#আমার_একলা_আকাশ
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
প্রাপ্তি গোসল সেরে শুয়ে পড়েছে। তার একদম মনেই নেই যে, আদনান এসেছে। ড্রয়িংরুমে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও প্রাপ্তির দেখা না মেলায় সুমনা বেগম এবার নিজেই মেয়েকে ডাকতে আসেন। আর এসে দেখতে পান, এর মধ্যেই প্রাপ্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। ভেজা চুল থেকে পানি পড়ে বালিশ, বিছানা ভিজে যাচ্ছে। মেয়েকে ডাকতে গিয়েও তিনি থেমে যান। ক্লান্ত, মলিন মুখটা দেখে আর ডাকতে ইচ্ছে হলো না। তিনি আলগোছে প্রাপ্তির মাথাটা নিজের কোলের ওপর নিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দিচ্ছিলেন। সুমনা বেগমেরও সাড়া না পেয়ে আদনান এবার নিজেই আসে প্রাপ্তির রুমে।
সুমনা বেগম দরজার দিকে তাকিয়ে আদনানকে ইশারায় বললেন,’ঘুমিয়ে পড়েছে।’
আদনান স্মিত হেসে তার মতো করেই ইশারায় বলল এবং ঠোঁট নাড়াল,’সমস্যা নেই।’
এরপর ধীরপায়ে এসে প্রাপ্তির পাশে খাটের ওপর বসল। রুমের দেয়ালে পেইন্টিং করা। এগুলো প্রাপ্তিই করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার আগের রুমটার মতো সাজানোর আপ্রাণ চেষ্টা সে করেছে। তবুও যেন একটু ফাঁকফোকর রয়েই গেছে। এই বাড়ির দেয়ালের কোথাও কোথাও রং উঠে গেছে। দেয়ালের গায়েও কালসিটে দাগ রয়েছে। এই খুঁতগুলোই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এটা প্রাপ্তির আগের রুম নয়। হতেই পারে না।
সুমনা বেগম প্রাপ্তির মাথাটা আবার বালিশে রেখে আদনানকে নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করেন,’কী দেখছিস?’
আদনান উত্তরে কিছু-ই বলতে পারল না। শুধু ভেতর থেকে দীর্ঘকায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সুমনা বেগম তবুও উত্তরের প্রতিক্ষায় আদনানের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
এক প্রকার দায় সারতে-ই আদনান বাধ্য হয়ে দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,’কিছু না।’
প্রাপ্তির রুম থেকে বের হওয়ার পর আদনান নিজের রুমে চলে এসেছে। সুমনা বেগম অনেকবার করে রাতের খাবার খেয়ে আসতে বলেছিলেন। আদনান শোনেনি। প্রাপ্তিকে দেখার আগ পর্যন্ত সেও ঠিক করেছিল, রাতের খাবার খেয়েই আসবে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। বুকের কোথায় যেন একটা চাপা আর্তনাদ বারবার জেগে ওঠে। অস্বস্তি, অস্থিরতায় দম আটকে আসে। কেন এমন হয় আদনান জানে না। আবার হয়তো জানে, কিন্তু কাউকে সেটা জানতে দিতে চায় না।
বাড়িতে ফিরে রুমানা বেগমের সাথে দেখা হয়ে যায় আদনানের। ছেলের চিন্তিত মলিন মুখ দেখে তিনি জানতে চান,
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’ বলে আদনান নিজের রুমে চলে যায়। তার কারো সাথে এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে। প্রাপ্তিকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে।
.
.
পরেরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আদনান প্রাপ্তির বাসায় আসে। সারা রাত তার ভালো করে ঘুম হয়নি। যার দরুণ চোখ দুটো জ্বলছে এখন। আজকে তার অফিসের প্রথম দিন। তাই যেতেই হবে। যাওয়ার পথে কী মনে করে যেন এই বাসায় চলে এসেছে। আসার পর থেকে তার নিজের কাছেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। অথচ আগের বাড়িতে থাকতে হুটহাট কারণ ছাড়া-ই চলে যেত। তখন তো কোনো রকম অস্বস্তি লাগত না। তবে আজ কেন?
যাক, সেসব প্রশ্নের উত্তর মেলার আগে-ই দরজা খুলে দিলেন ফিরোজ ইসলাম। আদনানকে দেখে আপ্লুত হয়ে বলেন,
‘আরে তুই! ভেতরে আয়।’
আদনান আগে ভেতরে ঢুকল। বাড়ির সবাই তখন নাস্তা করতে বসেছে। পেছন থেকে ফিরোজ ইসলাম বললেন,
‘কাল নাকি এসেছিলি তুই। আমার সাথে দেখা না করে চলে গেলি কেন?’
