আমার_সংসার,পর্ব ৩,৪

0
1911

#আমার_সংসার,পর্ব ৩,৪
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৩

ধপধপ আওয়াজ করে হাটছিলাম। দোরের সামনে চিকন পিনপিনে সিঁড়িতে পা লেগে উষ্টা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলা। চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলাম। কেউ সর্বস্ব দিয়ে আঁকড়ে নিলো আমায়। ব্যাথা না লাগায় কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। সিয়াম ভাইয়া বাহুডোরে আমি। কালো ঘন পাপড়ি যুক্ত ছোট ছোট চোখদুটি অকপটে আমার দিকেই তাকিয়ে। শুকনো ডোগ গিললাম। প্রথম কোন পরুষের স্পর্শে, কলিজা শুকিয়ে কাঠ! পায়ের তলায় মাটি নেই যেন আমার।

‘ আ’ম সিওর তুই জানিস এখান থেকে পড়ে গেলে কি হতো? ‘

তড়িৎ গতিতে সরে আসতে গিয়ে আবারো পড়ে যাচ্ছিলাম, কোনমতে সামলে শক্ত হয়ে দাড়ালাম আমি। সুট,বুট,টাই,ব্লেজার পড়ে দাড়িয়ে সিয়াম ভাইয়া। কালো ব্লেজার সাদা শার্টে অপুর্ব লাগছে ওনাকে। প্রথম এতটা কাছ থেকে দেখলাম আমি তাকে। বুক ধুকপুক করছে! ওনার বলা কথাগুলো কান অব্ধি পৌছায়নি আমার। আমার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা!

‘ কি বললাম শুনেছিস? ‘

চমকে উঠলাম। সকাল থেকে এত কেন দেখছি তাকে আমি? তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হওয়ার কি আছে? আমার চেনা আমি এমন পাল্টাচ্ছি কেন? শপথ তো এমন ছিলো না? কেন ওনাতে দুর্বল হয়ে পড়ছি? অন্যদিক ফিরে অস্ফুটস্বরে বললাম,

‘ আমি খেয়াল করিনি। ‘

‘ ইডিয়ট! একটা থ্যাংসও বললো না। ‘

সাথেসাথে রক্ত গরম হয়ে উঠলো আমার। তিক্ষ্ম চোখে তাকালাম। মুখ বাকিয়ে হাসছেন উনি। কর্কষ কন্ঠে বললাম,

‘ কি বললেন আপনি? ‘

‘ ওকে ফাইন, তুই অকৃতজ্ঞ। ‘

হনহন করে চলে গেলো সিয়াম ভাইয়া। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে রইলো আমার। আজকাল একটু অপমানই কাটার মতো বিঁধে শরীরে।

চিঠিটার কথা নিচে আসতেই মনে পড়েছিলো। ড্রইংরুমের সোফায় মামাসহ আরও বৃদ্ধ কয়েকজন বসে ছিলো। সবাইকে উপেক্ষা করে ছুটে গেছিলাম চিঠিটা খুজতে। বাইটে গিয়ে রজদ কাকার থেকে জানলাম গাড়িটা নাকি নেই। খুব ভোরে সায়েম বেড়িয়েছে গাড়ি নিয়ে। সে দৌড়াতে গেছে। তখনি মনটা বিষন্নে ভরে উঠলো। আর সেই সময়েই ঘটলো এই অঘটন। ধুরু৷ ভালো লাগে না। জুবুথুবু হয়ে সোফায় বসলাম। ইডিয়ট, অকৃতজ্ঞ শব্দু দুটি জ্বালাচ্ছে খুব। তখন থেকে ভুলতে গিয়েও ভুলতে পারছি না। গেঁথে বসেছে মাথায়।

‘ আজ নাকি তোর রেজাল্ট বেরোবে সিয়া? ‘

একহাতে মগ নিয়ে আসতে আসতে বললেন মামী। আমি একটু হেঁসে উঠে দাড়ালাম। ধোঁয়া ওড়া মগটা আমার হাতে গুজে মামী সোফায় বসে পড়লো। খুব আস্তেধীরে আমিও বসলাম।

