আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে-০৮,০৯

0
464

#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে-০৮,০৯
#৮ম_পর্ব

বৃষ্টিতে ভেজা অন্না ওদিক তাকাতেই দেখলো অর্জুনদার পাশেই একটি অপরিচিত মেয়ে। পরণে সাদা-লাল জামদানী, শুভ্র বদনে হালকা গহনা। টানা টানা দেবীর ন্যায় চোখ, শান্ত মুখশ্রী। স্নিগ্ধ তার হাসি। মেয়েটির কৃষ্ণ চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। সেই খোপায় তাজা বেলীর মালা। তার সম্মুখে অন্নাকে মোটেই সুন্দর লাগছে না। যেনো জীবন্ত গোলাপের কাছে মূর্ছানো রজনীগন্ধা। অন্নার ভেতরটা আরোও নিভে গেলো। মনে মনে শুধালো,
“এই কি তবে অর্জুনদার হেমনলিনী?”

নিভু হৃদয়ের যন্ত্রণাটা বেশ ভালোমতোই অনুভূত হচ্ছে অন্নার। এর মাঝে লাবণ্যের গোয়েন্দাগিরি চলমান। সে কানের কাছে বলেই যাচ্ছে,
“মেয়েটি কে? তুই চিনিস? আমি আসার পর থেকেই অর্জুনদার সাথে দেখছি। তোর কাছে ছ্যা’কা খাওয়ার পর কি অর্জুনদা রাস্তা বদলে দিলো? তাই যদি হয় তাহলে তোকে ফুল দিবে কেন? তাও নিজের গাছে থেকে ছেড়া?”

লাবণ্যের শানিত কথাগুলো হৃদয়ের ছাইছাপা যন্ত্রণাকে আরোও হাওয়া দিলো। মূহুর্তেই বিষাদ, ক্রোধ, ঈর্ষায় দিশেহারা হয়ে উঠলো অন্না। কন্ঠের রোষ বাড়িয়ে উত্তর দিলো,
“আমি কি অর্জুনদার সেক্রেটারি? না কি আমি তার বউ লাগি? আমি কি করে জানবো? তোর এতো জানতে ইচ্ছে করলে যেয়ে জিজ্ঞেস কর। সারাটাক্ষণ শুধু আউল ফাউ’ল কথা। ওখানে কি হলো, সেখানে কি হলো— সব জানতে হবে। যেনো এবারের বোর্ডে এই প্রশ্ন আসবে। একেবারে একশ তে একশ পেয়ে তিনি নাম উজ্জ্বল করবেন। বিরক্তিকর। অঞ্জলি দিতে এসেছিস তাই দে। আমার মাথা খা’স নে”

বলেই হনহন করে ভেতরে চলে গেলো অন্না। তার চোখ জোড়া জ্বলছে। ভেতরটায় তীব্র ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। অসহনীয় সেই ব্যাথা। ধীরে ধীরে যেনো সারা শরীরে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। আড়চোখে দুটো হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে বিশ্রী তেতো অনুভূতি হলো যা ভোঁতা হৃদয়ের যন্ত্রণাটা আরোও বৃদ্ধি করলো। এদিকে লাবণ্য হতবিহ্বল কন্ঠে বললো,
“যাহ বাবা, অন্না এতো চেঁতে উঠলো কেনো?”

সন্ধ্যিপুজোর শেষ ক্ষণ। দেবীর নিকট সকলে তাদের অঞ্জলি অর্পন করলো। অন্নাও হাত জোড় করে বেশ কিছু চাইলো। সকলের ধারণা এই সময়টায় দেবী তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে। অন্নার ও একই বিশ্বাস, তাই বুক ভরা শ্রদ্ধা নিয়ে কিশোরী মনের ভোঁতা ইচ্ছে গুলো সে প্রকাশ করলো দেবীর নিকট। দেবব্রতের আগমণ ও ঘটলো। অর্জুনের ঠিক পাশে আগুন্তক মেয়েটি দাঁড়িয়েছে। সকলে নিজ নিজ মনের ইচ্ছে গুলো দেবীর কাছে প্রকাশ করছে। এখন সময়ের ব্যাপার, কার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে তা কেবল বিধাতাই জানে।

