে মহিলা জবা ফুল গাছ লাগিয়েছিস। যাতে তোর গাছের ফুল দেখে জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাই তাই না?’

প্রথম প্রথম প্রাপ্তি কথাগুলোর প্রতিবাদ করলেও একসময়ে আর কিছুই বলত না। কেননা সে খুব ভালো করেই জানত, যত-ই সে বলুক যে কোন গাছে ফুল হবে আর কোন গাছে ফুল হবে না এটা তো সে জানত না; এসব আদনান কোনোকালেই বিশ্বাস করবে না।

আজ গাছটি দেখে অতীতের কথাগুলো মনে পড়ে যায় আদনানের। আনমনেই সে হেসে ফেলে। হাসির কারণ হচ্ছে এতদিন সে অযথাই প্রাপ্তিকে বকত। কেননা এতদিন বাদে তাদের গাছটিতে একটা টকটকে রক্তজবা ফুল ফুটেছে। পাতার আড়ালে থাকায় এতদিন চোখেই পড়েনি। আজ হঠাৎ করে দৃষ্টিটা একদম গাছের আড়ালে থাকা ফুলটার দিকেই পড়েছে। সে ফুলটা ছিড়ে খুব সন্তর্পণে শার্টের বুকপকেটে রাখল যাতে ফুলটি ছিঁড়ে না যায়।

ঐ বাড়িতে যাওয়ার পর দরজা খুলে দেয় সুমনা বেগম। আদনান ভেতরে যেতে জিজ্ঞেস করে,’প্রাপ্তি কোথায়?’

‘ওর রুমে।’

‘কালকে চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছি আন্টি তাই দেখা করতে আসলাম।’

‘কাল যাবি, আর দেখা করে যাচ্ছিস আজ? কাল কি আসতে বারণ নাকি?’

‘তা নয়। অত সকালে তো তোমাদের ঘুম না-ও ভাঙতে পারে তাই আরকি!’

সুমনা বেগম মৃদু হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’চা খাবি?’

‘হুম! খাওয়া যায়।’

তিনি রান্নাঘরে যাওয়ার সময় আদনান পেছন থেকে বলে,’তুমি প্রাপ্তিকে বকোনি তো?’

সুমনা বেগম পিছু ফিরে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকান। আদনান হাসার চেষ্টা করে বলল,’এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি যদি না বকে থাকো, তাহলে তোমার হয়ে আমি বকে দেবো।’

হেসে ফেলেন তিনি,’বকিনি। তবে একটু অভিমান করে আছি।’

‘তাই নাকি? অভিমান করা ভালো। এতে ভালোবাসা বাড়ে।’

তিনি আর কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। আদনান প্রাপ্তির রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করে। প্রাপ্তি ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে,’কে?’

‘আমি।’

‘দরজা খোলা আছে।’

আদনান রুমে গিয়ে দেখে প্রাপ্তি আধশোয়া হয়ে ফোন চাপছে। চেয়ার টেনে বসে আদনান বলল,’সারাক্ষণ এত শুয়ে থাকিস কেন?’

‘এমনিই। ভালো লাগছে না।’

‘ভালো না লাগলে ঘুমাবি। ফোনে এত কী?’

প্রাপ্তি এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে জানতে চাইল বাড়িতে আজ কী হয়েছে। আদনান একটু ঢং করেই বলল,’যা হওয়ার আরকি! তোর সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড তোকে বিয়ে করার জন্য ওর বাবা-মাকে নিয়ে এসেছিল। তোকে কে বলল? আন্টি?’

‘না। সেতু আপু। আম্মু তো আমার সাথে কথাই বলতেছে না।’

‘ঠিকই আছে। আরো কর জেদ করে রিলেশন।’

প্রাপ্তির মুখটা মলিন হয়ে যায়। আদনান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,’তুই আবার গলে-টলে যাসনি তো?’

‘মানে?’

‘মানে এইযে তুই সেদিন রায়হানকে এমন জবাব দিলি, সব জায়গা থেকে ব্লকও করলি; তারপরও মাত্র একদিনের ব্যবধানে সকাল হতে না হতেই রায়হান ওর বাবা-মাকে নিয়ে তোর বাসায় উপস্থিত হয়েছে। তোকে বিয়ে করবে। এসব শুনে তুই ইম্প্রেস হোসনি? মনে হচ্ছে না, ইশ! রায়হান তোকে কত ভালোবাসে! মন গলে যায়নি?’

‘পাগল নাকি তুমি? এতকিছুর পরও তোমার মনে হয় আমি গলে যাব? অসম্ভব! ওর প্রতি ঘৃণাটাও আমার ঠিকমতো আসে না। কোনো অনুভূতিই কাজ করে না।’

‘গুড। এখন থেকে সাবধানে থাকবি। একা একা কোথাও বের হওয়ার দরকার নেই।’

‘কেন? ওর ভয়ে?’

‘কারও ভয়েই না। নিজের সেইফ্টির জন্য। আন্টির সাথে মান-অভিমান মিটিয়ে নিস। জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলবি, স্যরি মা। খুব ভালোবাসি তোমায়। দেখবি মোমের মতো কেমন গলে যায়।’

আদনানের কথা বলার ভঙ্গি দেখে প্রাপ্তি হেসে ফেলে। আদনান কপাল কুঁচকে বলে,’এত হাহা হিহি করে হাসছিস কেন? তুই কি ভেবেছিস তোর হাসি খুব সুন্দর? একটুও না। তোর চেয়ে তো আমার হূরপরীর হাসি বেশি সুন্দর।’

প্রাপ্তি দু’হাত জড়ো করে সামনে রেখে বলে,’মাফ করো! জিন্দেগিতে আর তোমার সামনে হাসব না। তবুও তোমার হূরের গুণগান বন্ধ করো।’

‘তুই তো খুব হিংসুটে।’

‘হ্যাঁ, আমি হিংসুটে। আমি আরো অনেক কিছু। তবুও তোমার হূরের গল্প শুনতে চাই না।’

‘আচ্ছা চোখটা বন্ধ কর।’

‘কোন দুঃখে?’

‘করবি নাকি হূরের গল্প শুনাব?’

‘করছি, করছি!’

আদনান মুচকি হেসে বুকপকেট থেকে ফুলটা বের করে প্রাপ্তির কানের পিঠে গুঁজে দেয়। ফোনের ক্যামেরা অন করে একটু দূরত্বে রেখে প্রাপ্তির মুখ বরাবর সামনে ধরে বলে,’এবার তাকা।’

প্রাপ্তি চোখ মেলে তাকায়। ক্যামেরায় দেখতে পায় তার এলোমেলো চুলের পাশে কানে গুঁজে থাকা টকটকে লাল ফুলটি। সে একটু কেমন যেন মায়াভরা দৃষ্টিতে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান হেসে বলে,

‘তুই আমার রক্তজবা।’

চলবে…

বিঃদ্রঃ-. আদনানের মায়ের নাম আগে ছিল রেহেনা বেগম। এই নামটি পরিবর্তন করে রুমানা বেগম দিয়েছি। এর কারণ হচ্ছে আগের নামটি আর আমার এক পাঠিকা আপুর মায়ের নাম এক। তার মা মৃত। তো গল্পটা পড়তে গেলে তার মায়ের কথা মনে পড়ায় তার খারাপ লাগে। এজন্যই নামটি পরিবর্তন করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here