#আমার_চন্দ্রাবতী,২৪
লেখিকা- সালসাবিল সারা
–“ভাইয়া,আম্মা,আব্বা বাঁচাও আমাকে।ইয়াদ,রামিসা আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ধোঁয়া বন্ধ করো কেউ।আ..”
দুআর কণ্ঠস্বর ক্ষীণ শোনাচ্ছে।এতক্ষণ যাবত চিল্লানোর ফলে মেয়েটার গলায় শব্দ ভান্ডারের বড্ড অনীহা। ধোঁয়া আর উত্তাপে ঘেমে একেকার সে।এখন তো শ্বাস নেওয়াটাই তার দায় হয়ে পড়লো।দরজার সাথে হেলান দিয়ে বসলো মেয়েটা।অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। ধোঁয়া এতো বিষাক্ত কখনো জানা ছিলো না তার।বুকে হাত দিয়ে দুবার শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো।নাহ,কষ্ট কমছে না মেয়েটার।অস্ফুট কন্ঠে আবারও আওড়ালো সে,
–“আম্মা,ভাইয়া,ইয়াদ!
দরজায় কড়া নাড়ার শক্তি ফুরিয়েছে।গায়ের চামড়া জ্বলছে তার।এতো উত্তাপ!নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে আবারও উঠে দাঁড়ালো দুআ।যেভাবেই হোক,এমন জ্বলে পুড়ে মরাটা সে স্বীকার করতে পারছে না।দরজায় হাত রাখবে সে,এমন সময়ই দরজা খুললো। ধোঁয়া রাশি বেরুনোর পথ পেয়ে হুরহুর করে কামরা থেকে বেরুনোর জন্যে প্রতিযোগিতা লাগালো যেনো।দুআর আফসোস হলো।এই কামরার ব্যালকনির দরজাটা যদি খুলতে পারতো সে,তাহলে ধোঁয়া থেকে বেঁচে যেতো!কিন্তু সেদিকে তো আগুন আর আগুন।কামরা বড় তাই চারিদিকে আগুন ছড়াতে সময় নিচ্ছে কেবল।
তাসনিমকে দেখে ভরকালো দুআ,এই মহিলা তাকে এমন করুণ পরিস্থিতিতে বাঁচাতে এসেছে?
–“আমি বাহিরে যাবো।আমাকে নিয়ে..নিয়ে যাবেন?”
তাসনিম হাসলো,মুখশ্রী তার কঠোর।ধাক্কা দিতেই দুআ পড়লো মেঝেতে।কোমরে চোট অনুভব করলো মেয়েটা।
–“তোর আব্বা যদি আমাকে বিয়ে করতে নাকচ না করতো, তাহলে তোর জন্যে আমার মনে কখনো এতো ক্ষোভ জমতো না।আমাকে রেখে ঐ আহেলীকে বিয়ে করছে তোর বাপ।আর আমি প্রেমিকের বিয়ে, এমন সুখের সংসার, কিভাবে সহ্য করে নিবো?তাই আমি তোকে ঘৃণা করি।তাদের ভালোবাসার ফসল যে তুই।আজ,এখন,এই মুহূর্তে মরবি তুই। নিচে সবাই ব্যস্ত।গানের শব্দে তোর এই আওয়াজ কেউ শুনবে না।সবাই ভাববে,দিয়ার আগুনে দুর্ঘটনা ঘটেছে।সেই দুর্ঘটনায় পুড়ে মরলো দুআ।ভেতরকার কাহিনী নিয়ে কেউ ভাববেই না।”
তাসনিম দুআকে দু,তিনটা চড় মেরে পুনরায় বাহিরে দাঁড়ালো দরজা ধরে।দরজা লক করলে মহা বিপদ।এই ঘটনা,দুর্ঘটনা বলে কেউ ভাববেই না।
অসহায় মেয়েটা আবারও উঠে দাঁড়ালো।বাবা,মা,
ভাই,ইয়াদ,বড় মা,বন্ধুগণ সবার চেহারা এক এক করে ভেসে আসছে।কেনো তার মাথা ব্যথা হলো,কেনো সে উপরে এলো,কেনো ডালিয়ার সাথে রুমেই থাকলো না,আফসোস হচ্ছে মেয়েটার। ধোঁয়া জমতে শুরু করলো পুনরায়।খুক খুক করে কাশলো দুআ।
দুর্বল হাতে দরজায় কড়া নাড়লো।আগুন এখন দ্রুত ছড়াচ্ছে।দুআর শরীর আগুনে ছুঁয়ে যেতে সময় লাগবে কিছুটা।
–“আমাকে বাঁচতে দিন।আমি কাউকে কিছু বলব না।কসম লাগে।কষ্ট হচ্ছে আমার অনেক।ইয়াদ.. আম্মা।”
গলাটা কেমন ধরে এলো দুআর।চোখের পানিও যেনো শুকিয়ে যাচ্ছে।
আড় চোখে দেখতে পেলো তার বাম পাশে টেবিলের উপর একটা স্টিলের ফুলদানি।গলার শব্দের শক্তি কুলিয়ে না পেয়ে সেই স্টিলের ফুলদানি হাতড়ে নিলো দুআ।সজোরে আঘাত করতে লাগলো দরজায়।এই যাত্রায় তাকে যে বাঁচতে হবে।এই মহিলাকে দুআ কখনোই ছাড়বে না বলে মনে মনে পণ নিলো।
.
