আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি #পর্বঃ০৭

0
284

#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

সকাল থেকে পুরো শহরজুড়ে একটি চাঞ্চল্যকর এবং ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজমান। প্রায় প্রতিটি ঘর, অফিস, দোকান-পাট সবখানে জনগণ টিভির সামনে বসে আছে। প্রতিটি টিভিতে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে একটি মাত্র খবরই প্রচলিত হচ্ছে।

শহরের একটি বেসরকারী হসপিটাল থেকে নকল ঔষধ এবং ভেজাল ঔষধ উদ্ধার করা হয়েছে। সকল সাংবাদিকরা ভীড় করেছে সেই হসপিটালের সামনে এবং জনগণ ভীড় করেছে টিভির সামনে।

হেমসিনী এবং তার পুরো পরিবার চিন্তিত অবস্থায় বসে আছে টিভির সামনে। আমজাদ আহমেদ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছেন। এই হসপিটালের কিছুটা দূরেই ওনার স্ত্রীর কর্মস্থল।

” এভাবে হা করে টিভির সামনে বসে না থেকে খেতে এসো৷ তোমাদের অফিস, ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে না হলেও আমাকে দুপুরে হসপিটালে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে আমার একটা কাজ কামাও, আমাকে আবার দুপুরে জন্য রান্না করতে হবে।”

প্রীতি আহমেদের ব্যস্তময় কন্ঠ শুনে সবাই দ্রুত টিভির সামনে থেকে উঠে খেতে বসে পড়লো। তবে টিভি তখনো চলছে।

” শোন তুমি না হয় কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে নাও।”

” ছুটি কেন নেবো? কোথাও যাবে নাকি?”

” না আমার জন্য বলছিনা। এখন যা পরিস্থিতি, তুমি বরং কয়েকদিন হসপিটালে না গিয়ে ঘরেই থাকো।”

নিজের প্লেটে রুটি তুলে নিয়ে চেয়ারে বসলেন প্রীতি আহমেদ৷ অল্প খেয়ে তিনি উওর দিলেন,

” যাবো না কেন? আমাদের হসপিটালে কিছু হয়েছে বা আমি কিছু করেছি? করিনি তো? তাহলে কেন শুধু শুধু ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকবো?”

” তাহলে আমিই ঘরে থাকি। তোমাকে না হয় এ কয়েকদিন আমিই পৌঁছে দেবো।”

” তার দরকার নেই। তুমি শুধু শুধু বেশি চিন্তা করছো।”

আমজাদ সাহেব বুঝতে পারলেন প্রীতি আহমেদকে এখন আর বলেও কোন লাভ হবেনা।

” আচ্ছা তাহলে এ কয়েকদিন হেঁটে যেওনা। রিকশা নিয়ে আসা-যাওয়া করো। আমি এর বেশি কিছু শুনতে চাইনা। তুমি যদি এটাও না শোন তাহলে আমিই তোমাকে পৌঁছে দেবো।”
……..

” ভাই কাজটা করলেন আপনি। সব বুদ্ধি খাটিয়ে, সময় দিয়ে বিষয়টা সমাধান করলেন আপনি। কিন্তু সব কৃতিত্ব নিয়ে যাচ্ছে পুলিশরা। কেন ভাই? আপনি তাদের সুযোগ কেন করে দিয়েছেন? আপনি যদি এখনো বলেন তাহলে আমরা এখুনি সাংবাদিকদের প্রমাণ সহ বলতে পারবো যে এই নকল ঔষধ হাতেনাতে ধরতে পেরেছে শুধু আপনার কারণে।”

” না মুকিত তোমরা এরকম কিছু করবেনা। আমি কিন্তু আগেই বারণ করে দিয়েছিলাম। আমার অগোচরেও করার চেষ্টা করবেনা।”

” কিন্তু কেন ভাই? এই খবরটা মিডিয়া, জনগণ জানতে পারলে তো আমাদেরই লাভ। সামনে ভোট, এটা একটা সুর্বণ সুযোগ আমাদের জন্য। এতে করে আমরা আরো মানুষের মন জয় করতে পারবো, এর ফলে আমরা আরো বেশি ভোট পাবো।”

” মুকিত আমি কোন কিছুই নিজ স্বার্থের জন্য করিনা, আমার বাবাও তা করেননি। আমরা কাজ করি সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য। সবাই যদি নিজের কথাই চিন্তা করে তাহলে সবার স্বার্থের কবলে পড়ে এই নিরিহ মানুষগুলো কষ্টে ভুগবে। যা আমি চাইনা। আমি নিঃস্বার্থ ভাবে, আড়ালে থেকে আমার কাজ করে যাবো। আর কেউ জানুক বা না জানুক, উপরে একজন আছেন। তিনি সবকিছু দেখছেন। আমি ভোটের যোগ্য হলে জনগণ মন থেকে এমনিতেই দেবে। এর জন্য সবার চোখে মহান হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা।”

মাহাতিবের কথন শুনে মুকিতের হৃদয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো।

” মানুষটা সাধারণ জনগণের কথা কত চিন্তা করে। রাত নেই, দিন নেই শুধু মানুষের জন্য কাজ করে যাই, একদম বড় স্যারের মতো।” মনে মনে বললো মুকিত।

.
.