আদনান সোফায় বসতে চাইছিল। ফিরোজ ইসলাম ঠেলে চোখের ইশারায় ডাইনিং চেয়ারে বসতে বললেন। আদনানও তাই করল। একটা চেয়ার টেনে প্রাপ্তির পাশে বসল সে। গ্লাস থেকে পানি পান করে ফিরোজ ইসলামের উদ্দেশ্যে বলল,
‘হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গেছিল।’
‘ওহ। এখানে-ই চাকরী নিয়েছিস শুনলাম।’
‘হ্যাঁ, অফিসে-ই যাচ্ছি এখন।’
‘বেশ। নে নাস্তা কর।’
‘না, না। সকালে মা জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।’
‘এখন অল্প একটু খেলে কিছু হবে না।’ বলে আদনানকে প্লেটে দুটো পরোটা, অর্ধেক ডিম ভাজি আর আলু ভাজি তুলে দিলেন সুমনা বেগম।
বাধ্য হয়ে আদনানকে খাওয়া শুরু করতে হয়। খেতে খেতে-ই আদনান ফিরোজ ইসলাম আর সুমনা বেগমের সাথে টুকটাক কথা বলে। প্রাপ্তি পুরোটা সময় নিরব ভূমিকা-ই পালন করে। খাওয়া শেষ করে প্রাপ্তি সবার আগে। সে ঘরে গিয়ে তার ব্যাগ এনে বাবা-মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বের হওয়ার মুহূর্তে আদনান পেছন থেকে বলে,
‘দাঁড়া প্রাপ্তি। আমার অফিস তোর ভার্সিটির ওখানে-ই। দুজনে একসাথে যাই।’
প্রাপ্তি বাবার দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়ে-ই দাঁড়াল। আদনান হাত ধুয়ে তার ব্যাগ নিয়ে উঠে আসে। যাওয়ার পূর্বে দুজনের থেকে বিদায়ও নিয়ে নেয়। বাড়ির বাইরে গিয়ে আদনান রিকশা নিতে চাইলে প্রাপ্তি বলে,
‘আমি রিকশায় যাব না। তোমার যদি দেরি হয়ে যায়, তাহলে তুমি রিকশায় করে চলে যাও।’
আদনান একটু থমকায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,’কোনো সমস্যা?’
‘কোনো সমস্যা নেই। হাঁটতে ভালো লাগে।’
আদনান হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’ঠিক আছে। আমারও সমস্যা নেই।’
দুজনে পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটছিল। এক সময়ে প্রাপ্তি নিজে থেকে-ই বলে,’কাল চলে গেছিলে কেন?’
‘তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলি তাই।’
‘আর একটু বসলেই পারতে। রাতে তো খাওয়ার সময় উঠেছিলাম।’
‘তাতে কী! এখন তো দেখা হলো।’
‘হুম।’
আবারও কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। গাড়ির, রিকশার হর্ণ আর পথচারী কিছু ব্যক্তির কথার শব্দ ব্যতীত ওদের কোনো আলাপ নেই। আদনান কিছুটা সময় নিয়ে বলে,
‘তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস প্রাপ্তি?’
‘কী জন্য রেগে থাকব?’
‘তোদের ওমন একটা খারাপ সময়ে আমি পাশে এসে থাকতে পারিনি।’
প্রাপ্তি শব্দ করে হেসে ওঠে। আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,’তুমি ঐ সময়ে এসে-ই বা কী করতে? ঐ সময়টাতে আমাদের মেন্টালি সাপোর্ট নয় ফিনানসিয়াল হেল্প দরকার ছিল। আর তোমার দিক থেকে যতটা সম্ভব ততটা হেল্প করেও ছিলে। তাহলে রাগ করার কথা আসছে কোত্থেকে?’
‘তুই টাকাগুলো মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে এসেছিস!’
‘হ্যাঁ। তোমার টাকা একেবারে কেন নেব? এখন আর কারো কাছে-ই আমরা ঋণী নই। আমরা এখন মুক্ত, স্বাধীন। যতটুকু অর্থ ও স্বার্থ আছে ততটুকুর মধ্যেই নিজেদের চাহিদা মেটাই।’
‘তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস প্রাপ্তি।’
প্রাপ্তি রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,’হয়তো!’
মাঝরাস্তায় এসে প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে যায়। আদনান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘দাঁড়ালি কেন?’
‘আমার একটা কাজ আছে। তুমি অফিসে চলে যাও।’
‘এত সকালে তোর আবার কী কাজ?’
‘আছে একটা কাজ।’
‘প্রাইভেট পড়াতে যাবি?’
‘না। তোমায় কে বলল আমি প্রাইভেট পড়াই? মা?’
‘হুম। প্রাইভেট না থাকলে কোথায় যাবি সেটা বল?’
‘লাইব্রেরিতে। কিছু বই কিনতে হবে।’
‘এখন-ই?’
‘পরে আমার সময় নেই।’
‘কী কী বই আনতে হবে আমায় লিস্ট করে দিস আমি এনে দেবো।’
‘কেন?’
‘আবার কেন কী? আমি বলেছি তাই।’
প্রাপ্তি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’ঠিক আছে।’
‘এখন রিকশা নিই? তোকে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাব।’
‘আমার তো এখন ক্লাস নেই। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস এখনো শুরু হয়নি।’
‘তাহলে তুই এত সকালে বের হয়েছিস কেন?’