ইয়াদ এবং তার বন্ধুরা উপরেই আসছে।ইয়াসিরের অবস্থা নাজেহাল বমি করে।বাকি বন্ধুরাও বিশ্রাম নিবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো।ঢাকা টু চিটাগং বাই রোডে আসা চারটে খানে কথা নয়।রুমের দরজার নিকটে আসতেই ইয়াসিরের অসাবধানতার দরুণ বড় আকারের ফুলদানি তিন টুকরো হলো মেঝেতে পড়তেই।সাথে হলো বিকট শব্দ।
এমন শব্দ শুনে তাসনিম পালালো।তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা এখন শতভাগ।
ক্লান্ত দুআ হার মেনে বসে পড়েছিল মেঝেতে।এই যাত্রায় তার মরণ নিশ্চিত ভেবে আল্লাহ্ মালিককে মনে মনে স্মরণ করছে মেয়েটা।হঠাৎই মৃদু গানের শব্দের মধ্যে এমন বিকট শব্দ শুনে তার মাঝে বেঁচে উঠার আকাঙ্খা জেগে উঠলো।টলমল পায়ে বন্ধ দরজায় পুনরায় ফুলদানি ঠেকছে।এইবার শব্দের বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে,এক নিরীহ জীবনের বাঁচার আকাঙ্খা হিসেবে।অসহায় দুআ জানেই না,দরজার হাতল বাঁকা করলেই দরজাটা খুলে যাবে।বিপদে মানুষের হুঁশ থাকে না নব্বই পার্সেন্ট।এই ক্ষেত্র দুআর বেলায়ও অনিয়ম করেনি।
–“সাবধানে হাঁটবি তো।”
ইয়াদ নির্দেশ দিল ইয়াসিরকে।
–“ঐটা কিসের শব্দ হচ্ছে রে?”
স্পন্দন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো।
–“রুমে যা তোরা।আমি দেখে আসছি।”
ইয়াদ দ্রুত পায়ে ছুটলো সেথায়।
রামিসার রুমের জানালা ভেদ করে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।ইয়াদের মস্তিষ্ক ফাঁকা হলো মুহূর্তেই।আবারও সেই বাজখাই শব্দ।কেউ কি আটকা পড়েছে সেই রুমে?দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইয়াদ।বুকটা হঠাৎ অশান্তিতে ছেয়ে গেলো কেনো?
দুআর আঁচলে আগুন লাগতেই চিল্লিয়ে উঠলো মেয়েটা,
–“আম্মা!”
দরজার হাতলে হাত রেখে,দুর্বল শক্তিতে জোরে চাপ দিতেই খট্ করে দরজা খুললো।টলমল পায়ে বেরিয়ে এলো দুআ।কামরা থেকে বের হতেই ধাক্কা অনুভব করলো এক সুঠামদেহি মানুষের সাথে।
ইয়াদের দৃষ্টি বিস্ফোরিত। ধোঁয়া,আগুনে জ্বলজ্বল করা রুম থেকে বেরিয়ে এলো তার প্রেয়সী।জ্বলন্ত আঁচলে আগুনের মাত্রা বাড়ছে। আঁচল গায়ের শাড়ি থেকে দূরে। তাই,গায়ের শাড়িতে এখনো আগুন লাগেনি।ইয়াদের মাথা এক মিনিটের জন্যে কাজ করা বন্ধ হলো।বুঝে উঠতে সময় নিচ্ছে এখন ঠিক কি করা দরকার!
হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলো,এই শাড়ি না খুললে দুআর নরম দেহে আগুনের স্পর্শ আবশ্যক।কাধের আঁচলে হাত রেখে শক্ত করে টান দিতেই পিনসহ খুলে এলো শাড়ি।ফলাফল স্বরূপ কাধের ব্লাউজ ছিঁড়ে বেশিরভাগ স্থান দৃশ্যমান।
ইয়াদ খেয়াল করলো শাড়িতে শুধু পিন আর পিন।কিছু ভাবতে পারছে না ইয়াদ,একে একে টেনে ছিঁড়তে লাগলো শাড়ি।বাম হাতে দুআকে আগলিয়ে রেখে ডানহাতে শাড়ির ধ্বংসাত্মক কাজ সারছে সে। কুচি নষ্ট করে দুআর সম্পূর্ণ শাড়ি খুলতে ইয়াদ সক্ষম হলো।দুআর মস্তিষ্কে আজ কোনো কার্য সম্পাদন হচ্ছে না। নয়তো এই দৃশ্যে সে নিশ্চিত মূর্ছা যেতো।ইয়াদ দুআকে একটু দূরে নিয়ে এলো।মেয়েটার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলো প্রেমিকের মন।ভয়ে, ক্লান্তে,আতংকে মেয়েটার চোখে-মুখের অবস্থা করুণ। না জানে,কতটা কষ্ট আর ভয় পেয়েছে মেয়েটার মনে!
দুআর শরীরের পানে দৃষ্টি যেতেই প্রেমিকের মনে উথাল পাথাল ঝড় এলো বুঝি।ব্লাউজের ছেড়া অংশে দৃশ্যমান ভেতরকার ছোট কাপড়ের অবয়ব,স্পষ্ট নিষিদ্ধ স্থানের প্রতিচ্ছবি।বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো সে দুআকে।মেয়েটার এমন অবস্থা যতোই না প্রেমের জাগান দিচ্ছে, মনে তার চেয়েও বেশি কষ্ট অনুভব করছে সে দুআর প্রতি।মেয়েটার নিশ্চয় বড্ড কষ্ট হয়েছে সেই আগুনের লীলাখেলায়?
ইয়াদ কোলে তুললো প্রেয়সীকে।সম্মুখে তাকিয়ে কোলে নেওয়া অবস্থায় বুকের সাথে চেপে ধরলো দুআর তনু।চোখের সামনে দৃশ্যমান সেই নিষিদ্ধ স্থানের প্রতিচ্ছবি কিছুতেই আর দেখবে না সে।দুআর এই করুণ অবস্থায় তো একেবারে নয়।প্রেমিক মন আপাতত অসুস্থ প্রেমিকাকে নিয়ে চিন্তিত।
ডালিয়ার রুমে দুআকে নিলো সে। ডালিয়া ঘুমে বিভোর।দুআ চোখ বুজে রেখেছে।হয়তো মেয়েটা মূর্ছা গেলো!ইয়াদ তার মুখশ্রীর পানে চেয়েই গায়ে কম্বল টেনে দিলো।দ্রুত হাতে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো সে।ফোন করলো তার ফুফাকে।
আগুনের ব্যাপারটা ছড়াতেই নিচের অনুষ্ঠান থমথমে।দুআর ব্যাপারটা চেপে গেলো ইয়াদ। দুআর এই ছেঁড়া অবস্থা দেখে এইখানকার আত্মীয় কি না কি ছড়িয়ে দেয় এই নিয়ে ইয়াদের ভাবনা নেই,যতো ভাবনা সব হলো সেইসব কথা শুনে এই মেয়ে মোটেও বাঁচবে না।আর ইয়াদের জন্যে দুআ’ই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ইয়াদ দুআর পাশে বসলো।বাহিরে আগুন নেভানোর তোড়জোড়ের শব্দ ভেসে আসছে।দুআর চেহারা মলিন।চোখের পানি শুকিয়ে পানির দাগ বসেছে মুখে।ইয়াদ বুড়ো আঙুলের সাহায্যে সেই পানির দাগে হাত ছোঁয়ালো। কেঁপে উঠলো মেয়েটার নেত্রপল্লব।দুআ ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে।ইয়াদ সেথায় কান পাততেই শুনতে পেলো,
–“আমি আগুন থেকে বাঁচতে চাই; আম্মা, ভাই, আব্বা,ইয়াদ!”
