আমি আসবই,পর্ব ১০,১১ অন্তিম পর্ব

0
2613

আমি আসবই,পর্ব ১০,১১ অন্তিম পর্ব
লেখিকাঃ সাইবা চৌধুরী
পর্ব ১০

অর্পিতা!
তুমি বাসায় থেকে নুরীর খেয়াল রাখবে।
আমরা কল করে কিছু না জানানো পর্যন্ত নুরীকে কোল থেকে সরাবে না।
অর্পিতা মাথা নেড়ে আরিকার কথায় সম্মতি জানায়।
হাসিবের দিকে তাকিয়ে আরিকা বলে,
রুমে গিয়ে দরকারী যা যা লাগবে বলে মনে হয় সাথে নিয়ে নাও।
বাকিটা আমি দেখছি!
আরিকার কথা অনুযায়ী হাসিব ও অর্পিতা উঠে নিজেদের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
দরজার কাছে যেতেই অর্পিতাকে ডাক দিয়ে আরিকা বলে,
-অর্পিতা!
যদি কখনো শোনো নুরী তোমাদের সন্তানই নয় তাহলে নিজেকে সামলাতে পারবে তো?
আরিকার কথা শুনে অর্পিতার বুকটা ধুক করে উঠলো। চোখে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে আরিকার দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
অর্পিতাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরিকা একটু হাসি দিলে বললো,
-ভয়ের কিছু নেই। আমি এমনিতেই বললাম।
এখন যাও তাড়াতাড়ি হাসিবকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করো।
আরিকার কথা শুনে অর্পিতা বড় একটা নিশ্বাস ফেলে রুমের দিকে রওনা দিলো।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। আরিকার পরবর্তী কথা যেন প্রাণ ঢেলে দিলো দেহে। কিন্তু অর্পিতার বুকটা এখনও অনেক জোরে জোরে কাঁপছে।
.
.
.
প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হতে ওদের প্রায় ৪ টা বেজে যায়।
অর্পিতা ও জোহরা বেগম মিলে তারাহুরো করে বেশকিছু খাবার রান্না করে দিয়ে দিয়েছে সাথে।
বের হওয়ার সময় হাসিব তার মা’কে সংক্ষেপে যতটুকু পারে বুঝিয়ে বলেছে। বিশেষ করে নুরী ও অর্পিতার উপর খেয়াল রাখতে বলে যায় সে ।
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে অর্পিতা বেশ অনেকক্ষণ ধরে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলো হাসিব।
চোখের কোণ বেয়ে ঝড়ে পড়েছিলো অজস্র অশ্রুবিন্দু।
নুরীকে রেখে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না হাসিবের। দরজার বাইরে থেকে আরিকার ডাক শুনে নুরীকে অর্পিতার কোলে দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যায় সে।
অর্পিতার চোখের দিকে তাকানোর মতো শক্তি হাসিবের নেই। সে জানে অর্পির কান্নারত চোখ, তার জন্য দূর্বলতা।
.
.
.
৮ ঘন্টা টানা গাড়ি চালিয়ে বিরক্তি চলে এসেছে হাসিবের।
সোজা হয়ে বসে থাকতে থাকতে পিঠটাও ধরে এসেছে। কিন্তু আরিকার কোন বিরক্তি নেই।
তৃষ্ণার্ত পাখি যেমন ছটফট করে পানির জন্য, ঠিক তেমনই ছটফট করছে আরিকা,
গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য।
মাঝপথে কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে জিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেও কোনো লাভ হয়নি।
হাসিবের কাছে বিষয়টি বেশ অস্বস্তিকর লাগছে।
একটা ফাঁকা রাস্তা দেখে হাসিব ব্রেক করে গাড়ি থামায়।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলে,
-কিভাবে পারিস তুই?
আমি তোর মতো রোবট না। আমার কষ্ট, ক্ষুধার অনুভূতি আছে।
আরিকা গাড়ি থেকে নেমে বিরক্তির সাথে হাসিবকে বলে,
-অলরেডি ১ টা বেজে গেছে হাসিব!
