#আমার_চন্দ্রাবতী-১৯
লেখিকা- সালসাবিল সারা
বাহারি রঙের আলোকসজ্জায় ঝলমলে জমিদার বাড়ি।গ্রামের দুই প্রধান পরিবারের প্রধান সড়ক থেকে বাড়ি অব্দি আলোকসজ্জায় সজ্জিত।নানান নকশার বাহারে আজ বাড়ির নকশা একেবারে অন্যরকম ঠেকছে।জমিদার বাড়ির সকলেই প্রস্তুত একমাত্র ছেলের হবু শশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্যে। সারি সারি গাড়িতে দল বেঁধে ছুটছে জমিদার বাড়ির আত্মীয়রা।
দুআ যতো দ্রুত সম্ভব হাত চালিয়ে সজ্জিত করতে ব্যস্ত নিজের তনু।আত্মীয়রা রওনা দিলো সবেমাত্র আর সে এখনো অপ্রস্তুত।জেনি এটা ওটা করে সাহায্য করছে দুআকে।ভাইয়ের অনুষ্ঠানে দুআর কাজের চাপ ছিলো মাত্রাতিরিক্ত।বাড়িতে উপস্থিত কাজের লোকের মাঝেও আহেলী,দুআ এবং কাকীর কাজের পরিমাণ ছিলো গগণ স্পর্শী।বাড়ির ছেলের অনুষ্ঠানের কাজ নিজেদের পাকাপোক্ত হাতে করাটা শ্রেয় মনে করেন জমিদার বাড়ির বাসিন্দারা। গৃহকর্মীর কাজ আর বাড়ির মানুষের ভালোবাসাময় যত্নশীল কাজের মধ্যে যেনো ব্যাপক অমিল।
ভারী কারুকার্য খচিত জামা পরিধানে হিমশিম খাচ্ছে দুআ।ভার সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বিদ্যমান টুলে নিজের জায়গা করে নিলো সে।জেনি সন্তর্পনে দুআর কেশ সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছে।দক্ষ হাতের কাজে একে একে কালো রঙের ক্লিপ চুলের মাঝে গুঁজে দিয়ে সুন্দর নকশা সাজালো।দুআ মুখশ্রীর ক্লান্তি ভাব আড়াল করতে প্রসাধনীর সাহায্য নিচ্ছে।অতঃপর অল্প সময়ে নিজেকে অনুষ্ঠানে যাওয়ার যোগ্য করে নিলো সে।ভারী কারুকাজ করা ওড়না একপাশে সেফটি’পিন দিয়ে আটকাতেই জেনি পেছন থেকে একগোছা চুল বুকের সামনে ডান পাশে দিয়ে দিলো দুআর।দুআ হাসলো নিভৃতে।
–“মালকিন,আপনারে আজ ব্যাপক লাইগতাছে।নজর না লাগুক কারো,থু থু।”
ইশারায় মুখ থেকে কিছু ফেলার ভনিতা করলো জেনি।
দুআর ঠোঁট পূর্বের অবস্থা থেকে আরো বেশি প্রসারিত হলো,
–“হয়েছে,নাটক করো না।”
জেনি পুনরায় কিছু বললে দুআ আয়নায় উপস্থিত নিজের অবয়ব দৃষ্টিপাত করে লাজুক হাসলো।এতো ভারী কাপড় আর সাজসজ্জিত অবস্থায় কোথাও যায়নি সে পূর্বে। যদিও আত্মীয় স্বজনদের বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলো পূর্বে,সেখানে দুআ ছিলো একেবারে সাধারণ।তবে এই অনুষ্ঠান তো তার বাড়ির অনুষ্ঠান,
একমাত্র ভাইয়ের অনুষ্ঠান।এই অনুষ্ঠানে দুআ কিছুতেই ছাড় দিবে না।অসম্ভব ব্যাপার সেটা।
–“চাঁদ,গাড়ি তৈরি।বেরিয়ে আয়।”
রিজোয়ান দুআর কামরার দরজায় কড়া নেড়ে বললো।
–“আসছি ভাই।”
দুআ দুহাতে জামা তুলে হাঁটা আরম্ভ করলো।দুআর নির্দেশে জেনি দুআর ড্রয়ারে মোবাইল রেখে তালা মেরে নিজেও ছুটলো দুআর পিছু পিছু।ততক্ষণে দুআর ভাই দুআর দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।একহাতে শক্ত করে ধরে রাখলো প্রাণপ্রিয় বোনটার হাত।জেনি অবাক হয়।আপন ভাইবোন না হলেও এদের মাঝে বড্ড মিল-মহব্বত।