‘তৃধার বাসায় যাব। ওখানে কিছুক্ষণ থেকে প্রাইভেট পড়াতে যাব।’
আদনান কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,’ঠিক আছে।’
এরপর সে হাত নাড়িয়ে একটা রিকশা থামায়। ইশারায় প্রাপ্তিকে রিকশায় উঠতে বলে। পাশে নিজেও বসে। রিকশা চলতে শুরু করলে প্রাপ্তি বলে,
‘তুমি কি এখন তৃধার বাসায় যাবে?’
‘হু, তোকে নামিয়ে দিয়ে আসব।’
‘এত কষ্ট করার কিন্তু দরকার ছিল না।’
‘তোর কাছে এটা কষ্ট মনে হচ্ছে?’
‘তা নয়তো কী?’
‘আমার তো মনে হচ্ছে না। তোর সঙ্গ ভালো লাগছে তাই যাচ্ছি।’
‘কী ব্যাপার বলো তো? মা তোমার ব্রেইন ওয়াশ করেছে নাকি? নিশ্চয়-ই কেঁদে-কেটে তোমার মন গলিয়েছে?’
‘মানে?’
‘খুব সহজ। একই তো ফ্যামিলি ক্রাইসিস, তার ওপর আমার বিয়েটাও ভেঙে গেল। সব মিলিয়ে তো ভালো একটা প্রেশার যাচ্ছে আমার ওপর। এজন্য আমি হয়তো ডিপ্রেশনে আছি। এমনটা মা ভাবে আরকি! তাই হয়তো, তোমায় বলেছে আমায় একটু সময় দিতে। স্বাভাবিক করতে।’
আদনান রাগীস্বরে মৃদু ধমক দিয়ে বলে,’বাজে কথা বলবি না একদম। তোকে নতুন করে আমি কী স্বাভাবিক করব? তুই আগের চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচিউর হয়ে গেছিস। আর আন্টি মোটেও আমাকে এসব কিছু বলেনি। অযথা উল্টা-পাল্টা চিন্তা করবি না আর আমারও মেজাজ খারাপ করবি না।’
‘আরে! রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘তুই কথা-ই বলেছিস রাগ করার মতো।’
‘আচ্ছা স্যরি। তোমার হূরপরীর একটা গল্প বলো শুনি। অনেকদিন হয়েছে শোনা হয় না।’
‘মুড নেই এখন।’
‘নাকি হূরপরী নেই?’
‘হূর থাকবে না কেন? ও আমার-ই থাকবে।’
‘ওহ আচ্ছা।’ স্মিত হাসল প্রাপ্তি।
কয়েক সেকেণ্ড পর আদনান ডাকল,’প্রাপ্তি?’
‘হু?’
‘রায়হানের সাথে তোর আর কথা হয়?’
‘না। পুলিশে কমপ্লেইন করার পর আর বিরক্ত করেনি।’
‘আর শান্ত ভাইয়া?’
‘তার সাথেও কন্টাক্ট নেই। আর কন্টাক্ট রাখার কোনো কারণও দেখি না।’
‘সে কাজটা কি ঠিক করেছে?’
‘বেঠিকের তো কিছু দেখি না। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জায়গা থেকে সঠিক থাকতে চাই।’
‘একটা সত্যি কথা বলবি?’
‘কী?’
‘তুই কি মন থেকে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলি?’
প্রাপ্তি হেসে বলল,’এসব কথা এখন কেন জিজ্ঞেস করছ বলো তো? যখন এই কথাগুলো শোনার প্রতিক্ষায় ছিলাম, তখন তো একবার ভুল করেও জিজ্ঞেস করোনি। জানতে চাওনি, আসলেই আমি এই বিয়েতে খুশি ছিলাম কিনা।’
‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর ছিল না।’
‘মেয়াদবিহীন প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। এছাড়া মন থেকে রাজি ছিলাম বা মুখ থেকে; বিয়েটা তো আর হয়নি।’
আদনান চুপ হয়ে যায়। প্রাপ্তির সাথে কথা বলতে গেলে এখন প্রতিটা কথায় সে হোঁচট খায়। তার মনে হয়, প্রাপ্তির কথাগুলোতে একটা গোপন আক্রোশ, রাগ, অভিমান মিশে আছে। যেটা প্রাপ্তি সরাসরি কখনো-ই প্রকাশ করে না। আর হয়তো কখনো করবেও না।
তৃধার বাড়ির গলির সামনে রিকশা আসতেই প্রাপ্তি রিকশাওয়ালাকে থামতে বলে। আদনান নেমে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দেয়। দুজনে গলি দিয়ে দু’মিনিট হাঁটার পর তৃধার বাসায় চলে আসে। প্রাপ্তি জানতে চায়,
‘ভেতরে যাবে?’
‘না। দেরি হয়ে যাবে তাহলে। তুই ভেতরে যা।’
‘ঠিক আছে। সাবধানে যেও তুমি। অফিসে পৌঁছে একটা ফোন দিও।’ বলে প্রাপ্তি বাড়ির ভেতর ঢুকতে প্রস্তুত হয়।
আদনান তখন কোনো কিছু না ভেবে-ই প্রাপ্তির হাত ধরে বলে,’দাঁড়া প্রাপ্তি। তোকে কিছু কথা বলার আছে আমার।’
চলবে…