#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে-০৬,০৭
#৬ষ্ঠ_পর্ব
অন্নার কথায় হতবিহ্বল হয়ে গেলো অর্জুন। কিছু সময় লাগলো মেয়েটির কথাগুলো মস্তিষ্কে ধারণ করতে। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“তুই আবার আমার জিনিসে হাত দিয়েছিস?”
অর্জুনের প্রশ্নকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে অন্না সাবলীল কন্ঠে বললো,
“হ্যা দিয়েছি, কি করবে? তার আগে আমাকে এটা বলো কে ওই মায়াবিনী যার জন্য তোমার মনে এতো আবেগ?”
অন্নার প্রশ্নে বেশ চমকালেও ভড়কালো না অর্জুন। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিনিট দুয়েক। মেয়েটার শ্যামমুখখানা কেমন লালচে লাগছে, চোখজোড়ায় এক অদ্ভুত অস্থিরতা। সে উত্তরের প্রতীক্ষায় রয়েছে অধীর আগ্রহে। অর্জুন এবার ঠোঁট বাকিয়ে দুর্বোধ্য হাসি হাসলো। যার অর্থ অন্না বুঝলো না। সে তার হাসি অক্ষত রেখে বললো,
“তোকে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে বুঝি? কে তুই? আমার উপর কিসের এতো অধিকার?”
প্রশ্নটা শুনেই হকচকিয়ে উঠলো অন্না। ভুল তো কিছু বলে নি অর্জুন, কে সে! সামান্য ভাড়াটিয়া, যার সাথে কথা বলতেও অনিচ্ছুক অর্জুন। আর ছাত্রী, সেই ট্যাগটা থাকা বা না থাকা একই কথা। অর্জুনের কাছে অন্না কেবল ই একটি অসহনীয় যন্ত্রণা যার থেকে পালাতে পারলে তার রক্ষা। একটা ধি’ঙ্গি, চঞ্চল, মহাবিরক্তিকর, অভ’দ্র, অকালকুষ্মাণ্ড এই উক্তিগুলোই সে ব্যাবহার করে অন্নার ক্ষেত্রে। সেখানে তাকে প্রশ্ন করাটা নেহাৎ বোকামি বই কিছু নয়। অন্না বুঝলো সে সীমা লঙ্ঘন করছে। তাই মলিন কন্ঠে বললো,
“ছাড়ো, ভালো লাগছে না। বাড়ি যাবো”
“কি হলো উত্তরটা দে! ফটফট অন্নার কথা ফুরিয়ে গেছে?”
“যে প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই সেই প্রশ্ন নিয়ে আমি সময় নষ্ট করি না”
কথাখানা বলেই দোকানের অন্যদিক চলে গেলো অন্না। তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, যে রাগ পরিমাপ করা যায় না। আচ্ছা, রাগ পরিমাপক যন্ত্র থাকলে ভালো হতো। তাহলে সূক্ষ্ণ পরিমাপ করে বলা যেতো কতটুকু রাগ হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটা অন্য স্থানে, এটা বড় কথা নয় যে অন্নার রাগ হচ্ছে বরং মুল প্রশ্নটি হলো রাগটি হচ্ছে কার উপর! নিজের উপর নাকি অর্জুনের উপর। যার উপর ই হোক, এখন সে নিয়ে ভাবতেই চায় না অন্না। বুকের ভেতরের সূক্ষ্ণ ব্যাথাটা একটু একটু করে ছড়াচ্ছে, অসহনীয় চিনচিনে ব্যাথা____
মধ্যাহ্নের শেষ লগ্ন, পুজোর সকল কেনাকাটার কাজ শেষ করেছে অন্না এবং অর্জুন। পেটে যেতো ইঁদুরেরা রীতিমতো দৌড় প্রতিযোগিতা করছে তাদের। কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলো সকালের পর থেকে এই নির্বাক পেটে একটি দানাও।দেওয়া হয় নি। অর্জুন তাই ব্যাগগুলো অন্নার হাত থেকে নিতে নিতে বললো,
“কি খাবি?”
