#আমার_ভুল,পর্বঃ১
অরিত্রিকা আহানা
আমার শৈশব কেটেছে পারিবারিক শাসন এবং অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। পড়াশুনা, খেলাধুলা সব কিছুতেই ছিলো নিয়ম মাফিক জীবনযাত্রা। একেবারে বাঁধাধরা নিয়ম যাকে বলে মোটামুটি সেরকম। তবে আদর যে পাই নি তাও নয়। দুইভাইয়ের একটি মাত্র বোন আমি। আব্বার একমাত্র আদরের কন্যা। দুহাত ভরে ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই ভালোবাসা কেবল আমাদের রক্ষণশীল পরিবারের সীমারেখা পর্যন্তই আবর্তিত ছিলো। এর বাইরে, নিয়মের বেড়ি শৃঙ্খল ভাঙ্গার সুযোগ কখনো হয় নি। আব্বা দেন নি।
এই নিয়ে অবশ্য আমার খুব বেশিই আফসোসও হয় না। পড়াশুনা নিয়েই আমার জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ কেটে গেছে। জাগতিক চিন্তাভাবনা সব ক্যারিয়ারকে কেন্দ্র করেই ছিলো। মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করা ছাত্রী আমি।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বাকি আর তিনমাস। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা বই নিয়ে পড়ে থাকি। যে করেই হোক পূর্বের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাইরে বেরোনো বন্ধ। এরমাঝে হঠাৎ আমার এক বান্ধবীর বিয়ে ঠিক হলো।
পাঁচবান্ধবীর একটা গ্রুপ আছে আমাদের। একেবারে বাচ্চাকাল থেকে ওদের সঙ্গে আমার সখ্যতা। যদিও স্বভাব চরিত্র, পড়ালেখা সব দিক থেকেই চারজন আমার বিপরীত। তবুও ওদের সঙ্গেই আমার উঠাবসা।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে কম করে তিনচার খানা প্রেম করেছে আমার এই তিন বান্ধবী। কয়েকবার পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যানও করেছে। কিন্তু আমার আর প্রাপ্তির জন্য সফল হতে পারে নি। প্রেম ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি আর প্রাপ্তিই অনাগ্রহী ছিলাম। আমাদের একটাই কথা, যাই হয়ে যাক না কেন পরিবারের মুখে চুনকালি দেওয়া যাবে না।
পড়ালেখায় বাকি তিনজনের মত প্রাপ্তির অবস্থাও নবডঙ্কা। মনোযোগ নেই বললেই চলে। প্রেম না করলেও বাকি তিনজনের সাথে আমার অগোচরে বেশ তাল দিয়েছে।
এখন স্বভাবতই, প্রশ্ন আসতে পারে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়ে আমি কি করে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়লাম?
উত্তরটা খুবই সিম্পল। আমি আগেই বলেছি ওদের সঙ্গে আমার বাচ্চাকাল থেকে সম্পর্ক। সেই ছোটবেলা থেকে পাঁচজন একসঙ্গে বড় হয়েছি। স্কুল কলেজ সব একসাথে পার করেছি।
তাছাড়া সঙ্গদোষে লোহা ভাসে এই কথাটি বোধহয় আমার বেলায় প্রযোজ্য নয়। আমার বেলায় ‘আপনি ভালো তো, জগৎ ভালো’ কথাটিই বেশ খাটে।
যাইহোক, সেসব কথা থাক। আপাতত বান্ধবীর বিয়ের আলোচনায় যাই। আব্বা কিছুতেই আমাকে বিয়েতে যেতে দেবেন না। পরীক্ষা সামনে। তিনদিন বাসার বাইরে থাকতে হবে এটা আব্বা মানতে পারছিলেন না। পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে!
