আমি আসবই,পর্ব-২
লেখিকা-saaiba Chowdhury
সকাল সকাল এমন অনাকাঙ্ক্ষিত খবর পেয়ে অর্পিতার বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে।
এরমধ্যে হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে খিলখিল করে একটা বাচ্চার মিষ্টি হাসির শব্দ।
আশেপাশে তাকিয়ে সে কাউকে দেখতে পায় না।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানার উপর বসে পড়ে।
অর্পিতা বুঝতে পারে না হাসির শব্দটা কি বাস্তব নাকি তার মস্তিষ্কের কোনো ভ্রম।
শক্ত করে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে অনেকক্ষণ।
কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ব্যাথাটা কমে যায়।
অর্পিতা ফোন হাতে নিয়ে আবারও হাসিবের নাম্বারে ডায়েল করে।
ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই অর্পিতা বলে,
-হাসিব! শিনশিন হাসপাতালে তো কয়েকজন গাইনী ডাক্তার বসেন তাই না!
তুমি রেডি হয়ে দ্রুত আমার বাসার সামনে আসো।
আমি আজই অসম্পূর্ণ কাজটি সেড়ে ফেলতে চাই।
যত দেরি করবো ততোই রিস্ক সো আমি আর এই বিষয়ে হেয়ালীপনা করতে চাচ্ছি না। তাছাড়া আমার কাছে কেন যেন ঠিক লাগছে না কোনোকিছুই।
অর্পিতার কথার প্রতি উত্তরে হাসিব বলে,
-আচ্ছা ঠিক আছ তুমি রেডি হও, আমি ফোনে সব ফাইনাল করে রাখছি। আজই তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
হাসিবের সাথে কথা শেষ করে লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নেয় অর্পিতা।
ফোনটা বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
.
.
.
প্রায় ৪০ মিনিট পর হাসিব অর্পিতার বাসার নিচে এসে তাকে কল দেয়।
কল পেয়ে অর্পিতা তাড়াতাড়ি নিচে চলে যায়।
অর্পিতাকে দেখে হাসিব মুগ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসিবকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্পিতা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-কি হয়েছে তোমার আজ! এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকবে নাকি গাড়িতে উঠে বসতে দিবে।
অর্পিতার কথা শুনে হাসিব সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে,
-আমরা হসপিটালে যাচ্ছি অর্পি!
হসপিটালে যাওয়ার আগে এতো মেকআপ করা কি খুব প্রয়োজন? যদিও তোমাকে আজ মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে।
হাসিবের কথা শুনে বেশ বিরক্ত হয়ে অর্পি বলে,
-এমন পরিস্থিতিতে ঠাট্টা কিন্তু বড্ড বেমানান হাসিব। তোমার কি মনে হয় আমার এখন মেকআপ করার কোনোপ্রকারের ইচ্ছা বা মুড আমার আছে!
হাসিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে অর্পি।
হাসিব ও ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে অর্পির পাশে গিয়ে বসে।
মুখ টিপে হাসতে থাকে হাসিব। হাসিবকে এভাবে হাসতে দেখে এবার বেশ রেগে যায় অর্পিতা।
রাগান্বিত স্বরে বলে,
-সমস্যা কি তোমার হাসিব। এভাবে মুখ টিপে টিপে হাসছো কেন!
-না আসলে একটা জিনিস ভাবছি। মেয়েরা মেকআপ করলে বা সৌন্দর্যের জন্য কিছু ব্যবহার করলে সেটা স্বীকার করতে চায় না কেন?
সবার থেকে লুকিয়ে কি লাভ! আর তুমি তো তোমার হাসবেন্ডের থেকেই লুকাচ্ছো।
হাসিবের কথা শুনে এবার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে অর্পিতা, কিছু বলতে যাবে তখনই হাসিব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-ওয়েট ওয়েট কিছু বলার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার করো,তুমি যদি মুখে কিছু না দাও, তাহলে তোমার মুখের ব্রণের দাগগুলো গেলো কই?
আর তুমি তো এতো উজ্জ্বল ফর্সা ছিলে না তাহলে একদিনের ভেতরে এতো পরিবর্তন কিভাবে হলো বলো!