অঞ্জলি শেষ হলে, সকলের কেন্দ্রবিন্দু হলো নতুন মেয়েটি। অন্না এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলো। লাবণ্য এবং দীপ্তি তাকে টেনে নিয়ে গেলো সেই আড্ডায়। সকলের কৌতুহল এই মেয়েকে কেন্দ্র করে। অন্নার যে কৌতুহল নেই তা নয়, তবে সে তা প্রকাশ করছে না। শুধু শক্ত মুখে সবটুকু দেখছে। মেয়েটি খুব সুন্দর করে কথা বলে৷ সবার সাথে এতোটা মিষ্টি করে কথা বলছে যেনো সে তাদের পূর্ব পরিচিত। অন্নার দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না। তখন সেখানে প্রসাদ হাতে উপস্থিত হয় অর্জুন এবং দেবব্রত। অর্জুনকে দেখেই অন্না সকলের সম্মুখে তার হাত ধরে বসলো। সকলকে অবাক করে টেনে নিয়ে গেলো তাকে এক কোনায়। দেবব্রত ব্যাপারখানা খেয়াল করলো কিন্তু মাথা ঘামালো না। তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি শুধু মেয়েটির দিকে।

অর্জুন হাত ছাড়িয়ে অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,
“কি সমস্যা? টানছিস কেন?”
“বাহিরের একটি মেয়েকে আমাদের পুজোতে কেনো এনেছো?”
“কিহ?”

অন্নার হুট করে করা প্রশ্নে তাজ্জব বনে গেলো অর্জুন। অবাক কন্ঠে বললো,
“বাহিরের মেয়ে কে?”
“ঐ যে, ঐ মেয়েটা”
“কৃষ্ণা? ও বাহিরের মেয়ে হতে যাবে কেন?”
“ওর নাম কৃষ্ণা?”
“হ্যা, একটা কথা বলতো, আমাদের পাড়ার পুজোতে বাহিরের মানুষের আগমণ মানা সেটা কোথাও লেখা আছে? আর কৃষ্ণা বাহিরের কেউ না। আমার বিশেষ অতিথি সে। তাই অহেতুক একটা ব্যাপার নিয়ে জলঘোলা করবি না। আর এই শেষবার, সকলের সামনে আর কখনো আমার হাত ধরবি না। জানিস তো ওরা ফাঁদ পেতে থাকে। এখন এটা নিয়ে আরোও কথা বানাবে”

অর্জুনের কড়া কন্ঠে মিয়ে গেলো অন্না। অর্জুন কথাটা বলে অপেক্ষা করলো না। হনহন করে যুবসমাজের মৌচাকে গেলো। অন্না সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বিশ্রী তিতকুটে অনুভূতিতে তার ভেতরটা জ্বলছে। কিন্তু প্রকাশ করার উপায় নেই।

পড়ন্ত বিকেল, বৃষ্টির ধার কমেছে। মন্দিরের সিড়িতে জমেছে কাঁদাপানি। কালো মেঘের দল নীলাম্বরের দক্ষিণ কোনে ঘাপটি মেরে আছে। তারা এখন ক্লান্ত। সফেদ মেঘেরা দল বেধে ঘুরছে। মন্দিরের পেছনে কিছু কাশফুল হয়েছে। তার ই একটা ডাটা হাতে নিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে অন্না। এদিকে বিকেলের শেষ সময় রবিন ভাই এবং সামির ভাই এসেছেন। গরম চায়ের ধুয়োয় উড়ছে হিমুলেনের আজকের আলোচনা। আলোচনা অর্জুনের সাথে আগত নতুন রমনী। রবিন ভাই আসতেই তার সাগরেট প্রতীক সকল ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা শুরু করে দিলো। দেবব্রত নেই। সে অঞ্জলি দিয়েই বাড়ি চলে গিয়েছে। তার নাকি মাথা ব্যাথা। অবশ্য সে থাকলে এই আলোচনাটা দমে যেতো। যুবসমাজের পেটেই শুধু ঘুরপাক খেতো। তাই সুযোগ বুঝে তারা আলোচনা করছে। আলোচনা আরোও সুন্দর বাক নিলো যখন বিদ্যুৎ বললো,
“অন্না তো রেগে মেগে ফায়ার। সে রীতিমতো হাত টেনে অর্জুনকে অন্যথা নিয়ে গেলো”
“বলিস কি! এই কাহিনী? আগুন লেগেছে তাহলে প্রেয়সীর হৃদয়ে। বাহ বাহ, এই না হলো অর্জুন ভায়া। অন্নাকে ঈর্ষান্বিত করার এই ফন্দি তো আগে ভাবি নি। তোমাকে করতালির সাথে সম্ভাষণ করতে হবে”