“খাবো কেন? বাড়ি যাবো না? বাড়ি যেয়েই খাবো।”
অন্নার কন্ঠে অভিমানের সূক্ষ্ণ প্রলেপ৷ অর্জুন চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অন্নার দিকে। তার শ্যামমুখে ক্ষুধার ছাপ স্পষ্ট। তবুও তার মুখে এক বুলি “বাড়ি যাবো”। অর্জুন হুট করে তার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
“কখন থেকে এই বাড়ি যাবার গান কানের কাছে গেয়ে যাচ্চিস! আর একবার শুনেছি তো দেখবি কি করি! খেতে বলেছি মানে খেতে যাবি। নাকি আমার সাথে খেতে গেলে তোর মান সম্মান যাবে?”
অর্জুনের কথায় ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করলো অন্না। একটু ভালো করে কথা বললে যেনো তার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। অন্না যে তার চক্ষুশূল ব্যাপারখানা প্রতিটি পদে পদে যেনো প্রকাশ করতেই হবে। বললেই হয় “আমার ক্ষুধা লেগেছে, খেতে যাবো”। নাহ! বাঁকা বাঁকা কথা বলে মেজাজ খারাপ করাবে। অন্না চোখ মুখ খিঁচে ফেললো, তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“ভালোভাবে কথা বলতে কি তোমার কষ্ট হয় অর্জুনদা? কাকীমা বুঝি জন্মের সময় তোমাকে মধু খাওয়াই নি, তাই তো এতো তেতো তুমি”
“আহা রে আমার মিষ্টভাষী! তোকে তো কাকীমা মধুতে স্নান করিয়েছিলো! মুখে আঙ্গুল দে, মাথাটা একেবারে ধরিয়ে দিলো কথা বলতে বলতে। আর একটা কথা না। মুখে আঙ্গুল দিয়ে হাটবি এখন”
অন্না হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারলো না, বেশি কথা কি সে বলছে নাকি এই খ’চ্চ’র লোকটি তাকে দিয়ে বলাচ্ছে! অন্না ঠিক করলো সে আর কথা বলবে না। মুখে এবার সত্যি ই তালা লাগাবে। লোকটির ত্যাড়া কথা গা জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট, প্রতিটি লোমকোষে বিরক্তি ঝরে, তবুও সে অর্জুনদার কথার উত্তর দিবে না। অন্নার মুখখানা দেখার মতো লাগছে, সে রাগে ঈষৎ কাঁপছে, মুখখানা রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু মুখে কথা নেই, শুধু চোখ দিয়ে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অর্জুনকে পু’ড়ি’য়ে দেবার বৃথা চেষ্টা চলছে। অন্নার এমন মুখখানা বেশ প্রশান্তি দিলো অর্জুনকে। এক পৈশাচিক আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। দৈত্যের মতো হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। তাহলে তার তেজী মুখখানা মিলিয়ে যাবে। তখন আর মেয়েটি তাকে দাম দিবে না। অর্জুন ব্যাগগুলো নিয়ে হাটা শুরু করলো। অন্না কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অন্নাকে পাশে না পেয়ে অর্জুন পেছনে তাকিয়ে বললো,
“ম্যাডামকে কি মাথায় নিয়ে হাটতে হবে?”
অন্না গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বিনাবাক্যেই পিছু নিলো অর্জুনদার।
একটা মোটামোটি খাবারের দোকানে খাবার খেলো অর্জুন এবং অন্না। খাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার পালা। বড় রাস্তা পার হয়ে রিক্সায় উঠতে হবে। অর্জুন যথারীতি রাস্তা পার হয়ে গেলো। কিন্তু পাশে তাকাতেই দেখলো অন্না নেই। অন্নাকে না দেখেই মূহুর্তেই বুকটা অস্থির হয়ে উঠলো। উগ্রীব চোখজোড়া দেরি না করেই খুঁজতে লাগলো তাকে৷ তখন ই দেখতে পেলো ব্যাস্ত রাস্তার ওপারে অন্না বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এক পা এগোচ্ছে, আবার পিছিয়ে আগের স্থানে চলে যাচ্ছে। মেয়েটির কাছ মিনিট দুয়েক পর্যবেক্ষণ করলো অর্জুন। মেয়েটি এই দুই মিনিটে প্রায় বার দশেক একই কাজ করছে। অর্জুন না পেরে ছুটে গেলো অন্নার কাছে। অন্নার কাছে যেয়ে অবাক কন্ঠে শুধালো,
“বে’কু’বের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? একবার এগোচ্ছিস, আবার জায়গায় যাচ্ছিস। সমস্যা কি?”