‘ তো আজ কলেজে যা। আবার কবে ভর্তি, সেটাও জেনে আয়। ‘

চোখ ছলছল করে উঠলো। বিয়ের পরের দিন সাধারণত বউরা বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। সেখানে আমি কলেজ যেতে পারব? ভাবতেই বুকে দামামার সৃষ্টি হচ্ছিলো। কফির দিকে আর খেয়াল নেই। আমি ভাবছিই।

‘ কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো সিয়া। খেয়ে নে। ‘

মামীর কথায় সজ্ঞানে ফিরলাম। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে হাসলাম আমি। মামীও কিঞ্চিৎ হাসলো। একসাথে বসে কফিটা শেষ করলাম। উপরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিবো,মামী পিছু ডাকলেন,

‘ আনন্দে আবার এখনি রেডি হস না। ব্রেকফাস্ট করে তবেই বাড়ির বাইরে পা রাখবি। বুঝলি? ‘

রিনরিনে কন্ঠে হেঁসে উঠলাম। মাথা দুলিয়ে সম্মতি নিয়ে ছুটে গেলাম রুমে। আমি পড়ার জন্য এটুকু তো করতেই পারি। ঘরটা কালকে যা দেখেছি তার থেকেও সুন্দর। সাদা, সোনালি রঙের দেয়াল। দেয়ালে দেয়ালে বাল্ব লাগানো। আসবাবপত্র গুলো অনেক সুন্দর। বড়বড় ফুলদানি। কিন্তু এত বড় সুবিশাল রুমটায় আমার চোখ যা খুজছে তা তো নেই! একটা পড়ার টেবিল নেই? তাহলে পড়বো কোথায় আমি? বিরক্ত হয়ে বিছানায় বসলাম। শুনেছি সিয়াম ভাইয়া খুব ব্রিলিয়ান্ট! তাহলে তার রুমে একটি টেবিল থাকবে না এটা তো অস্বাভাবিক! মুখে আধার নেমে এলো। বিছানায় বসে পড়তে পারি না আমি।

কিছুক্ষণ ঠায় বসে ছিলাম। একটু হায় হায় না করলে আমার নিজের’ই ভালো লাগবে না। এরপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

____

রিকশায় বসে উশখুশ করছি। তন্নি,প্রিয়,সামি,তিশা সবাই আসছে। কাল থেকে আজকে একটু বেশিই খুশি অনুভব করছি। তবে বিরক্ত একটু খানি তো আছেই। সামি আসছে! খুব জ্বালাবে ছেলেটা।

রিকশা থেমে গেলো কলেজের সামনে। ভারা মিটিয়ে ডুকে পড়লাম। এত আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। সবাই নিশ্চই পশ্চিম দিকটায় আছে। হাঁটতে লাগলাম পশ্চিম দিকে। বিরাট জাম গাছটার নিচে ওরা বসেছে। সকালের তুখোড় রোদে হালকা কুয়াশা শুকিয়ে গেছে। একটু ছায়া প্রয়োজন। রুমাল বিছিয়ে তারা বসে। আমি আসতেই তিশা বলে উঠলো,

‘ ফার্স্টবেঞ্চার হাজির হয়েছে। দেখ,দেখ তোরা। ‘

সকলে হেঁসে তাকালো আমার দিকে। তিশা একটু ফাজিল। কিন্তু ওর মনটা খুব সুন্দর। ওর পদ্ম ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটি দিয়ে হো হো করে হাসছে। কেউ তার জোক্স পছন্দ করুক বা না করুক, নিজের কথায় সে নিজেই হাসে।

‘ আয় সুন্দরী আমার পাশে বস। ‘ বললো সামি। আমি ইচ্ছে করেই তন্নির পাশে বসলাম। আগে হলে হয়তো বসতাম,কিন্তু এখন বসতে মন চাইছে না। দ্বীধা হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখন ওর পাশে বসলে ঘোর পাপ হবে। তাই তন্নির সাথে বসলাম। সামিরের সাথে না বসায় ও ব্যাঙ্গ করে বললো,