যত লেট করবো আমাদের ততোই সমস্যা। জঙ্গলটা কতো বিপদজনক সেটা তো জানিসই।
আচ্ছা! তোর ক্ষুধা লেগেছে তাই তো?
তুই পাশের সীটে বসে খাওয়াদাওয়া কর, আমি ড্রাইভ করছি।
আরিকার কথামতো হাসিব পাশের সীটে গিয়ে বসে।
.
.
জঙ্গল থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাকা রাস্তায় গাড়ি থামায় আরিকা। বাকি পথ
এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে।
জঙ্গলটা বেশিদূরে না হলেও পথটা খুব খারাপ।
ছোট ছোট ঝোপঝাড় ও নানারকম বিষাক্ত লতাপাতা স্তুপ হয়ে আছে।
যদিও আরিকা গুগলে দেখেছে এ জঙ্গলে কোনো পোকামাকড় বা জীবজন্তু নেই, তবে এটা যে ১০০% সত্যি তার গ্যারান্টি কি!
হাসিবের কাধে বড় একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে দিয়ে,হাতে বড় একটা ছুরি নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো দু’জন।
ছুরি দিয়ে ঝোপঝাড় গুলো কেটে আলাদা করতে করতে সামনে আগাতো লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পরে ধীরে ধীরে তারা জঙ্গলে প্রবেশ করলো।
জঙ্গলে ঢুকতেই এক ঝাঁক অন্ধকার এসে চোখে লাগলো তাদের।
অন্ধকার চোখে সয়ে এলে আশেপাশে তাকিয়ে তারা দেখতে পায়, জঙ্গলের ভেতর সারি সারি লম্বা লম্বা গাছ।
ভেতরেও অনেক ঝোপঝাড় তবে বাইরের তুলনায় কম।
জঙ্গলের ভেতরটা এখন সন্ধ্যার মতো।
তবে একটা কথা সত্যি, এখানে কোনো জীবজন্তু নেই। ভেতরটা খুব বেশি শীতল।
আরিকা ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে ধীরে ধীরে সামনে আগাতে থাকে অর্পিতার স্বপ্ন অনুযায়ী সেই ছোট্ট ঘরটার খোঁজে।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেও কোনো ধরণের ঘর তারা খুঁজে পায় না।
আচমকা আরিকা কেঁপে ওঠে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দে।
সাথে সাথে নাকে ভেসে আসে উদ্ভট একটা বিশ্রী গন্ধও। হাসিব হাত দিয়ে নাক চেপে ধরতে যাবে ঠিক তখন আরিকা ইশারা দিয়ে বারণ করে দেয়।
চোখের ইশারায় আরিকা নিজেদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া ফুটিয়ে তুলতে নিষেধ করে।
টর্চের মৃদু আলোতে হাসিব সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারে।
অগত্যা তীব্র গন্ধ সহ্য করেই তারা বাচ্চার কান্নাকে অনুসরণ করে আগাতে থাকে।
বেশ কিছুদুর যেতেই তারা ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর দেখতে পায় সামনে।
খুশিমনে ঘরটার দিকে পা বাড়াতেই বিশ্রী গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে,চারপাশ থেকে শো শো করে বাতাস ছুটে আসে তাদের দিকে।
আরিকা চিৎকার করে কিছু মন্ত্র পড়তে শুরু করে।
মন্ত্র পড়াকালীন সময়ে বাতাসটা তাদের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে।
মন্ত্র পাঠ করতে করতে হাসিবের হাত ধরে সে কুঁড়ে ঘরের দিকে দৌড় দেয়।
পেছন পেছন ছুটে যায় তীব্র বাতাসের বেগও।
দৌড়াতে দৌড়াতে দু’জনে কুঁড়ে ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
জঙ্গলের ভেতরে থাকা নানারকম কাঁটাযুক্ত গাছে আরিকা ও হাসিবের শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে গেছে।
আরিকার পায়ের একটা ক্ষত জায়গা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।
কিন্তু এসব দিকে তাদের কারও খেয়াল নেই।
দু’জনে মিলে সন্তর্পণে কুঁড়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।
ঘরটার ভেতরে ঢুকতেই আরিকার হাতের টর্চ লাইটটা বন্ধ হয়ে যায়।
সাথে সাথে ঘরের মাঝখানে টিপটিপ করে জ্বলে ওঠে একটা মোমবাতি।
মোমবাতিটির আলো এতোটাই স্বল্প যে শুধু আলোটা বাদে আশেপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আরিকা ও হাসিব একে অন্যের হাত চেপে ধরলো।
দু’জনের মনেই সীমাহীন ভয় বাসা বেঁধেছে।
তবুও মনে সাহস সঞ্চার করে আরিকা বললো,
-ভেতরে কেউ আছেন?