সকাল থেকে হেমসিনীদের বাড়িতে ব্যস্তময় একটা পরিবেশ বিদ্যামান রয়েছে। বর্তমানে বাড়ির মানুষরা আরো অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

হেমসিনীর দাদা বহুমাস পর আবারো তাদের বাড়িতে এসেছেন৷ তিনি দু’তিন বছর পর পর একবার আসেন। প্রীতি এবং সৃষ্টি আহমেদ দু’জনে শশুরের সাথে কুশলাদি করে রান্নাঘরে চলে গিয়েছেন। হিমাল বহুদিন পর দাদাকে পেয়ে ওনার সাথে বসে আছে। আজ যেন সে পণ করেছে শত বকা খেলেও সে সরবেনা।

সৃষ্টি আহমেদ শশুড়ের জন্য শরবত এবং কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এলো।

” এই নিন বাবা, ঠান্ডা শরবতটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।”

বউয়ের হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা একবারেই খেয়ে নিলেন আকবর আহমেদ।

” কেমন আছো বড় বউমা? শরীর ভালো আছে তো? ছোট বউদের সাথে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো? সমস্যা হলে বলো, আমি না হয় যাওয়ার সময় তোমাকেও সাথে নিয়ে যাবো।”

” না না বাবা, কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমি এখানে বেশ ভালো আছি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনি বরং খাবারগুলো খান, আমি রান্নাঘর থেকে আসছি।”

আকবর আহমেদ বুঝতে পারলেন উনার বড় বউ কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এখান থেকে চলে গিয়েছেন।

” আচ্ছা হিমাল দাদু ভাই তোমার বাবা-মা কি তোমার চাচীকে বকাবকি করে?”

” না তো। তবে জানো দাদু চাচী মাঝে মাঝে কান্না করেন। তখন মা খুব রে’গে যাই। আচ্ছা দাদু চাচী কেন লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করেন?”

নাতীর কথা শুনে আকবর আহমেদের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। তিনি হিমালকে কি উওর দেবেন তা বুঝতে না পেরে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললেন।

হেমসিনী মা এবং চাচীর কাজে সাহায্য করছে। অনেক্ক্ষণ যাবৎ তার ফোর বেজে চললেও সে কাজ ফেলে যাচ্ছেনা। একবার ফোনের শব্দ বিরক্ত হয়ে প্রীতি আহমেদ বললেন,

” কে ফোন করেছে দেখো হেমসিনী। অনেক্ক্ষণ ধরে বেজে চলেছে।”

” থাক মা আমি পরে দেখে নেবো।”

” ফোন না দেখলে বুঝবে কিভাবে কে ফোন করেছে? হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে। তাই এতোবার ফোন করছে। যাও ফোনটা রিসিভ করো। এতোবার ফোন করার পরেও না ধরাটা একধরনের অভদ্রতা।”

হেমসিনী আর মায়ের উপরে কথা বলতে পারলোনা। হাতটা ধুয়ে দৌড়ে রুমে এলো।

ফোন এখনো অনবরত বেজে চলেছে। এতোবার ফোন পেয়ে এবার হেমসিনীরও একটু চিন্তা হতে লাগলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো আননোন নম্বর থেকে তাকে ফোন করা হচ্ছে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে তার।

” হ্যালো। কে বলছেন?”

” হেম।”

কন্ঠস্বর শুনে হেমসিনীর বুক ধক করে উঠলো। দ্রুত কানের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে নম্বরটা আবারো চেক করে দেখলো। না এটা আননোন নম্বর তাহলে সে মাহাতিবের কন্ঠ কি করে শুনতে পেলো? হেমসিনী ভাবনায় পড়ে গেলো সে কি ভুল শুনেছে?

” মাহাতিব? মাহাতিব এটা কি আপনি বলছেন?”

” মাত্র দু’দিন কথা হয়নি এর মাঝেই আমার কন্ঠস্বরও ভুলে গেলেন হেমসিনী।” তার কন্ঠস্বরে স্পষ্ট মন খারাপের রেশ পেলো হেমসিনী তবে সে তা আমলে নিলোনা।

” এটাতো আপনার নম্বর নেই মাহাতিব। এটা কার নম্বর?”

” মুকিতের। আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক ব্যস্ত আছি, নতুন ফোন কিনে যে সেটাপ করবো তারও সময় হচ্ছেনা। কেমন আছেন আপনি? মনে আছে মাহাতিব নামক অবহেলিত ব্যক্তিটিকে?”

” আপনি এতোবার ফোন কেন দিয়েছেন বলুন তো? এতোবার ফোনের শব্দ শুনে মা পর্যন্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো।”

” আপনি ফোন ধরছিলেন না। চিন্তা হচ্ছিলো আপনার জন্য তাই দিয়েছিলাম।”

” আর কখনো এতোবার দেবেন না। না জানি বাড়ির সবাই কি ভাবছে এখন।”

” নিষ্টুর মানবী আপনি।”

” জানি আমি। এবার বলুন কেন এতোবার ফোন দিয়েছেন?”

” আপনার কথা মনে পড়ছিলো।”

” এই কারণে লাগাতার এতোবার আপনি ফোন দিয়েছেন! এই সামান্য কারণে!”

মাহাতিব পরবর্তীতে কিছু বলবে তার আগেই কেউ তাকে ডেকে উঠলো। ফোন কাটার আগে সে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,

” কাউকে মন থেকে চাইলে এই কারণটা আপনার কাছে সামান্য মনে হতোনা হেমসিনী। কিন্তু আপনি তো পাথর মনের মানবী। তাই এই কথাটার মর্ম আপনি বুঝতে পারেননি। তবে আমি অপেক্ষায় থাকবো সেইদিনের যখন আপনি কথাটা অনুভব করতে পারবেন। সাবধানে থাকবেন হেম।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here