গাড়ি চলছে, কিয়ৎ ধীরে আবার দ্রুত।সামনে সারিবদ্ধ অবস্থায় আছে একেকটা গাড়ি।তাদের সাথে তাল মিলিয়েই দুআদের গাড়ি ছুটছে।
সারাদিনের ব্যাস্ততার ভিড়ে প্রেমিক পুরুষের কথা মনে আসলেও, তা নিয়ে ভাবার সময় পায়নি দুআ।ব্যস্ততায়,সব কাজ ঠিক ভাবে করার চিন্তায় বুদ ছিলো মেয়েটা।তবে,এখন দুআ ভাবছে,ঘামছে,অস্থির হচ্ছে।হাতের পাতা ভিজে আছে উত্তেজনায়।প্রেমিক পুরুষের সাথে কি আজ সাক্ষাৎ হবে মানবীর?জানেনা সে।কাউকে জিজ্ঞেস করেনি লজ্জায়।যদি কিছু ভাবে?সেদিনের পর লোকটা আর ফোন দেয়নি।সেই প্রেমিক পুরুষের খবর নিজ থেকে নেওয়ার সাহস পায়নি দুআ।বড্ড ভীতু যে মেয়েটা!
দুআ ভেবে পায় না,আজ যদি ইয়াদ আসে কিভাবে নিজেকে তার সামনে উপস্থিত করবে?এখন যে তাদের সম্পর্কটা আর আগের মতো নেই।যদিও দুআ এখনো নিজের অনুভূতি নিয়ে ঘোরে আছে,তবে তার প্রতি ইয়াদের অনুভূতিটা একদম পাকাপোক্ত।লোকটার কথায় আন্দাজ করতে পারে রমণী,তার প্রতি যথেষ্ট পরিমাণ দিওয়ানা তার প্রেমিক পুরুষ।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, উত্তেজিত হচ্ছে দুআ।গন্তব্যে পৌঁছাতেই অস্থির হয়ে উঠলো মেয়েটা।লজ্জায়,
সংকোচে তার জান যায় যায় অবস্থা।এতদিন পর লোকটাকে দেখবে বলে মনে স্বস্তি অনুভব করলেও,তার ভেতরটা ক্ষ’ত বিক্ষ’ত হচ্ছে লাজ লজ্জায়।
মানুষে ভরপুর বাড়ি।সবাই বিস্ফোরিত নজরে দৃষ্টিপাত করছে অনুষ্ঠানের মধ্যমনিদের পানে।দুআ ভাইয়ের হাত ধরেই এগুচ্ছে ভেতরে।দৃষ্টি তার নিচের দিকে।লম্বা আয়তনের জামা সামলানোতে ব্যস্ত সে।ভেতরে যেতেই আলাদা হলো ভাই থেকে।উদ্দেশ্য, রামিসা এবং মাহিকে খোঁজা।মাইশা থেকে জানলো রামিসা তার কামরায় এখনো।জেনি দুআর সাথেই আছে, তাকে সামলানোর কড়া নির্দেশ দিয়েছে আহেলী।দুআর হেয়ালি মন খুঁজে চলেছে ইয়াদকে।কিন্তু, মানুষটার ছায়া অব্দি দৃষ্টিতে এলো না।তবে কি মানুষটা এলো না আজ?মুহূর্তেই কালো মেঘ ছেয়ে গেলো মনের অন্তরালে,খুবই গহীনে।ঘোলা ঘোলা হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি।মানবটার সাথে কথা বলার ব্যাপক ইচ্ছা জেগেছে আজ দুআর মনে।হাজার হলেও,দুআ জানে সেই লোকটি তার প্রেমিক পুরুষ।
জেনি বিদ্ধস্ত দৃষ্টিতে চারিদিকে আন্দাজ করতে লাগলো।মেয়েটার দৃষ্টি যেনো শকুনের দৃষ্টি।দুআর প্রতি অন্য পুরুষ এবং মহিলার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না জেনির নজর থেকে।অতঃপর জেনি মুখ কুঁচকে বললো,
–“এই মানুষগুলার কোনো কাম নাই নাকি?মালকিনের দিকে এমনভাবে চাইয়্যা আছে।আমার মালকিনের উপর যদি নজর লাইগা যায়, একটারেও ছাড়ুম না আমি।অমাইনষের দল সব।”
–“কি বিড়বিড় করছো,জেনি?”