আমরা একটা বিপদে পরে এখানে এসেছি।
আরিকার কথা শেষ হতে না হতেই একটা গম্ভীর কন্ঠ তাদের কানে ভেসে এলো,
-সব রহস্য সমাধানের পথ সহজ না।
নুরী কোনো সাধারণ মানুষ নয়। অর্পিতার গর্ভে পৃথিবীতে আসাও একটা রহস্যকুন্ডলী। নুরী এক শুভ শক্তির প্রতিক। তবে এটা স্থায়ী না। নুরীর মাঝে শুভ শক্তি অশুভ শক্তি দুই ই বিদ্যমান।
তবে যদি শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাও অনেক বড় প্রতিদান দিতে হবে।
পরীক্ষা হবে সাহসের, দিতে হবে বুদ্ধির পরিচয়।
এসব কথার মাঝে হঠাৎই হালকা একটা বাতাসে মোমবাতিটি নিভে গেলো।
সাথে সাথে ভেসে এলো মৃদু একটা কন্ঠস্বর।
আরিকা ঘরের মাঝে দুটো অস্তিত্বের উপস্থিতি টের পেলো।
মৃদুস্বরে দ্বিতীয় কন্ঠস্বর বললো,
-নুরীর সম্পর্কে যা জানতে চাও আমাকে বলো,
ওর কথা শুনো না ও কখনো তোমাদের সৎ বুদ্ধি দেবে না।
নুরীর থেকে যদি খারাপ শক্তি চিরতরে সরাতে চাও তাহলে আমি যেটা বলছি সেটা করো,
-ঘরটার উল্টোদিকে যাও।
সোজা কিছুক্ষণ হাঁটার পরে মোটা একটা গাছ দেখতে পাবে, তার আশেপাশেই পাবে দুইটা ছোট গাছ।
একটার রঙ বেগুনি আরেকটার রঙ নীল।
তুমি নীল রঙের গাছটি তুলে সাথে নিবে এবং বেগুনি রঙের গাছটি তুলে মাটিচাপা দিয়ে দিবে।
তখনই অপর গম্ভীর কন্ঠটা আবার বলে উঠলো,
-না না একদম না নীল গাছটি বাসায় নিয়ে গেলে এটা নুরীর জন্য ঘোর বিপদ।
নীল গাছটা ছিড়ে মাটিচাপা দিয়ে বেগুনি গাছটি বাসায় নিয়ে যাবে।
গাছের পাতার রস নুরীকে খাওয়াবে আর গাছটি রোপণ করে দেবে বাসার ছাঁদেই।
এভাবে দুই কন্ঠস্বরের মাঝে বিশাল এক দ্বন্দ্ব বেঁধে গেলো।
আরিকা বুঝতে পারলো না,এদের দু’জনের মাঝে কে সত্য বলছে। বুঝতে হলে সময় নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
আরিকা তাদের কিছু না বলে হাসিবকে নিয়ে দ্রুত ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে গেলো।
কুঁড়ে ঘরের উল্টোদিকে দু’জনেই খুব দ্রুত পা চালাচ্ছে।
হঠাৎ কিছু পিচ্ছিল জিনিসের উপর পা পরে আরিকা ধপাস করে পড়ে গেলো।
উপর থেকে টপটপ করে তরল জাতীয় কিছু মাথার উপর পড়লো।
বিশ্রী গন্ধে ওখানেই বমি করে দেয় আরিকা।
হাসিব গায়ে তরল পদার্থটি পড়ার পরে উপরের দিকে লাইট মারতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠে।
আরিকা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো,
-প্রতিটি গাছে ঝুলছে অর্ধগলিত অনেকগুলো দেহ।
সেগুলোর শরীর থেকেই দুর্গন্ধময় রক্ত ও পঁচা মাংস গলে গলে পড়ছে।
আরিকা বুঝতে পারলো সে এখন পচা রক্ত মাংসের উপর বসে আছে।
হঠাৎ উপর থেকে একটা বিকট হাসির শব্দ ভেসে এলো।
ভয়ে পুরো শরীর কেঁপে উঠলো দু’জনের।
.