এই প্রথম দুআর মুখে নিজের নাম শুনলো প্রেমিক পুরুষ।তাও মেয়েটা অজ্ঞান অবস্থায়।মৃদু হাসলো সে।সন্তর্পনে হাত রাখলো সে দুআর চুলের গভীরে,
–“তোমার ইয়াদ বাঁচিয়েছে তোমায়,চন্দ্র।”
–“ভাইয়া?”
মারিয়ার কণ্ঠ উত্তেজিত।
–“হুম?”
ইয়াদ ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্নাত্মক ইঙ্গিত করলো।
–“সব ঠিক আছে তো ভাই?”
রামিসা হতদন্ত হয়ে বললো।
–“সেই রুমেই আটকে ছিলো দুআ।ভাগ্যিস কিছু হয়নি।ওর জ্ঞান ফিরলে কাপড় বদলিয়ে দিস।আর আমি খোঁজ নিচ্ছি আগুন লাগলো কিভাবে?আমার মনে হয় না এটা কোনো দুর্ঘটনা।কারণ;আগুন লাগলেও,দুআ সেই ঘর থেকে প্রথমেই বের হতে পারলো না কেনো?যখন আমি গিয়েছিলাম তখন বেরিয়েছিল সে।তার চিৎকারে নয়,বরং ভারী কিছু দ্বারা দরজায় আঘাত করার শব্দে আমি রুমের সামনে গিয়েছিলাম।যেতেই দেখি মেয়েটা বেরিয়ে এলো তৎক্ষণাৎ।এর মানে,কেউ ইচ্ছে করেই চন্দ্রকে আটকে রেখেছিল।তার উদ্দেশ্য মোটেও সুবিধার ছিলো না।”
ইয়াদ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো।
শান্ত ভাবের মাঝে তার অশান্ত ভাবভঙ্গি বুঝতে বেগ পেতে হলো না কাউকেই।
–“কিন্তু ভাইয়া,কে করবে এই কাজ?”
রামিসা পুনরায় রপ্ত হলো ভাবনায়।
–“দেখা যাক।দুআ বেঁচে আছে শুনলে অপরাধী নিজেই তার দেখা দিবে।ওর সাথেই থাকবি।দায়িত্ব দিয়ে গেলাম।”
ইয়াদ বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে।
রামিসা,মাহি,মারিয়া,জেনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের অবস্থান করে নিলো খাটে।
দুআর খোঁজ নিলে,রিজোয়ানের কাজিনদের ভুলভাল বুঝিয়ে যাচ্ছে মাইশা।তাদের কানে দুআর ঘটনা গেলে কেলেঙ্কারি বাজতে একটুও সময় নিবে না।
‘
তিমিরের কালো রং বাদে আকাশে ফুটে উঠলো সফেদ আর হালকা নীলের সংমিশ্রণ। ডালিয়া তার পাশে শায়িত ঘুমন্ত দুআর মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।গতরাতের ঘটনায় নিজেকে দোষ দিয়ে মহিলা বুক ভেজালো নোনাজলে।মেয়েটার সাথে সে ঐ রুমে গেলে মেয়েটার উপর এতো বিপদ আসতো না,এমনটাই ভেবে অশ্রুসিক্ত হচ্ছেন ডালিয়া।জেনি মেয়েটাও নিজেকে দোষ দিচ্ছে দুআর সাথে এমন ঘটনা ঘটে যাওয়ায়।কেউ যেনো এই মেয়ের ক্ষতি মেনে নিতে একেবারে নারাজ।
দুআর তন্দ্রা ছুটলো।ভীত দৃষ্টিতে চারিদিকে চোখ বুলাতেই পরিচিত সকল চেহারা ভেসে এলো।রুম ভর্তি তার পরিচিত মানুষ।গত রাতের সেই ভয়ংকর ঘটনার কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিলো মেয়েটার।কি বিভৎস্য ছিলো সেই ধোঁয়া এবং আগুনের তাপ!ক্রন্দনরত ডালিয়া বেশ আহ্লাদী কণ্ঠে দুআকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
–“কালকে যদি আমি থাকতাম তোমার সাথে!”