‘ সুন্দরীর দেমাগ দেখলে? আমার মতো হ্যান্ডসামকে কেমন অবহেলা করছে। তোরা দেখলি? ‘

সামির অভিমানি স্বরে হাসির রোল পড়ে গেলো। সকলে হাসলাম। হঠাৎ প্রিয়ো বললো,

‘ রেজাল্ট দুপুরে বের হবে। চল গিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে শুনে আসি ভর্তি সম্পর্কে। ‘

প্রিয়োর এক কথায় সবাই রাজি। ছেলেটা চুপচাপ, তেমন কথা বলে না। আমরা চেষ্টা করি ওর কথা রাখার। নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেই পছন্দ করে ও। শুধু নামটা নিয়েই একটু মজা করে সবাই। পরাশোনায় বেশ ভালো। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় ওর মতো হতে, কিন্তু বাকিগুলোর জন্য আর হয়ে ওঠে না। সবাইতো আর এক হয় না। কেউ কেউ চেয়েও হতে পারে না।

সকলে উঠতেই তন্নি বিরোধিতা করে বলে ওঠে, ‘ ওই রাগচটা লোকটার কাছে যাস না। দেখবি কেমন দেমাগ! তারথেকে আজাদ স্যারের কাছে গেলে হয় না? ‘

তিশা কটাক্ষ করে বললো,

‘ উনি কি আমাদের স্যার? ইন্টারে পড়ায়। ‘

তন্নি একটু লজ্জা পেলো। সে আজাদ স্যারের উপর ক্রাসড। সকলে অফিস রুমে গেলাম। পার্মিশন নিয়ে ভর্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই প্রিন্সিপাল স্যার গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

‘ আগে পাশ করো, তারপর তো ভর্তি! ‘

তন্নি এখনি বিরোধিতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। হাত ধরে থামিয়ে দিলাম। স্যার দুদীন পর আসতে বললো আমাদের। আমরা সকলে বের হয়ে আসলাম। তন্নির কথা না শোনায় সবাইকে ঝাড়লো ও। কানফাটা গলায় চিৎকার করতে করতে মাথা ঝালাপালা করে দিলো একদম। কলেজ থেকে বেরোতেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। একপায়ে গাড়িতে ভর করে সিয়াম ভাইয়া দাড়িয়ে। চোখে রোদচশমা! উনি আমার কলেজ চিনলেন কিভাবে? জানলেন কিভাবে আমি কলেজে এসেছি? আমাকে প্রস্থান হতে দেখেই হিরো স্টাইলে হেঁটে এলেন উনি। বললেন,

‘ চল সিয়া! ‘

‘ ওয়েট! আপনি কে? এটা কে রে সিয়া? ‘

বললো সামি। শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠ ওর। সিয়াম ভাইয়া আরেকটু এগোলেন আমার দিকে। সবাই ভুত দেখার মতো তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সিয়াম ভাইয়া সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ তোমাদের দুলাভাই আমি। আরেকদিন দেখা হবে। লেট’স গো সিয়া। ‘

হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো সিয়াম ভাইয়া। সবার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সামির মুখে তৎক্ষনাৎ আধার নেমে আসে। বুক মুচরে ওঠে। সূক্ষ্ম ভেজা দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। ওর বুকে যে আম্ফান বইছে বোঝলাম আমি। সিয়াম ভাইয়া পাশে বসালেন আমায়। গাড়ি চলতে আরম্ভ করে।

#চলবে…

#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৪

রুমে এসে থমকে গেলাম আমি। সিরদাড়া বেয়ে হিম শিতল স্রোত বয়ে গেলো। চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার অবস্থা। ঘরের দ্বীভাগে একটি টেবিল রাখা। সাথে ছোট্ট একটি শেলফ। চোখ ঘোরাতেই অধর প্রসার হয়ে উঠলো। বিছানায় এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে বিভিন্ন রঙা প্যাকেট। সম্ভবত শপিং ব্যাগ এগুলো। গিফট পেতে বড্ড ভালোবাসি আমি। ওষ্ঠদ্বয় প্রসার করে দাঁত বের করে হাঁসতে থাকলাম আমি। বুকে কতটা সুখানুভব হচ্ছে বুক চিঁড়ে না দেখালে বোঝাতে হয়তো অক্ষম থাকবো আমি।