.
.
চলবে।

আমি আসবই
১১ অন্তিম পর্ব
লেখিকাঃ সাইবা চৌধুরী

আরিকা তাদের কিছু না বলে হাসিবকে নিয়ে দ্রুত ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে গেলো।
কুঁড়ে ঘরের উল্টোদিকে দু’জনেই খুব দ্রুত পা চালাচ্ছে।
হঠাৎ কিছু পিচ্ছিল জিনিসের উপর পা পরে আরিকা ধপাস করে পড়ে গেলো।
উপর থেকে টপটপ করে তরল জাতীয় কিছু মাথার উপর পড়লো।
বিশ্রী গন্ধে ওখানেই বমি করে দেয় আরিকা।
হাসিব গায়ে তরল পদার্থটি পড়ার পরে উপরের দিকে লাইট মারতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠে।
আরিকা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো,
-প্রতিটি গাছে ঝুলছে অর্ধগলিত অনেকগুলো দেহ।
সেগুলোর শরীর থেকেই দুর্গন্ধময় রক্ত ও পঁচা মাংস গলে গলে পড়ছে।
আরিকা বুঝতে পারলো সে এখন পচা রক্ত মাংসের উপর বসে আছে।
হঠাৎ উপর থেকে একটা বিকট হাসির শব্দ ভেসে এলো।
ভয়ে পুরো শরীর কেঁপে উঠলো দু’জনের।
আরিকা হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলে,
-যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে প্রস্থান করতে হবে।
সামনের দিকে দৌড় দাও।
কথাটা বলে আরিকা উঠে দৌড় দিতেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায় বমির উপড়ে।
ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো তার।
আবারও এগোতে গিয়ে সে বুঝতে পারলো কিছু একটা তার পা টেনে ধরে আছে।
ভয়ে ভয়ে পায়ের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলো আরিকা।
হাসিব তার দিকে লাইট মারতেই দেখতে পেলো, একটা মৃতদেহ তার পা টেনে ধরে রেখেছে।
হাসিব এবং আরিকা দু’জনে মিলে অনেক চেষ্টা করলো ছাড়ানোর জন্য।
সমস্ত শক্তি দিয়ে হ্যাঁচকা টান দিতেই লাশটির হাতসহ ছুটে চলে আসে। দু’জনে
কোনোরকমে চেষ্টা করে লাশটির থেকে মুক্ত হয় তারা।
কিন্তু জোর করে ছাড়াতে গিয়ে হাসিবের হাতে লেগে যায় লাশের পঁচা গলা মাংস।
পকেট থেকে টিস্যু বের করে কোনোরকমে নিজেদের পরিষ্কার করে আবার রওনা দেয় সেই গাছগুলো খোঁজার উদ্দেশ্যে।
কিছুদুর আগাতে হঠাৎ কিছু গাছের মোটা শিকড় এসে হাসিবকে পেঁচিয়ে ফেলে।
শত চেষ্টা করেও হাসিবকে ছাড়াতে ব্যর্থ আরিকা।
অবশেষে ব্যাগ থেকে বড় একটা চাকু বের করে শিকড়গুলো কাটতে শুরু করে।
অদ্ভুত ভাবে চাকুর প্রতিটি আঘাতে শিকড় থেকে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করে।
আরিকা এমন কিছুর জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েই ছিলো।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে হাসিবকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় আরিকা।
দু’জনে আবারও দৌড়াতে থাকে সামনের দিকে।
কিছুদূর গিয়ে তারা দেখতে পায় সামনের বেশ কিছু জায়গা জুড়ে নীল ও বেগুনি রঙের আলোর ঝলকানি।
আরিকার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
হাসিবকে বলে,
আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি হাসিব!
সামনে দেখো আমি যদি ভুল না হই সেই গাছ দুটি থেকেই এমন আলো ছড়াচ্ছে।
হাস্যোজ্ব্যল মুখে দু’জনে আলো অনুসরণ করে এগিয়ে যায়।
গাছ দুটোর সামনে পৌঁছে আরিকা দ্বিধায় ডুবে যায়।
বুঝে উঠতে পারছে না কার কথা সঠিক হতে পারে।
একটা ভুল সিদ্ধান্ত অনেকগুলো জীবনে দূর্যোগ এনে দিতে পারে।
বেশ অনেকক্ষণ ভেবে আরিকা বেগুনি গাছটা ধরে টান দিলো।
গাছটা ধরার সাথে সাথে হাত পুরে যায় আরিকার।
এ যেন জ্বলন্ত আগুনের কয়লা।
হাতের ভিতর অস্বাভাবিক যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার।
ছেড়ে দিতে গিয়েও টান দিয়ে উঠিয়ে ফেললো গাছটি। গাছটি তোলার সাথে সাথে হাতের জ্বালাপোড়াও অনেকটা কমে গেল আরিকার।
হাসিবের উদ্দেশ্যে বলে,
-নীল গাছটা তুলে ছিড়ে ফেলো এবং মাটিতে পুঁতে দাও।
তবে খুব সাবধানে।
আরিকার কথামতো হাসিব নীল গাছটি তুলে ছিড়ে ফেলে দেয়।
কাজ শেষে
দু’জনে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে বাইরে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে।
এদিক ওদিকে ছোটাছুটির করে বেশ অনেকক্ষণ পরে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পায় তারা।
বের হওয়ার সময় তাদের নাকে এসে লাগে সেই অদ্ভুত বিশ্রী গন্ধ সাথে বিকট হাসি।
.
.
.
অবশেষে তারা ভয়ানক জঙ্গল থেকে বের হয়ে গাড়ির কাছে এসে পৌঁছায়।
তারা ঠিক কতক্ষণ দৌড়েছে তার হিসেব নেই।
তবে আসার সময় তেমন কোনো বিপদে পড়তে হয়নি তাঁদের।
গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ভেঙে পড়ে দু’জনে।
মনে হচ্ছে, না জানি কতোদিন তারা না খেয়ে আছে।
অথচ জঙ্গলের ভেতরে থাকতে খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলেই গেছিলো তারা।
হাসিব গাড়ির ভেতর থেকে তাড়াহুড়ো করে খাবারগুলো বের করে।
খাবারের বক্স খুলতেই বক্সসহ দুরে ছুড়ে ফেলে দেয়।
খাবারে কিলবিল করছে বড় বড় পোঁকা।
পাউরুটি বের করেও দেখে সেগুলো পঁচে গেছে।
এতো তাড়াতাড়ি খাবার নষ্ট হওয়ার কারণ তারা কেউ বুঝলো না।
হাসিব পকেট থেকে ফোন বের করে অর্পিতাকে কল করে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য।
কিন্তু ফোন বের করে দেখে ফোনটাও অফ।
অগত্যা শুধু পানি খেয়েই রওনা দেয় বাসার উদ্দেশ্যে।
.
.
.
কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে পথিমধ্যে নেমে খাওয়াদাওয়া সেড়ে নেয় দু’জন।
অতঃপর আবারও গাড়ি চালাতে শুরু করে হাসিব।
দু’জনেই খুব ক্লান্ত।
আরিকা ক্লান্ত শরীরে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
ঘুমের ব্যাঘ্যাত ঘটিয়ে হাসিব বলে,
-আরিকা তুই কিভাবে বুঝলি বেগুনি গাছটাই আমাদের তুলতে হবে?
