#আমার_চন্দ্রাবতী,৩৬এবং অন্তিম পর্ব
লেখিকা- সালসাবিল সারা
স্ত্রীর ডেলিভারির সময় অব্দি সকল কার্যক্রম হতে ছুটি নিয়েছে ইয়াদ। অর্ধাঙ্গিনীর এমন করুণ সময়ে সে সর্বদা উপস্থিত থাকবে,এমনটাই ভেবে রেখেছে ছেলেটা।গত একমাস যাবত ইয়াদ ঘরেই ছিলো।তবে,রুটিন মাফিক নির্দিষ্ট সময়ে মাঠে প্র্যাকটিসের জন্যে চলে যায় সে।সবকিছুর জন্যে নিজেকে বিসর্জন দিলেও,ছেলেটা ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ।দৈনিক অল্প প্র্যাকটিস ইয়াদের বাধ্যতামূলক।তাই প্রেয়সী ঘুমন্ত অবস্থায় সে স্টেডিয়ামে প্র্যাক্টিস করে মেয়েটা তন্দ্রামুক্ত হওয়ার পূর্বেই ফিরে আসে।গত একমাসে দুআর সবটাই খেয়াল রেখেছে ইয়াদ।
বাস্তবতার ভিত্তিতে,দুআ গর্ভধারণ কালীন সময়ে যতটা না অসুস্থ ছিলো;অষ্টম মাস হতে নবম মাসে ততটা সুস্থ মেয়েটা।যদিও নবম মাসে সবচেয়ে কষ্ট হয়,তাও দুআর ধারণা অতীতের মাসগুলোয় তার কষ্টের পরিমাণ বেশি ছিলো।ইয়াদ মেয়েটার সকল কিছু ডাক্তারের দেওয়া রুটিনের সাথে খাপে খাপ মিলিয়ে রুটিন পালন করতে সাহায্য করেছে।এরই কারণে,দুআর এমন সুস্থতা।দুআর উন্নতি দেখে ডাক্তার বলেই দিলেন,দুআর ডেলিভারি প্রসেস প্রাকৃতিক নিয়মে সম্ভব।সি-সেকশনের কোনো দরকার নেই।এই খবর সকলের মন খুশি করতেই যথেষ্ট।
অন্যান্য দিন ইয়াদ স্টেডিয়ামে যাওয়ার সময় মেয়েটা গভীর নিদ্রায় ডুবে থাকে।তবে, আজ এর ব্যতিক্রম।ইয়াদের আসার পূর্বেই দুআ আজ জেগে।মেয়েটা কাবার্ড হতে একে একে ইয়াদের জিনিসপত্র বের করছে।ঠিক কতদিন পর সে এমন দায়িত্ব পালনে নেমেছে জানা নেই তার। জানবেই বা কিভাবে!ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে বিশাল ঘুমকাতুরের নামে দুআর নামটাই যেনো মানানসই।তার উপর ঔষধের ডোজ তো থাকেই।মেয়েটা একেবারে দুনিয়া-দারির খবর রাখে না।তবে,আজ তার দৈনন্দিন কাজের বিপত্তি ঘটলো।ইয়াদ ওয়াশরুমে যেতেই মেয়েটা এর পরপর সজাগ হলো নিদ্রা হতে।ইয়াদের জন্যে নিজ পছন্দের কাপড় নির্বাচন করে বিছানার উপর রাখলো সেগুলো।কালো রঙের জিন্স এবং শুভ্র শার্ট খানা পুনরায় পরখ করলো মেয়েটা।ড্রেসিং টেবিলের সামনের পাটাতন খুলে,লোকটার ঘড়ি কালেকশন হতে মেয়েটা কালো রঙের সুন্দর চকচকে ঘড়ি পছন্দ করে শার্টের উপরেই রাখলো নির্বিঘ্নে।
বাথরুম হতে পানির শব্দ ভেসে এলে দুআ বুঝলো লোকটার বেরুতে এখনো ঢের দেরী।দুআ ধীরে হেঁটে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো।বাগানে নতুন কাজ করা হয়েছে।ফলস্বরূপ পরিবেশটা সম্পূর্ণ চকচকে।দুআ নিজের বাড়ন্ত পেটে হাত রাখলো।প্রকৃতি আজ বেশ ফুরফুরে।ঠান্ডা পবন বিদ্যমান।নিচ তলা হতে কেবল বাগানের এই দিকটায় দৃশ্যায়িত।এর কিছুদুরেই যতো গার্ডের ছড়াছড়ি।উপর তলা হতে দুআর নিচতলা সর্বপ্রিয়।মনের খোরাক মিটিয়ে বাগানের শুভ্রতা যে উপভোগ করতে পারে!প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলাসের পাশাপাশি দুআ মনের অন্তরালে এক বিরাট পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত।
আজ তার খেলোয়াড় সাহেবের জন্মদিন।গত রাতে বাড়ির সকলে ছোটখাটো করে জন্মদিন পালন করলেও সেথায় শামিল ছিলো না দুআ।মেয়েটা সেসময় ঘুম মশগুল। হাই পাওয়ারের ঔষধের ডোজে বেখবর ছিলো মেয়েটা। এতে তার আফসোস নেই।কারণ, সে জানে খেলোয়াড় লোকটার জন্যেই বাড়ির কেউ তাকে নিদ্রা হতে জাগায়নি।গতরাতের এহেন কাহিনী তার নিকট প্রকাশই পেতো না হয়তো।যদি না তার গোয়েন্দা তাকে এইসব খবর মোবাইলে পাঠাতো!