উপায়ান্তর না পেয়ে চার বান্ধবী আমাদের বাসায় চলে এলো আব্বাকে রাজি করানোর জন্য। মা আর ভাবী মিলেও অনুরোধ করলেন। অনেক কাকুতিমিনতি পর আব্বা রাজি হলেন। এংগেইজম্যান্ট এর দিন সকালেই প্রাপ্তিদের বাসায় চলে গেলাম।
কিন্তু সেখানে গিয়ে বন্ধুমহলে আঁতেল, বইপোকা, মুখচোরা খেতাবপ্রাপ্ত ‘আমি’ টাকে বেশ বিপাকে পড়তে হলো। বাকি চারজনের মত হৈহৈ রৈ রৈ করে সবার সঙ্গে মিশতে পারলাম না। রান্নাঘরে আন্টির কাজে সাহায্যই করাই ছিলো আমার একমাত্র স্বাচ্ছন্দ্যের কাজ।
★
এংগেইজম্যান্ট দিন দুপুরবেলা,
আমার বান্ধবী প্রাপ্তিকে ড্রয়িংরুমে দুলাভাইয়ের পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমার বাকি তিন বান্ধবী সেখানেই আছে। দুলাভাইয়ের বন্ধুবান্ধবরাও সবাই আছে। দুপক্ষের রঙ্গতামাশা বেশ চলছে। দুষ্টুমির দিক থেকে কে কাকে হারাতে পারে সেই প্রতিযোগীতা। আমি ছেলেদের ব্যাপারে বরাবরই আনাড়ি। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলাম না। আন্টিকে সাহায্য করার ছুঁতোয় রান্নাঘরে চলে এলাম।
আন্টি ট্রে তে এক এক করে নাশতা সাজিয়ে দিয়েছেন। আমি সেগুলো প্রাপ্তির ছোট ভাই প্রান্তর হাতে তুলে দিচ্ছি।
প্রাপ্তিদের বাসায় এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি আমি। বাসা চেইঞ্জ করে ফেলায় এবার প্রায় দুবছর পরে আসা। প্রাপ্তিরা চারভাইবোন। প্রান্ত সবার ছোট। ক্যাডেটে পড়ছে। ওর সঙ্গে চারবছর বাদে আমার দেখা। বেশ বড় হয়ে গেছে। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বড় দেখাচ্ছে।
আমাকে হাঁ করে ওর তাকিয়ে থাকতে দেখে বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলো নাশতা সব রেডি আছে কিনা। আন্টি চুলায় বিরিয়ানি বসিয়েছেন। সেটা নিয়ে ব্যস্ত। ওর কথা শুনতে পান নি। আমি নাশতা সাজিয়ে রাখা দুটো ট্রে ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম,’আরো আছে। আগে এগুলো দিয়ে আয়।’
বান্ধবীর ছোট ভাই। ‘তুই’ বলাই যায়। তাছাড়া এই ছেলের সঙ্গে ছোটবেলায় আমার অনেক ঝগড়া হয়েছে। প্রাপ্তি সঙ্গে করে আমাদের বাসায় নিয়ে গেলে ধুমিয়ে ঝগড়া করতাম দুজনে। অনেকটা আন্তরিকতা থেকেই ‘তুই’ করে বললাম। প্রান্ত ট্রে হাতে নিয়ে হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওর পেছন পেছন প্রাপ্তি এসে দাঁড়িয়েছে। প্রান্তর হাত থেকে ট্রে দুটো নিয়ে মুচকি হেসে বললো,’আমার কাছে দাও ভাইয়া আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ভেতরে যাও।’
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। প্রাপ্তি প্রান্তকে ভাইয়া ডাকা শুরু করলো কবে থেকে?
মূল ঘটনাটা হচ্ছে, এতক্ষণ আমি যাকে প্রান্ত ভেবে ভুল করেছি উনি আসলে প্রাপ্তির বড়ভাই প্রিন্স। প্রাপ্তির বিয়ে উপলক্ষ্যে বাসায় এসেছে। এর আগে উনাকে কখনো দেখি নি। তাই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি। উনি প্রাপ্তির হাতে ট্রে দিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে গেলেন।
আমি করুণ মুখ করে প্রাপ্তির দিকে চাইলাম। প্রাপ্তি হেসে ফেললো। আমাকে আশ্বস্ত করে বললো,’কিচ্ছু হবে না। ভাইয়া কিছু মনে করবে না।’
-‘আমি ভেবেছি প্রান্ত।’
প্রাপ্তি আমার অসহায় মুখ দেখে পুনরায় সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
-‘আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলবো।’
ড্রয়িংরুমের পাশ দিয়ে প্রান্ত হেঁটে যাচ্ছিলো। হাতে ফোন। গেইমস খেলছে। প্রাপ্তি ওকে ডাক দিলো। হাত দিয়ে নিজের সিল্কি চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে এগিয়ে এলো প্রান্ত। প্রাপ্তি ওর হাতে ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘যা। ড্রয়িংরুমে দিয়ে আয়।’
আমি প্রান্তকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করছিলাম। প্রাপ্তি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,
-‘ও হচ্ছে প্রান্ত।’
প্রান্ত ট্রে হাতে নিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো,
-‘হ্যাঁ। তো?’