আমি তো কনফিউজড হয়ে গেছিলাম একদম।
আরিকা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
-কুঁড়েঘরে প্রথমে যিনি কথা বলছিলেন সেটাই সঠিক ছিলো।
পরে যেই জন আসলো সে আর কেউ না,
নুরীকে যেই কালো শক্তিটা ডিস্টার্ব করে সেটাই।
দেখলে না!
আসার সাথে সাথে মোমবাতিটা কিভাবে নিভে গেল!
এটা হচ্ছে অশুভ শক্তির সংকেত।
বাকি প্রশ্নগুলো জমিয়ে রাখো, বাসায় গেলে করিও।
আমি এখন ঘুমাবো।
হাসিব আর কোনো কথা বাড়ায় না।
.
.
.
.
আরিকার ঘুম ভাঙে হাসিবের ডাকে।
চোখ মেলে দেখে চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে।
জিনিসপত্র সব নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠে।
বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পরে রিতা এসে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খুলে দিয়ে হাসিব ও আরিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বলে,
-ভাইজান! আপনারা বাইচ্চা আছেন?
কতোদিন ধইরা আপনাদের খোঁজখবর নাই।
ভাবি তো আপনাগো চিন্তায় চিন্তায় একদম
শেষ।
খালাম্মা! ও খালাম্মা দেহেন হাসিব ভাইজান আইছে।
রিতার কথা শুনে বেশ অবাক হয় আরিকা ও হাসিব। কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে
দু’জনের মনেই একটা প্রশ্ন,
এতোদিন কোথায় ছিলেন মানে!
আমরা তো গেলাম মাত্র ১ দিন!
.
.
রিতার ডাক শুনে জোহরা বেগম ও হানিফ সাহেব এগিয়ে আসেন।
হাসিবকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন জোহরা বেগম।
হানিফ সাহেবও তখন পুরোপুরি সুস্থ।
কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না হাসিব।
আরিকার কাছে কোনোকিছুই ঠিক লাগছে না।
সবার পাশ কেটে সে চলে যায় অর্পিতা ও নুরীর কাছে।
রুমে গিয়ে আরিকা থমকে দাঁড়ায়।
এ কি অবস্থা অর্পিতার!
চেহারা একদম নষ্ট হয়ে গেছে, হাতে পায়ে নানান জায়গায় ব্যান্ডেজ করা।
খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে অর্পিতা।
ধীরে ধীরে অর্পিতার কাছে গিয়ে বসে আরিকা।
নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিতেই অর্পিতা চোখ মেলে তাকায়।
তার পাশে বসা আরিকাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অর্পিতা।
অর্পিতাকে স্বান্তনা দিয়ে কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করে।
কান্না থামিয়ে অর্পিতা বলে,
-টানা ১০ দিন হয়ে গেছে তোমরা বাসা থেকে বের হয়েছো।
এরমাঝে তোমাদের কোনো খোঁজখবরই পাইনি।
কতোবার কল দিয়েছি কিন্তু ফোন বন্ধ দু’জনেরই।
ভেবেছিলাম তোমরা হয়ত ওই জঙ্গলে বিপদে পড়েছো।
তোমরা হয়ত আর পৃথিবীতে নেই।
অর্পিতার কথা শুনে বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় আরিকার।
জঙ্গলের ভেতর ওইটুকু সময়ে বাহিরে ১০ দিন কেটে গেছে!
এটা অবশ্য অবাক হওয়ার মতোই কথা।
এসব চিন্তা দূরে ফেলে এখন আরিকা বলে,
-আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে।
আমরা সুস্থভাবে ফিরতে পেরেছি এটাই অনেক।
যদিও অভিজ্ঞতা খুবই বাজে ছিলো।
কিন্তু আমরা আমাদের কাজে সফল।
কথার মাঝে রুমে প্রবেশ করে হাসিব।
-এসব কথা পরে ফ্রী হয়ে বলা যাবে।
এখন বলো আমার সোনামণি নুরী কোথায়?