দুআর প্রশ্নে জেনি নিজেকে সামলে নিলো।দুআ এইসব জানলে নিশ্চয় ঘর থেকেই বেরুবে না আর।তার মালকিন যে বড্ড নাজুক!সবকিছুতেই মেয়েটা ভয়ে অস্থির হয়ে যায়।
–“নাহ নাহ,কইতেছিলাম সুন্দর আয়োজন করলো এইহানে।”
দুআ হাসলো কেবল,উত্তর দিলো না কোনো।
কামরায় পৌঁছাতেই দুআর চোখ চড়কগাছ!এই কাকে দেখলো সে?জিয়া এবং মারিয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে বিছানায়।দুআকে নিজের দৃষ্টির সীমানায় পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠলো মারিয়া,
–“চাঁদ আপু?”
দু’জন দুজনকে আলিঙ্গন করলো শক্তভাবে।জিয়া ক্লান্তিভাবে হাত নাড়ালো বিছানা থেকেই।দুআ ইশারায় মাথা নাড়ালো।
–“কেমন আছো, মারু?”
–“অনেক অনেক ভালো।এতক্ষণ টায়ার্ড ছিলাম, এখন একেবারে ক্লান্তিহীন।একটু আগেই পৌঁছিয়েছি আমরা।ফ্লাইটে এসেছি,তাও যেনো রাজ্যের ক্লান্তি ভিড় করেছে।”
দুআ মারিয়ার চিবুকে হাত বুলালো,
–“রেস্ট নাও তবে।”
–“এতক্ষণ নিয়েছি।এখন আমি তোমার সাথেই থাকবো চাঁদ আপু।”
–“আচ্ছা।”
দুআ হাত বুলিয়ে দিলো মারিয়ার মাথায় আদুরে ভাব নিয়ে।
সবাই এসেছে!তার মানে কি খেলোয়াড় মানুষটা কি এসেছে এইখানে?প্রশ্ন উঁকি দিলো মনে।তবে মুখে আওড়ালো না কিছু।
রামিসা এখনো তৈরি হতে ব্যস্ত।মাহি তার পাশে বসে রমিসার কান্ড কারখানা দেখছে।দুআ তাদের নিকট যেতেই বসে পড়লো মাহির সম্মুখে।
মারিয়া হেয়ালি ভাব নিয়ে ফোনে ধ্যান দিলো সম্পূর্ণ।
–“তোর খেলোয়াড় সাহেব এসেছে।”
ধ্বক করে উঠলো দুআর অন্তর।কানের মাঝে ভোঁতা শব্দ শুনলো যেনো।সত্যি তার প্রেমিক পুরুষ এসেছে!খুশিতে,আনন্দে, লাজে অস্থির হয়ে উঠলো তার ছোট্ট হৃদয়।পাশে মারিয়ার দিকে দৃষ্টি পড়তেই,দুআ ইশারায় চুপ করতে বললো রামিসাকে।
–“বাচ্চা মানুষ বুঝবে না,আজব।আর জিয়া আপু অনেক দূরে খাটে শুয়ে আছে।আমাদের শব্দ তার কান অব্দি পৌঁছাবে না।আর তোর জেনি তো সেই অনেক দূরে জানালার ধারে,আজব।”
মাহি দাঁত কেলালো।
–“কিসব শুরু করেছিস তোরা?”