অর্জুন গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে বুঝেছিলো এমন ই কিছু হবে। শান্ত গলায় বললো,
“তোমার সত্যি বিয়ে দেবার দরকার রবিন ভাই, মাথা ভর্তি অকে’জো চিন্তা”
“ভায়া তোমার ভাগ্যটি ভালো বুঝলে। তোমার প্রেয়সী কি সুন্দর ঈর্ষান্বিত হয়েছে। গাল ফুলিয়ে তোমাকে শাষিয়েছে। আমার জন তাও করে না। ইশ! তানিকে যদি এভাবে জেলাস ফিল করাতে পারতাম! মেয়েটি একদম অনুভূতিশূন্য। তার কিছুতেই কিছু যায় আসে না”
“ভাই, আপনি যে একটা প্রেমিকা জুটিয়েছেন এটাই অবিশ্বাস্য কাহিনী ছিলো। উপরন্তু আবার জেলাস ফিল করাতে চান?”

বিদ্যুতের কথায় চটে গেলো রবিন ভাই। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কি বলতে চাস? আমার প্রেমিকা হতে পারে না। শোন, আমাকে প্রেম নিবেদন কিন্তু তোর তানি আপুই আগে করেছিলো। আমি ই তার থেকে সময় নিয়েছি, তাও ২ দিন। ২ দিন পর আমি তাকে হ্যা বলেছি”
“ঢপ মেরো না রবিন ভাই, বয়সের সাথে সাথে ঢপের মাত্রা বাড়ছে”

অর্জুনের কথায় আবারোও প্রতিবাদ করলো রবিন ভাই। কড়া স্বরে বললো,
“তোদের বিশ্বাস হয় না?”
“না হয় না, আমার তো মনে হয় তানি আপু তোমার উপর দয়া দেখিয়ে প্রেম করতে রাজি হয়েছে, বন্ধুমানুষ কতো আর একা থাকবে। তাই সে তোমার প্রেম নিবেদনে হ্যা বলেছে”
“ধুর ছাই, তোরা কি আমার ভাই নাকি তানির? কোথায় আমাকে বাহবা দিবি, না তানির সাগরেট হয়েছিস এক একটা”
“অবশ্যই আমরা তানি আপুর টিমে। তবে যদি তুমি এবার বেতন পেলে আমাদের হাজির বিরিয়ানি খাওয়াও তবে দল পালটে দিবো”

অর্জুনের কথায় সবাই সায় দিলো। রবিন ভাই হতাশ কন্ঠে বললো,
“ঘর ভর্তি আমার বিভীষন”

*******

অন্নাকে একা বসে থাকতে দেখে কৃষ্ণা তার কাছে এলো। মৃদু কন্ঠে বললো,
“তুমি অন্নপূর্ণা?”

হঠাৎ প্রশ্নে চমকে গেলো অন্না। অবাক কন্ঠে বললো,
“আপনি আমাকে চিনেন?”

মেয়েটি তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। তার ঠোঁটের স্নিগ্ধ হাসি প্রসারিত করে বললো,
“আমার নাম কৃষ্ণা”
“জানি”
“তুমি একা একা বসে আছো কেনো?”

অন্না চুপ করে রইলো। সে একা বসে আছে কারণ মীরজাফরের দলের কেন্দ্রবিন্দু এখন কৃষ্ণা। তারা মেয়েটির প্রতি এতোটাই আসক্ত যে অন্নাকে ভুলেই গেছে। অন্নাও তাদের আচারণে কষ্ট পেয়েছে। ফলে একা একা বসে থাকতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলো সে। অন্নাকে চুপ থাকতে দেখে কৃষ্ণা বললো,
“আমি তোমার পাশে বসি?”