ছুটে গেলাম টেবিলে। কোন বই নেই। নেই কোন ময়লা। ঝকঝকে তকতকে রঙ! সাথে একটু গন্ধ এসে নাকে লাগছে। চোখ ভিজে এলো আমার। টেবিলটায় পরম যত্নে হাত রাখলাম। ছটফটে মন মুহুর্তে প্রসাস্তিতে ছেয়ে যায়। কান্না আটকাতে পারলাম না। গাল বেয়ে নোনাজলের স্রোত গড়িয়ে পড়লো। আমি তো কাউকে বলিনি এতোকিছু প্রয়োজন আমার? সায়সই হয়নি মামীকে বলার। তাহলে কে আনলো এগুলো?সিয়াম ভাইয়া? না বললেও এতো কিছু বোঝেন কি করে উনি? সিক্ত চাউনিতে দরজার দিকে তাকালাম। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমার পানেই চোখ তার। চকচক করছে সে দৃষ্টিদুটি। তার অধর জড়ো পাতলা, মৃসন! চোখ ছোটছোট,তবে গভীর! ঠোঁট পরিষ্কার! কালো ছটার লেশ মাত্র নেই। চোখ ফিরিয়ে বিছানায় তাকালাম। কতকত ব্যাগ। তখনি আগমন ঘটে সিয়াম ভাইয়ার। মুখে বিশুদ্ধ কোমলপ্রাণ হাসি। যেকোন মেয়েকে ঘায়েল করার জন্য তার হাসিটুকুই যথেষ্ট।

‘ তুই কি এখনো লিটিল সিয়া? বয়সটাই কি বেড়েছে তোর? এখনো বারো তেরো বয়সের কচি খুকিকে মনে পুশে রেখেছিস না? ‘

বলার ভঙ্গিতে বিরক্তি ওনার। কোমরে দু হাত গুজে তাকালেন আমার দিকে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে পানি মুছে বললাম আমি,

‘ এমন করে বলছেন কেন? কি করলো সিয়া? ‘

‘ এইযে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিস তুই! সামান্য টেবিল দেখে আজকালকার যুগে কেউ কাঁদে? ডায়মন্ড দিলেও তো আজকাল কেউ কেউ খুশি হয় না, আর তুই এমন যে এটুকুতেই কাঁদছিস! ‘

শেষের কথায় কষ্ট, গভীর ক্ষত মনে হলো। মুখের হাসিও নেই। যেন জোড় করে একটুখানি হাসি রাখলেন মুখে। আর বাকিটা বুকভাঙা কাতর কষ্টে বিলুপ্ত হলো। আমি এগিয়ে এলাম। সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কেন ঠকালো আপনাকে ত্রিধাপু? আপনার মতো মানুষকেও ঠকানো যায় সিয়াম ভাইয়া? ‘

চোখ ছলছল করে ওঠে সিয়াম ভাইয়ার। স্বচ্ছ টলটলে পানি ওনার চোখে। উত্তর না দিয়ে সোজা বেলকনিতে চলে গেলেন উনি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে পানি মুছলেন চোখের। এতটা ভালোবাসতো সিয়াম ভাইয়া, ত্রিধা আপুকে? এতটা? কেন তার ভালোবাসায় আঘাত হানলো ত্রিধা? উনি যে এখনো দুর্বল তা এই চোখের পানিতেই কি স্পষ্ট নয়! যদি কোনদিন সামনে পাই,ঠিক জিজ্ঞেস করবো! কড়া গলায় জানতে চাইবো গোলাপের মতো শুদ্ধ মনটা ভাঙার কারন ঠিক কি!

কিছুটা সময় নিয়ে ভিতরে আসলো সিয়াম ভাইয়া। চোখের পানি চোখে শুকিয়ে পাতলা চামড়া একটু টেনেছে। উনি বিছানায় গিয়ে বসলেন। একচোখে চেয়ে রইলাম তার দিকে। কত শক্ত উনি!