–“আন্টি, কাঁদবেন না।আমি ঠিক আছি।”
–“হাত মুখ ধুয়ে নাও, মা।তোমার কাপড় পরিবর্তন করতে হবে।বাকিরা সকালেই চলে গিয়েছে।তুমি আস্তে ধীরে করো সব। ইয়াদু বললো,রিজোয়ান বলেছে,ইয়াদ যেনো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসে।তাই একদম ভয় পেও না কিছুতে। ”
দুআ কষ্টের মাঝেও মলিন হাসলো।তাসনিম জাঁদরেল মহিলাটা কাল তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে,এটা ভাবতেই চমকে উঠলো দুআ।একটা মানুষের ভেতরে কি করে এতো হিংসা থাকে!তাও যে ভুল সে করেনি,সেই ভুলের জন্যেই মহিলাটা তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলো।এই মহিলার নাম দুআ চিল্লিয়ে বলবে সবার সামনে। শুধু একটু শক্তির দরকার তার এখন। কাল ইয়াদ না এলে শাড়ির আগুনেই ভস্ম হতো মেয়েটা।দুর্বল শরীরে কি একটানে শাড়িটা খোলার শক্তি পেতো?একদম’ই না। দুআর স্পষ্ট মনে আছে,লোকটা তার শাড়ি খোলার সময় কতটা চিন্তিত ছিলো।এরপর দুআর স্মরণে আর কিছুই এলো না।তবে সে নিশ্চিত,
এই ঘরে তার প্রেমিক পুরুষ নিয়ে এসেছে তাকে।
–“আমি নিচে যায়। রামু তুই আর মাহি মিলে একটু মেয়েটার খেয়াল রাখ।জেনি তুমি আসো আমার সাথে।মেয়েটার নাস্তা দরকার। ”
ডালিয়া নির্দেশনা দিয়ে রুম ছাড়লেন।জেনি অপরাধী চেহারা বানিয়ে চললো নিচে।দুআ আড়মোড়া ভেঙে উঠতে নিলেই কোমরে হাল্কা ব্যাথা অনুভব করলো। কাল রাতের আঘাতের ব্যাথা এটা।গায়ের উপরের কম্বল সরাতেই নড়ে উঠলো মেয়েটা।ইয়াদ কাল তার শাড়ি খোলার সময় শাড়ি টান দিতেই ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলেছিলো।পিন খোলার সময় যে ছিলো না!নিজের বক্ষদেশে একবার তাকিয়ে নিজেকে পুনরায় কম্বলের খোলসে ভর্তি করলো দুআ।এই অবস্থায় লোকটা তাকে দেখেছে? মাথা চক্কর দিলো দুআর।লজ্জা,শঙ্কায় নুয়ে পড়লো লজ্জাবতীর মতো।
–“চল ভাই,ফ্রেশ হবি।”
রামিসা এসে বসলো দুআর পাশে।
–“আমাকে,উনি এই অবস্থায় দেখেছেন!কি লজ্জার ব্যাপার।”
দুআর আঁখি ছলছল।
–“তোকে বাঁচাতেই এমনটা করেছে,আজব।আর আগে পরে উনিই তো তোর সকল বস্তু একেবারে স্বচক্ষে দেখবেন।তাই এখন লজ্জা পেয়ে কি লাভ?বিয়ের পর তো সব খুল্লাম, খু…”
মাহি বেশ মজার ছলে বলতে গিয়েও দুআর মুখশ্রীর পানে চেয়ে চুপ করে গেলো।পুনরায় সে হাসলো আর বলে,
–“নো লজ্জা।ইয়াদ ভাই তোর এই অবস্থা কাউকেই দেখতে দেয়নি।কম্বলে মুড়ে ছিলি তুই।আমরাও তোর এই নটি রূপ এখন দেখেছি,আজব।”
দুআ হাসলো মাহির কথায়।এই মেয়ের মুখে কিছুই আটকায় না।লজ্জা ছেড়ে দুআ হাসছে।মাহির মতো সই যেনো বিপদের বন্ধু।যেকোনো সময় হাসাতে উস্তাদ।
কথা বাড়ালো না কেউ আর।দুআ মাইশার কাপড়ে আবৃত করলো নিজেকে।রামিসার রুমের অবস্থা বেহাল।তাসনিমের পলায়নের ঘটনা, আগুন লাগানোর ব্যাপারটায় সম্পূর্ণ দোষী সাব্যস্ত করলো তাসনিমকে।কারণ, চোর চুরি করে ধরা না পড়ায় জন্যেই পালিয়ে যায়।মাইশার পরিবার ক্ষমা চাইলো দুআর নিকট।সহজ সরল দুআ,এক সেকেন্ডেই তাদের ক্ষমা করলো।দোষ তো তারা করেনি,করেছে তাসনিম।
দুআ,ইয়াদ,মাহি,রামিসা,জেনি চললো দুআর বাড়ি।