খানিক লজ্জা পেলো যেনো দুআ।
–“কি আর বলবো?আমার তো মাথা ঘুরে যাচ্ছে ইয়াদ ভাইকে দেখে।এতো আকর্ষণীয় লাগছে উনাকে।পাঞ্জাবি পড়েছে।ধূসর রঙের।উনাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যাস না আবার।”
মাহির নির্দেশনা অনুযায়ী মনে মনে ছবি একে ফেললো দুআ তার প্রেমিক পুরুষের।কল্পনার ছবিতে ব্যাপক লাগছে ইয়াদকে।না জানি তাকে সরাসরি দেখে টিকতে পারবে কিনা মেয়েটা।নাকি সেদিনের মতো উত্তেজনায় আজও মূর্ছা যাবে ইয়াদের চন্দ্রাবতী?
–“আমাকে কেনো বলছিস?আমি উনার সামনে যাবো না এমনিও।”
দুআ গলার স্বর মৃদু।কিন্তু, তার স্বরে বুঝা যাচ্ছে;
মেয়েটার স্বর কাঁপছে।আচ্ছা,মেয়েটা কি অতিরিক্ত লজ্জা পাচ্ছে?
–“কেনো যাবে না আপু?জানো ভাইয়া আজ বেরুনোর আগে,ভাইয়ার পরিহিত পাঞ্জাবি দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিলো,’ তোমার দুআ ভাবী আমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার দিকে তাকাতে পারবে তো লজ্জায়?পারবে না মনে হচ্ছে।মেয়েটা ভারী লজ্জাবতী।’ আর তুমি বলছো আমার ভাইয়ের সামনে যাবে না?জানো,
আমার ভাইয়া রোজ তোমার কথা বলে আমায়।তুমিই আমার ভাবী হবে।আমার ভাইয়ার একমাত্র দুলহান।”
অক্ষিকোটর ভেদ করে যেনো বেরিয়ে আসবে দুআর সুন্দর চোখজোড়া।এই লোককে যতটা সাংঘাতিক ভেবেছিলো,তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি সাংঘাতিক লোকটা।নাহলে এইসব কথা কেউ তার হাঁটুর বয়সী বোনকে বলে?সারা শরীরে অদ্ভুত কাঁটা দিয়ে আসছে দুআর।লজ্জায় হাত পা কেমন যেনো নড়ছে আপনাআপনি।এতো লজ্জা ইহকালে দুআ কখনো অনুভব করেনি একটিবার।
———————–
জিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল।তাকে জাগিয়ে সকলে মিলে নিচে নামার হই হুল্লোর লাগালো।একঝাঁক পরীর দল যেনো সিঁড়ি ভেঙে পাতালে নিজেদের অবস্থান দখল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ভিড়ের মাঝে ছিলো ইয়াদ।তার পাশে দুইজন বডি গার্ড।তাদের নির্দেশে এখন সাধারণ মানুষ বা আত্মীয় কেউ ইয়াদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসছে না।গার্ড দুজন সরে দাঁড়ালো পাশে।ইয়াদ এখন ঝামেলামুক্ত।
ভেতরটা স্বস্তি পেলেও নজরটা অস্থির হয়ে উঠলো সিঁড়ির ডান দিকের রমণীকে দেখতে পেয়ে।এতমাসের অপেক্ষার পর প্রেয়সীকে চোখের সামনে দেখে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে সবকিছু।তার উপর মেয়েটার বেশভূষা,অলংকার সবটা ইয়াদকে মাতাল করতে বাধ্য।হিম হয়ে আসে শরীর।প্রেয়সী হাসছে,মুখে হাত রাখলো মেয়েটা সন্তর্পনে।কি মায়াবী সেই হাসি!ইয়াদকে এখনো দেখতে পায়নি দুআ,দেখলে হয়তো আর একটিবার ইয়াদের পানে ভুলেও চেয়ে দেখতো না সে!