‘ দেখতো এগুলো পছন্দ হয় কিনা। ‘

ধ্যান ভাঙলো আমার। আমিও একপা একপা করে গিয়ে বসলাম বিছানায়। অনেক কিছু এনেছেন উনি। অনেক কিছু। তবুও কয়েক প্যাকেট দূরে পড়ে আছে। আমি শুধু অবাক চোখে তার পছন্দ৷ ছেলে মানুষের এতটা সৌখিন পছন্দও হতে পারে? কত সুন্দর সুন্দর কাপড়! উৎকন্ঠায় তাকিয়ে থাকালাম তার দিকে। উনি দূরে রাখা প্যাকেটগুলো হাত বাড়িয়ে নিলেন। বের করলো সোয়েটার। আবারো আকাশকুসুম অবাক আমি! চাদরও এনেছেন উনি। আরেকটা প্যাকেট থেকে একজোড়া চটি, আর লেডিস সু বের করলেন। আমি শুকনো গালায় বললাম,

‘ এত টাকা খরচ করেছেন কেন? এখন এতোকিছুর দরকার নেই আমার। ‘

উনি হেঁসে বললেন, ‘ জাঁকিয়ে শিতটা তো পড়তে দে, তখন বুঝবি এগুলোর কতটা প্রয়োজন। ‘

আমি চুপ করে সব দেখছি। উনি বললেন,’ রেজাল্ট কখন বেরোবে তোর? ‘

‘ বারোটার পর। ‘

‘ এসএসসি তে রেজাল্ট কি ছিলো তোর? ‘

আকস্মিক প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম। ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বললাম, ‘ ফোর পয়েন্ট নাইন টু। ‘

‘ মানে তোর প্লাস আসেনি? ‘

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ‘ না। ‘

হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে বলতে আরম্ভ করলো সিয়াম ভাই, ‘ জানিস সিয়া? আমার যেদিন এসএসসি রেজাল্ট বেরোবে সেদিনের আগের রাত একফোঁটা চোখ বুজিনি আমি। পরিক্ষা ভালোই দিয়েছি, কিন্তু উত্তেজনা,উৎকন্ঠা আমার চোখে ঘুম আসতে দেয়নি। ছোট বোনটা সারারাত আমার সাথে ছিলো। আয়ু! আমার পাগলামির সঙ্গ দিয়েছিলো ও। আম্মু হাজার বার ডাকতে এসেছে, ও যয়নি। বরং রাগ দেখিয়ে বলেছে, আমি যাব না। ঘুমাও তুমি গিয়ে। খুব উত্তেজনায় সারাটা রাত পার করলাম। আমার বিছানাতেই আয়ু ঘুমিয়ে পড়ে। সিনথির বয়স তখন দু বছরের। আয়ুর সাত কি আট। সায়েম সেবার সেভেন পাশ করেছে। রেজাল্ট দশটার পর বের হবে। আমি নটার আগে গিয়েই বসে আছি কম্পিউটারের দোকানে। শীতকাল তখন। গা হিম করা ঠান্ডা৷ সাঁ সাঁ বাতাস বইছে। পড়োনে তেমন সোয়েটার নেই। দোকান অব্ধি খোলেনি কেউ তখন। বসে বসে ঠান্ডায় কাঁপছিলাম। কুয়াশায় একহাত দূরে কি তা দেখা যাচ্ছিলো না। দশটার দিকে রোদ উঠলো। ঘোলাটে সূর্য দেখা দিলো তখন। একে একে দোকান খুলতে আরম্ভ করলো। খুললো কম্পিউটারের দোকানও। দোকান খুলতেই আমি আঙ্কেলটাকে রেজাল্ট বের করতে বললাম। তখনি কারেন্ট গন! প্রায় দেড় ঘন্টা হাড় কাঁপানো শিতে অপেক্ষা করলাম করেন্টের জন্য। পছন্দের গিয়ার সাইকেলটাকেও অত বেলায় ভিজে যেতে দেখেছি। কারেন্ট আসলো! কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট পেলাম। প্রতিটা সাবজেক্টে হায়েস্ট মার্ক পেয়েছি। সুন্দর করে লেখা ছিলো A+। কি আনন্দ! বাইরে এসে দেখলাম সিট ভিজে গেছে কুয়াশায়। রুমাল দিয়ে মুছে কিছুটা এগোতেই আয়ুর কথা মনে পড়লো। বেচারি সারারাত আমার সঙ্গে জেগেছে। তাই ওর জন্য ওর ফেবারিট চকলেট কিনলাম, চিপ্স কিনলাম, কিনলাম কিন্ডাজয়! বাড়ি এসে শুনলাম ও স্কুলে চলে গেছে। আমার রেজাল্টের আনন্দে পুরো বাড়ি হইহই করে উঠলো। পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ চললো।