“আমি রাস্তা পার হতে পারি না”
অন্নার অসহায় স্বীকারোক্তিতে ঠিক কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারলো না অর্জুন। অন্না অসহায় মুখখানা দেখে বকতে ইচ্ছে হলো না। ফলে তার কোমল হাতখানা গলিয়ে নিলো নিজের হাতের ফাঁকে। বিনা বাক্যে হাত ধরেই রাস্তা পার করলো অর্জুন। রুক্ষ্ণ, উষ্ণ হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো অন্না। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণের স্রোত। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভূত হলো। ঢেউ খেলে গেলো কিশোরী অন্নার নিষ্পাপ হৃদয়ে। গোল গোল চোখে দেখছে সে অর্জুনদার দিকে। লোকটি তার সামনে হাটছে। বৃহৎ কায়া তাকে ঢেকে রেখেছে সূর্যের তেজহীন রশ্নি থেকে। অন্নার অবুঝ মনটা হুট করেই যেনো বুনতে লাগলো নিষিদ্ধ কিছু অভিলাষ। সেই অভিলাষের বীজ এখনো ভেজা মাটিতে রোপিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। অজান্তেই রংধনুর সাত রঙ্গে রঙ্গিন হলো মনের একলা আকাশ। রাগ, অভিমানগুলো গলতে লাগলো, বৃষ্টিরুপে বর্ষিত হলো মনমন্দিরের ভেজা মাটিতে। রাস্তা পার হয়ে যখন রিক্সায় উঠলো তারা তখন ও অন্নার হাত অর্জুনের হাতের ফাঁকে। অন্না ধীর কন্ঠে বললো,
“হাত ছাড়বে না?”
সাথে সাথেই হাতটা ছেড়ে দিলো অর্জুন। বেশ বিব্রতবোধ ও করলো সে। কিন্তু প্রকাশ করলো না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। অন্নাও বাহিরের দিকে দৃষ্টি দিলো। তার ঠোঁটে এখনো স্নিগ্ধ হাসি লেপ্টে রয়েছে। ঠিক তখন ই অর্জুন বললো,
“আমি কবিতাটা হেমনলিনীকে লিখেছি”
হঠাৎ এমন কথায় অন্না বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
“কোন হেমনলিনী?”
“আমার শ্বশুরের স্ত্রীর ভাইয়ের পিসতোতো বোনের বোনঝি”
অর্জুন দায়ের কথায় আরোও একবার ধাক্কা খেলো অন্না। অর্জুন তার বিমূঢ় মুখখানা দেখে বললো,
“আ’হা’ম্ম’ক, উপন্যাসের নায়িকা হেমনলিনী”
কথাখানা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লো অন্না। মুখ বাকিয়ে বললো,
“আমার মাথায় কি সত্যি আ’হা’ম্ম’ক লেখা? মশকরা করছো? তুমি উপন্যাসের নায়িকার জন্য কবিতা লিখেছো এটা বিশ্বাস করতে হবে?”
“কেনো? উপন্যাসের নায়িকার জন্য কবিতা লেখা কি অন্যায়?”
“কাল্পনিক চরিত্র সে, তার জন্য কেউ কবিতা লেখে?”
“কবি যদি কাল্পনিক চরিত্রের জন্য উপন্যাস লিখতে পারে, আমি কবিতা লিখতে পারবো না কেনো? আমিও চাই আমার জীবনে হেমনলিনীর মতো কেউ আসুক, যে আমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারে, যে আমাকে আমার থেকেও ভালো বুঝবে। যে শত বাধা অতিক্রম করেও আমার জন্য অপেক্ষা করবে! আমি চাই আমার জীবনে সে আসুক। আমার হেমনলিনী, আমার একলা আকাশের সেই ধ্রুবতারা যাকে আমি পুজি, আমি ভালোবাসি। আমার মনের একলা আকাশ জুড়ে শুধু তার ই বিস্তার, তাই তাকে নিয়ে হাজারো কবিতা লিখিতে পারি আমি”
অর্জুনের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয়েছে অন্না। এই মুগ্ধতার মাঝে চাপা বেদনাও রয়েছে। বেদনাটির নাম হয়তো আক্ষেপ। আক্ষেপ কেনো সে হেমনলিনী হয়_________
******
দেখতে দেখতে সপ্তমী চলে এসেছে। হিমুলেনের পুজো এবার ধুমধাম করেই পালিত হচ্ছে। পাড়ার সনাতন যুবসমাজ ধুতি পাঞ্জাবীতে নিজেদের সাজিয়েছে। তবে সকলের চোখ শুধু অর্জুনের দিকে। সাদা পাঞ্জাবীতে ছেলেটিকে রাজপুত্রের ন্যায় লাগছে। মাঝে রবিন ভাই, সামির ভাই এসেছিলেন। রবিন ভাই ইশারা করে বললো,
“কি ভায়া কেমন চলছে?”