মারিয়া; গতরাতের যতো ভিডিও,ছবি সবটা দুআর মোবাইলে পাঠিয়েছে।
সকালবেলা ইয়াদ তার নিকট হতে সরতেই হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে মেয়েটার।ইয়াদ রুমে অনুপস্থিত থাকায়, শুয়েই মোবাইলে আসা বার্তার খোঁজ করলে মেয়েটা গতরাতের সব কাহিনী দেখে এবং বুঝে।
এই ঘটনার জের ধরেই দুআর যতো পরিকল্পনা।ইয়াদকে সে আজ চমকে দিবে,বিরাট সারপ্রাইজের আয়োজন করছে মেয়েটা গুরু গম্ভীরে।ঠোঁটের কোণে তার অদ্ভুত হাসির দেখা মিললো।
–“দুআ?”
–“জ্বী!”
ইয়াদের হাঁকে মেয়েটা ব্যালকনি হতে বেরুলো।
–“ঘুম থেকে উঠেছো কবে?”
–“কিছুক্ষণ হলো।”
দুআর ললাটে ছেলেটা অধর ছোঁয়ালো সরাসরি।
–“রেডি হোন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
–“যাও।”
ইয়াদের দৃষ্টি তার প্রেয়সীতে আবদ্ধ।মেয়েটার ঘুম জড়ানো আঁখি,স্বাস্থ্যবান তনু তাকে বড্ড আকৃষ্ট করছে।বাচ্চাটা পেটে আসার পরপর তার ছোট্ট দুআ কেমন পরিপূর্ণ হলো।দুআর ধীরে সুস্থে হাঁটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো ছেলেটা।মনের ইচ্ছেটা আজ অপূর্ণ তার।মেয়েটা অসুস্থ!
দুআ বেরুলে দেখে, ইয়াদ তার রাখা সেই প্যান্ট,শার্ট গায়ে না জড়িয়ে তার চেয়ে ভালো শার্ট এবং প্যান্ট জড়িয়েছে।সূক্ষ্ম ভ্রু জোড়া বক্র হয়।
–“হ্যাঁ আসছি।প্রেস কনফারেন্স এতো আর্লি রাখতে কে বলেছে তোমায়? স্টিল ব্রেকফাস্ট করিনি।অ্যান্ড আরেকজন আছে,যাকে ঘুমের মাঝে না খাইয়ে আমি বেরুই না।ভাগ্য ভালো,আজ সে জেগেই আছে।”
অপর পাশ হতে কি বললো তা কর্ণগোচর হলো না দুআর।তবে পরপর ইয়াদের কণ্ঠ তার শ্রবমান,
–“তিনটা ইভেন্টে জয়েন করবো জাস্ট। নো মোর ইভেন্ট।আর হ্যাঁ,পথচারী শিশুদের দায়িত্বটা নাও তুমি।আমি পেমেন্ট করে দিবো।এটা সিক্রেট থাকবে।প্রেস আসলেও হ্যান্ডেল করবে।আমার আসতে খানিকটা দেরী হবে।”
ইয়াদ বাম হাতের ইশারায় দুআকে তার নিকট আসার ইঙ্গিত দিলো।
মেয়েটা স্থির।নড়চড় নেই।ইয়াদের ফোনের কথার ধাঁচ না বুঝলেও তার পরিবর্তিত কাপড় নিয়ে দুআর যতো মাথাব্যথা।লোকটা কখনোই তার পছন্দের কাপড়কে নাকচ করেনি।তাহলে এখন কি এমন হলো? দুআ দূর হতে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করলো,
–“আমি রেখেছিলাম তো কাপড়।চোখে দেখেননি?”