অন্না নিষেধ করতে পারলো না। ফলে একটু সরে বসলো সে। কৃষ্ণাও তার পাশে বসলো। তারপর বললো,
“তোমার কথা শুনেছি জানো? অবশেষে দেখাটা হলোই।”
“আপনি বললেন না আমাকে কিভাবে চিনেন!”
“একজনের মুখে তোমার কথা শুনেছি খুব। তাই তোমার প্রতি আমার অনেক কৌতুহল ছিলো। তোমাকে ঠিক যেমন কল্পনা করেছি তুমি ঠিক তেমন। খুব মিষ্টি”
“আপনি খুব সুন্দর, আমি আপনার মতো সুন্দরী নই। এলেবেলে, হাটতে গেলে দশবার উ’ষ্টা খাই।”

অন্নার কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো কৃষ্ণা। কি চমৎকার সেই হাসি! পড়ন্ত বিকেলের ঝিমিয়ে যাওয়া সোনালী রোদ কৃষ্ণার মুখে আছড়ে পড়ছে। মেয়েটি সত্যি খুব সুন্দর। তার থেকেও সুন্দর তার হাসি। হাসলে তার চোখ ও হাসে। অন্না মুগ্ধ নয়নে দেখলো সেই হাসি। কৃষ্ণা হাসি থামিয়ে বললো,
“তুমি খুব মজার মেয়ে, তবে সুন্দরী কথাটা মানতে পারছি না। সৌন্দর্য্য তো মনের হয়। রক্ত মাংসের শরীর তো একটা সময় গ’লে পঁ’চে যাবে। তখন এই সৌন্দর্য্য তো নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। তুমি আমার থেকে অনেক সুন্দর। কারণ তোমার মনটা খুব সুন্দর। আমার না ইচ্ছে হচ্ছে তোমার সাথে খুব ভাব করতে। তোমার যদি একটা দাদা থাকতো ঠিক তাকে বিয়ে করে নিতাম। তখন তুমি হতে আমার ননদিনী।”
“আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। এইজন্য ই আপনি অর্জুনদার বিশেষ অতিথি”

অন্নার কথায় কোথায় যেনো চাঁপা বেদনা ছিলো। কথাগুলো মন খারাপ করে দিলো কৃষ্ণার। কৃষ্ণা ধীর কন্ঠে বললো,
“আমি অর্জুনদার কাছে কৃতজ্ঞ জানো। মানুষটা সত্যি ই অন্যরকম। অনেকটা নারকেলের মতো। বাহিরের আবরণ শক্ত, কঠিন। আর ভেতরটা একেবারে তুলতুলে”
“অর্জুনদার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”

প্রশ্নটা অনর্থক, তবুও শুধালো অন্না। কেনো যেনো কৌতুহল চেপে রাখতে পারছিলো না। বক্ষস্থলের জমায়িত অশান্তির লহর তাকে উত্যোক্ত করছে। পু’ড়বে যখন পু’ড়ে বিক্ষিপ্ত হওয়াটাই শ্রেয়। একটু একটু করে পোড়ার যন্ত্রণা অধিক। কৃষ্ণা আবারো হাসলো। হাসি অক্ষত রেখে বললো,
“ভালোবাসো অর্জুনদাকে?”

প্রশ্নটা শুনেই চমকে উঠলো অন্না। তার চোখ স্থির হয়ে গেল। মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হতে লাগলো। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। হাসিমুখে খুব জটিল প্রশ্ন করলো কৃষ্ণা যার উত্তর দিতে পারলো না অন্না। অন্নার নিশ্চুপ দৃষ্টি দেখে কৃষ্ণার হাসি প্রসারিত হলো। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“চিন্তা করো না, আমি শুধুই তার বন্ধু। বন্ধুত্বটা শ্রদ্ধার, সেখানেও ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু সেই ভালোবাসার ভাষাটা ভিন্ন”

বলেই কৃষ্ণা ভেতরের দিকে পা বাড়ালো। কৃষ্ণার কথার মর্মার্থ ঠিক কতটুকু বুঝলো অন্না বোঝা গেলো না। তবে তার বিষাদের কালো মেঘগুলো সরতে লাগলো। অশান্তিগুলো ধুয়োয় উড়তে লাগলো। অন্না তাকিয়ে রইলো কৃষ্ণার দিকে। মেয়েটি সত্যি ই আলাদা। কেনো যেনো মেয়েটিকে হিংসে হচ্ছে না______