“তুমি আমায় শান্তি দিবে না, তাই না রবিন ভাই?”
“শান্তি তোমার তানি আপু কেড়ে নিয়েছে। এখন আছে শুধু বেদনা”
বলেই হো হো করে হাসলো রবিন ভাই। তখন ই হাজির হলো অন্না। মেয়েটি আজ শাড়ি পড়েছে, সবুজ রঙ্গের সুতি শাড়ি। কোকড়ানো চুল গুলো বেধেছে খোপা। চোখে কালো কাজল। দূর থেকে মনে হলো যেনো রবীঠাকুরের চারুলতা হেটে আসছে। পাড়ার সকল যুবকের মুখে কথা নেই। গাছে উঠা, ছুটে বেড়ানো অন্নাকে শাড়িতে দেখে যেনো তারা অবাক। এ কি একই অন্না! নাহ, মেয়েটি সত্যি সুন্দর। শুধু শুধু অর্জুন তার দেবদাস নয়। রবিন ভাই অর্জুনের পেটে গুতো দিয়ে বললো,
“আসলেই তোমার পছন্দ আছে বলতে হয়”
অন্না প্রসাদ নিয়ে বের হতেই দিপ্তী এবং লাবণ্য ধরে বসলো। মীরজাফরের অর্ধেক দলের বেশ আগ্রহ অন্নার প্রতি। অন্না বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,
” কি চাই?”
“তুই তো বললি না কিছু। ওই যে সেদিন অর্জুনদার সাথে সেদিন ঘুরতে গেলি কি হলো?”
“বলেছিলাম তো!”
“ধুর, পুরোটা বলিস নি তো!”
এবার বিরক্তি যেন বাড়লো অন্নার। চোখ মুখ কুচকে বললো,
“কি শুনতে চাস? যে অর্জুনদা আমার হাত ধরে হেটেছে?”
অন্নার কথাটা শেষ হবার পূর্বেই অর্জুনের মোটা পুরুষালী কন্ঠে কানে এলো,
“এই অন্না, শুনে যা”
পেছনে ফিরতেই দেখলো শক্ত মুখে অর্জুনদা দাঁড়িয়ে আছে। তবে কি সব শুনে ফেললো সে!……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#৭ম_পর্ব
অন্নার কথাটা শেষ হবার পূর্বেই অর্জুনের মোটা পুরুষালী কন্ঠে কানে এলো,
“এই অন্না, শুনে যা”
পেছনে ফিরতেই দেখলো শক্ত মুখে অর্জুনদা দাঁড়িয়ে আছে। তবে কি সব শুনে ফেললো সে! ভয়ে বুকখানা কেঁপে উঠলো অন্নার। মুখখানা মিয়ে গেলো। নিভু কন্ঠে বললো,
“কেনো?”
“আসতে বললাম তো নাকি?”