–“আই’উইল কল ইউ,ইউনূস।আপাতত ওদের সামলানোর ব্যবস্থা করো।”
নিজের বক্তব্য পেশ করে ইয়াদ পকেটে মোবাইল পুরলো।দুআর সম্মুখে দাঁড়াতেই মেয়েটা দু কদম পিছু হটলো তীব্র ক্ষোভে।কোনো লাভ হলো না মেয়েটার।তম্মধ্যে ইয়াদের হাত তার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো হুট করেই।
–“ডাকছিলাম তোমায়।”
–“আমার পছন্দের কাপড় পড়েননি কেনো?”
দুআর মুখশ্রী অভিমানে রক্তিম।
–“আজকের দিনে আমার অনেক কাজ।”
ইয়াদ হাসলো।প্রেয়সীর এমন খিটখিটে মেজাজ তার বাচ্চাটা আসার বাদেই হয়েছে।ইয়াদ এও জানে,একবার তাদের সন্তান দুনিয়ায় এলে তার বউ পুনরায় সেই ভীতু দুআয় পরিণত হবে।ইয়াদের কোনো চিন্তা নেই এইসব নিয়ে।সে তার দুআর সকল রূপেই মত্ত।
–“কি কাজ?আজ কোথাও যাবেন?”
ইতিমধ্যে লোকটার বাহু খাঁম’চে ধরলো রমণী।
–“আজ তোমার খেলোয়াড়ের বার্থডে।অনেক কাজ,
চন্দ্র।প্রেস কন্ফারেন্সে এইভাবেই সহজ সরল লুক নিয়ে যাওয়া যাবে না।”
ইয়াদের দৃষ্টি তার রাগী অর্ধাঙ্গিনীর স্নিগ্ধ মুখখানায়।
–“ওহ আচ্ছা।আগে বলবেন তো।খামোখা আমি রেগে গেলাম।যায় হোক,চলুন।আমার অনেক খুদা লেগেছে।”
দুআ নিজ কোমর হতে ইয়াদের হাত সরাতে চাইলেও পারেনা।ছেলেটার হাতের বাঁধন শক্ত।
–“রেগেছো যখন,ছোট্ট করে রাগ ভাঙ্গানো আমার দায়িত্ব।”
ইয়াদ হাসলো আলগোছে।অতঃপর তার অধর স্পর্শ করলো মেয়েটার মুখশ্রীতে।বাদ যায়নি প্রেয়সীর নিষিদ্ধ স্থানও।
‘
ইয়াদ তার কাজে যেতেই দুআ বসার ঘরে গোল মিটিংয়ের আয়োজন করলো।নিজ বক্তব্য পেশ করেই শান্ত হলো সে।দুআর পরিকল্পনা সকলের পছন্দ।এরমাঝে সাজ্জাদ বলে উঠলেন,
–“সব ঠিক আছে।তবে,ইয়াদ আসবে কবে?”
–“বললো তো রাত আটটার দিকে।”
ডালিয়া জবাব দিলো।
–“তোমার ছেলে এতো সময় বউমা থেকে দূরে থাকবে?পারবে সে?”
সাজ্জাদ শব্দ করে হাসলো।পরপর বসার ঘরে হাসির শব্দ।ইয়াদ বিগত একমাস দুআর সহিত যেমনটা পাগলামি করেছে তাই নিয়ে সকলের যতো হাসি ঠাট্টা।
–“আহা,এমন বলছো কেনো বাবা?তোমার ছেলের অনেক কাজ আজ।যদিও মনে হয় আটটার আগেই ফিরবে ইয়াদ।”
জিয়া তার বক্তব্য পেশ করলো।
লাজুক দুআ মাথা নুইয়ে।মারিয়া তার হাতে হাত রাখতেই মাথা তুলে তাকালো মেয়েটা।মারিয়া হাসলো আর বলে,
–“অ্যাটেনশন,আমার চাঁদ ভাবীকে কেউ আর লজ্জা দিবে না প্লিজ।চলো আমরা প্ল্যানিং অনুযায়ী কাজে লেগে পড়ি!হাত মেলাও সকলে।”
মারিয়া নিজের হাত এগিয়ে দিলে, একে একে সকলে মারিয়ার হাতের উপর হাত রাখলো আলগোছে।দুআ মারিয়ার অন্যহাত ধরে রইলো।ভারী শরীর নিয়ে সবার ন্যায় ঝুঁকে হাত মেলানো তার পক্ষে অসম্ভব।
ঘরোয়া ভাবেই ইয়াদের জন্মদিন পালনের লক্ষ্যে ঘরের ভেতরকার অংশ সাজানো হচ্ছে।জিয়া ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যাবস্থা করেছে দ্রুত।তারাই মূলত ঘর সাজাতে ব্যস্ত। বাকিরা টুকটাক কাজকর্মে হাত বাড়াচ্ছে।অবশ্য কাজ বলতে তেমন কিছুই নেই।অযথা আধিখেত্যে।দুআ সোফায় বসে।টুকুর টুকুর দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে।সবার মতো তারও ইচ্ছে করছে,কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু, আকস্মিক পেট ব্যথায় হার মানলো মেয়েটা।নবম মাসে এসে কোনো অঘ’টন ঘটুক,এটা স্বয়ং দুআ এবং বাড়িতে উপস্থিত কেউই চাই না।অগত্য দুআ চারিদিকের সুন্দর ডেকোরেশন দেখছে।ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকেরা বেশ পটু।দুআর মতে,তারা উড়ে উড়ে সকল কাজ মুহূর্তেই সাধন করছে।
ব্যথা হালকা কমলে জিয়ার সাহায্যে দুআ সোফা হতে উঠলো।জিয়ার মুখে প্রশ্নের ছাপ,
–“কই যাবে,দুআ ভাবী?”