হাসিবের কথা শুনে অর্পিতা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।
ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করে নিজের চেহারা দেখে অবাক হয়ে যায় সে।
তার মুখের দীর্ঘদিনের ব্রণের দাগগুলো নিমিষেই মিলিয়ে গেছে। একদম ফ্রেশ কাঁচের মতো স্কিন হয়ে গেছে তার। আয়না সরিয়ে হাত ও পায়ের দিকে তাকায় অর্পিতা। মুখসহ হাত পা ও অনেক ফর্সা হয়ে গেছে,মাথার চুলগুলো বেশ খানিকটা লম্বা হয়ে গেছে। অর্পিতার নিজের কাছে নিজেকেই অপরূপ সুন্দরী লাগছে। অথচ একটু আগেও এমন পরিবর্তন সে লক্ষ্য করেনি।
নিজের এমন পরিবর্তন নিয়ে অন্য সময় হলে হয়ত অনেক চিন্তা মাথায় আসতো কিন্তু এখন দুশ্চিন্তা থাকায় এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না অর্পিতা।
তবে হঠাৎ চেহারা এমন মোহনীয় হয়ে যাওয়া নিয়ে বিস্ময়ের সাথে মনে মনে বেশ খুশি হয় সে।
হাসিবের সাথে এই বিষয়ে তর্ক না করে অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে থাকে।
.
.
.
হাসিব ও অর্পি দুজনেই নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে নিজেদের মাঝে। ড্রাইভার ফাঁকা রাস্তা পেয়ে আপন মনে ধীরে ধীরে ড্রাইভ করে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে।
আজ অর্পির মনটা অনেক ফুরফুরে। যেভাবেই হোক আজ নিজ উদ্দেশ্যে সফল সে হবেই।
সব দুশ্চিন্তাকে ছুটি দিয়ে আবারও ফিরে যাবে আগের জায়গায়। নিজের স্বপ্ন পাড়ি দেওয়ার মাঝে আর কোনো বাঁধাই থাকবে না।
কিন্তু ভাবনা আর বাস্তব এক হওয়া যে খুব কঠিন।
অর্পি মনে মনে যাই ভাবুক নিয়তির চাওয়া বোধ হয় ভিন্ন কিছুই ছিলো।
কথা বলার মাঝে হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন এক দমকা হাওয়া এলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনজন মানুষসহ অর্পিতাদের গাড়িটা উল্টে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে যায়।
গাড়ি ভেঙেচুরে অনেক অংশ আলাদা হয়ে এক এক জায়গায় পড়ে থাকে।
অর্পিতা ভয়ে একটা জোরে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
আশপাশ থেকে দৌড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে সবাই।
এমন ফাঁকা রাস্তায় এতো মারাত্মক এক্সিডেন্ট দেখে সবাই বেশ অবাক হয়। সবার মনে একটাই প্রশ্ন,আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কোনো গাড়ির দেখাও নেই, না আছে রাস্তায় কোনো বাঁধা! তাহলে সামান্য একটু বাতাসে কিভাবে এতো ভয়ংকর এক্সিডেন্ট ঘটতে পারে!
.
.
.
লোকজন এগিয়ে গিয়ে সতর্কতার সহিত ড্রাইভারকে বের করে।
ড্রাইভারের পুরো শরীর রক্তে ভেজা, গাড়ির জানালার গ্লাস ভেঙে চোয়ালের ভেতরে ঢুকে গেছে।
জীবিত আছে কিনা বলা মুশকিল।
ইতিমধ্যে এম্বুলেন্সও চলে এসেছে ড্রাইভারকে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে তারা ছুটলো অপরজনকে উদ্ধার করতে।
কিন্তু গাড়ির কাছে গিয়েই তারা একটা মেয়ের কান্নারত কন্ঠ শুনতে পেলো।
গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে একজন মেয়েকে দেখতে পেয়ে সবাই ধরাধরি করে তাকে বের করে আনে।
কিন্তু অর্পিকে বের করে আনার পরে সবাই অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে।
অর্পির গায়ে রক্তের একটা ছিটেফোঁটাও নেই কোনো আঘাত তো দূরের কথা। কিন্তু এতো মারাত্মক একটা এক্সিডেন্টে এমন হওয়ার কোনো চান্সই ছিলো না। অর্পিকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্য ফ্রেশ হয়ে মেয়েটি হয়ত এখানে এসেছে।
-দয়া করে আমার হাসবেন্ডকে বাঁচান।
ও গাড়ির ভেতরেই আছে অনেক বাজেভাবে আঘাত পেয়েছে আপনারা একটু তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ।
অর্পির কথায় ঘোর কাটে তাদের।
পরবর্তীতে দেরি না করে সবাই মিলে গাড়ি থেকে বের করে হাসিবকে।
কিন্তু হাসিবের অবস্থা খুবই খারাপ। মাথার পেছন দিকের মাংস উঠে গেছে।
পায়ের অনেকখানি মাংস কেটে গেছে। রক্তে পুরো শরীর মাখামাখি।
হাসিবের এমন অবস্থা দেখে অর্পি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
সবাই মিলে ধরাধরি করে এম্বুলেন্সে তুলে দিলো হাসিবকে।
হাসিবের সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো অর্পিতাও।
.