অর্জুনের কন্ঠের প্রখরতা বাড়লো। মুখে কিঞ্চিত বিরক্তির ছাপ, কপালে তিনখানা ভাঁজ পড়েছে। ভ্রুযুগল একবিন্দুতে টেনে রেখেছে। অন্না শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজালো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। ভয় হচ্ছে, অর্জুনদা যদি শুনে তাকে আ’স্তো রাখবে না। দেখা যাবে দেবীর ত্রি’শুল খুলেই তাকে দৌ’ড়ানি দিবে। এই মীরজাফরের দল আজ অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও ফাঁসিয়েই ছাড়লো অন্নাকে। দীপ্তি এবং লাবন্য তাদের গোয়েন্দা দৃষ্টি তাক করে রেখেছে অন্নার দিকে। অর্জুনদা অন্নাকে ঠিক কি বলার জন্য জরুরি তলব দিলো তা জানাটাই যেনো এখন পৃথিবীর একমাত্র কাজ। এই বিষয়টা জানতে না পারলে তাদের পৃথিবীটাই যেনো ফেটে যাবে, আকাশ ভেঙ্গে পড়বে।
অন্না ধীর পায়ে অর্জুনের সামনে গেলো। ঈষৎ ভয়ার্ত কন্ঠে শুধালো,
“ডাকছিলে কেনো?”
“হাতটা সামনে আন”
অর্জুনদার সাবলীল কথায় হকচকিয়ে উঠলো অন্না। অর্জুনদা কি সকলের সামনে তার মাস্টার হবার সুযোগ নিবে? অন্না অর্জুনের দিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতেই দেখলো তার এক হাত পেছনে রাখা। সেই হাতে কি বেত রয়েছে! অর্জুনদা কি সকলের সম্মুখে অন্নাকে মা’র’বে? অবশ্য তার বিশ্বাস নেই, সে বলেছিলো পাড়ায় যদি আর কোনো কানাগোসা হয় তবে অন্নার একদিন কি তার যে ক’দিন লাগে। অন্না ইতস্তত চোখে পেছনে তাকালো। দীপ্তি এবং লাবন্যের চোখ তার দিকেই স্থির। অন্না ঠোঁট কামড়ালো, মস্তিষ্কটা কাজ করছে না। অর্জুন এবার অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“কি দেখছিস পেছনে?”
“সকলের সামনে না মা’র’লে হয় না অর্জুনদা?”
অসহায় কন্ঠে অন্না কথাটা বললো। অন্নার কথায় বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলো অর্জুন। হতবাক দৃষ্টিতে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো সে। অবাক কন্ঠে বললো,
“যখন ঈশ্বর বুদ্ধিদান করছিলো তুই কি ঘুমাচ্ছিলি?”
“হ্যা?”
“হাত বাড়াতে বলেছি আমি, এক কথা চৌদ্দবার বলতে ভালো লাগে না অন্নপূর্ণা”
বেশ কড়া স্বরেই কথাটা বললো অর্জুন। অন্নাও শুকনো ঢোক গিলে হাতখানা বাড়ালো। তাকে অবাক করে একথোকা শিউলী ফুল হাতে দিলো অর্জুন। শিউলির মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে। অন্না বিমূঢ় দৃষ্টিতে চাইলো। এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। অনুভূতিগুলো ধলা পাকিয়ে গেলো অচিরেই। কৌতুহল, বিস্ময়, আনন্দরা জট পাকালো অন্নার। তার বিমূঢ়, হতবিহ্বল দৃষ্টি দেখে অর্জুন চাঁপা স্বরে বললো,
“অকেজো মস্তিষ্কটা একটু কাজ করা, খোঁপা করেছে অথচ এটুকুও জানে না খোঁপা খালি রাখতে নেই। সাজতেও জানিস না নাকি! খালি খোপা দেখে দয়া হলো, তাই দিলাম। তবে ভাবিস না আমি তোকে অনুমতি দিচ্ছি আমার গাছের ফুল ছেড়ার, খবরদার কখনো আমার শিউলি গাছের যেনো তোকে না দেখি”
বলেই হনহন করে হেটে চলে গেলো অর্জুন। অন্না অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্জুনের যাবার পানে। হাতে তার এক থোকা শুভ্র শিউলি, তার মৃদু মিষ্টি গন্ধ নাকে ধীরে ধীরে আসছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো কুসুম প্রভা। তার বক্ষস্থলে হাজারো সুখের লহর বয়ে গেলো। শ্যাম গালজোড়া রক্তিম হয়ে উঠলো অজানা অনুভূতির শিহরণে। সারা শরীরে সেই শিহরণ লজ্জার রুপে ছড়িয়ে গেলো। হৃদস্পন্দন বেসামাল হলো, ভেতরের জমা ভয় অনুরাগের রঙ্গে রঙ্গিন হলো। এক পশলা বৃষ্টির পর হৃদয়ের আঙ্গিনায় উদিত হলো সাতরঙ্গের রংধনু। অন্না ফুলগুলো মুখের সামনে নিলো। হৃদয় ভরে গন্ধ নিলো। তার ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো। স্নিগ্ধ শিহরণে তার হৃদয় আজ বেসামাল। আচ্ছা, রমেশ কি কখনো হেমনলিনীকে শিউলি ফুল দিয়েছে? কে জানে! তবে অন্নার রমেশ তার রিক্ত খোঁপার অলংকার ঠিক ই দিয়েছে। তার যে রিক্ত খোঁপা অপছন্দ।
অন্না যখন মীরজাফরের দলের কাছে ফিরলো তখন তার গালের লালিমা অক্ষত। দীপ্তি বললো,
“অর্জুনদা সত্যি তোকে এই ফুলগুলো দিলো?”