–“কিচেনে নিয়ে যাবে?তোমার ভাইয়ের জন্যে কেক বানাতে ইচ্ছে করছে।”
জিয়া দুআর পেটের স্ফীত অংশে হাত রাখলো,
–“বাবুকে কষ্ট দিয়ে?”
–“ওখানে চেয়ার টেবিল আছে।বসে বসে কাজ করবো।আহামরি কিছু নয়।মারিয়া সাহায্য করবে আমাকে।তোমার ভাইয়ের বাবুর কোনো ক্ষ’তি আমি হতে দিবো না।”
দুআ হাসলো।খুবই মিষ্টি হাসি মেয়েটার অধরে।জিয়া তার এহেন হাসিতে গললো। যার দরুণ জিয়া মেয়েটাকে হাঁটতে সাহায্য করে রান্নাঘরের অবস্থানরত চেয়ারে বসালো ধীরে,
–“আমি মারিয়াকে ডেকে দিচ্ছি।”
–“শুকরিয়া আপু।”
জিয়া নিজের আঙ্গুল দুআর চিবুকে স্পর্শ করে বেরুলো সেই স্থান হতে।
মারিয়া এলে দুআ তাকে নানান নির্দেশনা দেওয়া শুরু করে। মারিয়াও ভাবীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে বিনা বাক্যে।অনেক সময় সে বড্ড মনোযোগ নিয়ে দেখছে,তার ভাবী কিভাবে কেকের ব্যাটার তৈরি করছে।দুআর হাতের বানানো ডার্ক চকলেট ফ্লেভারের কেক মারিয়ার বড্ড প্রিয়।রাত বিরাতে দুআ যখন ইয়াদের আবদারে এই কেক বানাতো,তখন মারিয়া চুপটি করে তাদের মাঝে উপস্থিত হতো।অতঃপর ভাই ভাবীর আহ্লাদের সমেত তার কেক খাওয়াটাও হয়ে যেতো সহজে।দুআর হাতের রান্না চমৎকার হওয়ায় প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায়ও নানান মানুষের আবদারে সকলের আবদার পূরণ করেছে মেয়েটা।ইয়াদ প্রথম প্রথম রাগলেও পরে দুআর খুশি উপলব্ধি করে কিচ্ছুটি বলেনি মেয়েটাকে।বরং,রান্নাঘরে থাকাকালীন সকলকে দুআর খেয়াল রাখতে বলেছে বড্ড কড়া সুরে।
দুআর কেক বানানোর প্রস্তুতপ্রণালী শেষ হতেই রান্নাঘরে উপস্থিত সার্ভেন্ট দ্বারা সেটা ওভেনে ঠিকভাবে রাখা হয়েছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে দুআ ওড়নায় ঘাম মুছলো।রান্নাঘরের এডজাস্ট ফ্যান থাকলেও মেয়েটা ঘেমে একাকার। পড়নে লম্বা ঢোলা কাপড়ে ঝাপটা দিয়ে বাতাসের সৃষ্টি করছে বারংবার।
–“ম্যাম,রুমে যান।এইখানে আপনি ঘামছেন।”
সার্ভেন্টের কথায় দুআ মাথা দোলালো,
–“জ্বী।একটু ধরুন আমায়।”
দুআর ক্লান্ত কণ্ঠ।
যেতে যেতে মেয়েটা মারিয়াকে নির্দেশ দিল,
–“ত্রিশ মিনিট পরেই কেকটা বাহির করবে।নজর রাখো ওভেনে।টাইমার দেওয়া আছে।”
মারিয়া হেসে মাথা দোলালো;যেনো কাজটা সে পূর্ব হতে জানে,
–“ওকে ভাবী।জিয়া আপুও হেল্প করবে।তুমি রেস্ট নাও।”
রান্নাঘর হতে প্রস্থান করে দুআ নিজের কামরায়।আসার পূর্বে একবার বসার ঘরের দিকে উঁকি দিয়েছিল অবশ্য।সাদা কালোর কম্বিনেশনে রুমটা দেখতে ব্যাপক লাগছে।মনটা তার শান্তিতে ভরে উঠলো।
গোসল সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে,সেই সার্ভেন্ট তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তবেই রুম থেকে বেরিয়েছে।দুআকে একা কেউই ছাড়ে না।
সবেমাত্র চোখ বুজলো দুআ,অমনি রুমে কড়া নেড়ে প্রবেশ করলো জিয়া,
–“দুআ,ভাই ফোন দিয়েছে।”
ভিডিও কল দেখে খানিক ঘাবড়ালো মেয়েটা।অসময়ে গোসলের জন্যে নিশ্চয় এখন ইয়াদ বকবে তাকে! হলোই তা।দুআর দৃশ্য তার সামনে আসতেই ছেলেটা কড়া কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“বেটাইমে গোসল?আবার ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমায়।কি হয়েছে?”
