#আমার_ভুল,পর্বঃ১৫
অরিত্রিকা আহানা
সেদিন প্রিন্স চলে যাওয়ার পর আমি একমুহূর্তের জন্যেও শান্তিতে থাকতে পারি নি। দিনরাত শুধু উনার কথাই ভাবছিলাম। উনার স্মৃতিগুলো বেদনার মত আমার চোখের সামনে ভাসছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো উনাকে না পেলে আমি দমবন্ধ হয়ে মরে যাবো। এত দূরত্ব, এত গ্লানি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। কাছে মানুষ দূরে সরে গেলে সত্যিই সহ্য করা যায় না! এই যন্ত্রণা বড় মারাত্মক!
দুদিন আর ইউনিভার্সিটিতে যাই নি। ভেবেছিলাম আব্বা হয়ত উনার কোনো খোঁজ জোগাড় করতে পারবেন। কিন্তু প্রিন্সরা আগের বাসাটা বদলে ফেলেছেন তাই চাইলেও কোনো খবর জোগাড় করা সম্ভব হয় নি।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কি করলে উনার দেখা পাবো এই ভেবে আমার ব্যাকুল, ব্যথাতুর হৃদয় আত্মগ্লানিতে পুড়ে মরছিলো। উনার চলে যাওয়ার কথা মনে পড়লেই আমি অনুশোচনায় কেঁদে ফেলি। কিছুতেই নিজের যন্ত্রণা কমাতে পারি না। হতাশায়, দুশ্চিন্তায় আমার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো।
কিন্তু সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আবার উনার দেখা পাবো ভাবতে পারি নি। ভেবেছিলাম এই জীবনে হয়ত আর কোনোদিন উনাকে দেখতে পাবো না। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো। তাই আবার উনার দেখা পেলাম।
মানুষ অপ্রত্যাশিত কিছু পেলে যেমন খুশিতে পাগল হয়ে যায় আমার অবস্থাও ঠিক সেরকম। আমি খুশিতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম।
উনার সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার উপলক্ষ্যটা ছিলো চেয়ারম্যান স্যার। স্যারের ছেলের বিয়েতেই উনার সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়।
বিয়ে উপলক্ষ্যে স্যার ডিপার্টমেন্টের সকল স্যার ম্যামদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমাকে ইনভাইট করলেন। আমার প্রথমে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না। ভেবেছিলাম শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে নেবো। এসব অনুষ্ঠানের আনন্দ, উচ্ছ্বাস কিছুই এখন আর আমাকে স্পর্শ করে না।
কিন্তু চেয়ারম্যান যখন পাত্রীর বর্ণনা দেওয়ার সময় প্রিন্সের কথা তুললেন তখন আর আমি স্থির থাকতে পারলাম না। পাত্রী প্রিন্সের আত্মীয়। পাত্রী মা আমার শ্বশুরের ফুপাতো বোন।
অতএব আমি মোটামুটি ধারণা করে নিলাম বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রিন্স থাকবেন। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও থাকবেন হয়ত। তবুও আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রিন্সকে আরো একবার দেখার সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইছিলাম না। অসুস্থ শরীর নিয়েও অনুষ্ঠানে এটেন্ড করতে চলে গেলাম।
★
আমাদের চেয়ারম্যান স্যার একটু প্রাচীন ধ্যান ধারণার মানুষ হলেও শৌখিন। ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে এলাহি আয়োজন করেছেন। অনুষ্ঠানে উপাচার্য মহাশয়ও উপস্থিত ছিলেন। যদিও উনি বেশিক্ষণ থাকবেন না। বর বউয়ের সঙ্গে দেখা করেই বেরিয়ে যাবেন। তথাপি চেয়ারম্যান স্যার আমাকে আর প্রিন্সকে ডেকে উনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুললেন না। স্মিত হেসে বললেন,”এরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই স্টার স্যার। আমার ডিপার্টমেন্টের গৌরব।’
উপাচার্য মহাশয় সম্মতি প্রদর্শন করে সামান্য হাসলেন। আগ্রহভরে আমাদের দুজনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের উদ্দেশ্যে। করমর্দন শেষে প্রিন্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’আপনার কথা অনেক শুনেছি ইয়াং ম্যান! আপনি আমাদের বিশ্বাবিদ্যালয়ের গর্ব। উই আর প্রাউড অফ ইউ।’
প্রিন্স সলজ্জ হাসলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিলো। চেয়ারম্যান স্যার মুচকি হেসে প্রিন্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’সেদিন তো ভেবেছিলাম তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। স্ত্রীর হাত থেকে স্মারক নেবে তুমি। একটু অন্যরকম হতো ব্যাপারটা। ছাত্রছাত্রীরাও একটু উৎসাহ পেতো। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো আবার ফ্যান্টাসি না হলে কোনো কিছুতে আগ্রহ বোধ করে না। তোমাদের স্বামী স্ত্রী দুজনকে একসাথে স্টেজে দেখলে কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণা পেতো।’