দেখতে দেখতে দুপুর হলো। বারোটায় পা রাখবে আয়ু বাড়িতে। ভাবলাম, ওকে চমকে দিবো। বলবো আমি ফেইল করেছি। যখন ও মনমরা হবে,তখব সারপ্রাইজ দিবো ওকে। কিন্তু সারে বারোটা বাজলো আয়ু এলো না। আমি ভাবলাম হয়তো বন্ধদের সাথে দুষ্টামি করছে। একটা বাজলো। তারপর দুটো, এরপর তিনটে! আয়ু এলো না। খোজার রোল পড়ে যায়৷ আয়ুকে পাওয়া যায় না। কোথাও নেই৷ পুলিশকে জানালে তারা খোঁজে, কিন্তু…… কিন্তু খুজে পাওয়া যায় নি আয়ুকে। তার হদিস যেন দুনিয়ায় বুক থেকে চিরোতরে মুছে গেছে। ‘

বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উনার দৃষ্টি কাপড়ে। চার থেকে তিন ভাই বোন হয়েছেন। কত পাষান! কত নিষ্ঠুর লোক! কোথায় লুকিয়ে রেখেছে আয়ুকে তারা? আয়ু নিজ ইচ্ছায় যায়নি তো? প্রশ্ন মনে আসতেই নিজের প্রতি রাগ চলে এলো। এতটুকু মেয়ে কেন নিজে বাড়ি ছাড়বে?

‘ তোকে মা ডেকেছে নিচে। ‘ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বললেন উনি। ধ্যান ছুটিয়ে সবকিছু গুছিয়ে আলমারিতে রাখলাম। নিচে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হবো তখনি পিছু ডাক ডেকে বললো সিয়াম ভাইয়া,

‘ আই থিংক ওই কড়া গলায় বলা ছেলেটা তোকে ভালোবাসে সিয়া! ‘

স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পায়ের নিচে শিরশির অনুভব হলো। এটা জানতাম আমি। একমাত্র আব্বু আমায় বলতো আমি নাকি সুন্দর। কেউ যদি মন দিয়ে দেখে, দেখতে পারবে আমার সৌন্দর্য! আর সেখানে সামি ডাকেই সুন্দরী বলে। অনেক সাহায্য করেছে ও আমায়। না চাইতেও। সিয়াম ভাইয়া একদিনেই বুঝে গেলো কি করে?

উনি উঠে পিছনে এসে দাড়ালেন আমার। বললেন,

‘ দেখলাম, আমি তোর হাসবেন্ড পরিচয় দেয়ার পর ওর মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো। ‘

কথা না বাড়িয়ে সোজা নিচে চলে আসলাম। উনি গম্ভীর! তবে বুঝদার মানুষ। এটুকু বুঝেছি!