মেয়েটা ভীত সন্ত্রস্ত।ইয়াদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভস্ম হচ্ছে সে।জিয়া দুআর পাশ হতেই চিল্লিয়ে বললো,
–“বকছো কেনো?অযথা ঘ্যান ঘ্যান করবে না,ইয়াদ।”
–“আপু ওর কাশি হলে ভাবছো কি হবে?দুদিন আগে না আইস্ক্রিম খেয়ে গলার অবস্থা খারাপ করে রাত দিন কেঁদেছে?এই অবস্থায় কাশি সহ্য হবে তার!”
ইয়াদ যেনো অগ্নিকুন্ড।
দুআর আঁখিতে অভিমানের জল।লোকটার জন্যে সে কতো কষ্ট করে খাটছে।প্রকাশ করছে না কিছুই। এতো সময় যে মানুষটার জন্যে খেটেছে মেয়েটা,সেই মানুষটাই তাকে এখন কথা শোনাচ্ছে।অভিমানের জল দুইপাশে গড়িয়ে পড়লো।মেয়েটা এই অসময়ে কখনো গোসলে যেতো না।কিন্তু,শোয়ার পূর্বেই বাচ্চার আচমকা আক্রমণে মেয়েটা অস্থিরতায় ঘেমে চুপচুপ হয়েছিল পুনরায়।তাই বিনা দ্বিধায় তার এই অসময়ে গোসলের সিদ্ধান্ত।সব সহ্য করা গেলেও ঘামে আড়ষ্ট শরীরে বসে থাকা অসম্ভব।ধাতস্ত সুরে মেয়েটা আওড়ালো,
–“বাবু পেটে লাথি দেওয়ার কারণে অস্বস্তি হচ্ছিলো।ঘাম শরীরে টানলে ঠিকই আবারও কাশি হতো। আমার কোনো কাজই আপনার পছন্দ না,আমি জানি।”
ইয়াদের রাগ হাওয়া হলো অদূর গগণে।বিনা নোটিশে মেয়েটাকে তিক্ত কথা শুনিয়ে দেওয়ার অপরাধে জর্জরিত ইয়াদ।রাগী ভাব ফেলে ছেলেটার মুখে জমা হলো প্রেয়সীর প্রতি স্নেহ,
–“আমার বাচ্চাটা বেশি কষ্ট দিচ্ছে?আর মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার।”
অভিমানী দুআ নিশ্চুপ।পাশে জিয়া হাসছে মিটিমিটি।
–“এতো রাগ!আচ্ছা আমি বাসায় আসি,এরপর তোমার রাগ আমি আদরে পুষিয়ে দিবো।সেদিনের মতো লাল রঙের নাই..”
দুআর আঁখি চড়কগাছ।এই লাগামহীন মানুষের মুখটা কাঁচির মতো ক্যাচ ক্যাচ করছে। বোন আছে এইখানে,সেটা কি জানা নেই?
–“এই ইয়াদ।আমি আছি।কন্ট্রোল ভাই।”
জিয়ার হাসি শব্দায়মান।
–“চন্দ্র,তুমি বলবে তো রুমে আপু আছে।”
মানবটা ইতস্তত।
–“বেশ ভালো হলো।আমি রাখছি ফোন।আপনার যখন ইচ্ছে বাসায় আসবেন।”
দুআ ফোন এগিয়ে দিলো জিয়ার পানে।তবে তখনো ইয়াদের স্পষ্ট সুর ভেসে আসে,
–“আমার আসতে আসতে রাত হবে,দুআ।”
.