দিনের বেলায়ও চমৎকার দেখাচ্ছে ভবনটা।চারিদিকে ইতোমধ্যে নানান বাহারের ডেকরেশনের পরিসমাপ্তি ঘটছে।রিজোয়ান ব্যতীত,দুআর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা জমিদার বাড়ির কেউ জানে না।রিজোয়ান মানা করেছে জানাতে।তার ধারণা,ইদ্রিস জমিদার জানলে প্রাণ হারাবে তাসনিম।
লজ্জিত দুআ একটিবার তাকালো না প্রেমিক পুরুষের পানে।তার মস্তিষ্কে শুধু একটা কথায় ভেসে যাচ্ছে,
লোকটা তাকে ঐ অবস্থায় দেখেছে!বাড়ি ঢুকেই দুআ সোজা ঢুকলো নিজের কামরায়। ডানে বামে তাকানোর ভুলটা সে করেনি।
দুআর আচমকা এমন গতি দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো ইয়াদের।দুআর এমন কর্মকান্ড আয়ত্বে এলো না মানবটার।
–“তাসনিম নামক মহিলাকে খুঁজতে আমি লোক লাগিয়েছি।বেশি সময় আত্মগোপনে থাকতে পারবে না উনি।আমার দুআকে মা’রতে চেয়েছে সে!এতো স্পর্ধা?”
রিজোয়ানের চোখে মুখে রাগের ছাপ।
–“উনাকে ‘এটেম্পট টু মা’র্ডার’ এই কেইসে জেলে পুরতে হবে।এরপর সহজে আর ছাড় পাবে না।বড্ড বজ্জাত উনি।”
ইয়াদের মুখে তীব্র আক্রোশ।
*
ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো।জাকজমোকের কোনো ত্রুটি ছিলো না।এই দুইদিন দুআ ঠিকভাবে ইয়াদের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেনি সেদিনের লজ্জায়।তবে,প্রেমিক পুরুষ নিজ দায়িত্বে দুআর সকল লাজের কাছে জয় করেছে নিজেকে।মেয়েটা কেনো এত লাজুক আর নাজুক জানা নেই ইয়াদের।তবে তার এই স্বভাব ইয়াদকে আরো বেশি কাছে টানে দুআর প্রতি।এই যেনো,বিনি সুতোর টান!
পরের দিন সকাল.
আচমকা জ্বর এলো দুআর।শরীর ব্যথায় ভেঙে আসছে।সেই যে বিছানায় পড়েছে আর উঠার নাম গন্ধ নেই।ইতিমধ্যে আঁখি ফুলে সারা শরীরে জ্বরের আভাসের তীব্রতা জানান দিচ্ছে।
ডাক্তার এসে ওষুধপত্র দিয়ে গেলো,তাতেও এই মেয়ের জ্বর কমার জো নেই।তবে,সকলের ধারণা সন্ধ্যা হতে হতে জ্বরের প্রকোপ কমবে।
ইয়াদ বিদায় জানাতে এসেছে।জরুরি টি টোয়েন্টি ম্যাচ পড়েছে তার।বোনকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি প্রেয়সীকে বিদায় জানিয়ে না গেলে ইয়াদ ইহকালে স্বস্তি পাবে না একেবারে।কিছু সময় নিচে কাটিয়ে রামিসা ইয়াদের শেখানো বুলি আওড়ালো,
–“ইয়াদ ভাই তো চলে যাচ্ছে।ভাইয়াকে তোমার ঘর ঘুরে দেখাও।আবার কখন আসে,না আসে ঠিক নেই।”
মাইশা বুঝতে পারলো রামিসার ইঙ্গিত।সে মুচকি হাসলো,
–“আসো না ভাইয়া।আমার ঘর দেখায় তোমাকে।”
–“যাও বাবা,ঘুরে আসো।”
আহেলী হেসে জবাব দিলো।
ইয়াদ উঠলো ধীরে।তার বন্ধুগণ গাড়িতে অপেক্ষা করছে।তাই শর্ট কাটে কাজ শেষ করতে হবে তার।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই ইয়াদ মাইশার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“সময় কম।জলদি বেরুনো দরকার আমার।তুমি সোজা আমাকে দুআর রুমে নিয়ে যাও।”
–“আসো ভাইয়া।”
মাইশা জবাব দিলো হাতে ইঙ্গিত দেখিয়ে।
ইয়াদ দুআর কামরায় প্রবেশ করলো।দুইবোন বাহিরে পাহারা দিচ্ছে দায়িত্ববান সৈন্যের ন্যায়।বিছানায় কম্বলে মুড়ানো ইয়াদের প্রেয়সী।জেনি ইয়াদকে দেখেই নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করলো।ইয়াদ বিছানায় বসলো দুআর মাথা কাছেই।কপালে হাত রাখতেই দুআর আঁখি খুললো আপনাআপনি,
–“আপনি এইখানে?”