আমি এবং প্রিন্স দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রিন্সের মনের মধ্যে কি চলছিলো আমি জানি না। কিন্তু আমার ভালো লাগছিলো। অস্বস্তিও হচ্ছিলো। কিন্তু অস্বস্তির চাইতে বেশি ভালো লাগা কাজ করছিলো।
★
উপাচার্য মহাশয় চলে যাওয়ার পর চেয়ারম্যান স্যার ছেলের বিয়ের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি অতিথিদের ঝামেলা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমার এক কলিগের সাথে কথা বলছিলাম। আর আড়চোখে একটু পর পর প্রিন্সকে দেখছিলাম।
উনি স্টেজর একপাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। উনার পাশে গোলাপি শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার সাজপোশাক বিবাহিতাদের মত। হঠাৎ দেখলাম প্রীতি ‘ভাবীমা’, ‘ভাবীমা’ বলে দৌঁড়ে এসে ঐ মেয়েটার কোলে উঠলো। মেয়েটাও হাসিমুখে প্রীতিকে কোলে নিয়ে আলতো করে গালে চুমু খেলো।
মাঝবয়সী এক জন ভদ্রমহিলা মিষ্টি হেসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন,’কে গো এই পিচ্চি মিসেস শাহরিয়ার?’
‘মিসেস শাহরিয়ার!’ বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। মনে হলো ভুল শুনেছি। ভালো করে ওদের কথা শোনার জন্য সামনে এগিয়ে গেলাম।
জবাবে ঐ মেয়েটা মুচকি হেসে বললো,’আমার ননদ।’
প্রীতি আবার ভাবিমা বলে মেয়েটার গলা জড়িয়ে ধরলো। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একমুহূর্তেই সব অন্ধকার, তমসাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিলো। মাথাটা ভোঁ ভোঁ ঘুরতে শুরু করলো। চোখের কোনে নোনাজল এসে জমা হলো। শক্ত থাকার জোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুকফেঁটে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। এতবড় অসম্মান! এত বড় অপমান! আমি চেয়ারের হাতল চেপে বসে পড়লাম।
চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে নিঃস্পৃহর মত পড়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু বুকের ভেতর ভয়াবহ তোলপাড় চলছে। বিরহের বেদনার চাইতেও এই বেদনা বেশি পীড়াদায়ক! আমার ভেতরটাকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়েছে একেবারে। আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না।
চোখমুছে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে ঠকিয়েছে ও! অপমান করেছে! আমি ওকে ছাড়বো না!
আমার ভালোবাসা এত ঠুনকো হতে পারে না!
উঠে দাঁড়ালাম সামনে এগোনোর জন্য। কিন্তু পা যেন চলছে না। ফের কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আবার নিজেকে শক্ত করে উঠে দাড়ালাম। আস্তে আস্তে স্টেজে উঠে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালাম। উত্তজনায় মাথা কাজ করছিলো না। পরিবেশ, পরিস্থিতি সব কিছুর ভুলে সোজা ওর কলার চেপে ধরলাম। সজোরে বুকে আঘাত করে বললাম,’মিথ্যেবাদী! ভন্ড! কেন আমাকে এমন করে ঠকিয়েছো।’
লাগাতর আঘাত করে উনার বুকটাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছিলাম। উনি নিরব! বিষন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উনার হাতখানা আমার কলার ধরে রাখা হাতের ওপর। প্রীতিকে কোল থেকে নামিয়ে ঐ কালনাগিনী, সর্বনাশী মেয়েটা ছুটে এলো। আমার হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বললো,’কি করছেন কি আপনি? উনাকে এভাবে মারছেন কে? কেউ এই মহিলাকে আটকান প্লিজ। নইলে আমি পুলিশ ডাকবো।’
আমি ধাক্কা মেরে ঐ মেয়েটাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চাইলাম। বেসামাল হয়ে সে স্টেজে থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছিলো কিন্তু উনি ধরে ফেললেন।
আমার তখন হুঁশ ছিলো না। তীব্রগতিতে উনার ধরে থাকা হাতের মধ্যে থেকে মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। ক্রমাগত আঘাত করলাম উনার হাতের ওপর। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে টেনে আলাদা করতে চাইলাম। কিন্তু উনি শক্ত করে ধরে রইলেন। হাত ছাড়লেই ঐ কালনাগিনী নিচে পড়ে যাবে।
অনুষ্ঠানে সবাই নিরব। অজস্র হতবাক চোখ নিরব বিস্ময়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলো সবাই।
উনি মেয়েটাকে টেনে উপরে উঠালেন। গভীর স্নেহের সহিত জিজ্ঞাসা করলেন,’তুমি ঠিক আছো।’
মেয়েটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। চোখেমুখে বিব্রত ভাব।
আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। অন্তঃসার শূন্য মনে হলো নিজেকে! চোখভর্তি টলমল করা পানি নিয়ে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না!