“নাহ, মিথ্যে মিথ্যে দিয়েছে। বলেছে এখন পড়, সন্ধ্যেবেলায় আমি নিয়ে আবার গাছে লাগিয়ে দিবো। ঈশ্বর যখন বুদ্ধি দিচ্ছিলো কোথায় ছিলি তখন?”
“এভাবে বলছিস কেন? অর্জুনদা তোকে ফুল দিয়েছে তাও নিজ শিউলি গাছের অবিশ্বাস্য নয়!”
দীপ্তির কথার যুক্তি আছে। ফলে ঠোঁটের হাসিটুকু বিস্তারিত করে অন্না বললো,
“আমার জন্য সব ছাড়”
বলেই প্রসন্নমুখে চলে গেলো প্যান্ডেলের ভেতর। বাহিরে থাকা দীপ্তি এবং লাবণ্য মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। তাদের মুখে কথা নেই। তারা মোটামুটি নিশ্চিত, “অর্জুনদা অন্নার প্রেমে মজেছে”
*****
ব্যস্ত দিনের অবসান ঘটিয়ে ধরনীতে নামলো স্নিগ্ধ তমসা। তমসার ঘোরে হিমুলেনের নীল আকাশটি কালো রুপ ধারণ করলো। তবুও উত্তেজনা এখনো কমে নি। প্যান্ডেলের বাহিরে যুবসমাজের জমজমাট আড্ডা। মেয়েরা চায়ের সাপ্লাই দিচ্ছে। চা আর রফিক ভাইয়ের গরম গরম পুরি। আর কি লাগে! তামিমা এবং সামিহা, নিপাও এসেছে। বান্ধবীদের আগমনে মীরজাফরের দল সম্পূর্ণ হলো। এর মাঝেই বিদ্যুৎ বলে উঠলো,
“একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে কেমন হয় প্রতীকদা?”
“এই শেষ সময়?”
প্রতীকের কথায় রবিন ভাই বলে উঠেন,
“শেষ সময় কোথায়? নবমীর দিন করে ফেলো। নিমাই দাদাকে বলো একটা ছোট স্টেজ বানিয়ে দিতে। আর আমাদের কৃতি শিল্পীরা তো আছেই। দীপ্তি, লাবণ্য, অন্না কি চমৎকার নাচে। বিদ্যুৎ , রনবীর তো আছেই গাইয়ে। আর ভুলে গেলে তো হবে না পাড়ার কৃতী গায়ক আমাদের অর্জুন ভায়া তো আছেই। আচ্ছা, আমি বলি কি অর্জুন ভায়া আর অন্না একসাথে একটা পারফরম্যান্স করুক। অর্জুন গাইবে আর অন্না নাচবে। আহা! কি দৃশ্য”
রবিন ভাই এর প্রস্তাবে চা টা মুখ অবধি এসেই থেমে গেলো অর্জুনের। চুমুকটি আর দেওয়া হলো না। সে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো রবিন ভাই এর দিকে। এদিকে সামির ভাই, বিদ্যুৎ, প্রতীক মিটিমিটি হাসছে। প্রতীক কমিটির সভাপতি হিসেবে বললো,
“ঠিক ঠিক রবিন ভাই, আমরা তো ভাবি ই নি এভাবে। তুমি না থাকলে কি হতো আমাদের। তুমি তো ভাই গুরুমানুষ”
“আরে কি যে বলিস, আমি তো পিপড়ে তুল্য মানুষ। হুটহাট মাথায় বুদ্ধি চলে আছে। তোদের ভালোবাসি বলে সেগুলো তোদের বলি”
রবিন ভাই লজ্জিত কন্ঠে বললো কথাগুলো। অর্জুন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রবিন ভাই এর দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বললো,
“বাঁচতে দিবে না?”