হাসিবের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে অর্পিতা। টপটপ করে পানি পড়তে থাকে চোখ থেকে।
অর্পিতাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে বুকটা ধুক করে ওঠে হাসিবের।
জোরে বলে ওঠে,
বলো অর্পিতা আমার নুরী কোথায়!
হাসিবের চিৎকারে কেঁপে ওঠে অর্পিতা।
শব্দ করে কান্না করে দিয়ে বলে,
-আমাকে ক্ষমা করে দাও হাসিব।
আমি নুরীকে সামলে রাখতে পারিনি।
সন্ধ্যার সময়ই অনেকগুলো কালো ছায়ার আগমন ঘটে রুমে হুট করেই।
অনেক শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিলাম নুরীকে।
কিন্তু আমি ওদের সাথে পারিনি।
দেখো আমার শরীরের কি হাল করেছে।
তবুও আমি হাল ছাড়িনি কিন্তু হঠাৎ কি হলো আমি নিজেও বুঝলাম না। কখন যে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম জানিনা।
চোখ খুলে দেখি নুরী আমার বুকে নেই হাসিব।

অর্পিতার কথা শুনে হাসিব ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে।
মন খারাপ হয়ে যায় আরিকারও।
হাসিবের উদ্দেশ্যে বলে,

-কিন্তু এমন হওয়ার তো কথা নয়!
আমরা তো ঠিকমতই সব কাজ সম্পন্ন করেছি।
বেগুনি গাছটা তুলে নীলটা মাটি চাপাও দেওয়া হয়েছে তবুও এমন হওয়ার কারণ কি!
-আমার দ্বারা বিরাট বড় ভুল হয়ে গেছে আরিকা!
আমি নীল গাছটা তুলে ছিড়ে ফেলেছি ঠিকই কিন্তু মাটিচাপা দিতে ভুলে গিয়েছি তাড়াহুড়োয়।
এই ভুলের জন্যই হয়ত আমাদের নুরী খারাপ শক্তির দখলে চলে গেছে।
কথাগুলো বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে হাসিব ও অর্পিতা দু’জনেই।
আরিকার ভিষণ রাগ হয় হাসিবের উপর।
রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
-এতোটুকুই তো কাজ দিয়েছিলাম তোমাকে!
সেটাও করতে পারলে না ঠিকমতো?
এতো কষ্ট করে লাভটা হলো কি আমাদের?
এর থেকে ভালো হতো যদি আমি আমার টিম নিয়ে কাজটা করতাম।
কথাগুলো বলে হনহন করে হেঁটে বের হয়ে যায় আরিকা।
.
.
.
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে আরিকা অর্পিতার রুমে ফিরে আসে।
রুমে ঢুকে দেখে দু’জনেই পূর্বের জায়গায় বসে আছে মনমরা করে।
আরিকা হাসিবকে টেনে তুলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে অর্পিতার কাছে বসে বলে,
-সীমাহীন শুভ শক্তির প্রতিক নুরী।
১০ মাস পেটে রেখেছো তাকে, এখন সে তোমারই মেয়ে।
তোমার থেকে কে কেঁড়ে নেবে ওকে?
তাছাড়া আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ নই।
নীল গাছটি মাটি চাপা না দেওয়ার কারণে শক্তিশালী একটা খারাপ শক্তি মুক্ত হলেও এর ঔষধও কিন্তু আমাদেরই কাছে।
আল্লাহর উপর ভরসা রাখো অর্পিতা!
দেখবে শুভ শক্তির জয় হবেই।
নুরীকে যে ফিরে আসতেই হবে!
আমি জানি, ও আসবেই।
.
.
.
.
এভাবে কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে নুরীর কথা মনে করে কান্না করতে থাকে অর্পিতা।
হঠাৎ রুম ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
দরজার কাছ থেকে একটা সাদা আলো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার দিকে।
আলোর ভেতরে ফুটে ওঠে ১০-১২ বছরের একটা সুন্দর মেয়ের চেহারা।
আলোর ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে অর্পিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
-কেঁদো না মা!
তুমি কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়।
তুমি শুধু একটু অপেক্ষা করো,আমি তোমার কাছে ফিরে আসবই।
.
.
.
সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here