আমি আর প্রাপ্তি দুজনেই হেসে ফেললাম। প্রাপ্তি বললো,
-‘কিছু না। ও ভাইয়াকে তুই ভেবে ভুল করেছে। তাই তোকে চিনিয়ে দিলাম।’
প্রান্ত ভদ্র ছেলে! আমি লজ্জা পেয়েছি বুঝতে পেরে ড্রয়িংরুমে চলে গেলো। আমি প্রাপ্তির রুমে গিয়ে বসে রইলাম।
★
প্রাপ্তির রুমে শুয়ে শুয়ে গান শুনছিলাম। ভালো লাগছে না। ড্রয়িংরুমে বান্ধবীরা দুলাভাইয়ের বন্ধুদের সঙ্গে লুডু খেলছে। আমার ইচ্ছা করছিলো না তাই রুমে শুয়ে আছি। প্রান্ত কোক খেতে খেতে ভেতরে এসে ঢুকলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে হাসি দিয়ে বললো,’কেমন আছেন আপু?’
আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। জড়তা কাটিয়ে মুচকি হেসে বললো,’ভালো আছি।’
প্রান্ত ছোটবেলায় আমাদের দুজনের দুষ্টুমির কথা মনে করে আরেকবার হাসলো। তারপর বললো,
-‘দুলাভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?’
-‘হ্যাঁ। সকালে আমরা সবাই একসাথে নাশতা করেছি।’
-‘দুলাভাই আর্মি অফিসার। ভাইয়ার পরিচিত। এইজন্যই আব্বু আর না করে নি।’
-‘শুনেছি প্রাপ্তির কাছ থেকে। ভালোই হয়েছে। তোমার কি খবর? পড়াশোনা কেমন চলছে?’
এবার আর ‘তুই’ করে ডাকার সাহস পেলাম না। এক ভাইকে তুই ডেকে যেই মুসিবতে পড়েছি আরেক ভাইকে দিয়ে সেটা আর নিজের স্মরণে আনতে চাইলাম না। প্রান্ত আমার দিকে কোকের ক্যানটা এগিয়ে দিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো খাবো কিনা। আমার না করলাম।
প্রান্ত পড়ালেখার প্রসঙ্গ টেনে বললো,
-‘প্রচুর খাটায় কলেজে আপু। আমার তো বাড়ি আসলে যেতেই মন চায় না।’
প্রাপ্তিরা সব ভাইবোনই ট্যালেন্টেড। কেবল প্রাপ্তিটা হয়েছে ফাঁকিবাজ। পড়াশোনা মন নেই বললেই চলে। তাই বাধ্য হয়ে আংকেল বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।
প্রান্ত চলে যাওয়ার দুমিনিটের মাথায় প্রাপ্তি এসে ভেতরে ঢুকলো। আমাকে টেনে বের করে নিয়ে গেলো। সেখানে বসে কিছুক্ষণ সবাই আমার আঁতলামো নিয়ে মজা নিলো। আমি বিব্রত ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে রইলাম। আর মনে মনে নিজেকে গালি দিলাম কেন এই বিয়েতে এসেছি।
গল্পগুজবের মাঝখানে প্রিন্স ভাইয়া আর আংকেল এসে ভেতরে ঢুকলেন। দুজনের হাতেই বাজারের ব্যাগ। প্রান্ত দৌড়ে গিয়ে আংকেলের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে নিলো। প্রাপ্তির হবু বর মানে সাফিন ভাইয়াও নিতে চাইলো কিন্তু আংকেল দিলেন না।
উনারা ভেতরে ঢুকে গেলে আমি ফিসফিস করে প্রাপ্তিকে বললাম,’চল রান্নাঘরে যাই। আন্টি একা একা কাজ করছেন।’
প্রাপ্তি আমার হাতে আলতো চাপড় মেরে বললো,’যাহ্ পাগল! তুই আমাদের মেহমান। মেহমানদের দিয়ে আমরা কাজ করাই না। বিয়ে উপলক্ষ্যে বাবা নতুন করে আরো দুজন কাজের লোক নিয়োগ করেছে। ওরা আছে মায়ের সঙ্গে, তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’
প্রাপ্তি এত জোরে জোরে কথাগুলো বললো যে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে ডাইনিংয়ে বসে থাকা লোকজনের কানে পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। মুরুব্বিগোছের কয়েকজন আমাকে উদ্দেশ্য করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। আমি ভয়ানক লজ্জা পেলাম। আসলে বাবা মা ছাড়া একা কোথাও যাওয়ার অভ্যেস নেই তো। তাই হঠাৎ মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। গাঁট হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।