_______

আধঘন্টা যাবৎ নিচে চেঁচামেচি হচ্ছে। আমি আর সিয়াম ভাই একদলে। আর বাড়ির প্রতিটা মানুষ আমাদের বিপক্ষে। তারা নাকি রিসিপশন পার্টি করেই ছাড়বে। আমি আর সিয়াম ভাইয়া রাজি নই তাই এমন চিল্লাচিল্লি। সিনথি একদম ভেজা চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। চোখে খুব আকুতি। যেন পার্টিটা হয়! সায়েম পায়ে পা তুলে ঝগড়া করছে ওনার সাথে। আমরা কিছুতেই রাজি নই। বসে বসে মামা,মামী দেখছে আমাদের তর্ক। বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। আত্মীয়রা সকলে চলে গেছে নিজ নিজ বাড়িতে। কোথথেকে ট্রে ভর্তি চা আর স্নাক্স নিয়ে আসলো জুঁই। বাড়িতে কাজ করে ও। অল্প বয়স। ছিচকাঁদুনে স্বরে বললো,

‘ এমন করতাছো ক্যান সিয়া আপা? রাজি হও। মেলা দিন হইলো কোন হইচই হয় না এ বাড়িত। সেই তো কত বছর আগে…’

বলে হঠাৎ থেমে গেলো জুঁই। আয়ু নিখোজ হওয়ার পর এ বাড়িতে অনুষ্ঠান হয় না। মূলত সিয়াম ভাইয়া হতে দেয় না। জুঁই এর কথা শেষ হওয়ার পরই সিয়াম ভাইয়া বলে উঠলো,

‘ জুঁই, যা এখান থেকে। ‘

মামা সিয়ামের কথার ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘ যাবে কেন ও? ঠিকিই তো বলেছে। এ বাড়িটা মরা মরা হয়ে যাচ্ছে। একটু আনন্দের দরকার। ‘

মামার উপরে একটা টু শব্দ করলেন না সিয়াম ভাইয়া। সায়েম উৎফুল্ল কন্ঠে বলে ওঠে,

‘ তাহলে অনুষ্ঠানটা হচ্ছে। তাইতো? ‘

এবার আমি বলতে লাগলাম। সাথে গলা মেলালো সিয়াম ভাইয়া। তোলপাড় চলছে। দুটি দলের কেউই হার মানতে রাজি নয়। অবশেষে আমরা হাড়লাম। তবে শর্ত থাকবে, আর সেটা হলো এখন নয়। আরও কয়েকদিন পর হবে রিসিপশন পার্টি। সিয়াম ভাইয়া খ্যান্ত হয়ে সোফায় বসলো।

‘ কাল তোরা তো ও বাড়িতে যাবি। গুছিয়ে রেখেছিস সবকিছু? ‘ বললো মামী। চোখদুটি চকচক করে উঠলো আমার। ও বাড়ি বলতে কি আমাদের বাড়ি? মামী সিয়াম ভাইয়ার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি আমার দিকে ফিরলেন। আমি কান্নাজড়িত হাসি হাসলাম। বুকে অলরেডি উথাল-পাতাল ঢেউয়ের খেলা আরম্ভ হয়েছে। বললাম,

‘ গুছায়নি। রাতে গুছাবো। ‘

রাতে বললেও তর সইলো না আমার। ছুটে চলে গেলাম রুমে। কিন্তু.. কিন্তু আমার তো লাগেজ নেই এখানে। কিসে গোছাবো কাপড়? এদিক ওদিক চোখ বুলিয়েও একটা ব্যাগ চোখে পড়লো না। কিছুক্ষণ বসে থেকে ভাবলাম, ‘ আমার তো ওখানে কাপড় আছেই। তাহলে টেনশন কিচ বাতকা? ‘

_____

সময় তখন দুপুর বারোটার কাছাকাছি। উত্তেজনায় হাত বারবার কয়লাকচলি চালাচ্ছি আমি। কপালে ঘাম জমছে। তাই ওড়নার বিচরন চলছে বারবার কপালে। সিয়াম ভাইয়া অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। হাতে ফোন, আর রোলনম্বর। ওয়েবসাইট এ বসে খুজবেন। বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। রেজাল্ট দেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লো। উত্তেজনা হাত পা মৃদু থেকেথেকে কাপছে আমার। কিন্তু রেজাল্ট বের হতেই পা অব্ধি মাথা পর্যন্ত নড়াচড়া বন্ধ করে দেন সিয়াম ভাইয়া। মুখশ্রীতে আধার নেমে আসে। আমার বুক ধুক করে উঠলো। অশ্রুসজল চোখে তাকালাম আমি। ফেল করলাম নাতো?

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here