জ্বরে নুয়ে পড়লো দুআর কণ্ঠস্বর।
–“হ্যাঁ।বিদায় জানাতে এসেছি।চলে যাচ্ছি।”
বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে দুআ প্রেমিক পুরুষের পানে তাকালো।ক্লিন শেভড খরশান চোয়ালে স্মিত হাসি।লোকটা বিদায় বেলায় এই রূপ দেখিয়ে দুআর ভেতরকার আগুনে ঘি ঢালতে এসেছে!ঝাপসা হয়ে এলো দুআর আঁখি। বিদায়বেলাটা খুবই কষ্টদায়ক।
–“এতো জলদি কেনো?”
–“ম্যাচ আছে।আবারও আসবো তোমার কাছে।খুবই দ্রুত।তখন কিন্তু আমার স্পর্শ তোমার সম্পূর্ণ মুখমণ্ডলে পরশ দিবে,কোনো মানা বা লজ্জা কিছুই শুনবো না আমি।”
দুআর আজ লজ্জা অনুভব হলো না,কেবল অনুভব করলো প্রিয়জন চলে যাওয়া বেদনা।দুআর আজ অন্যরকম অনুভূতির জানান হলো।হুট করেই এক হাত বাড়িয়ে দিলো ইয়াদের প্রতি,
–“উঠে বসবো।”
ইয়াদের হাসি প্রবল হলো।মেয়েটার অতি আদুরে মোহে আবারও জব্দ হলো ছেলেটা।
ইয়াদ দুআর হাত ধরে, বসালো তাকে। গালে হাত ছুঁয়ে বললো,
–“কাঁদে না তো।আমি আসবো আবার।ইন্টার শেষ করো,এরপর বাড়িতে নিয়ে যাবো আমার বউ করে।”
–“আপনি প্লিজ যাবেন না।আমি আপনাকে দেখতে চাই।”
দুআর মুখশ্রী অশ্রুতে মাখামাখি।
ইয়াদ পানি পুছে দিলো সন্তর্পনে,
–“আসবো আমি আবার।তখন সারাক্ষণ তোমার সামনে বসে থাকবো, দেখবো কতো দেখতে পারো আমাকে।এখন আসি।দেরী হচ্ছে।ভালো থেকো,চন্দ্র।ভালোবাসি।”
দুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে পড়তে নিলে দুআর বুলি থামালো ইয়াদকে,
–“আমি আপনাকে ভালোবাসি,ইয়াদ।”
ইয়াদ কিংকর্তব্যবিমুঢ়।দ্রুত হেঁটে দুআর সম্মুখে বসলো।দুই হাতে আলগোছে দুআর গাল চেপে বলে উঠলো,
–“আমি যদি তোমাকে এই মুহুর্তে চুমু দিই,তুমি কি লজ্জায় নুয়ে পড়বে?”
দুআ দুদিকে মাথা দোলালো।অস্পষ্ট স্বরে বলল,
–“নাহ!”
দেরী করলো না প্রেমিক পুরুষ।বিদায়বেলায় এমন প্রশান্তি পাবে ভাবেনি সে কস্মিককালে।অতঃপর ইয়াদ অধর ছুঁয়ে দিলো প্রেমিকার উত্তপ্ত ললাটে।
চলবে…..