গগণে আঁধার ছেয়ে।কালো আকাশেই মেঘ জমে ধূসর।ঘড়ির কাঁ’টায় নয়টা।সবটা তৈরি। অস্ট্রেলিয়া হতে ইয়াদের,দুআর জন্যে কেনা খয়েরী রঙের গাউন গায়ে চড়ালো দুআ।এই কাপড়ে না আছে কোনো চাকচিক্যের ভাব,না আছে কোনো ভারী পাথরের কারুকাজ।মখমলের কাপড়ের মাঝেই সুতার সুন্দর সাধারণ ডিজাইন।অত্যন্ত ঢোলা হওয়ায় সহজেই দুআর তনুর স্ফীত অংশটাও স্বস্তিতে এঁটেছে সেথায়।সাধারণ সাজে সজ্জিত ইয়াদের প্রেয়সী।এখন শুধু তার প্রিয়তমের অপেক্ষায়।
ঠিকই ইয়াদের আগমন হলো দশ’ঘটিকায়।ঘরের বাইরের পরিবেশ যতটা শান্ত,ভেতরকার পরিবেশ ঠিক ততটা জাকজমকপূর্ণ। ঘরের মাঝে এমন সারপ্রাইজ ইয়াদের নিকট অবিশ্বাস্য।কারণ,ইয়াদ ভেবেছিল দুআকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত; তারা অন্তত এতো খাটনি করবে না।তবে সে ভুল।বাহিরের ধকলে যতটা না ক্লান্ত ছিলো মানবটা,তার চেয়েও বেশি প্রশান্তিতে ফুরফুর হলো তার তনু।প্রিয় মানুষের সামান্য আন্তরিকতা যেনো মরুর বুকে পানির ফোয়ারা।ক্লান্ত অবস্থা দূর হয়ে ইয়াদের দেহে সঞ্চার হলো আবেগ এবং প্রশান্তি।ধীরে সেথায় হেঁটে যাচ্ছে।তার দৃষ্টি গোচরে কেউ নেই।সকলে তৈরি হচ্ছে নিশ্চয়।রান্নাঘর হতে টুকটাক শব্দ বিদ্যমান।বাঁক ঘুরিয়ে সেদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো মস্তিষ্ক।
সেখানেই মস্তিষ্কের হার।ক্রিয়াকলাপ যেনো এই মুহূর্তে বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
চকলেট ক্রিমের সহিত কেক ডেকোরেট করছিল দুআ।লোভ সামলাতে না পেরে সেও কিছুটা ক্রিম মুখে চালান করেছিল হয়তো। যার দরুণ, খয়েরী রং লেপ্টানো অধরের কিনারায় ক্রিমের ছাপ!কেশ ছড়িয়ে রইলো চারদিকে।শুভ্র তনুতে খয়েরী রংটা কি মারাত্মক না লাগছে! অমাবস্যার মাঝে যেনো এক চিলতে রশ্মি এই মেয়ে।
–“চন্দ্রাবতী!”
দুআ কিঞ্চিৎ কাঁপলো।আচমকা ইয়াদ এসে পড়বে সে ভাবেনি।মেয়েটার ধারণা ছিল ইয়াদ আসতে কমপক্ষে রাত এগারোটা হবে।এইযে মাত্রই তো সকলকে তৈরি হতে পাঠিয়েছিল,নিজেকে এই নিরাপদ স্থানে বসিয়ে।কাজের মেয়ে দুটো হলরুমের কাজে।আয়েশ করেই দুআ নির্জনে নিজের কাজ সারার মধ্যে ইয়াদের কণ্ঠস্বর শুনে ব্যাপক অবাক হলো,
–“আপনি,এতো জলদি?”
–“বকেছিলাম,তাই মন টিকেনি সেখানে।যতো দ্রুত সম্ভব চলে আসলাম।কিন্তু, এসে আমি অবাক।ডেকোরেশন যতোই না সুন্দর,তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে আমার সামনে বসা মেয়েটা।এই চন্দ্রাবতী,কেনো এমন রূপের তেজে ঘা’য়েল করো আমাকে?”
ইয়াদের অধর পরপর ছুঁয়ে দিলো মেয়েটার মোলায়েম অধর।তার অধরের পাশে লেপটানো ক্রিম এখন প্রেমিক পুরুষের দখলে।
দুআ হতবিহ্বল।লোকটা কারো পরোয়া করেনা কস্মিককালে।মেয়েটা লজ্জায় নুয়ে।এখন যদি কেউ এসে পড়ে?
দুআ তাকে সরালো ইয়াদের বুকে ধাক্কা দিয়ে,
–“মানে,বুদ্ধিশুদ্ধি নেই?”
–“নো!”
পুনরায় স্পর্শ করলো সেই নিষিদ্ধ স্থান।দুআ কুঁকিয়ে উঠলো।ইয়াদের বাহুতে চিমটি কা’টতেই সরলো মানবটা।
–“ফ্রেশ হয়ে আসি। বাকী হিসাব নিকাশ রাতে হবে।”
পরবর্তীতে প্রেয়সীর পেটে ছুঁয়ে আওড়ালো,
–“বাবা, লাভস ইউ।”
ইয়াদের প্রস্থান ঘটলো।দুআ অবাক দৃষ্টিতে সেথায় চেয়ে।লোকটা বড্ড নিয়ন্ত্রণহীন।আল্লাহ্ সহায় ছিলো বলে আজ ইজ্জত রক্ষা হলো।তবে লোকটার এইসব ভাবনার সময় আছে বলে মনে হয় না দুআর।মলিন হেসে নিজ কাজে পুনরায় মন দিলো মেয়েটা।
____
ছোটখাটো ভাবেই ইয়াদের জন্মদিন পালন শেষ হলো।অনুষ্ঠানের পর,ইয়াদ তার প্রেয়সীর বানানো কেক এবং ছোট এই অনুষ্ঠানের কিছু ছবি শেয়ার করলো সোসিয়াল মিডিয়ায়।আশ্চর্যজনক সেই ছবিতে ইয়াদ আর দুআর যুগল অর্ধ ছবি ব্যতীত,দুআর কোনো ছবি নেই। ইয়াদের কারসাজি সবটা।অবশ্য দুআর মাথা ব্যথা নেই এইসবে।ইয়াদ নিশ্চিত কিছু ভেবেই এমনটা করেছে।
লোকটা ওয়াশরুমে।দুআ সেই ফাঁকে পরিবার পরিজন এবং বন্ধুবান্ধবের সাথে আলাপ সারলো।এই মানুষগুলো দুআর জীবনকে রাঙিয়েছে।সর্বদা,
সবকিছুতেই তাকে উৎসাহ দিয়েছেন,সাহায্য করেছে।ইহকালে তাদের ভোলা দুআর নিকট অসম্ভব।
দেওয়ালে টাঙানো তাদের বিয়ের এবং রিসিপশনের ছবিতে নজর পড়তেই একে একে স্মৃতি তাজা হয় মেয়েটার।
লোকটা তার নিকট অপরিচিত ছিলো,এমন বিখ্যাত লোককে সে জীবনসাথী হিসেবে পাবে এমনটা ভাবাও নিষিদ্ধ ছিল মেয়েটার।অথচ এখন এই লোকটাই তার জীবনের সকল সুখ,দুঃখ,ভালোলাগা,আবেগ সবটা।দুআর ধারণা ইয়াদের অনুভূতি তার চেয়েও প্রবল দুআর প্রতি।
দুআ হাসলো নির্বিঘ্নে।ইচ্ছে করলো ছবিটা ছুঁয়ে দেওয়ার।কিন্তু, সে নিরুপায়।শরীরটা তার বড্ড নাজুক।পেটের কিনারায় চিনচিন পীড়া।তাই দূর হতেই ছবিটায় ফুটে উঠা ভালোবাসাটাই উপভোগের চেষ্টায় রইলো মেয়েটা।
–“কি দেখছো এমন অবাক হয়ে?”
দুয়ার ধ্যান ভেঙেও ভাঙলো না।তার ঘোরমাখা দৃষ্টি ইয়াদের অবয়বে নিবদ্ধ।এলোমেলো কেশে ঢেকে আছে লোকটার ললাট। তাওয়ালের হামলায় কেশযুগল এমন বিদ্ধস্ত।উদোম তনুতে বিন্দু বিন্দু জল।অধর প্রসারিত।এই প্রসারিত অধরেই তো মেয়েটা ম’রিয়া হয়েছিল,মত্ত হয়েছিল লোকটায়।দুজনের নজর মিলতেই তব্দ খেলো দুআ।সরে বসতেই পেটে টান ধরে,ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে মেয়েটা।
তার নিকট ইয়াদের আগমন হলো দৃষ্টির পলকেই,
–“খারাপ লাগছে?”
জবাব দেওয়ার পূর্বেই উদেরর অভ্যন্তরে অবস্থানরত অংশের নড়াচড়া উপলব্ধি করলো দুইজনই। আঁকড়ে ধরা ইয়াদের বাহুতে নখ দাবলো মেয়েটা।অসহনীয় ব্যথার সহিত এই যেনো তীব্র সুখ।
–“আপনার বাচ্চা,আপনার মতোই।অশান্ত।”
ইয়াদ আলগোছে মাথা রাখলো প্রেয়সীর উরুতে।মেয়েটার হাতের আঙ্গুল ইতোমধ্যে ছেলেটার ভেজা চুল ছুঁয়ে।
–“তা ঠিক বললে।আর কয়টা দিন এরপরই বাবার কোলে আসতেই আমার মেয়েটা শান্ত হবে।”
উল্টো হাতে ছেলেটা উদর স্পর্শ করছে প্রেয়সীর।
–“আচ্ছা ইয়াদ,মেয়ের গায়ে যদি আমার মতো দাগ থাকে!সে কি আপনার মতো ভালো মানুষ, এমন জীবনসাথী পাবে?যেমনটা তার মা পেয়েছে!”
ইয়াদ উঠে বসলো।মেয়েটার কথায় গাম্ভীর্য।ইয়াদের সহ্য হলো না সেই গাম্ভীর্যতা,
–“হোক দাগ।দুনিয়ায় যেমন রূপের পূজারী আছে,
তেমন আছে মনের পূজারী।আল্লাহ্ ঠিকই আমার মেয়েটার জন্যে ভালো দিক বিবেচনা করবেন।তোমার এতো ভাবনার দরকার কি?তুমি আপাতত তার বাবাকে নিয়ে ভাবো।”
ইয়াদের দৃষ্টি মাদকতায় ভরপুর।দুআর অন্তর কাঁপে।বিয়ের কতটা সময় পেরিয়েছে।তাও এই অস্থিরতা হ্রাস পায় না।লোকটা কাছে এলো,দুআর শ্বাস ভারী।অনুভব করলো গলার চিনচিন পীড়া।লোকটা তার কার্যসাধন করে মেয়েটার পানে আসক্তি নিয়ে তাকিয়ে।দুআর নজর ঝুঁকে আবার উপরে তুলে।লোকটা পলক ফেলে না।দুআর অবয়বে সেই দৃষ্টি তালাবদ্ধ,
–“মনের মানুষকে জীবনসাথী করার মতো সুখ ইহকালে নেই,চন্দ্রাবতী।প্রত্যেক রাতে,দিনে তোমার এই মুখশ্রী দেখেই আমার পরান জুড়ায়।প্রিয় মানুষের চেহারায় কিসের এতো শান্তি,চন্দ্র?”
–“মনের শান্তি বড় শান্তি।প্রিয় মানুষদের কাছে আমাদের মন থাকে।তাই তাদের দেখলেই মনটা প্রফুল্লতায় ছেয়ে যায়।এর দরুণ,আপনি শান্তি অনুভব করেন।”
দুআ হাসলো সন্তর্পনে।
মেয়েটার গালে ইয়াদ আঙ্গুল ছোঁয়ালো।আবেশে বুঁজে এলো দুআর আঁখি জোড়া,
–“তুমি আমার প্রশান্তি,চন্দ্রাবতী।”
অধরে ঝুলন্ত হাসি বিদ্যমান রেখেই দুআ দুহাত মেললো ইয়াদের সম্মুখে।খেলোয়াড় ছেলেটা দেরী করলো না।সাবধানে বিলীন করলো তার অস্তিত্ব প্রেয়সীর বক্ষদেশে।
ফিসফিস এক সুর প্রবেশ করলো মেয়েটার কর্ণগুহরে,
–“তোমাতেই রবো নিমত্ত ধরণীর অন্তিম অব্দি,
হৃদয়ের গহীনে একফালি সুখ তুমি,চন্দ্রাবতী।”
দুআ আঁখি বুঁজে ইয়াদের কথার গভীরতা আঁচ করলো।সে তার সুখী প্রেমিকা আবার তারই অর্ধাঙ্গিনী।ছেলেটার প্রত্যেক স্পর্শে তীব্র অনুভূতি।মেয়েটা সেই অনুভূতির শীর্ষে।
ইয়াদের ন্যায় প্রত্যেক প্রেমিক পুরুষই নিজস্ব চন্দ্রাবতীতে তাদের মানসিক প্রশান্তির সন্ধানে।এমন মানসিক প্রশান্তির জন্যে হলেও ,সকল প্রেমিক পুরুষ যেনো তাদের কাঙ্খিত চন্দ্রাবতীর সন্ধায় পায়।
….সমাপ্ত…