খবর শুনে চেয়ারম্যান স্যার ছেলের বিয়ের কাজকর্ম ফেলে রেখে ছুটে এলেন। আমার অবস্থা দেখে বিস্মিত হতবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’কি হয়েছে কিরণ?
আমার ভেতরটা তীব্র বেদনায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম,
-‘উনি আমাকে ঠকিয়েছেন স্যার। প্রথম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও উনি আবার বিয়ে করেছেন। বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন আমার সঙ্গে। আপনি এর বিচার করুন। নইলে আমি উনাকে ছাড়বো না।’
আমার বাঁ হাতের তর্জনী উনার দিকে তাক করা। চেয়ারম্যান স্যার হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চারদিকে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। প্রান্ত আর প্রাপ্তি ওরা এতক্ষণ বাইরে ছিলো। খবর শুনে ওরাও ছুটে এলো। প্রাপ্তি মেয়েটার হাত ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,’কি হয়েছে?’
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে বললো,’আমি জানি না। উনি ভাইয়ার সাথে মিসবিহেভ করছিলেন। তাই আমি বাধা দিতে গিয়েছিলাম। আমাকেও ধাক্কা মারেন।’
‘ভাইয়া!’
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না! মেয়েটা উনাকে ভাইয়া বলেছে! তবে কি উনি বিয়ে করেন নি!
প্রাপ্তি আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মনে হচ্ছিলো চোখ দিয়েই আমাকে ভস্ম করে দেবে।
চেয়ারম্যান স্যারকে উদ্দেশ্য করে বললো,’কিছু মনে করবেন না স্যার। ও আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। সায়মা তানজিলা। এই ভদ্রমহিলা কি ভেবে ওকে আমার বড় ভাইয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে আমরা জানি না।’
চেয়ারম্যান স্যার সঙ্গে সঙ্গে সম্মতিসূচক মাথা দোলালেন। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য সামান্য হেসে বললেন,’আমি জানি এসব। কিরণ না বুঝে ভুল করে ফেলেছে। এসো কিরণ আমার সঙ্গে এসো। আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি।’
আমি কথা বলতে ভুলে গেলাম। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো। প্রাপ্তি ফের আমার দিকে অগ্নিবর্ষণ করে বললো,’আমার মনে হয় উনার আমার ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। না জেনে এভাবে কাউকে অসম্মান করার কোনো অধিকার উনার নেই।’
চেয়ারম্যান স্যার চুপ করে রইলেন। প্রিন্স এতক্ষণ শান্ত, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ প্রান্তকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’আমি বাড়ি যাবো। আমার শরীর খারাপ লাগছে।’
প্রান্ত আর প্রাপ্তি উনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমি মূর্তির মতন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম! কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। চোখের আমার পানিতে গাল ভিজে গেলো।
চেয়ারম্যান স্যার আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বললেন,’মনোমালিন্য হলে মিটিয়ে নাও কিরণ। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে বেশিদিন রাগ অভিমান পুষে রাখতে নেই। এতে সম্পর্কের জটিলতা বাড়ে।’
কিন্তু এতবড় জঘন্য ঘটনা ঘটানোর পর আর কি করে আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো! নিজের কাছে আমি নিজেই তো ছোট হয়ে গেছি।
উত্তেজনার বশত কত বড় একটা ভুল করে ফেললাম! যেই ভুলের কথা আমি কোনোদিন নিজের দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি।