আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি #পর্বঃ০৬

0
295

#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

হেমসিনী মাহাতিবকে ফিরে যেতে বললেও সে গেলোনা। হেমসিনীর থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে তার পেছন পেছন ভার্সিটি পর্যন্ত গেলো। নিজ দায়িত্বে তাকে সাবধানে পৌঁছে দিয়ে সে বাড়িতে ফিরে এসেছে।

সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই আচমকা মাহাতিবকে কেউ জড়িয়ে ধরলো। আচমকিক কাজে ভড়কে গেলো মাহাতিব। রমণীটি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো। কিছুক্ষণ সেভাবে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো সে, পরমুহূর্তে হালকা করে রমণীর মাথা হাত বুলিয়ে দিলো।

” কখন এসেছো দিভাই?”

” তুই এতো কেয়ারলেস কেন ভাই? তোর দুলাভাই থেকে খবরটা শোনার পর থেকে জানিস আমি কতটা ভ’য় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুই কেন এপথে পা বাড়িয়েছিস আনদ্রে? তুই জানিস না এসব কত বি’পদ’জনক? কপালের জোড়ে কাল বেশি কিছু হয়নি কিন্তু পরবর্তীতে যে আরো বড় কিছু হবে না তার কি কেন নিশ্চয়তা আছে?”

মেয়ের সাথে সঙ্গ দিলেন সুমাইয়া নাসরিন। তিনিও কাঁদতে কাঁদতে ইশারায় বললেন,

” ওকে একটু বোঝা সাইরা। কতবার বলেছি এসবে জড়িয়ে যাসনা, বড় বিপদ এপথে৷ খুবই কুৎসিত রাজনীতি বিষয়টা। মানুষকে প’শু বানাতে সময় নেই না, ভালো মানুষদের বি’প’দ লেগে থাকে সবসময়। সাইরা ওকে বোঝা, এখনো সময় আছে যেন বেরিয়ে আসে।”

মাহাতিব বোনকে ছেড়ে মাকে আগলে ধরলো। চেয়ার টেনে ওখানে বসালো, হাঁটু গেড়ে বসলো মাহাতিব।

” মা এই পথ থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়, চাইলেও এখন পারা যাবেনা। বাবা তো তোমাকে বুঝিয়েছে৷ একটু বোঝার চেষ্টা কারো। সামনে ভোট, এখন পিছিয়ে এলে জনগণ ভাববে আমরা ভ’য়ে পিছিয়ে গিয়েছি। বিপক্ষ দল জিতে যাবে, পরবর্তীতে তারা আমাদের ক্ষতি করার জন্য অনেক বড় সুযোগ পেয়ে যাবে। আর তাদের সেই সুযোগটাই আমি দিতে চাইনা। ভয় পেওনা মা, সবঠিক হবে।”

.
.

বিকেল বেলায় ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামে ফিরে এসেছেন হেমসিনীর বাবা আমজাদ সাহেব। প্রীতি আহমদের আজ সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো বিধায় বেশ অনেক পদের রান্না করেছেন। স্বামী, ছেলে-মেয়ে এবং জা’ কে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও খেতে বসে পড়লেন।

বেশ কিছুসময় পর আমজাদ সাহেব গলা খাকড়িয়ে বললেন,

” ভাবী, আপনার শরীর ঠিক আছে? কোন কিছু প্রয়োজন আপনার?”

সৃষ্টি আহমেদ প্লেটের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন,

” না ভাই, আমার কিছু লাগবে না।”

” আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না। আপনার কি খাবার পছন্দ হয়নি? আপনি কি অন্যকিছু খেতে চান? ইচ্ছে হলে বলুন, আমি এবং প্রীতি তৈরি করে দিচ্ছি।”

” না ভাই তার প্রয়োজন নেই। খাবার যথেষ্ট ভালো হয়েছে, তুমি তো জানো প্রীতির রান্নার হাত ভালো।”

” তাহলে না খেয়ে মন ম’রা হয়ে রয়েছেন কেন? এভাবে নিজের প্রতি অবহেলা করলে কি করে হবে? নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে, অন্যকেউ তো আপনার খেয়াল সঠিকভাবে রাখতে পারবেনা।”

” কথায় আছে ‘ সুখে থাকলে ভুতে কি’লা’ই ‘ বর্তমানে ওনার অবস্থাও সেরকম। বাপের বাড়িতে নিজের যত্ন নিতো না বলে আমরা ওনাকে এখানে নিয়ে এসে সেবাশুশ্রূষা করছি আর উনি দেবদাসী হয়ে থাকেন সবসময়। যে নিজের যত্ন নেই না তাকে আমরা হাজার সেবা করলেও কি আধো কিছু হবে?”

জায়ের কথা শুনে সৃষ্টি আহমেদ টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন।

” প্রীতি শান্ত হও তুমি। তুমি তো জানো ভাবীর অবস্থা, তার এই আচরণটা কি স্বাভাবিক নয়?”

” স্বাভাবিক আমিও জানি কিন্তু আর কতদিন? কমদিন তো হলোনা। তাকে এভাবে দেখলে আমাদেরও যে খারাপ লাগে। কার জন্য সে মন মরা হয়ে থাকে? তুমি ভালো মতোই জানো কেন আমি তাকে মনখারাপ হয়ে বসে থাকলে বকাবকি করি।”

” ঠিক হয়ে যাবে। ভাবী আবারো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, তুমি চিন্তা করোনা।”

হেমসিনী চুপচাপ খাবার খেয়ে যাচ্ছে। ছোট হিমাল খাবারের পাশাপাশি উৎসুক নয়নে বড়দের কথাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে।
.
.

বিকেলে নিজের ঘরে বসে গিটার প্র্যাকটিস করছিলো হেমসিনী। কিছুদিন পর তাদের ভার্সিটিতে ৫০ বছর উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে তারা কয়েকজন মিলে গান পরিবেশন করবে সেইসাথে হেমসিনী এবং অন্য একজন মেয়ে গিটার বাজাবে।

হেমসিনী মনোযোগ দিয়ে প্র্যাকটিস করছিলো, অন্যদিকে তার ফোন বেজে চলেছে। সে শুনতে পেলেও তৎক্ষনাৎ উঠে গেলোনা। পুরোটা শেষ করে তবেই ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনে বাংলায় গোটা গোটা অক্ষরে “মাহাতিব” নামটি ভেসে উঠছে।

” এই লোকটা কবে আমার পিছু ছাড়বে? প্রতিদিন হুটহাট ওনার ফোন না দিলে কি পেটের ভাত হজম হয়না? রাত নেই দিন নেই যখন খুশি ফোনের উপর ফোন দিয়ে থাকেন৷ আর সহ্য করা যাচ্ছেনা, এবার একটু কঠিন ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন। তবে যদি একটু দূরে সরে যান।” খানিকটা রাগ এবং বিরক্ত নিয়ে নিজেই বললো হেমসিনী।

” আপনার গিটার বাজানো খুবই মনোমুগ্ধকর। কবে আপনি আমার কাছে আসবেন হেম? অপেক্ষায় আছি সেইদিনের যখন আপনি আমার সামনে বসে গিটার বাজাবেন, সাথে আপনার সুরেলা কন্ঠে কোন গান শোনার সৌভাগ্য হবে আমার। হেম গাইবেন আপনি গান? রাখবেন তো আমার আবদার? নাকি বরাবরের মতোই ফিরিয়ে দেবেন?”

হেমসিনী ভেবেছিলো ফোন রিসিভ করেই মাহাতিবকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে কিন্তু মাহাতিবের ব্যথাকাতুর কন্ঠ শুনে সে কিছু বলতে পারলোনা৷ রাগীভাবটা মূহুর্তেই উবে গেলো, গম্ভীরভাব ছেঁয়ে গেলো তার মুখমন্ডলে।

” আপনি কি করে জানলেন আমি এখন কি করছি?”

” তোমার গিটারে শব্দ রাস্তার প্রতিটি মানুষ শুনতে পাচ্ছে, তাহলে আমি কিভাবে বাদ যাবো?”

মাহাতিবের কথা শুনে হেমসিনীর বুঝতে বাকি নেই মাহাতিব তার বাড়ির সামনেই আছে।

” আপনি আবারো আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সবসময় দাঁড়িয়ে থাকলে যে-কেউ তা লক্ষ্য করবে। বাবা-মা অন্যের মুখ থেকে জানতে পারলে কি হবে চিন্তা করেছেন?”

” কি হবে? সিনেমার মতো আমার সাথে জোড় করে বিয়ে করিয়ে দেবে বুঝি? তাহলে তো ভালোই হবে, আমাকে আর এতো কষ্ট করে এক মানবীর পাথরের তৈরি হৃদয়ে ফুল ফোটাতে হবেনা।”

” বড্ড বা’জে কথা বলেন আপনি। এই বিকেল বেলা কাজকর্ম ফেলে কেন দাঁড়িয়ে আছেন তা বলুন।”

” একটু বারান্দায় আসবেন? আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি, রাতে ফেরা হবেনা। আপনাকে না দেখলে আমার দিন সার্থক হয়না। রাতে যেহেতু আপনাকে দেখা হবেনা তাই এখনই তা পুষিয়ে নেবো। দয়া করে একটি বার বারান্দায় আসুন৷ প্রমিজ আজ আর বিরক্ত করবোনা।”

হেমসিনী জানে এখন সে বারান্দায় না গেলে মাহাতিবও সরবেনা। তাই কথা না বাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তায় একটি সাদা রঙের গাড়ির দেখতে পেলো সে, হেমসিনী জানে মাহাতিব কাঁচ উঠানো গাড়ির ভিতর থেকেই তাকে দেখছে।

” এবার আমার কাজ আরো ভালোভাবে সম্পন্ন হবে। সাবধানে থাকবেন হেমসিনী, নিজেকে কখনো একা মনে করবেন না। সবসময় মনে রাখবেন আপনার আশেপাশে একজন আ়ছে, যে আপনার জন্য নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবেনা।”

” কোন মুভি থেকে তুলে এনেছেন লাইনগুলো?”

ফোনের অপর পাশ থেকে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শুনতে পেলো হেমসিনী।

” আমার মনের মুভি থেকে। দেখবেন মুভিটা? আপনার জন্য একদম বিনামূল্যে দেখার সুযোগ আছে।”

” আর কখনো ফোন করে বলবেন না আমাকে বারান্দায় আসার জন্য। বললেও আমি আসবোনা। এবার আমার বাড়ির সামনে থেকে যান।”

আবারো হেসে উঠলো মাহাতিব।

” যতদিন বেঁ’চে থাকবো ততদিন আপনার কাছে আমার আবদার শেষ হবেনা হেমসিনী। আর আপনাকে আমার ছোট ছোট সব আবদার পূরণ করতে হবে, আমি জানি আপনি করবেন। থাকতে মূল্য দিতে হয় হেমসিনী। আজ আমি আছি, কাল নাও থাকতে পারি। তখন কে আবদার করবে? তাই যতদিন আছি আবদার করা বন্ধ করবোনা। ভালো থাকবেন হেম।”

লাইন ডিসকাউন্ট হওয়ার সাথে সাথে মাহাতিবের গাড়িটাও মূহুর্তেই উধাও হয়ে গেলো। হেমসিনী স্থির হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। অজানা কারণে তার অদ্ভুত অনূভুতি হচ্ছে তবে সেটা সুখকর নয়।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here