******

দীপ্তি, লাবণ্যের সাথে হিমুলেনের আড্ডাগৃহে যাচ্ছে অন্না। রবিন ভাই এর পিতৃকল্যানে তাদের বাড়ির নিচ তলার একটা ভাঙ্গা ঘরকে বানানো হয়েছে “হিমুলেন যুবসমাজ আড্ডাগৃহ”। কুয়াশার রাতে অথবা বর্ষার বিকেলে এখানে কেরাম, দাবা খেলেই আড্ডার আসর জমায় যুবসমাজ। এই আড্ডাগৃহেই এখন রিহার্সাল হবে। অন্নাদের যাবার কারণ ও তাই। যাবার পথে হুট করেই তার হাতটা টেনে একটি ঝোপের পেছনে বসালো দীপ্তি। লাবণ্য ও বসে উঁকি দিলো। অন্না বুঝতে পারলো না কারণ। ফলে শুধালো,
” কি হলো বসে পড়লি কেনো?”
“চুপ চুপ, সামনে দেখ। দেবদার সাথে কৃষ্ণা দাঁড়িয়ে আছে”…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#৯ম_পর্ব

রবিন ভাই এর পিতৃকল্যানে তাদের বাড়ির নিচ তলার একটা ভাঙ্গা ঘরকে বানানো হয়েছে “হিমুলেন যুবসমাজ আড্ডাগৃহ”। কুয়াশার রাতে অথবা বর্ষার বিকেলে এখানে কেরাম, দাবা খেলেই আড্ডার আসর জমায় যুবসমাজ। এই আড্ডাগৃহেই এখন রিহার্সাল হবে। অন্নাদের যাবার কারণ ও তাই। যাবার পথে হুট করেই তার হাতটা টেনে একটি ঝোপের পেছনে বসালো দীপ্তি। লাবণ্য ও বসে উঁকি দিলো। অন্না বুঝতে পারলো না কারণ। ফলে শুধালো,
” কি হলো বসে পড়লি কেনো?”
“চুপ চুপ, সামনে দেখ। দেবদার সাথে কৃষ্ণা দাঁড়িয়ে আছে”

দীপ্তির কথা শুনেই ওদিকে নজর গেলো অন্নার। রবিন ভাই এর বাড়ি যেতে যে ফাকা মাঠ পড়ে সেখানের একটি গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। অন্নাদের অবস্থান তাদের থেকে খুব একটা বেশি নয়। ফলে তাদের কথোপকথন ক্ষীণমাত্রায় শুনতে পারছে তারা। লাবণ্য তখন ফিসফিসিয়ে শুধালো,
“দেবদা কি কৃষ্ণাকে চিনে?”
“জানি না, কখনো এই নামখানা শুনি নি”

তখন ই কৃষ্ণার শান্ত কন্ঠ কানে আসে অন্নার কানে,
“আমাকে এখানে টেনে আনার কারণ জানতে পারি মাস্টারমশাই?”
“তুই আমাকে না বলে এখানে কেনো এসেছিস?”
“কারণ তুমি আনতে না। তাই নিজ কাধেই দায়িত্বটা নিয়েছি”
“আমাকে বলা যেতো না?”
“আমি তো বলেছিলাম, তুমি যদি কিছু না করো আমি আমার মতো করে সবটা সামলাবো। কাকীমার সাথে কথাটাও আমার হচ্ছিলো। এর মাঝে বাধা না দিলে হতো না?”

কৃষ্ণার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দেবব্রত। তারপর গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধীর কন্ঠে বললো,
“আমার সময় লাগবে কৃষ্ণা। সবসময় তাড়াহুড়ো করাটা উচিত নয়। আমি তো বলেছি সবটুকু সামলে নিবো নিজের মতো। একটু ধৈর্য্য ধর”
“ক্ষমা করো মাস্টারমশাই, পারছি না। প্রণয়সিক্ত হবার সময় তো সময় চাও নি, তবে এখন কেনো? দায়িত্ব নিতে হবে বলে? এমন তো তুমি নও। আমার মাস্টারমশাই তো দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে যাবার মতো মানুষ নয়। তবে এখন কেনো? আমি না আর পারছি না। ক্লান্ত হয়ে গেছি। প্রতিনিয়ত এই ছেলেপক্ষদের নানা উছিলায় বাতিল ঘোষনা করতে করতে ক্লান্ত। মা এর সাথে প্রতিনিয়ত কাটাকাটি লেগেই যায়। বাবা কন্যাস্নেহে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। আর কতো সময় মাস্টারমশাই? তাই আজ নিজেই আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অর্জুনদা কে বলায় তিনি ব্যাবস্থা করেছেন”

কৃষ্ণার কন্ঠ কাঁপছে। তার চোখজোড়া ছলছল করছে। অভিমান তার কন্ঠে প্রকাশ পাচ্ছে। দেবব্রত কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর আলতো করে উষ্ণ হাতে ছুলো কৃষ্ণার কোমল গাল। কৃষ্ণা দৃষ্টি রাখলো দেবের গভীর নয়নে। তার গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রুকণাকে মুছে দিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
“একটু সময় দে, এতোদিন ধৈর্য্য রেখেছিস এবার নাহয় আর একটু ধৈর্য্য ধর। একটু বিশ্বাস রাখ আমার উপর। আমি দায়িত্ব এড়াচ্ছি না। কোনো পাত্র দেখতে হবে না। ওই সিঁথিটুকু আমার জন্যই বরাদ্ধ”
“একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?”
“কি?”
“ভালোবাসো?”

কৃষ্ণার প্রশ্নে হাসলো দেবব্রত। ভোরের প্রথম কিরণের ন্যায় উজ্জ্বল সেই হাসি। কৃষ্ণার গাঢ় কাজল লেপ্টানো চোখে উষ্ণ চুম্বন আঁকলো দেবব্রত। আবেশে চোখ বুজে নিলো কৃষ্ণা। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
“সন্দেহ আছে?”

কৃষ্ণা উত্তর দিলো না। শুধু চোখ বুজে মূহুর্তটাকে হৃদয়ে আবদ্ধ করলো পরম যত্নে। সে জানে তার মাস্টারমশাই তাকে পাগলের ন্যায় ভালোবাসে। এদিকে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিশোরীদের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। কেঁ’চো খুড়তে যেয়ে সাপ বের হবার ন্যায় ঘটনা ঘটে গেলো তাদের সাথে। এবার সব জলের ন্যায় পরিষ্কার অন্নার কাছে। কেনো দাদা সব ফেলে দেশে ফিরেছে, কেনো দাদা হুট করে বিয়ের ঢোল বাজাবার চিন্তায় ছিলো। বিয়ে করে বাড়ি আনার কান্ডটা তাহলে এই এবং মেয়েটি তাহলে আর কেউ না কৃষ্ণা। অন্নারা আর দাঁড়ালো না, সুযোগ বুঝে কেঁটে পড়লো।

আড্ডাগৃহে সবাই উপস্থিত। তারা চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে অন্নাদের জন্য৷ অর্জুন ক্ষণে ক্ষণে দেখছে ঘড়ি। তার সময় মাপা। মাপা সময়ের একটুও বেশি সে ব্যাবহার করতে রাজি নয়। কিন্তু এই পা’জি মেয়েটার কোনো সময় জ্ঞান নেই। কোথায় ফা’ত’রা’মি করে বেড়াচ্ছে কে জানে! অর্জুনের মুখশ্রীতে একরাশ বিরক্তি ফুটে উঠলো। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“বিদ্যুৎ দা, আমার নাম কেঁটে দাও। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। বাড়ি যাবো”
“সে কি কথা! কালকে অনুষ্ঠান এখন বলছিস নাম কেটে দিতে?”
“অনুষ্ঠান চুলোয় যাক, কান্ডজ্ঞানহীন মানুষদের সাথে কাজ করা যায় না।”
“আরে ভায়া, অভ্যাস করে নাও। এটা তোমার ভবিষ্যত জীবনের শিক্ষা। নারী মানেই পলিক্রোনিক টাইম। তারা সময়কে নিজের মতো করেই দেখে। অভ্যাস করে নাও”

রবিন ভাই এর কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। অর্জুন হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো রবিন ভাই এর দিকে। ঘুরেফিরে তার কাঁটা এক জায়গায় এসেই থেমে যায়। আগায় ও না পিছায় ও না। এর মাঝেই অন্নার প্রবেশ ঘটলো। তাকে দেখেই অর্জুন কড়া স্বরে বললো,
“কোথায় ছিলি? সময়জ্ঞান কবে হবে অন্না! তোদের অপেক্ষায় এতোগুলো মানুষ বসে রয়েছে। আমি কখন থেকে বসা জানিস?”
“আমরা তো ওই মাঠের সামনে….”