.
.
হাসিবকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয়।
মা বাবার একমাত্র সন্তান হাসিব। দু’জনেই ইতালি থাকে,হাসিবকে জোর করা সত্যেও নিতে পারেনি দেশ থেকে। তাই এমন কঠিন সময়ে অর্পিতা খুব একা পড়ে যায়।
ডাক্তার জানান প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, এবং মাথার ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
শীঘ্রই যদি অপারেশন করে সেটা বের করা না হয় ,এর পরিণতি খুব খারাপ হতে পারে।
হতে পারে হাসিব অনির্দিষ্টকালের জন্য কোমায় চলে যাবে অথবা হতে পারে মৃত্যুও।
ডাক্তারের কথা শুনে অর্পিতার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। হাসিব তার একমাত্র সম্বল।
তাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতেও পারে না অর্পিতা।
হাসিবের রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ হওয়ায় সহজেই রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায়, কিন্তু ডাক্তার জানিয়েছেন, অপারেশনের জন্য ৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। অর্পিতা তাই দেরি না করে ব্যাংকের দিকে রওনা দেয়।
এতো অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাংকের ভীড় ঠেলে একাউন্ট থেকে টাকা তুলে আনা এক প্রকারের যুদ্ধের মতো৷
কিন্তু যতদ্রুত সম্ভব সবটা ম্যানেজ করতেই হবে।
তাই বেশি না ভেবে একটা ট্যাক্সি করে অর্পিতা রওনা হয় ব্যাংকের উদ্দেশ্যে।
.
.
.
টানা তিনঘণ্টা পরে অর্পিতা ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারে। ওদিকে হাসিবের অবস্থাও বেগতিক।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ব্যাগে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যায় সে।
তাড়াহুড়োয় সে একদমই লক্ষ্য করে না যে, শুরু থেকেই দু’টো লোক তাকে সন্তর্পণে অনুসরণ করছে।
অর্পিতা একটা ট্যাক্সি ঠিক করে গাড়িতে উঠে বসার সময় একটা মাস্ক পরিহিত লোক ছোঁ মেরে হাত থেকে ব্যাগটি কেড়ে নিয়ে দৌড়ে একটা বাইকে উঠে বসে।
বেগ সামলাতে না পেরে অর্পিতা রাস্তার মাঝে পড়ে যায়। হাতের কনুইয়ের দিক থেকে অনেকখানি চামড়া উঠে যায়। গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে সেখান থেকে কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। ছিনতাইকারীর বাইকের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,কেউ আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ। আমার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য এই মুহূর্তে টাকাটার খুব দরকার।
কিন্তু নির্বোধ লোকেরা কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো না বরং অনেকেই ফোন বের করে ভিডিও করতে ব্যস্ত।
দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে অর্পিতার।
হঠাৎ বিকট একটা শব্দে সবাই কেঁপে ওঠে।
সামনের দিকে তাকিয়ে সবাই দেখতে পেলো,ছিনতাইকারীদের বাইকটা ব্লাস্ট হয়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। টাকার ব্যাগটি ছিটকে দূরে পড়ে আছে।
ছিনতাইকারীর শরীরেও আগুন লেগে গেছে।
জ্বলন্ত শরীর নিয়ে তারা করছে একটু বাঁচার আকুতি।
তাদের ভয়ানক চিৎকারে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সবার। অর্পিতা সময় নষ্ট না করে দৌড়ে টাকার ব্যাগটি নিয়ে এসে ট্যাক্সিতে বসে পরে।
ছিনতাইকারীদের আর্তনাদের সাথে বাতাসে মিলে যায় একটা বাচ্চার মিষ্টি হাসির শব্দ।
সেটা কেউ কর্ণপাতও করে না।
.
.
.
.
চলবে….