এতো মানুষের সম্মুখে দুআর সাথে কখনোই প্রাণখুলে কথা বলতে পারবে না ইয়াদ।মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে তার।প্রেয়সীর সাথে এই মুহূর্তে আলাপ করা ব্যাপক জরুরি।কতদিন দেখেনি সে মেয়েটাকে!বুকটা হাহাকার করছে।মরুভূমির মতো শুকিয়ে পড়লো নিমিষেই।এই মরুভূমিতে পানি দরকার ইয়াদের।দুআ নামক পানি।ইয়াদ মোবাইল বের করলো।স্ক্রিনে দ্রুত আঙ্গুল চালিয়ে রামিসার মোবাইলে মেসেজ পাঠাতে দেরী করলো না সে।
দুআ তার পানে দৃষ্টি জ্ঞাপন করার পূর্বেই ইয়াদ সরে গেলো নিভৃতে।
রামিসার ঠোঁটে হাসি ঝুলন্ত।ভাইয়ের মেসেজ পড়ে সবটা বুঝে নিলো দক্ষতার সমেত।
–“এই দুআ,পেছনের দিকে আয়।একটা জরুরী কাজ আছে।”
দায়িত্ববান দুআ,সাত পাঁচ না ভেবে রাজি হয়ে গেলো নিমিষেই।
–“আমার যাওয়া লাইগবো মালকিন?”
–“আমিও কি যাবো?”
জেনি এবং মারিয়ার প্রশ্নে রামিসা মাথা নাড়ালো,
–“নাহ।ব্যক্তিগত কাজ।মাহি তুই এদের সামলিয়ে রাখ।আমি একটু আসছি।”
রামিসার ইশারা বুঝতে বেগ পেতে হলো না মাহির,
–“অবশ্যই আমি আছি।তোরা সময় নিয়ে কাজ কর,আজব।”
দুআর হাত চেপে হাঁটতে আরম্ভ করলো রামিসা।বাড়ির পেছনের দিকে যেতে এখনো সময় বাকি আছে।বাড়িটা যে বিশাল!দুআর তৃষ্ণার্ত নজর চারিপাশে খুঁজে যাচ্ছে কাঙ্খিত মানুষকে।তার দেখা না মিললে, লাজ লজ্জাকে মাটি দিয়ে রামিসাকে সে প্রশ্ন করলো,
–“তোর ইয়াদ ভাই কোথায়?উনাকে দেখছি না যে?”
রামিসা মনে মনে হাসলো দুআর অগ্রগতি আন্দাজ করে।তবে নিজেকে সে শক্তভাবে পেশ করলো।দুআর সাথে এই বিষয়ে কোনো আহ্লাদ করলো না ,
–“এসেছে তো।”
–“দেখছি না কেনো?”
–“দেখবি।হয়তো ব্যস্ত!”
দুআ আর কিছু আওড়ালো না।ইয়াদ এইখানে ব্যস্ত কেনো হবে এই ব্যাপারে আর জিজ্ঞাসা করলো না সে।এইখানের সব কাজ তো মাইশার পরিবার এবং কাজের লোকরা সামলাচ্ছে।তাই এইখানে ইয়াদের ব্যস্ততার কথাটা মাথায় এলো না মেয়েটার।পরক্ষণে ভাবলো,
বিখ্যাত খেলোয়াড় হয়তো তার ফ্যান ফলোয়ার নিয়ে ব্যস্ত!হ্যাঁ,এটাই হবে মূল কারণ।
পেছনের দিকে হট্টগোল নেই।নেই কোনো মানুষের আগমন।সবার যেনো এই স্থানে আসা বারণ!পেছনের দিকের পুকুরের পানি চিকচিক করছে মরিচ বাতির আলোয়।বড় বড় গাছের সাথে ঝুলছে বাহারি রঙের মরিচা বাতি।
–“এইখানে কি কাজ?”
দুআ প্রশ্ন করলো।
–“ঐ দেখ।”
রামিসার আঙ্গুলের ইশারায় দৃষ্টি ঘোরালো দুআ।বড় গাছটার পাশেই লম্বা মানবের ছায়ামূর্তি।ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তারই দিকে।আলোয় এসে স্পষ্ট হচ্ছে মানবের আকর্ষণীয় অবয়ব।অতঃপর সামনে এলো ইয়াদ।চন্দ্রাবতীর সম্মুখে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো প্রেমিক পুরুষ।প্রেয়সীর আঁখিতে চমক দেখতে দারুণ লাগছে তার।
–“তোমরা কথা বলো,আমি দরজার আড়ালে আছি।”
রামিসা চলে যাচ্ছে।দুআর গলায় যেনো পাথর ঢালায় করা।রামিসাকে আটকানোর মতো বুলি পেটে এলেও মুখে আসলো না কিছুতেই।রামিসার অবয়ব অদৃশ্য হলো।এগিয়ে এলো প্রেমিক পুরুষ।দুআর সম্মুখে, খুব একটা দুরত্বে না।সর্বপ্রথম হাত রাখলো সে মেয়েটার থুতনিতে।দুই আঙ্গুলের সাহায্যে মেয়েটার নিচু মুখটা উপরে তুললো অতি যত্নে,পরম আদরে।
–“তাকাবে না?”
ইয়াদের প্রশ্নে তনুটা বুঝি কম্পিত হলো।চোখ খিচঁলো আরো প্রগাঢ়ভাবে।মাথা দোলালো দুদিকে।যার অর্থ – না,এই চোখ সে খুলবে না।
–“কেনো?আমাকে দেখে খুশি হওনি?”
চট করে আঁখি জোড়া খুললো ইয়াদের প্রেয়সী।আলোয় মেয়েটার চোখ জ্বলজ্বল করছে।
ইয়াদের মুখশ্রীতে দুআর বেহায়া আঁখি তান্ডব চালিয়ে ফেললো বিনা দ্বিধায়।লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়ি সুন্দর করে বিন্যস্ত হয়ে আছে মুখশ্রীতে।অথচ আগের বার লোকটার মুখে কোনো দাড়ি ছিলো না।তার চেহারার পরিবর্তন হলো না।পূর্বের ন্যায় ভয়ংকর সুন্দর লাগছে মানবটাকে।দৃষ্টিতে তার দুআকে দেখার আকুলতা স্পষ্ট।ইয়াদের দৃষ্টি যেনো অক্ষরে অক্ষরে প্রশ্ন করছে,’আমার পূর্ব প্রশ্নের জবাব দেওয়া কি খুবই কঠিন?’
নিজেকে সামলে নিলো দুআ।লজ্জার আবরণ মুড়িয়ে নিয়েছে সে।এই আবরণ হালকা সরিয়ে নিচু গলায় দুআ উত্তর দিলো,
–“খুশি হয়েছি।”
ব্যস!ইয়াদের মনে প্রশান্তির ঝাপটা ছুঁয়ে গেলো।ব্যস্ত আঁখিতে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করছে সে।লাজুক মুখে কুঁকড়ে আছে মেয়েটা।
–“তুমি কি ভাবতে পারো,আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি?তুমি কি জানো,প্রতিরাতে তোমাকে নিয়ে হাজার স্বপ্ন সাজাই আমি?আরেকটু বড় হলে কি বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?এইযে এখন তোমাকে বিয়ে করতে শত বাঁধা।কেনো? শুধু তোমার বয়স কম বলে।কিন্তু,
আমাকে দেখো!আমি অস্থির,আমি ছটফট করছি,শুধু তোমার জন্যেই।আমি তোমায় মত্ত, দুআ।”
ইয়াদের কথাগুলো যেনো সুর তুলে গান করছে দুআর কর্ণগহ্বরে।এতো ভালোবাসার বিনিময়ে দুআর পাথর মন বাধ্য হচ্ছে লোকটার ভালোবাসায় সাড়া দিতে,খুব করে ইচ্ছা করছে ইয়াদের জন্যে পরিবর্তিত অনুভূতির নাম “ভালোবাসা” দিতে। এমন ভালোবাসার সন্ধানেই তো ছিলো দুআর ছোট্ট মনটা!
হালকা পবন ছুঁয়ে গেলো দুই মানব মানবীর সত্তায়।অবাধ্য চুল এসে হানা দিলো দুআর মুখমন্ডলে। কুঁচকে উঠলো দুআর মসৃণ ভ্রু জোড়া।পছন্দ হলো না প্রেমিক পুরুষের।এই সাজের সাথে প্রেমিকার মসৃণ ভ্রু জোড়া তার কাছে অতি মানানসই ঠেকলো। আঙ্গুলের ডগার সাহায্যে সরিয়ে দিলো অবাধ্য কেশকে।ভ্রু জোড়া সটান হলো দুআর।সামনের মানবটা তার অতি নিকটে।হনহনিয়ে বেড়ে উঠলে হৃদ স্পন্দন।
ছোট্ট স্বরে শুনতে পেলো খেলোয়াড়ের কণ্ঠ,
–“এমন ভারী সাজে আমার সামনে ভ্রু কুঁচকানো মানা।”
দুআর মুখে লাজুক হাসি।এই হাসিতেই খু’ন হয় প্রেমিকের পূর্ব বি’ক্ষত হৃদয় পুনরায়।
–“এইভাবে হেসো না।আমি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যাচ্ছি,চন্দ্র।আমি চাই,তুমি ধীরে ধীরে আমাতে মত্ত হও।কোনোরূপ জোর করবো না আমি।তবে, আমাতেই মত্ত হতে বাধ্য তুমি।এই জেদী মানুষটা যে কিছুতেই আর ছাড়বে না তোমাকে।আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।আমার ধরণীর একান্ত চাঁদ তুমি,আমার চন্দ্রাবতী তুমি।”
ইয়াদের আঁখিতে ভালোবাসার উত্তাল চাহনী বিদ্যমান।দুআ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।সরাসরি এমন আবেগী প্রেম নিবেদন কি করে ঠেকাবে সে?মুহূর্তেই যে তার পাথর হৃদয় ভেঙে গুড়ি হলো।মনটা ইয়াদের প্রেমে ঝাঁপ দিলো বিনা সংকোচে।এই মানবকে ভালোবাসলে কোনো ক্ষতি নেই হৃদয়ের,তার জন্যে শুধু যেনো সুখের ফোয়ারা এই মানব।
–“চলুন।সবাই অপেক্ষা করছে।”
অন্তর খানায় ইয়াদের নামে লিখিয়ে মুখে আওড়ালো অন্য কথা।ইয়াদকে প্রেম নিবেদন করা ইহকালে দুআর জন্যে সম্ভব কিনা জানা নেই তার।
ইয়াদ চেয়ে রইলো মানবীর দিকে উচ্ছ্বাসিত দৃষ্টিতে।এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করা অতীব জরুরী।দুআর দ্রুত শ্বাস নেওয়াটা ইয়াদের মনে অন্য চাহিদার জানান দিচ্ছে।এই মুহূর্তে ইয়াদের থেমে যাওয়া মুখ্য।
–“চলো।”
গম্ভীর কণ্ঠ তার।
দুআ মাথা নাড়িয়ে সম্মুখে কদম ফেলতেই জামার নিচে পড়লো তার কদম। হোঁচট খেয়ে পড়তে নিলেই দুআর বাহু টেনে ধরলো ইয়াদ।পড়তে গিয়েও পড়লো না দুআ।বলিষ্ঠ হাতের অধিকারী তাকে বাঁচিয়ে ফেললো।
–“দেখে হাঁটো।তাড়াহুড়োর কি?”
–“খেয়াল করিনি।”
দুয়ার কণ্ঠে অনুতাপ।
হঠাৎই অনুভব করলো ইয়াদের হাতের তালু দুআর হাতের মুঠোয়।ইয়াদের হাত জোড়া বরফের ন্যায় ঠান্ডা।বুকের ভেতরকার হাহাকার বাড়লো রমণীর।হাত ছাড়াতে নিলে,এর বিপরীতে কিঞ্চিৎ চাপ অনুভব করলো হাতে।
–“এইসবের অভ্যাস করে নাও।তোমার হাত ধরা আমার অধিকারে মাঝে পড়ে।ধীরে ধীরে এইসবে সহজ করো নিজেকে।আমি সময় দিবো তোমায়।নিজেকে অভ্যস্ত করে নাও এইসবে।ইয়াদ তোমার জন্যে হবে অতি রোমাঞ্চকর প্রেমিক পুরুষ।এই চন্দ্রৌজ্জ্বল রাতে কথা দিচ্ছি,তুমি একান্তই ইয়াদের সহধর্মিণী হবে।”
চলবে…..