লাবণ্য কথাটা বলতে গেলেই সজোরে চিমটি কাটলো অন্না। সাথে সাথেই সে থেমে গেলো। অন্না কখনো ধীর স্বরে বললো,
“ক্ষমা করে দাও, আর হবে না এমন”

অন্নার ক্ষমা চাওয়া যেনো পৃথিবীর সবথেকে আশ্চর্যজনক ঘটনা। অর্জুনের মুখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে হা হয়ে গেলো। অন্নার মুখে এই উক্তি যেনো অবিশ্বাস্য৷ অর্জুন আরোও বকাঝকা করতো। কিন্তু অন্নার ক্ষীন চিন্তিত মুখখানা দেখে কিছুই বলতে পারলো না। কিছু তো একটা কান্ড ঘটিয়েছে সে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। হালকা কেঁশে বললো,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। চল শুরু করা যাক”

অন্না ঘাড় কাত করলো। রিহার্সাল শুরু হলো। অর্জুন ভেবেছিলো তাদের মাঝে গান নিয়ে গন্ডগোল হবে। কিন্তু অন্না আজ যেনো নিশ্চুপ দর্শক মাত্র। সবকিছুতেই মাথা কাত করাই তার কাজ। সেই সুযোগে রবিন ভাই বেশ জম্পেশ দুখানা গান বেছে দিলেন। অর্জুন অবাক কন্ঠে বললো,
“এতো গান থাকতে এগুলো কেনো?”
“বাকি গান বুকড, তোমার টিমমেট দেরি করে এসেছে, তাই তোমার ভাগ্যে এই দুখানাই জুটেছে”

অর্জুন দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো,
“রবিন ভাই ভালো হয়ে যাও, ভালো হতে পয়সা লাগে না।”

রবিন ভাই বত্রিশখানা দাঁত কেলিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন,
“আমি ভায়া পণ নিয়েছি, তোমার এই হৃদয় ভাঙ্গনটায় ফেবিকল দিয়েই ছাড়বো। আগুন তো লাগিয়েই দিয়েছো। এখনই লোহার হাতুড়ি চালাও। অন্নাকে দেখেছো! মেয়েটার মুখখানা মিয়ে গেছে। নয়তো তোমার কথায় হ্যা তে হ্যা মিলায়?”

কথা সত্য, অন্নার মাঝে আজ বেশ পরিবর্তন ই দেখা গেলো। সেই দুপুর থেকে তার পরিবর্তিত আচারণ অর্জুনকে একটু হলেও ভাবাচ্ছে। তখন ওভাবে রুঢ় আচারণ না করলেও হতো। একেই কৃষ্ণাকে কেন্দ্র করে বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছিলো। তার উপরে অন্নার জেরাটা ঠিক ভালো লাগে নি। তাই ক্রোধটা অন্নার উপর ই উগড়ে দিলো সে। অথচ অন্নার এখানে প্রশ্ন করাটা অযথা নয়। সে তো জানে না কৃষ্ণার আসল পরিচয়। কৃষ্ণা এবং দেবব্রতের প্রণয়ের সূচনাটি হয়েছিলো আজ থেকে পাঁচ বছর পূর্বে। বন্ধু হবার সুবাদে অর্জুন এই ব্যাপারটা জানতো। অবশ্য তাদের প্রণয়ের গল্পের প্রথম বাক্যটি অর্জুন ই লিখেছে। টিউশনের সুবাদে কৃষ্ণাকে পড়ানোর দায়ভার পেয়েছিলো অর্জুন। কৃষ্ণা তখন ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনার চাপে অর্জুন সেই পড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে দেয় দেবব্রতকে। ফলে দেবব্রত হয়ে গেলো কৃষ্ণার মাস্টারমশাই। সেখান থেকেই তাদের গল্পটি শুরু। তাই তো কৃষ্ণার অনুরোধ ফেলাতে পারলো না অর্জুন। নিমন্ত্রণ দিলো পুজোতে। আর এই ঘটনা আগুনের মতো ধোঁয়া উঠালো হিমুলেনের অতিউৎসাহী যুবসমাজে। ফলে অন্নাকে মুখোমুখি হতে হলো অর্জুনের কড়া আচারণের। এটা যেনো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, সকল রাগ, অভিমান, বিরক্তি মেয়েটার উপর উগড়ে দেওয়া। মেয়েটি বিপরীতে শানিত বাক্যের ত’লো’য়া’ড় দিয়ে প্র’হার করে অর্জুনকে। ফলে এই বিরক্তিকর অনুভূতিগুলো কোথায় যেনো মিলিয়ে যায়। তবে আজ এমনটা হয় নি। মেয়েটি তার বাক্যে শুধু মাথাই নাড়াচ্ছে। তাই বিরক্তি কাটার বদলে তা যেনো আরোও বেড়েছে। অর্জুন বা হাত দিয়ে মাথাটা চুলকালো। তারপর তাকালো অন্নার দিকে। অন্না এখনো শুষ্ক মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। যা মোটেই ভালো লাগছে না অর্জুনের।

রিহার্সাল শুরু হলো। অর্জুন প্রগাঢ় কন্ঠে সুর তুললো। অন্নাও সেই সুরের সাথে নাচের প্রস্তুতি নিলো।
“এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?”

অর্জুনের মধুর কন্ঠের সাথে অন্নার যুগলবন্দী যেনো সকলের নজর কাড়লো। সবাই মুগ্ধ নয়নে রিহার্সাল দেখলো। অর্জুনের চোখ স্থির অন্নার দিকে। তখন ই আড্ডাগৃহে প্রবেশ ঘটলো দেবব্রত এবং কৃষ্ণার। দুজনকে একত্রে দেখে অন্নার ধ্যান যেনো সরে গেলো। মাঠের কথাগুলো তার মস্তিষ্কে ঘুরতে লাগলো। তার থেকেও ভয়ংকর যে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো তা হলো বাড়িতে একটা বিশাল ঝড়ের পূর্বাভাস। যেখানে এক প্রান্তে থাকবে বড়মা এবং অন্য প্রান্তে দেবব্রত। দেবব্রতের জিদ এবং অবন্তীকা দেবীর দৃঢ়তা তার অবগত। ফলে একটা ঝড় আসবেই। আর সেই ঝড়ে উড়ে যাবে অন্না এবং বাকি পরিবারবর্গ। অবান্তর চিন্তাগুলো যখন বাড়লো তখন ই তার পা জোড়া যেনো নিয়ন্ত্রণ হারালো। শাড়ির পাড়ে আটকে ধরাম করে পড়ে গেলো সকলের সামনে। পায়ের শিরায় লাগলো টান। ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো অন্না। সাথে সাথেই একজোড়া হাত তার পায়ে চলে গেলো, চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“লেগেছে? মচকায় নি তো?”

মাথা তুলে দেখলো হাতজোড়া আর কারোর নয় বরং অর্জুনদার। তার কন্ঠ বেশ চিন্তিত ঠেকলো। তার চোখের দৃষ্টিতে অস্থিরতা। অর্জুনের অস্থিরতায় উপস্থির সকলের মাঝেও বেশ উত্তেজনা দেখা গেলো। অন্না মিয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
“আমি ঠিক আছি”

বলেই উঠতে যেয়েও বসে পড়লো। শিরার টানটা ব্যাথা করছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ব্যাথা সহ্য করলো অন্না। দেবব্রত ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
“মচকেছে কি?”
“না, শিরায় টান লেগেছে বোধহয়। একটু বরফ আন তো”

অর্জুনের কথায় দেবব্রত ছুটলো বরফ আনতে। অর্জুন তখন বললো,
“এতো অন্যমনস্ক কেনো তুই অন্না? কি ভাবিস সারাটাক্ষণ? যদি পা মচকাতো, তখন?”

অন্না অবাক নয়নে দেখতে লাগলো অর্জুনকে। অর্জুনদার চোখে মুখে চিন্তার গাঢ় ছাপ, এই চিন্তাটুকু কেবল ই অন্নার জন্য। অবাকের মাত্রা তখন আরোও গাঢ় হলো যখন সকলকে অবাক করে অন্নাকে কোলে তুলে নিলো অর্জুন……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here