“ভায়া, রাস্তা করে দিচ্ছি। এবার শি’রটা কাটা যাবে না। দেখবে গান গাইতে গাইতেই হৃদয়ের দ্বার খুলে যাবে। তুমি অধৈর্য্য হও কেন? কবি বলেছে একবার না পারিলে দেখো শতবার”
অর্জুন যুক্তি খুঁজে পেলো না রবিন ভাইয়ের বিপরীতে। সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো অন্নার দিকে। অন্নাকে ইশারা করলো কিছু বলতে। অন্না ইশারা ঠিক কি বুঝলো বোঝা গেলো না। সে প্রশ্ন করে বসলো,
“রিহার্সাল কবে করবো?”
অর্জুন কপাল চা’পড়ালো। একেই ফাঁকিবাজ, ও তো সুযোগ খুঁজছে কিভাবে পড়ায় ফাঁকি দিতে হয়। রবিন ভাই বললেন,
“সে বোন যখন তুমি চাও, অর্জুন ভায়া সবসময় প্রস্তুত”
যুবসমাজ হো হো করে হেসে উঠলো। অন্না বুঝলো তারা কি বোঝাতে চাইছে, সাথে সাথেই রক্তিম হয়ে উঠলো তার গাল। এদিকে মাথা নামিয়ে নিলো অর্জুন। এই রবিন ভাই বিয়ের পিড়ি অবধি না নেওয়া অবধি ক্ষান্ত হবে বলে মনে হচ্ছে না। গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো অর্জুন। তারপর অন্নার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার গানের সাথে নাচতে পারবি? পা ভেঙ্গে খোঁ’ড়া হয়ে যাবি না তো?”
“তুমি কি উচ্চাঙ্গ সংগীত গাইবে? হাহ! আমি বিনা সঙ্গীতে নাচতে পারি। নিজের হেরে গলার খোঁজ নাও। পাড়ায় আমার নাম ডুবিও না”
“সময় আসলে না হয় পাড়ার মানুষ ই দেখবে কে কার নাম ডুবাচ্ছে”
দুজনের আরোও এক দফা ঝগড়া লাগলো। রবিন ভাই হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একজন বুনোওল তো অন্যজন বাঘাতেতুল। এদের গল্পের পরিণতি বিধাতা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
*****
বাসায় ফিরতেই বেশ হুল্লোর দেখলো অন্না। মা, বড়মা ছোটাছুটি করছেন। তাদের মুখ উজ্জ্বল। অন্না চটি খুলতে খুলতে বললো,
“কি হয়েছে মা? এভাবে ছুটছো কেন?”
“আরেহ, দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যেয়ে দেখ দেব এসেছে। কত জার্নি করে এসেছে, ক্লান্ত হয়ে আছে। ওকে খেতে দিবো না?”
“দাদার না কাল ফেরার কথা ছিলো?”
“এই তোর প্রশ্নোত্তরের সময় নেই। যেয়ে ওর মাথা খা, আমাকে জ্বা’লাস নে”
বলেই রীতাদেবী তার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। অন্নার খুশি হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই সাথে কৌতুহল ও হচ্ছে। এতো তাড়াতাড়ি দাদা ফিরলো কেন? তাই ছুটে দেবব্রতের ঘরেই গেলো সে।
দেবব্রতের ঘরের দরজা ভেজানো। লাইট ও জ্বালায় নি। ভেতর থেকে তার পায়চারির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সে কারোর সাথে কথা বলছে, হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তাই শব্দ ক্ষীন শোনা যাচ্ছে। দেবব্রত বারংবার একই কথা বলছে,
“আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। আমার সময় লাগবে। পাগলামি করো না”
অন্না খানেক দ্বিধায় পড়লো। সে কি প্রবেশ করবে! দেবব্রতের কন্ঠে ক্ষীন গম্ভীর ঠেকলো। ফলে কিছুটা চিন্তিত হয়েই দরজায় কড়া নাড়লো সে। সাথে সাথেই দেবব্রতের কন্ঠে শোনা গেলো,
“কে?”
“দাদা, আমি”
মিনিট পাঁচেক বাদে ঘরের বাতি জ্বললো। দরজা খুলে দেবব্রত হাসি মুখে বললো,
“বাড়ি ফিরলি তবে, ভেতরে আয়”
দেবব্রতের মুখে হাসি ঝুলছে কিন্তু সেই হাসিটা কেমন ফিকে ফিকে ঠেকলো অন্নার কাছে। অন্না তার খাটে বসতে বসতে বললো,
“কি রে কলকাতা বাবু, তোর না কালকে আসার কথা ছিলো। এমন রাত বিরাতে ছুটে এলি যে? ছুটি কি পেলি নাকি পালিয়েই চলে এসেছিস?
” আমি এসেছি খুশি হস নি?”
“আমার জন্য কি এনেছিস না দেখে বলতে পারছি না খুশি হয়েছি কিনা”
“পাকাবুড়ি একটা”
বলেই মাথায় গা’ট্টা দিলো দেবব্রত। অন্না এবার বললো,
“তুই কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত দাদা?”
দেবব্রত প্রশ্নটা শুনলো। তারপর কিছুসময় থেমে বলল,
“আমি বিয়ে করবো অন্না”
দেবব্রতের কথা শুনেই আকাশ থেকে পড়লো অন্না। হা করে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। নিজেকে বহুকষ্টে সামলে বললো,
“তুই কি করবি?”
“বিয়ে, আমি বিয়ে করবো”
“কাকে?”
“সময় হলে জানতে পারবি”
“বড়মা জানে?”
“না, জানাবো”
“রাজি না হলে?”
“বিয়ে করে বাড়ি এনে তুলবো”
দেবব্রতের দৃঢ় কন্ঠ শুনে শুকনো ঢোক গিললো অন্না। অবন্তীকা দেবী গোরা মনোভাবের নারী, দেবব্রতের এমন আবদার সে ঠিক কতটা মানবে জানা নেই। তবে এতোটুকু জানা আছে একটা বিশ্বযু’দ্ধ হবেই। এবং তার প্রথম শহীদ অন্নাই হবে_______
*****
দুপুরের পর থেকেই ঝুম বৃষ্টি। থেমে থেমে নয়। অঝরধারায় অবিরাম বৃষ্টি। সন্ধিপুজোর ক্ষণ গড়িয়ে আসছে। কিন্তু বৃষ্টির থামার নাম নেই। প্যান্ডেলের ভেতর পানি জমার আশংকা নেই তবে মন্দির আসতে আসতে সকল সাজের বারোটা বেজে যাচ্ছে তাতে দ্বিধা নেই। অন্না আজ লাল শাড়ি পড়েছিলো। কিন্তু শাড়ির তলায় কাদা লেপ্টে আছে। অর্জুনের দেওয়া ফুলের মালাটিও বৃষ্টিতে ভিজে নেতিয়ে গেছে। ফলে তার মন বেজায় খারাপ। প্যান্ডেলে প্রবেশ করতেই মন খারাপের মাত্রা বাড়লো, যখন লাবণ্য বলে উঠলো,
“অন্না, অর্জুন দার সাথে ওই মেয়েটা কে রে?”
বৃষ্টিতে ভেজা অন্না ওদিক তাকাতেই দেখলো অর্জুনদার পাশেই একটি অপরিচিত মেয়ে। পরণে সাদা-লাল জামদানী, শুভ্র বদনে হালকা গহনা। টানা টানা দেবীর ন্যায় চোখ, শান্ত মুখশ্রী। স্নিগ্ধ তার হাসি। মেয়েটির কৃষ্ণ চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। সেই খোপায় তাজা বেলীর মালা। তার সম্মুখে অন্নাকে মোটেই সুন্দর লাগছে না। যেনো জীবন্ত গোলাপের কাছে মূর্ছানো রজনীগন্ধা। অন্নার ভেতরটা আরোও নিভে গেলো। মনে মনে শুধালো,
“এই কি তবে অর্জুনদার হেমনলিনী?”……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি